গান্ধর্বী (Gandharbi) : 23
পরের বহস্পতিবার যখন বিবেকানন্দ পার্কে সারারাতের ফাংশনে জমজমাট আসরে সোহম এবং অপালা শুদ্ধ কল্যাণে গান ধরেছে, তখন রণো দু ঘন্টার ওপর মেট্রোর তলায় সুমনের জন্য অপেক্ষা করে করে অবশেষে যাবার জন্য পা বাড়ালো। হঠাৎ সে দেখতে পেলো একটা ইমপোর্টেড কার এসে থামল, তার থেকে নীচে নেমে সুমনকে নামাল একটি বিজ্ঞাপনের মডেলের মতো দেখতে ছেলে। প্রথমটা সুমন তাকে দেখেও দেখল না। দু’জনেই ওরা মেট্রোর ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল, হঠাৎ সুমন পেছন ফিরে বলল—‘হাই রণো, তুমি এখানে? কতক্ষণ?’ বলতে বলতে একটা চোখ ছোট করে টিপল সে, মুখে একটা দুষ্টু হাসি। সঙ্গের ছেলেটি পেছন ফেরেনি। সুমন তার হাত ধরে টানলো—তারপর রণোকে দেখিয়ে বলল—‘মিট রণো, ওয়ান অফ মাই ব্লাইন্ড অ্যাডমায়ারার্স। রণো, দিস ইজ সঞ্জয়, বাবার পার্টনারের ছেলে, বম্বে থেকে এসেছে। মোস্ট প্ৰব্যাবলি উই আর গোয়িং টু বি এনগেজড সুন।’ সঞ্জয় ছেলেটি রণোর দিকে ফিরেও দেখল না। বিড় বিড় করে একটা কী বলল, তারপর সুমনের পিঠে হাত দিয়ে—মেট্রোর ভেতরে ঢুকে গেল।
অনেক দিন পর এই বিশাল জনমণ্ডলীর সামনে বড় রাগ গাইতে পেরে সোহমের বুকটা ভরে ভরে উঠছে। তার অভ্যাস হঠাৎই দ্রুত লয়ের দিকে চলে যাওয়া, এটাকে অপালা তার ধৈর্য, বিলম্বিতে তার অজস্র সুরবৈচিত্র্য দিয়ে সংযত করে রেখেছে। অপালার গান আজ আকাশের মতো, যার ওপর দিয়ে বহু মেঘের, সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের, চন্দ্র, তারকারাজির খেলা হয় আবার মিলিয়ে গিয়ে সেই গভীর নীল ব্যাপ্তি বেরিয়ে পড়ে। সোহমের গান যেন সমুদ্র। বারবার ফিরে যায়, বারবার সহ ব্রেকারে ভেঙে পড়ে। কখনোই একভাবে নয়। কখনও হামাগুড়ি দিতে দিতে ছুটে আসছে সুর, দূর থেকে একটা কলরোল আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, কখনও হুস্স্ করে এসে ফেনায় ভর্তি জলরাশি ছড়িয়ে গেল, তার সেই সুরের সমুদ্রের ওপর জ্যোৎস্নার আদিগন্ত রুপোলি ঝারির জল ছিটিয়ে দিচ্ছে অপালা ‘মন্দবরা বাজো রে…’ সোহম সেই জ্যোৎস্নার রাশি ফেনার কিরীটে টেউয়ের মাথায় মাথায় জড়ো করছে। হলকের পর হলকে। খেয়ালের পর তরানা, আর তিলং ঠুংরি গেয়ে তার কতকগুলো জনপ্রিয় গজল ধরল সোহম, বহু অনুরোধ আসছে। ‘ভজন অপালা দত্তগুপ্তর ভজন,’ একদল চেঁচিয়ে বলে উঠল। অপালা দুটি মাত্র নিবেদন করলো—‘না তীরথ মে, না মূরত মে, ম্যঁয় তো তেরি পাস মে,’ আর ‘সাধো সাধো মন কা মান তিয়াগো/কামক্রোধ সঙ্গত দুর্জন কী/ইন্ তে অহনিশি ভাগো।’ বহু অনুরোধ-উপরোধেও সে আর কান দিলো না, গলায় কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে মাফ চাইল। দু’জনে মিলে আজ প্রায় চার ঘণ্টা পার করে দিয়েছে। আজ বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। নানান কারণে।
সোহম গ্রীনরুমে এসে বলল—‘অপু, তোর কর্তা কি একটু জেলাস হয়ে উঠেছেন আমার ওপর?’
