গন্ধী
একটু আগেই এক পশলা জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। কাক আর শালিকেরা গলা তুলে ডাকাডাকি শুরু করেছে। প্রবোধবাবু দোতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
ঘোষেদের বাড়ির কার্নিশে একটি অশ্বত্থ চারা গজিয়েছে বেশ কবছর হল। বাড়ির দেওয়াল আস্তে আস্তে ফেটে যাচ্ছে, প্রবোধবাবুর ভেতরটা যেমন ভাবে ফেটে যাচ্ছে গত কয়েক বছর। এখন তিনি তাকান কিন্তু দেখতে পারেন না। এসবই আগে দেখার স্মৃতি। বৃষ্টির পর রোদ ওঠাতে বাগবাজারের ওই গলির মধ্যেও সোনা ঢেলে দিয়েছে আকাশ রৌদ্রস্নাত দুপুরে। বিন্তিদের বাড়ির দোতলার বারান্দাতে বিন্তির বউদি চান করে শাড়ি মেলে দিতে এসেছে। শাড়ি মেলার আগে জল-ঝরাবার ফতফত শব্দ কানে আসছে তা থেকেই বুঝতে পারছেন যে মহিলা শাড়ি মেলতে এসেছেন। সম্ভবত একটা খড়কে-ডুরে শাড়ি পরে ভেজা-চুল পিঠের উপরে মেলে দিয়ে মহিলা অন্য একটি খড়কে-ডুরে শাড়ি মেলে দিতে এসেছেন।
এখন অল্পবয়সি বাঙালি মেয়েরা শাড়ি পরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে অনেকেই। তারা জিনস আর টপস পরে, ছোটো করে চুল কাটে, গটগট করে হেঁটে যায় এক হাতে মোবাইল ফোন কানের পাশে চেপে ধরে। কলকাতা এখন খুবই কর্মব্যস্ত নগরী হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন একটি অজগর সাপের মতো ঘুমোচ্ছিল কলকাতা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে এক সাংঘাতিক প্রতিযোগিতাতে সামিল হয়েছে। প্রবোধবাবুদের ধীর, শান্ত দিন-রাত হারিয়ে গেছে।
বিন্তির বউদির কী যেন নাম? নাম মনে নেই। কোনো কিছুই মনে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে। ফেলেছেন প্রবোধবাবু। বিয়ের সময়ে তন্বী ছিলেন মহিলা। বেশ একটা আলগা সৌন্দর্য ছিল। মুখে। প্রবোধবাবু বিয়ে করলে তাঁর স্ত্রীর যেমন বয়স হত ওই মহিলারও তেমনই বয়স। বিয়ের সময়ে বেশ ফর্সাও ছিলেন। এখন মোটা হয়ে গেছেন অনেক। একটু কালোও। হাঁটুতে বোধ হয়। ব্যথা, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। মেয়ের ভালো বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন হল। প্রবোধবাবু কি। বিয়েতে নিমন্ত্রিত ছিলেন? মনে নেই। জামাই যেন বাইরে কোথায় থাকে, ব্যাঙ্গালুরু বা মুম্বাই বা চেন্নাই-প্রবোধবাবুর ঠিক মনে নেই। এই গলিতে কাক চড়াই শালিখ যেমন এখনও আছে তেমন পুরোনো দিনের সব বাড়ির জানলাতে পাখিও আছে। সত্যি পাখিরই মতো জানালার পাখিদেরও আর দেখা যায় নানাকি দক্ষিণ কলকাতাতে। জীবেন বলছিল।
