গান্ধর্বী (Gandharbi) : 03
অবিকল বৃষ্টি-ধোয়া গন্ধরাজ ফুলের মতো সকাল। আকাশ এখন নিকোনো তকতকে, স্বয়ং গোপাল-গোবিন্দর গায়ের রঙটি চুরি করে পরে ফেলেছে। গাছপালাগুলোও যেখানে যা ছিল সব তেমনি সাবান মেখে নেয়ে-ধুয়ে দ্যুতিময় সবুজ পরিচ্ছদে সেজেছে। আশীর্বাদের মতো সকাল। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রবাসী প্রিয়জনের ফেরার মতো সকাল। জানলার বাইরে থেকে গোছা গোছা রাধাচুড়োর ডাল ঘরের ভেতর অনুপ্রবেশ করবার চেষ্টা করছে। পর্দাগুলোও খুব সুন্দর একটা হালকা সবুজ। তাই সকালের এই বিশ্বজোড়া আলোর মধ্যেও ঘরের ভেতর কেমন একটা সবুজাভ অন্ধকার। অন্য দিন হলে এমন একটা সকালে জেগে উঠতে সোহমের দারুণ লাগত। পৃথিবী সকালের মুখ দেখারও কত আগে সে তার নিজস্ব, একদম একলার ঘরে তানপুরো নিয়ে ভৈঁরো সেধে যেত। আরম্ভ করত মন্দ্র সপ্তকে, ধীরে ধীরে বাড়িয়ে মধ্য-সপ্তকের পা পর্যন্ত বাস। আবার ফিরে আসা, আবার ভিন্ন পথে ভিন্ন মিড়ে সুরের ক্ষুরধার অলিতে গলিতে ঘোরাফেরা। কিন্তু আজ তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা ভারী হয়ে আছে, মন ততোধিক ভারী। সে জানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি যাওয়া দরকার। মাস্টারমশাই তো আশা করবেনই। উপরন্তু মিতুল অপেক্ষা করে থাকবে। কিরকম গান শুনল। কারটা কি রকম সব ক্যারিকেচার করে দেখাবে মিতুল। কিন্তু সোহম শুধু এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুলো। একবার আধবোজা চোখ দিয়ে দেখে নিল মাথার কাছে রাখা টাইমপিসটাতে নটা বেজে গেছে। আরও কিছুক্ষণ সে গড়াবে। তাদের বাড়িতে কারুর প্রাইভেসি, স্বাধীনতা কেউ নষ্ট করে না। মা বেঁচে থাকলে হয়ত এসব অভিজাত নিয়ম মানত না। কিন্তু মা তার তেরো কি চোদ্দ বছর বয়স থেকে সামনে চুল ফেরানো মাথায় আধঘোমটা দেওয়া এক সারদাদেবী গোছের ছবি হয়ে তার পায়ের দিকের দেওয়ালে ঝুলছে। ঘুম ভাঙলেই প্রথম চোখ পড়ে এই ছবিটার ওপর। বউদিদের কারও এতো আগ্রহ বা সাহস নেই যে পরিবারের এই সৃষ্টিছাড়া ছেলেটিকে নিয়ন্ত্রিত করে। সকলেই অবশ্য তাকে ভালোবাসে, সমীহও করে। সমীহ করে তার এই বিশেষ গুণকে, যা পরিবারের আর কারো নেই। সোহম তার পরিবারের বিস্ময়। তাদের বংশানুক্রমিক প্রেসের ব্যবসা। কিন্তু তার বাবা নিজে তো উচ্চশিক্ষিত বটেই, তার তিন দাদাও রেডিওফিজিসিস্ট, অর্ডন্যান্সের বড় অফিসার এবং কেমিস্ট। মাঝখান থেকে সে-ই গানের সঙ্গে কেমিস্ট্রি ল্যাব চলবে না বলে সায়েন্স ছেড়ে দিয়ে এক বছর নষ্ট করে স্ট্রীম বদলালো। এবং হু হু করে গানের জগতে ওপরে উঠতে লাগল। ব্যাপারটা তার অ-শিল্পী কিন্তু উচ্চশিক্ষিত পরিবারে প্রথম প্রথম অস্বস্তি জাগাত, এখন সম্ভ্রম জাগায়। তার বাবা মনে মনে আত্মপ্রসাদের সঙ্গে ভাবেন—‘আমার সব ছেলেগুলিই ট্যালেন্টেড কে জানে ছোটটা সবচেয়ে বেশি কিনা।’
দ্বিতীয়বার পাশ ফিরতে যাচ্ছে, ঘরে কে ঢুকছে মনে হল। মেজ বউ-দি নাকি? তার মাঝে মাঝে এ ধরনের সাহস এবং ইচ্ছে হয়। ভালো করে চোখ মেলে সোহম দেখল দীপালি। এরকম অবস্থায় তার পক্ষে শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। ভেতরে ভেতরে ভীষণ লজ্জা পেয়ে—‘আরে দীপালি নাকি, বোসো, বোসো, প্লীজ, আমি বাথরুম থেকে আসছি।’ চোখ কচলাতে কচলাতে একদম এক লাফে সে বাথরুমে পৌঁছে গেল।
