গলিত সুখ
আমি এখন করব কী তুই বল।
কথাটা দ্বিতীয় বার সে বলল, পূর্ণিমা মুখ নীচু করে ফুটন্ত দুধে হাত নেড়ে যাচ্ছে মন দিয়ে। জবাব না দিয়ে শুধু জ্ব কোঁচকাল। এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে সে জ্যোতির দাম্পত্য বিপর্যয়ের কথা শুনে যাচ্ছিল।
তুই আমার শোবার ঘরে গিয়ে একটুখানি বস আমি এই দুধটা…ছেলে পায়েস খেতে চেয়েছে, এই হয়ে এল।
তুই বোধ হয় বিরক্ত হচ্ছিস। ফোনে অবিরত ঘ্যানঘ্যান করি, আবার বাড়িতে এসেও সেই একই কথা বলে জ্বালাচ্ছি। কিন্তু তুই ছাড়া আর আমার কে আছে যাকে এসব কথা বলতে পারি! বল কাকে বলব, কাকে শোনাব, কাকে এভাবে জ্বালাতন করব? জ্যোতির স্বর অনুপ্তের মতো, কান্নাভেজা এবং গভীর দুঃখ ও অসহায়তা প্রসূত।
হয়েছে তোকে আর ফরম্যাল হতে হবে না। একশো বার জ্বালাতন করবি। পূর্ণিমা হালকা ধমক দিল। যা ঘরে যা।
ওরা স্কুলজীবন থেকেই বন্ধু। প্রায় বাইশ বছরের বন্ধুত্ব। একসঙ্গে কলেজেও পড়েছে। বুদ্ধি বিবেচনায় পূর্ণিমার থেকে জ্যোতি কিছুটা দুর্বল। এটা সে জানে বলেই পূর্ণিমার যুক্তি পরামর্শ মেনে সে চলে। শুধু এক বার ছাড়া সে আর কোনো ব্যাপারে পূর্ণিমার কথা অগ্রাহ্য করেনি এবং সেই ব্যাপারটাতেই সে ঠকে গেছে। প্রসাদকে বিয়ে করেছিল পূর্ণিমার বারণ সত্ত্বেও।
ওরা দুজনই একসঙ্গে গান শিখতে যায় সঙ্গীতা নামে এক গানবাজনা শেখাবার স্কুলে। সেখানে আধুনিক গান শেখাত প্রসাদ ঘোষ। তখন সে জনপ্রিয়তার প্রথম ধাপে, এখনকার শীর্ষস্থানীয়দের একজন হিসেবে গণ্য হত না। চারখানি রেকর্ড বেরিয়েছে, একটি ফিলমে একখানি মাত্র গান গেয়েছে এবং সেটি হিট করেছে। প্রসাদ গৌরবর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট, হ্রস্বাকৃতি, দেখতে পুরুষালি নয়, নারীসুলভ কোমল লাবণ্য তার মুখে এবং দেহের গড়নেও। কথায় ও ব্যবহারে বিনীত, মৃদুভাষী। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় দৃষ্টি বেশিক্ষণ মুখে নিবদ্ধ রাখতে পারে না।
জ্যোতি একটা গানের অনুষ্ঠানে প্রসাদকে দেখে এবং দেখামাত্র ভালো লেগে যায়। গান তো আগেই ভালো লেগেছিল। খোঁজ করে জানল প্রসাদ গান শেখায় সঙ্গীতায়। বাড়ি থেকে হেঁটে দশ মিনিট, পূর্ণিমার সঙ্গে গিয়ে সে ভরতি হল আধুনিক গানের ক্লাসে। জ্যোতির গানের গলা ভালো তবে প্রথাবদ্ধভাবে শেখেনি। রেকর্ড বা রেডিয়ো থেকে শুনে গলায় তুলে নিত। জ্যোতিকে দেখতেও ভালো। হালকা তসরের মতো ত্বক, চোখা নাক, পানের মতো আকৃতির মুখ এবং সুঠাম দেহ। প্রথমদিন ক্লাস করেই সে মুগ্ধ হল এবং প্রসাদকে আরাধ্য করল।
যেসব ফাংশনে প্রসাদ গান গাইতে যেত জ্যোতি টিকিট কেটে সেখানে গিয়ে বাইরে এমনভাবে অপেক্ষা করত যাতে গাড়ি থেকে নেমেই প্রসাদ তাকে দেখতে পায়।
একবার প্রসাদ তাকে দেখতে পেল। কী ব্যাপার? জ্যোতি লাজুক স্বরে বলল, আপনার গান শুনব বলে এসেছি।
প্রসাদ বলল, আমার গান না মান্নাদার গান?
জ্যোতি ব্যস্ত হয়ে প্রতিবাদ করেছিল, না না শুধু আপনার গানই। দেখবেন আপনার গান শেষ হলেই হল থেকে বেরিয়ে যাব, আর কারুর শুনব না। কিছু লোক প্রসাদকে ঘিরে তখন দাঁড়িয়ে। তারা হেসে উঠল। লজ্জায় রাঙা হয়ে প্রসাদ বলে, চলো, ভেতরে চলো।
জ্যোতি মাথা নেড়ে বলে, টিকিট কেটেছি অডিয়েন্সের মধ্যে বসে আপনার গান শুনব বলে। ওদের রিঅ্যাকশনও আমার ভালো লাগে।
প্রসাদ গান গেয়ে বেরিয়ে এসে দেখে জ্যোতি দাঁড়িয়ে। তাকে মোটরে বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় প্রসাদ বলেছিল, তোমার গলা তো ভালো, ফাংশনে গাইতে চাও যদি তাহলে একদিন নয়, রোজ বসতে হবে, এটা সাধনার ব্যাপার।
কুষ্ঠিতভাবে জ্যোতি বলে, একা একা রেওয়াজ করতে ভয় করে, ভুলভাল হলে শুধরে দেবে কে?
প্রসাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, সকালে আমি বাড়িতে আলাদা করে শেখাই।
তার কথা শেষ হওয়া মাত্র জ্যোতি বলেছিল, জানি। আমাকে শেখাবেন? ঘাড় নেড়েছিল প্রসাদ।
ব্যাপারটা পূর্ণিমাকে জানিয়েছিল। শুনে সে বলেছিল, একা এক জনকেই শেখায় না আরও অনেকে থাকে?
জ্যোতি চোখ সরু করে তীব্র স্বরে বলে, তোর সন্দেহ করার একটা বাতিক আছে। যদি একা শুধু আমাকেই শেখায় তাতে হয়েছে কী? পূর্ণিমা শান্ত স্বরে বলেছিল, কিছুই হবে না। পরে কপাল চাপড়াবি!
এরপর ওদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি। তবে প্রসাদ এবং গান নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে সে আর কথা বলত না। একদিন পূর্ণিমা বলল, সালকেয় সেজদিদের পাড়ার ফাংশনে তুই গান গেয়েছিস? কই আমাকে তো বলিসনি? জ্যোতি অপ্রতিভ হয়ে বলে, প্রসাদদার কান্ড। ভয়ে তোকে বলিনি, কী জানি বাবা প্যাঁক দিয়ে যদি তুলে দেয়! চেনাশোনা বন্ধুবান্ধবদের সামনে হলে লজ্জাটা বেশি করবে বলে তোকে আর বলিনি। এবার কোথাও গেলে তোকে বলব, যাবি তো? প্রশ্নটা এড়িয়ে পূর্ণিমা বলেছিল, প্রসাদ ঘোষ তাহলে তোকে চান্স করিয়ে দিচ্ছে? জ্যোতি অবাক হয়ে বলে, বাঃ, আমার নিজের কি কোনো নামডাক আছে নাকি যে যেচে ফাংশনে ডাকবে!
