Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গান্ধর্বী || Bani Basu » Page 22

গান্ধর্বী || Bani Basu

হল পরিপূর্ণ। তিলধারণোর স্থান নেই। চল্লিশের দশকের বিখ্যাত প্রডিজি গায়কবাদক রামেশ্বর ঠাকুরের দুই শ্রেষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রী অপালা দত্তগুপ্ত এবং সোহম্ চক্রবর্তীর যুগলবন্দী। এরা দুজনেই আরও অনেক প্রতিভাবান গুরুর তালিম পেয়েছেন। এক এক করে সেই তালিকা পাঠ হল। আজ তাঁরা দ্বৈতভাবে পেশ করছেন প্রধানত তাঁদের প্রথম গুরু রামেশ্বরজীর তালিম।

এই সঙ্গীতোৎসবে কলকাতার সঙ্গীতরসিকরা তো এসেছেনই। নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন বহু গুণী। মঞ্চের আজ বিশেষ সজ্জা। প্রধানত: এই দুই শিল্পীকে উপস্থিত করা হবে, কিন্তু অন্তত রাত আট সাড়ে আট না বাজলে তাঁদের গান আরম্ভ হয় কী করে? তাই ফাউ হিসেবে দর্শকরা দেখতে পেলেন নতুন দুই শিল্পীর উচ্চমার্গের কত্থক। এঁরা খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে কালীয় দমন ও অহল্যা উদ্ধার দেখালেন। তারপর মঞ্চে আস্তে আস্তে এসে বসলেন যন্ত্রীরা, সারেঙ্গী, দুটি তানপুরা, দুটি হারমোনিয়াম, জোড়া তবলা। অপালা আজ চন্দন রঙের ওপর ঘন লাল পাড় কাঞ্জিভরম পরেছে। মাথায় ফুল। কপালে মেরুন টিপ। এই শাড়ি সোহমের উপহার। মাথার এই ফুলের সাজে তার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল, এত বড় টিপও সে পরতে চায়নি। কিন্তু সোহম অনড়। সে পরেছে তসরের পাঞ্জাবি, তাতে বাদামী কাজ। পায়জামা মানানসই রঙের। তার ডান হাতের আঙুলে গোটা দুই পাথর চমকাচ্ছে।

