গান্ধর্বী (Gandharbi) : 17
শিবনাথ বললেন— অপু তুমি অফারটা নাও। সত্যি তোমার জীবনের সমস্ত সাধনা, আশা আমার জন্য, আমাদের জন্য নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু…’
অপালা আলনা গুছোচ্ছিল, বলল—‘বাজে না বকে আর কি বলতে চাও ঠিক করে বলো।’
‘আমি বলছিলুম বাড়িতে এখন কিছু জানিয়ে দরকার নেই। আমি নিজে তোমায় নিয়ে যাওয়া আসা করব। কোনও অসুবিধে হবে না।’
কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল শিবনাথকে অপালার সঙ্গে যাতায়াত করতে হলে অফিস কামাই করতে হয়। তার অবশ্য দরকারও হল না। মিতুলের গাড়ি নিয়মিত অপালাকে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে লাগল। মিতুল নিজেও তাতে বসে থাকে।
একদিন অপালার ছেলের সঙ্গে মিতুলের আলাপ হলো। রণো তখন বেরোচ্ছিল। মিতুল আজ শাড়ি পরে এসেছে। রণো তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মিতুল গাড়ি থেকে মুখ বার করে বলল— ‘তুমি নিশ্চয়ই রণো, মা রেডি হয়েছে? ডেকে দাও। আমি আর নামছি না। শীগগির যাও।’ বলতে বলতে সে ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল। রণো এ ধরনের আদেশের সুরে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু এখন সে পেছন ফিরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। অপালা তখন তার সাজ-পোশাকের শেষ পর্যায়ে। অর্থাৎ পায়ের গোড়ালি দিয়ে শাড়িটা টেনে নীচে নামাচ্ছে। রণো বলল, তোমায় এক ভদ্রমহিলা ডাকছেন, গাড়িতে বসে আছেন।’
—‘চল্’— ব্যাগটা তুলে নিয়ে অপালা বলল। রণো দু তিনটে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নামতে নামতে বলল ‘উনি কে?’
—‘আমার মাস্টারমশায়ের মেয়ে, মিতুল মাসি।’
—‘মুখটা আমার খুব চেনা লাগল। গত বছর আমাদের কলেজ সোশ্যালে এসেছিলেন।’
—‘হতেই পারে। ভালো নাম মিতশ্রী ঠাকুর।’
—‘তাই বলো তাই চেনা-চেনা লাগছে। ওঁর সঙ্গে কোথায় যাবে?’
অপালা ভালো করে মিথ্যে কথা বলতে পারে না। সে সংক্ষেপে বলল— ‘রেকর্ডিং আছে।’
—রণো গাড়ির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল— মিতুল ডাকল— ‘রণো, রণো, তুমি কোথায় যাবে?’
—এই একটু…’
—‘জায়গাটা বলো, আমি নামিয়ে দেবো।’
রণো আঠার বছরের ছেলে। সে মোটের ওপর তার বাবার মতো দেখতে। যদিও অনেক পাতলা। কিন্তু স্বভাব একদম বিপরীত। এখন সে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় কর্কশকান্তি। হঠাৎ লম্বা হয়ে যাচ্ছে। গোঁফ দাড়িতে মুখ আচ্ছন্ন। নিজের বয়সের ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া স্বস্তি পায় না।
সে বলল— ‘কাছেই, গাড়ি লাগবে না।’ বলে বড় বড় পা ফেলে গাড়ির যে দিকে মুখ তার উল্টো দিকে চলে গেল। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে মিতুল বলল— ‘অপুদি, তোমার ছেলে খুব শাই, ইনট্রোভার্ট তোমার মতো, না?’
—‘আমাদের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলে না, তবে ইনট্রোভার্ট কি না জানি না। বয়সটা ভালো না, মিতুল, আমার ভয় করে।’
—‘ভয়? কেন?’