জ্যোতি কলকাতার মধ্যে এবং কাছাকাছি অনেক জায়গায় প্রসাদের সঙ্গে গিয়ে গান করেছে কিন্তু পূর্ণিমাকে এক বারও বলেনি। কিন্তু পূর্ণিমার কানে খবর ঠিকই এসেছে। সে আবার একদিন বলল, আমার কাছে লুকোচ্ছিস কেন, আমি তো সবসময় তোর ভাললাটাই চাই। তুই প্রসাদ ঘোষের সঙ্গে এখানে-ওখানে গেয়ে বেড়াচ্ছিস, তোর নামটাম হলে আমার তো আনন্দই হবে। কিন্তু আমাকে কিছু আর কেন বলিস না.প্রেম করছিস? জ্যোতি উদ্ধত ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছিল, আমি! ওর সঙ্গে প্রেম আমি করছি না প্রসাদ করছে আমার সঙ্গে। পূর্ণিমার বিস্ফারিত চোখ দুটি তখন জ্যোতিকে গর্ব এবং অহংকারের চোরাবালির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কথাটা বলে সে যে তৃপ্তি পেয়েছে সেটা আরও গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জ্যোতি তারপর বলেছিল, আমার শরীরে কটা তিল আছে আমি জানতুম না, প্রসাদ গুনে বলে দিয়েছে। মর্মাহত পূর্ণিমা বিড়বিড় করে বলেছিল, এটা বাড়াবাড়ি। এতটা ভালো নয়, তোকে কপাল চাপড়াতে হবে। জ্যোতি একগাল হেসে জবাব দেয়, তাহলে তোর কাছে এসেই চাপড়াব।
এর দশ বছর পর পূর্ণিমার নতুন বাড়িতে একদিন দুপুরে হাজির হয়ে জ্যোতি বলে, তোর কথাই সত্যি হল পুনি, আমি কপাল চাপড়াতেই এসেছি রে।
জ্যোতির বিয়ে হয়েছিল রেজেষ্ট্রি করে। সাক্ষী হবার জন্য সে পূর্ণিমাকে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু সে রাজি হয়নি। বরং জিজ্ঞাসা করেছিল, লোকটাকে ভালো করে চিনেছিস, বুঝেছিস তো? জ্যোতি বলেছিল চেনা বোঝার কী আছে, ওসব হবে বিয়ের পর। একসঙ্গে বসবাস না করলে কি চেনা বোঝা হয়?
সেই কথা তুলে জ্যোতি দশ বছর পর বলেছিল, আমি বরাবরই বোকা রে। তোর কথা আমার শোনা উচিত ছিল। তখন পাগলের মতো হয়ে গেছলাম। ওর গান, ওর খ্যাতি, ওর চেহারা সব আমি দখল করব, সব আমার তাঁবে থাকবে, লোকেরা এসে আমায় খোশামোদ করবে, এইসব ভেবে মাথা ঘুরে গেছল। এখন ও অন্যরকম হয়ে গেছে। দু-হাতে টাকা কামায়, বম্বেতে প্লেব্যাক করতে তো যাচ্ছেই, ইংল্যাণ্ড আমেরিকা কানাডাও ঘুরে এল। আমিও ওর সঙ্গে গেছি।
তাহলে তো সুখেই আছিস!
না।
তাহলে…আর তোকে ভালোবাসে না?
না।
অন্য আর কেউ?
হ্যাঁ। ওর এক ছাত্রী। ইতস্তত করে জ্যোতি বলেছিল, ওর সঙ্গে সঙ্গেই সব জায়গায় যায়, বম্বেতেও গেছল।
কেন, প্রসাদ ঘোষের ক-টা তিল আছে গোনার জন্য?
জ্যোতি ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল। বিদ্রুপটা হঠাৎই মুখ থেকে বেরিয়ে আসার অনুতপ্ত পূর্ণিমা সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিকে বুকে টেনে নিয়েছিল। ফুঁপিয়ে উঠে জ্যোতি বলে এখন আমি কী করব রে পুনি? আমি তো বউয়ের যা-যা করার সবই করি, তবে এমন কেন হল? ও বলল, গান করা ছাড়ো তোমার দ্বারা হবে না। আমি গান ছেড়েদিলুম। বলল মন দিয়ে ছেলে–মেয়েদের মানুষ করো। তাই করছি, এখন এইটেই আমার কাজ। কিন্তু..।
কিন্তু আবার কী, তোকে কি ডিভোর্স করবে বলেছে?
না। কিন্তু করলেই মনে হচ্ছে বেঁচে যাই।
পূর্ণিমা উঠে গেল চা করার জন্য। জ্যোতি একা বসে ঘরের সর্বত্র চোখ বোলাল। মেঝেয়, বিছানায়, দেয়ালে, সিলিঙে যেখানেই দৃষ্টি রাখল কেমন যেন একটা শক্তির আর নিরাপত্তার, যত্নের আর মমতার বাঁধন নড়েচড়ে উঠল। পূর্ণিমার স্বামী জনপ্রিয় নামকরা কেউ নয়। খুব বেশি লেখাপড়া করেনি। কিন্তু মনের সুখ আছে এই সংসারে। বিষগ্ন বোধ করে সে রাস্তার দিকে বারান্দায় বেরিয়ে আসে।
পূর্ণিমার বাড়িটার বয়স ছয় মাসও নয়। তার স্বামী কাঠের ব্যবসায়ী। জ্যোতির এক বছর পর বিয়ে হয়ে পূর্ণিমা অসমে স্বামীর সঙ্গে চলে যায়। দুজনের মধ্যে যোগাযোগটা পত্র মারফত ক্ষীণভাবে ছিল। দশ বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে পূর্ণিমাই টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে নম্বর বার করে ফোন করেছিল জ্যোতিকে।
কলকাতার উপকণ্ঠে ইস্টার্ন বাইপাসের কাছাকাছি সদ্য গড়ে-ওঠা এই বসতিটায় বাড়ির সংখ্যা বেশি নয়। কিছু বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। বহু প্লটেই শুধু ঝোপজঙ্গল, রাস্তার উপর দিকে পুরোনো বসত অঞ্চল। পল্লিগ্রামের মতো দুটো কলোনি আর প্রচুর ঝুপড়ি নিয়ে একটা
পাকা রাস্তা ভিতর দিকে গেছে। সেখানে ইন্দ্রনগর নামে একটি ক্ষুদ্র উপনিবেশ। প্রধান রাস্তাটি থেকে মাছের শিরদাঁড়ার কাঁটার মতো দু-ধারে সরু সরু রাস্তা বেরিয়ে গেছে। নানান আকারের ও গড়নের বাড়িগুলোর প্রায় সবই একতলা। কিন্তু ইন্দ্রনগরের বাসিন্দাদের শিক্ষা, রুচি, পেশা এবং আর্থিক সঙ্গতি এক স্তরের নয়। মোটর গাড়ি, স্কুটার ও সাইকেলের সহাবস্থান এখানে মামুলি দৃশ্য, চোখে পড়ার মতো নয়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে জ্যোতি ইন্দ্রনগরের প্রবেশ রাস্তার দিকে আনমনা তাকিয়েছিল। সেখানে রাস্তার মোড়ে চাক বেঁধে রয়েছে ছছাটো-বড়ো কিছু দোকান আর আরোহীর অপেক্ষায় গুটিকয় সাইকেল রিকশা। চায়ের কাপ হাতে পূর্ণিমা বারান্দায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। জ্যোতিকে পিছন থেকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে সে বলল, অত ভাবছিস কেন, ভগবান আছেন তিনিই তোকে দেখবেন।
হ্যাঁ, এখন ভগবানই আমার ভরসা, আর তুই। আমার দিন রাত যে কী করে কাটে তোকে বোঝাতে পারব না। জ্যোতি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বিষাদমাখা চোখে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণিমার মনে হল, তাদের এতকালের বন্ধুত্ব, যা মাঝের দশটা বছরে ঝাপসা হয়ে গেছিল, আবার যেন তা ঝলমলিয়ে ফিরে আসছে। জ্যোতির চোখ দুটো কোটরে ঢুকে নাকটা আরও খাড়া দেখাচ্ছে। চোখের কোলের ছোপটা ঢাকতে কিছু-একটা মেখেছিল যার রং এখন ফিকে হয়ে গেছে, হাতের গড়নে সেই নরম ভাবটা আর নেই। দুটো কাঁধ আড়ষ্ট লাগছে। চল্লিশে পৌঁছোতে এখনও অনেকটা বাকি, বুড়ি বুড়ি দেখাচ্ছে না ঠিকই তবে তারুণ্যের কোনো প্রমাণ চলাফেরা, চাহনি বা স্বরে আর নেই। পূর্ণিমার কষ্ট হল। কিন্তু বন্ধুর দুঃখ কী করে যে লাঘব করবে তার হদিস সে খুঁজে পাচ্ছে না!
