গান্ধর্বী (Gandharbi) : 14
কে তুমি দাঁড়িয়ে আছো; ওপরে, অনেক অনেক ওপরে যাকে এক ঝলক দেখবার জন্য চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে আমরা ঊর্ধ্বমুণ্ড, হতশ্বাস, জিরাফ প্রমুখের গলা ক্রমাগত লম্বা, সরলবর্গীয় বৃক্ষগুলি দিবারাত্র দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে! কোন সে শক্তি যা একোহহম বহুস্যাং বলে কিম্বা প্রচণ্ড আভ্যন্তর চাপের বিস্ফোরণে ফেটে গিয়ে এই বিশাল অন্ড প্রসব করল? গান্ধারী প্রসূত মাংসপিণ্ডের মতো এই অণ্ড থেকে অযুত নিযুত প্রাণী সৃষ্টি হয়েই চলেছে, হয়েই চলেছে। তুমি কি এইরকমই প্রজায়মান হতে চেয়েছিলে? শুধু সংখ্যা, সংখ্যা আর সংখ্যা। তাদের ভেতরে কত সাধ্য, কত স্বপ্ন, কত আকাঙক্ষা, কত ভুল, কত ঠিক, কত আদর্শ। কোনটারই কেন পূরণ হয় না? তুমি গাছে তুলে দাও হে অমিতবিক্রম তার পরে মইটি কেড়ে নাও। ভাবি, ভাবতে থাকি, আজকাল বয়স সত্তরের কাছে চলে গেছে। ক্রমাগত এইসব ভাবতে থাকি। যখন সাত আট বছরের শিশু ছিলাম, বাবা এসরাজ বাজাতেন, সেই সুরগুলি অবিকল গলায় তুলে, নিজের শিশুবুলি দিয়ে সুরের নিসঙ্গতা ভরাট করে গাইতুম। বল খেলতে খেলতে বলের গান! সাঁতার কাটতে কাটতে জলের গান, গাছে চড়তে চড়তে ফলের গান, রান্নাঘরের চাতালে ঘটিবাটি সার বেঁধে বাজাতুম। বাবা একদিন হুঁকো খেতে খেতে উঠে এসে বললেন—‘ছোট বউ, ছেল্যাড়া কি গায়, খেয়াল করছ?’ মা বললেন ‘কী আবার গাইবে? গাইছে আগডম আর বাগডম।’
‘না গো না, গাইছে ভীমপলাশী। একটি পর্দাও মিস হচ্ছে না। কোমল গান্ধার, কোমল নিষাদ ঠিকঠাক লাগাচ্ছে। মনরঙ্গ সাহেবের যে গানটা আমি বাজাই ‘মধুর মূরত মনকো মোহত/ মনরঙ্গ কে তনমন কো মোহে? অন্তরার এই সুর ঠিক গাইছে। নিজে কি সব বুলি দিয়ে।’ সে বুলি আমার এখনও মনে আছে। ‘ইচ্ছে হলেই কালুর বাড়ি যাবো/গিরগিটিটা ধরে নিয়ে ভীষণ ভয় দেখাবো। ভীষণ ভয় দেখাবো।’ সাধে কি আর মা আগড়ম বাগড়ম বলতেন!
