পাতুর ঘরের আগুন
একা পাতুর ঘর নয়, পাতুর ঘরের আগুন ক্রমশ বিস্তৃত হইয়া সমস্ত হরিজন-পল্লীটাকেই পোড়াইয়া দিল। বড় বড় গাছের আড়াল পাইয়া খান-দুই-তিন ঘর কোনো রকমে বাঁচিয়াছে। বাকি ঘরগুলি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পুড়িয়া গিয়াছে। সামান্য কুটিরের মত নিচু-নিচু ছোট ছোট ঘর-বশের হালকা কাঠামোর উপর অল্প খড়ের পাতলা ছাউনি; কার্তিকের প্রথম হইতে বৃষ্টি না হওয়ায় রোদে শুকাইয়া বারুদের মত দাহ্যবস্তু হইয়াই ছিল; আগুন তাহাতে স্পর্শ করিবামা বিস্ফোরণের মতই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়া গেল। গ্রামের লোক অনেকেই ছুটিয়া। আসিয়াছিল—বিশেষ করিয়া অল্পবয়সী ছেলের দল। তাহারা চেষ্টাও অনেক করিয়াছিল, কিন্তু জল তুলিবার পাত্রের অভাব এবং বহ্নিমান সঙ্কীর্ণ চালাগুলিতে দাঁড়াইবার স্থানের অভাবে তাহারা কিছু করিতে পারে নাই। তাহাদের মুখপাত্র ছিল জগন ডাক্তার। অগ্নিদাহের সমস্ত সময়টা চিৎকার করিয়া সেনাপতির মত আদেশ দিয়া ও উপদেশ বাতলাইয়া এমন গলা ফাটাইয়া ফেলিল যে, আগুন নিবিতে নিবিতে তাহার গলার আওয়াজও বসিয়া গেল।
রাত্রে উহাদের সকলকে চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া শুইতে অনুমতি দেওয়া হইল; কিন্তু আশ্চর্য মানুষ উহারা—কিছুতেই ওই পোড়া ভিটার মায়া ছাড়িয়া আসিল না। সমস্ত রাত্রি পোড়া ঘরের আশপাশে কোনোরূপে স্থান করিয়া লইয়া হেমন্তের এই শীতজর্জর রাত্রিা কাটাইয়া দিল। ছেলেগুলা অবশ্য ঘুমাইল; মেয়েগুলা গানের মত সুর করিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া দিল, আর পুরুষেরা পরস্পরকে দোষ দিয়া নিজের কৃতিত্বের আস্ফালন করিল এবং দগ্ধগৃহের আগুন তুলিয়া ক্রমাগত তামাক খাইল।
প্রায় ঘরেই দু-একটা গুরু, দুই-চারিটা ছাগল আছে; আগুনের সময় সেগুলাকে তাহারা ছাড়িয়া দিয়াছিল। সেগুলা এদিকে-ওদিকে কোথায় গিয়া পড়িয়াছে রাত্রে সন্ধানের উপায় নাই। হাঁস-মুরগিও প্রত্যেকের ছিল; তাহার কতকগুলা পুড়িয়াছে, চোখে দেখা না গেলেও গন্ধে তাহা অনুমান করা যায়। যেগুলা পলাইয়া বাঁচিয়াছে—সেগুলা ইতিমধ্যেই আসিয়া আপন আপন গৃহস্থের জটলার পাশে পালক ফুলাইয়া যথাসম্ভব দেহ সঙ্কুচিত করিয়া বসিয়া গেল। অন্য সম্পদের মধ্যে কতকগুলা মাটির