প্রবোধবাবু চোখে প্রায় দেখেনই না আজকাল। নিজের পাড়ার মধ্যে বহুদিনের পরিচিত সব দৃশ্য এখনও প্রায় আন্দাজেই দৃষ্টিগোচর হয়। অন্য কিছু নতুন কিছু দেখতে পেলেও আবছা দেখেন। ঠিকমতো ঠাওর করতে পারেন না। কথাও আজকাল বলতে পারেন না। খেতেও খুব কষ্ট হয়। গলা ভাত আর তরল ছাড়া গিলতে পারেন না। গানও একেবারেই গাইতে পারেন না। কথা বন্ধ হয়েছে মাস খানেক হল। নিজের গলাতে আঙুল ঠেকিয়ে আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের বোঝান যে তিনি কথা বলতে পারেন না। দু-চোখ দিয়ে জল ঝরে। দু-টি হাত জড়ো করেন প্রণাম করার মতো করে। আসলে, তাঁর চরম অসহায়তা বোঝাতে চান। হয়তো সহানুভূতিও প্রার্থনা করেন। ঠিক বোঝা যায় না। অনেকদিন হয়ে গেল বই পড়তে পারেন না। টিভিও দেখতে পারেন না। চোখের সামনে নানা রঙা মেঘ খেলা করে শুধু। প্রবোধবাবুর ঘরে রবীন্দ্রনাথের একটি বেশি। বয়সের ফোটো আছে। সম্ভবত ওঁর অসুস্থতার সময়ে তোলা। খুবই ক্লিষ্ট চেহারা। চোখ দুটির নীচে গাঢ় কালি। দু-টি হাত নমস্কারের অথবা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বুকের সামনে ধরা। কে। জানে! হয়তো রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হবার জন্যেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন কবি। ওই ছবিটির দিকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকতেন প্রবোধবাবু, যখন দেখতে পেতেন। এবং তাঁর দু চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়াত। ছবিটি এখন আর দেখতে পান না তবে তার বহু পুরোনো অর্গানটির ওপরে ফোটোটি রাখা ছিল। ফোটোটি কোথায় যে আছে, সেটা আন্দাজ করতে পারেন। এখন তাঁর জগৎ শুধু শব্দের জগৎ। আন্দাজের জগৎ। চোখদুটি ছুটি নিয়েছে। চিরদিনের মতো। কিন্তু চোখ ছুটি নেওয়ায়, কান দুটি মনে হয়, অত্যন্তই সজাগ হয়েছে।
প্রতিবেশিনী রেশমি প্রতি শনিবারে বাপের বাড়ি আসে (শনিবারই কি? দিন তারিখ সব হারিয়ে গেছে জীবন থেকে) তখন একবার আসেই তাঁর কাছে। পাশের বাড়ির রেশমির সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল দুর্দম যৌবনে। রেশমির স্বামী মারা গেছেন। কবে যেন? ঠিক মনে নেই। কিন্তু মারা যে গেছেন সেটা ঠিক। মানুষটি একটি ঠক ছিল। মিথ্যা কথা বলে বিয়ে করেছিল রেশমিকে। রেশমির তার সঙ্গেও প্রেম ছিল। প্রেম করেই বিয়ে করেছিল। মানুষটি বাইরে খুব সপ্রতিভ, ঝকঝকে ছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলত। রেশমি তার বাইরেটা দেখে মজেছিল ভিতরের। খোঁজ পায়নি। হয়তো নেয়ওনি। মানুষটা মাতাল ছিল। একটি একটি করে বাপের সম্পত্তি বিক্রি করত আর দু-নম্বরি টাকাতে ফুটুনি করত। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম রেশমি তার টাকাতে। মজেছিল। পরে যখন বুঝল যে শুধুমাত্র টাকাই একজন পুরুষের পরিচয় নয়। আরও অনেক কিছু লাগে একজন পুরুষকে পুরুষ হয়ে উঠতে, তখন খুব দেরি হয়ে গেছিল।
রেশমির এক ছেলে। ছেলেটি মেধাবী হয়েছে। তার বাবা মেধাবী ছিল না। হয়তো অন্য কারো জিন এর গুণেই হয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পরে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে বিদেশে গিয়ে কী সব পড়ে টড়ে এসে এখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মস্ত চাকরি করছে।