—‘ছেলেটা বাড়ির একমাত্র, এবং বড় ছেলে। কষ্ট করে বাঁচানো হয়েছে। দাদু-দিদার চোখের মণি। ছোট থেকেই ওঁদের হাতেই একরকম মানুষ হয়েছে। আমি ওকে ভালো করে চিনতে পারি না। আমি কেন, ওর বাবাও না।’
—‘গান-বাজনা কিছু করে না?’
—‘গান? গান এদিক দিয়ে যাবে তো ও উল্টো দিক দিয়ে যাবে। কিছু ওয়েস্টার্ন মিউজিক শোনে। কিছু হিন্দি ফিলমি গান। বাস। কখনও বাথরুমেও গুনগুন করতে শুনিনি।’
—‘তোমার ছেলে গান করে না? ছেলেবেলায় ওকে গান শোনাতে না! ঘুম পাড়াবার সময়ে আমাকে যেমন শোনাতে। ধেড়ে মেয়ের কচি মায়ের মতো!’
—‘দূর, ও বরাবর ঠাকুমার কাছে ঘুমোতো। তিনি ভাই খুব বেসুর। “ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো” টুকুও সুরে বলতে পারেন না। আমার ছেলেও অমনি বেসুর।’
মিতুল চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল— ‘মেয়েরা?’
—‘বড় টিটুটার খুব স্বাভাবিক সুন্দর গলা আছে। কিন্তু কিছুতেই গানে বসবে না। ছোট বনিটার গলা ভালো না। ছাত্রীদের সঙ্গে তবু বসাই। কিন্তু বড় সহজে হতাশ হয়ে পড়ে। ইচ্ছে আছে। কিন্তু দমে যায়।’
—‘তুমি দমিয়ে দাও না তত? আমার সেই শ্রীকণ্ঠের কথা মনে রেখো।’
—‘না মিতুল, দমিয়ে দিই না একেবারেই। কিন্তু আমার গান শুনেই ও সবচেয়ে দমে যায়। যাই হোক, চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজকালকার পড়াশোনার যা চাপ, তাতে রেওয়াজের সময় কতটুকু পায়! কত আঁকাজোকা। বাপরে। অর্ধেক তো আমাকেই করে দিতে হয়।’ একটু থেমে অপালা বলল— ‘মিতুল তোদের গানের বংশ। গানের বাড়ি, কত পুরুষ ধরে গানের সাধনা চলেছে? তোরা রক্তে ক্ষমতা নিয়েই জন্মেছিস। প্রথম দিকের গলার কর্কশত্ব কিছু না। বংশের সুরের ধারা যাবে কোথায়? আর আমরা ভূঁইফোঁড়। শ্বশুরবাড়িতে তো গানের কোনও চর্চাই নেই। আমার বাপের বাড়িতেও আমিই একমাত্র গানের ভক্ত। খুব সম্ভব আমার বাবা, যিনি আমার খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর ভেতরে গান ছিল। ঠাকুরঘরে বসে সন্ধেবেলায় নিয়মিত গাইতেন। ‘তুমি বিবেক হলদি গায়ে মেখে যাও ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে’, এই লাইনটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। হলুদ মাখলে কুমিরে ধরে না। এইরকম একটা বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল গানটা থেকে। ভাবলেও হাসি পায়। তোদের ঘরের সঙ্গে আমাদের কোনও তুলনা চলে না।’
মিতুল বলল—‘কি জানি অপুদি, এগুলো আমি ঠিক মেনে নিতে পারি না।’
—‘তুই তো কিছুই মানিস না।’
—‘মানববা কেন, বলো! যে ঘরানাই হোক, কেউ না কেউ তো তাকে আরম্ভ করে। তার ক্ষমতাটা কোথা থেকে এলো। বিলায়েত খাঁয়ের তিন পুরুষের কথা আমরা জানি। তার আগে? ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ওই পাগলের মতো সঙ্গীতপ্রীতি, ঢোল থেকে আরম্ভ করে সরোদ, সুরশৃঙ্গার পর্যন্ত সমস্ত বাজনা বাজাবার ওই অদ্ভুত ক্ষমতা কোথা থেকে এলো! তাঁর পিতৃপুরুষের কাছ থেকে বলে তো আমি শুনিনি।’
অপালা বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল—‘ঠিক আছে, তোর কথা মানলুম, আমি অপালা-ঘরানার সৃষ্টি করতে পারিনি, কারণ কি আমি জানি না।’ শেষের দিকে তার গলা খুব বিষণ্ণ শোনালো। সে চেয়েছিলো টিটু, অন্তত টিটু গানটা ধরুক। ওকে সে কত দিয়ে যেতে পারতো!
