গান্ধর্বী (Gandharbi) : 05
সামনে ব্যাকেলাইটের হাতল-ওলা কফির পট। দুটো কাপে মাপমতো কফি এবং দুধ ঠিকঠাক ঢালতে ঢালতে দীপালি বলল—‘সোহম সত্যি তুমি এটা জানতে না? না ন্যাকা সাজছ?’
—‘হোয়াট ডু ইউ মীন? ন্যাকা সাজছি মানে?’
—‘সরি। কিন্তু আমার ধারণা বিশ্বশুদ্ধু লোক জানে।
—‘অপালা জানে না।’
—‘অপালার কথা ছেড়ে দাও। সে কারও কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপারে থাকে না। একটা পুরোপুরি মানুষই না। কিরকম নন-হিউম্যান মেয়ে।’
—‘আই অবজেক্ট দীপালি।’
—‘আমি আসলে ঠিক তা বলতে চাইনি। ও আসলে নিজের গান নিয়ে এমন মশগুল থাকে যে অন্যসব ব্যাপার ওর নজর এড়িয়ে যায়। একেবারে ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ড। যাই হোক, টেক ইট ফ্রম মি। মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী। অথাৎ মিতুলের মা মাস্টারমশাইয়ের এক শিষ্যের সঙ্গে ইলোপ করেছিলেন। মিতুল তখন জাস্ট পাঁচ বছরের মেয়ে। এর চেয়েও ইন্টারেস্টিং গল্প আমার জানা আছে। মিতুলের মার এই ফার্স্ট ইলোপমেন্ট নয়। উনি প্রথমে ছিলেন মাস্টারমশাইয়ের গুরুজীর স্ত্রী। মিতুল তাঁরই মেয়ে। মাস্টারমশায়ের যখন ফর্ম পড়তে শুরু করেছে, তখনই উনি দ্বিতীয়বার ইলোপ করলেন এক উঠতি বাজিয়ের সঙ্গে। বেশ এলেমদার মহিলা।’
—‘বলো কি?’ সোহম আত্মগত বলল, কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে।
—‘মিতুল জানে?’
দীপালি কাঁধ নাচাল। —‘কি করে জানবে বলো। ষোলো বছর বয়স তো হলই!’
কানাঘুষোও তো শোনে! মিতুলের মায়ের ছবি কোথাও দেখেছ?’
—‘না। তা অবশ্য দেখিনি।’
—‘অস্বাভাবিক মনে হয় না?’
—‘হয়নি কখনও। অনেকের থাকে মৃত স্ত্রীর ফটো দেখলে কষ্ট হয়। আমার বাবাই তো মায়ের ছবি নিজের ঘরে রাখেন না। আমার ঘরে টাঙানো আছে। দেখেছ তো?
মাস্টারমশায়ের তো তবে খুব কষ্ট।’
—‘দ্যাখ্ সোহম, কিছু মনে করিস না। গল্পের প্রথম অংশটা যদি সত্যি হয়, তাহলে উনি নিজের জালে নিজে জড়িয়েছেন। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। লোকে তো বলে ওঁর সেই রাইভ্যাল নাকি ওঁকে সিঁদুর খাইয়েছিল। তাইতেই ওঁর গলা নষ্ট হয়ে যায়।’
—‘সিঁদুর?’
—‘হ্যাঁ সিঁদুর। সিঁদুর বিষ। খেলে স্পেশ্যালি গলার বারোটা বেজে যায়।’
—‘এসব তুমি জানলে কোত্থেকে?’
—‘আমাদের গানের বাড়ি। আমি গান শেখাচ্ছি পনের বছর বয়স থেকে। দিদিও নাচ নিয়ে আছে। গান-বাজনার লাইনের অনেক কেলেঙ্কারি, অনেক কেচ্ছাই আমার জানা। সামনে দেখছি, আহা কী গুণী, কী সাধুপুরুষ, শিবনেত্র হয়ে আছেন। দিলের সব দরদ মিশিয়ে ছাত্র-ছাত্রী গড়ছেন, ভেতরে ভেতরে দেখবে কে কবে কাকে ফুসলিয়ে এনেছেন। কে শিষ্যাদের কারো কারো ওপর কুনজর দিচ্ছেন, কিছু পাওয়া গেলে ভালো, না পাওয়া গেলে তুমিও আর কিছু পাচ্ছো না গুরুর কাছ থেকে।’
সোহম ভীষণভাবে চমকে উঠল—‘কী বলছো? দীপালি? কী বলতে চাইছো?’
—‘তোমরা আর কী বুঝবে? আমরা বুঝি। আমরা জানি। ইন ফ্যাক্ট, আমাকে উনি প্রায় কিছুই শেখান না। ব্যাক করেন না। রাগে। বোঝ না?’
—‘উনি কি তোমাকে…’
দীপালি বাধা দিয়ে বলে উঠল—‘এসব কেউ সোজাসুজি বলে না সোহম, ঠারে-ঠোরে চায়। প্লীজ আমাকে এ নিয়ে ঘাঁটিও না। কী দরকার? আমি ফেড আপ হয়ে গেছি।’
সোহম ইতস্তত করে বলল—‘তুমি কি বলতে চাও অপালা ওঁকে কোনভাবে খুশি করে?’