ওর নাম কী? কতদিনের ছাত্রী? দেখেছিস ওকে?
ছায়া চ্যাটার্জি। হ্যাঁ দেখেছি। কতদিনের তা বলতে পারব না, তবে আমার বিয়ের আগে থেকে নয়। সবথেকে আমার অবাক লাগে কেন জানিস, মেয়েটাকে কুচ্ছিত দেখতে। দাঁত বার করা চ্যাপটা গোল মুখ, কয়লার মতো রং, রুগ্ন, এইটুকু খোঁপা, মোটেই মিষ্টি নয়। চলনসই গলা, দেখলে ঝি ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। প্রসাদের টেস্ট যে এত নীচু হবে তা আমি কল্পনা করতে পারি না।
তুই এই নিয়ে আর ভাবিসনি। দু-দিন পরেই দেখবি প্রসাদের নেশা ছুটে গেছে।
এত বছরেও যা ছুটল না আর তুই বলছিস কিনা দু-দিনেই সেটা হয়ে যাবে! জ্যোতি অবিশ্বাসভরে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা তুই ঠিক করতে পারছিস না। পুরোপুরি ভগবানের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। রাক্ষুসিটা ক্যান্সারট্যান্সার বা অন্য কিছুতে যদি মরে যায় তবেই আমি শান্তি পাব। ঠাণ্ডা চা একচুমুকে শেষ করে জ্যোতি বলল, এবার আমি যাব। বড়োছেলের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়েছে। এখান থেকে ভবানীপুর কম দূর তো নয়!
ছোট্ট দুধসাদা রঙের মরিস মাইনরের দরজা খুলে জ্যোতি ড্রাইভারের পাশে বসল। পূর্ণিমা ঝুঁকে বলল, এত নামকরা লোকের এইটুকু গাড়ি কী রে! প্রসাদকে বড়ো একটা কিনতে বল।
এটা তো ছ-বছর আগে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনেছিল। এখন একটা কন্টেসা হয়েছে। মন কি শরাবি সুপার হিট করল তো প্রসাদেরই গানের জন্য, প্রসিউসার গাড়িটা দিয়েছে। কিন্তু ওর ফেভারিট এই খোকা গাড়িটা। এটা নাকি ওর খুব পয়া তাই রেখে দিয়েছে, নিজেই চালায়।
এবার যখন আসবি কন্টেসায় চড়ে আসবি। পাড়ায় আমার খাতির বাড়বে।
তোর এখানে আবার পাড়া কোথায়, কেমন ফাঁকা ফাঁকা।
আছে, ইন্দ্রনগরের লোকেরা তো এখান দিয়েই যাতায়াত করে। পূর্ণিমার সঙ্গে জ্যোতিও হেসে ওঠে।
গাড়ি রওনা করার জন্য ড্রাইভার যখন গিয়ার দিয়েছে জ্যোতি মুখ বার করে চাপা গলায় তখন বলে, আমি কিন্তু ভগবান নয় তোর ভরসায় রইলুম। কী করব বলে দিস।
গাড়িটা ছেড়ে দেবার পর পূর্ণিমা মাথা হেলিয়ে বলেছিল, বলব। কিন্তু বলা আর হয়নি। গত দু-বছরে জ্যোতি মাঝে মাঝে এসেছে। প্রায়ই ফোন করে একই কথা বলেছে; কখনো কাতর অসহায় স্বরে, কখনো রাগী তিক্ত কণ্ঠে। পূর্ণিমা প্রতিবারই ফোন রাখার আগে বলে, ধৈর্য হারাসনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবান আছেন।
অবশেষে একদিন জ্যোতি এসে বলল, আমি এখন করব কী তুই বল।
পূর্ণিমা প্রায় চমকে উঠেছিল ওর মুখটা দেখে। গাল দুটো বসা, দুই হনুর হাড় উঁচু, চোখের কোটর আগের থেকে গভীর, চামড়া খসখসে, কালচে ছোপ পড়া, চোখের নীচের কালিতে আর একটা পরত, ঠোঁট দুটি ফ্যাকাশে, চুল পাতলা নারকোল ছোবড়ার মতো প্রায়। প্রথম দৃষ্টিতেই তাই মনে হয়েছিল সে একটা মড়ার মুখ দেখল। ভুল ভাঙল চোখ দুটি দেখে। বহুদিন খেতে না পাওয়া মানুষের সামনে থালায় ভাত ধরে দিলে তার যেমন চাউনি হবে সেইরকম।
উনুনে দুধ চাপিয়ে এসেছি। এই বলে পূর্ণিমা দ্রুত রান্নাঘরে চলে আসে। তার পিছু নেয় জ্যোতি।
আমি আর ঘুমোতে পারি না পুনি। চোখ বন্ধ করলেই ওই মাগিটার মুখ ভেসে ওঠে। এ যে কী দুঃসহ কষ্ট তোকে বোঝাতে পারব না। কিছু-একটা কর, না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি আমি মরে যাব? টস টস জল ঝরল জ্যোতির গালে।
প্রশস্ত রান্নাঘরের কোণে সিমেন্টের আল দেওয়া ছোট্ট জায়গাটায় বসে বাসন মাজছে ঠিকে-ঝি জোনাকি। বিবাহিতা, রুগণা, মুখটিতে পরিশ্রমের ও দারিদ্রের ঝামেলা থাকলেও শ্ৰী আছে।
জনু তাড়াতাড়ি ডেকচিটা মেজে দাও।
জনুর অবাক হয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থাকাটা প্রত্যাহত হল। পূর্ণিমা চায় না বাইরের কেউ তার বন্ধুর লজ্জার ও দুঃখের কথা জানুক।
জ্যোতিকে শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে সে জনুর অবশ্যম্ভাবী কেতুহলী প্রশ্নগুলোর গোড়া কেটে দেবার জন্য নিজের থেকেই বলল, আমার ছেলেবেলার বন্ধু, দুই বোনের মতো ছিলুম। বিপদে আপদে ও ছুটে আসত, এখনও আসে। আমিও যাই।
কী বিপদ বউদি, উনি কাঁদছেন যে?
