গাপ্পুনামা
আজ বিকেলে গাপ্পুকে বললাম – ছাদে যাবি ? শুনেই চার হাত পা তুলে দুটো ডিগবাজি খেয়ে নিল। পনের বছরের গাপ্পুর ঘর ছাদের পাশে হলেও আজ পর্যন্ত কোনদিন ছাদে যায়নি। রোজ ছেলেটাকে দেখতাম যখন ছাদে ঘুরি, করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, ভাল করে দেখলেই বোঝা যায় কত না’বলা কথা লুকিয়ে আছে ওই চোখদুটোতে।যদিও আমাকে ভয় পায় তবুও মাঝে মাঝে খুব অবাধ্য হয়ে ওঠে, একটা কথা শুনবে না, তখন ওর মন যা চাইবে তাইই করবে। তার ওপর ওর ছিট্টুপনা আছে। ভয় পাই, যদি ছাদে এসে আনন্দের চোটে কিছু বেফাঁস করে বসে , হ্যাপা তো আমার । গাপ্পু কথাটা শুনে এমন ভাবে তাকাল যেন স্বয়ং ঈশ্বর ওর সামনে দাঁড়িয়ে। ওর তুতো বোন মুন্নি মানে মুনমুন কাছেই ছিল , বলে উঠল — নিয়ে চল মামা, বলদটা একটু জগৎকে চিনতে শিখুক। মুন্নির মাথাটা একটু স্নেহ ভরে নাড়িয়ে বললাম- তুই ওকে চোখে চোখে রাখতে পারবি তো ? সঙ্গে সঙ্গে একটু তফাতে গিয়ে চোখ ঠোঁট মাথা উল্টে নেড়ে বলল – আমার দায় যেন, জানোই তো আমার মেলা কাজ থাকে। হেসে ফেললাম মুন্নির কথায়, বললাম – এই যে সেনোরিটা, কাজ তো ওই একটাই, ঘোড়ার ঘাস বাছা । কপট রাগ দেখিয়ে তার জবাব – এত তাচ্ছিল্য কর কেন গো মামু ? তোমার কি রাজকার্য থাকে শুনি ! পার তো একটাই কাজ , আমাদের ধমক দেওয়া আর মেরে সহবৎ শেখানোর ক্লাশ নেওয়া , যেন মাস্টার্সের ক্লাশ , বিহেভেরিয়াল সায়েন্সের প্রফেসর। আমাদের এই খুনসুটি দেখে গাপ্পু করুণ স্বরে বলল – তোমরা ঝগড়া করবে না আমাকে নিয়ে একটু ছাদ দেখাবে ? সঙ্গে সঙ্গে মুন্নি- নাও ম্যাও সামলাও, যেমন নাচিয়েছ, বলেই ছাদের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে এ টব সে টব , জলের বালতি, ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে চলে গেল ঘাসান্বেষণে, অগত্যা । ছাদে পা দেওয়া মাত্রই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল আমাদের হিরো । গাপ্পুকে দেখতে খুব সুন্দর, চেহারা ছবি বেশ শক্তপোক্ত, সাইজে বড় হলেও আদতে ভীষণ ভীতু আর আদুরে । ওর ভয় দেখে হাসিও পেল , বললাম তুই মুন্নির সঙ্গে থাক, ও কোথায় কোথায় যাচ্ছে, কি করছে ফলো কর। কাকস্য পরিবেদনা, এমন করতে লাগল মনে হল পারলে পা জড়িয়ে ধরে। মুন্নি গাপ্পুর ওই অবস্থা দেখে হেসে কুটোপাটি। ভীতু ভীতু বলে টোন কাটতে লাগতেই গাপ্পুর মনে হয় পৌরুষে একটু ঘা লাগল। রাগ দেখিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দিদিকে তাড়া করল। মুন্নি যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল, মারল টেনে এক দৌড়, সোজা ওপরের বা তিনতলার ছাদে। পিছু নিতে গিয়েই প্রথম বাধা, গাছে জল দেবার ছোট প্ল্যাস্টিকের বালতিটা ফাঁকা ছিল, হওয়াতে উঁচু চাতাল থেকে সোজা ওর নাকের ডগায় এসে ঝাঁপ , ভূত দেখলেও কেউ এত ভয় পায় না, গাপ্পু ওই বালতি পড়া দেখে মারল অলিম্পিকের চাম্পিয়নশিপের দৌড়। পেছনেই ছিলাম, আটকে বললাম- ভয় পেলি কেন, একটা মামুলি ফাঁকা বলতি দেখেই তোর হিরোবাজি জিরো। গাপ্পু উত্তর