—‘আমি কিছুই বলতে চাই না সোহম। শুধু আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যতটুকু বুঝেছি বলছি। আর আমার অভিজ্ঞতাটা নেহাত ফ্যালনা নয়। অপালা আমার চেয়ে অনেক বেশি ট্যালেন্টেড—একথা আমি একশবার স্বীকার করছি। সেটা একবারও কোয়েশ্চন করছি না। কিন্তু এটা তো মানবে দ্যাট শী ইজ প্লেইন… লুকিং! আমার অভিজ্ঞতা আর ওর অভিজ্ঞতা এক হতে পারে না। মানো তো?’
সোহম অন্যমনস্কভাবে কফির কাপটা নামিয়ে রাখল। অপালাকে দেখতে ভালো, কি ভালো নয় এ প্রশ্ন তার মনে কখনও ওঠেনি। অপালার সঙ্গে সে একসঙ্গে গান শিখছে রামেশ্বর ঠাকুরজীর কাছে তা প্রায় আট দশ বছর তো হবেই। শিখতে শিখতেই বালক-বালিকা থেকে তরুণ-তরুণী হয়ে উঠেছে। অত ছোট থেকে কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশলে তার চেহারা সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠা খুব শক্ত। তাদের সব সময়েই ভালো লাগে। সোহম তাই চোখের সামনে শূন্যের ওপর অপালাকে দেখবার চেষ্টা করল। ছোট কপাল। একপাশে সিঁথি কেটে একটা খুব লম্বা মোটা বেণী করে অপালা। ওর বাড়ি গেলে ওকে খোলা চুলে দেখা যায়। পুরো পিঠ জুড়ে বেশ কালো চুল। তাতে বোধহয় একটু বাদামির মিশ্রণ আছে। খুব লম্বা না হলেও অপালার চেহারাটা লম্বাটে। সেন্টিমিটারে কতটা আসবে, কল্পনার চোখে দেখে বলা যাচ্ছে না। কালো? হ্যাঁ সোহমের নিজের পরিবার, দীপালি, মিতুল, এদের সবার সঙ্গে তুলনায় অপালা বেশ কালো। কালো? তা সে যতই কালো হোক, অপালাকে কোনদিন খারাপ লাগেনি। সোহম হঠাৎ লজ্জিত হয়ে অনুভব করল সে অপালার শরীরের উচ্চাবচতা আবিষ্কার করবার চেষ্টা করছে। মাথাটা একটু নেড়ে নিজেকে নাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে সে একটু ঝাঁঝাল গলায় বলল—‘ওসব বাদ দাও তো!’
—‘বাদ তো দেবই! আমার যে জিনিসটা খারাপ লাগে সেটা হল, মিতুল তো ওই মায়েরই মেয়ে! যে মা দু দুবার ইলোপ করেছে! দ্বিতীয়বার একটা পাঁচ বছরের মেয়ে ফেলে! মিতুল কিরকম চঞ্চল দেখেছো?— মাস্টারমশাইয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কিরকম ভাবে মেশে! এর গলা জড়িয়ে ধরছে। ওর চুল টেনে দিচ্ছে। তাকে ভেঙাচ্ছে!’
সোহম দেখেছে। চাঞ্চল্যটা মিতুলের এক ধরনের আকর্ষণ! ভারী ছটফটে। ভারী ফাজিল।
দীপালি বলল—‘ও আবার না মায়ের মতো পালায়! বাড়িতে তো বাবা ছাড়া কেউ নেই। বাবারা মেয়েদের কতটুকু বুঝতে পারে! দলে দলে ছাত্র আসছে যাচ্ছে। কত ছেলে বাপরে বাপ! দিলীপ সিন্হাকে দেখেছ? কনটেসা চড়ে আসে? ওদের এক্সপোর্টের ব্যবসা, অনেক বড়লোককে সেভর্যাল টাইমস্ কিনে নিতে পারে। সরোদিয়া। এদিকে মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। ফার্স্টক্লাস পাচ্ছে। চেহারাও দারুণ। ছোট থেকে সিলভার-টনিক খাওয়ার চেহারাই আলাদা। ওর বাজনা শুনেছো? পুরো গোয়ালিয়রের ঘরের বাজনা। দা-রুণ। তবু মাস্টারমশায়ের কাছে আসছে। আরও ভ্যারাইটি, আরও ডিফারেন্ট গতের জন্য। শুনেছো ওর বাজনা?’
