গান্ধর্বী (Gandharbi) : 06
অফিস পাড়ায় সবে ঘর-ফিরতি ভিড় আরম্ভ হয়েছে। বাস-স্টপগুলোয় জটলা। এই সময়ে পথ-চলতি জনতার চেহারাটা সাইক্লোনের আকার নেয়। উত্তর-যাত্রী আর দক্ষিণ-যাত্রী, পূর্ব-যাত্রী আর পশ্চিম-যাত্ৰী জনতা পরস্পরের সঙ্গে যেন কাটাকুটি খেলে। রাস্তায় হকারদের উৎসাহ-উদ্দীপনাও এ সময়ে বহুগুণ বেড়ে যায়। গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় কাগজের কুমির চলতে থাকে। মাথায় পালকওলা পালোয়ান পুতুলদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ, ফোমের থলি, টি-শার্ট, বাহারী পেন, ঘড়ি, ছাতা ইত্যাদি পণ্য নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তার ওপরে ইভনিং শো সিনেমার খদ্দেরও জমতে থাকে। এই সমস্ত দিগ্বিদিক শূন্য জনতার মধ্য দিয়ে পথ কেটে কেটে এসপ্ল্যানেড পাড়ার একটি কাফেতে ঢুকল সৌম্যদর্শন যুবক। পর্দা-ঢাকা একটি ছোট কেবিনের মধ্যে ঢুকে সে বেয়ারাকে কিছু নির্দেশ দিল। পর্দার ফাঁক দিয়ে রেস্তোরাঁর প্রবেশ পথ দেখা যায়। যুবক অপেক্ষা করছে। আপাত দৃষ্টিতে ধীর। কিন্তু ঘন ঘন মুখ মোছা, ঘাড় মোছা, হাতের ভঙ্গি বদলানো ইত্যাদি থেকে বোঝা যাচ্ছে যুবকটি উত্তেজিত। খানিকটা অধৈর্যও। যুবক নির্ভেজাল গৌরবর্ণ। পরিষ্কার কামানো মুখ। চুল খুব ভদ্রভাবে উল্টে আঁচড়ানো। বাঁ দিকে সিঁথি। বয়স হয়ত ত্রিশ পার হয়নি, কিন্তু মুখের চেহারায় গাম্ভীর্যের সঙ্গে চিন্তাশীল মেজাজ দুটো মিলে তাকে আরেকটু বয়স্ক দেখায়। বঙ্কিমচন্দ্রের নায়ক যেমন ব্রজেশ্বর, নবকুমার কি গোবিন্দলালের ভূমিকায় একে বেশ মানাত। খুব সুপুরুষ দেখতে হলেও যুবকটি বোধ হয় তাড়াতাড়ি প্রৌঢ় হয়ে যাবে। কথা বললে দাঁত দেখা যায় না, এত ছোট ছোট এবং পরিপাটি সাজানো দাঁত। এই মুখগহ্বর চুপসে যায় তাড়াতাড়ি। মাথায় ঘন চুল, কিন্তু দু’পাশে পেছনে সরে গেছে। এই বিন্যাস অবধারিত ভাবে ভবিষ্যৎ টাকের লক্ষণ।
হঠাৎ যুবকটি চঞ্চল হয়ে উঠল। দুটি তরুণ-তরুণী ঢুকছে। দুজনেরই রোগাটে গড়ন। তবে তরুণটির চেহারায় ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যের লক্ষণ আছে। সে একটি টি শার্ট ও ট্রাউজার্স পরেছে। মাথার চুল ফুরফুরে, ঢেউ-খেলানো। মেয়েটি লাজুক, শান্ত। ক্ষীণাঙ্গী। হাতের তুলনায় মুখটি চকচকে। গালে একটা লাল আভা। খুব সম্ভব তার হালকা কমলা রঙের শাড়ির রং প্রতিফলিত হয়েছে মুখে। বড় বড় পল্লব-ঘেরা লম্বা টানা চোখ। নাক চাপা। ঠোঁটের পরিধি বেশ ছোট্ট। মাথায় অনেক চুল। সে দুদিকে দুটি বেণী পেছনে ঝুলিয়েছে। ভীরু কিশোরীর যেটুকু লাবণ্য, বা আকর্ষণ থাকে তার চেয়ে একচুল বেশি বা কম তার নেই। যুবকটি পর্দা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। একটা হাত তুলল। অতঃপর তিনজনেই পর্দা-ঢাকা কেবিনটার মধ্যে ঢুকল। তরুণ বলল—‘শিবনাথবাবু, আমার বোন আপনাকে কিছু বলতে চায়। ও খুব কম কথা বলে। চট করে নালিশ করে না। শান্ত এবং লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। সেই বোন যখন মুখ ফুটে তার ভবিষ্যৎ হ্যাজব্যান্ডের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চাইল, আমার মনে হল দিস মাস্ট বি ভেরি ভেরি ইস্পর্ট্যান্ট অ্যান্ড উই মাস্ট টেক হার সিরিয়াসলি। আপনার কী মনে হয়?’
