গান্ধর্বী (Gandharbi) : 20
‘আশাবরী’ অপালার জীবনটাকে খানিকটা বদলে দিল। সে প্রচুর জলসায় ডাক পেতে লাগল, কলেজ সোশ্যাল, ক্লাব-ফাংশন। বেশির ভাগই অবশ্য সে নেয় না। কিন্তু মাঝারি ধরনের কিছু সঙ্গীত-সভায়, যেগুলো বন্ধ হলে হয়, সেখান থেকে ডাক আসলে রামেশ্বর তাকে খুব জোর করতে থাকেন। যদিও বাড়িতে সকলে খুব খুশি হন না। যেখানেই যায় দর্শকদের কাছ থেকে সেই এক অনুরোধ আসে কৌশিকী কানাড়া, কিম্বা আসাবরী। ভাটিয়ার আর বৃন্দাবনী সারং-এ রাগপ্রধান দুটির চাহিদাও খুব বেশি। অভিজাত মার্গসঙ্গীতের আসরে তার ডাক এলো বছর খানেক পরে। এখন সে ছাত্র-শেখানো কমিয়ে দিয়েছে। রামেশ্বরের সল্টলেকের বাড়িতে নিয়ম করে যায়। ইমতিয়াজ খাঁ নামক এক কুশলী তবলিয়ার কাছ থেকে বহু কূট তালের পাঠ নিচ্ছে। রামেশ্বরের বাড়িতেই।
এবার তাকে সময় দেওয়া হয়েছে মাঝরাতে। প্রথম এ ধরনের প্রোগ্রাম। অল্প স্বল্প একটু আলাপ সেরেই সে তিলক কামোদে গান ধরে ফেলল-‘ক্যায়সে জীবন রাখুঁ এরীসখী/অব তো প্রাণ রাখো না জায়। নিশিদিন হৃদয় ভরে বিরহামে/ দরশ বিনে মেরো নয়ন দুখায়।’ তারপর তরানা গেয়ে ভজনে পৌঁছে গেল, ‘পগ ঘুঙুরু বাঁধ মীরা নাচি রে।’ ভজনের বাণীর ওপর তার মনোযোগ অন্য ধরনের। অনেক মিড় অনেক টুকরা থাকা সত্ত্বেও বাণী অস্পষ্ট হয় না। ‘বিষকা পিয়ালা রাণাজী ভেজা/পীবত মীরা হাসি রে’, যখন সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায় তখন অডিটোরিয়াম সিক্ত হয়ে থাকে, ‘সহজ মিলে অবিনাশী রে।’ শেষ চরণ গেয়ে সে আর ফিরে আসে না। সুরে সুরে সত্যিই যেন কোন অবিনাশীর মধ্যে মিশে অবিনশ্বর হয়ে যেতে চায়। এ ধরনের ভজনের স্বাদ শ্রোতারা বহুদিন পাননি। আরও ভজনের অনুরোধ আসতে থাকে। কিন্তু অপালা নম্রভাবে পরবর্তী শিল্পীর অসুবিধের কথা জানিয়ে তার প্রোগ্রাম শেষ করল। অনেক দিন আগে এই কনফারেন্সেই দীর্ঘ আলাপ এবং রাগের বাঢ়হতের জন্য গাল খেতে হয়েছিল। তার অভিজ্ঞতায় সে এখন যা বুঝেছে, তাতে করে বড় রাগগুলো প্রাণ ভরে গাওয়া যাবে শুধু মাস্টারমশাইয়ের কাছে। বা নিজের কাছে। আজ সে অল্পক্ষণ গেয়ে শ্রোতাদের মনে আরো আরো’র আশা জাগিয়ে ফিরে গেল যেন সেই কতদিন আগেকার ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে। যত শান্ত মেজাজের মানুষই হোক, জমাটি আসর পেছনে ফেলে আসার পুলকই আলাদা। ‘সহজ মিলে অবিনাশীরে’ পংক্তিটির ভাঁজে ভাঁজে সুরবৈচিত্র্যের রসালো টানটোনগুলো এখনো মনে মনে দিতে দিতে সে সাজঘরে ঢুকল। ঢুকতেই এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদেহী, দোহারা গড়ন, রঙ টকটকে ফর্সা। মাথায় প্রচুর অবিন্যস্ত চুল। বড় বড় উত্তেজিত পায়ে তিনি অপালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘অপু!’ অপালার তন্ময়তা ভেঙে যাচ্ছে। সামনে চল্লিশোত্তর দেহের ছদ্মবেশের মধ্যে থেকে উঁকি মারছে সোহম। সোহম তাকে দুই শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল।— ‘অপু, অপু, কতদিন পর, কত কতদিন পর… !’
