গান্ধর্বী (Gandharbi) : 04
অতন্দ্র আকাশে খালি ধ্রুবতারার মতো জেগে থাকেন নাজনীন বেগম। ধ্রুবতারার মতো স্থির অথচ শুকতারার মতো উজ্জ্বল। ‘মেরে তো মন শ্যামসুন্দর বনমালী’ তিলঙে বাজতে থাকে কানের মধ্যে, প্রাণ নিংড়ে নেওয়া সুরের চলা ফেরা, কখনও মেঘলেশহীন আকাশে চলে যাবে, কখনও একটি মাত্র মেঘের পেছন থেকে চাঁদের কিরণের মতো বহুধা সৌন্দর্যের বিস্ময়ে ছড়িয়ে পড়বে আকাশময়, পৃথিবীময়। জ্যোৎস্নাবিধৌত গঙ্গা-যমুনা-কৃষ্ণা-কাবেরী-গোদাবরীর ওপর কখনও তির্যকভাবে, কখনও সোজাসুজি পড়েছে সুরের ছটা ‘বিনাদরশন মন বিরধ রতনহি। মদন মোহন গোপাল।’
বাবাকে বেশ ছোট বয়সেই হারিয়েছে অপালা। তবু বাবার স্মৃতি অমলিন। মুখটা স্মৃতিতে আবছা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার বাবাত্বটুকু একেবারে স্পষ্ট। তিনি ঠিক কি রকম ছিলেন, কি ভাবে কথা বলতেন, আদর করতেন বিশদ মনে নেই, খালি তিনি ওইরকম ধ্রুবতারার মতোই একটা উপস্থিতি। খুব উজ্জ্বল নয়, কিন্তু আছেন, সর্বদা আছেন, পথ দেখাতে, আলো দিতে, দিক নির্ণয় করতে। সব সময়ে। খুব মৃদুভাবে, নিজেকে একদম জাহির না করেও আছেন। বাবা মারা যাবার পর থেকে অপালার জীবনে সুখ-শান্তি ইত্যাদি বলতে যা বোঝায় তার কিচ্ছু নেই। আরাম, আশ্রয়, অবসর বলতে কিছু নেই। আর শান্তিরও অভাব। যা যা সে করতে চায় তার প্রত্যেকটাতে যদি প্রথমেই না না না শুনতে হয়, আর তার মতো লাজুক নম্র স্বভাবের মেয়েকে সেই ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ করতে হয় তাহলে শান্তি বলতে আর কী রইল? তবু অপালা একদিকে জেদী আরেক দিকে স্থিতিস্থাপক। এখন মোটামুটি একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে তার জীবনযাত্রা। বাড়ির সকলে মেনে নিয়েছে গানটা সে করবেই। সে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীটের মুখে যাবেই। তার কিছু-কিছু মেয়ে-বন্ধুর সঙ্গে ছেলে-বন্ধুও থাকবেই। তার সঙ্গীত ক্লাসের বন্ধু। অনেক সময়ে তাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে অথবা সোজাসুজি তাদের বাড়ির গাড়িতে সে আসবেই। এসব নিয়ে অশান্তি হয়েছে। এখনও হয়। তবে কম।
বিপত্নীক হবার পর জেঠু আবার বিয়ে করেননি। নিজে নিঃসন্তান, ভাইয়ের সংসারেই থাকতেন, এবং ভাই মারা যেতে তার সংসারটি টেনে চলেছেন এটা একটা মস্ত ভরসা। কিন্তু জেঠুর বাবার মতো স্নেহ নেই। শাসন আছে, দাবি আছে, কর্তব্যবোধ আছে, চূড়ান্ত অহং আছে, কিন্তু মমতা নেই। মা ব্যবহার করেন জেঠুর ক্রীতদাসীর মতো। মাথায় আদ্যিকালের দু ব্লেডের পাখাখানা চললেও, ঝালর দেওয়া হাতপাখা নিয়ে মা জেঠুর খাওয়ার কাছে ঠায় বসে থাকেন। রান্নাঘর নীচে, তারা সবাই রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে খেয়ে নেয়। খালি জেঠুর খাবারটাই মাকে চারবেলা ঠাকুরের নৈবেদ্যর মতো থালায় বাটিতে সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিক জামাইষষ্ঠীর স্টাইলে ওপরে নিয়ে যেতে হয়। এই সময়ে অপালার দাদা প্রদ্যোৎ নানারকম টিপ্পনী কাটে। দু ভাইবোনের কেউই পারিবারিক প্রথার মধ্যবিত্ততার মধ্যে জেঠুর এই জমিদারি চাল যার বেশির ভাগ দায়টাই তাদের মা বেচারিকে বহন করতে হয়, সেটা পছন্দ করে না। কিন্তু প্রতিবাদ করার কথাও তাদের মনে আসে না। প্রদ্যোৎ খুব হাসি-খুশী ধরনের ছেলে। একেবারেই ‘রাগী যুবক’ নয়, আর অপালা বড়ই শান্ত, খানিকটা ভিতু। জেঠুর মুখোমুখি হওয়ার মতো ব্যক্তিত্বই তার নেই। জেঠুর দুবেলার ভোজনের এই যে পূজা-পর্যায় এই সময়টা যত রকম সাংসারিক কথার আদান-প্রদান চলে। জেঠু বলবেন, মা শুনবেন, মৃদুস্বরে জবাব দেবেন।
—‘বউমা, এ মাসে বাজার খরচটা যেন বড্ড বেশি মনে হচ্ছে, বাজেট ছাড়িয়ে গেছে!’
—‘আনাজের দাম আকাশে চড়েছে দাদা, তাছাড়া দেশ থেকে বনবিহারী এসে দুদিন থেকে গেল না?’