অপালা বলল—‘যাঃ।’
—‘না যতগুলো প্রোগ্রাম একসঙ্গে করলাম, ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত বসে রইলেন, প্রতিদিন তোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেও থেকে থেকেই এসে পড়ছেন। আজই শুধু আসেননি দেখছি।’
—‘তুই ভুলে গেছিস সোহম, আমার গান শুনেই উনি আমাকে পছন্দ করেছিলেন। উনি গান খুব ভালোবাসেন।’
—‘আমি আসবার আগের প্রোগ্রামগুলোতেও এভাবে থাকতেন সারাক্ষণ!’
অপালা বলল—‘তুই আসার আগে আর প্রোগ্রাম করেছি কই, অতি সামান্য।’
—‘লেটস হোপ ফর দা বেস্ট, অপু, আমার কিন্তু মনে হয়, কিছু মনে করিস না, শিবনাথদাকে ওপর থেকে যতটা সরল বলে মনে হয়, ভেতরে উনি ততটা না।’
এ কথা অপালা জানে। সোহম বলল—‘এই শাড়িটা তোকে কে দিয়েছে? গরদ?’
—‘কে আর দেবে? উনিই। এই প্রোগ্রামটার জন্যে বিশেষ করে কিনে আনলেন। এটা গরদ নয়, কড়িয়াল।’
—‘তাহলে আমার সন্দেহ ঠিকই। এডিনবরায় বৃন্দা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব হয় আমার। গজল ভীষণ ভালোবাসত। সারা ইংল্যান্ডে একরকম আমার ইমপ্রেসারিওর কাজ করেছে। তা তার হাজব্যান্ডও অবিকল এই রকম করতেন। অলদো হী হিমসেল্ফ্ ওয়াজ এ নাম্বার ওয়ান ডন জুয়ান।’
—‘আমার স্বামী এরকম নয় সোহম। এভাবে বলিস না। আমার খারাপ লাগছে।’
—‘সরি অপু, বৃন্দার স্বামীর পুরো চরিত্রটার সঙ্গে আমি শিবনাথদার তুলনা করতে চাইনি। আসলে বহু দেশের বহু মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে আমি ঝানু হয়ে গেছি। আর অপু তুই এখনও সেই বিংশতিবর্ষীয়া বালিকাই রয়ে গেলি, সুরের আমি, সুরের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’
অপালা বলল— ‘ঠিকই বলেছিস। তোর মতো যদি মনের কথা মুখের ভাবে ফোটাতে পারতুম!’
—‘আমি অন্তত প্রকাশ্য আসরে বসে ভাবাবেগে কাঁদি না অপু।’
অপালা মুখ নিচু করে ফেলল। সোহম এখন রাত শেষ পর্যন্ত গান শুনবে। অপালা কিছুতেই শুনল না, চলে গেল।
বাড়ি এখন নিঝুম। দরজা খুলে দিল টিটু। অপালা বলল—‘রণো ফিরেছে!’
—‘কখন। এখন সাড়ে বারোটা বাজছে মা!’
—‘খেয়েছে?’
—‘বলতে পারবো না।’
—‘কেন বলতে পারবি না?’ অসহিষ্ণু গলায় বলল অপালা।
—‘আহা খেতে দেওয়া-টেওয়া ওসব ঠাম্মার ডিপার্টমেন্ট। আমি কি করে জানবো? দাদার ধারে-কাছে আমি থাকি নাকি? কথায় কথায় যা রেগে যায়! একমাত্র ঠাম্মাই ওকে ট্যাক্ল্ করতে পারে।’
কম্বলের মধ্যে যখন ঢুকলো অপালা তখন রাত দেড়টা হবে। শিবনাথের রকম-সকম দেখে অপালা বলল—‘প্লীজ, আজ আমায় ছেড়ে দাও। ভালো লাগছে না।’ একে গেয়ে সে ক্লান্ত, তার ওপর রণোর জন্য সমস্ত মনটা ভার হয়ে আছে। শিবনাথ বললেন—‘তা ভালো লাগবে কেন? সোহম হলে হয়ত লাগত।’
অপালা পাশ ফিরে শুয়েছিল। প্রবল বিস্ময়ে এবং ব্যথায় সে উঠে বসল, সোহম তাহলে ঠিকই বুঝেছে। তার স্বামীকে তার চেয়ে সোহম বেশি চিনেছে। সে শিবনাথের শরীরের ওপর ঝুকে বলল—‘কী বললে তুমি?’