হাড়ি, দুই-চারিটা পিতল-কাসার বাসন, ড়ো-কাপড়ে তৈয়ারি জীৰ্ণমলিন দুর্গন্ধযুক্ত কয়েকখানা কথা ও বালিশ, মাদুর চ্যাটাই, মাছ ধরিবার পলুই, দু-চারখানা কাপড়—তাহার কতক পুড়িয়াছে বা পোড়া-চালের ছাইয়ের মধ্যে চাপা পড়িয়াছে। যে যাহা বাহির করিয়াছে—সে সেগুলি আপনার পরিবার বেষ্টনীর মাঝখানে—যেন সকলে মিলিয়া বুক দিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছে। শেষরাত্রের হিমেল তীক্ষতায় কুণ্ডলী পাকাইয়া সকলে কিছুক্ষণের জন্য কাতর ক্লান্তির নীরবতার মধ্যে কখন নিদ্ৰাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।
সকাল হইতেই জাগিয়া উঠিয়া মেয়েরা আর এক দফা কাঁদয়া শোকোচ্ছাস প্রকাশ করিতে বসিল। একটু রোদ উঠিতেই কোমর বাঁধিয়া মেয়ে-পুরুষে পোড়া খড়ের ছাইগুলা ঝুড়িতে করিয়া আপন আপন সারগাদায় ফেলিয়া ঘর দুয়ার পরিষ্কার করিতে লাগিয়া গেল। পাকা কাঠগুলি একদিকে গাদা করিয়া রাখা হইল; পরে জ্বালানির কাজে লাগিবে। ছাইয়ের গাদার ভিতর হইতে চাপাপড়া বাসন যাহার যাহা ছিল—সেগুলি স্বতন্ত্র করিয়া রাখিল। এ সমস্ত কাজ ইহাদের মুখস্থ। গৃহের উপর দিয়া এমন বিপর্যয় ইহাদের প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। প্রবল বর্ষা হইলেও ঘরগুলির জীর্ণ আচ্ছাদন থুবড়াইয়া ভাঙিয়া পড়ে, নদীর বাঁধ ভাঙিলে বন্যার জল আসিয়া পাড়াটা ড়ুবাইয়া দেয়, ফলে দেওয়ালসুদ্ধ ঘরগুলি ধসিয়া পড়ে। মধ্যে মধ্যে জ্বালানির জন্য সংগৃহীত শুকনা পাতায় তামাকের আগুন ও জ্বলন্ত বিড়ির টুকরা ফেলিয়া মদ্যবিভোর নিশীথে নিজেরাই ঘরে আগুন লাগাইয়া ফেলে। সব বিপর্যয়ের পর সংসার গুছাইবার শিক্ষা এমনি করিয়া পুরুষানুক্রমেই ইহাদের হইয়া আসিতেছে। ঘর-দুয়ার পরিষ্কারের পর আহার্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে। গত সন্ধ্যার বাসি ভাতই ইহাদের সকালের খাদ্য, ছোট ছেলেদের মুড়ি দেওয়া হয়; কিন্তু ভাত বা মুড়ি সবই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। ছোট বাচ্চাগুলা ইহারই মধ্যে চিৎকার আরম্ভ করিয়া দিয়াছে কিন্তু তাহার আর উপায় নাই। দুই-একজন মা ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলার পিঠে দুমদাম করিয়া কিল-চড় বসাইয়া দিল। রাক্ষসদের প্যাটে যেন আগুন লেগেছে। মর মর তোরা, মর!