শিবনাথ বলল—‘কী আশ্চর্য! নিশ্চয়! আপনি বসুন! অ্যাকচুয়ালি আমিও মনে মনে এইরকমই কিছু একটা চাইছিলুম…’
প্রদ্যোৎ বলল—‘তাহলে তো কথাই নেই। দুই বাড়ির কেউই যেন ঘুণাক্ষরে এই মিটিঙের কথা জানতে না পারেন। আমি বসছি না। আপনারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করুন। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুরে আসছি। তখন ওকে নিয়ে যাবো। ও কে সী ইউ।’
শিবনাথ কিছু বলবার আগেই প্রদ্যোৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল। শিবনাথ দেখল অপালার মুখ নিচু, সে ঘামছে। এই সেই মেয়ে যে রবীন্দ্রসদনে হল-ভর্তি শ্রোতার সামনে পণ্ডিত চন্দ্রকান্তর মতো ভারত বিখ্যাত সঙ্গীতকোবিদ ও ওস্তাদ গায়কের সঙ্গে বিতর্ক জুড়েছিল। যদিও তার মধ্যে আশ্চর্যভাবে কোনও অবিনয়, ঔদ্ধত্য অনুপস্থিত ছিল। বেয়ারাকে বলা ছিল। সে দুটো লস্যি এনে রাখল। শিবনাথ বলল—‘ঠাণ্ডা চলে তো? না অন্য কিছু বলব?’
অপালা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ঠিক আছে। তার সিঁথির দুপাশের আলগা চুল এবং কানের মাকড়ি দুলে উঠল। শিবনাথ জানে না সাহানা রাগিণীর শাস্ত্রীয় রূপ ঠিক কেমন। কিন্তু সেটা যা-ই হোক, এই মেয়েটিকে ‘সাহানা’ বলে মনে হচ্ছে। নরম, শ্যামল, চকচকে গায়ের রঙ, তাতে কমলা আভা। এইরকম কৃশাঙ্গী। বিরহিণী তাই ক্ষীণা। প্রসাধনরহিতা। এমনি নম্র, শান্ত, বিষণ্ণ।
সে বলল, ‘ঠাণ্ডাতে যদি সত্যিই কোনও ক্ষতি না হয় তো শুরু করুন। এই দেখুন, আমি কিন্তু আরম্ভ করছি।’
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ লস্যি পান করার পর শিবনাথ বলল—‘কি যেন বলছিলেন?’
অপালা মুখ তেমনি নিচু করেই বলল—‘আমি বিয়ে করতে চাই না, জেঠু, মা আমায় জোর করে…আপনি বলে পাঠান না যে আপনার পছন্দ হয়নি…।’
সামান্য তরল গলায় শিবনাথ বলল—‘আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি, সেটাই মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, না কি?’
—‘পছন্দের কথা নয়’ অপালা আপাদমস্তক কমলা রং হয়ে বলল—‘বিয়েটাই পছন্দ নয়। আমি এখন গান শিখতে চাই, গান করতে চাই।’
শিবনাথ বলল—‘গান শুনবো বলেই তো আপনাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাই। আর শুনতে হলে তো শিখতে দিতেই হবে। কী আশ্চর্য!’