দীপালি সোহমের বাড়ি প্রায়ই আসে। অপুর বাড়িও যায়। কিন্তু সোহমের বাড়িতে যে ধরনের অবারিত দ্বার, স্বাধীনতা, আধুনিক রুচি-মেজাজ ও আতিথ্য তা তো অপুর বাড়ি নেই। এখানে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোহমের সঙ্গে গল্প করো, গান করো, কেউ না ডাকলে উঁকি দিয়েও দেখতে আসবে না, সোহমের ফরমাশ মতো খাবার পৌঁছে যাবে হোটেলের ক্ষিপ্রতায় এবং কেতায়। ওদিকে অপু তার খুব প্রিয় হলেও অপুর তো নিজস্ব একটা ঘরই নেই। নেই দীপালিরও। তারা তিন বোন এক ঘরে শোয়। কিন্তু তিনজনেই বোন তো! অপুর যা কিছু নির্জনতা তার চিলেকোঠায় ঘরে। সে ঘর তার দাদার। স্বভাবতই তার দাদা এবং দাদার বন্ধুরাও অনেক সময়েই ঘরখানা অধিকার করে থাকে। তার জ্যাঠামশায়ের শেয়ারে অবশ্য দুখানা ঘর—একখানা শোবার, একখানা বসবার। কিন্তু সেদিকে অপু কেন বাড়ির কেউই পারতপক্ষে যায় না। বাকি রইল একখানা ঘর। যেটাতে অপু তার মায়ের সঙ্গে শোয়। সে ঘরে খাট, আলনা, বাড়তি বিছানার মাচা, খাটের তলায় হাঁড়ি-কুঁড়ি, চৌকিতে সেলাই-কল, কি আছে আর কি নেই হিসেব করতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। একতলার এক দিকটা ভাড়া। সেদিকের উঠোনের অংশটা তো প্রায়ই খুব অপরিষ্কার হয়ে থাকে। এদিকে রান্নাঘর। সামনে দাওয়া, আর একটা ছোট্ট ঘর, যেটাকে ওরা গুদোম ঘর বলে ব্যবহার করে। বাথরুমে যেতে হলে উঠোন পার হয়ে যেতে হবে। দোতলাতেও অবশ্য একটা ছোটমতো আছে, জ্যাঠামশাইয়ের অংশের লাগোয়া, তাতে তোলা-জল থাকে। জলের হিসেবে কম পড়লেই, কাউকে না কাউকে নিচ থেকে এনে ঢাউস বালতিটা ভর্তি করে রাখতে হবে।
অপুকে ভালো লাগলেও অপুর বাড়ি যেতে ভালো লাগে না দীপালির। তারা পাঁচ বোন। অপুর মতোই পিতৃহীন। কিন্তু মা এবং পাঁচ বোন মিলে তাদের ফাটা সিমেন্টের মেঝে, চৌপাল্লার জানলা, জায়গায় জায়গায় আগড়হীন দরজা এবং সাবেক কালের আলমারি, পা-মেশিন, ট্রাঙ্ক-বাক্স, দেরাজ-আয়না এতো গুছিয়ে রাখে যে অল্প জায়গাকেও অল্প বলে মনে হয় না। তার বড়দি পাশ করা নার্স, মেজদি স্কুলের সেলাই-টিচার, সেজ জন একদিকে নাচ শেখে আর একদিকে রাজ্যের পুঁচকে পুঁচকেকে নাচ শেখায়, চতুর্থ সে। সে-ও গান শিখিয়ে ভালোই উপার্জন করে। ছোট এখনও স্কুলে, কিন্তু হলে হবে কি এতো ভালো সাজাতে পারে, আলপানা দিতে পারে যে বিয়ের মরশুমে তাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এবং কোনটাই সে একেবারে বিনা দক্ষিণায় করে না। ফলে তাদের সংসার মৌচাকের মতো বিন্দু বিন্দু মধু দিয়ে ভরা। সবার ওপরে রানী মৌ মা। সংসারের কর্তৃত্ব এবং তাদের পাঁচ বোনের পরিচালনার দায়িত্ব মোটামুটি তাঁরই হাতে। সকলেই স্বাবলম্বী। সকলেই হিসেবী, গোছালো। তাই তাদের পয়সা-কড়ির অভাবও তেমন কিছু নেই। যদিও প্রত্যেককেই অসম্ভব খাটতে হয়। মা চান, এইবার একটি একটি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু কিছুতেই, একটা মেয়েরও বিয়ে হচ্ছে না, অথচ প্রত্যেকে গুণী, প্রত্যেকে স্মার্ট, গৃহকর্মনিপুণা। দেখতে-শুনতেও অল্পবিস্তর সুশ্রী। দীপালি হেসে বলে—‘ব্যাপারটা কি জানিস অপু হবু জামাইরা এতগুলো শালী দেখে ভড়কে যায়, ভাবে সব গুলোই বুঝি ঘাড়ে চাপবে।’