বনবিহারী অর্থাৎ দেশে তাঁদের যা সম্পত্তি আছে, তার তদারকি যে করে এবং বেশির ভাগটাই ভোগ করে সে মাঝে মাঝেই কিছু আম, কিছু ডিম, আলু, সর্ষের তেল এবং চাল, একেক সময়ে হয়ত একেকটা নিয়ে উপস্থিত হয়। তখন সে কদিন থেকে যায়। হগ মার্কেট, কালীঘাটের মন্দির, দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা—এসব তাকে দেখে যেতেই হবে। প্রত্যেকবার।
বট্ঠাকুর বলেন—‘বনবিহারী তো রইল, দুদিন কি তিনদিন।’
বউমা বলতে পারেন না বনবিহারীর এক দিনে যা আহার্য লাগে তা প্রায় তাঁদের চারজনের সমান।
সুতরাং বটঠাকুর আবার বলেন, ‘তবে কি দুধটা কমিয়ে দেবো?’
বউমা জানেন দুধ কমাবার অর্থ তাঁর ছেলেমেয়ের সামান্য অংশটুকু বাদ পড়া। কারণ বটঠাকুর তো দুধ ছাড়া থাকতেই পারবেন না। দুধটাকে সামান্য ঘন করতে হয়, তাঁর গোঁফে লেগে থাকে সেটা তিনি পরিতৃপ্তি সহকারে মুছে নেন, এ প্রতিদিনের অনুষ্ঠান। বউমা চুপ করে থাকেন। সহজে তিনি ভেঙে পড়বার পাত্রী নন, কিন্তু এখন তাঁর চোখ টলটল করতে থাকে। স্বামী হঠাৎ মারা গেলেন। কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এই বাড়ির ভাগ আর দেশের সম্পত্তির ভাগ এইটুকু তাঁদের নিজস্ব আয়। বাকি সবই বড় ভাসুর।
বড় ভাসুর হঠাৎ উদার কণ্ঠে বলেন—‘না, না, আমারই ভুল। ছেলেটার ডাক্তারি পড়ার খাটুনি কি সোজা খাটুনি? মেয়েটাও তো হামেহাল কলেজ, গান, সংসারের ইতি-কর্তব্য করে যাচ্ছে। তবে কি জানো বউমা, যা থাকবে তোমার ছেলে-মেয়েরই থাকবে। আমি তো আর সঙ্গে নিয়ে যাবো না।’
এ কথা ‘সুজাতা খুব ভালোই জানেন। ভাসুরের আর কেউ নেই। দুটিই ভাই। বোন-টোনও নেই। ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের ভালোও বাসেন খুব। তবে তাঁর নিজের ধরনে। প্রদ্যোৎ বলেছিল এঞ্জিনিয়ারিং পড়বে, তাড়াতাড়ি কোর্সও শেষ হয়ে যাবে, চাকরি পাবারও সুবিধে, কিন্তু জেঠু সেই যে ধরে বসলেন ডাক্তারিতে যখন চান্স পেয়েছে, ডাক্তার হওয়াই চাই, সে থেকে তিনি এক চুলও নড়লেন না। প্রদ্যোৎ এঞ্জিনিয়ারিং পড়লে সংসারটা তাড়াতাড়ি সাবালক হতে পারত। তাঁর নিজেরও যথেষ্ট সুবিধে হত। কিন্তু তিনি কোনও যুক্তিতেই কান দিলেন না। বাড়িতে, বংশে একটা ডাক্তার থাকা দরকার। তাঁদের ঠাকুর্দা খুব সফল ডাক্তার ছিলেন। অপালার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি লড়াই করতে হয় সুজাতাকে। সায়েন্স তাকে পড়তেই হবে। এদিকে মেয়েটা অঙ্ককে ডরায়। জেঠুর যুক্তি, গান করছে, তার ওপর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, তালের অত সূক্ষ্ম হিসেব, রাখে কি করে? মন দিলেই অঙ্ক পারবে। জেঠুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চুপচাপ গিয়ে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছে অপালা। জেঠু খুব অসন্তুষ্ট। তার পর ফলও ভালো হচ্ছে না। মেয়েকে যতটা পারেন আড়াল করে চলতে হয় তার মাকেই।
অপালা ভাবে এই স্যাঁতসেঁতে এঁদো ঘর, জেঠুর ভ্রূকুটি, দাদার উদাসীনতা, যা প্রায় স্বার্থপরতার মতো লাগে একেক সময়ে, মায়ের অসহায়ত্ব, একটা নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র নেই, এরপর কি সত্যি সে লখনৌ যাবে? নাজনীন বেগমের খাসমহলে কিংবদন্তীর গানঘরে তানপুরো নিয়ে বসতে পারবে? সত্যি? একটু পরিবেশের অভাবে বাড়িতে তার গান গেয়ে তৃপ্তি হয় না। সারা বর্ষাকাল ছাতে বেরোতে পারে না, গ্রীষ্মকালেও বড় জোর ছটা। তার পর আর বসা যায় না। দাদা তক্তপোশে ঘুমোয়। বালিশের পাশে উপুড় করে রাখা মোটা মোটা বই। অর্থাৎ অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। সে আস্তে, খুব আস্তে সুর ধরে, দাদা ঘুমে লাল চোখ মেলে বলে—‘আরম্ভ করলি তো ক্যাঁও-ম্যাঁও? অপালা বলে—‘হ্যাঁ করলুম।’ বেশ স্থির সিদ্ধান্তের তেজ তার গলায়। একটু পরে আরেক ঘুম দিয়ে নিয়ে দাদা বলে—‘নাঃ গলাটা তোর সত্যিই খাসা রে, ঘুমের ব্যাঘাত তো হয়ই না, উপরন্তু এই ভোর সকালে একটা দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখে ফেললুম। কি সুর গাইছিলি রে ওটা?’