রামেশ্বরকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ আসনে। একটি নরম সোফায়। তাঁর দুই পাশে দুই শিষ্য। যদি কোনও অসুবিধে বা প্রয়োজন হয়। উদাত্ত খোলা গলায় আরম্ভ করল সোহম্‌। দরবারী। সে ফিরে গেছে বহুদিন আগে। গলায় সেই পুরুষালি বিক্রম। সুরকে যেন দু’ হাতে পাকড়ে ধরেছে। গজলিয়া সোহম নদীস্রোতের ওপর দিয়ে লহরীমালার মধ্যে দিয়ে ভেসে যায়। খেয়ালিয়া সোহম সমুদ্রের তলদেশে অবতরণ করছে। সুরের ডুবুরি। তার পরেই সোনার ঘণ্টার মতো অপালার গলা সুরের মুক্তাগুলি একেক করে তুলে আনল। আজ সবাই এসেছে। শিবনাথ নিজে, অপালার দুই মেয়ে, এমনকি তাদের ঠাকুমা পারুল দেবী এবং দিদিমা সুজাতা পর্যন্ত। খালি রণো বাদ। রণো নেই। ইদানীং রণো ভীষণ ভাবাচ্ছে। তার একটি বন্ধু অপালাকে বলে গেছে রণো নাকি একটি পাঞ্জাবী মেয়ের সঙ্গে খুব ‘উড়ছে’। মেয়েটি নাকি বিরাট ব্যবসায়ী পরিবারের। রণোর মতো ছেলেকে ওরা ‘চাকর’ রাখতে পারে। রণো মাঝে মাঝে খুব দেরিতে ফেরে, দাদু কৈফিয়ত চাইলে বিরক্ত হয়ে বলে কমপিটিটিভ পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া মুখের কথা নয়। এর চেয়ে বেশি কথা জিজ্ঞাসা করবার সাহস কারো হয় না। কপালে তার প্রচণ্ড ভ্রূকুটি। অপালার আলাপের পরতে পরতে খুলে যায় গভীর আর্তি। ‘পট খো-ল’ বলে যে মিড় সে টানছে তার মধ্যে বুক ফাটা কান্না, রণো, রণো, তুই কোথায় যাচ্ছিস! যাদের সঙ্গে প্রথম যুগ থেকে তোর মেলা মেশা সেই তারাই যে তোর নামে যা-তা বলে গেল। রণো তুই এখন বন্ধুবিহীন একা। তার এই সুরের গলিতে অন্বেষণের ফাঁকে সোহম দুর্দান্ত তেজে একটা হলক তান দিল। সে কি মনে করিয়ে দিচ্ছে অপালাকে এবার লয়কারির সময় এসে গেছে! আর এখন এই টানা মিড়ের কাজ নয়! অপালা তখন বিভ্রান্তের মতো সুরগুলি নিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল— রণো তোর বাড়িতে এতজন শুভার্থী রয়েছে, কারুকে তুই কিছু বলতে পারিস না কেন? কাউকে কেন বিশ্বাস করতে পারিস না? শোন রণো, শোন, আমরা বুঝবো। আমি বুঝবো। আর কেউ না বোঝে আমি বুঝব। গলা ধরে গেল অপালার, তার চোখ ভরে উঠেছে। এই গলা ধরে যাওয়াও কী মধুর, ভাবল শ্রোতা! তারপরেই সোহম ধরে নিল দ্রুত বন্দিশ, গমকে গমকে ভরিয়ে দিচ্ছে সে কলামন্দিরের প্রতিটি কোণ, অপালার মধুক্ষরা কণ্ঠ— পরক্ষণেই ছুটে যায় সপাটে। কতক গুলি কূতানের চক্রে ঘুরে ঘুরে আবার দাঁডায় রেখাবে। সোহম এখন গরম হয়ে উঠছে। আবর্তনের পর আবর্তন ঘুরছে তার কণ্ঠ, বিশাল বিশাল তেহাই, সোহম যেটা করছে অপালা ঠিক সেই ভাবে আরম্ভ করে সুরগুলিকে সামান্য এদিক ওদিক করে অন্যরকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে যাচ্ছে। যেখানেই যাস রণো, তোকে আমি উদ্ধার করবোই। বলো বলো হে ঈশ্বর, কোন সে দায়িত্ব যা আমাকে দেওয়া হয়েছিল অথচ আমি পালন করিনি? আতিপাতি খুঁজে বেড়াচ্ছে অপালা তার ফিরৎগুলিতে কোথায় তার ভুল। কেমন করে সে ভুলের সংশোধন হবে! আমি কি ভালোবাসিনি ঠাকুর? রণোকে কি আমি ভালোবাসিনি? গানকে এভাবে ভালোবাসা কি স্বার্থপরতা? আমি বিবাহ চাইনি, স্বামী চাইনি, সন্তান চাইনি, পরিপূর্ণ ভালোবাসার স্বাদ, বাৎসল্যের স্বাদ, রতিসুখের স্বাদ আমি গানে পেয়েছি, গানে আমি পেয়েছি তোমাকে, পেয়েছি না, পাই, নতুন নতুন করে পাবো বলেই ক্ষণে ক্ষণে হারাই। সেই হারানোর বেদনা সে-ও কী মধুর! কিন্তু তুমি এই পার্থিব জগতের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ন্যূনতম জিনিসগুলি আমায় সবই দিলে, না চাইতেই দিলে, তার সঙ্গে দিলে অসংখ্য অজস্র জটিলতা, আমি আমার স্বামীকে বুঝতে পারি না, ছেলে মেয়েদের বুঝতে পারি না, বুঝি না কেন, বিশ্বনাথ অমন উদাসীন, জয়া কেন অমন নিরুত্তাপ। বুঝি না আমার প্রাণ নিংড়ে দেবার পরও কেন শশুর মশাই অত নিষ্ঠুর, শাশুড়ি অত একদেশদর্শী। বলো ঈশ্বর বলো আমার রণো কোথায় যাচ্ছে? যদি না-ই ভালোবাসি তো এতো যন্ত্রণা কেন? এবার ঠুমরি ধরেছে সোহম, নাজনীনের তালিমের ঠুমরি। ‘আজ মুরলি বজাই শুনাই রে। চলো সখি বৃন্দাবন যাই।’ তার গলা মোলায়েম হয়ে গেছে, নাজনীন স্টাইল ঠুমরি, প্রতিটি শ্রোতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তার আবেদন। অপালাও যখন মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে, সে এক একটা দুর্লভ গোধূলির আলো জ্বলা মুহূর্ত। ক্ষণমধুর। চিরকাল মাথায় রাখবার জন্য শ্রোতা আকুল। তারপর ভজন ধরল অপালা। ‘জাগিয়ে রঘুনাথ কুঁয়ার পন্‌ছি বন বোলে’, তোর জেগে ওঠার সময় হলো রণো, পাখি ডাকছে শুনতে পাচ্ছিস না! ঐ তামসী নিদ্রা ত্যাগ কর রণো। চন্দ কিরণ শীতল ভই, চাঁদের কিরণ, সে যে তোর মায়েরই ভালোবাসার কিরণ, বড় শীতল, তুই বুঝিস না? তুলসীদাস অতি আনন্দ, নিরখি কে মুখারবিন্দ। তুলসীদাস আনন্দে থাকতে পারেন তাঁর রঘুনাথ কুঁয়ার, এক আদর্শ বালক, আদর্শ পুরুষ, আদর্শ রাজা হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আমি যে আনন্দিত হতে পারছি না রণো। দীননাথ দেত দান ভূষণ বাহু মূলে। কি চাস রণো! ভুল জিনিস চাসনি রণো! আগুনে হাত দিসনি! জাগিয়ে রঘুনাথ কুয়ার পন্‌ছি বন বোলে।’

