গান্ধর্বী (Gandharbi) : 13
অপালার অষ্টম বিবাহবার্ষিকীতে শিবনাথ ঘরে ঢুকে বলল—‘কী এনেছি বলো তো?’
—‘কী আবার আনবে?’ অপালা বলল ‘শাড়ি!’
শিবনাথের বউকে শাড়ি দেবার শখ খুব। কিন্তু সে একেবারেই পছন্দ করতে পারে না। অন্তত অপালার একদম পছন্দ হয় না। টিয়া-সবুজ তাতে জরির চেক, গাঢ় মেরুন রঙের ওপর সবুজ-হলুদ পাড়, ভেতরে ওই রঙেরই বুটি। সে গাঢ় রঙের শাড়ি পছন্দ করে না। তার ধারণা সে কালো, কালোকে এসব পরতে নেই। মেরুন শাড়িটা সে দু একবার পরেছে। শিবনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল—‘বাঃ, কী সুন্দর দেখাচ্ছে।’ কিন্তু অপালার যে অভ্যাস নেই! টিয়া রঙ শাড়িটা সে চুপিচুপি এক পারিবারিক নেমন্তন্নে পাচার করে দিয়েছে। ভাগ্যিস, শিবনাথ অত খেয়াল করেনি। এক এক ধরনের পশুপাখি থাকে তারা পরিবেশের সঙ্গে রঙে রূপে একদম মিশিয়ে থাকে, যাতে শিকারী তাদের কোনমতেই খোঁজ না পায়। সবুজ পাতার সঙ্গে মিশিয়ে সবুজ রঙ! বহুরূপী তো ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। অপালাও তার ধূসর-জীবন-পটভূমির সঙ্গে মিশে থাকতে স্বস্তি বোধ করে।
শিবনাথ একটা প্যাকেট বার করল। ক্যাসেট। প্রদ্যোৎ অপালাকে খুব ভালো টেপ-রেকর্ডার পাঠিয়েছে। যাকে বলে টু-ইন-ওয়ান। প্রত্যেক বছর ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটও পাঠায় যথেষ্ট। সেগুলো অপালার খুব কাজে লাগে। কিন্তু এদেশে ক্যাসেট এখনও ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সেভাবে আরম্ভ হয়নি। এ নিশ্চয়ই শিবনাথ তার নিজস্ব কোনও যোগাযোগ ব্যবহার করে আনিয়েছে। ক্যাসেটের প্যাকেটটা খুলল অপালা—ঠুমরি ও গজল। সোহম চক্রবর্তী।
সোহম লখনৌ থেকে বম্বে, তারপর বম্বে থেকে দিল্লি বহু প্রোগ্রাম করে বেড়াল সারা ভারতবর্ষ। ইদানীং সে ইয়োরোপ টুর করছে। আমেরিকা টুর করতে গিয়েই সবচেয়ে নাম হয়েছে তার। সে নাকি আজকাল সুপার স্টার হয়ে গেছে। সংস্কৃতির জগতে ভারতের নিয়মই হল যতদিন না বাইরের দেশের লোকে হই-হই করছে ততদিন দেশে খাতির মিলবে না। সে তুমি রবীন্দ্রনাথই হও আর রবিশঙ্করই হও। এমনকি সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের ওপরেও পি এইচ ডি, ডি লিট স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ কি জামানি টার্মানি থেকে করে আসলে পাত্তা পাওয়া যায়। সোহমের বেলায় সেটা আবার প্রমাণিত হল। অথচ ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের কিছু বোঝে না পশ্চিমের লোকেরা। ওদের কানই অন্যভাবে তৈরি, প্রধানত হার্মনি দিয়ে, সমারসেট মমের মতো লোক যিনি প্লট আর চরিত্রের খোঁজে এতবার প্রাচ্য ঘুরে গেছেন তিনিও প্রাচ্য সঙ্গীতকে ব্রেন-ফিভার-বার্ডের ডাকের একঘেয়েমির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
অপালা ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত। কতদিন পর সে আবার সোহমের গান শুনতে পাবে। নাজনীনের তালিমের গান। সে বলল—‘এখন চাপিও না। আমার হাতে কটা কাজ আছে, সেগুলো সেরে আসছি।’