—‘ললিত।’
—‘বড় ভালো রে সুরটা। নোন তোম তেরে নেরে ওটা কি করিস রে?’
—‘আদি যে মার্গসঙ্গীত, সেটা ঈশ্বরকে লক্ষ্য করে গাওয়া হত। তাই রাগের আলাপের একটা বাণী ছিল ‘অনন্ত হরিনারায়ণ’, পরে মুসলমানী যুগে খানিকটা অশিক্ষিত, খানিকটা সংস্কৃত না জানা গাইয়েদের মুখে ওটা নোম তোম হয়ে গেছে।’
—‘ও রে বাব্বা, এ তো বেশ জ্ঞানের ব্যাপার রে?’
—‘তা তুই কি মনে করেছিলি গান মানে ভ্যারেন্ডা ভাজা?’
—‘ঠিক আছে, ঠিক আছে তুই তোর নোম তোম কর, করে যা, ফ্রাঙ্কলি স্পীকিং অপু আমি ভাবতুম সেই ‘তুমি আমার আর আমি তোমার’ টাইপের কিছু একটা হবে এটা।’
এবার অপুর হাসি পেয়ে যাবে। ললিতের সুরটা কেটে গেছে। গম্ভীর সন্ধি প্রকাশের সুর। সে হাসি চেপে বলবে— ‘তাহলে ওই জাতীয় একটা শোন, আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রকাশভঙ্গির গভীরতা, ডিফারেন্সটা দ্যাখ, দেখবি?’
অপুর দিকে ফিরে চোখটা বুজিয়ে প্রদ্যোৎ বলবে—‘ঠিক আছে। গেয়ে যা। যদি ভোরের স্বপ্নটা ফিরিয়ে দিতে পারিস তো তোকে একটা প্রাইজ দেবো।’
তখন অপালা যোগিয়ায় ধরবে—‘পিয়া কে মিলন কি আশ সখিরি…’ মীড়ে মীড়ে ভরিয়ে দেবে দাদার চিলেকোঠার ঘর, দু চারবার দাদা মাথা নাড়বে, আহা আহা করবে শুনিয়ে শুনিয়ে, তারপর ঘুমিয়ে পড়বে।
নাজনীন বেগমের গানমহলের খোলা জানলা দিয়ে ঝাউয়ের সারি দেখা যায়। কিরকম ঝাউ কে জানে? কতরকমের আছে? সবগুলোই অপালার ভালো লাগে। যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কোনটা বেশি ভালো লাগে? ইমন না পুরিয়া না শ্রী সে কি বলতে পারবে? বেছে নিতে পারবে? বাছা খুব শক্ত! ফোয়ারায় রামধনু রং তুলে ভোরের সূর্য উঠবে। সম্পূর্ণ শূন্য, প্রশস্ত মহলে গুরু-শিষ্যার যুগলবন্দীতে ‘বাজুবন্ধ্ খুলু খুলু যায়।’
ক’দিনই মনটা তার খুব ভালো আছে। সুরলোকের নির্বাচিত বিচারকরা তার ওপর সুবিচার করেননি, প্রথম হলে সে একটা ভালো স্কলারশিপ পেতো, তার আর্থিক সুবিধে হত অনেক, এসব তার মাথায় নেই। ইংরেজি ক্লাসে রমলাদি একদিন বললেন—‘অপালা, অপালা মিটার, উই আর প্রাউড অফ য়ু, দা স্টেটসম্যান মিউজিক ক্রিটিক হ্যাজ প্রেইজড্ ইয়োর পার্ফম্যান্স সো এলোকোয়েন্টলি!’ কলেজের যাবতীয় ফাংশনে অপালার গান বাঁধা, লেখাপড়ায় সাধারণ হলেও সকলেই তাকে চেনে। তবে ইংরেজির প্রোফেসররা বিশেষত রমলাদি বা আর জি বড্ডই হাই-ব্রাও। সেই তিনি ক্লাসে সবার সামনে এভাবে তাকে প্রশংসা করবেন, ভাবাই যায় না। অপালার মুখ একটুতেই লাল হয়ে যায়, সে মুখ নিচু করে ফেলল। তার দুষ্টু-বন্ধুরা পরে বলতে থাকল—‘দ্যাখ অপালা, তুই যতই ভালো গাস, স্টেটসম্যান যদি তোকে ওভাবে মাথায় না তুলত, আর জিও তোকে নিয়ে এত প্রাউড হতেন না।’ আর জির কথার মাত্রাই এক এক সময়ে হয়ে যায় ‘অ্যাজ দা স্টেটসম্যান সেইজ।’ স্টেটসম্যান নাকি বলেছে ‘দি অ্যাওয়ার্ড মে গো টু অ্যাসাম’স সাদিক হুসেন, বাট দি অ্যাক্লেম গোজ ডিসাইডেডলি টু বেঙ্গলস অপালা মিট্রা, শী ইজ দা রিয়্যাল ট্যালেন্ট দ্যাট দা সুরলোক ওয়াজ লুকিং ফর।’ পল সায়েন্সের চন্দনাদি যাঁকে তাঁর বদমেজাজের জন্য মেয়েরা বলে চণ্ডী তিনি পর্যন্ত বললেন: ‘আমার এক ক্লোজ রিলেটিভ গিয়েছিলেন, শুনলাম অপূর্ব গেয়েছো। গানটাই তোমার আসল ভোকেশন। পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য মন খারাপ করো না। ভালো করার চেষ্টা অবশ্যই করবে। কিন্তু দুটো যদি এক সঙ্গে পেরে না ওঠো, কি আর করতে পারো?’