—‘শুনেছি। ভালো বাজায়।’
—‘মিতুল তো শুনছি ওর কাছে আজকাল তালিম নিচ্ছে। মাস্টারমশাই নাকি বলেছেন মিতুলের ভোক্যাল হবে না। ও যন্ত্র ধরুক। সরোদ—না সেতার ধরছে। তোমায় বলেনি? হয়ত ওর সঙ্গেই…’
সোহম প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। সে আনমনে কফি ঢেলেই যাচ্ছে।
দীপালি বলল—‘সোহম, আমরা টেবিলটা অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। বেয়ারাটা বড্ড ঘোরাফেরা করছে। চলো আমরা ময়দানের দিকে গিয়ে একটু বসি।’
সোহম হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল—‘ময়দান-ফয়দান ভালো লাগছে না। ওঠা যাক।’
দীপালি বলল—‘আমাদের বাড়ি যাবে? কিম্বা যদি বলো তোমাদের বাড়ি।’
—‘বাড়ি? বাড়ি-টাড়ি নয়।’ সোহম মাথা নাড়ল, এত জোরে যে দীপালি একটু অবাকই হয়ে গেল।
সোহম হঠাৎ প্রায় লাফ দিয়ে উঠে কাউন্টারে গিয়ে বিলটা ঢুকিয়ে দিল। দীপালি পেছন পেছন আসছিল। তার দিকে সামান্য ফিরে সোহম বলল—‘আচ্ছা দীপু চলি। পরে দেখা হবে, একটু কাজ আছে।’ সে এমন হন হন করে এগিয়ে গেল যে দীপালি তাকে ধরবার চেষ্টাই করতে পারল না।
গোধূলি শেষ হয়ে গেছে। প্রথম সন্ধের অন্ধকারে বিজ্ঞাপনের আলোগুলো জ্বলছে নিবছে। এই সময় থেকে আরম্ভ করে চৌরঙ্গি সুন্দরী হতে শুরু করে। পাশে একজন পুরুষ-বন্ধু নিয়ে এই সুন্দরী চৌরঙ্গির পেভমেন্ট দিয়ে পথ চলাও যে কী আরামের, কী তৃপ্তির, কত নবজীবনদায়ী হতে পারে! দীপালি কখনও অসহায় নয়। শৈশবে পিতৃহীন। তারা পাঁচ বোন এবং মা এই ছ’জন নারী মিলে তছনছ হয়ে-যাওয়া সংসার দাঁড় করিয়েছে। অসম সাহসে। বাবা এসরাজ বাজাতেন। মার্চেন্ট অফিসের কর্মী হলেও গান-বাজনার জগতের সঙ্গেই তাঁর দহরম-মহরম ছিল বেশি। সংসারে অনেক রকম উল্টোপাল্টা লোক এসেছে। বাবা মারা যাবার পর বহু লোক সুযোগ নিতে চেয়েছে। তারা বোনেরা মাকে রক্ষা করেছে, মা রক্ষা করেছে তাদের। কিন্তু রক্ষা-করার কাজটা ঠিক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। একেবারেই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। দীপালি, ছাইয়ের মতো মুখ নিয়ে মনুমেন্টের দিকে তাকালো। শহীদ মিনার। চৌরঙ্গির যে কোনও কোণে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালেই ওই শহীদ-মিনারের চুড়োটা চোখে পড়ে। এতো ভিড় তবু একলা। এতো মিছিল, এতে বক্তৃতা, তবু শান্ত। এই সগর্জন জীবন-মত্ততার ভেতরে শহীদ-মিনার নিশ্চুপ। সোহম কোনদিকে গেল? যদি দক্ষিণের বাসে উঠত তো অনায়াসেই তাকে সঙ্গে নিতে পারত, আর যদি উত্তরে কিম্বা পূর্বে কিম্বা পশ্চিমে যাওয়ার থাকত সে তো দীপালিকে বলে যেতে পারতো! দীপালির সঙ্গে তার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। এমন কী গোপন প্রয়োজন যে ওইরকম লাফ দিয়ে চলে যেতে হবে? দীপালির সঙ্গ কি তার সহ্য হচ্ছিল না? এত দিন তো বেশ সহ্য হচ্ছিল! দীপালির সঙ্গ পেলে অনেকেই তো কৃতার্থ হয়ে যায়! মিষ্টি গলা, কথা বলে সুন্দর, দেখতে নয়ন শোভন। পোশাক পরিচ্ছদ রুচিসম্মত, খবরাখবরও রাখে যথেষ্ট। আজকাল সে নাভির ঈষৎ নীচে নামিয়ে শাড়ি পরতে শুরু করেছে। কিন্তু বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। শাড়ি হাওয়ায় উড়লে, স্বচ্ছ আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদের মতো তার পরিষ্কার নাভিমণ্ডলী দেখা যায়। আর নাইলন ডেক্রন ইত্যাদি কৃত্রিম সুতোর কাপড় পরলে পাতলা মেঘের আস্তর-ঢাকা চাঁদের মতো দেখায়। নিজেদের আলমারির লম্বা আয়নায় শাড়ি