সোহম এই বাড়ির এক চতুর্থাংশের অধিকারী। দোতলায় তার শোবার ঘর এবং পড়া ও গানের ঘর পাশাপাশি। এছাড়াও আছে, ঘরের সঙ্গে টয়লেট, চমৎকার একটি ব্যালকনি এবং ছোট্ট একটু কিচেনেট। সোহমদের বাড়ির তিন চারটি কাজের লোকের মধ্যে একটি বনমালী। তাকে আদেশ করলেই সে ছোটবাবুর ফরমাশমতো খাবার-দাবার ঐ ছোট্ট রান্নাঘরে বানিয়ে দেয়। বউদিদের কাউকেও ফরমায়েশ করতে হয় না। আর নানা ধরনের মজলিশ সোহমের ঘরে যখন তখনই হয়। তার কলেজের বন্ধু, গানবাজনার জগতের বন্ধু, পাড়াতেও সে অঢেল পপুলারিটি পায়।
দীপালি দক্ষিণের দিকে তাকালো চমকে। চমৎকার একটা গন্ধ ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে ভেসে এলো। ওদিকেই সুন্দর ঝুলবারান্দাটা। সবুজ-পর্দাগুলো লেসের, সরু সরু, ছোট্ট ছোট্ট কাঁচুলির মতো। তাদের ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে হাওয়া আসছে। মাথার ওপর ঘুরছে বাজারের সবচেয়ে দামী ফ্যান। খাটের উল্টোদিকে দেওয়াল জোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি। কোনও আর্টিস্টের আঁকা তেলরঙ। এই পাহাড় দেখতে দেখতে রোজ ঘুমোয় সোহম। খাটের পায়ের দিকে ওর মায়ের রঙিন ছবি। বেশ ভালো করে রি-টাচ্ করা।
এর আগে কখনও ঠিক এই ঘরটিতে এসে বসেনি দীপালি। পাশের ঘরটাই সোহমের আড্ডাখানা। সেটাকে গানঘরও বলা যায়। মেহগনি কাঠের, কাচের পাল্লা বসানো দেরাজে পর পর শোয়ানো আছে তানপুরো তানপুরো আর একটা, বাঁয়া তবলা, একটা সারেঙ্গি। শখ করে এটাও মাস্টারমশায়ের কাছে শিখছে সোহম। আজকে বাড়িতে ঢুকতে প্রথমেই মেজ বউদির সঙ্গে দেখা। ইনি বেশ মাই-ডিয়ার গোছের বউদি। ফিজিক্স-বউদি অর্থাৎ বড়বউদির মতো গম্ভীর-গাম্ভার অল্পভাষী নয়। ওকে ঢুকতে দেখে মেজ-বউদি বললেন ‘ওমা, দীপালি, তুমি এতো সকালে?’ দীপালিকে এঁরা সবাই পছন্দ করেন। সে সপ্রতিভ, সে পরিচ্ছন্ন, ফ্যাশনদুরস্ত। তার সাজপোশাক, কথাবার্তা চালচলন দেখলে কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না সে ভবানীপুরের একটা বারো ফুট গলিতে এক তলার দুখানা ঘর, এক চিলতে উঠোন, একটা টিনঘেরা কলঘর নিয়ে থাকে। এতো সকালেই দীপালির প্রসাধন সারা। আসলে দীপালি যখনকার যা তখনকার মতো প্রসাধন ছাড়া বেরোনোর কথা কল্পনাই করতে পারে না। অপুর মতো তেল চকচকে মাথা, নাকের ডগা লাল, মুখে পাউডার নেই, ব্লাউজে সেফটি-পিন—এসব তার চিন্তার বাইরে। সে রঙ মিলিয়ে নীল রঙের হালকা, সিনথেটিক শাড়ি-ব্লাউজ পরেছে। দেশীই কিন্তু দেখলে মনে হবে বাইরের। তার চোখে কাজল, ঠোঁটে ঈষৎ লিপস্টিক, হাতে দামী বিদেশী ঘড়ি—এসব কোথায় কম দামে পাওয়া যায়, তার নাড়ি-নক্ষত্র দীপালির জানা। পায়ের চটিটি পর্যন্ত নেভিব্লু রঙের, রঙ মেলানো, সে মেজবউদির কথার উত্তরে হেসে বলেছিল—‘কেন, বুঝতে পারছেন না বউদি? সোহমকে কংগ্রাচুলেট করতে, আবার কি? আর খুব সকালও নেই। নটা বেজে গেছে, গাইয়েদের সকাল অনেক আগে হয়। আপনি রেজাল্ট জানেন না?’