মনীষা কলেজে অপালার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, নিজেও গায়। সে গিয়েছিল শুনতে। মনীষা বলল—‘তুই একদিন হীরাবাই-টাই দরের গায়িকা হয়ে যাবি অপু। তোর একটা বিশেষত্ব কী জানিস? বেশির ভাগ ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত গায়িকারাই কিরকম একটা ট্যারা আওয়াজ বার করেন গলা থেকে। পুরুষের ভঙ্গির মতো। খুব সম্ভব সকলেরই শিক্ষা মেল ওস্তাদদের কাছে তো, তাই। তোর একে ওরকম অপূর্ব গলা, তার ওপর ওই ধরনের কোনও অ্যাফেকটেশন নেই। যারা ক্ল্যাসিক্যালের অতশত বোঝে না, তাদেরও তোর গান ভালো লাগবে।’ মনীষা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, একটু ভারী গলা। কলেজ সোশ্যালের নৃত্যনাট্যগুলোতে পুরুষ ভূমিকার গানগুলো তার বাঁধা। নায়িকার গানগুলো গায় অপালা। তার উচ্চাঙ্গসঙ্গীত-দুরস্ত গলায় একটু বেশি কাজ অনেক সময়ে এসে যায়। বাঁধা স্বরলিপিতে গাইতে অসুবিধে হয়। এসব জায়গায় মনীষা তাকে সাহায্য করে। মনীষা বলল—‘দ্যাখ অপু, আমাদের দ্বারা পড়াশুনো বেশিদূর হবে না। তোতে আমাতে মিলে একটা গানের স্কুল খুলব। তুই ক্ল্যাসিক্যাল, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত, আর তোর ওই বন্ধু দীপালি, নজরুল-টুলগুলো দারুণ গায়, ও ওগুলো শেখাবে। কি বলিস?’ আর তখনই অপালা মনীষাকে তার লখনৌ-এর স্কলারশিপটার কথা বলল। কাউকে না বলবার অঙ্গীকার করিয়ে অবশ্য। মনীষা লাফিয়ে উঠল—‘বলিস কি? তুই তো এবার অনেক উঁচু আকাশের তারা হয়ে যাচ্ছিস তা হলে? আর কি তোর নাগাল পাবো?’
কলেজ বিল্ডিং-এর পেছনের দিকে বাগানে একটা রেন-ট্রি। সেইখানেই বসে ওরা সাধারণত গল্প করে। অপালা গাছটার উঁচু শাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল— ‘মনীষা, আমি আমিই, তারা-টারা কোনদিনও হবে না। গান গেয়ে অসম্ভব আনন্দ পাই। সত্যি কথা বলতে, গানকে আমি ঠিক একটা মানুষ, একটা ভীষণ প্রিয় মানুষের মতো ভালোবাসি। গানের চেয়ে বেশি কিছুকে, কাউকে ভালোবাসি না।’
মনীষা বলল—‘তুই একটা পাগল। গান তো একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিস। তাকে আবার কেউ মানুষের মতো ভালবাসতে পারে? ধর তোর মা, তোর দাদা, ধর এর পরে তোর বিয়ে হবে, ছেলে-মেয়ে হবে, এদের তুই ভালোবাসবি না?’
অপালা বলল—‘ভালো তো বাসি। বাসবও। মায়ের ওপর আমার ভীষণ মায়া। খালি মনে হয়, মাকে কবে একটু অবসর একটু স্বাধীনতা দিতে পারব। কিন্তু গান আমাকে যা দেয়, তা আর কেউ, আর কিছুই দিতে পারে না রে! সত্যি বলছি।’
—‘কেন, তোর সোহম?’
অপালা একটু চমকে উঠল, ‘কি বলছিস তুই?’
—‘সোহম আর তোর মধ্যে কিচ্ছু নেই, বিশ্বাস করতে বলিসনি আমায়। এই তো সেদিন দেখলুম মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে একটা নীল অ্যামবাসাডর বেরিয়ে গেল। তার মধ্যে তুই আর সোহম বসে কথা বলছিস। এমন মত্ত হয়ে যে আমাকে দেখতেই পেলি না।’
অপালা হেসে বলল—‘আমাকে দেখতে পেয়েছিলি, সোহমকে দেখতে পেয়েছিলি, তানপুরার ডাণ্ডিটা যে গাড়ির জানলার বাইরে বেরিয়েছিল দেখতে পাসনি? মাস্টারমশায়ের তানপুরাটা এই কমপিটিশনের জন্য প্র্যাকটিস করার উদ্দেশ্যে সোহমের গাড়ি দিয়ে মাস্টারমশাই আমার বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তোর মুখের এই অদ্ভুত কথাটা আমি এই প্রথম শুনছি, মনীষা, আমাদের কারুরই কোনদিন মনে হয়নি। দুজনে এক গুরুর কাছে নাড়া বেঁধেছি, তালিম নিচ্ছি এক সঙ্গে অনেক দিন হয়ে গেল। পরস্পরকে হেল্প্ও করি খুব। খুব সুন্দর বন্ধুত্ব আছে আমাদের। তার বেশি কিছু না। কেনই বা থাকবে?’
মনীষা বলল—‘দ্যাখ, গান আমিও করি। গানের মতো রোম্যান্টিক জিনিস আর নেই। খুদে খুদে ছাত্রী বয়স্ক মাস্টারমশায়দের প্রেমে পড়ে যায়, আর যারা এক গুরুর কাছে শেখে, ক্ষমতায় পরস্পরের কাছাকাছি তাদের মধ্যে লাভ্ আসবে না? হতে পারে?’