স্বামীর সঙ্গে খটাখটি, যা হয়ে থাকে।
জনু নিজের কাজে মন দিল এবং পূর্ণিমাও। কিছুক্ষণ পর জনু আপনমনে বলার মতো স্বরে বলল, স্বামীর সঙ্গে খটাখটি থেকে শেষকালে কী কান্ডই যে হয়ে যায়। আমার ছোটোননদ মলি, পাশের কলোনির গৌতমের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফিরে এল। সবার আপত্তি ছিল বিয়েতে, গলা নামিয়ে জনু ফিসফিস করে বলল, ছেলেটা মাডার করে। দু-বার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছল বাড়ি থেকে, জেলও খেটেছে।
তা খটাখটি থেকে কী কান্ড হল? পূর্ণিমা দুধে চাল ঢালার আগে এক বার তাকাল জনুর দিকে। হাতের কাজ বন্ধ করল জনু।
গৌতম সন্দেহ করত মলিকে, চরিত্রটা তো খুব ভালো নয়। বউদি ওকে তুমি দেখনি, হিন্দি সিনেমার রেখাকে দেখেছ তো, ঠিক ওইরকম দেখতে। গৌতমের আগে আরও অনেকের সঙ্গে মিশেছে। বিয়ের পরও একজনের সঙ্গে ভাব শুরু করেছিল। এই নিয়েই দুজনের খটাখটি হত, মারধরও চলত। শেষে কী হল জান? জনু নাটকীয়ভাবে কথা বন্ধ করল। পূর্ণিমা কৌতূহলভরে ঘুরে দাঁড়াল।
ছেলেটাকে একদিন লোডশেডিংয়ের সময় অন্ধকারে ধরে এই তোমার বাড়ির সামনেই, তখনও তোমরা এখানে আসনি, রাস্তার ওপর মাথায় অ্যাসিড ঢেলে দিল।
ই-ই-ই মাগো! পূর্ণিমা শিউরে উঠল। কী মানুষ গো, একটা লোকের মাথায়…!
তাহলে আর বললুম কী, মাডার করে। এই যে কসবায় ট্যাক্সিওলাটা খুন হল, ও তো গৌতমের কাজ। ইলেকশনে ইন্দর নগরে পিস্তল চালাল তো ওই টাকা দিলে ও মানুষ খুন। করে দেবে।
তা মলি এখন কী করছে? সেই ছেলেটা মরে গেছে না বেঁচে আছে?
বেঁচে আছে। ওকে তো গৌতম মারতে চায়নি। মাস দুই পরে মলিকে নিয়ে গেছল ছেলেটার বাড়িতে। বাইরে থেকে ডাকতেই ছেলেটা বেরিয়ে আসে। ওকে দেখেই মলির ভিরমি লেগে মাথা ঘুরে যায়। বাড়ি এসে বমি করে, একহপ্তা ভালো করে খেতে পারেনি।
কেন? পূর্ণিমা হঠাৎ আগ্রহ বোধ করল মলির এইরকম প্রতিক্রিয়ার কারণ জানতে।
অ্যাসিডে মুখের আধখানা গলে গিয়ে কী ভয়ংকর যে…। জনু চোখ বন্ধ করে ফেলল।
পূর্ণিমা চাপা স্বরে বলল, তুমি দেখেছ?
না বাবা, আমার আর দেখে কাজ নেই। মলির কাছেই শুনেছি একদিকের গাল কান আর চোখ প্রায় নেইই, কেউ যেন চেঁচে কামিয়ে দিয়েছে। নাকে শুধু দুটো ফুটো। লাল দগদগে..
থাক থাক আর বলতে হবে না।
পূর্ণিমা শোবার ঘরে এসে দেখল জ্যোতি বুকে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে।
ঘুমোচ্ছিলিস?
ঘুম আমার হয় না। জ্যোতি উঠে বসল।
ওনাকেও ইদানীং এই রোগ ধরেছে। পূর্ণিমা ড্রেসিং টেবলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোটো অ্যালুমিনিয়াম কৌটো বার করে জ্যোতিকে দেখিয়ে ড্রয়ারে রেখে বলল, খেতে হয়। অসম থেকে ট্রাক আসছিল, মালদার কোথায় অ্যাকসিডেন্ট করেছে তাই কাল দৌড়েছে। ফিরে এসেই ক-দিন নির্ঘাত খেতে হবে।
জ্যোতি চোখ বন্ধ করে বসে রইল। কথা বলছে না। দাঁতে দাঁত চাপার জন্য চোয়ালের হাড় এক বার প্রকট হল। রগের কাছে শিরা ফুলে দপ দপ করছে। ঢোঁক গিলল।
গরম পায়েস খাবি? লক্ষ করতে করতে পূর্ণিমা বলল।
দে।
পূর্ণিমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই জ্যোতি চোখ খুলে ড্রয়ারের দিকে তাকাল।
সেদিনই রাত এগারোটা নাগাদ পূর্ণিমা জ্যোতিকে ফোন করল বিপন্ন কণ্ঠে; স্লিপিং পিলের কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছি না রে, ওর দরকার, না খেলে ঘুমোতে পারবে না, তুই কি…
হ্যাঁ।
পূর্ণিমার কানের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ঢুকে তাকে কয়েক সেকেণ্ড অসাড় করে রাখল। তারপরই চিৎকার করে উঠল, না জ্যোতি না, এমন কাজ করিসনি, জ্যোতি করিসনি, জ্যোতি ভুল করিসনি। আমি তোর সুখের ব্যবস্থা করব জ্যোতি, কথা দিচ্ছি তোকে…
পুনি এগারোটা ছিল, এইমাত্র সব ক-টাই খেয়েছি।
হাউহাউ করে কেঁদে উঠল পূর্ণিমা। তার স্বামী সুরেন ছুটে এল।
পুনি, হ্যালো হ্যালো। …প্রসাদ তো বিয়ে করবে আবার, তুই আমার বাবু, বান্টা আর মণিকে তোর কাছে নিয়ে যাবি এই আমার শেষ চাওয়া তোর কাছে।
জ্যোতি এ তুই কী করলি? মাউথপিসে ঠোট ঠেকিয়ে পূর্ণিমা কান্না-জড়ানো গলায় বলল। আমি তোর ব্যবস্থা করব, তোকে কথা দিচ্ছি। তুই ফোন কর ডাক্তারকে, বাড়িতে প্রসাদ থাকলে তাকে ডাক, হাসপাতালে নিয়ে যাবে। জ্যোতি দেরি করিসনি।
আমি একটা চিঠি লিখে যাব। এক লাইন, আমার মৃত্যুর জন্য…তারপর কী লিখব রে? আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, কী লিখব বল তো? কেউ দায়ী নয়, নাকি আমার স্বামী দায়ী? প্রসাদকে ডুবিয়ে গেলে কি ভগবানের কাছে।
পূর্ণিমার মনে হল টেলিফোনটা জ্যোতির হাত থেকে পড়ে গেল। বার কয়েক হ্যালো হ্যালো বলে সে সুরেনের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে বলল, তোমার কৌটোটা জ্যোতি নিয়ে গিয়ে সব খেয়েছে। আমি যাব ওর কাছে, এখনি আমি যাব।
সুরেন ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। পূর্ণিমার হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে কানে দিল। সাড়াশব্দ পেল না।
তুমি আমায় এখনি নিয়ে চলো। এখনও গেলে ওকে বাঁচাতে পারব।
দাঁড়াও। এখন ট্যাক্সি পাব কি পাব না..বাড়ি তো ভবানীপুর থানার আণ্ডারে, ওদের খবর দিচ্ছি।
পুলিশ পৌঁছোতে দেরি করেনি। আর সেইজন্যই জ্যোতি বেঁচে গেল। হাসপাতালে দু-দিন রেখে প্রসাদ ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। জ্যোতির সঙ্গে হাসপাতালে কাউকেই কথা বলতে দেওয়া হয়নি, পূর্ণিমা বাড়িতে ওকে দেখতে যায়। বিছানায় শোয়া জ্যোতি হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমি মরলুম না কেন বল তো?