অনুষ্ঠান শেষ। মনে হল সমস্ত হল সুরের স্থাপত্য হয়ে গেছে। তার থাম, তার সিলিং, মঞ্চ, বসবার আসন সব ভিন্ন ভিন্ন সুর শ্রুতি দিয়ে তৈরি। মানুষগুলিও যেন সারাক্ষণ বেজে বেজে বাদ্যযন্ত্র হয়ে গেছে। আর কোনও অনুরোধ করবার কথা শ্রোতার মনে এলো না। তার হৃদয়ের সমস্ত সুর, সমস্ত প্রার্থনা দিয়ে অপালা ভজনটি গেয়েছে। কোনও তৃষ্ণা বুঝি অপূর্ণ রাখে নি। এই গানের রেশ কানে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায় সবাই। ‘পঞ্ছি বন্ বোলে।’

রণো বলল— ‘সুমন, সুমি তুমি আমাকে এ ভাবে ট্যানট্যালাইজ করো না প্লীজ।’

সুমি হেসে রণোর কাঁধের ওপর মাথা রাখল— একটা পাগল করা সুগন্ধ, মাতাল করা স্পর্শ—‘হোয়াট ডু য়ু মীন বাই ‘ট্যানটালাইজ?’ তুমি একটা থার্স্টি পার্টি, অ্যান্ড আই অ্যাম আ ম্যাজিক স্প্রিং! ইজ দ্যাট সো! তো ডিফাইন এগজ্যাক্টলি হোয়ট ইউ আর থার্স্টি ফর!’

রণো সুমির মুখের ওপর মুখ নামাতে গেল। সুমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে সরে গিয়ে বলল— ওহ, য়ু আর টিকলিং মি? হাউ মেনি ডেজ হ্যাভ্‌ন্‌ট্ ইউ শেভ্‌ড্?’

রণো বলল, ‘আমি শেভ করতে আরম্ভই করি নি এখনও। খালি ট্রিম করি। সুমি ডোন্ট য়ু লাইক ইট? অনেকেই তো বলে আমায় ভালো দেখায়!