অপালা একটু সীরিয়াস ধরনের মেয়ে। চট করে ঠাট্টা-তামাশা করে উঠতে পারে না। তবু খানিকটা ঘাস ছিঁড়ে, সেগুলোকে টুকরো টুকরো করতে করতে চাপা হেসে বলল—‘তোর এরকম কোনও অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে?’
মনীষা ফিক করে হেসে বলল—‘এখনও হয়নি। কিন্তু হলেও তো হতে পারে। সোহম কিন্তু ভালোবাসার মতো ছেলে। সুন্দর চেহারা। লেখাপড়ায় অন্তত তোর চেয়ে ভালো। অমন ব্যাকগ্রাউন্ড, তারপরে ওইরকম ট্যালেন্টেড।’
অপালা বলল—‘তুই কি পাত্র-পাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিস নাকি?’
অপালা খুব শান্ত ধীর স্বভাবের মেয়ে। বেশি কথা বলে না। মনের কথাও চট করে বলতে পারে না। দু চোখ শুধু ভারী হয়ে যায় দুঃখ হলে। আনন্দে গাল চকচক করতে থাকে। এই পর্যন্ত। বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও সে আজ উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরল। কলেজ থেকে বাড়ি অনেক দূর। অর্ধেক বাসে ওঠা যায় না। আজ চারটে পঁয়তাল্লিশ অব্দি ক্লাস ছিল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ছ’টা। দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে অপালা দেখল দরজাটা খোলা, খুলতেই মা বলল—‘অপু, এত দেরি?’
—‘শেষ পর্যন্ত ক্লাস ছিল তো!’
—‘ঠিক আছে। শিগগিরই বাথরুমে যা। গা ধুয়ে আয়। আমি চুলটা বেঁধে দিচ্ছি। শাড়ি জামা সব বার করে রেখেছি।’ অপালা দেখল মায়ের পরনেও পাট ভাঙা শাড়ি। ধোপর বাড়ির সুন্দর গন্ধটা বেরোচ্ছে। চুল-টুল পরিষ্কার বাঁধা। মা যেন কোথাও যাবে।
সে বলল—‘কেন মা কোথায় যাবো?’
—‘তুই চলই না আগে।’
দোতলায় উঠে অপালা আবার জিজ্ঞেস করল—‘কি ব্যাপার বলো তো মা, জেঠুর কি আবার থিয়েটার যাবার শখ চেপেছে?’ খুব মাঝে মাঝে হলেও পুরো পরিবার নিয়ে সিনেমা থিয়েটার বা দক্ষিণেশ্বর বেলুড় ব্যান্ডেল চার্চ এসব যাওয়া জেঠুর একটা শখ।
মা তখন বলল—‘জনাকয়েক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা এসেছেন, জেঠুর বসার ঘরে বসে আছেন, তাঁরা তোকে দেখতে চান।’
—‘আমাকে? কেন?’ অপালা অবাক হয়ে বলল।
—‘তোকে দেখতে এসেছেন। বিয়ে, বিয়ের জন্য।’
অপালা একটা পাথরের টুকরোর মতো বসে পড়ল। মায়ের বিছানায়। মা ভয়ে ভয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন—গাল দুটো রক্তহীন হয়ে গেছে। জ্যাঠামশাইয়ের চটির আওয়াজ শোনা গেল। —‘কই তোমাদের হল?’
ঘরের দরজার পর্দা টানা। তিনি দোর থেকেই ফিরে গেলেন। মা ফিসফিস করে বললেন—‘যা অপু, শিগগির যা।’
অপালা ধরা গলায় তেমনি বসে বলল—‘আমি বিয়ে করব না মা।’
মা বললেন—‘বিয়ে করব না বললে মেয়েদের চলে? আজ নয় কাল বিয়ে তো করতেই হবে।’
—‘বেশ তো পরে ওসব কথা ভেবো।’
—‘আমি কোনদিকে যাই অপু। এঁরা নিজে এসেছেন। ছেলেটি তো রাজপুত্তুরের মতো। তোমার গান শুনে, খোঁজ খবর করে ওঁরা এসেছেন। যাও দেখা করে এসো। যা-ও বলছি, যেতেই হবে। আমি বাথরুমে শাড়ি-ব্লাউজ রেখে এসেছি।’
অপালা উঠল। বাথরুমে ঢুকে গেল প্রাণহীন পুতুলের মতো। মা বাইরে অপেক্ষা করছেন তো করছেনই। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল। দরজায় আস্তে ধাক্কা দিতে যাচ্ছেন, দরজা খুলে গেল। অপু বেরিয়ে এসেছে। যে ধানীরঙের ধনেখালি শাড়ি পরে সে কলেজ গিয়েছিল সেই একই শাড়ি তার পরনে। চোখ দুটো টকটকে লাল। চোখের নোনতা জল পড়ে মুখের রঙ চকচক করছে। মাথার চুলে পর্যন্ত সে চিরুনি চালায়নি। যেমন সিঁথির দুপাশের চুলগুলো উড়ে একটা ধোঁয়াটে কুন্ডলিমতো হয়েছিল, তেমনি আছে। হা-ক্লান্ত চেহারা।
—‘এ কি? গা ধুসনি? চুল ঠিক করলি না? গাড়োয়াল শাড়িখানা রাখলুম..’
অপালা জবাব দিল না।
—‘মুখে সাবান দিসনি। চোখ এতো লাল। এভাবে কারো সামনে যাওয়া যায়?’