পরবার সময়ে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই শোভা দেখে। সত্যি কথা বলতে কি নিজে নিজেই মস্ত্ হয়ে যায়। দীপালি চন্দন-আতর ব্যবহার করে খুব একটুখানি, দুই কবজির ওপর এবং তুলোয় একটু আতর ঢেলে বুকের খাঁজে রেখে দেয়। একদিন এভাবে রাখলে দুতিনদিন অনায়াসে চলে যায়। মৃদু চন্দনের সুগন্ধ তাকে সবসময়ে ঘিরে থাকে। দীপালির ভেতরে ভেতরে কান্না পাচ্ছিল। অপমানের কান্না। হতাশার কান্না। তার চেয়েও দুর্বোধ্য কিছু একটা তার বুকের ভেতর থেকে কান্নার আকারে ঠেলে ঠেলে উঠছিল। চন্দনের গন্ধটা তার এতো অসহ্য লাগছিল যে বুকের ভেতর থেকে তুলোর টুকরোটা বার করে সে মিউজিয়ামের এক পাশে পেভমেন্টের ওপর ফেলে দিল। কোথায় যাবে সে এখন? আজ, মাত্র আজ, এই শুক্রবার দিনটা তার পূর্ণ ছুটি। আজ সে যা খুশি করতে পারে। সোহমকে টেলিফোন করে আজকের পুরো সন্ধেটা তার সঙ্গে কাটাবার পরিকল্পনা করে সে এসেছিল। সে আজ পরিপূর্ণ গোলাপি। অনেক কিছু না পেয়ে পেয়ে এবং সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায় অনেক কিছু করতে পেরে তার আত্মবিশ্বাস, দম্ভ, জেদ, উচ্চকাঙ্ক্ষা সবই এখন তুঙ্গে। তার মনে হল সোহমকে ঠিক এই মুহূর্তে আর একবার দেখতে না পেলে সে মরে যাবে, এখনই তার বুক ফেটে যাচ্ছে। এখন সে পরিষ্কার চিন্তাও করতে পারছে না। সোহমের চিবুকের ভাঁজটা, উঃ কেন ভগবান এরকম ভাঁজ তৈরি করেন, সোহম হাফ-হাতা শার্টও একটু গুটিয়ে পরে। বাইসেপ্স্ না ট্রাইসেপ্স্ সে সব বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। সান্ধ্য চৌরঙ্গির সমস্ত বিজ্ঞাপনের আলো, ব্যানার, চলমান জনতা কিছু নেই, কিচ্ছু নেই, আছে খালি সোহমের গুটনো হাতার তলা থেকে দৃশ্যমান স্ফীত মাস্ল্। তার জামার ওপরের বোতাম খোলা, তার মধ্যে দিয়ে সরোদের জমজমার মতো রোম! একটা অন্ধ তাড়না ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে জোয়ারের স্রোতে তাকে যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
তবে কি অপালা? সোহম কি অপালার বাড়ি গেল? দীপালি রাস্তা পার হল। নর্থের বাসে তুমুল ভিড়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ডিপো থেকে একটা গ্যালিফ স্ট্রীটের ট্রাম ধরল। একটু ঘুরে ফিরে যাবে, তবু যাবে তো? আজকে রাত ঘন হবার পর সোহমকে তার একবার দেখাই চাই। তারপরে অনেক রাতে, নিজের ঘরে, বোনেদের সঙ্গে ভাগের বিছানায় সে ঘুমের ঘোরে সোহম চক্রবর্তীর সঙ্গে পিলু বারোঁয়া হয়ে যাবে। সোহম যখন তার ভরাট পুরুষালি গলায় গায়, দীপালি তার নিজের আসনে বসে মন্ত্রমুগ্ধ মৃগীর মতো নিস্পন্দ হয়ে থাকে। সোহম তার বিলম্বিত বিস্তার পেরিয়ে হঠাৎ বিনাভূমিকায় হলক তান আরম্ভ করে দেয়। অমনি দীপালির শিরা-উপশিরায় ঝলকে ঝলক নীল রক্ত ছুটতে শুরু করে হৃৎপিণ্ডের দিকে, সোহম অভিমুখে। সোহম যদি ঠুমরি বা গজল ধরে, দীপালি সেখান থেকে চলে যায়, কারণ প্রচণ্ড আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ, চোখের জলে তার মুখ প্লাবিত, ‘তোরে দেখনে কো জিয়া লাল চায় সজনোয়া!’ সে যে এত লোকের মাঝখানে সোহমের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছে না, সেই কারণে সমস্ত উপস্থিত জনমণ্ডলীকে তার স্লেটের ওপর স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে। অর্থহীন, বিদ্যুৎ-হীন মুখ সব। অপ্রয়োজনীয়। কেন আছে ওরা? শুধু কতকগুলো নীরস পাথরের দেয়ালের মতো! যাতে সে এইসব বাধা পেরিয়ে সোহমের কাছে পৌঁছতে না পারে!