সুমি আবার সেই কাচের চুড়ি ভাঙার হাসিতে ফেটে পড়ে—

—কে বলেছে? সাম গার্ল ফ্রেন্ড? আই বেট দেয়ার্স নো আদার গার্ল ইন ইয়োর লাইফ বাট মি। ইউ আর সেয়িং দিস সিম্পলি টু মেক মি জেলাস।’

রণো বলল—‘বাজে কথা ছাড়ো সুমি, তুমি শুধু একবার আমায় ইয়েস বলো, তারপর দেখো আমি কী করি?’

—‘আমার ইয়েস’ বলাতে কী আসে যায়, আমার ড্যাড রয়েছে, আঙ্কল রয়েছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে তুমি কথা বলতে পারবে?’

—‘হোয়াই নট? ইউ মে বী স্টিংকিং রিচ। কারণ তোমরা বিজনেস করো। বাট উই আর মোর কালচার্ড পিপল। আমার বাবা রেসপেকটেবল গভমেন্ট অফিসার, আমার মা এত বড় সিঙ্গার যে যে-কেউ নাম বললে চিনবে।’

—‘আই নো, কিন্তু তুমি নিজে, তুমি কী! তোমার নিজের স্টেটাস কী?’

—‘আরে আমি তো ডাবলু বি সি এস করছি, এম বি এ-র ডিপ্লোমা কোর্স করছি। একটা না একটা কিছু লেগে যাবেই। ইউ কান্ট এক্সপেক্ট এ ইয়ংম্যান অফ মাই এজ টু বি এ বিজনেস ম্যাগনেট! ক্যান ইউ!’

সুমি বলল—‘আমার দাদা, দ্যাট ইজ মাই কাজিন ইজ ওয়ান। অ্যাট দি এজ অফ টোয়েন্টি ফোর আ ডিরেক্টর। গোজ অ্যারাউন্ড ইন অ্যান ইমপোর্টেড এয়ারকনডিশনড কার।’

রণো বলল—সে তো তোমাদের বাবা, কাকা, এঁরা বিজনেসটাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন বলে। তোমার কাজিন একটা রেডিমেড কেরিয়ার পেয়েছে।’

—‘আমার বাবা, ওই রকমই চান।’

—‘তো তুমিও কি তাই-ই চাও? আমায় সিম্পলি বলে দাও তোমার মত কি? এতোদিন তো আমায় বুঝতে দিয়েছো আমিই তোমার চয়েস।…’

সুমি আবার রণোর কাঁধে মাথা রাখল, হঠাৎ মুখটা তুলে তার নরম দাড়িঅলা গালে একটা সশব্দে চুমো খেলো। বলল—‘ওহ রণো, মাই রনি বয়, ইউ আর সো সুইট! দেয়ার্স এ ডিয়ার, এখানেই আমাকে নামিয়ে দাও প্লীজ। লাউডন এসে গেছে।’

রণো এখন প্রায় কাঁপছে। ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। কিন্তু রাগের কান্না ছাড়া অন্য কোনও রকম কান্না তো সে জীবনে কাঁদেনি! সে নিঃশব্দে তার কান্না গিলে নিয়ে বলল—‘আবার কবে দেখা হবে? কখন?’