অপালা জবাব দিল না এবারও। মার হাতে এক গ্লাস দুধ, তাতে আজ জেঠুর বরাদ্দ বোর্নভিটা। —‘খেয়ে নে।’
অপালা বলল—‘খিদে নেই।’ অগত্যা টেবিলের ওপর দুধের গ্লাস নামিয়ে রাখলেন মা। বললেন—‘চল।’
জেঠুর বসার ঘরে একটি আরামকেদারা। পুরনো কালের গোল শ্বেতপাথরের টেবিল ঘিরে গদি মোড়া কিছু বেতের সোফা, কাঠের হাতলওলা। অপালাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই তিনটি পুরুষ উঠে দাঁড়ালেন। একজন মহিলা উৎসুক চোখে চেয়ে আছেন।
জেঠু সোৎসাহে বলে উঠলেন—‘এই আমার ভাইঝি। মানে টেকনিক্যালি ভাইঝি। আসলে আমার মেয়েই তো! এই মাত্তর কলেজ থেকে ফিরল। ভীষণ সিম্পল। সাজ নেই গোজ নেই। মায়ের সঙ্গে হাতে-হাতে সব করছে। তার ওপর কলেজের বি.এ. অনার্সের পড়া, গান। কোনটিতেই ফাঁকি নেই।’
অপালা দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন পুরুষ শশব্যস্ত হয়ে বললেন—‘আপনি বসুন।’
হঠাৎ এই কণ্ঠস্বরের ভদ্রতায় বা সমাদরে কে জানে কিসে অপালার মাথা ঘুরে উঠল, গা বমি করছে, গলার ভেতর কিসের প্রচণ্ড চাপ, সে আস্তে আস্তে বসে পড়ল। কে বলছে। কোথা থেকে বলছে কিছুই দেখল না।
মহিলা একটু বয়স্ক, ভারীভুরি, তিনি বললেন— ‘তোমার থেকে অনেক বড় আমি। তুমিই বলছি। সেদিন সুরলোকের আসরে তোমার গান শুনে আমরা মানে আমি, আমার স্বামী, আর এই আমার ভাই। আমরা অভিভূত হয়ে গেছি।’
জেঠু বললেন—‘একটা গান শুনিয়ে দাও না মা! সেই যে ‘মহা সিন্ধুর ওপার হতে’, কিম্বা ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’, খালি গলায় গাইবে দেখবেন কিচ্ছু লাগবে না। একটি সুর এদিক-ওদিক হবে না।’
একটি পুরুষ বলে উঠলেন—‘না না, ওঁকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। গান শোনাতে হবে না। গান তো আমরা শুনেছি, গান শুনেই তো আসা!’
মহিলা বললেন—‘মাসিমা, ওকে নিয়ে যান, পরে একদিন আলাপ হবে’খন।’
অপালা চৌকাঠ পেরোতে পেরোতে শুনল, মহিলা বলছেন—‘খুব লাজুক না?’
জেঠু বললেন—‘লাজুক, নম্র, শান্ত, ধীর। অথচ কী স্টেজ ফ্রি ভাবতে পারবেন না।
‘পাঁচ ছ-বছর বয়স থেকে স্টেজের ওপর শ’এ শ’এ লোকের সামনে গাইছে। তাছাড়া আপনাদের আসার কথাও তো আমরা ওকে জানাইনি!’
—‘সে কি? কেন?’
—‘আরে এসব মেয়ে-দেখানো-টেখানো আজকালকার মেয়েরা পছন্দ না-ও করতে পারে। হয়ত মনে আঘাত লাগবে।’
মহিলা বললেন—‘তো বেশ তো! বললেই হত, কোনও রেস্তোরাঁয় কিম্বা লেক-টেক, ভিক্টোরিয়া-টিয়ায় ব্যবস্থা করা যেত।’
—‘তা যদি বলেন প্রবালবাবু, আমি বয়স্ক মানুষ। আমার ওসব পছন্দ নয়। আর আজ না হয় আপনারা দেখতে এসেছেন। এর পরে আপনাদের শ্বশুর-শাশুড়ি এঁরাও আসবেন। তখন কি বয়স্ক, মানী মানুষকে আমি বলব —“চলুন ভিক্টোরিয়ায় চলুন!”
ছোট্ট একটু হাসি শোনা গেল। মহিলা বললেন—‘তা অবশ্য। আমরা কর্তাগিন্নি বা আমার ভাইয়েরা যে-রকম লিবর্যাল, বাবা-মা ন্যাচারালি তেমন না। তাঁরা হয়ত চুল খুলিয়ে, হাঁটিয়ে মেয়ে দেখে নিতে চাইতে পারেন। এ রান্নায় কী ফোড়ন, অম্বলে ঘি লাগে কি না…তখন কিছু মনে করবেন না কাকাবাবু।’
জেঠু বললেন—‘মনে করব কি? আমিও তো ওই দলে! ঘরে নেবেন, বরাবরের মতে, বাজিয়ে নেবেন না?’
জেঠুর ঘর থেকে মায়ের ঘরের দিকে আসতে আসতে গলার আওয়াজগুলো ক্রমশই মৃদুতর হয়ে যাচ্ছিল।
অপালা ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। প্রদ্যোৎ ঢুকল, মা বললেন—‘খোকা, কোন সকালে মেয়েটা এইটুকু খেয়ে বেরিয়েছে। দুধটা ওকে একটু খাওয়া তো! আমার ওদিকে এক গাদা কাজ। ওঁরা তো মেয়ে আসবার আগে একটু চা ছাড়া কিছু মুখে করেননি।’
প্রদ্যোৎ দুধের গেলাস হাতে খাটে বোনের পাশে এসে বসল, বলল—‘তুই কি খুকুমণি? ডুডু খাইয়ে দিতে হবে?’