ট্রামে একেবারে কোণের দিকের লেডিজ সিটটা সে পেয়েছিল। ডান দিকে তাকালেই সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীদের দেখা যায়। দীপালি তার ব্যাগ খুলে গোগো সানগ্লাস পরে নিল, যদিও সূর্য নেই, রোদ নেই। গগল্সের তলায় সে রুমাল চেপে ধরল। গরম চোখের জল শুষে নিতে লাগল টার্কিস তোয়ালের টুকরো। তার মেজাজ এখন তার সপ্তকের ধৈবতে। আস্তে আস্তে নিখাদের দিকে উঠছে, তীব্র, তীব্রতর নিখাদ। যেখানে সোহম, তার সোহম। এতে তীব্র, তপ্ত, এতে ক্ষিপ্ত এ ছুট তান যে ট্রামের সিটে মাথা কুটতে চাওয়া শরীর মনটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দীপালির সমস্ত দম ফুরিয়ে গেল। সে যখন অপালাদের কীর্তি মিত্র লেনের বাড়িতে পৌঁছলো তখন সে একটা মাঝদুপুরের ঝলসানো পাতা, কিম্বা সম্পূর্ণ নিংড়ে নেওয়া গামছা, শক্তিহীন, দীপ্তিহীন, অবসন্ন। সুজাতা তাকে এ সময়ে দেখে অবাক হয়ে বললেন ‘আরে! দীপালি। এতো রাতে? অপাই ছাতে আছে। খুব ভালো হয়েছে তুমি এসেছে। আজ কিন্তু খেয়ে যাবে।’
অপুর মার আতিথ্য এইরকমের। সন্ধে পেরিয়ে গেছে, অতএব খেয়ে যাবে। আয়োজন হয়ত খুব সামান্যই। কিন্তু অসামান্য তাঁর হাতের গুণ আর আন্তরিকতা।
দীপালি বলল—‘আর কেউ আসেনি?’
—‘কে আসবে আর? কেউ না।’ দীপালির মুখে যেটুকু আলো ছিল, এবার তা এক ফুৎকারে নিভে গেল। অপুদের বাড়ির ছাতে যাবার উৎসাহ আর বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখন তো আর পিছোনো যায় না। সে আস্তে আস্তে উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠল।
ছাতের এক কোণে পাঁচিলের ওপর বসানো ফুলের টবের ওপর হাত রেখে অপালা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার ঈষৎ ঢেউ খেলানো চুল আবাঁধা, পিঠের পেছনটা অন্ধকার। সামনেও অন্ধকার। তারার আলোয় শুধু মুখের আদলটুকু দেখা যায়।
কাছে গিয়ে দীপালি বলল—‘এ কি রে অপু, তুই কাঁদছিস?’
—‘না তো!’ অপালা মুখ ফেরালো। তারার আলো পড়ে তার গাল চকচক করছে, নাকের ডগাটাও। কিন্তু এখনও দীপালির মনে হল অপালা কাঁদছে। কান্না তো এক রকমের হয় না। মল্লার কত রকম আছে, সারং কত রকম আছে, কান্না কেন এক রকমের হবে! দীপালি নিজেও তো এখন কাঁদছে, গরম চোখের জলে তার আপাদমস্তক নোনা, অপু কি দেখতে পাচ্ছে? সোহম কি বুঝতে পারছে?
দীপালি বলল—‘কি খবর রে অপু? কবে যাবি ঠিক করলি?’
—‘কোথায়?’ অপালা জিজ্ঞেস করল।
—‘লখনৌ, আবার কোথায়? তুই না বললেও খবরটা আমাদের কানে এসেছে।’
অপালা একটু চুপ করে থেকে বলল—‘যাবো। তবে লখনৌ নয়, হরিশ মুখার্জি রোডের কাছে একটা কি রাস্তা, বেণীনন্দন না কি, তোরা ভালো বলতে পারবি।’
—‘কেন, সেখানে আবার কোন ওস্তাদ থাকেন? একজন নাম-করা সেতারী থাকেন। তুই কি তাঁর কাছে শিখবি? তুই নাজনীন বেগমের স্কলারশিপটা নিবি না?’
—‘কোনও স্কলারশিপই নিচ্ছি না দীপুদি। ওই গলিটাতে আমার বিয়ে হচ্ছে।’
—‘বিয়ে?’ দীপালি আকাশ থেকে পড়ল। ‘তোর বিয়ে? কোনদিন ভাঙিসনি তো?’
—‘আমি নিজে জানলে তো ভাঙব। জেঠু ঠিক করে ফেলেছেন। হঠাৎ। কে ভদ্রলোকের নাকি আমার গান শুনে খুব ভালো লেগেছে। জেঠু অ্যাডাম্যান্ট।’
—‘এ তো খুব ভালো কথা রে অপু!’
—‘তুইও এ কথা বলছিস দীপুদি?’