ফিল্মের গান খুব ভালো হচ্ছে। বাঁধা গান, কিন্তু রামেশ্বর আর সে দুজনে মিলে বেঁধেছে। এতো ভালো গলা, তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে ফুটে উঠছে একটার পর একটা গানে। এরা বরং মুশকিলে পড়েছে মিতুলের গান নিয়েই। মিতুলের গানে যতক্ষণ চটক চমক, পপ-মেজাজ আছে ততক্ষণ ঠিক আছে। তার গলায় আছে এক ধরনের দানা, একটু ভারী গলায় এই দানা, ফিল্মের লোকেরা বলে খুব সেক্সি। এগুলোই তার গানের আকর্ষণ। কিন্তু শুদ্ধ রাগসঙ্গীত গাইতে গেলেই অপালার গানের গভীরতা, কণ্ঠ সবই এতো উচ্চ স্তরের যে মিউজিক ডিরেক্টরদের এটা খুব অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে! রামেশ্বর বিচলিত নন। তিনি জানতেন এটা হবেই। এমন কি নজরুলের গানের এক জলসার দৃশ্যেও অপালা তিলক কামোদে ‘সৃজন ছন্দে’ গানটি বহু সুরবৈচিত্র্য করে ভজনের ভঙ্গিতে গাইল, যা মিতুলের গানকে বহু বহু গুণ ছাড়িয়ে গেল। মিতুল বলল—‘এটাই আমাদের গল্পের ক্লাইম্যাক্স হোক না। এই গানটা শুনেই নায়িকা প্রথম রিয়্যালাইজ করুক সত্যিকারের গান কী জিনিস! আপনারা ঘাবড়াচ্ছেন কেন?
‘আশাবরী’ মুক্তি পেলো পুজোর সপ্তমীর দিন। রেকর্ড তার আগেই কিছু কিছু বেরিয়ে গেছে। অপালা দত্তগুপ্তর নজরুল, রাগপ্রধান, এমন কি খেয়াল, ঠুমরি, ভজনও পড়তে না পড়তে বিকিয়ে গেল। বেশির ভাগ পুজো-মণ্ডপেই তারস্বরে বাজছে ‘ভোলো ভোলো-সৃজনছন্দে’, ‘দুসর ন কোঈ মেরে তো গিরধারী গোপাল’ রাগপ্রধান ‘গঙ্গা চিতপাবনী ভবানী শিবরঞ্জনী’
ছবি মুক্তি পাবার এবং রেকর্ডের অসামান্য সাফল্যের কথা পুরোপুরি জানবার পর খবরটা বাড়িতে ভাঙল শিবনাথ। খুব আশ্চর্যের কথা মনোহর বাবু বললেন—‘এতো ভালো কথা, এত দিন বলে নি কেন? বাড়িতে রঙিন টিভি সেট এলো, শাশুড়ি ও জায়ের জন্য দামী শাড়ি। অপালা বলল—‘বাবা, আমি ভাবছি একজন ওস্তাদ তবলিয়ার কাছে কিছুদিন শিখবো!’
মনোহর দত্তগুপ্ত অবাক হয়ে বললেন—‘চল্লিশ বছর বয়স হতে চলল এখনও শিখবে? তা-ও আবার তবলা? হাসালে মা। আর কোনকিছু করতে হলে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবার অভ্যেস তো তোমার নেই? হঠাৎ অনুমতি চাওয়া?’
