হরেন ঘোষালের উত্তেজনা
হরেন ঘোষালের উত্তেজনা—সে এক ভীষণ ব্যাপার! সে গোটা গ্রামটার পথে পথে ঘোষণা করিয়া দিল–প্রজা-সমিতির মিটিং! প্রজা-সমিতির মিটিং! স্থানটার উল্লেখ করিতে সে ভুলিয়াই গেল। ঠিক ছিল মিটিং হইবে ওই বাউরিপাড়ার ধর্মরাজতলায়। কিন্তু ঘোষাল সে-কথা উল্লেখ করিতে ভুলিয়া যাওয়ায় লোকজন আসিয়া জমিল নজরবন্দিবাবুর বাসার সম্মুখে। কারণ প্রজা-সমিতির সকল উৎসই যে ওখানেই।
হরেন বলিল—তবে এইখানেই হোক। আবার এখান থেকে ওখানে। তা ছাড়া এখানে চা করা যাবে দরকার হলে। চেয়ার-টেবিল রয়েছে এখানে। এখানেই হোক।
সঙ্গে সঙ্গে সে যতীনের টেবিল-চেয়ার টানিয়া বাহিরে আনিয়া রীতিমত সভার আসর সাজাইয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে দুই গাছা মালাও সে গাঁথিয়া ফেলিয়াছে। ওটাতে তাহার ভুল হয় না।
লোকজন অনেক জমিয়াছে। বাউরিবায়েনরা প্রায় সকলেই আসিয়াছে। গ্রামের চাষীরাও আসিয়াছে। বিশেষ করিয়া আজিকার গরু খোঁয়াড়ে দেওয়ার জন্য সকলেই বেশ একটু উত্তেজিতও হইয়াছে। ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বধ জমিদারের খাসখতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত হইলেও ওই বাঁধ তৈয়ারি করিয়াছে তো প্রজারাই। সেখানে চিরকাল লোক গরু চরাইয়া থাকে। গ্রামের পতিত জমিও আবহমানকাল গোচারণভূমি হিসাবে লোকে ব্যবহার করিয়া আসিতেছে। সেখানে গোচারণ করিবার অধিকার নাই—এই কথায় সকলকেই উত্তেজিত করিয়াছে। আজ ওই অন্যায় আইন বাউরিবায়েনদের পক্ষে প্রযুক্ত হইল-কাল যে সকলের পক্ষেই তা প্রযোজ্য হইবে না তাহাকে বলিল? বাউরিরা অবশ্য এত বোঝে নাই। তাহারা শুনিয়াছে—পণ্ডিতমশায় কমিটির কর্তা হইবেন। তাই শুনিয়াই তাহারা সকৃতজ্ঞচিত্তে আসিয়াছে। নিৰ্ভয়ে আসিয়াছে।
তাহাদের পাড়ায় আজ ঘরে ঘরে পণ্ডিতের কথা। দুর্গার মা পর্যন্ত মুক্তকণ্ঠে আশীর্বাদ করিতেছে। মাথার চুলের মত পেরমাই হবে, সোনার দোতকলম হবে, বেটার কোলে বেটা হবে, লক্ষ্মী উথলে উঠবে। সোনার মানুষ, পণ্ডিত-জামাই আমার সোনার মানুষ!
সন্ধ্যার সময় আপনার ঘরে বালিশে বুক রাখিয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিয়া দুর্গাও ওই কথা ভাবিতেছিল—সোনার মানুষ, পণ্ডিত সোনার মানুষ, বিলু-দিদি তাহার ভাগ্যবতী! আজ ওই সুকুমার নজরবন্দিবাবুটিও পণ্ডিতের তুলনায় হীনপ্ৰভ হইয়া গিয়াছে। তাহার ইচ্ছা—একবার মজলিসে যায়, দশের মধ্যে পণ্ডিত উঁচু করিয়া বসিয়া আছে, সেই দৃশ্যটি আড়ালে দাঁড়াইয়া থাকিয়া একবার দেখিয়া আসে। আবার ভাবিলনা, মজলিস ভাঙক, সে বিলু-দিদির বাড়ি যাইবে, গিয়া পণ্ডিত-জামাইয়ের সঙ্গে দুইটা রসিকতা করিয়া উত্তরে কয়েকটা ধমক খাইয়া আসিবে। সে ভাবিতেছিল—কি বলিয়া কথা আরম্ভ করিবে।
আবার ওদিকে নজরবন্দিকে বলিবার মত অনেক কথা তাহার মনে ঘুরিতেছে।
—মউ-ফুলের মধু কেমন লাগল বাবু?