—‘কি করে জানবো ভাই? কাল মাঝরাত্তিরে কেলে হাঁড়ির মতো মুখ করে এসে শুয়ে পড়ল, কিছু খেল না, দেলো না, বাবা বললেন,—“অতবড় কম্পিটিশন। নিশ্চয়ই খাইয়েছে। ওকে এখন বিরক্ত কর না।”
দীপালি বলল—‘কোনও মানেই হয় না। সোহম থার্ড এসেছে। পুরো ইস্টার্ন রিজিওনের ট্যালেন্ট সার্চ কম্পিটিশন করেছে সুরলোক। একেবারে কনফারেন্স স্টাইল। সেখানে খেয়ালে থার্ড হওয়া ইয়ার্কি নাকি?’
—‘তাই বলো’—মেজ বউদি লম্বা চুলের তলায় গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বললেন। তাকিয়ে তাকিয়ে দীপালি ভাবল—অন্তত রঙে সে সোহমের মেজবউদির কাছে হারছে না। চুলও তার একটু একটু কোঁকড়া, মেজবউদির গুলো একেবারে সোজা।
—‘তাই বাবুর রাগ হয়েছে।’ মেজ বউদির মুখে হাসি, ‘ফার্স্ট কে হল? অপালা মিত্র?’
—‘নাহ!’ দীপালি হতাশ ভঙ্গিতে বলল—‘অপালাও না। সাদিক হোসেন বলে কে একটি আসামের ছেলে, কোনদিন নামও শুনিনি। অপালা সেকেন্ড এসেছে।’
মেজ বউদি বললেন—‘তুমি সোজা ওর ঘরে চলে যাও। বেলা নটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। আমি চা-টা সব পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাল রাত-উপোসী আছে, উঠেই খাই খাই করবে।’
বউদির অনুরোধ এবং অনুমতির সূত্র ধরেই দীপালির প্রথম এই ঘরে ঢোকা। পর্দা দুহাতে সরিয়ে ঘরে ঢুকতে তার কেমন গা শিরশির করছিল। ছেলেরা কেমন করে শুয়ে থাকে কে জানে! কে জানে খালি গায়ে নাকি? সোহমের বুকে সামান্য চুল আছে, তার খোলা শার্ট বা পাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যায়। অনেক কষ্টে নিজের ভেতরের শিরশিরোনি থামিয়ে সে ঘরে ঢুকেছে এবং ঢুকে অবাক হয়ে গেছে। এতে পরিচ্ছন্ন, এতো সুবাসিত, এতো সুন্দর ও শালীন যে একটা এই বয়সের ছেলের ঘর হতে পারে সে ভাবতেও পারেনি। উত্তর-দক্ষিণ মুখোমুখি জানলা খোলা, মাথার ওপর তা সত্ত্বেও ফ্যান ঘুরছে। সোহম তার ডোরা-কাটা নাইটড্রেস পরে দুটো বালিশের ওপর একরকম উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। তার অবিন্যস্ত অজস্র চুল বালিশ ছাড়িয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দীপালি একটা দোলনা চেয়ার টেনে বসেছিল। সে বসে থাকাকালীনই সোহম তিন-চারবার ওল্টালো পাল্টালো, দীপালির বুক দুরদুর করছিল, কিন্তু কোনও অশালীন অশোভন উন্মোচন ঘটল না। অবশেষে তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে সোহম ধড়মড় করে উঠে বসল এবং তারপর একলাফে বাথরুমের দরজায়।
একটু দেরি হল সোহমের। সে একেবারে স্নান সেরে বেরিয়েছে। কোনও একটা ও-ডি-কালোন, না-কি বাথসল্ট ফল্ট ব্যবহার করেছে বোধহয়। ঘরময় মৃদু সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। সোহম মেয়েদের মতো শেখিন। পাটভাঙা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে, চুল উল্টে আঁচড়ে বেরিয়েছে। একটু তাড়াহুড়োর ছাপ। চোখগুলো ওর এমনিতেই একটু রক্তাভ। রাত-জাগা বা বেশি ঘুমোনোর জন্যে আরও বেশি লাল হয়ে উঠেছে। ঘুমন্ত এবং অবিন্যস্ত থাকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপই বোধহয় সে আজ একটু বেশি সেজেছে। পাঞ্জাবিতে নীল কাজ। সৌরভটা একটু বেশি রকমই ঢেলেছে।
বিছানাটা দ্রুত হাতে গুছিয়ে ফেলতে ফেলতে সে বলল— ‘ওয়েট এ মিনিট।’
দীপালি বলল— ‘আমি একটু হাত লাগালেই···’
—‘ক্ষেপেছিস!’