অপালার মনটা বহুদিন পর আবেগে আনন্দে পরিপ্লুত হয়েছিল। কত দিন পর সে প্রাণভরে গান গেয়েছে, সেই গান এতো লোকে ভালোবেসে শুনছে, রাতারাতি অপালা দত্তগুপ্ত একটা নাম হয়ে গেছে। বাড়ির লোককে সম্পূর্ণ নিজস্ব উপার্জনের টাকায় দামী দামী উপহার দিতে পেরেছে। শ্বশুরের কথায় সে এক নিমেষে নিভে গেল। ছাইয়ের মত মুখ নিয়ে ঘরের ভেতরে আসতে তার বড় মেয়ে ষোল বছরের টিটু বলল—‘মা তুমি বুঝি ভেবেছিলে, কালার টিভি ঘুষ দিয়ে দাদুর কাছ থেকে কিছু পাসপোর্ট আদায় করে নেবে?’ টিটুর গলায় শ্লেষ। অপালা তখন প্রাণপণে চোখের জল গিলছে। আঘাতটা কিছুটা অপ্রত্যাশিতই তো! টিটু বলে উঠল—‘মা তোমার যেটা করবার দরকার সেটা বোল্ডালি করো, কে তোমাকে ভিক্ষে চাইতে যেতে বলেছে?’
টিটু বয়সের আন্দাজেও বেশ পরিণত। সে মায়ের সামনে বসে আছে দু হাতের ওপর থুতনি রেখে। বলল—‘তুমি তো সংসারের অনেক কাজ করো। রুটি বেলো, খেতে দাও, কাপড় কাচো। এই সমস্ত করেও তুমি তোমার গানের ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছো। গানও চালিয়ে যাচ্ছে। আর ওই কোয়ালিটির গান। কাকি তো তোমার চেয়েও অনেক কম কাজ করে সংসারের, খালি সিনেমা যাচ্ছে, আর বাপের বাড়ি যাচ্ছে, কই তাকে তো তোমার মতো শাসন সহ্য করতে হয় না! যত মানবে এই দাদু-দিদারা, ততই পেয়ে বসবে জানবে।
শিবনাথ বললেন—‘এই টিটু, কী বলছিস? থাম।’
—‘থামতে তো বলবেই। আমরা ছোট,তোমাদের মধ্যে যা ছোটোমি তা দেখলেও বলবার অধিকার তো আমাদের নেই।
বনি বলল—‘মা সবার জন্যে খালি খাটে। শুধু আমার আর টিটুর বেলায় কিছু না।’ আদুরে গলা বনির,—বলল, ‘এতো করে বললুম শুটিং দেখতে নিয়ে যেতে, গেলে না। স্টিরিওটা তো দাদাই একচেটে করে রেখেছে।’
টিটু বলল—‘বনি, থামবি?’
