গান্ধর্বী (Gandharbi) : 07
জ্যাঠামশাই একটা গাড়ি ভাড়া করেছেন সারাদিনের জন্যে। শুভকর্মের আর মাসখানেক মতো বাকি। এর মধ্যে তিনি কনেকে একলা একলা রাস্তায় ছাড়তে চান না। ডিসেম্বর মাসে বিয়ে। শীত। জিনিসপত্রের দুর্মূল্যতা দুপ্রাপ্যতা দুটিই হ্রাস পাবে। একটি মাত্র কন্যার বিবাহ দিতে হলে এমনি সময়ই প্রশস্ত। সবচেয়ে স্বস্তির কথা কন্যাটি কোনক্রমে হলেও বি.এ. অনার্সটা পার হয়ে গেছে। হতে পারে তাঁরা খুব নামজাদা বনেদি পরিবার নন—কি শিক্ষায়, কি অর্থ সামর্থ্যে। কিন্তু একটি ন্যূনতম মানদণ্ড তো আছে। সেই মানদণ্ডটি তিনি বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। আর কিই বা আছে জীবনে! নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নেই। কর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন। ভাইয়ের স্ত্রীকে যথাসম্ভব দুধে-ভাতে রাখা, আর পরিবারের ঐতিহ্য তা সে যত সামান্যই হোক, সেটুকু বজায় রেখে খাওয়া—বাস, এই বই তো নয়! তিনি নিজে নিজের জন্য আর কতটুকু চান! ভোরবেলা একটু বেল-কলা, ইজিচেয়ারের ওপর পা তুলে রোজ গীতা এক অধ্যায়। একটু দুধ। খাওয়ার সময়ে একান্তে একটু বউমার সাহচর্য, পাঁচরকম কুটি-কুটি পদ দিয়ে একটু শাকান্ন। রাত্রে রুটির সঙ্গে একটু ভাজা, একটু মিষ্টান্ন, একটু ঘন দুধ, একটু নিশ্চিন্ত নিদ্রা, ছেলেটি ডাক্তারি পাশ করে কোনও সরকারি হাসপাতালে জয়েন করুক, মেয়েটি সৎপাত্রস্থ হোক। এই তো তাঁর আশা, এইটুকুই তাঁর আকাঙক্ষা।
অপালা মাস্টারমশায়ের বাড়িতে একাই ঢুকল। জেঠু অবশ্য নামতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এই গলি সম্পর্কে তাঁর ঘৃণা এবং ভীতির কথা মনে করে অপালা তার স্বভাববিরুদ্ধ দৃঢ়কণ্ঠে জানাল দরকার নেই। তা ছাড়াও সে জানে এ মুহূর্তগুলো শুধু তার আর তার মাস্টারমশায়ের। সে তো শুধু বিয়ের নেমন্তন্ন করতে যাচ্ছে না! এ এক রকম শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা। এই পিতা-পুত্রীর অনুক্ত বেদনার মাঝখানে জেঠুর উপস্থিতি সইবে না।
নীচের তলায় অন্য দিনের মতো সারেঙ্গি বা হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা গেল না। অপালা ঢুকে ডাকল—‘মাস্টারমশাই!’ কোনও সাড়া পেল না। এবার সে মিতুলের নাম ধরে ডাকতে লাগল—‘মিতুল! মিতুল!’ এবার দোতলার বারান্দায় মাস্টারমশাই বেরিয়ে এলেন। অচেনা গলায় বললেন—‘কে?’
—‘আমি অপু মাস্টারমশাই!’
—‘অপু! অপু! নীচে কেন!’ চটিতে চটাস চটাস শব্দ করে রামেশ্বর নীচে নামতে লাগলেন।
‘না, মাস্টারমশাই ওপরে আর যাবো না,’ ভারী হাতে হলুদ চিঠিটা সে মাস্টারমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিল। নিশ্বাস ফেলে মাস্টারমশাই বললেন—‘এ এক হিসেবে ভালোই হল মা। ছেলেটি শুনছি সঙ্গীতপ্রিয়। সহানুভূতিশীল। সৌম্যদর্শন। সৌম্যদর্শন পুরুষ দরদী হয়। হয়ত তুমি আরও অনুকূল পরিবেশই পাবে। তোমাকে নিয়ে আমার একটাই ভয় মা।’
অপালা মাস্টারমশাইকে প্রণাম করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রামেশ্বর বললেন—‘তুমি বড় দুর্বল মা, বড় অভিমানী, আজকের এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কার অভিমান কে বুঝবে? তোমার মধ্যে অপার ঐশ্বর্য, শুধুমাত্র অসার অভিমানের জন্যে যদি নষ্ট করো…’
অপালা একটু চুপ করে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বলল—‘মিতুল কোথায় মাস্টারমশাই! ওকে কিন্তু সকাল থেকেই যেতে হবে। রাতে থাকবে। গানবাজনা হবে…।’
—‘যাবে তো নিশ্চয়ই তবে ওর একটা ছোটখাটো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, ওকে আপাতত ওর এক বন্ধুর বাড়িতে রেখেছি।’
—‘সে কি? কী হল?’
‘ও কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। এখনও তো দেরি আছে। অপুদির বিয়েতে মিতুল যাবে না, আনন্দ করবে না, তা-ও কি হয়? এর পর কোথায় যাবে?’
‘এখান থেকে সোজা সোহমের বাড়ি। তারপর…’
মাস্টারমশাই অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন—‘অপু সে মর বাড়ি যেও না। সোহম অসুস্থ। অত্যন্ত অসুস্থ।’
—‘সে কি? কী বলছেন, তবে তো আরও যাওয়া দরকার! জেঠুকে বরং বলব, বাকিগুলো উনি একাই সেরে নিন। আমি সোহমের কাছে একটু থাকব।’
—‘না, অপালা না। এ সাধারণ অসুস্থতা নয়। সোহমের মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। সাংঘাতিক ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে। গত পরশু আমাদের বাড়িতে এসে একটা ছুরি দিয়ে মিতুলকে আক্রমণ করে। অশ্রাব্য গালাগাল দেয়। পাড়ার লোকে এসে না বলপ্রয়োগ করলে মিতুল হয় অন্ধ, নয় খুন হয়ে যেত। তারাই ওকে কোনক্রমে বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিছুদিন থেকেই দেখছিলুম কিরকম বদমেজাজী, উগ্র, অস্থির হয়ে উঠছে। ছুরিটা ভাগ্যিস ভোঁতা ছিল!