ঘরদুয়ার পরিষ্কার হইয়া গেলে মনিব-বাড়ি যাইতে হইবে—তবে আহার্যের ব্যবস্থা হইবে। মনিবেরা এসব ক্ষেত্রে চিরকালই তাহাদিগকে সাহায্য করিয়া থাকেন। এ পাড়ার প্রায় সকলেই চাষীদের অধীনে খাটে, বাধা বাৎসরিক বেতন বা উৎপন্ন ভাগের চুক্তিতে শ্রমিকের কাজ করে। কেহ কেহ পেট-ভাতায় বা মাসে ভাতের হিসাবমত ধান লইয়া থাকে এবং ছোটগুলা পেট-ভাতায় বৎসরে চারখানা সাত হাত কাপড় লইয়া রাখালি করে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ছেলেরা মাসে আট আনা হইতে এক টাকা পর্যন্ত মাহিনা পায়—ধানের পরিমাণও তাহাদের বেশি। পূর্ণ জোয়ানদের অধিকাংশই উৎপন্নের এক-তৃতীয়াংশ পাইবার চুক্তিতে চাষে শ্রমিকের কাজ করে। মনিব সমস্ত চাষের সময়টা ধান দিয়া ইহাদের সংসারের সংস্থান করিয়া দেয়—ফসল উঠিলে ভাগের সময় সুদসমেত ধান কাটিয়া লয়। সুদের হার প্রায় শতকরা পঁচিশ হইতে ত্রিশ পর্যন্ত। অজার বৎসরের এই ঋণ শোধ না হইলে আসল এবং সুদ এক করিয়া তাহার উপর আবার ওই হারে সুদ টানা হয়। এই প্রথার মধ্যে অন্যায় কিছু ইহারা বোধ করে না বরং সকৃতজ্ঞ আনুগত্যের ভাবই অন্তরে ইহার জন্য পোষণ করে। দায়-দৈবে মনিবেরা যে সাহায্য করেন সেইটাই অতিরিক্ত করুণা। সেই করুণার ভরসাতেই আহার্যের চিন্তায় এখন তাহারা খুব ব্যাকুল। নয়। মেয়েরাও অবস্থাপন্ন চাষী-গৃহস্থের ঘরে সকালে-বিকালে বাসন মাজে, আবর্জনা ফেলিয়া পাট-কাম করে। মেয়েরাও সেখান হইতে কিছু কিছু পাইবে। এ ছাড়া দুধের দাম কিছু কিছু পাওনা আছে। সে পাওনা কিন্তু গ্রামে নয়। চাষীর গ্রামে চাষীদের ঘরে দুধ হয়। হরিজনেরা তাদের গরুর দুধ পাশের বড়লোকের গ্রাম কঙ্কণায় গিয়া বেচিয়া আসে। খুঁটেও সেখানে বিক্রয় হয়। কেহ কেহ জংশনে যায়।