শাশুড়ি ডাকলেন—‘বড় বউমা এবার খাবে এসো।’
অপালা উঠছিল না। শিবনাথকে বলল—‘খিদে নেই বলে দাও।’
টিটু বলল—‘মাম্মি, না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। একেই তো তুমি অ্যানিমিক। চলো তো। খাবে তো রুটি আর আলু চচ্চড়ি, পটলভাজা সব দাদা মেরে দিয়েছে কিনা কে জানে। আজ আবার চিংড়ি মাছ হয়েছে। তোমার অ্যালার্জি। অলটারনেটিভ কিছু আছে বলে মনে হয় না। দেখি যদি একটু দুধ জোগাড় করা যায়।’ টিটু উঠে গেল। শিবনাথ মিনতির সুরে বললেন—‘যাও অপু, খেয়ে এসো। তোমার যার কাছে ইচ্ছে শিখবে। আমি তো রয়েছি।’
‘আমি তো রয়েছি কারুর মুখ থেকে এই আশ্বাস বাক্য বড় মূল্যবান। সাহস দেয়, সান্ত্বনা দেয়। আরও কত কিছু দেয়। কিন্তু শিবনাথের এই ‘আমি’ বড় ভালোমানুষ, দুর্বল ‘আমি’, এতদিনে অপালা এটা জেনে গেছে। বহুকাল আগে যেদিন মা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করে সাজগোজ করতে পাঠিয়েছিল, কনে দেখানোর জন্য, সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদে অবশেষে বিপুল অভিমানে সে ঠিক করেছিল আজ থেকে সে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিল। গান ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই। সেই গান জোর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, অতএব আজ থেকে সে এক রকম মৃত। মৃতও নয়, জীবন্মৃত। যান্ত্রিকভাবে বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দেবে। কিন্তু এই সংকল্প ধরে রাখাও তো খুব শক্ত! জীবনটা ছোট হলেও তো খুব ছোট নয়। তাতে প্রতি দিন চব্বিশটি ঘণ্টা। চব্বিশ ইনটু ষাট মিনিট, চব্বিশ ইনটু ষাট ইনটু ষাট সেকেন্ড। এতগুলো পল বিপল অনুপল যান্ত্রিকভাবে কাটানো তো সহজ নয়। তার ওপর ছিল শিবনাথের আশ্বাস। পরবর্তী জীবনে এই আশ্বাস যে এক অসার তা সে ভালো করেই টের পেয়েছে। প্রথমত শিবনাথ অফিসের কাজে সাংঘাতিক ব্যস্ত থাকে। শ্বশুরবাড়ির আবহাওয়া এমনই প্রতিকূল যে সেখানে ভোর বা সন্ধেয় তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসাটা খুব একটা হাস্যকর ব্যাপার। গলা ছাড়তেও লজ্জা লাগে। এদের চিলেকোঠা বলেও কিছু নেই। অথচ মুখ ফুটে কেউ বলেনি—‘বউমা, তুমি গান করো।’ বা ‘এসব আবার কী?’ প্রথম প্রথম কেউ বউ দেখতে আসলে বা এমনি কোনও অতিথি আসলে শাশুড়ি বলতেন—‘আমাদের বউমা কিন্তু খুব ভালো গান জানে, একটা শুনিয়ে দাও তো মা!’
তখন অপালা তার সেই সোহমের উপহার-দেওয়া হাতির দাঁতের কাজ করা অপরূপ হার্মোনিয়ম নিয়ে অতিথির মন বুঝে গান করত। বিয়ের পর এরকম সুযোগ তার অনেক হয়েছে। ‘ও কে গান গেয়ে গেয়ে চলে যায়/ পথে পথে ওই নদীয়ায়/ কিম্বা ‘এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ কিম্বা ‘ক্ষমিও হে শিব আর না কহিব’। শুনে অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না, বলতেন—‘গান জানে তা শুনেছিলুম, কিন্তু সে যে এমন গান তা তো জানতুম না, গান এমন হয় কখনও ভাবিনি।’ দিদি-জামাইবাবু যতদিন ছিলেন, এলেই গানের আসর বসাতেন, ফরমাশ করে করে গান শুনতেন। কিন্তু তাঁরা ভেনেজুয়েলায় চলে যাবার পর থেকে গান গাওয়ার, বিশেষ করে ওরকম সারা সন্ধে জুড়ে দু ঘণ্টা তিন ঘণ্টা টানা গান গাওয়ার সুযোগ কমে গেছে। কিন্তু এ তো গেল গান! রেওয়াজ কি জিনিস সে ধারণা এঁদের খুব একটা নেই। পাশের বাড়ির একটি মেয়ে রোজ সকাল-বিকেল তারস্বরে ‘সা রে গা রে গা মা গা মা পা’ করে চিৎকার করে, শ্বশুরমশাই বলেন—‘বাপ রে, এ যে কবে পরের ঘরে যাবে!’