—‘কংগ্র্যাট্স্ সোহম।’
—‘টু হেল উইথ ইয়োর কংগ্র্যাট্স্।’
—‘অত রাগছিস কেন বাবা? মনে রাখিস এটা কোনও সাধারণ কম্পিটিশন নয়। এরকম আগে হয়নি। পরে হবে কিনা তাই বা কে বলতে পারে।’
সোহম এবার কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
—‘যেতে দে ওসব কথা। গানটা অবশ্য আমি একেবারেই খারাপ গাইনি। ওয়ান অফ মাই বেস্ট দীপু।’
—‘তুই কি করে ভাবিস মাস্টারমশাই থাকতে তুই অপালাকে ছাড়িয়ে যাবি?’
—‘সেটা তো আরও বড় প্রশ্ন আমার। অপালা কাল যা গেয়েছে, আমি ওর গলাতেও অদ্যাবধি অমন গান শুনিনি। আর ওইরকম বাগ-বিতণ্ডার পর। ও যে অত স্মার্টলি জবাবগুলো দেবে ভাবতে পেরেছিলি? তানপুরো হাতে নিলেই অপালা মিত্র আর মনুষ্যলোকে থাকে না। কিভাবে নিজেকে কালেক্ট করল! যে রাগ তৈরি করে এসেছিল, সেটা ছাড়া অন্য সাজেশন এলো অমনি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে। অথচ অবলীলায় গেয়ে গেলো, আহা! সু প্নো মে আওয়ে পিয়া’, সুর করে গেয়ে উঠল সোহম। বলল—‘মধ্যলয় থেকেই তো আমার ওড়িশি নাচতে ইচ্ছে করছিল। প্রতিটি গান্ধারে আর নিখাদে যেই থামছিল আমার দীপু সত্যি মনে হচ্ছিল কোণার্কের টপ-ফেজের সেই যক্ষিণী না সুরসুন্দরী বলে তাদের কথা। যেন নাচতে নাচতে কেউ ঠিক অমনি ভাবে ত্রিভঙ্গ পোজে থেমে গেল।’
দীপালি বলল—‘তুই কি আজকাল নাচও শিখছিস নাকি?’
—‘শিখছি না, তবে দেখছি, দেখেছি, ভালো প্রোগ্রাম থাকলে একটাও মিস করি না। আর কোণার্ক দেখেছি অলরেডি বার চারেক, ভবিষ্যতেও কতবার দেখব বলতে পারছি না।’
দীপালি বলল— ‘দ্যাখ সোহম, তোরা একটু বাড়াবাড়ি করিস। ভয়ানক ইমোশন্যাল, ইম্পালসিভ। প্রথমত, অপালা ভালো গাইলেও অত বড় ওস্তাদকে ওভাবে বলবার সাহস পায় কোথা থেকে রে? “সকালের রাগ কখন গাইব?” পাণ্ডিত্য ফলানো হচ্ছে চন্দ্রকান্তজীর সামনে? মার্গসঙ্গীতের জগতে সহবৎ একটা মস্ত জিনিস তা জানিস?’