—‘থার্স ডে উইক, সেটাইম, সেম প্লেস’ ট্যাকসির দরজা খুলে সুমন নেমে গেল। রণো ট্যাকসিটাকে ঘুরিয়ে থিয়েটার রোডের মোড়ে ছেড়ে দিল। তারপর বাকি পথটা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতে লাগল। কারণ আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করবার নেই। তার নিষ্ফল ক্রোধ, কান্না যতক্ষণ না প্রশমিত হচ্ছে তাকে এভাবে হেঁটে যেতে হবে। হয়ত পরের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। মনের মধ্যে আর কোনও চিন্তা নেই, কথা নেই, শব্দ নেই, শুধু সুমির স্পর্শ, অদ্ভুত নরম ফুলের পাপড়ির মতো ভিজে ভিজে স্পর্শ। অদ্ভুত গন্ধ, চুলের, পোশাকের, দেহের। কি করে একটা মেয়ে এতো পেলব, এতো চিকন, এতো সুগন্ধ হতে পারে! রণো জানে না ওই ভিজে ভিজে স্পর্শ, ওই সৌরভ কোনটাই ঈশ্বরদত্ত নয়, সবই নামী দামী কোম্পানির প্রসাধনদ্রব্যের কেরামতি। সুমন কাপুর সুন্দর হতে পারে, কিন্তু তার জাদুর অনেকটাই রাসায়নিক। তার চুলের ওই গোল গোল গুচ্ছ যা অনবরতই রণোর গালে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে উত্তেজিত করে তোলে তাও বিউটি সেলুনের কারসাজি। রণো, আজ সুমিকে নিয়ে কলামন্দিরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, একবারও তার মনে হয়নি আজ এই উৎসবদীপ্ত পাবলিক হলের মধ্যে তার মা গাইছে, যে মার নাম সে নিয়েছিল সুমন কাপুরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠতা দেখাতে। তার মা গাইছে হয়ত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গান, যা শুনতে কলকাতার বহু গুণী জন এসেছেন। তার বয়সের ছেলেমেয়েরাও আছে এই শ্রোতৃমণ্ডলীতে। যারা গান শোনে, ভালোবাসে। কিছু এসেছে হুজুগে। কিছু এসেছে বহু টাকা আছে তার কিছুটা অংশ এভাবে খরচ করে ফেলতে। কিন্তু বেশির ভাগই এসেছে পৃথিবী-বিখ্যাত সোহম চক্রবর্তী এবং ভারত-বিখ্যাত অপালা দত্তগুপ্তর যুগলবন্দী শুনতে। সাংস্কৃতিক জগতে এটা একটা লাখে এক ঘটনা বলে গণ্য হচ্ছে। এবং আজকের শ্রোতারা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাবে।

দরজা খুলে দিলো দাদু।—‘বড্ড দেরি করিস রণো!’

—‘বাজে বকো না।’

মনোহর ভুরু কুঁচকে বললেন—‘বাজে বকো না মানে? এখন সাড়ে দশটা বাজছে। তা জানো?’

—‘বুড়ো আছো, বুড়োর মতো থাকো।’ বলতে বলতে রণো দু-তিন লাফে ওপরে পৌঁছে গেল। তারপর তিনতলায় নিজের নতুন ঘরে। বাড়িটা কেন আজ এত খালি খালি সে বুঝতে পারল না। সে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গেছে আজ সবাই তার ঠাকুমা-দিদিমা পর্যন্ত কলামন্দিরে। পেছন থেকে দাদু ডাকছেন।

—‘খাবার ঢাকা আছে। খেয়ে যাও।’

—‘টু হেল উইথ ইয়োর খাবার’ রণো ভয়াল মুখ করে ফিরে দাঁড়াল। সে মুখ দেখে মনোহরের মতো ব্যক্তিও ভয় পেয়ে গেলেন। তেতলার সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে তিনি শুনতে পেলেন রণো অশ্রাব্য গালাগাল দিচ্ছে—সন অফ এ বিচ, ব্লাডি বাস্টার্ড,…মনোহর ভয়ে বিস্ময়ে প্রায় স্থাণু হয়ে ভাবতে লাগলেন এগুলো রণো কাকে বলছে, তাঁকেই নাকি? ওপরে কি একটা ছুঁড়ে ফেলার শব্দ হল। ভারী কিছু। তারপর সব চুপ। মনোহর প্রথমে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন, কিন্তু ভীষণ উৎকণ্ঠা হচ্ছে। কী পড়ল ওপরে? ছোট ছেলের ঘর থেকে মৃদুস্বরে কথাবার্তার আওয়াজ আসছে। বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন।

—‘সাতশ টাকা স্কোয়ার ফিট টূ মাচ।’ বিশু বলছে।

—‘আহা তোমার যেন নেই! দু’জনের কতটুকুই বা স্পেস লাগবে!’

—‘একটা গেস্ট রুমও তো থাকবে রে বাবা!