অপালা মড়ার মতো পড়ে ছিল। কোনও জবাব দিল না।
দাদা বলল—‘অপাই, ভালো করে আমার কথা শোন। তুই তো তোর পাণিপ্রার্থী ভদ্রলোককে দেখিসনি। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, এ. জি. বেঙ্গলে কাজ করেন। টকটকে ফর্সা। চমৎকার স্বাস্থ্য, রীতিমতো সুপুরুষ। খুব গান ভালোবাসেন। মানে তোর ওই নুম, তুম, দিরে, নানা। তোদের লাস্ট সুরলোকের যে কমপিটিশনটা হল, তাইতে তোর গান শুনে, অর্থাৎ তোর গুণ নিজের কানে যাচাই করে, তোকে দা-রুণ পছন্দ করেছেন। এক্কেবারে ফেল্যাট। দ্যাখ, যারা গান ভালোবাসে তারাই সেধে তোকে নিতে চাইছে। এখানে তোর গাইবার ঘর নেই। পরিবেশ নেই। জেঠু দিনরাত টিকটিক করছে। অপাই, এখানে বিয়ে হলে তুই বেঁচে যাবি। লক্ষ্মী মেয়ে। দুধটা খেয়ে নে। দাঁড়া অনেকক্ষণ খালি পেটে আছিস, আগে একটা বিস্কুট খা।’
অপালা বলল—‘ডাক্তারি করিসনি দাদা। সলিড গলা দিয়ে নাববে না। দুধটা দে, খেয়ে নিচ্ছি।’
—‘তবে? রীজনেব্ল্ হতে হবে তো? আমি নিজে তো কবে জেঠুর গারদখানা থেকে ছাড়া পাবো, তার দিন গুনছি। মেয়ে বলেই তোর কত সুবিধে।’
অপালা দুধটা খেয়ে পাশ ফিরে শুলো।
ঘণ্টাখানেক পরে জেঠু ঘরে ঢুকলেন। তাঁর চটির শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়। প্রদ্যোৎ বলে এ বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধাই আছে।’
—‘অপাই! শুয়ে আছো কেন? কান্নাকাটি করছো নাকি? শোনো, ভালো ঘর। ভবানীপুরে নিজেদের বাড়ি, দুটি ভাই, এটি বড়, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। অত্যন্ত ভালো লোক। বাবাজীটির তো কথাই নেই। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ভালো ডিগ্রি, ভালো রোজগার, তোমাদের খেয়াল-ঠুংরিতে রীতিমতো ইন্টারেস্ট। তোমার আপত্তিটা কিসের? আমি তো মনে করি এটা গড-সেন্ড। এতো ভালো সম্বন্ধ আমরা নিজেরা হাজার চেষ্টা করলেও জোগাড় করতে পারতুম না। আর বাইজি হয়ে ঘরে ঘরে মুজরো নেবার বদলে ঘরের বউ হয়ে সংগীত চর্চা করাটাই আমি ভালো মনে করি। আমি কেন, যে কোনও ভদ্রলোক তাই মনে করবে।’
অপালা এখনও তেমনি শুয়ে আছে। কিন্তু উৎকর্ণ। জেঠু এসব কি বলছেন? বাইজি-টাইজি? এতো খারাপ কথা সে কখনও তাঁকে বলতে শোনেনি।
—‘লখনৌ যাবে? নাজনীন বেগমের কাছে গান শিখতে? সেখান থেকে তুমি আর ভদ্রঘরে ভদ্রসমাজে ফিরে আসতে পারবে মনে করেছো? বউমার কাছে সব শুনে আমি গতকাল রামবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। বলি, তোমার গার্জিয়ান কে? তিনি না আমি? আজ যদি আমি চোখ বুজি, তিনি তোমায় দেখবেন? সারা জীবনের মতো ভার নিতে পারবেন? না নেবেন? ডু যু নো হু দ্যাট নাজনীন বেগম ইজ? একটা তওয়ায়েফ। চরিত্রহীন, ভ্ৰষ্টা রমণী। তাঁর হাতে আমি তোমাকে তুলে দেবো? আমার ভাইয়ের কাছে, স্বৰ্গত আর সব পিতৃপুরুষের কাছে কী কৈফিয়ত দেবো আমি? ভারতবিখ্যাত তয়ফাওয়ালি হয়ে মঞ্চে মঞ্চে চোখে সুর্মা আর পেশোয়াজ পরে কানে হাত দিয়ে গান করে বেড়াচ্ছো আর হয়ত অনেক টাকা রোজগার করছে—এর চেয়ে অনেক বেশি অভিপ্রেত আমার কাছে যে তুমি তোমার মায়ের মতো গৃহস্থঘরের বউ হয়ে, কস্তাপেড়ে কাপড় পরে স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে জাজ্বল্যমান সংসারে গিন্নিপনা করছো। আজ তুমি ছেলেমানুষ। বাইরের চটক, গ্ল্যামার এই সবেই মন যাচ্ছে। স্বাভাবিক, দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু ভবিষ্যতে একদিন এই বুড়ো জেঠুকে মনে করবে, বলবে, বলতে হবে—জেঠু যা বলেছিল, ঠিক বলেছিল। সংসারে অসতীত্বের মূল্যে কেনা নাম টাকার চেয়ে সদুপায়ের সুখ শান্তি সামান্য শাক ভাত অনেক বড়। অনে-ক বড়।’ জেঠু ভারী ভারী পায়ে চলে গেলেন।
অনেক রাতে দাদার চিলে-কোঠার ঘরে অপালা আস্তে আস্তে জিগগেস করল—‘দাদা, তওয়ায়েফ কী রে?’
—‘ওঃ অপু, তুই বড় এমব্যারাসিং কোশ্চেন করিস।’
—‘বল না।’
—ওই বাইজি-টাইজি হবে আর কি?’