দেবে কি, কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে বালতি দেখছে যেন হিরোশিমার অ্যাটম বোম পড়া দেখছে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বুকে সাহস জোগান দিয়ে বালতি কাছে এনে ভাল করে দেখিয়ে আশ্বস্ত করলাম। যাই হোক গাপ্পু নিশ্চিন্ত হল যে ওটা নেহাতই একটা নিরামিষ বস্তু, গুটিগুটি পায়ে ছাদে ঢুকল , ঢোকা ইস্তক সে যে কত কথা বলে যাচ্ছে , আর তার কি যে মানে , তা বোঝা দায়। মুন্নি ইতিমধ্যে তিনতলা থেকে মুখ বাড়িয়ে ভাইকে ডাকছে, তাই শুনে বাবু এগিয়ে গেল। ফের বিপত্তি, যেই না সিঁড়ির মুখে , মুন্নির দৌড়াদৌড়িতেই হোক বা ইচ্ছে করেই হোক একটা ইঁটের টুকরো মিসাইলের মত করে এসে লাগল সোওজা ওর নাকে। চরম বিদ্রোহ করে বসল গাপ্পু। আর এক ইঞ্চি এগোবে না। ভয়ানক রাগ দেখাতে লাগল আমার ওপর। যেন আমি জেনেশুনে ওকে এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে এসেছি। প্রথমে কাঁইমাই পরক্ষণেই চিল চিৎকার করে কানের দফারফা। অনেক করে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, হলো তো নাই-ই বরং রাগে গজগজ করতে লাগল। উপায় না দেখে আমিও ছুঁড়লাম ব্রহ্মাস্ত্র, বেতের ভয়, কারণ ততক্ষণে আমারও জেদ চেপে গেছে। একপ্রকার ধাক্কা মারতে মারতে ওকে তিনতলার ছাদে ওঠালাম। এখানেও ওর ভয় কাটে না, জানালার যে লোহার জাল লাগিয়েছিলাম তার টুকরো টাকরা পড়েছিল, উনি কেতা মারতে গিয়ে পা আটকালেন, ভূমিকম্প হল।
মুন্নির কথাই ঠিক দেখছি এখন। পরের এপিসোড তো আরও…. । ছাদে দুটো পেল্লায় জলের ট্যাঙ্ক আছে। হাল আমলের পিভিসি দিয়ে তৈরি। ছাদের ওপর ছাদ, ব্যাটার ভারি কৌতুহল। চ্যাংদোলা করে বসলাম একটা ট্যাঙ্কের মাথায়। এখানেই পাহাড় ভেঙে পড়ল ওর মাথায় বসার একটু পরেই । বলে রাখি, খেলার সঙ্গী না হওয়ার জন্য মুন্নি আগেই গাপ্পুকে দুয়ো দিয়ে নিজের মত ঘুরছে। যাই হোক ট্যাঙ্কে বসে সবেমাত্র আকাশ , পাশের বাড়ি, উড়ন্ত পাখি, ঘুড়ি এইসব দেখছে , হটাৎই …… কেউ পাম্প চালিয়েছে নীচে, তেড়ে জল পড়ছে। বেচারা বসে নৈসর্গিক শোভা দর্শন করছে আর তার পাছার নীচে একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ ( গাপ্পুর মনে এটাই ছিল ) , পৃথিবীর সর্বকালীন রেকর্ড ভেঙে মারল সামারসল্ট ভল্ট, ওকে ধরতে গিয়ে আমিই হোঁচট খেয়ে দুম। যখন ধরলাম দেখি ভয়ে বাথরুম করে ফেলেছে। উবু হয়ে বসে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরতেই বগলে মুখ গুঁজে ক্রমাগত বলতে থাকল, আমি বাড়ি যাব, আমি বাড়ি যাব। কি আর করি, ওই আদদামড়া ছেলেটাকে বাধ্য হয়ে কোলে তুলে ওর ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। ভয়ে বা ভালোবাসায় এমন ভাবে আমার গলা জড়িয়ে ধরল যে গোটা চারেক নখ বসে গেল ঘাড়ে। ঘরে ঢুকে ওর ধরে ফের প্রাণ এল, জল খেল। এখন আমি চলি ওই নখের চিহ্নে বেটাডাইন লাগাতে। তোমরা চাইলে এসে গাপ্পুর সঙ্গে আলাপ করতে পার, অবশ্য টিকিট লাগবে। ওহো বলা হয়নি , গাপ্পু আসলে একটা হুলো , মুন্নি হল মেনি। ছবি দিলাম দেখে নাও।