অপালার চোখে আতঙ্ক। সে বড় বড় স্থির চোখে চেয়ে বলল—‘কেন? কেন এমন হল মাস্টারমশাই?’
—‘কিছুই বুঝতে পারছি না। মিতুলের ওপর তো ওর একটু বেশিই…’
অপালা বলল, ‘সোহম আমার আপন ভাইয়ের মতো। ওর এরকম বিপদ। আমি কিছুতেই নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যেতে পারব না মাস্টারমশাই। আমাকে যেতে দিন।’ তার গলায় কাতরতা।
রামেশ্বর বললেন—‘চলো, তবে সে ক্ষেত্রে আমিও যাবো।’ তিনি চটপট সদর দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
রামেশ্বরকে বেরোতে দেখে জেই কৃতাঞ্জলি হয়ে নেমে এলেন। তাঁর ভদ্রতায় কখনও কোনও ঘাটতি থাকে না। বললেন—‘মাপ করবেন রামবাবু, আমি নামতে চেয়েছিলুম। আমার কন্যেটি বুড়ো জেঠুর বেতো হাঁটুর জন্যে বড় ভাবে তো…’
—‘তাতে কী হয়েছে? রসময়বাবু, ওসব চিন্তাও করবেন না। আমাদের অতো ফর্মালিটি নেই। আমরা ভাবগ্রাহী।’
—‘তা আপনিও কি অপুর বন্ধুদের বাড়ি যাবেন?’
—‘হ্যাঁ, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, সোহমের সঙ্গে বিশেষ করে একটু দরকার ছিল। যান যখন রয়েইছে একটা।’
—‘আপত্তি কি? আপত্তি কি? ছি ছি ছি। আসুন…’ সাদরে দরজা খুলে দিলেন রসময়বাবু।
সোহমের বাড়িতেও জেঠুকে নামতে দৃঢ়ভাবে বারণ করল অপালা। জেঠুর নামবার কোনও কারণও নেই। তাঁর আসবার কারণও খুব ছিল না। কিন্তু প্রদ্যোৎকে পাওয়া যায়নি। বিয়ের মাসখানেক আগে কনেকে ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভারের ভরসায় ছেড়ে তিনি দেবেন না। তিনি বললেন—‘বেশি দেরি করো না মা অপু।’
অপু মাস্টারমশাইয়ের চোখের দিকে চেয়ে বলল—‘একটু দেরি হবে জেঠু। মাস্টারমশায়ের কি দরকার আছে বলছিলেন, না? ওঁকে আমরা নামিয়ে দিয়ে যাবো তো!’
এদিক থেকে সোহমের দক্ষিণের বারান্দা দেখা যায়। জানলাগুলো বন্ধ। অপালা আর মাস্টারমশাই ভেতরে ঢুকতেই বনমালী চাকর শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল, পেছনে-পেছনে সোহমের রাশভারী বাবা। তাঁর মুখ থমথম করছে। এগিয়ে এসে বললেন—‘আপনারা?’
—মাস্টারমশাই অপালাকে দেখিয়ে বললেন—‘অপু মার বিয়ে। ও সোহমকে নেমন্তন্ন করতে এসেছে।’
‘আপনি তো জানেন রামেশ্বরবাবু সোহম এখন ঠিক নেমন্তন্ন নেবার অবস্থায় নেই।’
—‘আমি নিষেধ করেছিলুম প্রতাপবাবু। কিন্তু সব শুনে অপু বলছে ও সোহমের সঙ্গে দেখা করবেই।’
—‘হী ইজ আন্ডার সিডেশন। তবে কিছুক্ষণ হল ওর ঘোরটা ভেঙেছে। ও যদি অপালাকে আক্রমণ করে, আমি কী করবো? একেই তো আপনার কাছে অপরাধী হয়ে আছি।’
অপালা বলল—‘আমায় ও কিছু বলবে না কাকাবাবু। আমায় একবার যেতে দিন।’
—‘কিন্তু ও খুব সম্ভব মেয়ে দেখলেই ক্ষেপে যাচ্ছে। ডু ইউ নো রামেশ্বরবাবু হী থ্রু এ পেপারওয়েট অ্যাট হিজ মাদার্স পোট্রেট, কলিং হার নেমস!’
অপু আবারও বলল—‘আমায় একবার, অন্তত একবার যেতে দিন কাকাবাবু।’
একটু ইতস্তত করে প্রতাপবাবু বললেন—‘ঠিক আছে এসো। কিন্তু চিঠিটা ওকে দিও না। আমার হাতে দাও। আর রামবাবু আমার অনুরোধ আপনি যাবেন না।’
বনমালী এবং আরেকটি চাকরকে তিনি বললেন অপালার সঙ্গে সঙ্গে যেতে। নিজেও ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সোহমের ঘরের জানালা সব বন্ধ। সময় বোঝা যায় না। কি একটা কেমিক্যাল সুগন্ধ ঘরে। সাবান হতে পারে, পাউডার হতে পারে, সেন্ট হতে পারে, কিন্তু অচেনা। সোহম বিছানার ওপর খালি গায়ে শুধু একটা পাজামা পরে বসে আছে। তাকে এভাবে খালি গায়ে এবং এমন অবিন্যস্ত কখনও দেখেনি অপালা। তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে ঘোরের মধ্যে আছে। চোখগুলো লাল।
বনমালী বলল—‘খোকাবাবু, কে এসেছে দেখো।’
লাল চোখ মেলে সোহম দেখল, জড়িয়ে জড়িয়ে বলল—‘অপু! তুই নয় শিওর। কিন্তু আমি জানি সামবডি আমাকে সিঁদুর খাইয়েছে। রক্ষাকালী পুজোর প্রসাদ বলে এক প্লেট কি ছাইভস্ম এনে দিলে। আসলে সিঁদুর, সিঁদুর ছিল তার মধ্যে।’
—‘সিঁদুর?’ অপালা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল—‘সিঁদুর খেলে কি হবে?’