—‘কি জানি, আমার তো ওকে কোথাও বে-সহবৎ মনে হয়নি। অপালার বিনয় নিয়ে বোধহয় কোনও দ্বিমত নেই। আমি তো শ্রোতাদের মধ্যেই ছিলুম। অনেককেই তারিফ করতে শুনেছি।’
দীপালি বিরক্ত হয়ে বলল— ‘এটাও জেনে রাখিস সমস্ত জিনিসটা মাস্টারমশাইয়ের শিখিয়ে দেওয়া। গিমিক। নইলে আমরা এতোজন সন্ধের রাতের রাগ তৈরি করে গেলুম, ও হঠাৎ তোড়ি আরম্ভ করল কেন? ওরা কিছু নিয়ম-কানুন করেনি ঠিকই। কিন্তু এটা তো কমনসেন্স! জানবি তোড়ি দিয়ে আরম্ভ, সওয়াল-জবাব যে কোনও রাগ গাইতে চাওয়া এ সমস্তই মাস্টারমশাইয়ের শেখানো। ওর রেঞ্জ দেখানোর চেষ্টা। ভোরের রাগে আলাপটা ও তো সত্যিই বেশি ভালো করে! দেখলি না পুরিয়াতে চট করে গান ধরে দিল!’
সোহম বলল—‘যদি ওর ভালো তৈরি নয় এমন কোনও রাগ গাইতে বলতেন পন্ডিতজী, কী করত ও?’
দীপালি মৃদু হেসে বলল—‘দ্যাখ সোহম, কিছু মনে করিস না আমরা প্রয়াগ, চন্ডীগড় এ সব পরীক্ষাগুলোয় ছাত্র-ছাত্রী বসিয়ে বসিয়ে ঘুণ হয়ে গেছি। আমরা পরীক্ষকদের সাইকলজি পরিষ্কার বুঝি। পণ্ডিতজীর প্রিয় রাগ পুরিয়া, লোকে বলে উনি পুরিয়ায় আর শুধ্ কল্যাণে সিদ্ধ। নিজেই সময়ের প্রশ্ন তুলেছেন, এটা এখন অনুমান, কিন্তু নাইনটিনাইন পার্সেন্ট অভ্রান্ত অনুমান যে উনি ওকে পুরিয়া গাইতে বলবেন। আর গাইলও তো দেখলি ওঁরই বন্দিশ, ওঁরই প্যাটার্নে।’
—‘এটা কিন্তু ঠিক বললি না দীপু। পণ্ডিতজীর স্টাইল সাংঘাতিক ভিরাইল, গমকে হলক তানে ভর্তি। অপু ওঁর কিছু কিছু জিনিস করেছে। ওঁর ছোট ছোট তান, মুরকি, ফিরৎ, কিন্তু গেয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং ফেমিনিন স্টাইলে। অ্যান্ড হোয়াটেভার ইট ইজ, ও গেয়েছে প্রাণের সমস্ত আবেগ দিয়ে, দুর্দান্ত। ইন ফ্যাক্ট আমি বহু লোককে বলতে শুনেছি সুবিচার হয়নি। সাদিক কি গেয়েছে, বল? একদম স্টিরিওটাইপ্ড্। ইমপ্রোভাইজেশন, তান, শুনলেই বোঝা যায় সব তৈরি। খুব রেওয়াজি গলা, তৈরিও করেছে ভালো, কিন্তু নো অরিজিন্যালিটি। কোনও তুঙ্গ মুহূর্ত পেলুম না। পেয়েছিস?’
‘তানগুলো তুবড়ির মতো করছিল সোহম। তা সত্ত্বেও আমার মতে তোরই ফার্স্ট হওয়া উচিত ছিল। অপালা সেকেণ্ড। সাদিক থার্ড।’
—‘আমি ফার্স্ট অপালা থাকতে? অপালা ওইরকম গাইতে? আমি আশাও করি না। হলে আমার চেয়ে দুঃখিতও কেউ হত না। তোর জাজমেন্ট বায়াজ্ড্ বলতে বাধ্য হচ্ছি।’
—‘হতে পারে’, দীপালি দাঁতে নখ কাটল। ‘তবে অপালার মতো ব্যাকিংও তো তুই পাস না!’