দুজনের চোখ দিয়েই জল পড়ছে। গ্রীনরুমে আরও গায়ক, বাদক, উদ্যোক্তা, দু চারটে ক্লিক ক্লিক শব্দ হল। একটু দূরে শিবনাথ এসে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে টিটু। শিবনাথ দেখছেন অপালা আর সোহম ঘন আলিঙ্গনে বদ্ধ। অপালার অনতি-উচ্চ স্তনচূড়া নিষ্পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে সোহমের প্রশস্ত বুকে। তার মাথা সোহমের কাঁধে, সোহমের মাথা অপালার পিঠে। দুজনেরই চোখের জলের সঙ্গে মিশে আছে খুব মধুর হাসি। জীবনে বোধহয় আর কোনও আলিঙ্গনে অপালা এভাবে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়নি।
টিটু দেখল মা হাসছে, মা কাঁদছে। মাকে এমন মেজাজে সে আর কখনও দেখেনি। সোহম চক্রবর্তীকে সে ছবিতে বহুবার দেখেছে। তার হট ফেভারিট। তাই চিনতে অসুবিধে হল না। প্রদ্যোৎ মামু দু বছরে একবার করে আসবার চেষ্টা করে, কখনও কখনও আরও দেরি হয়ে যায়। তখন দুই ভাই বোনের আনন্দ দেখে কে! সোহম মামু মনে হচ্ছে প্রদ্যোৎ মামুর থেকেও মায়ের বেশি প্রিয়। গুরু ভাই তো! একজনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্তের। আরেক জনের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা-রুচির, অর্থাৎ মরমের মিল।
সোহম বলল—‘আমি ইচ্ছে করে তোকে জানাইনি। এঁদেরও আমার নামটা আগে থেকে অ্যানাউন্স্ করতে বারণ করে দিয়েছি। চন্দ্রকান্তজী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই সুযোগটা হয়ে গেল। আজকের আসরে আমি অনেক দিন পর খেয়াল গাইব, একটু চটকদারি করব, ডোন্ট মাইন্ড! থাকছিস তো!’
অপালা বলল—‘থাকবার তো কথা ছিল না। কিন্তু এখন তো থাকতেই হয়!’ শিবনাথের দিকে একমুখ হাসি নিয়ে ফিরল অপালা। —’এসো! সোহম, এই আমার..’
‘কর্তা!’ সোহম একগাল হেসে বলল।
শিবনাথ শুকনো গলায়, শুকনো হেসে বললেন—‘গ্ল্যাড টু মীট ইউ।’
—‘এই আমার বড় মেয়ে সোহম, টিটু…’ অপালা ততক্ষণে বলছে।
টিটুর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিতে গিয়ে সোহম সামলে নিল। বলল—‘ও হো, তোমরা তো আবার এসব পছন্দ করো না। তার ওপর আবার হেয়ার স্টাইল আছে!’
টিটু কিছু না বলে একটু হাসল।
শিবনাথ ঘড়ি দেখে বললেন—‘দেড়টা বাজে। আমার পক্ষে আজ বসা সম্ভব হচ্ছে না। কাল ফার্স্ট আওয়ারেই প্রচুর কাজ। প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড। টিটু তুই বরং থাক। এত রাত্রে তোকে নিয়ে মুশকিলে পড়ব। মার সঙ্গে আসিস। অপু তুমি তোমার বন্ধুর সঙ্গে এখন যতখুশি আড্ডা মারো।’—বলে শিবনাথ হাসলেন—‘আচ্ছা মিঃ চক্রবর্তী, আবার দেখা হবে।’ তিনি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।
সোহম বলল—’ওরা চন্দ্রকান্তজীর বদলে আমার নাম ঘোষণা করছে। এইবেলা কটা জরুরি কথা তোর সঙ্গে সেরে নিই। আমি কিন্তু সারা শীতকালটা ক্ল্যাসিক্যালের প্রোগ্রাম করব, গজল গাইতেই হলে গাইব শেষে। আমার তোর কাছে বিশেষ অনুরোধ আমরা যুগলবন্দী করব।’
—‘মানে?’