পাতুর কিন্তু এসব ভরসা নাই। সে জাতিতে বায়েন বা বাদ্যকর অর্থাৎ মুচি। তাহার কিছু চাকরান জমি আছে। গ্রামের সরকারি শিবতলা, কালীতলা এবং পাশের গ্রামে চণ্ডীতলায় নিত্য ঢাক বাজায়। সেইহেতু বৎসরে দেবোত্তর সম্পত্তির কিছু ধান সে পিতামহদের আমল হইতে পাইয়া আসিতেছে। নিজের দুইটা হেলে বলদ আছে—তাই দিয়া সে নিজের জমির সঙ্গে ওই কঙ্কণার ভদ্রলোকের কিছু জমিও ভাগে চাষ করিয়া থাকে। এ ছাড়া ভাগাড়ের মরা গরু-মহিষের চামড়া ছাড়াইয়া পূর্বে সে চামড়া ব্যবসায়ী শেখদের বিক্রয় করিত। আপদে-বিপদে তাহারাই দু-চারি টাকা দাদনস্বরূপ দিত। কিন্তু সম্প্ৰতি জমিদার ভাগাড় বন্দোবস্ত করায় এদিকের আয় তাহার অনেক কমিয়া গিয়াছে। নেহাত পারিশ্রমিক অর্থাৎ তিন-চার আনা মজুরি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। ইহা লইয়া চামড়াওয়ালার সঙ্গে মনান্তরও হইয়াছে। সে কি আর এ সময় সাহায্য করবে? যে ভদ্রলোকের জমি ভাগে চাষ করে, সে কিছু দিলেও দিতে পারে; কিন্তু ভদ্রলোক খৎ না লেখাইয়া কিছু দিবে না। সেও অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার। খৎকে পাতুর বড় ভয়। শেষ পর্যন্ত নালিশ করিয়া বাড়িটা লইয়া বসিলে সে যাইবে কোথায়? পৃথিবীর মধ্যে তাহার। সম্পত্তি এই বাড়িটুকু।
আপন মনে ভাবিতে ভাবিতে পাতু দ্রুতগতিতে ছাই জড়ো করিয়া চলিয়াছিল। ছিরু পালের কাছে সেদিন মার খাইয়া তাহার মনে যে উত্তেজনা জাগিয়া উঠিয়াছিল—সে উত্তেজনা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। সে উত্তেজনাবশেই সেদিন অমরকুণ্ডার মাঠে দ্বারকা চৌধুরীর কাছে ছিরু পাল সম্পর্কে আপনার সহোদরা দুর্গার যে কলঙ্কের কথা প্রকাশ করিয়া নালিশ করিয়াছিল তাই লইয়াই গত সন্ধ্যায় স্বজাতির মধ্যে তাহার যথেষ্ট লাঞ্ছনা হইয়াছে। স্বজাতিরা কথাটা লইয়া ঘোট পাকাইয়া তাহাকে প্ৰশ্ন করিয়াছিল—তুমি তো আপন মুখেই এই কেলেঙ্কারির কথা চৌধুরী মহাশয়ের কাছে বলেছ, জমিদারের কাছারিতে বলেছ। বলেছ কি না?