—‘এটা বলিস না দীপু! মাস্টারমশাই আমাদের তিনজনের সঙ্গে হারমোনিয়াম সঙ্গত করে গেছেন। অপুর নেবার ক্ষমতা বেশি, অনেক বেশি তো কী করা যাবে? একে তো কিন্নর কণ্ঠ, তারপর গলাটা আপনি ঘোরে, মনে হয় না তার জন্যে ওকে আলাদা করে কোনও এফর্ট দিতে হচ্ছে।’
—‘যাই বলিস সোহম। অপালা কিন্তু ঠিক খেয়াল গাইল না। ওর দ্রুত গানটা তো একেবারে ঠুংখেয়াল হয়ে গেল।’
—‘ও যে খেয়ালের মেজাজে গাইতে পারে সেটা ও ওর তোড়ির আলাপেই দেখিয়ে দিয়েছে। আর দীপু, এক এক জনের একেকটা স্টাইল আছে। তুই নারায়ণ রাও ব্যাসের রেকর্ডগুলোর কথা মনে কর, বড়ে গোলাম আলি সাহেবের স্টাইলের কথা মনে কর। যাক গে, বাজে কথা ছাড়, কত তো বুঝি! আমার প্রধান দুঃখ অপু ফার্স্ট হল না। আমি সেকণ্ড এলাম না। আর দ্বিতীয় দুঃখ তুই নিজেকে বড্ড নেগলেকট করছিস। ছুকরিগুলোকে শেখানো একটু বন্ধ কর এবার। শেখাতে শেখাতে তোর নিজের রেওয়াজ হচ্ছে না। মাস্টারমশাইয়ের জিনিসগুলো গলায় তোল। অত হেলফেলা করিসনি।’
বনমালী কফি এবং খাবার নিয়ে এসেছে। প্রচুর। লুচি, ঘুগনি, মাংস, চাটনি, মিষ্টি।
সোহম বলল—‘কি রে বনমালী? রাতের ডিনার নিয়ে এলি নাকি? সাত সক্কালবেলা? মার-ধোর খাবি মনে হচ্ছে?’
বনমালী দাঁত বার করে হেসে বলল— ‘মেজ বউদিমণি বলে পাঠিয়েছে এক টুকরো পড়ে থাকলে কর্তাবাবুর কাছে খবর যাবে। কাল রাতে দাঁতে কুটো কাটোনি।’
দীপালি বলল—‘জানিস তো সোহম, গান একরকমের কুস্তি। কালোয়াতি গান। আগেকার ওস্তাদরা পুরী, হালুয়া, মালাই, রাবড়ি এসব না খেয়ে গানে বসতেন না। অনেকে আবার তার আগে কতকগুলো ডন বৈঠক সেরে নিতেন। খেয়ে নে।’
সোহম বলল— ‘খিদে অবশ্য পেয়েছে ঠিকই। যাকগে কি বলছিলুম। গান শেখানো বন্ধ কর।’
দীপালি বলল— ‘আমার গান শেখানো বন্ধ করাও হবে না, কোনও কম্পিটিশনে স্ট্যান্ড করাও হবে না। আমি রব চিরদিন নিষ্ফলের, হতাশার দলে।’
—‘ছাড় তো। যত বাজে চিন্তা। দীপালি তোর কিন্তু খুব ন্যাচার্যালি সুরেলা গলা। বাজে গান গেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নে। খেয়ে নিয়ে চল মাস্টারমশায়ের কাছে যাই। উনি নিশ্চয়ই এক্সপেক্ট করছেন। আমাদের তিনজনের সঙ্গে সমানে হারমোনিয়াম সঙ্গত করেছেন। ভাগ্যিস ওরা হারমোনিয়ামটা অ্যালাউ করেছিল। নাহলে অত জমাটি হত না। কাল বড্ড রাগ হয়েছিল। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। আজ তুই আসাতে মেজাজটা ভালো হয়ে গেল। আফটার অল এক গুরুর দুই ছাত্র-ছাত্রীকে ওরা প্লেস দিয়েছে। দ্যাট ইজ সামথিং।’
দীপালি বলল— ‘সকালে গিয়ে লাভ নেই। মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই অপুকে খবরটা এবং সান্ত্বনা দিতে গেছেন।’
সোহম বলল— ‘তা হোক, মিতুল তো আছে। মিতুলও এক্সপেক্ট করবে।’
দীপালির মুখ একটু চীনেধাঁচের। খুব ফর্সা, ছোট ছোট ফুলো ফুলো বাঁকা চোখ। গোলগাল চ্যাপ্টা মুখ এবং শরীরের গড়ন। এ ধরনের মুখে মনের ভাব চট করে ফোটে না। সে শুধু বলল— ‘মিতুল? মিতুল কি করবে? মিতুল তো তোমার খবর জেনেই গেছে। তা ছাড়া মিতুল নিশ্চয় এতক্ষণে স্কুলে চলে গেছে।’
সোহম একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল— ‘তা অবশ্য। তা অবশ্য। ঠিক আছে, বিকেলের দিকেই যাবো। তবে তখন তো মাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন কিনা! তোর এখন কী প্রোগ্রাম?’