—‘মানে আর কি? বিসমিল্লা বিলায়েত হতে পারে, রবিশংকর-আলি আকবর হতে পারে, অপালা-সোহম হতে পারে না! তোর সাপোর্ট আমার চাই। বড় খেয়াল গাওয়ার কনফিডেন্স আমার নড়বড়ে হয়ে গেছে এখন। আচ্ছা অপু, চলি।’
মেয়ের সঙ্গে প্রথম সারির একেবারে শেষের আসনে বসে সোহমের গান কতদিন পর শুনছে অপালা। শংকরা গাইছে ও। সেই বহুদিন আগেকার মতো। সেবার শোনা হয়নি। আজ হল। সোহমের গলার স্বর কত পাল্টে গেছে। অনেক মোলয়েম হয়ে গেছে। সে সত্যি খুব সহজ হতে পারছে না। ঠুংরিতে এসে সে তার কেরামতি দেখাল। পিলুতে ‘ছোড়ি মোরি বৈঁয়া’ গাইল অসাধারণ, আদ্ধাতালে। তারপর হংসকিংকিণীতে ঝাঁপতালের গান ‘সখী মনমোহন শ্যাম, বাঁশীয়া বজায়ী।’
শেষ হলে, উদ্যোক্তাদের একজন বলে গেলেন গ্রীনরুমে সোহম চক্রবর্তী ডাকছেন। তখন আসরের শেষ শিল্পী ললিতে সানাই ধরেছেন। পাখিদের ঠিক আড়মোড়া ভাঙার অবস্থা। টিটুর চোখ ভারী হয়ে এসেছে। সোহম বলল—‘চল্ অপু একসঙ্গে যাই। আগে তোকে নামিয়ে দোব। কাছাকাছিই তো।’
অপালা বলল—‘তুই তোদের সাবেক বাড়িতেই এসে উঠেছিস?’
‘—অবশ্যই। কি ভাবিস বল তো আমাকে? মেজদা দিল্লিতে জানিসই তো! বড়দা জার্মানিতে সেট্ল, কর গেল। আর ছোড়দা গন, মাচ, মাচ বিফোর হিজ টাইম। এ বাড়িটা তো এখন পুরোটাই আমি নিয়ে থাকি। বাবা বড্ড বুড়ো হয়ে গেছেন। কোনদিন টুক। অনেক দিন বম্বে, লখনৌ, লন্ডন, পারী হয়েছে। এখন আমি কলকাতাতেই গান গাইব। কিন্তু অপু একটা কথা। গাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আজকাল আমি দারুণ চালাক চতুর শোম্যানও হয়ে গেছি। প্রত্যেক প্রোগ্রামে তুই আমার সঙ্গে থাকছিস! থাকছিস তো!’ অপালা বলল—‘প্রত্যেকটা? আমার পক্ষে কি সম্ভব হবে? আমি তো একটা বাড়ির বউ! ছেলেমেয়ের মা!’
সোহম বলল—‘তোর এ মেয়েটাকে তো দেখে মনে হচ্ছে বেশ ইনডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছে। দেখ অপু তোর সবচেয়ে বড় পরিচয় তুই শিল্পী। কয়েকটা কনফারেন্সে গাইলে তোর বধূত্ব, মাতৃত্ব খুব একটা ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে হয় না। মঘুবাই, হীরাবাই, সকলেই তো সংসার করেছেন। এমন কি নাজনীন বেগম পর্যন্ত!
অপালা বলল—‘সোহম, ঠুম্রিতে তুই সিদ্ধ। তোর ‘হমারি পিয়া যো মানত নাহি’-র ভেরিয়েশনগুলো এখনও আমার কানে বাজছে।’
সোহম বলল—‘হ্যাঁ, তোরটা চুরি করে গেয়েছি।’
—‘সে আবার কি?’
—‘মানে, নাজনীনের তালিম ছাড়া তো ও জিনিস গলা দিয়ে বেরোত না। এই শুনেই সিদ্ধ টিদ্ধ বলছিস। কী অদ্ভুত যে ওই মহিলার ক্ষমতা! অদ্ভুত ধরনের ভাওবাতানো, আর মুখবিলাস, সেসব তো আমার মুখে মানাবে না! শুনবি যখন ভুলে যাবি এ কি পুরব অঙ্গ না পছাঁও। পঞ্জাবী সুরের ছোঁয়া আছে না বিশুদ্ধ বেনারসী লচাও ঠুমরি। শুধু সুরের ইন্দ্রজালে সুরের ভাষায় তোকে নাচিয়ে, কাঁদিয়ে, আশা নিরাশার দোলায় দুলিয়ে একেবারে সব বিস্মরণ করিয়ে ছেড়ে দেবে। আর অসাধারণ ভয়েস কনট্রোল ও মডুলেশন। কখনও ফিসফিসিয়ে গাইছেন যদিও প্রত্যেকটি কন্ পর্যন্ত কানে পরিষ্কার ধরা পড়ছে, কখনও গম্ভীর নাদে, কখনও মত্ত কুরঙ্গীর মতো। শুধু দিনের পর দিন ওঁকে শোনাই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। অপু ভীষণ মিস করলি। ভী-ষণ। আর তুই যেটা মিস করলি, আমি সেটা পেলুম, অথচ পুরোপুরি নিতে পারলুম না। কোনদিনই এ কথা আমি ভুলতে পারব না।’
অপালা বলল—বাজে বকিস না সোহম। আমার ভাগ্যে ছিল না, আমি পাইনি। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের একজন শিষ্য তো অন্তত সুযোগটা পেয়েছে। এটাই আমাদের সান্ত্বনা!