শীতকালের রাতে আটকাঠ বন্ধ করে সে শিবনাথকে বলত—‘মালকোষ শুনবে?’ শিবনাথ বলত—‘অফকোর্স।’ তখন সেই বন্ধ ঘরে মন্ত্র আর মধ্য সপ্তকে শুরু হত তার মালকোষের সুরবিহার। ভয়ে উঁচুতে উঠত না। ত্রিসপ্তক বিস্তৃত তার সেই অনুপম কণ্ঠ লাবণ্য সীমার মধ্যে বাঁধা থাকত। এর পরে পিলু কি মিশ্র খাম্বাজে ঠুমরি। ঠুমরি শেষ হতে না হতেই যে শিবনাথকে বাইরে থেকে দেখলে নরম প্রকৃতির, শান্ত স্বভাবের মানুষ বলে মনে হত সে-ই হয়ে উঠত খ্যাপা বাঘের মতো। সুর-ছমছমে সেই মধ্যরাতে যখন অপালার সমস্ত শরীর সুরের প্রেমে শিউরে-শিউরে উঠছে, মনে মনে সে অনুবাদী সুরগুলিতে লঘু পায়ে বিচরণ করে বার বার বাদীস্বরে ফিরে এসে নিজেকে ন্যস্ত করতে চাইছে দীর্ঘ সময় ধরে, তখন শিবনাথের দিক থেকে আসত একটা বীভৎস আক্রমণ। ঠিক যেন একটা শিকারী চিতা তার শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর তাকে টুকরো টুকরো করছে। হাড় মাংস মজ্জা সব আলাদা আলাদা করে ফেলছে। শিবনাথ যদি এই সময়গুলোতে তাকে আদরে সোহাগে বেহালার ছড়ের টানে টানে বাজাত, তাহলে হয়ত তার অন্য রকম লাগত। কিন্তু শিবনাথের ওই উন্মত্ত ব্যবহার তাকে অসহ্য কষ্টে কাঁদিয়ে ছাড়ত। সুখের, উত্তেজনার, আনন্দের শীৎকার নয়। বাঘের হাতে অসহায় মৃগ শিশুর মরণ-আর্তনাদ। অপালার তিনটি সন্তানই হয়েছে এইভাবে। অথচ তিনজনেরই সুরের সঙ্গে আড়ি। এভাবে ছাড়া তার রেওয়াজের উপায়ও বিশেষ ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে সে বুঝেছে নির্জন মাঝরাতের সঙ্গীত শিবনাথের প্রথম রিপুকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। সে আর শিবনাথ হাজার অনুরোধ করলেও ওই সময়ে গাইতে চায় না। শিবনাথ বলেও—‘ও একলা শ্রোতাকে শোনাতে বুঝি ইচ্ছে করে না! শ’য়ে শ’য়ে শ্রোতার সামনে গেয়ে অভ্যেস!’ অপালা মনে মনে বলে—‘শোনাতে খুবই ইচ্ছে করে, একলা কেন, কোনও শ্রোতা না থাকলেও আমার চলে যায়।’ মুখে বলে—‘বড় ক্লান্ত লাগছে গো, আজ থাক।’ পরের দিনই শিবনাথ ভিটামিনের শিশি নিয়ে বাড়ি ফেরে। এইটুকুই তার হাতে। অবশেষে, অনেক কষ্টে নীচের ওই ঘর। সাহস নেই নেই করেও একটু সাহস তো অপুর আছেই। বিনা প্রতিবাদে, বিনা বিদ্রোহে, চুপচাপ নিজের কাজ করে যাবার সাহস! জেঠুর নিরবচ্ছিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও সে তার কাজ করে গেছে, এঁদের উদাসীনতা এবং অজ্ঞতার পটভূমিতে কোনমতে চালিয়ে গেছে। কিন্তু তার উচ্চ শিক্ষা থেমে গেছে। জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রের মতো গানের ক্ষেত্রেও শেখার তো শেষ নেই। মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত সে কী-ই বা শিখতে পেরেছে। মাস্টারমশাইয়ের কাছে সপ্তাহে দুদিন যেত। মাস্টারমশাই নিজেই বলতেন—‘তুমি এবার অমুকের কাছে যাও অপু, তমুকের কাছে যাও, আমার যা দেবার সবই তুমি। নিয়েছো!’