দীপালি হাত উল্টে বলল— ‘আমার আবার কি প্রোগ্রাম হবে? খাড়া বড়ি থোড়, আর থোড় বড়ি খাড়া। তোকে কংগ্র্যাচুলেট করতে এসেছিলুম। এবার বাড়ি চলে যাবো। অনেক কাজ বাকি। সকালে এক ব্যাচ আসার কথা ছিল। ফাঁকি মেরেছি। কিন্তু দুটো মেয়ে আসে ইনডিভিজ্যুয়ালি। তাদের আমায় অ্যাটেন্ড করতেই হবে। বেসুরো-বেতালার দল সব। কিন্তু তাদের মা-বাবারা তাদের সঙ্গীতপ্রভাকর করে তুলবেই। আমি তাদের জন্যেই বলিপ্রদত্ত ভাই।’
সোহম অন্যমনস্ক গলায় বলল— ‘ঠিক আছে। আমি আজ সকালটা রিল্যাক্স করি। কিম্বা ‘ক্রিটিক অব পিওর রীজন’ বলে একখানা পাঠ্য বই আছে। দেখি উদ্ধার করতে পারি কিনা। কর্তাবাবুর কড়া হুকুম, ভীষ্মদেবই হও আর তারাপদ চক্কোত্তিই হও, এম এ হতেই হবে।’
দীপালিকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সোহম। দীপালি বাঁক ফিরছে। মুখ পেছনে ফিরিয়ে একবার হাতটা নাড়ল। তারপর প্রিয়নাথ মল্লিক রোড়ের বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে গেল। বড় ভালো মেয়ে দীপালি। এমন সেতারের মতো সুরেলা মিঠে আওয়াজ নিয়েও আজ কতগুলো বচ্ছর একই জায়গায় আটকে আছে। তবু কোনও নালিশ নেই। সোহম, অপালা, বিশেষত সোহমের জয়েই যেন ওর জয়। এই ধরনের ঈর্ষাহীন পরিবেশের জন্যেই মাস্টারমশাই-এর কাছে শিখতে আরও ভালো লাগে তার। আরও অনেক সফল শিক্ষক আছেন। তাঁরা গলায় সব কিছু করে দেখান। মাস্টারমশাই যখন গলায় পারেন না হার্মোনিয়মে, এসরাজে, সেতারে দেখান। ফলে হয়ত আরও সূক্ষ্ম কাজ, আরও লম্বা লম্বা মিড় আরও তড়িৎগতি তান তাদের গলায় এসে যায়। মিতুল কি হয়ে উঠবে কে জানে? শী ইজ সুইট সিক্সটিন। ওর মা নাকি খুব সুন্দরী ছিলেন। মিতুল নিশ্চয়ই তাঁর মতনই হয়েছে। আহা! তার মার মতো ওর মা-ও ওর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হঠাৎ হার্ট-অ্যাটাকে মারা যান। বাবার গলার সুর ও পায়নি। কিন্তু মাস্টারমশাই অসীম ধৈর্যে ওকে নিয়ে পড়ে আছেন। বলা কিছু যায় না। চার পাঁচ বছর পর হয়ত ওর ওই ধরা ধরা গলা দিয়ে অন্যরকম সুর বেরোবে। ওর ঝোঁক আপাতত লাইট ক্ল্যাসিক্যালের দিকে। গায়। প্রচুর শোনে। সবচেয়ে ঝোঁক অবশ্য নাচে। ওর কাছে কিছু-কিছু নাচ দেখেছে সোহম। সম্পূর্ণ অশিক্ষিত পটুত্ব থেকে যে এ ধরনের নাচ হওয়া সম্ভব তা সোহম না দেখলে বিশ্বাস করত না। কিন্তু ভারী চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। ধৈর্য কম। ঠিক তৈরি হয়ে উঠতে পারছে না।
দীপালি চলে যাবার আধঘণ্টা পর সোহম চুলটা আঁচড়ে শার্ট প্যান্ট পরে নিল। বনমালীকে ডেকে বলল—‘বউদিকে বলে দিস আজ কলেজ যাচ্ছি না। দুপুরে এসে ভাত খাবো। বেলা হতে পারে।’
সে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মুখে যাচ্ছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি। আজ শনিবার। মিতুলের স্কুল ছুটি থাকে। যাবার সময়ে সে একটা মনোহারি দোকান থেকে বেছে বেছে কিছু ভালো চকলেট কিনল। মিতুল চকলেট খেতে দারুণ ভালোবাসে।