ভগবান চাননি তাই। হয়তো তাঁর অন্য কোনো ইচ্ছা আছে।
জ্যোতি গভীর দৃষ্টিতে তার বন্ধুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পূর্ণিমা আঁচলে জল মুখে নিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগল।
তোকে আর নিজের সম্পর্কে কিছু ভাবতে হবে না, আমিই যা ভাবার, যা করার করব। তোকে আমি সুখী করবই।
কর। জ্যোতি সান্ত্বনা দেবার জন্য হাসল।
ছায়া চ্যাটার্জি থাকে কোথায় রে?
ঠিক জানি না। শুনেছিলাম পার্কসার্কাসে থাকে।
ওর কোনো ছবি তোর কাছে আছে?
না। কেন?
এই সময় প্রসাদ ঘরে ঢুকল। পূর্ণিমার আর জবাব দেওয়া হল না।
এর তিন সপ্তাহ পর রবিবার বিকেলে পূর্ণিমা বারান্দায় গাছের টবে জল দেবার সময় গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল, সাদা একটা মরিস মাইনর ইন্দ্রনগরে ঢোকার জন্য বাঁক নেবার আগে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ির চালককে দেখা যাচ্ছে না তবে তার পাশে বসা শ্যামবর্ণা স্ত্রীলোকটির মুখের কিছুটা পূর্ণিমা দেখতে পাচ্ছে। খুবই সাধারণ, দ্বিতীয় বার না তাকানোর মতোই লম্বাটে মুখ, বয়স সম্ভবত ত্রিশের দু-এক বছর এধার ওধার-গলায় কানে অলংকার নেই। খোলাচুল সিথির দু-ধারে নামানো। ঘন প্রচুর চুলেই পূর্ণিমার চোখ আটকে গেল। দোকানি ব্যস্ত বিগলিত হয়ে পানের খিলি ভরা একটা কাগজের দোনা চালককে দিয়ে গেল। তারপর আবার দিয়ে গেল বোধ হয় মিঠামশলা। স্ত্রীলোকটি হাত পেতে চালকের কাছ থেকে মশলা নিয়ে মুখে দিল।
মোটরটা বাঁক নিয়ে ইন্দ্রনগরে যখন ঢুকছে পূর্ণিমা তখন চালকের মুখটি দেখতে পেল এবং কিছুক্ষণ পাথর হয়ে রইল তার মাথাটা। প্রসাদ!
পানওয়ালার হাবভাব দেখে তার মনে হল প্রসাদকে সে চেনে। মিনিট দশেক পর পূর্ণিমা পান কিনতে দোকানটায় এল। খিলিটা হাতে নিয়ে সে বলল, একটু আগে একটা সাদা গাড়িতে করে এসে এক ভদ্রলোক পান কিনলেন, চেনা চেনা মনে হল।
উনি তো প্রসাদ ঘোষ। বিরাট গাইয়ে, বিরাট নাম। ইন্দ্রনগরে নতুন যে গানের স্কুলটা সেখানে প্রতি রোববার শেখাতে আসেন। আমার কাছ থেকে পান নিয়ে ঢোকেন। শোনেননি ওঁর গান?
নিশ্চয় শুনেছি। স্কুলটা কোথায় বলুন তো?
এই তো সোজা গিয়ে, দুটো রাস্তা ছেড়ে থার্ডটার মোড়ে একটা লন্ড্রি, ঠিক তার পাশের বাড়ি, সাইনবোর্ডে গীতিপ্রসাদ লেখা।
কতদিন হল স্কুলটা হয়েছে?
তা মাস খানেক কী আর একটু কমই হবে। একদম নতুনই। ওর পাশে মোটরে যে মহিলা বসেছিলেন তাঁরই স্কুল। প্রসাদ শেখায় বলে খুব ছাত্র-ছাত্রী হয়েছে।
এইটুকুই যথেষ্ট। পূর্ণিমা ধরেই নিল প্রসাদের পাশে যাকে দেখেছে সে-ই ছায়া চ্যাটার্জি। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সে ইন্দ্রনগরে ঢুকল। আগে কখনো সে এখানে পা দেয়নি। রাস্তার একধার দিয়ে ড্রেনের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। মাটির ঢিপির পাশ দিয়ে সাইকেল রিকশার চাকার ধাক্কা সামলে প্রায় ষাট-সত্তর মিটার হেঁটে সে লন্ড্রির সামনে পৌঁছোল। পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা ভিতরে ঢুকেছে তার প্রথম বাড়ির সামনেই সাদা মোটরটা দাঁড়িয়ে।
বাড়িটা একতলা। বুক সমান উঁচু ছোট্ট লোহার গ্রিলের ফটক। একটুখানি বাগান, বারান্দা, জানলায় পর্দা-লাগানো দুখানা ঘর। ফটকের পাশে পাঁচিলের হলুদ রং-করা কাঠের তক্তায় সাদা অক্ষরে লেখা, গীতিপ্রসাদ। তার নীচে, প্রতি রবিবার বৈকাল ৫টা থেকে ৮টা। বারান্দায় দুটি বেঞ্চে কয়েক জন স্ত্রীলোক বসে। ঘরের ভিতর দেখা যাচ্ছে না তবে গান ও হারমোনিয়ামের শব্দ ভেসে আসছে। পূর্ণিমা ভিতরে গিয়ে কাছের থেকে ছায়া চ্যাটার্জিকে দেখে আসবে কি না ভেবে ঠিক করতে পারছে না। প্রসাদ যদি তাকে দেখে ফেলে। এটা সে কোনোমতেই চায় না।
বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এক মা পূর্ণিমার পাশ দিয়ে ফটকের দিকে যাচ্ছে। তাকে থামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা এখানে কি বড়োদেরও গান শেখানো হয়?
হয় বোধ হয়, আপনি ভেতরে গিয়ে ছায়াদিকে জিজ্ঞেস করুন-না।
ছায়াদি!