—‘ডোন্ট ইউ রিয়্যালাইজ? সিঁদুরের মধ্যে মার্কারি থাকে, আরও কি কি থাকে কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে দেখতে হবে। ইট ইজ ব্যাড অ্যাজ ব্যাড ক্যান বি। কক্ষনো সিঁদুর পরিস না অপ। আর গলার পক্ষে ইট ইজ ডেডলি। ওরা আমার গলা নষ্ট করে দিতে চায়। আমি আর গাইতে পারবো না। গাইতে পারবো না।’ সোহমের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
অপালা বলল—‘কে তোকে এসব বাজে কথা বলেছে? কোথায় কার বাড়িতে কালীপুজোর প্রসাদ খেয়েছিলি?’
—‘দ্যাট দিলীপ সিনহা। সরোদিয়া! রামেশ্বর ঠাকুর। সৌম্য। স-ব। দীপালি। দ্যাট সাদিক হুসেন! ওর ওখানে কী দরকার রে? ও অবধি ছিল। খালি তোকেই দেখলাম না। সবাই মিলে জোর করে আমায় বিষটা খাইয়ে দিল। দেখছিস না গলাটা কি রকম হোর্স লাগছে?’
অপালা বলল—‘তুই বোধহয় খুব চেঁচিয়েছিস সোহম। তাই গলাটা আপাতত ভেঙে গেছে। একটু চুপ করে থাক। কথা বলিস না। ওষুধ খা। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কর। বিশ্রাম নে। ঠিক হয়ে যাবে।’
সোহম মাথা নাড়ল, যত জোরে সম্ভব—‘খাওয়া-দাওয়া আমি আর করছি না। দেখছিস না, মাই ফাদার, ব্রাদার্স, সিসটার্স-ইন-ল, এমনকি দীজ হেল্পিং হ্যান্ডস্ এরা পর্যন্ত চায় না আমি গান করি। সব খাবারের সঙ্গে একটু একটু সিঁদুর মিশিয়ে রেখেছে।’
বনমালী বলল—‘সেই পরশু থেকে কিছু খাওয়াতে পারিনি অপু দিদিমণি। আমি, আমি নাকি ছোড়দাবাবুকে বিষ দেবো!’ সে কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে লাগল।’
সোহম বলল—‘অপু তুই প্লিজ যাস না। সেভ মি, সেভ মি ফ্রম দীজ পিপল। ফর গড্স্ সেক অপু!’
অপালা বলল—‘ঠিক আছে থাকব। কিন্তু তোকে খেতে হবে।’
আমি দিলে খাবি তো?’
সোহম বলল—‘প্লীজ ডু মি দ্যাট ফেভার। আই অ্যাম স্টার্ভিং।’
অপু বাইরে বেরোতে সোহমের বাবা বললেন—‘ডাক্তার লিকুইড দিতে বলেছেন।’
একটু দুধ ওকে যদি খাওয়াতে পারো মা…’
এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ তাতে ভ্যানিলা দেওয়া, সে সোহমের মুখের কাছে এনে ধরল। আস্তে আস্তে গ্লাসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল সোহম।
বলল—‘কোথা থেকে আনলি?’
অপালা বলল—‘আমাদের বাড়ি থেকে। পাশে খাটাল আছে দেখিসনি, সদ্য দুয়ে দেয়!’
—‘ঠাণ্ডা হল কী করে? তোরা কি রিসেন্টলি ফ্রিজ কিনেছিস?’ অপালা বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে বলল—‘হ্যাঁ।’
সোহম আস্তে আস্তে দুধটা খেয়ে নিল। তার বাবা বললেন—‘ওষুধটাও ওকে খাইয়ে দাও অপালা।’
অপালার হাত থেকে ওষুধটা নিল সোহম, বলল—‘ওষুধটা কিসের? এমনিতেই আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি অফ দীজ ব্লাডি পিল্স্।’
অপালা বলল—‘এই যে তুই খেতে পারছিস না। শরীরটা কেমন কেমন লাগছে। এগুলো ওষুধটা খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তুই খেয়ে নে। আমিও এটা মাঝে মাঝে খাই।’
সোহম বড়িটা মুখে ফেলে দিল। তারপর বলল—‘অপু আমার যদি খিদে পায়। আমি কি খাবো? কে আমায় দেবে?’
অপালা বলল—‘আমিই দেবো, আর কে দেবে! দাঁড়া আমি ব্যবস্থা করছি।’
বাইরে প্রতাপবাবু দাঁড়িয়ে, অপালা বলল—‘ওকে আর কি খেতে দিতে বলেছেন ডাক্তার?’
প্রতাপবাবু বললেন—‘একদম লিকুইড। তবে যতবার সম্ভব। লেবুর রস রয়েছে। ক্লিয়ার চিকেন সুপ রয়েছে।’
অপালা দুহাতে দু গ্লাস নিয়ে ফিরে এলো। সোহমের বেডসাইড টেবিলে দুটি গ্লাস ঢাকা দিয়ে রাখল। বলল—‘এই আমি তোর মুসাম্বির রস করে দিয়ে গেলাম, আর এই গ্লাসটাতে চিকেন সুপ রাখলাম, আমি নিজের হাতে করেছি। তোর যখন খিদে পাবে, যেটা যখন ইচ্ছে, খেয়ে নিস। কেউ তোর ঘরে ঢুকবে না, আমি বারণ করে দিয়ে যাচ্ছি। আর বিকেলে আমি দাদাকে পাঠিয়ে দেবো। দাদার হাতে খাবার পাঠিয়ে দেবো। খাবি তো?’