—‘কী জানি আমার মধ্যে সব সময়ে একটা অপরাধ বোধ কাজ করে যায় অপু। আমি ভুলতে পারি না।’
তাদের বাড়ি এসে গিয়েছিল। অপালা নামছে। সোহমের হাতে তার তানপুরো। টিটু দরজার বেল বাজালো। ‘তোর আসাবরী’র ডুয়েটটা থেকে আমাদের ডুয়েট-এর কথাটা আমার মনে এসেছে। শেষের দিকে ওই ঝালা-টাইপ পরিকল্পনাটা কার?’
—‘অবশ্যই মাস্টারমশায়ের।’
—‘ওই আরেক ভাগ্যহত ভদ্রলোক। সত্যিকার প্রতিভাবান। জীবনের বেশির ভাগটাই তরোয়াল দিয়ে ঘাস কেটে গেলেন। তুই গেয়েছিস যা একেবারে সুরের সমুদ্রে নুনের পুঁটলির মতো ডুবিয়ে দিয়েছিস অপালা। ‘সব সখী আনমিল মঙ্গল গাও/ সদারঙ্গে জগত দুলারে || সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে বাংলা করে যাওয়ার পরিকল্পনাটাও খুব চমৎকার হয়েছে।’
—‘আমারটা ভালো বললি, মিতুলের কথা বলছিস না যে!’
—‘মিতুল তো তোকে জাস্ট সাপোর্ট করে গেছে। খারাপ করেনি, ও যে এই রকমটা দাঁড়াবে আমি ভাই বুঝতে পারিনি। গিধড়ের মতো গলা ছিল। এনিওয়ে, ফোন করবো।’
সোহমের গাড়ি গলির মোড়ে বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সোহম আর অপুর বাড়ি দেখতে পাচ্ছে না। অপুর জন্য বিদেশ থেকে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সে বহু জিনিস উপহার এনেছে। শাড়ি, গন্ধ দ্রব্য, দুষ্প্রাপ্য বন্দিশ, শ্যামপু, ইলেকট্রনিক নানা রকম জিনিস। কিভাবে সেগুলো দেবে তাই ভাবছে। যতই তার জীবন এগিয়েছে সোহম ততই একেবারে স্থিরনিশ্চিত হয়ে গেছে যে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে লখনৌ-এর অভিজ্ঞতা ও তালিম। এবং তার পেছনে অপুর সেই করুণ পিছিয়ে-যাওয়া, ভবিতব্যের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ। তার চেয়েও বড় কথা ওই তালিমের জন্য সে সময়মতো কেন কোনদিন উপস্থিত হতে পারত না যদি না অপু তাকে তার হিংস্র উন্মাদ অবস্থা থেকে সারিয়ে তুলত। সে জানে, অপু তখন ওইটুকু মেয়ে হয়েও ঠিক বুঝেছিল কোথায় তার ব্যথা, কিসে তার যথার্থ প্রলেপ! তার অনেক ভাগ্য সে কোনও নামী সাইকিয়াট্রিস্টের হাতে পড়েনি। সে অপুর চেষ্টায় একটু ভালো হয়ে না উঠলে বাবা তাকে ওইসব মনস্তত্ত্ববিদদের কাছে নিশ্চয়ই নিয়ে যেতেন, কড়া ওষুধ খেয়ে, ইলেকট্রিক শক খেয়ে সে আজ একটা জীবন্মৃত জরদ্গবে পরিণত হত। বিয়ের ক’দিন আগে, ওই রকম রক্ষণশীল পরিবারের সমস্ত আপত্তি উপেক্ষা করে তার মতো উন্মাদের কাছে অপু এসেছিল নির্ভয়ে, গেয়েছিল অসীম প্রত্যয়ে সেই গান যা অমৃতধারার মতো তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এই সাহস অপু কোথা থেকে পেলো? নিজের ব্যাপারে তো পায়নি! সেখানে মেনে নিয়েছে দিনগত পাপক্ষয়ের ভবিতব্য। অথচ তার বেলাতেই অপু আর ভয় করল না, কারো নিষেধ শুনল না, জেঠুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করল। দীপালির জীবনটাকেও তো অপুই সাজিয়ে দিল। তার ভাগ্যে সইল না! কিন্তু দীপালির দিদিটি তো পরম সুখে আছে! এই যে ‘আশাবরী’র সাফল্য এ-ও কি অপু ছাড়া হত! অপুকে সে কখনও আলাদা করে মেয়ে বলে দেখেনি। অপু তার সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। এটা হচ্ছে অপু মানুষটার কথা। কিন্তু অপুর গান তাকে বরাবর কিরকম অন্যভাবে নাড়িয়ে দেয়, যেন অপুর সুরের সঙ্গে সুরসংযোগ করতে না পারলে সে চিরবিরহী থেকে যাবে। তার জীবনের লখনৌ-পর্ব থেকে আরম্ভ করে প্রচুর নারী এসেছে। তার জীবনের প্রথম প্রেম ছিল মিতুল। কিন্তু সেই বিশ্রী ঘটনার পর থেকেই মিতুলের প্রতি সে বীতরাগ। মিতুল বা মিতশ্রী দারুণ পাবলিসিটি পায়। দেখতে অতীব সুন্দর। এবং নিজেকে, নিজের গানকে পেশ করার সর্বাধুনিক সমস্ত কায়দা নাড়ি-নক্ষত্র মিতুল জানে বলে তার ধারণা হয়েছে ‘আশাবরী’ দেখে। মিতুলের কোনদিন গান হবে সে ভাবেনি। দীপালির কথা, অর্থাৎ দিলীপ সিনহার কাছে সে সেতার শিখছে এ কথা সে বিশ্বাস করে নিয়েছিল। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক সমস্ত কথাও। এখন দেখা যাচ্ছে দীপালি সঠিক অনুমান করতে পারেনি, কিম্বা ঘটনার মোড় ঘুরে গেছে। মাস্টারমশাই তাকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন—‘মিতুলের গান কিরকম শুনছো?’ মাস্টারমশাই যে সমস্ত পূর্ব ইতিহাসের মুখে তুড়ি মেরে এ কথা তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, তা সে ভাবেনি। কিন্তু মাস্টারমশাই সব সময়েই সব অনুমানকে, সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যান। সে বলল—‘ওর একটা অদ্ভুত গলা তৈরি হয়েছে, একটু ওয়েস্টার্ন ধরনের। ওই গলায় ক্ল্যাসিক্যাল গাইলে একটা পিকিউলিয়ার এফেক্ট হয়, যেন গিটারে এদেশী মার্গসঙ্গীত বাজছে। তবে গিটারের চেয়েও ওর গলাটা অনেক খসখসে।’ মাস্টারমশাইয়ের দাড়ি-ভরা মুখে একটা সরল হাসি—‘ও আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল সোহম। সুর তো ছিলই। খালি গলাটাই ছিল নীরস। ওকে বহু খাটিয়েছি। নিজেও খেটেছি।’
—‘যন্ত্রের দিকে দিচ্ছিলেন শুনেছিলাম।’
—‘কই না! তবে কি জানো, বাজিয়েকেও যেমন কণ্ঠসঙ্গীত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, গাইয়েকেও তেমনি একটু আধটু যন্ত্র ধরতে হয় সোহম। নইলে পূর্ণতা আসে না। আদিতে তো দুটোর কোনও তফাত নেই! একটায় সুর নিজের গলায় তুলছ, আরেকটায় তুলছ আঙুলের টিপে। শুনেছি ওস্তাদ কালে খাঁ সাহেব অসম্ভব সব লরজ্দার তান করতে পারতেন গলায়, যা নাকি তিনি বীণ থেকে তুলেছিলেন। …তবে মিতুল তো পুরোপুরি উচ্চাঙ্গের দিকে গেল না। গেলে আরো উন্নতি করতে পারতো!’
মাস্টারমশাইয়ের সল্ট লেকে বাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে সোহম ভাবল—না—উচ্চাঙ্গে পুরোপুরি গেলে মিতুল এ ধরনের উন্নতি করতে পারত না। এই ছবির মতো বাড়ি। পুরোটা যেন তেলরঙে আঁকা মনে হয়। দুখানা গাড়ি। আয়নামোড়া গান ঘর। মাস্টারমশায়ের বৃদ্ধ বয়সের জন্য এতো আরাম!