ছায়া চ্যাটার্জি, প্রসাদ ঘোষের ছাত্রী। উনিই স্কুলটা করেছেন।
পূর্ণিমা সোজা বাড়ি ফিরে না এসে ইন্দ্রনগর থেকে বেরিয়ে জনু যেখানে থাকে সেই নন্দ কলোনির দিকে গেল। জনুর ঘরটাকে চেনে না। মাঝবয়সি একটি স্ত্রীলোক টিউবওয়েলে জল ভরছে। পূর্ণিমা তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে হাত তুলে দেখাল, আর খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে একটা পেঁপে গাছ, ঘরের চালে দু-তিনটে কুমড়ো, ওইটে জনুর ঘর।
জনু ঘরে নেই। বছর বারোর মেয়েটি পূর্ণিমাকে চেনে। সে বলতে পারল না, তিন বাড়ির কাজ সেরে মা কখন ফিরবে। পূর্ণিমা তাকে বলে এল, তোমার মা ফিরলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলে দিয়ো। খুব দরকার। পারলে আজই যেন দেখা করে।
রাত আটটা নাগাদ জনু এল। কী ব্যাপার বউদি, ডাকতে গেছলে কেন? খুব দরকার বলেছ!
ছেলে আর সুরেন টিভি দেখছে। জনুকে বারান্দায় ডেকে এনে পূর্ণিমা কোনো ভণিতা না করে বলল, গৌতমকে দরকার, আমার একটা কাজ ওকে করে দিতে হবে।
জনু হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলল, তোমার দরকার! গৌতমকে?
হ্যাঁ। সে জন্য যা টাকা লাগবে দেব।
কী দরকার গো বউদি? জনুর স্বর ষড়যন্ত্রীর মতো নীচু হয়ে গেল।
সে এখন বলা যাবে না। কর্কশ গলায় পূর্ণিমা বুঝিয়ে দিল কৌতূহল তার পছন্দ হচ্ছে না। তুমি কি ওকে বলতে পারবে আমার সঙ্গে কালই এক বার দেখা করতে?
গৌতম এখন বাড়িতে না অন্য কোথাও এসব নোক ঘরে তো কমই থাকে। আমারও ছছাটো ছেলেটার সকাল থেকে বমি আর পায়খানা–
তার কথা শেষ হবার আগেই পূর্ণিমা দাঁড়াও বলে শোবার ঘরে ঢুকল এবং আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে জনুর হাতে কুড়ি টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল।
চুপচাপ যাবে। গৌতমকে বলবে দুপুরে আসতে। ওকে চিনি না, এসে যেন বলে জোনাকি পাঠিয়ে দিয়েছে, তাহলেই বুঝব।
খারাপ কাজ কিছু নাকি বউদি? জনুর স্বরে আবার কৌতূহল ফুটে উঠল।
খারাপ নয়, একদমই নয়। একজনের খারাপ কাজ বন্ধ করতে হবে, ভালো উদ্দেশ্যেই দরকার। এতে তোমার তো কোনো দায়দায়িত্ব থাকছে না, তুমি শুধু যোগাযোগটা করিয়ে দেবে। কাজটা হলে তোমাকে আরও পঞ্চাশ দেব। নিশ্চয় তুমি এটা নিয়ে কাউকে কিছু বলবে না।
না গো না, গৌতম কি তাহলে আমায় আর আস্ত রাখবে?
জনু চলে যাবার পরও পূর্ণিমা বারান্দার গ্রিল ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রনগরের মোড়ের দিকে। কিছু লোক আর যানবাহন, অস্পষ্ট শব্দ আর আবছা আলো ছাড়া তার চেতনায় আর কিছু পোঁছুচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সে মুখটা তুলে বিড়বিড় করল, তোকে সুখী করব। একটু ধৈর্য ধর। সেই সময়ই লোডশেডিং হল তল্লাটজুড়ে। দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা হা আ আ রব উঠে তখন ছড়িয়ে পড়তেই পূর্ণিমার গ্রিলধরা মুঠোটা শক্ত হয়ে উঠল।
পরদিন দুপুরে বারান্দায় অপেক্ষা করছিল পূর্ণিমা। দেখতে পেল জনুর সঙ্গে একটা লোক আসছে। তার মনে হল এই লোকটাই গৌতম। পায়ে চটি, খয়েরি রঙের সরু ফাঁদের ট্রাউজার্স যাতে ইস্ত্রির বালাই নেই, হাওয়াই শার্টটা নীল ও কালো ডোরাকাটা, পাতাকাটা চুল, গায়ের রং গাঢ় শ্যাম। পূর্ণিমা খুবই দমে গেল লোকটির স্বাস্থ্য দেখে। কঠিন অসুখ থেকে ওঠার পর মানুষ যেভাবে হাঁটে, রুগ্ন দেহটার চলন সেইরকম।
কাজের মেয়েটির ঘুম না ভাঙিয়ে পূর্ণিমা এক তলায় নেমে এল! সদর দরজা খোলামাত্র জনু বলে উঠল, বউদি এই হল গৌতম, কথা বলো, আমি কাজে যাচ্ছি। এই বলেই সে দোতলায় উঠে গেল কাজ করতে। পূর্ণিমার একটাই সমস্যা দেখা দিল, গৌতমের সঙ্গে তুমি না আপনি সম্বোধনে কথা বলবে।
দুটো ঠোঁট ঢেকে রাখতে পারে না সামনের লম্বা দাঁতগুলোকে, তাই বেরিয়েই থাকে কিন্তু গৌতমের মুখে রাক্ষুসে ধরনের ছাপ নেই। পূর্ণিমা সামান্য হতাশ হল। জনুর গল্প থেকে যে রকম একটা ধারণা ইতিমধ্যেই গড়ে ফেলেছে তার সঙ্গে গৌতমকে কোনোভাবেই সে মেলাতে পারছে না। এক-তলায় বসার ঘরে ঢুকে সোফার দিকে হাত বাড়িয়ে গৌতমকে সে বসতে ইঙ্গিত করল।
কেন দেখা করতে চাই সেটা আর জনুকে বলিনি, ওর কাছেই তোমার একটা ব্যাপার শুনে মনে হয়েছে আমার একটা কাজ তুমি বোধ হয় করে দিতে পারবে। অবশ্য সেজন্য টাকা দেব। চোখ-কান বুজেই প্রায় এক নিঃশ্বাসে পূর্ণিমা কথাগুলো বলে একটু সহজ বোধ করল। তারপরই খেয়াল করল সম্বোধন সমস্যাটা মিটে গেছে।
কী শুনেছেন আমার সম্পর্কে কোনোরকম ঔৎসুক্য নেই গৌতমের চাহনিতে ও কণ্ঠস্বরে। স্বরটা ভরাট। চোখের পাতা দুটোই শুধু সামান্য নেমে মণির আধখানা ঢেকে দিল। পূর্ণিমার মনে হল ভণিতা ও শোভনতার জন্য সময় নষ্ট করার সময় এখন নয়। সোজাসুজি কাজের কথাতেই যাওয়া উচিত।
তুমি একজনকে মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিলে, জনু আমায় বলেছে।
অসিত। তা হয়েছে কী? এটা তো পুরোনো ব্যাপার!
হয়েছে এই যে, পূর্ণিমা চেয়ার থেকে উঠে এসে সোফায় বসল। এইরকম একটা কাজ আমার জন্য করে দিতে হবে।
গৌতমের বসাটা ঢিলেঢালা থেকে খাড়া হয়ে উঠল। কেন?