সে কাজগুলো সেরে এসে ঘরে বসল—তখন ক্যাসেট চলল। সোহম গেয়েছে এককালের বিখ্যাত গায়ক শচীনদাস মতিলালের কণ্ঠের বিখ্যাত ঠুমরি ‘ন মানুঙ্গি ন মানুঙ্গি’, ‘জিয়া নহি মানে… রয়না বীত গই’ একটা মিশ্র ঠুমরি। পিলতে—‘মোরে আলি পিয়াকে দরশকৈসে পাঁউ’ প্রাণভরে গেয়েছে সোহম। তারপর গজল। অনেক। মীরের, গালিবের, তাছাড়াও আরও কারো কারো রচনা। নামগুলোও সোহম গানের আগে বলে দিচ্ছে ভরাট গলায়। সবচেয়ে ভালো লাগল অপালার ‘ম্যঁয় আফতাব তু শবনম/ ম্যঁয় আন্ধেরা তু চাঁদনী।’ রোম্যান্টিক আর্তির চরম গজলটির পরতে পরতে। কিন্তু এটাও লক্ষ্যের বিষয় সোহম ঠুমরির অঙ্গ মিশিয়ে অনেক সময়ে বেশ বড় বড় বোল তান মিশিয়ে এক নতুন ধরনের গজল তৈরি করেছে। কিন্তু সোহমের গলা কী অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে! এত মসৃণ, ভাবালু, তার গানের পৌরুষ এখনও বজায় আছে ঠিকই, কিন্তু কৃষ্ণ-কানহাইয়ার বাঁশির সুরের মধ্যে যে পৌরুষ কল্পনা করা যায় এ সেই ধরনের ললিত পেলব পৌরুষ। রাজরাজেশ্বরের দাপট নয়, বিরহীর আর্তি।
শিবনাথ বলল—অনেকটা পালুস্কর টাইপের ছিল না ওর গলাটা? অপালা বলল—‘যাঃ, পাঙ্কর আমরা যতটুকু রেকর্ডে শুনেছি, একটু চাপা, কোমল, রিচ ভয়েস, কিন্তু কেমন একটা চাপাভাব ছিল। আর সোহমের গলাটা ছিল দরাজ, অতটা কোমলতা ছিল না! আর এখন এতো মডুলেশন! এতো ভ্যারাইটি! নাজনীনের হাতের তৈরি!’ বলতে বলতে অপালা জোড় হাত কপালে ঠেকালো। বিদ্যুচ্চমকের মতো একবার মনে পড়ল সেই অসম্ভব আশা! কোথায় সোহম, কৃতী সম্পন্ন পরিবারের অতি আদরের দুলাল, মুখ থেকে কথা খসার আগেই যার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়ে যায়, আর কোথায় সে! বিধবা মায়ের মেয়ে, স্যাঁতসেঁতে নোনাধরা দেয়াল। পড়ুয়া দাদা, যুদ্ধেরত, রাজ্যের পুরনো শতাব্দীর ভাবনা-চিন্তা-ফেলে-দেওয়া আদর্শ ভর্তি মগজঅলা জেঠামশাই। আহা তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তিনি অপালার ক্ষতি করতে চাননি। তাঁর সাধ্য এবং ধারণা অনুযায়ী যা তার পক্ষে সবচেয়ে ভালো মনে করেছিলেন তা-ই করেছিলেন। স্বপ্ন, স্বপ্ন, ওসব সাধ-ইচ্ছা তার মতো মেয়ের পক্ষে একেবারেই ছেঁড়া-কাঁথায় শুয়ে রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখার শামিল। তবু, তবু যে কিছুই ভালো লাগে না। এই ঘর-দুয়ার, এই সামাজিকতা, এই ভালোবাসা, কিছু না, কিছু না। গানের ভেতর দিয়ে সে যখন ভুবনটা দেখে তখন তাকে চিনতে পারে, নইলে সব কেন এমন বেসুরো, বেতালা, কর্কশ! নাই রস নাই! দারুণ দাহন বেলা!
হঠাৎ অপালা বলল—‘একটা জিনিস চাইব, দেবে?’
শিবনাথ বলল—‘সাধ্যের মধ্যে থাকলে, নিশ্চয়ই!’
অপালা বলল—তোমাদের নীচের ঘরটা তো পড়েই থাকে। বসবার ঘর করে রেখেছে কিন্তু যে-ই আসে তাকে তো ওপরে নিয়ে আসো। একেবারে বাইরের লোক তেমন আসেও না।’
শিবনাথ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অপালা বলল ‘ওই ঘরটা আমার গানের ঘর করে দেবে? কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রীও শেখাবো। ভোরের রেওয়াজ কি জিনিস আমি যেন ভুলেই গেছি।’
শিবনাথ বলল—‘মুশকিল করলে। তোমার আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু বাড়িটা তো আমার নয়। বাবার। তাঁকে না বলে কিছু করা যাবে না।’
অপালার মুখ নিভে যাচ্ছে দেখল শিবনাথ। সে যেন এই শেষ কুটোটিকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল। কুটোটা হাত থেকে ফস্কে গেছে। এখন সে ডুবছে। সে হঠাৎ বলল ‘এক কাজ করো না অপু, তুমি নিজেই বলো না।’
—‘বলব?’