বিয়ে করলেও প্রবোধবাবুকে ত্যাগ করেনি রেশমি। সে এক গভীর অপরাধবোধে ভুগত। প্রবোধবাবুর সারাজীবন অবিবাহিত থাকার পেছনে সেই যে মূল কারণ, তা সে বুঝত এবং স্বীকারও করত, বিশেষত নিজের কাছে এবং সেই কারণেই দু-ঘন্টার জন্যে বাপের বাড়ি এলেও সে একবার প্রবোধবাবুর কাছে আসতই। দীর্ঘ দুই যুগের মধ্যে মাত্র দু-দিন রেশমি প্রবোধবাবুকে তার শরীর দিয়েছিল। সেই স্মৃতিটুকুও ছিল প্রবোধবাবুর মাথায়। ছিল, কিন্তু এখন যেন নেই। সেসব মনে করতে গেলেও মনে করতে পারেন না। দমকা হাওয়া এসে স্মৃতির মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে একটা বোধ বেঁচে আছে মাথার মধ্যে। শরীরই সব নয়, প্রেম শরীরের চেয়ে অনেক। গভীর ব্যাপার। মনকে জড়িয়েই প্রেম বেঁচে থাকে। রেশমি যখন আসে, তখন তার পাটভাঙা শাড়ির খসখসানি আওয়াজেই প্রবোধবাবু বুঝতে পারেন যে রেশমি এল। আর তার আসার বার্তা বয়ে আনে তার সুগন্ধ। পারফিউমের নাম জানে না সে কিন্তু গন্ধটি চেনে। সেই গন্ধের পতাকা উড়িয়ে আসে রেশমি। সেই সুগন্ধিই ঘোষণা করে তার আগমন বার্তা।
রেশমি তার সামনের চেয়ারে বসে ফিসফিস করে বলে, কেমন আছ? প্রবোধবাবু বলেন, আছি একরকম কিন্তু একে কি থাকা বলে? রেশমি চুপ করে থাকে। উত্তরে কিছু বলার থাকে না বলেই নীরবে থাকে। পরম সোহাগে তার মুখ ও বুক দুটি সঁপে দেয় প্রবোধবাবুর বুকে। প্রবোধবাবু স্থবিরের মতো বসে থাকেন। সবরকম ভাবাবেগহীন হয়ে।
রেশমির চোখের জল গড়িয়ে পড়ে দু-গাল বেয়ে প্রবোধবাবুর বুকে। প্রবোধবাবু দু-হাত দিয়ে রেশমির দুটি হাত ধরে থাকেন। অনেকক্ষণ। দুজনেই নির্বাক থাকেন। একজন নিরুপায়ে, অন্যজন স্বেচ্ছায়।
একসময়ে রেশমি ওঠে চেয়ার থেকে। প্রবোধবাবুর কপালে একটি চুমু খেয়ে বলে, আজ চলি। ভালো থেকো। তুমি ছাড়া এই সংসারে আমার আপনজন কেউ নেই। মা চলে যাবার পরে দাদা বউদিদের কাছে আসি, আসতে হয় বলে। শ্বশুরবাড়ি বলে তো আমার কিছুই নেই। আমার দুই ভাসুরই অমানুষ, জানোয়ার, তুমি তো সবই জানেনা। আমার মুখ চেয়েই তুমি থেকো।
প্রবোধবাবু বলতে চান আমি যে চাইতে পারি না রেশমি। কতদিন তোমার মুখটা দেখিনি। তাঁর ঠোঁট দুটি শুধু দু-বার নড়ে ওঠে। কোনো কথা সরে না।
রেশমি তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে প্রবোধবাবুর মুখ চাপা দেয়। ফিসফিস করে বলে, চলি। প্রবোধবাবু রেশমির চলে যাওয়ার শাড়ির শব্দ কান-খাড়া করে শোনেন। অবোধ পশুর মতো। রেশমির গায়ের সুগন্ধ মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
২.
ছোটকুই চা দিয়ে এসে প্রথমে লক্ষ করে যে প্রবোধবাবু ঘরে নেই। তখন সকাল সাতটা। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ছোটকু দেখে যে সদর দরজাটি খোলা। কাজের ঠিকে মেয়ে মন্দাকিনীকে চেঁচিয়ে বলে ছোটকু, মন্দা, তুমি ঢুকে দরজাটা দাওনি আজ?