—‘শিওর!’ খুব জড়ানো গলায় বলল সোহম। সে শুয়ে পড়েছে। তার চোখ বুজে আসছে।
অপালা বাইরে বেরিয়ে এলো। প্রতাপবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। সেই জলদ্গম্ভীর চাল, রাশভারী ভাব কিছুই যেন আর নেই। ছোট ছেলের মতো অপালার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন, বললেন—‘দুদিন পরে ও কিছু খেল মা। তুমি পারলে আবার এসো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। পৌঁছেও দেবো। ওর মায়ের মৃত্যুর পর এ বাড়িতে, বা আমার জীবনে এত বড় বিপদ আর কখনও হয়নি।’
অপালা বলল—‘বিকেলে দাদাকে পাঠিয়ে দেবো। দাদা মেডিক্যাল কলেজে, ফাইন্যাল ইয়ার এখন। আপনারা ওকে খুব ভালো ডাক্তার দেখাচ্ছেন। জানি। কিন্তু দাদাকে ও বিশ্বাস করবে বেশি।’
অপালা তাড়াতাড়ি সিঁড়ি নেমে মাস্টারমশায়ের কাছে এলো। তিনি এতক্ষণ ধরে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ তাঁকে বসবার একটা চেয়ার দিতেও ভুলে গেছে।
প্রতাপবাবু বললেন—‘কিছু মনে করবেন না রামেশ্বরবাবু। আপনি দেবতুল্য মানুষ। কিন্তু গান বাজনার লাইন বড় খারাপ। যতরকম কুৎসিত প্রবৃত্তির রাজত্ব। ছেলেটার ক্ষমতা ছিল। পারিবারিক ট্র্যাডিশন ভেঙে গান করতে চাইল। আই হ্যাড মাই মিসগিভিঙস্। এখন দেখছি আই ওয়জ রাইট। ভুল করেছি।’
রামেশ্বর ঠাকুর কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। প্রতাপবাবু বললেন—‘আপনার মেয়ে এখন কেমন আছে? ওর চিকিৎসার খরচ সমস্ত আমার। প্ল্যাস্টিক সার্জারি করাতে হলে তাই হবে। বিন্দুমাত্র ভাববেন না।’
রামেশ্বর নম্র প্রায় আর্দ্র স্বরে বললেন—‘প্রতাপবাবু, খরচ খর্চার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। সোহম আমার নিজের সন্তানের মতে, এই অপু যেমন। সে সেরে উঠলেই এখন আমি নিশ্চিন্ত হই।’
রাত ন’টা নাগাদ প্রদ্যোৎ যখন ফিরে এলো তখন এক ভয়াবহ গল্প শুনল অপালা। দিন তিনেক আগে সোহম নাকি কোথা থেকে ফিরে গুম হয়ে থাকে, ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করেনি; দাদারা দু একবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ভালো করে জবাব দেয়নি। ভোরবেলায় ওর ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে সবাই ছুটে গিয়ে দেখে ভারী পাথরের পেপার ওয়েট ছুঁড়ে সে তার মায়ের ছবিখানা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। মুখে তার মৃত মাকে লক্ষ্য করে অশ্রাব্য খিস্তি। বড়দা রেগে-মেগে তাকে থামাতে গেলে সে তাঁকেও একটা ফুলদানি ছুঁড়ে মারে। এছাড়াও টি ভি ট্রানজিস্টার রেডিও সেট, ওয়াল ডেকোরেশন ঘরের মধ্যে যা-যা ছিল সব ভেঙে ছত্রখান করে। তার চেহারা তখন উন্মাদের মতো। মনে হল কাউকে চিনতে পারছে না। লোক্যাল ডাক্তার ঘুমের ওষুধ ইনজেকশন দিয়েছিলেন, কড়া ডোজে। কিন্তু রাতের দিকে কখন সে উঠেছে কেউ জানে না। রামেশ্বরের বাড়ি গেছে এবং সেখানে কোথা থেকে একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে মিতুলকে আক্রমণ করেছে। অনেক কষ্টে রামেশ্বর এবং পাড়ার কিছু লোকে তাকে ধরাশায়ী করে, বেঁধে ছেঁদে। কোনক্রমে বাড়ি দিয়ে যায়, সবসময়ে তাকে ঘুমের ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার। মিতুলের কপালে গালে বুকে বেশ ভালো মতো লেগেছে। কপালের আঘাতটা চোখ ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে। প্রদ্যোৎ খুব চিন্তিত, গম্ভীর। বলল—‘অপু ভাবিসনি। আমি বিদ্যুৎদাকে নিয়ে গিয়েছিলুম। উনি বলছেন প্যারানয়েড বলে মনে হলেও আসলে এটা খুব সম্ভব একটা সাময়িক নার্ভাস ব্রেক-ডাউন। এর কারণটা ইমিডিয়েটলি খুঁজে বার করতে হবে। হঠাৎ ও একটা দারুণ শক পেয়েছে। আচ্ছা অপু, ছেলেটা তো তোরই মতো গান-পাগলা, যতবার আমাদের বাড়ি এসেছে দেখেছি সুর ভাঁজতে ভাঁজতে দুটো তিনটে সিঁড়ি একসঙ্গে টপকাতে টপকাতে হয় ওপরে উঠছে নয় নীচে নামছে, আর মা কিছু খেতে দিলেই বলছে—“কি করেছেন এটা মাসিমা, ফাস কেলাস।” তা এমনি মানুষ হিসেবে কিরকম বল তো!’
—‘আমি তো যতদূর জানি, বাড়ির খুব আদরের, বুদ্ধিমান, কিন্তু সরল খুব, হিংসে টিংসের বাষ্পও ওর মধ্যে নেই, সহজেই সব কিছু বিশ্বাস করে নেয়।
মিতুলের প্রতি ওর দুর্বলতার কথাটা দাদাকে এক্ষুনি বলবে কিনা ঠিক করতে পারল না, অপালা। কোনও কোনও গোপন কথা জানা থাকলেও তার গোপনতা রক্ষা করা পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে সে। যদি দাদা কিছু প্রশ্ন করে নিশ্চয়ই বলবে। সোহমকে পুরোপুরি ভালো করে তোলার জন্যে যদি প্রয়োজন হয় নিশ্চয়ই প্রকাশ করতে হবে।
প্রদ্যোৎ ততক্ষণে বলছে—‘দেয়ার ইউ আর। ছেলেটা বলছিস সরল আর গালিব্ল্। এটা একটা ইমপর্ট্যান্ট ক্লু। ও যে বলছে রক্ষাকালী পুজোর প্রসাদ খেয়েছে এবং সেখানেই ওকে কেউ কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছে এটা সম্পূর্ণই ওর কপোল কল্পনা, তোর মাস্টারমশায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম আমি। দিলীপ সিংঘি না কি এক ছাত্র আছে ওঁর, তার বাড়িতে রক্ষাকালীপুজো হয়। সারা রাত নাকি কালী কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত হয়, তাতে রামবাবু, মিতুল এরা যায়, গান-টান করে, কিন্তু সোহম সেখানে প্রসাদ খাবে কি। কখনও যায়নি, তার নেমন্তন্নই হয় না!’