প্রথম প্রথম কনফারেন্সে ডাক আসত, প্রথম সন্ধ্যার শিল্পী হিসেবে। তখন রামেশ্বরের শিক্ষক হিসেবে অসম্ভব সুনাম। প্রভাব। অপালারও সম্ভাবনাময় শিল্পী হিসেবে গায়ক মহলে যথেষ্ট মর্যাদা। মঞ্চে বসে বসে অপালা দেখত শ্রোতাদের আসন তখনও অর্ধেকের ওপর খালি। চলাচল চলছে। মাঝরাতে যিনি আসবেন তাঁরই জন্যে এই টিকিট কাটা। কে অপালা দত্তগুপ্ত! হীরাবাই বরোদেকারের মতো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, শ্যামবর্ণ, ক্ষীণাঙ্গী গায়িকা, কোনও মোহন মুদ্রা ছাড়াই তানপুরো ধরে যে একঠায় গেয়ে যায়। গোড়ার দিকে বসে বসে কেউ ‘ওয়া ওয়া’, ‘আহা আহা করে তারিফ করতেন। যখন সে তিনতালে তিন আবর্তন তান করে সমে ফিরছে, কিংবা বিস্তারের মাঝে একটা অসাধারণ পুকার দিচ্ছে তখন পেছন দিকে একদল উঠে গিয়ে সম্ভবত ফুচকা খেয়ে আরেক দলের জন্য চুরমুর নিয়ে এলো, কোল্ড ড্রিংকসের বোতলগুলোর নড়া ধরে ঢুকলো আরেক দল! কী গাইল রে! কী গাইল রে! নটবেহাগ? নতুন রাগ নাকি? অনেক সময়ে মন্তব্য হত সা থেকে মা-তে যেতে কত সময় নিল দেখলি? আমীরা খান সাহেবা। এই সমস্তর জন্য ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত বিরক্ত অপালা একদিন মারোয়ায় সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরে মধ্য লয়ে গান ধরে চট করে পৌঁছে গেল তার সেই বড়ে গোলাম আলি সুলভ কূট তানে, তারপর তারসপ্তকের ধৈবতে অনেকক্ষণ ধরে সুরস্পন্দন সেরে তারসপ্তকের সা। নেমে এলো মধ্যসপ্তক তারপর মন্ত্রের সাতে। তখন সারা অডিটোরিয়াম জুড়ে হাততালির পর হাততালি। অপালা এইবার তার নিজস্ব মুড অনুযায়ী পিলুতে ঠুমরি শেষ করে ভজন ধরল মৎ যা। মৎ যা। মৎ যা যোগী। তার ভেতরটা তখন সুরে টগবগ করে ফুটছে। বহুক্ষণ ধরে ভজনটি গাইল সে। তার পরেও অনুরোধ আসছে। আরও ঠুমরি, আরও ভজন এমনকি আরও খেয়ালের জন্য। উত্তাল অডিটোরিয়াম পেছনে ফেলে সে চলে এসেছিল। সে শুনেছে তার এই দিনের গানের পরই এক বিখ্যাত ওস্তাদের বাজনা ছিল, সেটা নাকি জমেনি। উদ্যোক্তা বিরক্ত হলেন, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি নিয়েছে বলে। বিখ্যাত ওস্তাদ তো বঙ্কিমচন্দ্র নন, যে আগামী দিনের গায়িকার হাতে জয়পত্র তুলে দেবেন। তিনি রাগী, মেজাজী মানুষ, সাঙ্ঘাতিক রেগে গিয়েছিলেন। ফলে পরদিন কাগজে কাগজে কী সমালোচনা, কী সমালোচনা! সবই রামেশ্বরের বিরুদ্ধ দলের। কেন সে দ্রুত বন্দেজে যায়নি! অল্পবয়স্ক