মন্দাকিনী লজ্জায় জিভ কাটে। বলে, একদম ভুলে গেছিলাম রে। ছোটকু অবিবাহিত প্রবোধবাবুকে খুব ভালোবাসে। তাঁর এই বৈকল্যর পরে তার প্রবোধবাবুর প্রতি ভালোবাসা আরও গভীর হয়েছে। ঘোড়ার মতো টগবগে মানুষটার কী অবস্থা হয়েছে। বহুদিনের কাজের লোক ছোটকু বাবুর এই অবস্থা চোখে দেখতে পারে না।
বাড়িতে সোরগোল পড়ে গেল। মন্দাকিনী সকাল সাড়ে পাঁচটাতে আসে। প্রবোধবাবু চোখে দেখতে পান না বলে বেশ কিছুদিন হল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেও পারেন না। যদি কখনো নামেন তাহলে সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত রেখে নামেন। কিন্তু তাঁর তো জানার কথা নয় যে, মন্দাকিনী দরজা বন্ধ করেনি। তিনি জানলেন কী করে যে দরজা খোলা আছে? মাস ছয়েক আগে ওই রকমই একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলেন বাবু। তখনও একটু একটু কথা বলতে পারতেন, চোখেও দেখতে পেতেন একটু একটু। বড়োরাস্তাতে পৌঁছে পথ পেরুতে গিয়ে ট্যাক্সি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যান। মানুষে চেঁচিয়ে উঠে বলেন, কী আহাম্মক মানুষ। তারপর তাঁকে ধরে ফুটপাথে এনে দাঁড় করাবার পরে তাঁরা বুঝতে পারে যে মানুষটা প্রতিস্থ নন।
কোথায় থাকেন? কী নাম আপনার?
প্রবোধবাবু জবাব দিতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থকেন। এমন সময়ে পাড়ার একটি ছেলে বাজারে যাওয়ার জন্যে বেরিয়ে প্রবোধবাবুকে দেখতে পেয়ে তাঁকে হাত ধরে নিয়ে এসে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। এর আগেও বার দুয়েক বাড়ি থেকে বেরোবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
প্রবোধবাবুর ছোটো ভাই, কাস্টমস-এ চাকরি করা সুবোধ জিগগেস করেন তুমি কোথায় যেতে চাও দাদা? আমাকে বললে তো আমিই তোমাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে পারি। কোথায় যাবার আছে তোমার?
প্রবোধবাবু অনেক সময় নিয়ে, তুতলে বলেছিলেন, নিমতলা।
সুবোধ পাড়াতে প্রবোধবাবুর যেসব বন্ধুবান্ধব আছেন এবং অফিসের সহকর্মীদেরও খবর দিয়েছিলেন প্রবোধবাবুর এই কুচিন্তার কথা। তাঁরা পর পর ক-দিন এসে তাঁকে অনেক করে বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন তোমাকে আমরা সকলেই ভালোবাসি প্রবোধ। তুমি এমন আর কোরো না। তাতে যে প্রবোধবাবুর মন কিছু প্রবোধ পেয়েছিল এমন মনে হয়নি।
কয়েকদিন হিতার্থীদের ভিড় ছিল বাড়িতে। তারপর একে একে সকলেই আসা বন্ধ করলেন। সকলেরই কাজ আছে। তা ছাড়া, প্রায় বোবা ও প্রায়-অন্ধ এক জন মানুষ যার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগই প্রায় অসম্ভব, তাঁর কাছে রোজ রোজ এসে করবেনই-বা কী তাঁরা। আবার সেই একা ঘরের অভিশপ্ত জীবনে ফিরে যান প্রবোধবাবু।