—‘কিন্তু আমি অন্য কর্তব্য করতে হয়তো পেরে উঠব না। গান আমার অনেকটা সময় নিয়ে নেয়।’
—‘বাড়িতে কী কী করেন, একটু শুনি।’
—‘পড়াশোনা করি। কলেজ যাই। ঘরটর একটু-আধটু গুছিয়ে দিই। মায়ের রান্নায় সামান্য, খুব সামান্য সাহায্য করি, রবিবার-রবিবার একটু জামা-কাপড় কাচাকুচি করতে হয়।’
—‘বাস বাস। এর চেয়ে বেশি আপনাকে কখনও কিছু করতে হবে না। বাড়িতে আমার মা রয়েছেন। পিসিমা রান্নাঘরে আপনাকে ঢুকতে দেবেন কিনা সন্দেহ। ভীষণ শুচিবাই। বাবার দেখাশোনাও তাঁদের তদারকিতেই। আমার চাহিদা খুব সামান্য। আর আমার ছোট ভাই এখন এঞ্জিনিয়ারিং-এ সবে ঢুকেছে। বাড়িতে থাকেই না। দিদির তো দেখলেনই বিয়ে হয়ে গেছে। জামাইবাবু অসাধারণ গান-পাগলা। আপনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবেন তিনিই। অন দি আদার হ্যান্ড আপনি ভেবে দেখুন, আপনার জ্যাঠামশাই যেরকম কনজারভেটিভ দেখলুম তিনি আপনাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেনই। সে জায়গায় আপনি অনুকূল পরিবেশ পেতে না-ও পারেন।’
অপালা এবার চোখ তুলে তাকাল। তার গালে এখনও কমলার ছোঁয়া। মা বলেছিল রাজপুরের মতো দেখতে, মিথ্যে বলেনি। অপালার হঠাৎ খুব সাহস বেড়ে গেল। কলেজের বন্ধু মনীষাকে সে যে কথা বলেছিল সেই কথাটাই সামনে-বসা সুন্দরকান্তি যুবকটিকে বলল—‘আসলে আমি গান ছাড়া আর কিছুই তেমন করে মানে ভালোবাসতে পারি না।’
শিবনাথের মুখে চাপা হাসি খেলে গেল, সে চাপা গলায় বলল—‘ভয় নেই। আমাকে কম ভালোবাসলে আমি কিছু মনে করব না।’
—‘আপনি ছাড়াও আরও অনেকে থাকবেন…’
—‘আপনাকে দেখে তো ঠিক নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হচ্ছে না?’
এবার অপালার হাসির পালা।
শিবনাথ বলল—‘আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। যথাসম্ভব সামলাবার চেষ্টা করব।’
এই তন্বী শ্যামলা দীর্ঘকেশী মেয়েটি যখন তার লম্বা চোখ সামান্য খুলে তানপুরা হাতে মঞ্চের ওপর বসে থাকে, কণ্ঠ থেকে সুরের স্রোত ঝরতে থাকে তখন শিবনাথের ভেতরে এক ধরনের বিপ্লব ঘটতে থাকে। সে সুরলোকের ফাংশন ছাড়াও অন্য আসরে এর গান শুনেছে। সুরলোকে দিদি জামাইবাবুকে সে-ই ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
বেয়ারা কিছু মিষ্টি এবং নোনতা খাবার এনে রাখল। অপালা বলল—‘আমি আর কিছু খেতে পারব না। জোর করবেন না প্লিজ।’
শিবনাথ বলল—‘এগুলো যে অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। একটু মুখে দিন। নইলে আমাকে বক রাক্ষস হতে হয়।’
অপালা বলল—‘দাদা এসে গেলে বাঁচা যায়।’
—‘আমার সঙ্গ কি আপনার খুব অসহ্য লাগছে?’