‘কোথা থেকে এ সুর পেলি রে সোনা?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন। বলে ড্রপ দিতে দিতে ভারী অদ্ভুত কথা বলেছিলাম—‘বিষ্টির সময়ে এই সুরই তো ঝমঝম করে পড়ছিল। তুমি তারপর সেটাই তো তোমার যন্তরে বাজালে? আমিও তেমনি গাই। আমি রোদের গান জানি, ঝড়ের গান জানি…’ ভীমপলশ্রীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় মতে বৃষ্টির কোনও সংযোগ নাই। তবু রাগটি শিশুর অপরিণত কিন্তু স্পর্শকাতর, সরল, কর্ণ কুহরে যদি বৃষ্টির সুর বলে মনে হয় তো ধরতে হবে কিছু নূতন গবেষণার দরকার।’ বাবা আত্মগত বললেন, সেই সঙ্গে আরও মনে করলেন এ ছেলে যুগন্ধর গায়ক না হয়েই যায় না। নিজে তো সঙ্গে করে নিয়ে বসতে লাগলেনই, উপরন্তু কলকাতায় নিয়ে এলেন, রামলাল ক্ষেত্ৰীজীর সাগরেদিতে জুড়ে দিলেন, তাঁর কাছে যেমন শাস্ত্রও পড়লাম, তেমন সঙ্গীত শিক্ষাও হতে লাগল, ওস্তাদ বদল খাঁ সাহেব, ওস্তাদ হাফেজ খাঁ সরোদিয়া, গহরজান, কেসরবাই কেরকার, ওঙ্কারনাথ, কত বড় বড় ওস্তাদের গান-বাজনা শুনলাম। মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়স থেকে রামপুর। সেখানে কী গান গেয়েছি আর কী গান শুনেছি ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। বছরে একবার করে পাথুরেঘাটায় আসতাম, বাস, কলকাতার সঙ্গে ওইটুকু সম্পর্ক। চতুর্দিকে তখন গুজব ঘুরে বেড়াত, ‘রামেশ্বর ঠাকুর এইটুকু ছেলে, প্রডিজি, গান শুনে আয়, আর কেউ এর পাশে দাঁড়াতে পারবে না।’ সতের বছর বয়স থেকে একা। মা-বাবা এবং আমার ছোট ভাইটি এক মহামারীতে শেষ। তখন আমি গান গাইতে বরোদায়। তারপর থেকে একেবারে মরিয়া চরিত্র। আমি গান গাই, ওস্তাদ ওস্তাদ তবলিয়ারা আমার সঙ্গে সাথ-সঙ্গতে ঘেমে যান। কোথাও কোনও নোঙর নেই। যেখানেই যাচ্ছি, রাজ-রাজড়ার সঙ্গে কারবার, সেই মতোই ব্যবহার, আর সম্মান। তারপর একদিন কাশীতে তিলভাণ্ডেশ্বরের কাছে এক এঁদো গলিতে অজস্র হনুমানের উৎপাতের মধ্যে আবিষ্কার করলাম এক মহৎ প্রতিভা। গায়ক বটে! এই ভারতের অজানা-অচেনা কোণে যেমন সব মহা মহা যোগী ঘুরে বেড়ান, কারোর জানাজানির তোয়াক্কা করেন না, ঠিক তেমনি আছেন কত সুরসাগর। বয়স্ক মানুষ, গলায় অসাধারণ সুর, সেই সঙ্গে পাণ্ডিত্য, যদি জিজ্ঞেস করতুম কেন এমন দীনহীন হয়ে কোণে পড়ে আছেন, জবাব দিতেন না, মুঠো শুদ্ধ মাথাটা খালি অল্প অল্প নাড়তেন। তার মানে কি আমি বুঝতাম না। একদিন দেখলাম ঘরে অসামান্য সুন্দরী তরুণী স্ত্রী। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা চলছেন না যেন নাচছেন, হাতের কাজ সারছেন মনে হত ভরতনাট্যমের মুদ্রাগুলি অভ্যাস করছেন। একজন যদি সুরে মজালেন তো অন্যজন মজালেন রূপে। কিভাবে এ সমস্যার কী সমাধান করি। নিজের সঙ্গে লড়াই করে করে যখন ক্ষতবিক্ষত তখন ঠিক করলুম আর নয়, অনেক শিখেছি, এবার চুপিচুপি পালাই। কাউকে কিছু জানাইনি। রাতের ট্রেন, সন্তর্পণে নিজের সুটকেসটি হাতে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। দেখি পাশে কয়েকমাসের শিশুসন্তান কোলে কেদারনাথজীর সেই সুন্দরী পত্নী। আকুল হয়ে বললেন— ‘আমায় ফেলে রেখে কোথায় যাও। আমি এই গুদোমঘরে আর থাকতে পারছি না, যদি চলে যাও তো এই বাচ্চাটাকে নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো।’ একে হৃদয় পরিপূর্ণ, টলটল করছে, তার ওপর এমনি কথা। দেখলাম সে গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছে। তার আড়াল থেকে উঁকি মারছে বহুমূল্য গহনা। বললাম—‘গয়নাগুলো খুলে রেখে এসো।’ সে দৃঢ়কণ্ঠে বলল—‘এ সব আমার, একদম আমার নিজস্ব। কেদারজী কিচ্ছু দ্যাননি।’ বললাম ‘তা হোক, আমি তোমাকে যা চাও করিয়ে দেবো, যত গহনা, কিন্তু চোর বনতে পারব না।’ এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সে বাড়ির ভেতর চলে গেল। মিনিট দশেক পরে অলংকারহীন সেই রমণী আর সেই শিশুকে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলুম। রামপুরে আর ফিরে যাওয়া যায় না। সুতরাং সুদূর বরোদায় ভাগ্যান্বেষণে, কয়েক মাস পরেই কলকাতা। সে পাপিষ্ঠা না আমি পাপিষ্ঠ তা-ও তো জানি না। বৃদ্ধ স্বামীর দীনদরিদ্র ঘরদুয়ার যদি সেই অপূর্বকান্তি রমণীর গুদোমঘরের মতো মনে হয়, তাকে কি করে দোষ দেবো? যতগুলি সম্ভব গহনা তাকে গড়িয়ে দিয়েছিলাম। দিবারাত্র অবিশ্রাম পরিশ্রম করতাম সংসারযাত্রার জন্য। কিন্তু এতো চেষ্টা সত্ত্বেও হয়ত আমার ঘরও তার কাছে একদিন ওদোমের মতো লেগেছিল, সে আমার শিষ্য এমদাদের সঙ্গে ঘর ছাড়ল। তবে এবার গহনাগুলি নিয়ে এবং শিশুকন্যাকে ফেলে, তার ওপর সত্যি আমার কোনও জোর নেই। আইনগত দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে। সে আমার স্ত্রী ছিল না, তবু তো স্ত্রী-ই। ভাগ্যিস সে মিতুলকে দিয়ে গিয়েছিল। পাঁচ সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়ে, আহা সে যে কী যন্ত্রণায় মা মা করে কাঁদত। তাকে কোলে করে কত বিনিদ্র রাত শুধু ছাত আর দালান, দালান আর উঠোন, যখনই কোথাও যাই গাইতে কি শুনতে দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ সুন্দর মিতুল আমার সঙ্গে থাকে। মানুষের আশার ঘরটি বারবার ভেঙে পড়ে। বারবার আবার সে ঘরটি প্রাণপণ করে গড়ে। ছোট্ট মিতুলকে নিয়ে আজ অবধি সেই ভাঙা ঘর গড়ে চলেছি। নিজের কণ্ঠে অকালবার্ধক্য আসছে বুঝে এসরাজের ছড়ি তুলে নিলুম। সারেঙ্গি, সেতার, ভাবলাম এ মেয়ে তো এক রাজ-গায়কের মেয়ে, একে গড়ে দিয়ে যাবো। দিয়ে যাবো সবার কাছে যা শিখেছি। সেই হবে আমার একরকমের ঋণশোধ। ক্ষতিপূরণ। কিন্তু মেয়েটা কাঁদে যেন কাক ডাকছে, আপনমনে কথা বলে যেন শালিখে কিচিরমিচির করছে, তবু লেগে আছি। এদিকে শিষ্য-শিষ্যা আসছে, তাদের মধ্যে কেউ-কেউ অপরূপ গলা নিয়ে আসছে। কী সাধনা! সঙ্গীতের জন্য কী ভালোবাসা! কী ত্যাগ! সঙ্গীত ছাড়া জীবনে যেন কিছুই নেই। দিলীপ ছেলেটি কৃতী এঞ্জিনিয়ার। সে তো সেদিকে গেলই না, সরোদ নিয়েই পড়ে রইল। আরেক জন ছিল অপালা। আমার বাবা যদি তাঁর সাত আট বছরের ছেলের গান শুনে আমাকে প্রডিজি ঠাউরে থাকেন, তাহলে আমিও একটা কচি মেয়ের গলায় কর্ণাটকী সঙ্গীতের সূক্ষ্ম কাজ, তার মধুরতা, গানের ওপর প্রয়াসহীন দখল শুনে তাকে প্রডিজিই ভেবেছিলাম। কথা কইছে, তা-ও যেন গান গাইছে, এমন সমৃদ্ধ তার কণ্ঠসম্পদ। তালিম দিলুম, আমার যতদূর সাধ্য, ভাই-বেরাদর ওস্তাদদের কাছে পাঠালুম, আমি যা জানি না, পারি না সে যেন তা অন্যের কাছ থেকে শিখে নিতে পারে! যার কাছে পাঠিয়েছি, সে-ই বলেছে— এ তো অসাধারণ গুণী, এখন এই বয়সেই এই গাইছে, আর একটু পরিণত হলে এ তো পূর্ণিমার আকাশে চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করবে!
