গর্ভধারিণী মামী
তেতাল্লিশ বছর বয়সে এসে আমি আবার কনসিভ করলাম।
খবরটা জানার পর পরিচিত মহলে কানাঘুষা শুরু হল— সব ঘরে ঘরে ছিল তাজা খবর—আমার বি.টেক পড়া মেয়ের বান্ধবীর মায়েরা চোখে মুখে প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল— কি রে সোমা তুই
এ বয়সে এসেও এত বড় ঝুঁকি নিলি??
কেউ বলল,এক্সিডেন্ট? তা হতেই পারে।
আমি আর কি বলি —ওদের কথার জবাবে হাসি।
কানে আসে কুমন্তব্য— বুড়ি বয়সে ভীমরতি—–এত বড় মেয়ের মা—- আচ্ছা তোর মেয়েতো লজ্জায় মরে যাবে—দুদিন পরে দিদি চাকরি করে বোনের ল্যাকটোজেন আনবে।
আমি লজ্জা পাই না—-তবে খানিকটা অস্বস্তিতে সরে আসি—আমার মেয়ে খুব খুশী রে—-তোরা এত চিন্তা করিস না— চুপচাপ বাড়ি আসি।
পেটটা দেখলেই বোঝা যায়—এখন ছয় মাস চলছে—-আমি টের পাই আমার ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকা নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। পৃথিবীর আলো দেখবার ব্যাকুলতা।
যেন ও জানান দিতে চায়—মামী আমি আসছি।
বড় মেয়ের সময় যেমন অনুভব—এখন বুড়ি হয়েছি তো কি হয়েছে–একই মাতৃত্বের অনুভব ।
আমার কোল আলো করে দোল খেতে চাই। শুনতে চাই ছড়া-গান।
“খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন গেছে কার বাড়ি”।
আমার কোলে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়তে চাই।
আমার মনে হয় এত তাড়া কিসের তোর? আমার সাথেই আর কিছুদিন থাক না।
মেয়েটা — ব্যাঙ্গালোরের বন্ধুদের কাছে আমার প্রেগন্যান্সির গল্প করেছে—ও বলেছে কেউ কটু কথা বলেনি।আমায় প্রতি মূহুর্তে সাবধানে থাকতে বলে।
শাশুড়ি আজকাল কথা কম বলেন — এড়িয়ে চলতে চান —-সেটা বুঝি— আগে কত আমার সাথে গল্প করতেন— সেজন্য কোনও দুঃখ নেই—- আমি আমার গর্ভের সন্তানের জন্য সব মেনে নিয়েছি—- ভগবান যেন সুস্থ সবল একটি শিশু আমার কোল জুড়ে দেন।
শ্বশুরবাড়িতে ননদ ও ননদাই খুব খোঁজ নেয়–। শাশুড়িকে বলে জোর করে একটা রাঁধুনি রেখে দিয়েছে।
ননদের যত্নের তুলনা হয়না। বন্ধু রা বলে ভাগ্য করে ননদ পেয়েছিস।
আমি মুচকি হেস বলি এক হাতে তালি বাজে না। আমাকেও ভালো বৌদি হতে হয়।ওদের সুখ,সুযোগ , সুবিধা দেখতে হয়।নাহলে বৌদি হবার যোগ্যতা থাকত না।
অফিস যাবার সময় আমার স্বামী মনে করিয়ে দেন সময়মত খাবার খাওয়ার কথা।বাড়িতে কত মাছ, ফল আসে।কর্তাকে অনেক বন্ধু আওয়াজ দিয়েছে বাড়িতে সুখবর কবে আসছে!! ভালো হয়েছে মুখেভাতে মনে করে নিমন্ত্রণ টা করো কিন্তু। বেশি বয়সের সন্তান আসছে তাইজন্য সকলের
দুঃশ্চিন্তা ।সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হচ্ছে। একটু সমস্যা মনে হলেই ডাক্তার খানায় যাই। পরিবারের সবাই এতটাই উদ্বিগ্ন একা কখনো ডাক্তার দেখাতে যেতে দেয় না। ননদ কখনো মিষ্টি বকা দেয় .. বৌদি কাজ করো না…শুয়ে গান শুনবে।এইসব কথা শুনে শাশুড়ি কখনো তেলেবেগুনে জ্বলে।ননদকে মুখ ঝামটা দেয়। মা ও মেয়ের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়ে যায়।মা নানান টিপ্পনি কাটে মেয়েকে।মেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরে।যাবার আগে বলে বৌদি চলো আমার বাড়িতে । আমি বলি আমার শাশুড়ি আছেন ,বর আছে , ওদের কে দেখবে শুনি!ননদের চোখে মুখেও দেখি উৎকন্ঠা। সব ঠিকঠাক হবে তো।বৌদি তোমারতো বয়স হয়েছে-!সুস্হ সন্তান জন্ম নেবে তো?
আমি বলি সব ঠিক হবে মাথার উপর ভগবানের আশীর্বাদ আছে।
দুপুরের খাওয়ার পর যখন বিশ্রাম নিই,পেটের ভেতর নড়াচড়া টের
পাই । হাত রেখে ওকে শান্ত করি। তখন খুব কান্না পাই।
নয় মাস পর্যন্তই ও থাকবে আমার সাথে— তারপর চুপিচুপি ওকে তুলে দিতে হবে আমার নিঃসন্তান ননদের কোলে— আমি কেবলই গর্ভধারিণী মামী।
এ সন্তানের সত্যিকারের বাবা-মা আমার ননদ আর ননদাই— আমি শুধু আমার গর্ভে ধারন করেছি—ভগবান কি করে পারব ওকে তুলে দিতে ?
সব জেনেই তো মাতৃত্ব নিয়েছি— তবু কেন যেন ভয় হয়—সন্তান হারানোর ভয়।
বন্ধুদের কাছে হাসির খোরাক হয়েছি।
নয়মাসের পর ননদকে দিয়ে দিলাম আমার কোখের সন্তানকে—কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতেই —শাশুড়ি বললেন বুড়ি বয়সের সন্তান বাঁচে না—ভগবান ভুল করে পাঠিয়েছিলেন—- তাই নিয়ে নিয়েছেন।
দিন যায়,চুপ করে থাকি।
শাশুড়ি বলেন—তোমার ঐ ঘটনার পর আমার মেয়ে ,জামাই আসে না।
ছি ছি ! কি লজ্জা।
ফোন করে ননদকে জানালাম—ননদরা ছয়মাস পরে কোলে বাচ্চা নিয়ে এল।শাশুড়ির কি আনন্দ।
ভুমি বাচ্চাটাকে একটু দেবে?
না রে ভুমি ওর কোলে দিস না—নিজের বাচ্চাটাকে শেষ করেছে—ওর নজর লেগে যাবে—-ননদাই বলে ভুমি বেবিকে ওর গর্ভধারিণী মামীর কাছে দাও—দেখছ বৌদির কি চেহারা হয়েছে।
সব শুনে শাশুড়ি ত অবাক।নিজের মেয়ের জন্য এত বলিদান।
বৌমাকে শাশুড়ি বলে একবার তো আমাকে সত্যি ঘটনা বলতে পারতে।ঘরে ঘরে এরকম ননদ বৌদির জুটি বজায় থাকুক।