–হ্যাঁ, বলেছি।
–তবে? তুমি পতিত হবে না কেন, তা বল?
কথাটা পাতুর ইহার পূর্বে ঠিক খেয়াল হয় নাই। সে চমকিয়া উঠিয়াছিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে হনহন করিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়া দুর্গার চুলের মুঠি ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া তাহাকে মজলিসের সম্মুখে হাজির করিয়াছিল। ধাক্কা দিয়া দুর্গাকে মাটির উপরে ফেলিয়া দিয়া বলিয়াছিল—সে কথা এই হারামজাদী ছেনাকে শুধাও! ভিনু ভাতে বাপ পড়শী; আমি ওর সঙ্গে পেথকান্ন!
দুর্গার পেছনে পেছনে তাহার মা চিৎকার করিতে করিতে আসিয়াছিল; সকলের পেছনে পাতুর বিড়ালীর মত বউটাও গুনগুন করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়াছিল। তারপর সে এক চরম অশ্লীল বাক-বিতণ্ডা। স্বৈরিণী দুর্গা উচ্চকণ্ঠে পাড়ার প্রত্যেকটি মেয়ের কুকীর্তির গুপ্ত ইতিহাস প্রকাশ করিয়া পাতুর মুখের ওপর সদম্ভে ঘোষণা করিয়া বলিয়াছিল-ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশি যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে। তোর কি? তাতে তোর কি? তু আমাকে খেতে দিস, না, দিবি? আপন পরিবারকে সামলাস তু।
পাতু আরও ঘা-কতক লাগাইয়া দিয়াছিল। পাতুর বউটি ঘোমটার ভিতর হইতে তীক্ষকণ্ঠে ননদকে গাল দিতে শুরু করিয়াছিল। মজলিসের উত্তাপের মধ্যে উত্তেজিত কলরব হাতাহাতির সীমানায় বোধ করি গিয়া পৌঁছিয়াছিল—ঠিক এই সময়েই আগুন জ্বলিয়া ওঠে।
এই দুই দিনের উত্তেজনা, তাহার উপর এই অগ্নিদাহের ফলে গৃহহীনতার অপরিমেয় দুঃখ তাহাকে রুদ্ধমুখ আগ্নেয়গিরির মত করিয়া তুলিয়াছিল। সে নীরবেই কাজ করিয়া চলিতেছিল, এমন সময় তার বউয়ের ছিচকান্না তাহার কানে গেল। সে এতক্ষণে ছাগল-গরুগুলিকে অদূরবর্তী খেজুরগাছগুলার গোড়ায় খেটা পুঁতিয়া দিল। তাহার পর হাঁসগুলিকে নিকটবর্তী পুকুরের জলে নামাইয়া দিয়া, স্বামীর কাজে সাহায্য করতে আসিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই গুনগুনানির কান্নার রেশও টানিয়া চলিল। পাতু হিংস্ৰ জানোয়ারের মত পাঁত বাহির করিয়া গৰ্জন করিয়া। উঠিল—এ্যাঁই দেখ, মিহি গলায় আর ঢং করে কাঁদিস না বলছি। মেরে হাড় ভেঙে দোব–হ্যাঁ।
ঘর পুড়িয়া যাওয়ার দুঃখে এবং সমস্ত রাত্রি কষ্টভোগের ফলে পাতুর বউয়ের মেজাজও খুব ভাল ছিল না, সে বন্যবিড়ালীর মত হিংস্র ভঙ্গিতে ফাঁস করিয়া উঠিল—ক্যানে, ক্যানে আমার হাড় ভেঙে দিবি শুনি? বলে দরবারে হেরে, মাগকে মারে ধরে—সেই বিত্তান্ত। নিজের ছেনাল বোনকে কিছু বলবার ক্ষোমতা নাই
পাতুর আর সহ্য হইল না, সে বাঘের মত লাফ দিয়া বউকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার বুকে বসিয়া গলা টিপিয়া ধরিল। তাহার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান তখন লোপ পাইয়া গিয়াছে।
পাতুর ঘরের সম্মুখেই একই উঠানের ওপাশে দুর্গা ও তাহার মায়ের ঘর। তাহারাও ঘরের ছাই পরিষ্কার করিতেছিল। বউয়ের কথা শুনিয়া দুৰ্গা দংশনোদ্যত সাপিনীর মতই ঘুরিয়া দাঁড়াইয়াছিল; পাতুর নির্যাতন ব্যবস্থা দেখিয়া বিজ্ঞভাবে ভাইকেই বলিলা বউকে একটুকুন শাসন কর, মাথায় তুলিস না।
সেই মুহূর্তেই জগন ডাক্তারের ধরা-গলা শোনা গেল, সে হা হা করিয়া বলিল ছাড় ছাড় হারামজাদা বায়েন, মরে যাবে যে!
কথা বলিতে বলিতে ডাক্তার আসিয়া পাতুর চুলের মুঠি ধরিয়া আকৰ্ষণ করিল। পাতু বউকে ছাড়িয়া দিয়া হাঁপাইতে পাইতে বলিল দেখেন দেখি হারামজাদীর আস্পা, ঘরে আগুনটাগুন লাগিয়ে–
–জল আন্, জল। জলদি, হারামজাদা গোয়ার-বলিয়া জগন হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িল। বউটা অচেতন হইয়া অসাড়ের মত পড়িয়া আছে। ডাক্তার ব্যস্ত হইয়া নাড়ি ধরিল।
পাতু এবার শঙ্কিত হইয়া ঝুঁকিয়া বউয়ের মুখের দিকে চাহিয়া অকস্মাৎ এক মুহূর্তে হাউ। হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল—ওগো, আমি বউকে মেরে ফেললাম গো।
পাতুর মা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল—ওরে বাবা, কি করলি রে?