‘—তা হোক, আমার ওটাই পছন্দ, প্লী-জ।’

এই সব কথাবার্তার অর্থ মনোহর ভালো বুঝতে পারলেন না। ডাকলেন ‘বিশু’। ভেতরের কথাবার্তা দুম করে থেমে গেল।

বিশু বেরিয়ে এলো। বিশুকে তিনি দুখানা ঘর দিয়েছেন। বউমার বাপের বাড়ি থেকে ঘর দুটি সাজিয়েও দিয়েছে। কিন্তু সেই বিয়ের দিনের পর থেকে তিনি আর কখনও ঘর দু’খানার চেহারা দেখেননি। ভারী ভারী পর্দা ঝোলে সব সময়ে। কাউকে ডাকলেই সে এসে বাইরে দাঁড়ায়। কখনও ভেতরে আসতে বলে না। দাঁড়ায় প্রায় দরজা আড়াল করে। বিশুর শ্বশুরবাড়ি থেকে যখন গাড়ি বোঝাই লোক আসে, তাঁর স্ত্রী পারুল খুব হাসিখুশি মুখ নিয়ে বলেন—‘ছোটবউমা ক’ কাপ চা হবে? চা না কফি?’ জয়া দরজার দু’পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলে— ‘আপনি ভাববেন না মা। কিছু করতে হবে না। ও দোকানে যাবে, কিছু কিনে নিয়ে আসবে’খন।’

—‘তা আনুক না। চা-কফিও কি কিনে আনবে নাকি?’ চাপাগলায় বলেন পারুল।

—‘আ-চ্ছা করুন চা।’ বলতে বলতে জয়া ঘরের ভেতর থেকে একটি সুদৃশ্য কৌটো এনে একটা কাগজে মাপ করে চা ঢেলে দেয়। বলে—‘তিন মিনিটের বেশি ভেজাবেন না।’

বিশু বেরিয়ে এসে বলল—‘কী বলছো বাবা?’

—‘রণো কি রকম বিচ্ছিরি মেজাজ নিয়ে ফিরল। খেলো না। ওপরের ঘরে কি একটা ভারী জিনিস পড়বার শব্দ হল, একটু দেখবি?’

বিশু বলল—‘যথেষ্ট বয়স হয়েছে, গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে গেছে, এখন আর বাবা-বাছা করার দিন নেই। আদর দিয়ে মাথায় তুলেছ। এখন চোটপাট করলে সহ্য করো। আমাকে এর মধ্যে টানছো কেন?’

—‘কিন্তু বিশ্রী একটা শব্দ হল, বিশু একবার যদি…’

বিশু কাঁধটা একবার নাচাল। তারপর ওপরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। তেতলার ঘরটা ভালোই বানিয়েছে। অপালা দত্তগুপ্তকে যতটা ভালোমানুষ মনে হতো ততটা বোধ হয় নয়, নিজের ছেলের ঘরটা বেশ ভালোই সাজিয়ে দিয়েছে। ছোট ঘর, কিন্তু মেঝেতে মোজেইক, দেয়ালে প্লাস্টিক পেইন্ট, নতুন বক্সখাট, মাল্টিপারপাস ক্যাবিনেট একটা। রণো বাইরের জামাকাপড়, জুতো সবশুদ্ধু শুয়ে আছে। দরজার দিকে তার পা। জুতোর তলা দুটোই সবচেয়ে ভালো করে দেখতে পেল বিশ্বনাথ।

কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করল—‘রণো, কী পড়ল ঘরে? নিচ থেকে আওয়াজ পেলুম!’

—‘দেখতেই তো পাচ্ছো!’

—‘না পাচ্ছি না।’

—‘জলের কুঁজো।’

এতক্ষণে বিশ্বনাথ দেখতে পেলো ঘরময় নদী বইছে। টুকরো টুকরো হয়ে পুড়ে আছে মাটির কুঁজো, তার ওপরে ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসটাশুদ্ধু টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।’

—‘কি করে হলো?’

—‘হয়েছে!’