মিতুল এখন শেখরণ আয়ারের সঙ্গে ফ্রান্সে গেছে! সে নাকি ওর ট্রুপে নাচও করেছে। ছ’মাস ইন্টেনসিভ নাচের তালিম নিয়েছে। যতই পরিশ্রম করুক ছ’ মাসের তালিমে নাচ হয়? সোহম জানে না! সবটাই নির্ভর করছে শেখরণ আয়ার ওকে তার নাট্যনৃত্যে কী ভাবে ব্যবহার করছে তার ওপর। হঠাৎ তার স্মৃতিতে একটা খসখসে গলা আবদেরে সুরে বলে উঠল—‘সোহমদা আলারিপু দেখবে? আলারিপু? দেখো কেমন পারি?’ ‘সেলামী আর তৎকার দেখো! সব মিতালিদির ক্লাসে বসে বসে তুলে নিয়েছি।’ এখন মাস্টারমশাই বাড়িতে একলা। কিন্তু ড্রাইভার, দাস-দাসী সব রয়েছে। অপালা সপ্তাহে তিন দিন আসে। ফোনেও সর্বদা যোগাযোগ রাখে। এখন সোহম এসে পড়ল, মাস্টারমশায়ের যেটুকু অসুবিধে ছিল, তাও আর রইল না। উনি বার বার করে সোহমকে ওঁর কাছে ক’দিন এসে থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। নানা রকম যন্ত্র ওঁর চারপাশে, যখন যেটা খুশি বাজান। নিজেই বলেন—‘একাকিত্ব আমার নেই। মিতুল থাকলেও তো তাকে খুব একটা পেতুম না! শিল্পীর জীবনে নিঃসঙ্গতা তার শিল্পিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। সে জন্য নয়। কিন্তু সোহম তুমি এলে, আমার কাছে থাকলে গান আমার আরও কাছে থাকবে।’
সোহম বলেছিল—‘আমি তো রইলামই। অন্য কাজ না থাকলে আপনার কাছে এসে বসে থাকব। অপু আর আমি এখানে এসে রেওয়াজ করব। সারাক্ষণ না-ই থাকলাম।’
আসল কথা—মিতুলের বাড়িতে থাকতে তার সঙ্কোচ হয়। বাড়ির কোণে কোণে ঠিক সুন্দর, মহার্ঘ শিল্পবস্তুর মতোই সাজানো আছে মিতুলের বিভিন্ন ভঙ্গির, বিভিন্ন মেজাজের ছবি। মেয়েটার নার্সিসিজম্ আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এতেও সন্দেহ নেই মিতুল নিজেকে এক অদ্ভুত ভাস্কর্যে পরিণত করেছে। ছবিগুলোর প্রত্যেকটাতে কপালের কাছে আর থুতনির কাছে ছোট্ট দুটো দাগ। এসব ছবি সোহমকে তীব্র বিদ্রূপের হাসি হাসতে হাসতে বলে—‘ইতর! চেয়েছিলে আমার রূপ নষ্ট করে দিতে কিম্বা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, সামান্য স্হূল ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে! পারলে? পেরেছে? আমার বাবা-মার চরিত্র নিয়ে কুৎসিত কথা বলেছিলে যখন আমি নিষ্পাপ কিশোরী! লজ্জা করে না! আমি সো-কলড্ চরিত্রকে, পিতৃপরিচয়কে, মাতৃপরিচয়কে থোড়াই কেয়ার করি। আমি নিজেই নিজের পরিচয়। তোমাকেও থোড়াই কেয়ার করি। চকলেট, লজেন্স আর মন ভোলানো বাহারি জিনিস দিয়ে মনে করেছিলে দরিদ্র সঙ্গীতশিক্ষকের মেয়েকে কিনে নেবে। তার চেয়ে অনেকগুণ দামী জিনিস আমি আজ তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলতে পারি।’ এ সবই হয়ত তার কল্পনা। সে সব ঘটনার পর গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেই তো মিতুলের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎ। রাগী মুখ, হাতে ছুরি, মুখে কুৎসিত ভাষা। মাঝখানে রয়েছে লখনৌ, বম্বে, দিল্লি, আমেরিকা, ব্রিটেন। তবে মিতুলকে তার খুব দরকার। মিতুলকে তার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেবার আছে।