আপন মনে দুর্গা হাসিল। বাবুর চোখের কোণে লালচে আমেজ সে স্পষ্ট দেখিয়াছে।–কিন্তু পণ্ডিতকে সে কি বলিবে?
দুর্গার কোঠার সম্মুখে অমরকুণ্ডার মাঠ, তারপর নদীর বাঁধ। বাঁধের উপর দিয়া একটা আলো আসিতেছে। আলোটা মাঠে নামিল।
পণ্ডিত বড় গম্ভীর লোক। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তারপর সহসা সে আনন্দে চঞ্চল হইয়া উঠিল। কথা সে খুঁজিয়া পাইয়াছে।
—জামাই-পণ্ডিত, তুমি ভাই আবার পাঠশালা খোল!
–কে পড়বে?
–কেউ না পড়ে আমি পড়ব। নেকাপড়া শিখব আমি–
ওঃ, আলোটা তাহাদের গ্রামেই আসিতেছে। হাতে ঝুলানো লণ্ঠনের আলোয় চলন্ত মানুষের গতিশীল পা দুখানা বেশ দেখা যাইতেছে। কে? কাহারা? এক জন লণ্ঠন হাতে আসিতেছে, পিছনে এক জন—এক জন নয়, দুই জন; বায়েনপাড়ার প্রান্ত দিয়াই ঢুকিবার সোজা পথ? সেই পথে আগন্তুকেরা কাছে আসিয়া পড়িল।
দুর্গা চমকিয়া উঠিল। এ কি! এ যে আলো হাতে ভূপাল থানাদার, তাহার পিছনে ও যে জমাদারবাবু! জমাদারের পিছনে সেই হিন্দুস্থানি সিপাহিটা! ছিরু পালের বাড়িতে চলিয়াছে নিশ্চয়।
ছিরু পালের নিমন্ত্রণে রাত্রে জমাদারের আগমন এমন কিছু নূতন কথা নয়। পূর্বে এমন আসরে দুর্গারও নিয়মিত নিমন্ত্রণ হইত। কিন্তু পালের নিমন্ত্রণে জমাদারের সঙ্গে তো সিপাহি থাকার কথা নয়! জমাদারবাবুর আজ এমন পোশাকই বা কেন? সে যে একেবারে খাঁটি জমাদারের পোশাক অ্যাঁটিয়া আসরে আসিতেছে! সিপাহির মাথায় পাগড়ি, তা ছাড়া শ্রীহরির নিমন্ত্রণের আসর তো প্রথম রাত্রে বসে না! সে আসর বসে মধ্যরাত্রে বারটা নাগাদ।
দুর্গা হঠাৎ একটু চকিত হইয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িয়া গেল নজরবন্দিকে, জামাইপণ্ডিতকে। কেন সে তাহা জানে না। কিন্তু তাহাদের দুজনকেই মনে হইল। সে তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িল। শুক্ল-ষষ্ঠীর চাঁদ তখন অস্ত গিয়াছে। অন্ধকারে আত্মগোপন করিয়া পথের পাশের জঙ্গলের মধ্য দিয়া সে তাহাদের অনুসরণ করিল।
চণ্ডীমণ্ডপ আজ অন্ধকার। ছিরু পাল আজ চণ্ডীমণ্ডপে বসে নাই। পালের পাল নয়, আজকাল ঘোষমশায়! ঘোষমশায়ের খামারবাড়ির বৈঠকখানাঘরে আলো জ্বলিতেছে। ভূপালের আলো গিয়া ওইখানেই প্রবেশ করিল। নিমন্ত্রণই বটে। চণ্ডীমণ্ডপ দেবস্থল, সেখানে এ আসর চলে না। কিন্তু শ্রীহরি আজকাল নাকি কথাটা মনে পড়িতেই দুৰ্গা না হাসিয়া পারিল না।
এক-একটা গুরু রাত্রে দড়ি ছিঁড়িয়া মাঠে যাইয়া ফসল খাইয়া ফেরে। যে গরু এ আস্বাদ একবার পাইয়াছে সে আর ভুলিতে পারে না। শিকল দিয়া বাধিলেও সে খুঁটা উপড়াইয়া রাত্রে মাঠে যায়। ছিরু পাল নাকি সাধু হইয়াছে। তাই সে হাসিল। কিন্তু নূতন নারীটি কে? একজন কেহ আছেই। কিন্তু সে কে? দুর্গা কৌতুক সংবরণ করিতে পারিল না। শ্ৰীহরির বাড়ির গোপনতম পথের সন্ধান পর্যন্ত তাহার সুবিদিত, কত রাত্রে সে আসিয়াছে। চুড়িগুলি হাতের উপরে তুলিয়া নিঃশব্দে আসিয়া সে শ্ৰীহরির ঘরের পিছনে দাঁড়াইল। ঘরের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাইতেছিল।