—‘এগুলো পরিষ্কার না করলে তো রাত্রে পা স্লিপ করবে। নিজেই আছাড় খাবে, পা কাটবে।’

—‘খাই খাবো। নোবডি হ্যাজ টু বদার অ্যাবাউট মি অ্যান্ড মাই অ্যাফেয়ার্স।’ শুয়ে শুয়ে জবাব দিল রণো।

চটির শব্দ তুলে নীচে নিমে এলো বিশ্বনাথ। মনোহর সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন—বলল—‘ও একটা বখে-যাওয়া অসভ্য ছেলে। কার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না। ওর কাছে আমাকে আর কোনদিন পাঠাবে না।’ নিজের ঘরের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে দিল বিশু। সে যে নিজেও বেশ ভদ্রলোক হয়ে গেছে। বাবার মুখের ওপর শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটা যে তার পক্ষেও খুব সভ্যতা নয় সেটা তার মাথায় এলো না। এবার মনোহর আর সাড়াশব্দ করলেন না। খালি আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে যখন কলামন্দির থেকে বাড়ির সবাই ফিরে এলো, তখন তাদের এতক্ষণ ধরে একটু একটু করে গড়ে ওঠা সুরেলা মেজাজ, অপার্থিব শান্তির আমেজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

অপালা বলল—‘আমি একবার যাই। দেখে আসি।’

বনি বলল—‘মা, মা, তুমি প্লিজ যেও না, দাদা তোমায় দু’চক্ষে দেখতে পারে না।’

শিবনাথ বললেন—‘আমি যাচ্ছি।’ ওপরে গিয়ে দেখলেন দরজা বন্ধ। দরজার ফাঁক দিয়ে জল পড়ছে, —‘রণো রণো’ তিনি দরজায় টোকা মারলেন। কোনও সাড়াশব্দ এলো না। নীচে নেমে আসতে জল পড়ছে শুনে টিটু বলল—‘ও, তা হলে নিশ্চয়ই কুঁজো ভেঙেছে। তোমরা ওকে ওর মতো থাকতে দাও তো। আর এবার একটা প্ল্যাস্টিকের জাগে জল রাখবে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কুঁজো ভাঙল।’

অপালা সহজে কাঁদে না। লোকের সামনে তো নয়ই। কিন্তু আজ কলামন্দিরের দর্শক দেখেছে গানের গভীর মূৰ্ছনায়, মিড়ে মিড়ে, তার চোখ ছলছলিয়ে উঠছে, রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ভাবে, ভজনের সময়ে দু’চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়েছে। তারা মনে করেছে সুর। সুরই এমন করে কাঁদাচ্ছে গায়িকাকে। এ এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা। কলকাতার শ্রোতা বহুদিন এ গান ভুলবে না, বলবে, ‘সে এক শুনেছিলাম বটে সোহম চক্রবর্তী আর অপালা দত্তগুপ্তর যুগলবন্দী।’ ঠিক যেমন তার আগের প্রজন্ম বলে ‘বড়ে গোলাম আলি, আমীর খাঁর কথা। কিন্তু কেউ জানে না অপালার গানের প্রত্যেকটি ভাঁজে আজ শুধু নিবেদন ছিল একজনের জন্যে। রণজয়। তার নিভৃত ডাকের প্রথম সন্তান হিন্দোল। তার জন্য প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট, মর্মবেদনা, উৎকণ্ঠা—তার প্রাণ-নিংড়োনো প্রার্থনায় এই-ই ঝরে পড়েছে সুর হয়ে, অশ্রু হয়ে। এখন নির্জন রাত্রে সে একা একা নিজের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে, খোঁপায় গন্ধরাজের গুচ্ছ মনে হচ্ছে নির্মম ঠাট্টা। চন্দন রঙের শাড়ির ওপর ঘন লাল পাড় যেন এক অতিশয় অতিশয়োক্তি। দরবারীর পঞ্চমে স্থিত হবার বদলে এখন তার কানের পর্দায় আছড়ে পড়ছে একটা জলের কুঁজো ভাঙার আওয়াজ। আর কিছু প্রাণ বিদ্ধ করা শব্দযুথ—‘তুমি যেও না মা, দাদা তোমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress