গান্ধর্বী (Gandharbi) : 02
তখন ধূপছায়া রঙের ভোরবেলা। দরজার কড়া-নাড়ার আওয়াজ শুনে অপালার মা সুজাতা প্রথমটা পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। আবার ঠকঠক, তবে তো তাঁদেরই বাড়িতে! ঠিকে-ঝি এত সকালে এলো আজ! যাই হোক, এসেছে যখন এখুনি দরজা না খুললে বিপদ। তিনি ধড়মড় করে নীচে নেমে দরজা খুলে দিয়েই লজ্জায় মাথায় কাপড় টেনে দিলেন।
—‘ওমা, মাস্টারমশাই। আপনি এখন এতো সকালে!’
—‘কেন দিদি, এতো সকালে আসার কোনও কারণ অনুমান করতে পারেন না? অপালা কোথায়? ঘুমোচ্ছে?’
—‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই।’
—‘নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে বেটি! বাঃ এই তো চাই। প্রকৃত শিল্পীর লক্ষণ! আমি তো সারাটা রাত উত্তেজনায় ঘুমোতে পারিনি দিদি। কখন ট্রামের ঘণ্টি বাজবে। না আছে হাতের কাছে একটা টেলিফোন, না একটা গাড়ি-ঘোড়া। সারাটা রাত ছটফট করেছি।’
—‘আচ্ছা। আপনি ভেতরে এসে বসুন তো আগে!’ মাস্টারমশাই-এর হাতে সেই বিশাল তুম্বিঅলা মেহগনি পালিশের তানপুরা।
দাওয়ায় শতরঞ্জি বিছিয়ে তাঁকে বসিয়ে সুজাতা তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে অপালাকে ঠেলে তুললেন। —‘অপু শী গগিরই নীচে যা। তোর মাস্টারমশাই এসে বসে রয়েছেন।’
ধড়মড় করে উঠে বসল অপালা, চোখ থেকে ঘুম কাটেনি। তাড়াতাড়ি করে মুখে-চোখে জল দিয়ে শাড়ি বদলে সে যতক্ষণে নীচে এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে তার মা কাপড় ছেড়ে চা করতে লেগে গেছেন। ভোরের ধূপছায়া ভাবটা কাটতে শুরু করেছে সবে। এবার সত্যি-সত্যি ঠিকে লোকের কড়া নড়ল।
অপালা মাস্টারমশাইকে প্রণাম করে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে দ্রুত ঝাপটার জল চিকচিক করছে। কুচো চুলগুলোর আগা থেকে জলের ফোঁটা দুলছে। হালকা বেগুনি রঙের একটা শাড়ি কোনমতে গায়ে জড়িয়েছে। কিছু বলছে না।
—‘অনুমান করতে পারছো মা, কেন এসেছি?’
যে শুভসংবাদটা সে প্রত্যাশা করেছে সেটা মুখে ফুটে বলতে পারছে না অপালা। কিন্তু তার সমস্ত চোখমুখ ভেতরের আভায় উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে।
—‘প্রথমেই বলে রাখি মা, হতাশ হয়ো না। তুমি কিন্তু প্রথম হওনি। প্রথম হয়েছে সাদিক হোসেন। শিলং থেকে এসেছে। গেয়েছে ভালোই, একেবারে ব্যাকরণসম্মত। কিন্তু তুমি যা গেয়েছো মা তার তুলনা নেই। ক্রিকেট দেখো?’