অপালর ঠোঁট কাঁপছে। বলল—‘দাদা, আমার ভীষণ ভয় করছে। একে তো বিয়েটা আমার একেবারেই করতে ইচ্ছে করছে না, তারপরে গোড়াতেই এরকম একটা অশুভ ঘটনা!’
প্রদ্যোৎ বলল—‘এই জন্যে তোদের ওপর রাগ ধরে। তোর বিয়ের সঙ্গে সোহমের অসুখের কী সম্পর্ক? তোদের মধ্যে কি লভ-অ্যাফেয়ার-টার আছে নাকি? সোহম তোর বিয়ের কথা শুনতে পেয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে?’
অপালা প্রদ্যোতের বলার ধরনে হেসে ফেলল, বলল—‘চড় খাবি। ঘটনাটা তো অশুভ। এটা তো মানবি! গানের লোকেরা খুব সুপারস্টিশাস হয় জানিস তো? তাছাড়া সোহমের চিন্তা মাথায় নিয়ে বিয়ে করতে আমার খুব খারাপ লাগবে।’ তার মাথার মধ্যে ঘুরছিল সোহমের সেই জড়ানো গলার সাবধানবাণী ‘সিঁদুর খুব খারাপ জিনিস, কক্ষনো সিঁদুর পরিসনি, অপু।’ কিন্তু একথাটা দাদাকে বলা যায় না।
প্রদ্যোৎ বলল—‘বিদ্যুৎদা বলছেন কয়েক মাসের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। তুই ঘাবড়াস না।’
অনেক রাত্তিরে দীপালি এলো। ন’টা বেজে গেছে। জেই খেয়ে উঠেছেন। মা জেঠুর থালা বাটি নিয়ে নীচে নামছেন, প্রদ্যোৎ বোধহয় মোড়ের দোকানে সিগারেট কিনতে গেছে, দরজাটা খোলা রেখে গেছে। তিনি দেখলেন খোলা দরজার এক পাট ভেজিয়ে দীপালি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি একেবারে অবাক। দীপালির আসা-যাওয়ার অবশ্য অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু তাঁদের বাড়ির রসময়বাবু-শাসিত পটভূমিতে রাত্তির ন’টায় কোনও মেয়ের বন্ধুর বাড়ি ঢোকার কথা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। দীপালি কেমন একরকম গলায় বলল—‘মাসিমা, আমি আজ অপুর কাছে থাকব। অসুবিধে হবে না তো? ও তো আর কদিন পরই শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।’
এতক্ষণে সুজাতা নিশ্চিন্ত হলেন—‘নিশ্চয়। নিশ্চয়। বাড়িতে বলে এসেছে তো! নিশ্চয় থাকবে। অসুবিধে কি! এসো আমি ওদের খেতে দিচ্ছি, তুমিও বসবে এসো।’
দীপালি বলল—‘আমি খেয়ে এসেছি মাসিমা। ব্যস্ত হবেন না। আমি ছাতের ঘরে যাচ্ছি।’
অপালা তার গলার সাড়া পেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দীপালি বলল—‘অপু খেয়ে ওপরে আয়।’ তার গলা কাঁপছিল। সুজাতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেছেন। অপালা টের পেল শেষ কথাটা প্রদ্যোৎও শুনতে পেয়েছে। সে এখন সদর দরজা বন্ধ করছে। দীপালির গলার কাঁপুনিতে অবাক হয়ে সে বোনের সঙ্গে চোখাচোখি করল।
কোনরকমে খেয়ে নিয়ে অপালা ছুটল ওপরে, দেখল দীপালি দু হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে থরথর করে কাঁপছে। ‘কী হয়েছে দীপুদি? কী হয়েছে?’
—‘সোহমের খবর শুনেছিস?’
—শুনেছি। গিয়েছিলাম।’
—‘ও যদি আমাকে খুন করতে আসে? এইরকম রাতেই ও মিতুলকে খুন করতে গিয়েছিল। মিতুল এখন হসপিটালে জানিস তো? চোখের ওপর, গালে, বুকের মাঝখানে লেগেছে। কে জানে ডিসফিগার্ড হয়ে গেল কিনা মেয়েটা!’
—‘তোকে কেন খুন করতে যাবে?’
—‘আরে পাগলদের কিচ্ছু বিশ্বাস নেই। আসলে মানে মিতুলের কথাটা তো আমিই ওকে বলি।’
—‘মিতুলের কথা! কী কথা!’
—‘মিতুলের মা যে মাস্টারমশায়ের এক ছাত্রর সঙ্গে পালিয়ে যান—ইন ফ্যাক্ট্ উনি যে মাস্টারমশায়েরও গুরুপত্নী, মাস্টারমশাই ভাগিয়ে এনেছিলেন, মিতুল ওই স্ত্রীরই মেয়ে। এসব তো আমিই…’
—‘এসব তুই বলছিস কি দীপুদি? কোথা থেকে শুনলি? যত গুজব?’
—‘গুজব নয়। আমি জানি। আগেকার লোকেরা অনেকেই জানে। আলোচনা করে না।’
—‘কই আমি তো জানি না!’
—‘তোর কথা আলাদা। স্ট্রিক্ট্ ডিসিপ্লিনে থাকিস। গান শিখিস, বাড়ি চলে আসিস। আমরা গান বাজনার জগতে ছোট থেকে ঘুরি-ফিরি। অনেক কথাই জানি। দিলীপ সিন্হা ওই যে রে সরোদ বাজায় ওর সঙ্গে মিতুলের ঘনিষ্ঠতার কথাও আমিই সোহমকে বলেছি।’
—‘ঘনিষ্ঠতা? কতজনের সঙ্গে তো মিতুলের ভাব! একটা ছোট মেয়ে! মা নেই! কেন এসব বলতে গেলি! তুই জানতিস না! আমি যে সেদিন বললাম!’
—‘তার আগে! আরে এমনি গল্প করতে করতে বলেছি, আমি তো ঘুণাক্ষরেও জানি না মিতুলের ওপর অত ঝোঁক! আর যতই বল ওদের কত বড় ফ্যামিলি। ওরা কি কখনও মিতুলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিত!’
—‘বিয়ে দিত কি না দিত সেসব পরের কথা। দীপুদি তুই খুব অন্যায় করেছিস। আমি চিন্তাই করতে পারছি না এই কথাগুলো তুই একটা ছেলের সঙ্গে আলোচনা করলি কি করে!’
দীপালি বলল—‘যা হয়ে গেছে, গেছে। আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। তুই আমাকে বাঁচা অপু। সোহম আমাকে খুন করবেই।’
অপালা বলল—‘সোহম, হয়ত তোর এসব কথাতেই ওরকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাতে তোর কোনও দুঃখ নেই দীপুদি! এই যে সেদিন বলছিলি সোহমকে তুই ভালোবাসিস।’
—‘উন্মাদ। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে ও। নিশ্চয় ভেতরে টেনডেনসি ছিল। নইলে এতো সহজে কেউ এমনি খুনোখুনি করে না। আমাকে ও শেষ করে দেবে। তোর কাছে আমায় রাখ।’
—‘ঠিক আছে। তুই থাক না এখানে। তবে সোহমের এখন তোর উপর হামলা করবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ওকে স্ট্রং ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা আরও জটিল হলে নার্সিং হোমে রাখা হবে।… আয় দীপুদি আমরা দুজনে মিলে শুধ্ কল্যাণ গাই।’
দীপালি বলল—‘তোর এখন গান আসছে? তুই গা ভাই! ভয়ে আমার হতা পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
অপালার হঠাৎ মনে পড়ল, সে বলল—‘কি সিঁদুর সিঁদুর করছে রে! সিঁদুর খাওয়ালে নাকি গলা নষ্ট হয়ে যায়। এ সব কথাও তুই-ই ওকে বলেছিলি না কি?’
দীপালির মুখ ছাইয়ের মত শাদা হয়ে গেছে। সে সবেগে মাথা নেড়ে বলল—‘না, না, মোটেই না।’
অপালার এখন মন অনেক শান্ত হয়ে গেছে। সে তার মাস্টারমশাই প্রদত্ত তানপুরো তুলে নিল। রাত যত গভীর হয়, তার গানও ততই গভীরে চলে যায়!’ ‘মন্দরবা বাজো রে’ শুধু ‘বাজো রে’ দিয়েই সে সুরের সমুদ্র তৈরি করে, বেশি তানের মধ্যে লয়কারির মধ্যে যায় না। শুধু ভাব। ভাব থেকে অনুভব, ‘আনন্দ রহো’ বলে সে যখন গলা তোলে তারপর টুকরো টুকরো কাজ দিয়ে নেমে আসে, চম্পকের তীব্র মধুর সুবাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে কল্যাণের স্বরাবরোহণ। সুর যখন তার নাড়িতে নাড়িতে এমনি করে প্রবেশ করে যায় তখন সুখ-দুঃখ থাকে না, ভাবনা-চিন্তা কিছু না, তার মনে হয় সে এক প্রবল পরাক্রান্ত কিন্তু অপরিসীম প্রেমী পুরুষকে অনুসরণ করে চলেছে। কী মাধুর্য, কী ধৈর্য, কী মহিমা এই অনুসরণে। অনুসরণের পথটি সোজা নয়। কখনও আঁকাবাঁকা, কখনও ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া, আবার কখনও হে বিরাট নদী—বিশাল রাজপথসদৃশ রাস্তা। তার দুধারে অলৌকিক সৌন্দর্যের সম্ভার। প্রত্যেকটি বাঁকে বিস্ময়ের উপচার নিয়ে অপেক্ষা করছে অদৃশ্য গন্ধর্বর। অবশেষে মোহনার মত এক সুরবিস্তারে তার কল্যাণের বিলম্বিত গানটি সুরসমুদ্রের মৌলিক স্রোতে মিশে যায়। সে আবিষ্ট হয়ে যায়। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে, ঘরটা যেন একটা সুরমণ্ডল। বেজেই চলেছে বেজেই চলেছে, ছাতটা সুরের সেই ত্রিসপ্তক বিস্তৃত আদি মহাসাগর, যেদিকে সে তার অভিসার শুরু করেছিল। দীপালি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। সটান। শিথিল। তার মাথাটা বালিশের এক দিকে কাত হয়ে পড়েছে। ভয়ের কুঞ্চনগুলো আর নেই। তার মুখে নিস্পাপ শিশুর আত্মসমর্পণের সরলতা।
অপালা তার তানপুরো পেরেকে ঝুলিয়ে রেখে, তুম্বিটার তলায় একটা ছোট টুল গুঁজে দিল। দীপালির পাশে দাদার বালিশে মাথা দিয়ে সে সিগারেট মিশ্রিত একটা পুরুষ-গন্ধ পেতে লাগল, যেটা তার ঘুমের ব্যাঘাত করতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর ঝরকে ঝরকে ঘুম আসতে লাগল। আনন্দময়, কিন্তু অপ্রগাঢ় নিদ্রা। মধ্যরাতে নাকি ভোরের দিকে অপালা জানে না সে ছাড়া ছাড়া দুটো স্বপ্ন দেখল, সে যেন আকুল আগ্রহে কোনও প্রেমিকের দিকে ছুটে চলেছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার কেমন একটা ধারণা আছে সে অবর্ণনীয়। সে রূপ বড় বড় শিল্পীদের ছবিতে আভাসিত হয় মাত্র। দারুণ সুগন্ধও সে। নিজেকে অপালা এমনকি শারীরিক ভাবেও ধরে রাখতে পারছে না। ওই পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে না পারলে যেন তার নির্মল শুচি সুরময় নারীত্ব মূল্যহীন অর্থহীন হয়ে যাবে। এমনই তার আকুলতা। এসব জিনিস অপালা জেগে জেগে সজ্ঞানে কখনও অনুভব করে না। সেই সঙ্গে সে বুঝতে পারছে তার পেছনেও ছুটে আসছে আর এক জন পুরুষ। দ্বিতীয়জনকে এড়াবার জন্য সে এঁকেবেঁকে ছুটছে। গান্ধার থেকে সোজা পঞ্চমে না গিয়ে সে রেখাবে ফিরে এলো। তারপর উঠে গেল ধৈবতে, ধৈবত থেকে বক্রভাবে পঞ্চমকে ছুঁয়েই উঠে গেল মধ্য সপ্তকের নিষাদে। এমনি করে সারা রাত সে স্বরের চড়াই উৎরাই ভেঙে আকুল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল কার কাছ থেকে পালিয়ে, কার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। সে জানে না এরা কারা। ঘুম ভাঙলো দুর্লভ চোখের জলে। বাগেশ্রী, বেহাগ গাইতে গিয়ে এমনিই তার চোখে জল এসে যায়, কেদারার পকড় ধরবার সময়ে ছলছল করে ওঠে চোখ।