দীপালি মৃদুস্বরে বলল—‘কি জানি, আমি তো বিয়ে হলে বেঁচে যাই।’ অপালা চুপ করে রইল।
দীপালী বলল—‘বলছিস গান শুনে পছন্দ করেছে, সেখানে তোর গানের অসুবিধে তো হবে না! লখনৌ-এর অফারটা হয়ত অ্যাকসেপ্ট করতে পারবি না এখনই। কিছু মনে করিস না অপু, তোর মতো বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় সৌভাগ্য মেয়েদের আর হতে পারে না। সে স্কলার মেয়েই হোক আর সঙ্গীতপ্রভাকরই হোক।’
অপালা যেন দীপালির কথাগুলো শুনেও শুনল না। আস্তে আস্তে বলল—‘একটাই আশা। ভদ্রলোকের মা বাবা নাকি বলেছেন বড্ড রোগা আর কালো।’
দীপালি হেসে ফেলল, বলল—‘এটাকে একমাত্র আশা বলছিস?’
অপালা দূরের দিকে তাকিয়ে বলল—‘নাজনীন বেগমের কাছে ঠুমরির তালিম নেওয়ার আশা বোধ হয় নেই। সে এ-বিয়ে না হলেও না।’
দীপালি বলল—‘নাজনীন বেগমের কাছে তালিম না নিলেও তুই ঠুমরি খুব ভালো গাস। সুরলোক যদি ঠুমরির আইটেমটা রাখত, তোর ফার্স্টা প্লেস কেউ হাজার পলিটিক্স করেও আটকাতে পারত না। অত ভেঙে পড়ছিস কেন?’
অপালা বলল—‘শুধু তো বেগমের কাছে তালিম না। দিবারাত্র একটা গানের আবহাওয়ার মধ্যে বাস করার অর্থ বুঝিস দীপুদি! শুধু ওঁর গান রোজ শুনতে পাবো তাই নয়, গানটা কি ভাবে তৈরি হয়ে উঠছে বুঝতে পারবো, ওঁর সাধনার সঙ্গে মিশে যাবো। আরো কত গুণী নিশ্চয়ই আসবেন, আসেন শুনেছি। তাঁদের গান টিকিট কেটে কনফারেন্সে শোনা যায় না। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও হয়ত কেউ অলৌকিক প্রতিভাধর থাকতে পারে যার সঙ্গে শিখে ধন্য হতে পারতুম। আচ্ছা দীপুদি, তওয়ায়েফ না তয়ফাওয়ালী কী রে?
দীপালি বলল—‘তুই বড্ড ছেলেমানুষ অপু, অন্য কেউ হলে তোকে ন্যাকা বলত। তওয়ায়েফ আর কি, গানবাজনাই যাদের প্রফেশন, বড় বড় রাজবাড়িতে জমিদার বাড়িতে মুজরো নেয়। সর্ট অফ বাইজি আর কি! তবে সাধারণ বাইজিদের সঙ্গে এদের একটু তফাত আছে। এরা উচ্চ মানের গান নাচ করে। বড় বড় ওস্তাদদের সঙ্গে সমানে সমানে। তুই গহরজানের নাম শুনিসনি? গহরজান, মালকাজান। এরাও অন্য বাইজিদের মতো দুর্দান্ত ফ্লার্ট করতে পারে, কিন্তু যার তার কাছে পয়সার বদলে দেহ দেয় না।
অপালা ভীষণ শিউরে উঠল, বলল—‘নাজনীন বেগম কি তাই ছিলেন?’
—‘বোধ হয়। শুনেছি উনি যখন সবে আসরে বার হতে শুরু করলেন রূপে আর গানে তামাম হিন্দুস্তান লিটর্যালি পাগল হয়ে গিয়েছিল। তারপর বম্বের কোন ঘরোয়া উৎসবে গান করতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশের কে এক রাজকুমারের সঙ্গে আলাপ হয়। বছর পাঁচেক ওঁর পেছনে লেগে থেকে থেকে ভদ্রলোক অবশেষে ওঁকে বিয়ে করেন। এর জন্য বোধ হয় ভদ্রলোককে ওঁর পরিবারের ত্যাজ্য-ট্যাজ্য হতে হয়েছে। খেতাবও ব্যবহার করেন না। এস্টেট না-ই রইল। বিজনেস ম্যাগনেট। টাকার পাহাড়ের উপর বসে আছেন। নাজনীনের কোনও সাধ নাকি অপূর্ণ রাখেননি। ইস্স্ অপু তোর আমার যদি এইরকম একটা বিয়ে হত! বছরে ছ মাস ইয়োরোপ, আমেরিকা, হংকং, সিঙ্গাপুর, আর ছ মাস নিজের মহালে বড় বড় গুণী ওস্তাদদের নিয়ে গান-বাজনা-নাচনা। তবে তোর আর তো গান শুনেই মুগ্ধ। তুই হয়ত ছোটখাটো নাজনীনই হতে চলেছিস!’
অপালা হাসল, বলল—‘বেণীনন্দনের নাজনীন? ভালো বলেছিস!’