ডাক্তার ব্যস্ত হইয়া বলিল—এরে জল, শিগগির জল আন।
দুর্গা ছুটিয়া জল লইয়া আসিল। সে বউয়ের মাথাটা কোলে তুলিয়া লইয়া বসিয়া বুকে হাত বুলাইতে আরম্ভ করিল, ডাক্তার ছপাছপ জলের ছিটা দিয়া বলিল—কই, মুখে মুখ দিয়ে ফুঁ দে দেখি দুগ্গা।
কিন্তু ফুঁ আর দিতে হইল না, বউ আপনিই একটা দীর্ঘ বিশ্বাস ফেলিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল। কিছুক্ষণ পরে সে উঠিয়া বসিয়া কাঁদিতে আরম্ভ কলিল—আমাকে আর কারুর মেমতা করতে হবে না রে, সংসারে আমার কেউ লাই রে। গলা তাহার ধরিয়া গিয়াছে, আওয়াজ বাহির হয় না; তবু সে প্রাণপণে চিৎকার আরম্ভ করিল।
জগন ডাক্তার কতগুলি ঘর পুড়িয়াছে গণনা করিয়া নোটবুকে লিখিয়া লইল; কতগুলি মানুষ বিপন্ন তাহাও লিখিয়া লইল। খবরের কাগজে পাঠাইতে হইবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে একটা আবেদনের খসড়া সে ইতিপূর্বেই করিয়া ফেলিয়াছে। স্থানীয় চার-পাঁচখানা গ্রামের অধিবাসীদের নিকট হইতে ভিক্ষা করিয়া খড়, বাঁশ, চাল, পুরনো কাপড়, অর্থ সংগ্রহের জন্য একটা সাহায্য-সমিতি গঠনের কল্পনাও মনে মনে ছকিয়া ফেলিয়াছে।
এ পাড়ার সকলকে ডাকিয়া ডাক্তার বলিল—সর আপন আপন মনিবের কাছে যা, গিয়ে বল-দুটো করে বাঁশ, দশ গণ্ডা করে খড়, পাঁচ-সাত দিনের মত খোরাকি আমাদের দিতে হবে। আর যা লাগবে—চেয়ে-চিন্তে আমি যোগাড় করছি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে একটা দরখাস্ত দিতে হবে আমি লিখে রাখছি, ও বেলায় গিয়ে সব টিপসই দিয়ে আসবি।
সকলে চুপ করিয়া রহিল, ম্যাজিস্ট্রেটের নামে তাহারা ভড়কাইয়া গিয়াছে। সাহেব-সুবাকে ইহারা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলিয়াই জানে, কনস্টেবল দাবোগার উপরওয়ালা হিসাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নামে তাহাদের আতঙ্ক বহুগুণ বাড়িয়া যায়। তাহার কাছে দরখাস্ত পাঠাইয়া আবার কোন ফ্যাসাদ বাধিবে কে জানে!
জগন বলিলবুঝলি আমার কথা? চুপ করে রইলি যে সব!
এবার সতীশ বাউরি বলিল—আজ্ঞে সায়েবের কাছে—
–হ্যাঁ, সায়েবের কাছে।
–শেষে, আবার কি-না-কি ফ্যাসাদ হবে মশায়!
ফ্যাসাদ কিসের রে? জেলার কর্তা, প্রজার সুখ-দুঃখের ভার তার ওপর। দুঃখের কথা জানালেই তাঁকে সাহায্য করতে হবে।
–আজ্ঞে, উ মশায়—
–উ আবার কি?
–আজ্ঞে, কনস্টেবল-দারোগা-থানা-পুলিশ–টানা-হ্যাঁচড়া-কৈফেত—সে মশায় হাজার হাঙ্গামা!
ডাক্তার এবার ভীষণ চটিয়া গেল। তাহার কথায় প্রতিবাদ করিলে সে চটিয়াই যায়! তাহার উপর এই লোক-হিতৈষণা উপলক্ষ করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত পরিচিত হওয়ার একটা প্রবল বাসনা তাহার ছিল। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সভ্যশ্রেণীভুক্ত হইবার আকাঙ্ক্ষা তাহার অনেক দিনের; কেবলমাত্র মান-মর্যাদা লাভের জন্যই নয়, দেশের কাজ করিবার আকাঙ্ক্ষাও তাহার আছে। কিন্তু কঙ্কণার বাবুরাই ইউনিয়ন বোর্ডের সমস্ত সভ্যপদগুলি দখল করিয়া রহিয়াছে। ইউনিয়নের সমস্ত গ্রামগুলিই কঙ্কণার বিভিন্ন বাবুদের জমিদারি। গতবার জগন ঘোষ বোর্ডের ইলেকশনে নামিয়া মাত্র তিনটি ভোট পাইয়াছিল। সরকার তরফ হইতে মনোনীত সভ্যপদগুলিও কঙ্কণার বাবুদের একচেটিয়া। সাহেব-সুবোরা উহাদিগকেই চেনে, কঙ্কণাতেই তাহারা আসে যায়, সভ্য মনোনয়নের সময়ও এই দরখাস্তগুলিই মঞ্জুর হইয়া যায়। এই কারণে এমন একটি পরহিতব্রতের ছুতা লইয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সহিত দেখা করিবার সঙ্কল্পটি ডাক্তারের বহু আকাঙ্ক্ষিত এবং পরম কাম্য। সেই সঙ্কল্প পূরণের পথে বাধা পাইয়া ডাক্তার ভীষণ চটিয়া উঠিল। বলিল—তবে মর গে তোরা, পচে মৰ্ব গে। হারামজাদা মুখর দল সব।
—কি, হল কি ডাক্তার—বলিয়া ঠিক এই মুহূর্তটিতেই বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী পিছনের গাছপালার আড়াল অতিক্ৰম করিয়া সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। চৌধুরী ইহাদের এই আকস্মিক বিপদে সহানুভূতি প্ৰকাশ করিতে আসিয়াছেন। এ তাহাদের পূর্বপুরুষের প্রবর্তিত কর্তব্য! সে কৰ্তব্য আজও তিনি যথাসাধ্য পালন করেন। ব্যবস্থাটার মধ্যে দয়ারই প্রাধান্য, কিন্তু প্রেমও খানিকটা আছে।
ডাক্তার চৌধুরীকে দেখিয়া বলিল—দেখুন না, বেটাদের মুখুমি। বলছি, ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে একটা দরখাস্ত কর। তা, বলছে কি জানেন? বলছে, থানা-পুলিশ-দারোগাসায়েব-সুবো-বেজায় হাঙ্গামা।
চৌধুরী বলিল, তা মিছে বলে নাই—এর জন্যে আর সায়েব-সুবো কেন ভাই? গাঁয়ের পাঁচজনের কাছ থেকেই তো ওদের কাজ হয়ে যাবে! ধর, আমি ওদের প্রত্যেককে দুগণ্ডা করে খড় দেব, পাঁচটা বাঁশ দোব; এমনি করে—
ডাক্তার আর শুনিল না, হনহন করিয়া সে চলিতে আরম্ভ করিল। যাইবার সময় সে বলিয়া গেলযাস বেটারা এর পর আমার কাছে। আরও কিছুদূর আসিয়া আবার দাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া বলিল-কাল রাত্রে কে কোথায় ছিল রে? কাল রাত্রে? চৌধুরীর কথায় সে বেজায় চটিয়া গিয়াছে।
চৌধুরী একটু চিন্তা করিয়া বলিলতা দরখাস্ত করতেই বা দোষ কি বাবা সতীশ? ডাক্তার যখন বলছে। আর সায়েবের যদি দয়াই হয়—সে তো তোমাদেরই মঙ্গল! তাই বরং তোমরা। যেও ডাক্তারের কাছে।
সতীশ বলিল হাঙ্গামা কিছু হবে না তো চৌধুরী মশায়? আমাদের সেই ভয়টাই বেশি নাগছে কিনা।
–ভয় কি? হাঙ্গামাও কিছু হবে বলে তো মনে নেয় না বাবা! নানা—হাঙ্গামা কিছু হবে না–
অপরাত্নে সকলে দল বাঁধিয়া ডাক্তারের কাছে হাজির হইল। আসিল না কেবল পাতু।
ও বেলার ক্রুদ্ধ ডাক্তার এ বেলায় তাহাদের আসিতে দেখিয়া খুশি হইয়া উঠিয়াছিল; বেশ করিয়া সকলকে দেখিয়া লইয়া বলিলপাতু কই, পাতু?
সতীশ বলিলপাতু আজ্ঞে আসবে না। সে মশাই গায়েই থাকবে না বলছে।
–গাঁয়েই থাকবে না? কেন, এত রাগ কেন রে?
—সে মশায় সে-ই জানে। সে আপনার,–উ-পারে জংশনে গিয়ে থাকবে। বলে, যেখনে খাটবে সেখানেই ভাত।
—দেবোত্তরের জমি ভোগ করে যে!