চিলেকোঠার ঘরটা এই সময়ে খুব সুন্দর। এতো সুগন্ধ। শীতল। নভেম্বরের গোড়া, অথচ শীত বলতে কিছু নেই। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে জানলা দিয়ে, তাইতেই শীত-শীত করছে। সে দীপালির গায়ে চাদর টেনে দিল। কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দীপালি সে চাদর পায়ের ধাক্কায় ধাক্কায় তলার দিকে পাঠিয়ে দিল আবার। সম্ভবত ওর গ্রীষ্মবোধ বেশি। হাওয়ায় তানপুরোর তারগুলো টুং টাং করে উঠল। দীপালি নিভাঁজ, ছেদহীন ঘুম ঘুমোচ্ছে। নিশ্চয় বেশ কয়েকদিন পরে। অপালা আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। এবারেও একটা স্বপ্ন দেখল। এটা অনেক স্পষ্ট। সে যেন এক জমিদারের জলসাঘরে গান গাইছে। সে নয়। নাজনীন বেগম। কখনও সে নাজনীনকে দেখছে, তাঁর কানবালা, হীরের নাকছাবি, এবং জরিদার বেনারসী শাড়ি সমেত, যেমন রেকর্ডের ছবিতে আছে, কিন্তু সে এও বুঝতে পারছে সে নিজেই নাজনীন। চারপাশে কিছু গম্বুজ। শ্রোতা মাত্র একজনই। তাঁকে দেখতে অনেকটা রামেশ্বর ঠাকুরজীর মতো। কিন্তু তার চেতনা বলছে এটা সোহম। সোহম তার গান শুনছে। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। শুধু দুজনেরই চোখ দিয়ে অবিরল জল পড়ছে। তারপর এক সময়ে সোহম শুয়ে পড়ল। সটান। অপালার পায়ের কাছে সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে। আস্তে আস্তে তার শরীর নিস্পন্দ হয়ে এলো। সে কি ঘুমন্ত না মৃত বোঝা গেল না। কিন্তু কে যেন বলল—‘সো যা বেটি, সো যা,’ অপালা দেখল সোহম তো নয় দীপালি ঘুমোচ্ছে। দীপালি না মিতুল ঘুমের ঘোরে সে একেবোরই ঠিক করতে পারছে না।
ভোরের প্রথম আলো তির্যকভাবে অপালার ঠিক ডান চোখের ওপর পড়ল। অর্থাৎ এমনিভাবে এই আলো দাদার চোখেও পড়ে। দাদা নিশ্চয়ই পাশ ফিরে শশায়। সে একটুখানি শুয়ে রইল দীপালি ওঠে কি না দেখতে। না, দীপালি এখনও ঠিক সেইভাবে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। কে জানে কতদিন ভালো করে ঘুমোয়নি! ব্যথায়, উৎকণ্ঠায়, শেষ পর্যন্ত ভয়ে! সে ছাতে বেরিয়ে এলো। আস্তে আস্তে চুল খুলতে খুলতে। এই সময়টা সাধারণত সে মুখ ধুয়ে রেওয়াজে বসে। ছাতের ওপর একটা মোটা কম্বল তার ওপর মায়ের বিয়ের গালচে পেতে। এরও আগে বসে যায়। কিন্তু আজকে মনের মধ্যে অনেক ভাবনা ঘোরাফেরা করছে। স্বপ্নগুলো তার স্পষ্ট মনে আছে। হঠাৎ অপালা একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে এলো।
সে তরতর করে নীচে নেমে গেল। মায়ের ঘরে দাদা ঘুমোচ্ছে। মা পাশ থেকে উঠে গেছে। অপালা দাদাকে ঠেলতে লাগল—‘দাদা! দাদা!’ প্রদ্যোৎ একটুখানি চোখ খুলে তাকে দেখল। বিয়ের ঠিক হওয়ার পর থেকে সে বোনের মধ্যে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে, মমতাও তার বেড়ে গেছে অনেক বেশি। সে পুরোপুরি চোখ খুলতে অপালা বলল—‘একবার ছাতে আসবি! কথা বলিস না। চুপ!’
প্রদ্যোৎ তার স্বভাবসিদ্ধ একটা মিথ্যা বিরক্তির ভান করে জামাটা গলিয়ে নিয়ে ছাতে উঠে এলো। চিলেকোঠার খোলা দরজা দিয়ে সে দাদাকে বলল —‘দ্যাখ! দ্যাখ্ না!’
—‘কী দেখব?’
দীপালি ঘুমোচ্ছ। পোশাক বদলানো হয়নি। পুরোপুরি পোশাক পরে সে ঘুমোচ্ছে। ঠোঁটের লিপস্টিক প্রায় মুছে গিয়ে ঠোঁট দুটিকে বাসি গোলাপের পাপড়ির মতো বিষণ্ণ করে রেখেছে। তার ফর্সা রঙ, সারা রাতের গাঢ় ঘুমের পর এখন সতেজ, সে সবসময়ে কাজল পরে থাকে। বোজা চোখ, কাজলের রেখাতে শুধু চোখের আকার দেখা যায়। বেণীটা তার বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে বুকের ওপর এসে পড়েছে এবং নিশ্বাস প্রশ্বাসের তালে তালে —উঠছে নামছে।
এই পর্যন্ত দেখে প্রদ্যোৎ বলল— ‘এটা কী করছিস অপু? ঘুমোচ্ছে ও। ওকে এভাবে চুপিচুপি দেখাতে ডেকেছিস আমাকে! তুই তো এতো অসভ্য ছিলি না আগে?’
অপালা বলল—‘দাদা, তুই আগে বল দীপুদি সুন্দর কিনা!’