যে কারণে অসিতকে শাস্তি দিয়েছ ঠিক সেই কারণেই। তবে এক্ষেত্রে একটা মেয়ে। আমার খুব ক্ষতি করেছে, করে যাচ্ছে।
আপনি আপনার নিজের স্বামীকে সামলাতে পারেন না? গৌতমের ভৎসনাটা পূর্ণিমার কাছে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সে নিজেকে ম্রিয়মাণ দেখাবার চেষ্টা করতে করতেই লক্ষ করল গৌতম তার বুক থেকে পেট পর্যন্ত দ্রুত জরিপ করে বোঝার চেষ্টা করছে স্বামী বেহাত হওয়ার কারণটা।
অনেক কাজই আমি করি, তাতে জানের ভয় আছে রিক্স আছে কিন্তু টাকা পেলে সব কাজই করে দিই। থেমে থেমে গৌতম বলল, চোখটা ভেজানো দরজার দিকে রেখে।
কত নেবে?
আগে শুনি কাজটা কেমন। অ্যাসিডের কারবারে ঝামেলা অনেক। চেম্বার দিয়ে হাসিল করা বরং অনেক সোজা। পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে কানেকশন থাকলে তো আরও ঝামেলা।
না না, কোনো পাটিফার্টির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। একদমই নিজস্ব ব্যাপার।
অ্যাসিডের কাজ আমার এলাকার বাইরে গিয়ে আমি করি না, এতে খুব হ্যাপা আছে।
ইন্দ্রনগরে সে আসা-যাওয়া করে। আর এটা তো তোমারই এলাকা!
হ্যাঁ।
এখানেই তো তাহলে কাজ সেরে ফেলতে পারবে।
যত সহজে বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু অত সোজা নয়। নিজের এলাকা হলে কি রিক্স থাকবে না? জনুবউদি আপনাকে কতটা কী বলেছে জানি না, তবে অসিতের কেসটা ছিল আমার নিজের বউকে নিয়ে, টাকার জন্য নয় তাই রিক্সের পরোয়া করিনি। গৌতম অনুত্তেজিত স্বরে বলে গেল। নিজের এলাকায় হলে মিনিমাম পাঁচ হাজার নেব। দেখুন, কেন, কী উদ্দেশ্যে আপনি করতে চান, বা মেয়েছেলেটার নাম কী, ঠিকানা কী এসব জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, দরকারও নেই। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল এই হচ্ছে আমার কথা। লেনদেনের ব্যাপারটা তাই গোড়াতেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। আপনি যদি টাকায় এগ্রি না করেন তাহলে আমি এখুনি চলে যাব, করলে বাকি যা জানার জেনে নোব।
পূর্ণিমার মাথার মধ্যে মৃদু একটা গোলমাল ঘটল টাকার অঙ্কটা শুনে। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, পাঁচ একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। অসিতের যা করেছ অতটা না হলেও চলবে।
দেখুন, এ কাজ কম আর বেশি বলে কিছু নেই। রিক্স ইজ রিক্স। ধরা পড়ে গেলে কী হবে জানেন তো!
চার পর্যন্ত উঠতে পারি।
দরাদরির কারবারে আমি যাই না। গৌতম উঠে দাঁড়াল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা বুঝে গেল কথার নড়চড় সম্ভব নয়।
বেশ।
গৌতম ধীরে ধীরে আবার সোফায় বসে বলল, বাকিতে কাজ করি না। এইটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স চাই, বাকি টাকা কাজ হাসিল হবার সঙ্গে সঙ্গে। পেমেন্ট গোলমাল করলে কিন্তু বিপদে পড়বেন। টাকা নিয়ে রেডি থাকবেন, আমার লোক এসে আপনাকে খবর দেবে, তার হাতেই বাকি টাকাটা দিয়ে দেবেন।
পূর্ণিমা একদৃষ্টে গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল। তার মনে হল লোকটা বাজে কথার নয়, কাজের। পাঁচ হাজার টাকা ধাপ্পা দিয়ে ঠকিয়ে নেবে না। এই দুবলা সাধারণ চেহারার লোকটার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড ক্ষমতা, সে জ্যোতির সুখের পথের বাধাটাকে অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে দিতে পারে। তার শোবার ঘরে স্টিলের আলমারির লকারে উপার্জন থেকে হিসাবের বাইরে সরানো প্রায় আড়াই লাখ টাকার নোট সুরেন রেখে দিয়েছে। পূর্ণিমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা কোনো সমস্যা নয় যতক্ষণ আলমারির ও লকারের চাবিটা তার কাছে রয়েছে।
আমি রাজি। আজই এইট্টি পার্সেন্ট দেব।
বেশ। তাহলে আমার যা যা জানার দরকার এবার সেগুলো বলুন। কোনো কথা বাইরে যাবে না গ্যারান্টি দিচ্ছি।
পূর্ণিমা দেখল গৌতমের মানুষের মতো মুখটা ধীরে ধীরে রাক্ষসের হয়ে আসছে। সে আশ্বস্ত বোধ করল।
পরের রবিবার বিকেলে পূর্ণিমা বারান্দায় টুলে বসে গ্রিলের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে রইল। সাদা মোটরটাকে পানের দোকানের সামনে সে দাঁড়াতে দেখল, পানওয়ালা পানের দোনা গাড়িতে দিয়ে গেল। ছায়া চ্যাটার্জির চুল কাঁধের উপর দিয়ে পিঠে ছড়ানো। একটা হাত তার সামনে এগিয়ে এল, ছায়া চ্যাটার্জির হাতের তালু থেকে লবঙ্গ বা এলাচ দু-আঙুলে খুঁটে তুলে নিয়ে মুখে দিল। প্রসাদের মুখটা সে দেখতে পেল ইন্দ্রনগরের পথে বাঁক নেবার সময়। তারপর সে অপেক্ষা করতে থাকল। আটটায় গীতিপ্রসাদ বন্ধ হয়। তারপর ওরা গাড়িতে উঠবে, এই পথ দিয়ে ফিরবে। সে-সময়েই কিংবা তারও আগে, গৌতমই তা জানে, কাজটা সারা হবে।
পূর্ণিমা সংসারের কাজের মধ্যে পাঁচ-ছ বার ঘড়ি দেখল। সে ঠিক করেই রেখেছে জ্যোতিকে কিছু জানাবে না। টেলিফোনে তার কাছ থেকে আচমকা খবরটা পেয়ে জ্যোতির যেরকম আবেগভরা মন হয়তো দুঃখও ছড়াতে পারে। অ্যাসিড খুব যন্ত্রণা দিয়ে কুৎসিত করার কাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু গৌতমকে তার বলা আছে শুধু মুখের একটা পাশ, গাল, কান আর চুল বাদে সব যেন অক্ষত থাকে। কিন্তু ওকে দেখে প্রসাদের দ্বিতীয় বার যেন তাকাবার ইচ্ছে না হয়।
আটটার সময় পূর্ণিমা আবার বারান্দায় এল। ইন্দ্রনগরের মোড় অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। একটা ভয়ংকর, বুক-হিম-করা ব্যাপার কাছাকাছিই ঘটবে, গানের স্কুল থেকে এই মোড়, এর মধ্যেই নিশ্চয় সেটা ঘটবে।
সময় জানার জন্য ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা দেখে বারান্দায় এসেই পূর্ণিমা বিরক্তি আর হতাশায় গ্রিলের উপর তালু ঠুকল। সাদা মোটরটা হর্ন বাজিয়ে বাঁক নিয়ে স্বচ্ছন্দ গতিতে কলকাতার দিকে চলে গেল।
এইভাবে হর্ন বাজিয়ে পর পর তিনটি রবিবার গাড়িটা ইন্দ্রনগরের মোড় থেকে বাঁক নিয়ে চলে যাবার পর, চতুর্থ রবিবারে পূর্ণিমা যখন বারান্দায় অপেক্ষা করছে তখন দুটি সাধারণ ব্যাপার ঘটল। লোডশেডিং নামল এলাকায় আর ফোন বেজে উঠল।
মা তোমার ফোন। ভিতর থেকে ছেলে ডাকল। মুহূর্তের জন্য পূর্ণিমার হৃদপিন্ডটা কুঁকড়ে যেন সর্ষেদানার মতো হয়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড কুঁজো হয়ে থেকে সে দ্রুত ঘরে এসে ফোন ধরল।
হ্যালো, কে? নীচু স্বরে সে বলল।
পুনি? আমি রে। এত দেরি হয় কেন তোর ফোন ধরতে? ছেলে বলল মা বারান্দায়। কী কচ্ছিলিস বারান্দায়? রাস্তায় কি প্রেমিক দাঁড়িয়ে? জ্যোতির উচ্ছল সুখী কণ্ঠস্বর। পূর্ণিমা অবাক, এভাবে বহু বছর সে জ্যোতিকে কথা বলতে শোনেনি।
ব্যাপার কী, এত খুশি কেন?