অপালা হেসে ফেলে বলল— ‘না।’ যদিও দাদার কল্যাণে ক্রিকেটের নাড়ি-নক্ষত্র তারও অজানা নেই।
—‘দেখা থাকলে বলতাম বুচার-হান্ট এদের খেলার সঙ্গে কানহাই সোবার্সের খেলার যে পার্থক্য এ তাই। গাইছে ভালো। তৈরি গলা। যদিও সে গলার কোয়ালিটি আহা-মরি কিছু নয়। সবই বেশ যথাযথ করল। কম্পিটেন্ট। বাস। তবে আমি আচার্য, আমি আশা করব, আশীর্বাদ করব সবাই বড় হোক। ভালো হোক। সে আমার ছাত্রই হোক আর অন্যের ছাত্রই হোক। গোপনে বলি, তুমি স্বয়ং পণ্ডিতজীর হাতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছো। জনৈক বিচারক, নাম করব না, তাঁর হাতে অসম্ভব নম্বর পেয়ে সাদিক তোমার থেকে দু নম্বরে এগিয়ে গেছে। তুমি দ্বিতীয় হয়েছো অপু। কিন্তু তোমারই প্রথম হওয়ার কথা, সেই প্রথম পুরস্কার ওরা না দিলেও আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম।’ মাস্টারমশাই তানপুরাটির দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘এ তম্বুরা আজ থেকে তোমার।’ সুজাতা চা নিয়ে এসেছেন। কয়েকটা বিস্কুট। এতো সকালে তিনি আর কিছু জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তাঁর দিকে তাকিয়ে রামেশ্বর বললেন—‘দিদি, অপুর জীবনে একটা মস্ত বড় সুযোগ এসেছে। ও একটা স্কলারশিপেরও স্কলারশিপ পাচ্ছে। লাখে একটা। লখ্নৌ-এর নাজনীন বেগম ওকে ঠুম্রির তালিম নিতে ওঁর কাছে ডেকেছেন। অপু তুমি তো জানো, বছরে দু-এক জন ছাত্র-ছাত্রীকে উনি এভাবে নিয়ে থাকেন। ওঁর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা মহাল আছে। সেখানে কারও জাতপাতের নিয়ম লঙ্ঘন না করে উনি তাদের খাওয়া-শোয়ার বন্দোবস্ত করেন। রাজার হালে থাকবে। প্রাণভরে শিখবে। নাজনীন বেগম সাহেবার তালিম মানে তুমি ভারতের এক নম্বর ঠুমরি-দাদরা-গজল গায়িকা হয়ে গেলে।’ সুজাতার দিকে তাকিয়ে রামেশ্বর বললেন— ‘দিদি মেয়ে আপনার ষাট-সত্তর বছরের পুরনো হার্মোনিয়মে গান সেধেছে। মাইল মাইল ঠেঙিয়ে পরের বাড়ি গিয়ে তানপুরার রেওয়াজ করেছে। আজ তাই ঠাকুর নিজে যেচে এসেছেন। দু-চার দিন চিন্তা করে নিন। তারপর মেয়েকে এ সুযোগটা নিতে দিন। কোনও দিক থেকেই কোনও অসুবিধে নেই। এই আমার অনুরোধ।’
অপালা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল। নড়তে পারছে না। তার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলছে। নাজনীন বেগম! নাজনীন বেগম ছিলেন নাকি তার ওই শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে? বিচারের আসনে তো কোনও মহিলাকে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তবে ভালো করে তাকায়ওনি সে। পণ্ডিত চন্দ্রকান্তকে দেখেই তটস্থ হয়ে গেছে। নাজনীনের পুরো রেকর্ডের সংগ্ৰহ তাকে উপহার দিয়েছেন মাস্টারমশাই। তার যা কিছু মূল্যবান প্রিয়তম উপহার সবই মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া। শেষ সংযোজন হল তাঁর নিজের ব্যবহৃত ঐতিহ্যময় এই তানপুরো। এই যন্ত্রটাকে কানের পাশে ধরে সে যখন এর চার তারের ওপর দিয়ে আঙুল চালায় তার শরীরের ভেতর মর্মে মর্মে সুর পৌঁছে যায়, মনে হয় সে যেন শুনতে পাচ্ছে বিশ্বের সেই আদি ধ্রুবপদ যার তানে সুরব্রহ্ম এই বিশ্বকে বেঁধে দিয়েছেন। নাজনীন বেগম এখন প্রকাশ্য কনফারেন্সে বড় একটা গান না। তিনি গান একেবারে সোজা বড় বড় গাইয়ে-বাজিয়েদের নিজস্ব ঘরোয়া আসরে। লখনৌ-এর এক মস্ত শিল্পপতি কোথাকার মহারাজ কুমারকে বিয়ে করবার পর তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে আবার বলে তিনি আজকাল তাঁর ইষ্টকেই