—‘কিন্তু নাজনীন বেগম তো বেগম—বেগম মানে রানী—কোন মহারাজকুমার মানে হিন্দু রাজকুমারকে বিয়ে করেছেন। নিয়মিত স্কলারশিপ দেন, আগেকার গুরুকুল পদ্ধতিতে গান শেখান। ওঁর সম্পর্কে জেঠু ওভাবে বললেন কেন?’
—‘আমি তোদের গানের জগতের কিছু জানি? তোর মাস্টারমশায়কে জিজ্ঞেস করিস। কে জানে হয়ত ভদ্রমহিলা বিয়ের আগে ওইরকম কিছু ছিলেন-টিলেন। তা ছাড়া লখনৌ, বেগম ইত্যাদি সব একসঙ্গে শুনে জেঠুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জানিসই তো সব।’
—‘তুই, তুই নিজে কী মনে করিস?’
—‘কী বিষয়ে?’
—‘মানে আমার কোনটা চূজ করা উচিত?’
—‘দ্যাখ অপাই, তোর এই লখনৌ-এর স্কলারশিপের ব্যাপারটার পুরো টার্মস অ্যান্ড কনডিশনস না জানা থাকলে তো কোনও মতামত দেওয়া সম্ভব নয়। আমি যেমন এফ. আর. সি এস হতে চাই। ইংলন্ডে যেতে চাই। একটা ওয়াইডার লাইফ, একটা বড় চান্স পেতে। এটাও তোর খানিকটা তেমন। শুধু আমার উচ্চাকাঙক্ষাটার যেমন একটা সোশ্যাল স্যাংশন আছে, তোরটার তেমন নেই। তোর ব্যাপারটা খুব আনসার্টন। আমাদের যদি উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা থাকত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হতাম, অন্ততপক্ষে বাবাটাও যদি বেঁচে থাকত, হী ওয়াজ এ ডেয়ারিং অ্যান্ড সেনসিব্ল ম্যান, তাহলে সেই ভরসায় তোকে এই চান্সটা দেওয়া যেত। কিন্তু আন্ডার দীজ সার্কামস্ট্যান্সেস, আমি জানি না। সত্যিই জানি না, তুইই ডিসাইড কর। এইটুকু বলতে পারি তোর বর, তার দিদি, জামাইবাবু এঁদের আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু এরাই তো সব নয়। শ্বশুর-শাশুড়ি টাইপের লোকগুলোও তো আছে! অ্যাডজাস্টমেন্ট, হ্যানা-ত্যানা। তোর লাইফটা একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে যাবে। তবে সিকিওর থাকবে। তাছাড়া যারা গান-বাজনা ভালোবাসে তারা তো তোকে গান কনটিনিউ করতে দেবেই। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট।’
অপালা বলল—‘ধর, আমি কিছুতেই বিয়েতে রাজি হলাম না, লখনৌ গেলাম। গেলে আমি শিখবই। তোদের ভাষায় অনেক ওপরে উঠবই। এ আমি জানি। কিন্তু ধর সমাজ আমাকে নিল না, মানে সামাজিক সিকিউরিটি যাকে বলছিস তা আমার রইল না। সে ক্ষেত্রে তুই আমার পাশে এসে দাঁড়াবি না? তুই আমায় সিকিওরিটি দিবি না?’
—‘আমি?’ প্রদ্যোৎ বলল—‘আমার নিজেরই সিকিওরিটি কোথায় তার ঠিক নেই। ডাক্তার হয়ে বেরোতে, এস্ট্যাবলিশড্ হতে কত বছর লাগে জানিস?’
অপালা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল—‘আজ আমার নীচে যেতে ভালো লাগছে না। দাদা তোর কাছে শুতে দিবি? প্লীজ!’
—‘শো না। আরে বোকা! তাতে কি হয়েছে? জেঠু অ্যালাউ করলেই হল।’
অপালা বলল—‘তুই এম. আর. সি. পি এফ আর সি এস করতে লন্ডনে যাবি, আমাকে একটু একটুখানি মনে রাখিস। যদি কখনও কোনও একান্ত দরকার হয়, একটু সাহায্য, একটু সাপোর্ট দিবি তো?’
—‘শিওর! কী পাগল বল তো তুই! আফটার অল আমরা দুটোই তো ভাই বোন। পরম্পরকে দেখবো না? কে বলতে পারে তোকেই হয়ত সাপোর্ট দিতে হবে আমায়।’
আরও রাতে সুজাতা ছাতের ঘরে এসে দেখলেন—দু-ভাই বোন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অপালা সাধারণত একটু কুঁকড়ে শোয়। তার একটা হাত তার দাদার গায়ে আলতো ভাবে পড়েছে। খোকা বোধহয় কোনও বই পড়ছিল। বইটা যথারীতি বুকের ওপর উল্টো করে রাখা। দু হাত মাথার ওপর তোলা।
দৃশ্যটা জেঠু পছন্দ করবেন না সুজাতা জানেন। কিন্তু ক’ বছরের আড়াআড়ি এই দুই ভাইবোনের অসহায় ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য তাঁর চোখে জল এনে দিল। তিনি বুঝলেন আজ আর অপুকে তুলতে পারবেন না। এটুকু। মাত্র এইটুকুই তার বিদ্রোহ। কিম্বা বিদ্রোহও নয়। অভিমান। চোখ উঁচু করে আকাশে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। এতখানিক আকাশ, এতখানিক পৃথিবী, অথচ তাঁর ছেলেমেয়ের জন্য একচিলতে ঘরের বেশি কেন নেই! কেন! তিনি আস্তে আস্তে নিচে নেমে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।