আছে আছে, ব্যাপার একটা আছে। শুনলে তুই চমকে যাবি। বল তো কী?
জানি না।
তবু বল?
ছায়া চ্যাটার্জিকে ক্যান্সারে ধরেছে।
খিলখিল হেসে উঠল জ্যোতি। ছি পুনি, ওসব অমঙ্গল চিন্তা আর আমি করব না। একটু আগে ডাক্তার সামন্তর চেম্বার থেকে ফিরেছি। চেক আপ করাতে গেছলুম। প্রসাদের চার নম্বর এসে গেছে। এখন বয়স দেড় মাস।
তার মানে! তোর বাচ্চা হবে?
আমার সেই বোকামির ব্যাপারটায় প্রসাদ খুব ঘাবড়ে গেছে। আর আলাদা শুতে ভরসা পাচ্ছে না। আমি এখন বলে দিতে পারি ওর গায়ে কটা তিল। জ্যোতি কলকলিয়ে হেসে উঠল আর বাইরে থেকে ভেসে আসা একটা ক্ষীণ কলরব একইসঙ্গে পূর্ণিমার কানে ধাক্কা দিল। ভ্রুকুটি করে অন্ধকার বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে বলল, এসব কথা তুই আমায় আগে বলিসনি কেন, তাহলে? সে থেমে গেল অস্বস্তি ভরে।
তাহলে কী?
কিছু না।
তুই খুশি হসনি?
দারুণ, সত্যিই দারুণ খবর তুই দিলি। আমার এত ভালো লাগছে তোর গলা। কতদিন তোর মুখ থেকে হাসি শুনিনি। জ্যোতি, বলেছিলাম ভগবান আছেন, তিনিই তোকে দেখবেন। তোকে সুখী দেখলে আমার যে কী ভালো লাগে। পূর্ণিমা কাঁধে গাল ঘষে জল মুছল।
প্রসাদ আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।
সত্যিই!
জার্মানি থেকে চিঠি পেয়েছে, সামনে জুলাইয়ে গাইতে যাবে। বলেছে আমাকে নিয়ে কন্টিনেন্ট ঘুরবে।
ভালোবাসা দেখছি উথলে উঠেছে। স্লিপিং পিল গোটা দশেক পাঠিয়ে দেব নাকি রে!
না বাবা, রক্ষে কর। এখন আমার ঘুম হয়, প্রসাদ বলে নাকও নাকি ডাকে। পুনি, এখন আমি রাখছি, ছেলে-মেয়ে ঝগড়া করছে, না থামালে রক্তারক্তি হয়ে যাবে, রাখছি রে।
টেলিফোন রেখে পূর্ণিমা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, লোডশেডিং।
ইনভার্টার থাকায় পাখা, আলোর সঙ্গে টিভিও চালু হয়েছে। হিন্দি সমাচার শুনতে শুনতেই সুরেন বলল, আবার বাচ্চা হবে?
হ্যাঁ, প্রসাদ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।
তারা আর এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেনি। পূর্ণিমা এক বার বারান্দার গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দোকানগুলোয় মোমবাতি জ্বলছে। মিনিবাস স্টপে কয়েক জন দাঁড়িয়ে। একটা পুলিশের জিপ ইন্দ্রনগরে ঢুকল।
বারান্দা থেকে ভিতরে আসতেই কাজের মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, বউদি একটা মেয়েছেলে নীচে তোমায় ডাকছে।
কে? চিনিস?
আগে কখনো দেখিনি। বলল বউদিকে ডেকে দাও খুব দরকারি কথা আছে।
একতলায় সিঁড়িতে হারিকেন জ্বলছে। সিঁড়ি আর সদর দরজার মধ্যে ছোটো জায়গাটায় স্ত্রীলোকটি দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই পূর্ণিমার মনে হল, এই হল মলি।
গৌতম পাঠিয়ে দিল, আমি ওর বউ।
বুক কেঁপে উঠল পূর্ণিমার। গৌতমের আর তো কোনো দরকার নেই। মিছিমিছি একটা মেয়ের সর্বনাশ সে করল। প্রসাদ তো ফিরেই এসেছে জ্যোতির কাছে। শুধু খবরটা জ্যোতি যদি আজ সকালেও জানাত তাহলে যেভাবেই হোক সে গৌতমকে জানিয়ে দিত, দরকার নেই। টাকাটাও আর ফেরত চাইত না।
হয়ে গেছে। গৌতম বলল বাকি টাকাটা এক্ষুনি দিতে। মলি কাজের মেয়েটির দিকে তাকাল। পূর্ণিমার পাশে দাঁড়িয়ে সে শুনছে।
তুই এখন ওপরে যা, এর সঙ্গে কথা আছে।
পূর্ণিমা মুখ ফিরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওর উপরে ওঠা দেখে, মলির দিকে এগিয়ে এসে ভীত গলায় ফিসফিস করে বলল, মেয়েটিকে কি খুবই… মানে বেশি কিছু তো হয়নি?
মলিও চাপা স্বরে বলল, আমাকে তো ও বলল, যা অন্ধকার ছিল তাতে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। এতে অবশ্য সুবিধেই হয়েছে, কেউ ওকে দেখতে পায়নি। আপনাকে নিশ্চিন্তি থাকতে বলেছে আর কারুর কাছে কখনো গল্প করবেন না। তাতে আপনিই বিপদে পড়বেন।
জানি, কিন্তু মেয়েটির অবস্থাটা জানতে পারলে…। পূর্ণিমার উৎকণ্ঠার সঙ্গে সহানুভূতি মিশে আছে।
মলি ঝুঁকে পূর্ণিমার মুখের কাছে মুখ এনে সান্ত্বনা দেবার মতো স্বরে বলল, মেয়েটার বোধ হয় কিছু হয়নি, হলেও খুব অল্পই হবে। ও বলল পাশের লোকটা মেয়েটাকে দু-হাতে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল। অন্ধকারে ও প্রথমে সেটা টের পায়নি। অ্যাসিড মারার পর লোকটাই প্রথম চেঁচিয়ে ওঠায় ও বুঝতে পারল মালটা কোথায় গিয়ে পড়েছে। কী বজ্জাত পোক বাবা!…বউদি একটু তাড়াতাড়ি এনে দিন।