—‘যা বলেছি তুমি শুনেছে, এক কথা দ্বিতীয়বার বলতে আমার ঘৃণা হয়।’
অপালা বলল—‘যা বললে, দ্বিতীয়বার আর এ কথা উচ্চারণ করো না।’
শিবনাথ হতভম্ব হয়ে গেছেন। এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অপালা কোনদিন কোনও কারণোই এরকম কঠিন, অনম্র সুরে কথা বলেনি।
তিনি মরিয়ার মতো বললেন—‘যদি দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করিই তাহলে কী হবে? কী করবে তুমি আমার?’
অপালা বলল—‘দেখতেই পাবে কী হবে! শেষ কথা ঠিক কী তা কেউ বলতে পারে?’
শিবনাথ হঠাৎ কেমন ভেঙে পড়লেন—‘তবে, তুমি আজকাল আমায় এমন করে ফিরিয়ে দাও কেন? জবাব দাও!’
অপালা বলল—‘তোমাকে আমি চিরকাল ফিরিয়ে দিতে চেয়েছি। পারিনি। আমি ভদ্র বলে। তোমাকে আঘাত করতে আমার কষ্ট হয় বলে। প্রতিবাদ আমার আসে না বলে। কিন্তু তুমি, তোমার মতো এরকম শান্ত ধীর-স্থির দেখতে মানুষ, তুমি … তুমি প্রত্যেকবার আমাকে নিমর্মভাবে রেপ করো। আমি ছাড়া আর অন্য কোনও মেয়ে এ জিনিস বছরের পর বছর সহ্য করতো না। তুমি হয় ভালোবাসো না, নিষ্ঠুর স্বভাবের মানুষ, তোমার ভদ্র শান্ত মুখোশটা শুধু খুলে যায় আমার কাছে, যাকে তুমি চিরকাল বোকা, সরল, নিরীহ বলে উপেক্ষা করে এসেছে, আর নয়তো তুমি … তুমি ভালোবাসতে শেখোনি।’
এতো কথা, এতো নির্মম কথা এভাবে অপালা কোনদিন কাউকে বলেনি। শিবনাথ বললেন—‘তুমি শিখেছ ভালোবাসতে? তুমি জানো? তুমি তো একটা পাথরের টুকরোর মতো, একটা নিশ্চেতন জড় পদার্থের মতো!’
—‘আক্রমণ করলে মানুষকে তার সমস্ত পেশী শক্ত করতেই হয়।’
—‘তাহলে আগে বলোনি কেন? কেন জানাওনি? নিজে যদি জানো কী চাও, তাহলে কেন জানাওনি?’
অপালা ক্লান্ত করুণ স্বরে বলল ‘—ভালোবাসা ঠুংরির মোচড়ের মতো, গজলের পুকারের মতো, সেতারের তরফের তারগুলোর ঝিনিঝিনি আওয়াজের মতো। তুমি গান এতো ভালোবাসো আর এইটুকু অনুভব করবে না, আমি কী করে জানবো বলো?’
অপালার স্বর নির্জন মধ্যরাতের ঘরের মধ্যে বেহাগের পকড়ের মতো বাজতেই লাগল, বাজতেই লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। কিন্তু দুজনেরই ঘুম অগভীর। শিবনাথ স্বপ্ন দেখলেন— তিনি আকাশের ওপর দিয়ে ছুটছেন কাকে ধরবার জন্য, কিন্তু যেই কাছে পৌঁছচ্ছেন সে মিলিয়ে যাচ্ছে, কখনও সে যেন মিতুলের মতো, কখনও তাঁদের অফিসের একটি উত্তরপ্রদেশীয় মহিলা-অফিসার। কখনও সেটা এক টুকরো মেঘ। আর সারাক্ষণ পেছন থেকে মিশ্র কালেংড়ায় ঠুমরি গাইছে কে। তিনি গাইবার চেষ্টা করছেন পারছেন না। গলাটা মিতুলের মতো। অপালা স্বপ্ন দেখল—তার বিয়ে হচ্ছে। বুকের ভেতরটা অস্থির কান্নার দাপাদাপি। কার সঙ্গে যেন বিয়েটা হবার কথা ছিল। অথচ হচ্ছে না। সে দেখল বিয়ের পিঁড়ির ওপর সোহম দাঁড়িয়ে আছে। সেই বহুদিন আগেকার তরুণকান্তি সোহম। সোহম পরম মমতায় তার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে কাঁদছে। কিন্তু এটা যেন একটা ফিলম্। দর্শকদের মধ্যে খুব মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রণো। ‘রণো!’ বলে একটা অস্ফুট চিৎকার করে জেগে উঠল অপালা। বাইরে পাখির কাকলি শোনা যাচ্ছে। ঘুম ভাঙা আধো-আধো স্বর। শিবনাথ অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। অপালাও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল আবার। চোখ জড়িয়ে আসছে।