-জমি ছেড়ে দেবে মশায়। বলে ওতে পেট ভরে না, তা উঁকি হবে। উ-সব বড়নোকের কথা ছেড়ে দেন। পাতু বায়েন আমাদের বড়নোক উকিল ব্যালেস্টারের শামিল।
—আহা তাই হোক। সে বড়নোকই হোক। তোমার মুখে ফুলচন্নন পড়ুক। দলের পিছনে ছিল দুর্গা, সে ফোঁস করিয়া উঠিল। তারপর বলিল—সে যদি উঠেই যায় গা থেকে, তাতে নোকের কি শুনি? উকিল ব্যালেস্টার—সাত-সতের বলা ক্যানে শুনি? সে যদি চলেই যায় তাতে তো ভাল হবে তোদেরই। ভিক্ষের ভাগ তোদের মোটা হবে।
জগন ডাক্তার ধমক দিয়া উঠিল—থাম, থাম দুর্গা।
–ক্যানে, থামব ক্যানে? কিসের লেগে? এত কথা কিসের?—বলিয়াই সে মুখ ফিরাইয়া আপনার পাড়ার দিকে পথ ধরিল।
–ওই! এই দুৰ্গা, টিপ-সই দিয়ে যা!
–না-–।
–তা হলে কিন্তু সরকারি টাকার কিছুই পাবি না তুই।
এবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া মুখ মুচকাইয়া দুর্গা বলিল-আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো। তোমার তালগাছ বিক্রি আছে শুনে এসেছিলাম কিনতে। গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি! সে আবার মুহূর্তে ঘুরিয়া আপনার মনেই পথ চলিতে আরম্ভ করিল।
পথে বাঁশ-জঙ্গলে ঘেরা পাল-পুকুরের কোণে আসিয়া দুৰ্গা দেখিল বাঁশবনের আড়ালে শ্ৰীহরি পাল দাঁড়াইয়া আছে। দুর্গা হাসিয়া দুই হাত জড়ো করিয়া একটা পরিমাণ ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলিলটাকা চাই! এই এতগুলি! ঘর করব। বুঝেছ?
শ্ৰীহরি কথাটা গ্রাহ্য করিল না, প্ৰশ্ন করিলকিসের দরখাস্ত হচ্ছে রে?
—ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে। ঘর পুড়ে গিয়েছে—তাই।
শ্ৰীহরি শুনিবামাত্র অকারণে চমকিয়া উঠিল, পরক্ষণেই মুখখানা ভয়ঙ্কর করিয়া তুলিয়া চাপা গলায় বলিল,—তাই আমাকে সুবে করে দরখাস্ত করছে বুঝি শালা ডাক্তার? শালাকে–
দুর্গার বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে শ্ৰীহরিকে চেনে। ছিরু পাল ছোট খোকার মত দেয়ালা করিয়া অকারণে চমকিয়া ওঠে না। স্থির তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতেই অপরাধীকে চিনিয়া ফেলিল এবং বলিল,া গো, তুমিই যে দিয়েছ আগুন!
শ্ৰীহরি হাসিয়া বলিল, কে বললে দিয়েছি! তুই দেখেছিস? সে আর কথাটা দুর্গার কাছে গোপন করিতে চাহিল না।
দুর্গা বলিল,—ঠাকুর ঘরে কে রে? না, আমি তো কলা খাই নাই। সেই বৃত্তান্ত। হ্যাঁ দেখেছি বৈকি আমি।
—চুপ কর, এতগুলো টাকাই দোব আমি।
দুৰ্গা আর উত্তর করিল না। ঠোঁট বাঁকাইয়া বিচিত্র দৃষ্টিতে শ্ৰীহরির দিকে মুহূর্তের জন্য চাহিয়া দেখিয়া আপন পথে চলিয়া গেল। দন্তহীন মুখে হাসিয়া ছিরু তাহার গমনপথের দিকে চাহিয়া রহিল।