একটা মেয়ের নিয়ম ভাঙার এ কী ধৃষ্টতা! তাছাড়া ওটা মারোয়া হয়েছে না সোহিনী? তানের সময় কোমল ঋষভ তো লাগছিলই না। একটিমাত্র বাংলা সাপ্তাহিকীতে তার ছবিসহ তার সমগ্র পার্ফম্যান্সের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হয়েছিল। তার পরে অন্য গান শোনার মেজাজ ফিরে আসতে যে মাঝরাত পার হয়ে গিয়েছিল সে কথাও এঁরা উল্লেখ করতে ভোলেননি।
কিন্তু তারপর থেকে আর ডাক আসে না। অপালা এখন শ্যাওলা-ধরা ডোবা, বা লবণ হ্রদ, যার ভেতরে ভেতরে সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগের একটা গোপন রাস্তা আছে, কিন্তু অব্যবহারে সেটা বুজে এসেছে। মিতুল সেই পথটা খুলে দিল। মিতুল। তার গুরুভগিনী। কতদিন তো সে বড় কনফারেন্সে গান শুনতেও যায় না। ওরা আস্তে আস্তে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড পাঠানো বন্ধ করে দিল। শিবনাথ বললেন—‘এ একটা অপমান! অপালা দত্তগুপ্ত টিকিট কেটে কনফারেন্স যাবে! এ হতেই পারে না।’ তখন গুরু রামেশ্বরকে নিয়ে ভীষণ দলাদলিও চলছে। অপালার মতো শান্ত-সমাহিত মানুষের পক্ষে সেখানে টেঁকাও খুব মুশকিল! কিন্তু… কিন্তু…! পণ্ডিত চন্দ্রকান্তকে সে আর শুনতে পাবে না! রবিশংকর। বিলায়েত! ভীমসেন! গিরজা দেবী! বিসমিল্লা! নিখিল ব্যানার্জী! সব, স-ব হারিয়ে গেল জীবন থেকে! খালি এক অন্যমনস্ক বউ দিস্তে দিস্তে রুটি বেলে যায়, এরা প্রাতরাশে, টিফিনে, সবেতে রুটি পছন্দ করে, এক অন্যমনস্ক মা ছেলের জামা মেয়েকে পরাতে যায়, মেয়ের বই নিয়ে ছেলেকে পড়াতে বসিয়ে বকুনি খায়, সংসারে নতুন-আসা ধনীঘরের দুলালী ফর্সা নতুন বউটির সঙ্গে তুলনা ক্রমশই মুখর, আরো মুখর হয়ে উঠতে থাকে। সে বউটি প্রাত্যহিক কাজের খুঁটিনাটি করে না বটে, কিন্তু এক একদিন হঠাৎ কেক কি পুডিং কি মাংসের কাশ্মীরি রান্না করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। রণো ভ্রূকুটি তুলে বলে—‘মা, তুমি কি একটা সিনথিটিক জামাও ঠিকভাব কাচতে পারে না! কলারে, কাফে ময়লা লেগে রয়েছে!’ বনি বলে—‘ওমা, আজকে কিন্তু আমরা সিনেমা যাবোই, বর্ন-ফ্রি এসেছে, সবাই দেখেছে স্কুলে, খালি আমরাই দেখিনি।’ অপালা বলে—‘যা, না, যা, বাবাকে বল।’ —‘ন্ না, তুমিও যাবে, তুমিও! ‘টিটু বয়সের তুলনায় ভারী পাকা, বরাবরই। সে বলবে—‘গান নিয়ে থাকলে কী পরিণতি হয় তোমাকে দেখেই তো বুঝছি মা, প্লীজ আমাকে জোর করো না। আমি আই.এ.এস হবো।’