—‘বলো, বলেই দ্যাখো না।’
সেদিন রাত্রে শ্বশুরের খাওয়া-দাওয়ার পরে অপালা বলল কথাটা। সে আজ নিজের হাতে বিশেষ এক রকম ছানার তরকারি করেছে। মাঝে মাঝেই করে, করতে হয়। কিন্তু তার মধ্যে তার তেমন মনোযোগ থাকে না। কিন্তু আজকেরটা করেছে যেন প্রাণপণে কোনও নতুন বন্দেশের স্বরলিপি শুনে শুনে লেখবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অপালার কথা শুনে শ্বশুর বললেন—‘তা অবশ্য তুমি চাইতে পারো মা। সত্যিই রেগুলার রেডিওতে গাইছো, তোমার একটা প্র্যাকটিসের দরকার আছে বইকি! ঠিক আছে ঘরটা তুমি ব্যবহার করো। তবে ওটা গোটা পরিবারের বৈঠকখানাও থাকবে। তেমন কেউ এলে…’
—‘নিশ্চয়ই। সে তো নিশ্চয়ই।’ আনন্দের আতিশয্যে অপালার মুখ দিয়ে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বেরোল না।
মহানন্দে খবরটা শিবনাথকে দিল অপালা। মাস দুয়েকের মধ্যে ঘর রঙ হয়ে, তাতে নতুন কার্পেট বিছিসে, চারদিকে ছোট ছোট নিচু নিচু আসন, হারমোনিয়ামের বাক্স, তানপুরার ঝুলি সব নামিয়ে আনা হল। বিয়ের আট বছর পরে এই প্রথম অপালা একখানা নিজস্ব ঘর পেল, যেখানে সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইচ্ছেমতো রেওয়াজ করতে পারে। সঙ্গত করতে বেণু নিয়মিত আসে। এবং আসে ছাত্র-ছাত্রীর দল। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক এখন ঘরে ঘরে পাঠ-ক্রমের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী এতো আসে যে অপালা নিতে পারে না। দুটো ব্যাচের বেশি সে কিছুতেই করবে না। তার নিজের গান হবে কি করে? শম্পা মিত্র বলে যে নামকরা সেতারী এবং বীণাবাদিনী তাদের পাড়ায় থাকেন, তাঁর কাছেও অপালা মাঝেমাঝেই যায়। দীর খাঁ। পরে রবিশঙ্কর, বিলায়েত এঁদের কাছে শিক্ষা ওঁর। যদি কিছু পায়। শম্পা বলেন ‘এতো চমৎকার গলা, এতো অপূর্ব গাস, এর মধ্যে বিয়ে করে মরেছিস কেন?’ অপালা চুপ করে হাসে। শম্পা ডিবে থেকে কিমাম দেওয়া জোড়া পান মুখে দিয়ে বলেন—‘এই দ্যাখ না, বিয়ে-থা করিনি, রাজ্যের লোকে বিরক্ত করে, নিজের ইচ্ছেমতে ওস্তাদদের কাছে শিখেছি, তবু মনে হয় কিছু হল না, কিছু হল না। আর তুই? কোনও সুযোগ, তেমন কোনও উচ্চশিক্ষা না পেয়েও এখনই রেডিওর এক্লাস আর্টিস্ট। কিন্তু এর পর? কোথায় দাঁড়াবি? বদ্ধ জলা হয়ে যাবি যে রে! আবার ছাত্রী-ঠেঙাতে শুরু করেছিস শুনছি? অপালা তার নিয়মিত রোজগারের একটা অংশ প্রতিমাসে শাশুড়ির হাতে তুলে দেয়। তিনি হাত পেতে নিতে নিতে বলেন—‘তুমি আমায় বাঁচালে বড় বউমা, আমরা না-ই বা ঘরের বাইরে বেরুলাম। আমাদেরও যে নিজেদের হাতে খরচ করার সাধ-আহ্লাদ থাকতে পারে কেউ বোঝে না। না কর্তা, না ছেলেরা।’