গান্ধর্বী (Gandharbi) : 18
এক মঙ্গলবার ভোর সকালে একটা ফোন পেলো অপালা। সকাল ছ’টা হবে। সে সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে। শিবনাথ বললেন—তোমাকে কেউ লন্ডন থেকে ফোন করছেন।’
—‘কে? বিদ্যুৎদা? হঠাৎ?’ অপালা তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরল। বিদ্যুৎদা তাকে বা তার মাকে মাঝেমাঝে চিঠি লেখেন। গীতালিদিও লেখে। কিন্তু এরকম হঠাৎ ফোন-টোন পেলে বড় ভয় করে। দাদা চিঠিও দেয়। ফোনও করে। থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। কিন্তু লন্ডন থেকেও মাঝে মাঝে দাদার ফোন আসে। কোনও কনফারেন্স ওখানে গেলে ফোন করে খবর নেয়। ওখানেই বিয়ে করে পাকাপাকি থেকে গেল। মাকে নিয়ে গিয়েছিল একবার। মার আবার একা-একা মুখ বুজে থাকা সহ্য হল না। চলে এলো। সেই থেকে এখানেই একা থাকে।
ফোন ধরতে ওপাশের কণ্ঠটি বিনা ভূমিকায় বলল—‘তোর ভাটিয়ার আর বৃন্দাবনী সারঙের রেকর্ড শুনলুম অপু! এককথায় অপূর্ব।’
অপালা বলল—‘কে, বিদ্যুৎদা?’
—কী? কী বললি? বিদ্যুৎদা? বিদ্যুৎ সরকার ডাক্তার হিসেবে ভালো হতে পারে কিন্তু এরকম গলা পেতে হলে তাকে বেশ কয়েক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।’
অপালার তখন সত্যিই খেয়াল হল ওদিকের কণ্ঠ বিদ্যুৎ সরকারের তো নয়ই। অসামান্য ভাবসমৃদ্ধ এক পুরুষালি কণ্ঠ। সে চুপ করে আছে দেখে কণ্ঠ আবার বলল—‘তুই কি আজকাল বিদ্যুৎ-টিদ্যুৎ সবার সঙ্গেই তুই-তোকারির টার্মস্-এ এসে গিয়েছিস নাকি অপু? খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি!’
অপালা প্রাণের সমস্ত আনন্দ ও বিস্ময় ঢেলে দিয়ে বলল—‘সোহম? সোহম? তুই সোহম কথা বলছিস?’
—‘ইয়া, ম্যাডাম, দিস ইজ সোহম চক্রবর্তী দি ইনফেমাস গজলিয়া স্পীকিং।’
—‘কোথা থেকে বলছিস?’
—‘বিদ্যুৎদার বাড়ির থেকে খুব দূরে নয়, কেন্ট-এই, বার্লে অ্যাভেন্যু বলে একটা জায়গা থেকে।’
হঠাৎ অপালার একটা প্রশ্ন মনে পড়ল, সে বলল—‘ইনফেমাস বললে কেন সোহম?’
—‘আরে ম্যাডাম, ইনফেমাস শুনেই তুমিতে ট্রান্সফার করে দিলি? আমার সব রোম্যান্টিক রসালো কাণ্ড-কারখানার বিবরণ কেচ্ছা-কাগজে বেরোয় না? নাবিকদের মতন প্রতি বন্দরে একটা করে বউ আছে ইত্যদি ইত্যাদি।
কিছু কিছু অপালার কানে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সে যে সোহমকে চেনে তাকে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারে না। সংক্ষেপে বলল—‘আমি ওসব কিছু জানি না, আসলে গানবাজনার জগতের পলিটিক্স্ থেকেও বহুদূরে বাস করি।’
—‘পলিটিক্স্ থেকে দূরে বাস কর, ইট্স্ ওকে বাই মি, কিন্তু গান-বাজনার থেকেও দূরে থাকিস না। “আশাবরী” নামক ছবিটার রেকর্ডে পুরনো অপালাকে খুঁজে পাচ্ছি যেন, খালি মাঝের কয়েক বছর কোথায় ডুব গেলে ছিলি, জানতে পারি কি?
অপালা বলল—‘অত কথা ফোনে বলা যাবে না। তোর বিল উঠছে না?’
—‘বিল আমার হোস্ট দেবে। আমার কি! তোর কি আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না? প্রুডিশ হয়ে গেছিস নাকি আজকাল?’
—‘বাজে কথা বলিস না সোহম। কিন্তু তুই গজলিয়া হয়ে গেলি কেন?’
—‘সে অনেক কথা। ফোনে এত দূরত্ব থেকে বলা যাবে না। অপালা, ভালো আছিস তো? তোর সেই কার্তিক ঠাকুর বরটি? ছেলেপিলে কটি?’ শেষ কথাটা সোহম বলল গিন্নিদের মতো করে। অপালার উত্তর শুনে বলল—‘তিনটি? বলিস কি? একেবারে ভারত সরকারের লিমিট অবধি চলে গেছিস? তুই যে এতটা মানে ইয়ে, তা তো জানা ছিল না, বাইরে থেকে দেখে তো মনে হত ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানিস না।’
অপালা বলল—‘মার খাবি সোহম্।’
—‘আচ্ছা রাখি। শীগগির দেখা হবে।’
আলো-ঝলমলে মুখ নিয়ে অপালা ফিরে দাঁড়াল। শিবনাথ মুখ থেকে কাগজ সরিয়ে বললেন—‘সোহম? বাঃ কতদিন পর? তোমার এক নম্বর বন্ধু।’
রণো সবে ঘুম থেকে উঠে দাদুর ঘর থেকে বেরোচ্ছিল। বলল —‘কে ফোন করছিল? সোহম চক্রবর্তী? গজল? ওহ্ ফ্যানটা! মা সোহম চক্রবর্তী কেন তোমায় ফোন…’
—‘ও তো আমার বন্ধু!’