শুধু গান শোনান। মোট কথা নাজনীন বেঁচে থাকতেই এখন কিংবদন্তী। লেজেন্ড। এর ওর কাছ থেকে শোনা কথা গেঁথে অপালা মনশ্চক্ষে দেখে দুধারে ঝাউ, বেঁটে-বেঁটে ঝাউ। মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে নাকি অন্তত কোয়ার্টার কিলো মিটার। এ পথের শেষে গম্বুজঅলা একটি দোতলা হর্ম্য। তার মধ্যে সাদা পাথরের ঘর; সেখানে বেগম গান করেন এক শূন্য, মূর্তিহীন ঘরে, যা মসজিদও নয়, মন্দিরও নয়। কিন্তু আত্মিক দিক থেকে দেখতে গেলে সরস্বতীর খাসমহল। দোতলার জাফরির মধ্য দিয়ে নাজনীন তাঁর এই খাসমহলে আগন্তুক গানের পথিকদের দেখেন। মহারাজকুমারের সঙ্গে নাকি তাঁর চুক্তি বছরের মধ্যে ছ মাস অন্তত তাঁকে তাঁর গানের কাছে সমর্পিত থাকতে দিতে হবে। তাতে কোনও অসুবিধে নেই কারণ নাজনীনের স্বামী বেশির ভাগ সময়েই ব্যবসায়িক কারণে ভ্রমণরত থাকেন। তাঁর হেড-অফিসই লন্ডনে। নাজনীনের এই আমন্ত্রণের অর্থ, ছ মাস তাকে লখনৌ থাকতে হবে। সরাসরি বেগমের কাছে তালিম। অপালা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। সুদূরতম কল্পনাতেও না। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে যেসব বেদিয়ারা রাস্তায় রাস্তায় গান করে বেড়ায় তাদের যন্ত্রগুলোর থেকেও অনেক খারাপ তার হারমোনিয়ামটার অবস্থা। তাছাড়াও ক্রোম্যাটিক স্কেলে বসানো বলে হারমোনিয়মে মার্গসঙ্গীতের স্বরগুলো ঠিকমতো আসে না। বড় বড় শিক্ষকরা হারমোনিয়াম ব্যবহার করতে একরকম নিষেধই করে দেন। তার যন্ত্রটার একটা রীডে চাপ দিলে অন্য একটি বেসুরে বাজতে থাকে। কোন কোনটা থেকে স্বরই বেরোয় না। দাদাকে অনেক খোসামোদ করে সে হারমোনিয়ামটাকে সারাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিশেষ কিছুই হয়নি। দোকানে বলে— ‘এটাকে এবার ফেলে দিন, এটা জাঙ্ক হয়ে গেছে।’ তা সেই হারমোনিয়ামেই তার আজন্ম গান সাধা। মাস্টারমশাই যখন তাকে জোর করে ছাত্রী বানালেন, প্রতিদিন সন্ধ্যেয় তাঁর বাড়ি গিয়ে সে রেওয়াজ করত। পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতাগুলোর আগে মাস্টারমশাই তাকে একটা ছোট তানপুরা ধার দিতেন। এই বড় দামী তানপুরা এ বাড়িতে আনতে ভয় হত তার। কোথায় রাখবে? কোনও আলাদা চৌকি নেই। চৌকি রাখবারও জায়গা বিশেষ নেই। দাদা অনেক রাত পর্যন্ত পড়বে। আর বেলা করে উঠবে। দাদার ঘরেই থাকে তার গানের সরঞ্জাম। ভোরবেলা ছাতের ওপর মাদুর পেতে সা পা র্সা টিপে দিনের পর দিন সে পাল্টা সেধেছে।
মাস্টারমশাই যাবার সময়ে মাথায় হাত রাখলে অপালার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। মাস্টারমশাই বললেন— ‘মনে করো না অপু তোড়ি গাওয়ার জন্য তোমার স্থান নীচে নেমে গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যে তোড়ির আলাপে তুমি রূপটি এতো অপরূপ ফুটিয়েছিলে যে পণ্ডিতজীর কিছু মনে আসেনি। গান ধরতে, তখন সম্বিৎ ফিরে আসে। উনি আমাকে জনান্তিকে বললেন— “এ রত্নটিকে কোথা থেকে আহরণ করলেন রামবাবু!” সভায় সব গুণিজনও তোমার গান শুনে অভিভূত হয়ে গেছেন। আমার ধারণা তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় বেশি দেওয়া হয়েছে ইচ্ছে করে মা, ছুতো করে, তোমার গান আরেকটু শোনবার জন্যে। তোমাকে আমি কোমল ধৈবতের পুরিয়া শিখিয়েছি। এ ধৈবত সাধারণ কোমল ধৈবতের থেকে একটু উঁচু শ্রুতিতে। হারমোনিয়মে আসে না। উনি তোমার ওই ধা-এর বিউটি তোমার গান্ধারে আর নিখাদে দাঁড়ানো শুনতে চাইছিলেন বারবার। দ্রুত বন্দেশে তুমি মারোয়ায় যাও কিনা দেখতে অত্যন্ত উৎসুক হয়েছিলেন।’