সেই অপালা দত্তগুপ্তর নাম আজ কে জানে? সেই সদাবিনয়ী নম্র, অহমিকাশূন্য, নিস্পাপ মেয়েটি কোনদিন গন্ধর্বসভায় তাল ভঙ্গ করেনি, কোনদিন কোনও সাফল্যের গর্বে আত্মহারা হয়নি, আমি জানি সে নিষ্কলঙ্ক চাঁদের মতো। কিন্তু হায়, এ চাঁদ দ্বাদশীর চাঁদ, আজও পূর্ণতা পেলো না। তার এ শাস্তি কেন? কলকাতা রেডিও-স্টেশনের প্রথম শ্রেণীর উচ্চাঙ্গসঙ্গীত গায়িকা? দূরদর্শনে নিয়মিত গাইছে আজকাল? সে তো কতই আছে! কোথায় গেল সেই বিশেষ, যাকে আমি পূর্ণভাবে চিনেছিলাম। আমার সঙ্গীতজীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে! শেখায়ও নাকি প্রাণ দিয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে তার গুণগান শুনি। কিন্তু সেই অপালা, যে যৌবনের হীরাবাঈয়ের সহস্র পাহাড়ি ঝরনার কলতানকণ্ঠ মনে করিয়ে দিত, সে কই! সে কই।
অথচ মিতুল। তার কাকিনীর মতো কণ্ঠস্বর ক্রমে গর্দভের মতো হল। তার রেওয়াজে প্রচুর ফাঁকি ছিল। তবু রেওয়াজ বন্ধ করতে দিতাম না। কিন্তু সেই কণ্ঠ এখন রবাবের মতো হয়েছে। অদ্ভুত আওয়াজ। কেমন ভোঁতা, খসখসে, অথচ কী চার্ম! মিতুল যখন বড় বড় জলসায় গায়, আমার তার পিতা বিস্মৃত, অবহেলিত, প্রতারিত সেই কেদারনাথজীর কথা মনে পড়ে। মাথা নত হয়ে আসে। তাহলে সাধনা কিছু নয়। আন্তরিকতা, সংকল্প, ব্রত, ঈশ্বরদত্ত গুণ এসব কিছুই নয়! সবই সেই আজকাল যে বলে জীন! বংশগতি! সেই!
এমন নয় যে মিতুলের এই সাফল্যে আমি দুঃখিত। মিতুলের রেকর্ড-বিক্রি জলসায় জলসায় তার ডাক, লাইট ক্ল্যাসিক্যাল এবং আধুনিক গানে এমন কি ইংরেজি পপ-সঙ্গীতে তার সমান অধিকার, এবং সর্বোপরি তার সৌন্দর্য তাকে যে ঐশ্বর্য দিয়েছে, আমিও তো সেই ঐশ্বর্যই ভোগ করছি। মাতৃহারা শৈশবের সে স্মৃতি আজও তার কাছে অমলিন। তার বাবা তাকে কিভাবে বাবা এবং মা উভয়ের মতো লালন করেছে, সে ভোলে না। সে যেরকম মায়ের মেয়ে সত্যি বলতে কি তার মধ্যে এতো ভালোবাসা, এতো ভক্তি, এতো বিবেচনা সম্ভব বলেই আমি মনে করিনি। তার মায়ের চরিত্র দিয়ে তার বিচার করার এই চেষ্টা সম্ভবত ভুল। আমার যখন হাঁপের টান ওঠে মিতুল তখন তার কোমল হাত দিয়ে আমার বুক নিচ থেকে ওপর দিকে আস্তে আস্তে মালিশ করে দেয়। অতিরিক্ত অক্সিজেন পাবার রবারের যন্ত্রটি আমার নাকের সামনে ঠায় ধরে থাকে। পর পর তিনদিন কোথায় বারাসতে কার কাছে মাদুলি নিতে গেছে আমার জন্য। সম্পূর্ণ উপোস করে। আমার বড় অবাক লাগে। ভেবেছিলুম নিতান্ত অল্পবয়সে সে সোহম চক্রবর্তী কিংবা দিলীপ সিনহা কিংবা ওইরকম কাউকে কিংবা আরও অনেককে বারবার বিয়ে