—‘না, না, তা নয়।’ অপালা তাড়াতাড়ি বলল—‘আমি আসলে খাবারগুলোর কথা ভেবে বলছিলুম।’
শিবনাথ বলল—‘আপনাকে বলে রাখা দরকার—আমাদের বাড়িতে প্রকৃত সঙ্গীতানুরাগী বলতে আমি আর আমার জামাইবাবু, যিনি সেদিন আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। উনি গান রীতিমতো বোঝেন। দিদিও ওঁর সঙ্গে থেকে থেকে ভালোই বোঝে এখন। মা বাবা পিসিমা এঁরা কিন্তু গান বলতে কীর্তন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভক্তিমূলক, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, এইসব বোঝেন। লোকসঙ্গীতও তেমন অ্যাকসেপ্ট করতে পারেন না। আর কোনটা ডি. এল. রায় কোনটা রজনীকান্ত তা বোঝবার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। তবে গান শুনতে ভালোবাসেন। আমি শুনেছি আপনি স-বই গান। ওঁদের একটু এই জাতীয় গান দিয়ে খুশি করে দিলেই আপনার সঙ্গীতচর্চার পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। আমার ছোট ভাই বিশ্বনাথ হিন্দি ফিল্মি গান থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত পর্যন্ত স-বই পছন্দ করে। গানটাকে কেরিয়ার করতে আপনার কোনও বাধা হবার কথা নয়। তবে মধ্যবিত্ত সংসারের নিয়মকানুন মেনে। সে তো আপনাকে এখনও মানতে হয়, হয় না?’
অপালা মাথা নাড়ল।
‘পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করবেন তো?’
‘সুযোগ পেলে তো নিশ্চয়ই। গ্র্যাজুয়েট না হলে জেঠু হার্টফেল করবেন।’
‘আর আপনি নিজে?’
অপালা একটু ভেবে বলল—‘আমার নিজের খুব একটা এসে যায় না।’
শিবনাথ বলল—‘আমার সম্বন্ধে আপনার কিছু জানবার নেই?’
অপালা একটু লাজুক হেসে বলল—‘আপনি তো সবই বলে দিয়েছেন।
‘সে কি? কী বললাম?’
অপালা টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল—‘শুধু গান শুনে কাউকে পছন্দ করবার ব্যাপারটা আমার একটু অদ্ভুত অবাস্তব লেগেছে। গান তো কোনও কাজে লাগে না!’
শিবনাথ কি বলবে ভেবে পেল না। তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—‘গান আপনাকে ভীষণ সুন্দর করে, আমি সেই সৌন্দর্যে অভিভূত। শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু সেই তানপুরাবাদিনী সুকণ্ঠী মূর্তিই ভাসছে।’ কিন্তু কথাগুলো সে বলতে পারল না। তার বদলে বলল—‘জীবনটা তো শুধু কাজ নয়!’
‘জীবনটা তাহলে কী? আপনার কাছে?’
অপালার মতো লাজুক, মুখচোরা মেয়ের কাছ থেকে হঠাৎ এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না শিবনাথ। সে বলল—‘মুশকিলে ফেললেন। এক কথায় কি এমন শক্ত প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়? আর এখন এই মুহূর্তে আমি কি ঠিক করে ফেলতে পেরেছি জীবনটা আমার কাছে কী? ঠিক আছে প্রশ্নটা আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আপনার কাছে জীবনটা কী?’
অপালা শিবনাথের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—‘আমার কাছে তো জীবনটার অর্থ খুব সহজ। ধরুন ভৈঁরো থেকে ললিত, ললিত থেকে রামকেলী, রামকেলী থেকে পরজ, পরজ থেকে আলাহিয়া বিলাবল…’ বলতে বলতে সে হেসে ফেল।
শিবনাথও হাসছে।
এই সময়ে প্রদ্যোৎ এসে ঢুকল। দুজনের হাসি মুখের দিকে চেয়ে বলল—‘বাঃ। দেখে যেন মনে হচ্ছে মিঞাবিবি রাজি! এক্সপিডিশন তাহলে সাকসেসফুল। কংগ্রাচুলেশনস শিবনাথদা। কংএ্যাট্স্ অপাই!’