সুবোধবাবুর স্ত্রী নমিতা সময় পেলেই আসে দাদার ঘরে। কিন্তু সে একটি স্কুলে পড়ায়। তার স্কুল, পরীক্ষার খাতা দেখা এসব নিয়ে সেও খুবই ব্যস্ত থাকে। ইচ্ছে থাকলেও সে বেশি আসতে পারে না। কারোকেই দোষারোপ করেন না। প্রবোধবাবু শুধুমাত্র নিজেকেই দোষারোপ করেন। নিরুচ্চারে। তাঁর পরিবারের সকলের জীবন, পাড়ার সকলের জীবন, বেগবতী নদীর মতো বয়ে যায় তাঁর সামনে দিয়ে, তিনি একা দাঁড়িয়ে থাকেন তীরে। জলরাশি দেখতে পান না। জলের শব্দ শুনতে পান, জলের গন্ধ পান। সব নারীর, রেশমির যেমন, আলাদা আলাদা গন্ধ আছে। নদীর, জীবনের নদীরও আলাদা গন্ধ আছে।
ছোটো ভাই সুবোধ, সুবোধের স্ত্রী নমিতা এবং ছোটকু তিনদিকে বেরিয়ে পড়ে প্রবোধবাবুকে খুঁজতে। যে মানুষ চোখে দেখেন না তিনি কতদূরেই বা যেতে পারেন। মন্দাকিনী নিজের কপাল চাপড়ায়। সুবোধ আর মিনতির একমাত্র মেয়ে, যার বয়স চার, জ্যাঠাযজ্যাঠা করে বিলাপ করতে থকে। প্রতিবেশীরা খবর পেয়ে যাবার পরে তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েন। প্রবোধবাবুকে খুজতে। বেলা দশটা নাগাদ সকলেই ফিরে আসেন। থানাতে ফোন করেন। কাছাকাছি সব হাসপাতালেও ফোন করা হয়। কেউই কোনো খবর দিতে পারে না। যে মানুষ। নিজের নাম বলতে পারেন না, নিজের ঠিকানা বলতে পারেন না তাঁকে তো খুঁজে পাওয়াও। মুশকিলই। দুর্ঘটনা ঘটলে হাসপাতালে কেউ নিয়ে গেলেও তো নাম ঠিকানা বলতে পারবেন না উনি। সঙ্গে নিজের পরিচয়ের কোনো প্রমাণও নেই। বাড়িতে কাচা পায়জামা আর ফতুয়া পরে। বেরিয়ে গেছেন উনি।
দিন পেরিয়ে রাত কাটল। তারপর রাতও পোহাল কিন্তু প্রবোধবাবুর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। পরদিন সকালে সবকটি খবরের কাগজ কিনলেন সুবোধ। যদি কোনো খবর পাওয়া যায় না। কোনো কাগজেই কোনো খবর নেই। নমিতা বলল, দূরদর্শনের সবকটি চ্যানেলে, মানে যারা এসব খবর দেয়–নিরুদ্দিষ্টদের খবর তাদের ফোন করে জানানো হোক দাদার একটি ছবি দিয়ে।
সুবোধ বললেন, ঠিক আছে। তাই করব। ছোটকু নমিতাকে বলল, বউদি, রেশমিদিদির বাড়িতে একটা ফোন করলে হয় না?
নমিতা রেশমিকে পছন্দ করত নাবিশেষ। মেয়েতে মেয়েতে নানাধরনের বৈরিতা থাকে যা পুরুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এই বৈরিতার কারণ ছোটকুও বুঝতে পারত না। নমিতা, বলল, ওঁকে ফোন করে কী হবে? তোর রেশমি মাসি কি মন্ত্র জানে? না গুনতে জানে?
তারপর সুবোধকে বলল, আজকে স্কুল ইনসপেক্টর আসবেন, আজকে কামাই করলে চাকরিটাই নট হয়ে যাবে।
৩.
রেশমি খুব সকালে চান করে। তারপর পিঠের উপরে খোলা চুল মেলে দিয়ে পুজো করে ঠাকুর ঘরে। তারপর ছেলের সঙ্গে বসে প্রাতঃরাশ খায়। ছেলে আটটা সোয়া আটটাতে বেরিয়ে যায়। আসেও রাত করে। ওদের অফিসেরই একটি মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব। হয়তো তাকেই বিয়ে করবে। মেয়েটি মাঝে মাঝে আসে বাড়িতে। বেশমিষ্টি মেয়ে এবং উচ্চ শিক্ষিতা এবং প্রতিষ্ঠাতা হলেও দুর্বিনীত নয় এবং বাঙালিয়ানা পুরোপুরি আছে।
রেশমি পুজো করছিল, তখনই দরজার কলিং বেলটা বাজল। অবাক হল রেশমি। দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা, ফুলওয়ালা তো এসে গেছে অনেক আগেই। এখন তো কারো আসার কথা নেই। একটু পরে সবসময়ের কাজের মেয়ে মীনা হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে দোতলাতে উঠে পুজোর ঘরের ভেজানো দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে উত্তেজিত গলাতে বলল, মা! তের নম্বরের বাবু। এসেছেন। অবাক হয়ে চেয়ে রইল রেশমি। মনে মনে বিড় বিড় করে বলল, তেরো নম্বরের বাবু? প্রবোধবাবুদের বাড়ি এবং ওদের বাড়ি গলির একই ফুটপাথে। প্রবোধবাবুর বাবা এবং রেশমির বাবা বন্ধু ছিলেন। প্রায় একই সময়ে দুজনেই বাড়ি করেছিলেন যতু মিত্তিরের কাছ থেকে জমি। কিনে। তবে প্লট দুটো পাশাপাশি হয়নি। প্রবোধবাবুদের বাড়ি তেরো নম্বর আর রেশমিদের বাড়ি দু-নম্বর।
রেশমি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নীচে নেমে দেখে নীচের বসার ঘরের সোফাতে আধশোয়া হয়ে বসে। আছেন প্রবোধ। আহা! বেচারা কতদিন বাইরে বেরোন না। না-হেঁটে হাঁটার ক্ষমতাই চলে গেছে। শারীরিক কষ্টর চেয়েও তাঁর মানসিক কষ্ট যেন অনেক বেশি। চোদ্দো বছর বয়স হয়ে যাওয়া। কুকুর মৃত্যুর আগে নীরবে যেমন করে ভালোবাসার মনিবের মুখে চেয়ে থাকে, ঠিক তেমন করে প্রবোধবাবু চেয়ে রইলেন। রেশমির মুখ তো দেখতে পারেন না! মুখটি শুধু তুললেন রেশমির দিকে।
রেশমির ছেলে, প্রযত এসে বলল, প্রবোধ মামা! তারপর রেশমির দিকে চেয়ে বিস্মিয়াভিভূত হয়ে বলল, এলেন কী করে!
জানি না।
অস্ফুটে বলল রেশমি।
তারপর বলল, বোধহয় দেওয়াল ধরে ধরে এসেছেন। জানি না, কী করে এলেন।
প্রযত বলল, মা আজ আমাদের এক ডিরেক্টর আসছেন ব্রাসেলস থেকে, আমি এখনই বেরুচ্ছি। তুমি প্রবোধ মামাকে ভালো করে দেখাশোনা কোরো।
ব্রেকফাস্ট খাবি না?
খেয়েছি। পদুদা ডিমের পোচ আর টোস্ট করে দিয়েছিল আর কফি, তুমি যখন চান করছিলে। প্রত চলে গেলে রেশমি এসে প্রবোধবাবুর হাত ধরে ধীরে ধীরে দোতলাতে উঠে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, সারাদিনে তোমাকেও অনেক ওষুধ খেতে হয়। সেই সব ওষুধ না খাওয়ালে তোমার বাড়ির মানুষেরা আমাকে বকবেন না।
দোতলাতে রেশমির ঘরে ঢুকে বিছানাতে শুয়ে পড়লেন প্রবোধবাবু। ভাবছিলেন, প্রত্যেক মেয়ের গায়ে যেমন আলাদা গন্ধ, তাদের ঘরেও আলাদা গন্ধ। রেশমির ভেজা চুল থেকে জবাকুসুমের। গন্ধ বেরুচ্ছিল। উত্তর কলকাতার মেয়েরা আজও চুলে তেল মাখে, শাড়ি পরে, বাঙালি রান্না খায়, পিৎজা আর চাওমিয়েন আর ম্যাকড়োনাল্ড-এর বিজাতীয় সংস্কৃতি এখনও গ্রাস করেনি উত্তর কলকাতা এবং মফস্বলের বাংলাকে। প্রবোধবাবুর এই কথা ভেবে ভালোলাগে।
রেশমির বালিশে জবাকুসুম তেলের গন্ধ, তার বুকের খাঁজে মা-মাসিমারা যে পাউডার মাখতেন সেই কিউটিকুরা পাউডারের গন্ধ। তার উরুসন্ধিতে তুহিনার গন্ধ।
প্রবোধবাবু পকেট থেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা বের করে দিলেন রেশমিকে। রেশমী বলল, বাঃবুদ্ধি করে এটা ভাগ্যিস এনেছ। তোমাকে আমি এমন করে লুকিয়ে রাখব, আমার মধ্যে যে, তোমাকে আর কেউই খুঁজে পাবে না। দেখো তুমি।
তারপরই বলল, কিন্তু সত্যি কথা বলোতো, তোমাকে কি কেউ পৌঁছে দিয়ে গেল আমার বাড়িতে?