নৈশ কলকাতার রাস্তা দিয়ে তার গাড়ি যাচ্ছে। সোহমের কানে এখনও অপালার তিলক কামোদের রেশ। এখন তার মনে পড়ছে না আমেরিক্যান বান্ধবী ক্ল্যারিসের কথা, বা স্কটল্যান্ড প্রবাসী বৃন্দা আগরওয়ালের কথা। বম্বের লছমী প্যাটেল, কিম্বা বারাণসীর তিহরবাঈ যার কাছে নাজনীন স্বয়ং তাকে অনেক সাবধানবাণী শুনিয়ে পাঠিয়েছিলেন তারাও চলে গেছে স্মৃতির কোন লুকোনো খাঁজে।
বাষট্টি বছরের নাজনীন সর্বদা সাদা সিল্ক পরতেন। বসরাই গোলাপের রং ফুটে বেরোত শাড়ির মধ্য দিয়ে। নাকে হীরের নাকছাবি। দুই কানে হীরে, আঙলে হীরে, হাতে একগাছা হীরের চুড়ি। যখন গান শোনাতেন, মনে হত যে অল্প সংখ্যক শ্রোতা রয়েছে, তাদের প্রত্যেককে তিনি আলাদা করে শোনাচ্ছেন তাঁর মিনতি, তাঁর আকুতি, অভিমান। বিরহের কী তীব্র মধুর ব্যথা, অভিমানের করুণ সুদূরতা, মিলনের জন্য আকুল পিপাসা,অথচ তীব্র মান, এ সবই তিনি ফোটাতেন সম্পূর্ণ পরিবেশ বিস্মৃত হয়ে। শেখানোর সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এই মূল মন্ত্রটা সম্পর্কে অবহিত করতেন নাজনীন। বলতেন: ঠুমরী বিশুদ্ধ প্রেমের সঙ্গীত। ভগবৎ প্রেম হলেই তা ভজন হয়ে যাবে। এ কিষণ একজন মানুষ কিষণ, এ রাধা একজন মানুষী রাধা—এ পিয়ামিলন কী আশ একজন গভীরভাবে প্রণয়কাতর মানুষের সঙ্গে আরেক গভীরভাবে প্রণয়ব্যাকুল মানুষের মিশতে চাওয়া—তন মন ধন সব উন পর বারুঁ। এই প্রণয়ী যদি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরও হন, তাহলেও আগে মানুষকে দিয়ে শুরু করতে হবে।’ বলে একটু হাসতেন। বলতেন—‘ঠুমরি বড় বিপজ্জনক গান’ সোজা সামনের দেয়াল কিম্বা জানলার বাইরে দৃশ্যমান নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি গাইতেন। যেন ওই নীল তাঁর জমাট বিরহ। ঠুমরি পেশ করবার ঢঙটিও ছিল তাঁর অপূর্ব! মুখের পেশীতে চোখের কটাক্ষে, চোখের পাতার আনতিতে, হাতের ছোটখাটো মুদ্রায় ফুটে উঠত ভাব। কিন্তু একটা অদ্ভুত সংযম রক্ষা করে চলতেন। তাদের বার বার সাবধান করে দিতেন ছেলেরা আর মেয়েরা ঠুমরী গাইবে আলাদা স্টাইলে। সেই স্টাইলের তফাতও তিনি দেখিয়ে দিতেন। পুরুষালি ঢং-এর পুকার আর মেয়েলি ঢঙের নখরা। গলার ভঙ্গি এমন কি আওয়াজও পাল্টে ফেলতে পারতেন। এই অসামান্য প্রতিভাময়ী রমণী প্রকাশ্য আসর থেকে বিদায় নিলেন, ভারত একটা অমূল্যরত্ন হারালো। শুধু গুটিকয় শিষ্য-শিষ্যা আর কিছু কিছু গুণীর শোনবার সৌভাগ্য হল। সেখানেই সোহম ভারতের তাবৎ গুণীর সঙ্গীত শুনেছে। নাজনীন তার মৌলিকত্ব উসকে দিয়েছেন। শিখতে শিখতেই তার মনে হত ঠুমরিও প্রেমের গান, গজলও তাই। কিন্তু গজলের মধ্যে যেন দিওয়ানা অথচ পুরুষালি ভাবটা আরও চমৎকার ফোটে। সে গজল গাইতে লাগল, ঠুমরির নানান অঙ্গ মিশিয়ে, কিছু ছুট তান, কিছু ফিরৎ, সামান্য হলক তা-ও মেশাতে লাগল, গজলের বাণী বুঝে। নাজনীন অভিভূত হয়ে বললেন—‘শাবাশ বেটা, তুম তো বাওরে কী তরহ্ গা রহে হো। তুম্হারে দিল কী দর্দ সবকে দিলমে পহুঁচ যাতা হ্যায়।’
তখন সোহম তার ইচ্ছের কথা বলল।
নাজনীন বললেন, —‘বাগিচে মে গানেওয়ালা বুলবুল ভি মর্দ হি হ্যায়। মগর তুমহারা দিল জো চাহে সো করো।’
লখনৌ, দিল্লি, বম্বে সে গজলে মাতিয়ে দিয়েছে। ক্যাসেট, রেকর্ড বেরিয়েছে অজস্র, ফিলমে গেয়েছে। তারপর বিদেশ চলে গেছে। সেখানে এশীয় সমাজে তার, তার গানের কী আদর! কিন্তু অপালার সমকক্ষ গায়িকা সে আর কোথাও পায়নি। কল্পনা করা যায়! নাজনীনের তালিমে অপালা একটা কী দুর্দান্ত গায়িকা হয়ে উঠতে পারত!