প্রদ্যোৎ বলল, ‘দ্যাট ডিপেন্ডস্।’
—‘জবাব এড়াবার জন্যে ইংরিজি বলবি না খবর্দার। বল্ অন্তত আমার থেকে তো অনেক সুন্দর। বল্ বল্ না রে!’
—‘আমি জানি না। তোর চেয়ে ফর্সা, এই পর্যন্ত। এর চেয়ে বেশি আমি বুঝি না। এর মানে কি অপু?’
—‘আচ্ছা দাদা, দীপুদি আমারই মতো গান জানে। আমার চেয়ে ভালো গায় এক হিসেবে কারণ আধুনিক, নজরুলগীতি, রাগপ্রধান এসবে ও একেবারে সিদ্ধ। রেডিওতে গায়। জলসায় গায়।’
—‘তো কি?’
—আচ্ছা শিবনাথবাবুকে ওকে দেখিয়ে প্রোপোজ করা যায় না, উনি আমার বদলে দীপালিকে বিয়ে করুন। গান ভালোবাসেন, দারুণ গান-জানা বউ পাবেন, সুন্দরী বউ পাবেন। প্লাস ও অত্যন্ত গৃহকর্মনিপুণা, ওদের বাড়িতে কী লক্ষ্মীশ্রী তুই ধারণা করতে পারবি না। ভীষণ গুণী ওরা পাঁচ বোনেই। তার মধ্যে দীপুদি আবার বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর। ও বিয়ে করতেও খুব ইচ্ছুক। মাসিমা খুব পাত্র খুঁজছেন।’
প্রদ্যোৎ চোখ বড় বড় করে বলল— ‘অপু, তুই কি পাগল? বিয়ের আর এক মাসেরও কম বাকি আছে। এখন আমি পাত্রী-বদলের দরবার করব? দীপালি রাজি হবে কেন? শিবনাথদার বাড়ি থেকেই বা রাজি হবে কেন?’
—‘দীপুদিকে রাজি করার ভার আমার। আর ওদের বাড়ি থেকে নিশ্চয় রাজি হবে। দীপুদি কত ফর্সা দেখছিস না?’
প্রদ্যোৎ বলল— ‘অপু তুই যে কী ছেলেমানুষ, কোন ইউটোপিয়ায় যে বাস করিস! গান তো একটা আর্ট, দিবারাত্র তা চর্চা করেও তোর অনুভূতিই বা এতো ভোঁতা হয় কি করে আমি জানি না। ডোন্ট ইউ রিয়্যালাইজ দ্যাট শিবনাথদা ইজ ইন লভ্ উইথ ইউ? কালো-ফর্সা ও সব কোনও ব্যপারই নয়। ইট ইজ নট এ সিম্পল কেস অফ ম্যাট্রিমোনিয়াল সিলেকশন।’
অপালা একদম চুপ করে গেল। দাদা তখনও বলে চলেছে— ‘লভ্ ইজ নট সো ইজিলি অ্যাভেলেবল্ অপু। আমি বুঝতে পারছি তোর দিক থেকে কোনও রেসপন্স নেই। কিন্তু সেটা ক্রমে ক্রমে আসবে। আসতে বাধ্য। দ্যাট শিবনাথ দত্তগুপ্ত হত্যা ডেপ্থ্ অফ ক্যারেকটার। তা ছাড়াও দীপালিরা তো মিশ্র, ব্রাহ্মণ, হঠাৎ এই ধরনের অসবর্ণ বিয়ের প্রস্তাবে ওরা কান দেবে কেন? ওরাও তো জেঠুর মতোই গোঁড়া। তোর কি কালো-টালো বলেছে বলে ভয় করছে? রাগ-টাগ হয়েছে?’
অপালা কিছুই বলল না। আসলে পরিকল্পনাটা মাথায় আসার পর সে মুক্তির আনন্দে আকাশে সাঁতার দিচ্ছিল। দাদা তাকে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। যা তার কাছে এতো সহজ এতো সুন্দর সমাধান মনে হচ্ছে তা কেন অন্যের কাছে এতো অসম্ভব মনে হয়? সে বিয়ে করতে চায় না, অথচ তাকে এরা জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবেই। দীপুদি বিয়ে করতে চায়, এক্ষুনি হলে এক্ষুনি, অত যোগ্যতা, অত রূপগুণ থাকা সত্ত্বেও তার বিয়ে হবে না, হচ্ছে না।
সে বলল— ‘আমার জন্যে একটা কাজ করবি?’
—‘কি? তোর জন্যে তো একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছি?’
—‘আমি কদিন রোজ সোহমের বাড়ি যাবো। আমার ধারণা গান শুনলে ও ঠিক হয়ে যাবে। অন্তত আমার গান। বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত।’
—‘সর্বনাশ! তুই কি সোহমকে ভালোবাসিস নাকি?’
—‘নিশ্চয়! আমি সোহমকে দারণ ভালোবাসি। এতো ভালোবাসি আগে জানতুম না।’
—‘তাহলে তো ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল রে অপু!’
—‘না দাদা। তুই যা ভাবছিস, ঠিক তা নয়। সোহমকে আমি বন্ধুর মতো, এক পথের পথিকের মতো করে বোধহয় ভালোবাসি। কিন্তু ওকে ভালো করবার জন্যে যেটুকু আমার করা দরকার, সেটুকু আমায় করতে হবেই।’
প্রদ্যোৎ বলল— ‘অপু, তুই আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিস। তুই অবশ্য বরাবরই ভেতরে ভেতরে জেদী ছিলি। কিন্তু যা করবার চুপচাপ করতিস। খুব বেশি নিয়ম ভাঙতিস না। এখন তো দেখছি তুই মরিয়া হয়ে গেছিস। কোত্থেকে তোর এই চেঞ্জটা এলো?’
অপালা বিষণ্ণ হেসে বলল— ‘তোরা কি ভেবেছিলি তোরা একটার পর একটা নিজেদের গড়া সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিবি। এমন কি একজন সম্পূর্ণ বাইরের ভদ্রলোকের ইচ্ছেটাকেও আমার ওপর জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেওয়া হবে। তবু আমি বড় হবো না?’
প্রদ্যোৎ তার দিকে তাকিয়ে বলল— ‘ঠিক আছে দেখি আমি কি করতে পারি।’