—‘তোমার বয় ফ্রেন্ড? আই কান্ট রিয়্যালি থিংক অফ ইট!’
—‘সোহম আমার গুরুভাই। দুজনেই রামেশ্বরজীর কাছে ছোট থেকে শিখেছি।’ অপালা গম্ভীর মুখে বলল।
রণো বলল—‘তোমাকে আজকাল ম্যাজিশিয়ান বলে মনে হচ্ছে। টুপির থেকে খরগোসের মতো একটার পর একটা চমক বার করছ? মিতশ্রী ঠাকুর… সোহম চক্রবর্তী… আর কতকগুলো এরকম খরগোস আছে বলো তো?’
আনন্দের আতিশয্যে আজকে অপালা চায়ে চিনির বদলে সুজি দিয়ে ফেলল। মনোহর বললেন—‘বউমা আমার যে ব্লাড সুগার হয়েছে তা তো জানতুম না!’
অপালা হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে ছোট দেওর বিশ্বনাথ হাসতে গিয়ে বিষম খেল। তারপর বলল—‘চায়ে চিনি নেই বউদি।‘
অপালা জিভ কেটে রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছে, বিশ্বনাথ ডেকে বলল— ‘বউদি, কিছু একটা দিয়েছো, কিন্তু সেটা চিনি নয়, এই যে তলায়, ক্রমশ ফুলে উঠেছে?’ তখন শাশুড়ি বলে উঠলেন— ‘ওই দ্যাখো, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই সুজি দিয়েছো, একরকম কৌটো পাশাপাশি থাকে।‘ তখন সবাইকারই হাসির পালা।
নিজের বিয়ের আগে পর্যন্ত বিশু দারুণ বউদি-ভক্ত ছিল। গান শুনতে চাইত, অবশ্য ক্ল্যাসিক্যাল নয়, কিন্তু অন্য যে কোনও গানেই তো অপালার সিদ্ধি আছে। বন্ধুর টেপ-রেকর্ডার এনে রেকর্ড করত, ভালো ভালো রেকর্ড, ক্যাসেট এনে উপহার দিত। রেডিও বা দূরদর্শনে রেকর্ডিং-এ যাবার সময়েও প্রায়ই বউদির সঙ্গী হত। প্রথম চাকরি পেয়ে বউদিকে একটা স্বরমণ্ডল কিনে দিয়েছিল। সেই দেওর একটু বেশি বয়সে বিয়ে করবার পর একেবারে বদলে গেছে। ধনী ঘরের ছোট জাটি খুব ফর্সা, নাদুসনুদুস, তার পিসশাশুড়ির ভাষায় এতদিনে বাড়িতে একটা সুন্দর বউ এলো। বেশ ভদ্র মার্জিত ব্যবহার। কিন্তু অপালা যতই তার দিকে এগিয়ে যায়, ততই সে দূরে সরে যায়। এভাবে নিজের থেকে এগোনোও অপালার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু একে বিশুর বউ, তার ওপর তার নিজের জা, তার বোনও নেই। স্বাভাবিক স্নেহেই সে এগিয়েছিল। বিশুও তখনও বউদির অনুগত দেওর। তারপর হঠাৎ একদিন বিকেলের জল-খাবারের পাত্রটা ছোট বউ জয়া তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। তখন খেতে বসেছেন শ্বশুরমশাই। রণো এবং বিশু সবে এসে বসছে। জয়া বিশুর প্লেটে সযত্নে খাবার সাজিয়ে দিল, তারপর হুড়মুড় করে ছুটে চলে গেল রান্নাঘরে। চা-এর কাপটা সন্তর্পণে নামিয়ে রাখল বিশ্বনাথের প্লেটের পাশে। বাকিগুলো অপালাই পরিবেশন করল। বিশু আগে খাবার টেবিলে বসে অনেক গল্প করত। বউদির সঙ্গে দাদার সঙ্গেও তার নানাবিষয়ে আলোচনা হত, তর্ক হত। বিয়ের পর আস্তে আস্তে সে ঘরবন্দী হয়ে পড়ল। হয় ঘরে, নয় জোড়ে। সে খাবার টেবিলেই হোক, বাইরে বেড়াতে যেতেই হোক। আজ অনেক দিন পর ও বাবার সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে, সম্ভবত জয়া কদিনের জন্য ভাইয়ের বিয়েতে বাপের বাড়ি গেছে বলে। অনেকদিন পর বিশু বউদি কথাটা উচ্চারণ করল। অপালার মনে হল একেকটা দিন যেন সুখের রোদ নিয়েই ওঠে। কী গভীর এই সুখের, শান্তির, আনন্দের স্বাদ, সে ছাড়া কে বুঝবে?