প্রবোধবাবু নিজের ডান হাতের তিনটে আঙুল নাকে ছোঁয়ালেন।
রেশমি বুঝল যে উনি বোঝাতে চাইছেন যে উনি গন্ধ চিনে এসেছেন এখানে। ভাগ্যিস তার নাক আর কান এখনও তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। রেশমির ঘরের মেঝে কোনো সুগন্ধ তরল সাবানে মোছা হয় নিশ্চয়ই। ভারি মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে। বিছানা ও বালিশের ওয়াড়ও ধোওয়া হয় কোনো সুগন্ধি সাবানে। ভারি আবেশ লাগছে সেই সুগন্ধে।
প্রবোধবাবু রেশমির বুকে মুখটি নামিয়ে প্রাণ ভরে তার শরীরের, তার বুকের খাঁজের গন্ধ নিলেন। হৃদয়ঙ্গম করলেন যে, ডাক্তারের লম্বা প্রেসক্রিপশনের ওষুধ নয়, পুরুষের যে কোনো শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতার নিরাময় একমাত্র নারীসঙ্গই করতে পারে, প্রিয় নারীর সঙ্গ। পুরুষের বিশল্যকরণী নারীই।
রেশমি বলল, তুমি একটু একা থাক, আমি কিছু খাবার করে নিয়ে আসি।
প্রবোধবাবু গলাতে আঙুল ঠেকিয়ে বোঝালেন যে তিনি কিছু খেতে পারেন না।
তোমার জন্যে পাতলা সুজির হালুয়া করে আনছি, কিসমিস দিয়ে। পারবে খেতে। আর চা, কম দুধ, কম চিনি দিয়ে, তুমি যেমন পছন্দ করো। রেশমি চলে গেলে প্রবোধবাবু উঠে বসলেন। ঘরের জানালাগুলির পাখিগুলো অর্ধেক খোলা। আলো-ছায়ার জাফরি ঘরের সাদা পাথরের মেঝেতে। অনেক দিনের পুরোনো সিলিং ফ্যানটা খুব আস্তে ঘুরছে। পাখির মধ্যে দিয়ে আসা আলোকে মন্থন করছে সেই আলো। মৃদু কিসমিস শব্দ করে চড়াই ডাকছে জানালার বাইরে। মোবাইল ফোনেরা এখনও কলকাতার সব চড়াইকে মারতে পারেনি। ভারি সুগন্ধ এই ঘরে, ভারি স্নিগ্ধতা, ভারি শান্তি। প্রবোধবাবুর খুব ইচ্ছে করল যে, রেশমি তার জন্যে পাতলা সুজির হালুয়া করে নিয়ে আসার আগেই রেশমির খাটে, রেশমির ঘরে তার নিঃশ্বাস যেন থেমে যায়। তবে এখানেও তাঁর চিরঘুম আসবে না। একেবারে নিমতলাতে গিয়েই চিরঘুম ঘুমোবেন।
আঃ। ভারি শান্তি। মরবার সময়ে এমন প্রগাঢ় শান্তি তো প্রত্যেক মানুষেরই কাম্য। কিন্তু সেই মরণ ক-জনের ভাগ্যে থাকে? প্রবোধবাবুর মন বলছে, তিনি সত্যিই ভাগ্যবান।