করবে। ছাড়বে। ত্রিশ পেরিয়ে গেছে, মিতুল এখনও বিয়েই করেনি। তবে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার যা ইচ্ছে করে। অজস্র পুরুষ-ভক্ত, পুরুষ-বন্ধু, এদের সঙ্গে সে কোথায় যায়, কি করে আমার জানা নেই। কিন্তু তার পালক পিতার প্রতি ব্যবহারে কোনও উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। মিতুল সুরকে পেয়েছে, ছন্দকে পেয়েছে, তার মনে কোনও অশান্তি আছে বলেও মনে হয় না। সুখী হোক, সুরাশ্রিত থাক, কিন্তু আমার অন্য সুরকন্যাটির জন্য আমার বড় মন কেমন করে। এই বয়সে তিনটি সন্তান। হয়েছে পরপর। স্বামী বাদে বড়ই বেসুর বাড়ি। স্বামীটিই কি সব দিক থেকে বিবেচক? কি জানি? অপুর মুখে কোনও অভিযোগ শুনিনি। তার মুখ বরাবরের মতো প্রশান্ত। আনন্দ হলে তার গণ্ডে একটা রক্তাভা দেখতাম। এখন গণ্ডদ্বয় সব সময়েই মলিন। ঈশ্বর তোমার এ কেমন বিচার? হে মহাশক্তি, সর্ব সুরের অধিকর্তা, হে সুরপতি, হে গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু এমন নির্মম উপেক্ষার অর্থ কী? আমি না হয় অপরাধ করেছি। প্রথম জীবনে বহু পুরস্কার, বহু খ্যাতি প্রশংসা, মানবশ পেয়েছি। কিন্তু আমার এই নিষ্পাপ সুরকন্যাটির ওপর তোমার এ দণ্ড কেন? ক্ষমা কোরো যদি প্রশ্ন করে অপরাধ করে থাকি। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে মনে হয় এ পিঠ সর্বদাই কোন না কোন অপরাধের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। সব কষ্ট, দুঃখ, শারীরিক, মানসিক, কোনও না কোনও অনিচ্ছাকৃত পাপের ফল। কুসংস্কারে পূর্ণ হয়ে রয়েছে মন। যদিও জানি এসব অবৈজ্ঞানিক, এ সব মিথ্যা, তবু সত্য বলে প্রতিভাত হয়। আজ কোথায় গেলেন আমার সেই সত্যসন্ধপিতা, যাঁর একমাত্র ব্যসন ছিল যাবতীয় কর্তব্যশেষে এসরাজ, সেই ওস্তাদ বদল খাঁ সাহেব যিনি গেলেই রাবড়ি খাওয়াতেন, আমার বন্ধু আমীর খাঁ সাহেব। তাঁরা কত ঋজু, কত নির্ভীক ছিলেন, সুরে অধিকার ছিল, কোনকিছুকেই পরোয়া করতেন না। আজ অকালন্যুব্জ, শ্বাসকষ্টদুষ্ট বৃদ্ধ সুরভ্রষ্ট এই হতশ্রী গন্ধর্বকে তোমরা ক্ষমা করো। তোমাদের অর্জিত পুণ্যের কিছু কিছু অন্তত দাও, আমি সে পুণ্যফল নিজের জন্য রাখবো না। দিয়ে যাবো। না, না, মিতুলকে নয়। আমার অপু মাকে।
সবুজ মলাট বাঁধানো ডায়েরিটা রামেশ্বর বন্ধ করে দিলেন। দুই মলাটের মধ্যে বন্দী হয়ে রইল তাঁর জীবন, তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর প্রার্থনা। তিনি তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে ডায়েরিটা রেখে চাবি ঘুরিয়ে দিলেন।