—‘তবু তো কিছু একটা হচ্ছে। জীবনটা এগোচ্ছে। আমায় দ্যাখ। নাজনীন-টিনের মতো সুন্দরী না হলেও লোকে বলে আমার নাকি গ্ল্যামার আছে। কত ছেলে আমার পেছনে ল্যা-ল্যা করে ঘোরে, সে তো আমিও জানি। কিন্তু নোবডি ইজ এ রাজকুমার। নোবডি ইজ সিনসিয়ার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যাচ-কে-ব্যাচ পার করে যাচ্ছি। গাধা পিটে পিটে ঘোড়া করার নিরর্থক চেষ্টায় দ্যাখ জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা কেটে গেল। এ যে কী শূন্যতা…নাঃ তুই বুঝবি না।’
—‘কেন রে দীপুদি, মাস্টারমশাইও তো সব সময়ে শেখাচ্ছেন, ওই রকম ব্যাচ-কে-ব্যাচ। ওঁর তো ওরকম কিছু মনে হয় বলে বুঝি না!’
—‘আরে উনি তো ছাত্র-ছাত্রী পাচ্ছেন অপালা মিত্র, দীপালি মিশ্র, সোহম চক্রবর্তী, দিলীপ সিনহা, সৌম্যকান্তি বিশ্বাস…এদের। আমার মতো গা টিপলে ধা বলে এমনি মাল নিয়ে কি ওনার কারবার?’
সোহমের নামটা মুখে আনতে পেরে দীপালির বুকের ভেতরের আটকানো পাথরটা যেন ধস-এর মতো নেমে গেল। ভেতরটা তার থরথর করে কাঁপছে। এতক্ষণে ভালো করে চাঁদ উঠেছে। একটা বাড়ির চিলেকোঠার পেছন থেকে একটু তোবড়ানো ফুটবলের মতো গোলগাল চাঁদ। সেই আলোতে দুজনেই দুজনকে আরও স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে।
অপালা বলল, ‘সেদিন তো আমি চলে এলুম, তুই কী গাইলি রে? আর সোহম?’
—‘আমার কথা ছেড়ে দে। গাইলুম খম্বাজ। চার্মিং রাগ বলে। থেকে থেকেই তিলং এসে যাচ্ছিল। নিজেই বুঝতে পারছি বিস্তার করতে করতে ধা বাদ যাচ্ছে মধ্যমে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি সমানে। ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ইনট্রুড করছে থেকে থেকে। কেউ একটা প্রশ্ন করল না। গানের শেষে প্রথামাফিক হাততালি।’
—‘তোর এতো আধুনিক আর নজরুলগীতি গেয়ে গেয়ে আর শিখিয়ে শিখিয়ে এই অবস্থা হয়েছে দীপুদি। তুই একটু রেওয়াজ করিস না, করিস?’
—‘দ্যাখ, অপু, আর কেউ না জানুক, কিন্তু তুই ভালো করে জানিস এ ছাড়া আর আমার উপায় নেই। এসব ছেঁদো কথা বলে কি লাভ? আমার কথা বাদ দে। গেয়েছে সোহম। সাংঘাতিক! তুই থাকলে মূর্ছা যেতিস। শাংকরাই গাইল। ফৈয়জ খাঁ সাহেবকে আর একটু মোলায়েম করে নিলে সোহমকে পাওয়া যাবে। এতো ম্যাস্কুলিন। সাদিক যে ওর ওই কালারলেস ‘দেশ’ নিয়ে কি করে ফার্স্ট হয়ে গেল, হলের কেউ বুঝতে পারেনি। ‘দেশ’ তো গাইলেই ভালো লাগে ভাই। ঠিক মনে হল নোটেশন ফলো করে গাইছে। বিস্তার পর্যন্ত। তান না হয় তুই তৈরি গাইতে পারিস। কিন্তু বিস্তার এরকম সতর্ক, স্বরলিপি-ধরা হবে! কি জানি বাবা, নাকি ও-ই সবচেয়ে কারেক্ট গেয়েছে। এসব ভেতরের পলিটিক্স ছাড়া কি! সব্বাইকার মত ছিল তুই ফার্স্ট। সোহম সেকেন্ড। ফার্স্ট হলে মাসে দেড়শ টাকা করে স্কলারশিপ পেতিস পাঁচ বছর, তোর কত সুবিধে হত বল তো! আমার অবশ্য মত, সোহম প্রথম, তুই দ্বিতীয়। সোহমের গানের বলিষ্ঠতা আমাকে অ্যাপিল করে বেশি। তুই কিছু মনে করলি না তো?’
—‘দূর মনে করব কি? আমার গাইতে ভালে লাগে গেয়ে যাই, কার থেকে ভালো গাইলুম অতশত বিচার করতে পারি না। আলাদা করে টেপ শুনলে হয়ত পারবো। পরে। কিন্তু সে সময়ে পারি না। সোহম একটা জিনিয়াস। ও তো প্রথম হতেই পারে।’
—‘ছেলেটাকে তোর কেমন মনে হয় রে অপু, তুই তো অনেক দিন ধরে মিশছিস!’
—‘আমার খুব ভালো লাগে। মহাপ্রাণ। সরল। কোনও ছোট জিনিস ওর মধ্যে নেই। ওর সঙ্গে যুগলবন্দী গাইতে আমার খুব ভালো লাগে। ওর সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব ভালো হয় আমার।’
—‘জীবনটাও ওর সঙ্গে যুগলবন্দী হলে ভালো হত, নারে অপু? আসলে ওকেই বোধ হয় তুই বিয়ে করতে চাইছিস, তাই এটাতে এতে আপত্তি, না?’