অপালার ভঙ্গিটা শাস্ত। গানে গভীরতা বেশি, চমক কম। চমক যখন থাকেও, এত অবলীলায়, এত বিনা আড়ম্বরে সে ব্যাপারগুলো করে যে মধ্যম শ্রোতার খেয়াল এড়িয়ে যায়। পেশ করার একটা ভঙ্গি আছে। খুব যে নাচতে কুঁদতে হবে তা নয়। কিন্তু মুখের ভঙ্গিতে, হাতের সঞ্চালনে, অন্যান্য সঙ্গতিয়া বিশেষ করে তবলচির সঙ্গে তানের খেলায়, লয়কারিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে হবে। অপালা এমন কি দীর্ঘ তান সেরে সমে পৌঁছেও তবলচির দিকে একটি সহাস্য কটাক্ষে দেয় না, মাথা প্রায় নাড়েই না, এমন স্থিরভাবে যে গাওয়া কি করে সম্ভব সেটা সোহম বুঝতেই পারে না। যাই হোক, পেশকারিটা নাজনীন ওকে শিখিয়ে দিতে পারতেন, নাজনীনের কাছে তালিম নিতে নিতে জিনিসগুলো আপনিই এসে যেত। আর আসলে এই কারণোই অপালার ‘আশাবরী’র রেকর্ডগুলো অত পপুলার হয়েছে। অভিজ্ঞ অভিনেত্রী সেলিমা গানগুলো পেশ করেছেন পাকা গাইয়ের মতো। সুর টেনে ধরে রাখবার সময়ে হাতকে উদাওভাবে প্রসারিত করে দিয়েছেন সামনে। আলঙ্কারিক তানগুলোর সময়ে তাঁর সুন্দর আঙুলগুলি খেলা করেছে। মুখের সামান্য ভঙ্গিতে মূর্ত করে তুলেছেন গানের ভেতরকার মেজাজ। ফলে রেকর্ডগুলো বাজবার সময়ে স্মৃতিতে এসে যায় ওগুলো। সোহমের মতো যারা নিজেরাই গায়ক, তারা সে স্মৃতি ছাড়াও অপালার গানকে এ প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে চিনতে পারে। ‘আশাবরী’র ক্যাসেটগুলো শোনবার পর তার মনে পড়ে গেছে সেই দীর্ঘ দরবারী কানাড়ার রাতগুলো, যখন নিজের মৃত্যু, বিয়েটা তো অপালা মৃত্যুর মতোই নিয়েছিল, সেই মৃত্যু সামনে নিয়ে অপালা তার রোগশয্যার পাশে সবুজ কার্পেটের ওপরে কখনও তানপুরো কখনও হারমোনিয়াম নিয়ে ‘ঘুংঘট কী পট খোল রে’ বলে তার আর্তি জানাত। ওষুধের নেশায় তখন সে আধা আচ্ছন্ন। তার চেতনার ওপর থেকে উঠে গেছে শিক্ষা-দীক্ষার সভ্যতার সব কৃত্রিম আবরণ। সেই নগ্ন চেতনার দুয়ারে গিয়ে ধাক্কা দিত দরবারীর বক্র কোমল গান্ধার। শুদ্ধ মধ্যম, পঞ্চম পার হয়ে অতি কোমল ধৈবতে আন্দোলিত হয়ে কোমল নিখাদ পার হয়ে মুদারার ষড়জে এসে ন্যস্ত হত স্বর। কতক্ষণ! কতক্ষণ! অপালার আলাপাঙ্গ চিরদিনই অসম্ভব পরিণত। শুধু যন্ত্রের ভঙ্গিতে আলাপ, মধ্য লয়ের আলাপ, পরপর দ্রুত লয়ের কাজ করে ঝালার মতো সে যে কোনও গান অতিশয় তৃপ্তি দিয়ে শেষ করতে পারে। পাছে তীব্র স্বরে তার নার্ভের কোনও অসুস্থ জায়গা স্পর্শ করে তাই সে মুদারার ওপর আর উঠত না। তার সেই মৃদু ঝনঝনে তান, তরানা, গমগমে মন্ত্র সপ্তকের আলাপ আর ঋষভে এসে দাঁড়ানো এসব তার মস্তিষ্কের কোষে কোষে সঞ্চিত আছে চিরকালের মতো। বার্লে অ্যাভেনুর কিংবা অ্যাশফোর্ড মিডোর ফ্ল্যাটে সারাদিনের গান আর অক্লান্ত মেলামেশার পর যখন সে খানিকটা উত্তেজনা খানিকটা অবসাদে মুহ্যমান হয়ে বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ত, ঘুম আসতো ঝুপ ঝুপ করে বাদুড়ের গাছে নামার মতো তখন ভেতরে কে মন্দ্র পঞ্চম ছুঁয়ে কোমল ধৈবতে উঠে যেত কেমন যেন মনে হত স্বপ্নের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট তার ঢাকনাটা খুলে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে আকাশ, তারপর সেই আকাশের নীল স্তব্ধ যবনিকা তাও ঘোমটার মতো খুলে গেল, তার ওপারে সে কি কোনও রহস্যময় মুখ, ক্লেশবারণ, তাপহরণ, সে কি কোনও অপার্থিব দৃশ্য! ভালো করে দেখবার, বোঝবার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ত। তার জীবনে যদি থিম মিউজিক বলে কিছু থাকে তা হল দরবারী কানাড়া। অপালার দরবারী তাকে নতুন জীবন দিয়েছে।