অপালা অবাক হয়ে বলল—‘কে এসব বলল তোকে? ও আমার ভাইয়ের মতো বা বলতে পারিস দাদার মতো, এবং খুব ভালো বন্ধু। তা ছাড়া ও তো কবে থেকেই ঠিক করেছে মিতুলকে বিয়ে করবে।’
দীপালি আস্তে আস্তে ছাতের ওপর বসে পড়ল। ভেতরে একটা আগ্নেয়গিরি ফেটে গেছে। মিতুলকে সোহমের ভালো লাগে এটা অনুমান করা যায়। কিন্তু মিতুল একটা ষোল বছরের স্কুলে-পড়া, ফ্রক পরা অতি-তরল স্বভাব, গাধার মত গলা-অলা মেয়ে আর সোহম তেইশ-চব্বিশ বছরের, রীতিমতো গুণী গাইয়ে, উচ্চ শিক্ষিত যুবক। সোহমের জীবনে অপালা, অতি সাধারণ দেখতে অপালা কিছু। তার গানের সাথী। মিতুল, অতি-তরল, খেয়ালী, বেয়াদব মিতুলও কিছু—তার ভালোবাসার পাত্রী। খালি দীপালি কেউ না। কিচ্ছু না। কেউ না। যদিও তার সঙ্গেই সবচেয়ে গল্প করে সোহম। কোনও মানে নেই তার। একেবারে অর্থহীন।
অপালা বলল—‘দীপুদি, তুই ওরকম বসে পড়লি কেন? কি হল তোর? শরীর খারাপ লাগছে?’ অবরুদ্ধ কান্নায় দীপালি খালি বলতে পারল—‘অপু, অপু, কী হবে এখন? আমি…আমি সোহমকে ভালোবাসি। ওহ, আই লাভ হিম ম্যাডলি!’
অপালার চোখে জল এসে গেছে। সে দীপালিকে প্রাণপণে তোলবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘দীপুদি শোন, আমার কথা শোন। এমন করে ভেঙে পড়িসনি। চল ঘরে যাই আমরা।’
দীপালির গোলাপি শাড়ি ছাতের ধুলোয় লুটোচ্ছে। কোথাও থেকে ঝলকে ঝলকে ভেসে আসা কোনও গন্ধপুষ্পের সৌরভের সঙ্গে মিশে তার চন্দন-আতরের গন্ধ কেমন গা-ছমছমে লাগছে। যেন শির ছিড়ে যায় যন্ত্রণায় এ এমন আকুল করা গন্ধ। দীপালি তেমনি দমচাপা গলায় বলতে লাগল—‘অপু তুই কিছু কর। কিছু কর প্লিজ। আমি পাগল হয়ে যাবো নইলে। মিতুল? হু ইজ মিতুল? একটা গুড়িয়া, মীনিংলেস, অপদার্থ। জাস্ট একটা পুতুল ছাড়া কী? সোহম কি করে ওকে অ্যাট অল…ওহ অপু তুই আমাকে বিষ দে…।’
এই সময়ে প্রদ্যোৎ ছাতে উঠে আসছে দেখা গেল। একটু চেঁচিয়ে বলল—‘অপু, মা খেতে ডাকছে।’
অপালা তাড়াতাড়ি বলল—‘দাদা, দীপুদির হঠাৎ বড্ড বুকে ব্যথা করছে, একটু দ্যাখ তো!’
প্রদ্যোৎ ব্যস্ত হয়ে বলল—‘সে কি? আপনার কিছু গণ্ডগোল ছিল নাকি আগে?’ দীপালি কোনও উত্তর দিতে পারছে না।
প্রদ্যোৎ বলল—‘অপু, পায়ের দিকটা ধরতে পারবি? আগে ঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার।’ প্রদ্যোৎ বুকে পিঠে স্টেথো লাগালো। প্রেশার মাপলো। তারপর কান থেকে স্টেথোর নল নামিয়ে বলল—প্রেশারটা একটু হাই। হার্টবিটও একটু বেশি। কিন্তু একসাইটেড হলে ওরকম হতেই পারে।’ সে অপালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। অপালা খুব ছোট্ট করে ঘাড় নাড়লো। প্রদ্যোৎ বলল—‘আপনি দেখছি খুব কেঁদেছেন। নিশ্চয় কোনও কারণে মনে খুব ব্যথা পেয়েছেন। ঠিক বলেছি না? হাসুন। একটু হাসুন তো আগে! আচ্ছা এইবারে একটা ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে দেয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকবেন। অপু, আর মিনিট দশেক পরে আমরা খেতে যাবো। তারপর আমরা দুজনে ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দেব। কোনও ভাবনা নেই। আরে জীবনে কত দুঃখ যন্ত্রণা, ডিস্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, তাতে ভেঙে পড়লে চলবে?’