সে কান পাতিল।
জমাদার বলিতেছিল নিৰ্ঘাত দু বছর ঠুকে দোব।
শ্ৰীহরি বলিল—চলুন তা হলে—জোর কমিটি বসেছে। জগন ডাক্তার, শালা হরেন ঘোষাল, গিরশে ছুতোর–অনে কামার তো আছেই। দেবু আর নজরবন্দিকে সব ঘিরে বসেছে। উঠুন তা
হলে।
জমাদার বলিলচাটা নিয়ে এস জলদি! চা খাওয়া হয় নি আমার।
শ্ৰীহরি খবর পাঠাইয়াছিল। নজরবন্দির বাড়িতে প্রজা-সমিতির কমিটি বসিয়াছে। জমাদার সাহেবের কাছে সেলাম পাঠানো হইয়াছিল, সেলামির ইঙ্গিতও ছিল। জমাদারের নিজেরও একটা প্রত্যাশা আছে। ডেটিনিউটিকে হাতেনাতে ধরিয়া ষড়যন্ত্র বা আইনভঙ্গ—যে কোনো মামলায় ফেলিতে পারিলে চাকরিতে পদোন্নতি বা পুরস্কার নিদেনপক্ষে বিভাগীয় একটা সদয়-মন্তব্য লাভ অনিবার্য। সেলামিটা ফাউ। সেলামিটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
দুর্গা শিহরিয়া উঠিল। নিঃশব্দে দ্রুতপদে সে ঘরের পিছন হইতে চলিয়া আসিয়া পথের উপর দাঁড়াইয়া কয়েক মুহূর্ত ভাবিয়া লইল। তাহার পর বেশ করিয়া চুড়ি বাজাইয়া ঝঙ্কার তুলিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। ঠিক পরমুহূর্তে প্রশ্ন ভাসিয়া আসিল—কে? কে যায়?
–আমি।
–কে আমি?
–আমি বায়েনদের দুৰ্গা দাসী।
–দুৰ্গা! আরে আরে–শোন্ শোন্!
–না।
ভূপাল আসিয়া এবার বলিল–জমাদারবাবু ডাকছে!
একমুখ হাসি লইয়া দুর্গা ভিতরে আসিয়া বলিল-আমরণ আমার! তাই বলি চেনা চেনা গলা মনে হচ্ছে—তবু চিনতে পারছি। জমাদারবাবু! কি ভাগ্যি আমার! কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আমি।
জমাদার হাসিয়া বলিলব্যাপার কি বল দেখি? আজকাল নাকি পিরীতে পড়েছিল? প্রথম অনে কামার, তারপর শুনছি নজরবন্দিবাবু!
দুর্গা হাসিয়া বলিলবলছে তো আপনার মিতে পালমশাই!
পরক্ষণেই সে বলিল-আজকাল আবার গোমস্তামশাই বলতে হবে বুঝি? ও গোমস্তামশাই মিছে বলেছে, মনের রাগে বলেছে।
বাধা দিয়া জমাদার বলিল—মনের রাগে? তা রাগ তো হতেই পারে। পুরনো বন্ধুলোককে ছাড়লি কেন তুই?
দুর্গা বলিল মুচিপাড়াকে-পাড়া আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিলে আপনার মিতে। ঘরে টিন দেবার জন্য টাকা চাইলাম, তা আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিলে আপনার বন্ধুনোক। সত্যিমিথ্যে শুধোন আপনি! বলুক ও ঘরে আগুন দিয়েছে কি না?
শ্ৰীহরির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। জমাদার তার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-দুর্গা কি বলছে, পালমশাই! জমাদারের কণ্ঠস্বর মুহূর্তে পাল্টাইয়া গিয়াছে।
দুর্গা লক্ষ্য করিয়া বুঝিল একটা বুঝাপড়ার সময় আসিয়াছে। সে বলিলঘাট থেকে আসি জমাদারবাবু! জমাদার দুর্গার কথার কোনো জবাব দিল না। সে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া ছিল শ্রীহরির দিকে। সে দৃষ্টির অর্থ দুর্গা খুব ভাল করিয়া জানে। জরিমানা আদায়ের পূর্বরাগ। এ পর্বটা শেষ হইতে বেশ কিছুক্ষণ লাগিবে। ঘাটে যাইবার জন্য বাহির হইয়া, তখনই ফিরিয়া দুর্গা লীলায়িত ভঙ্গিতে দেহে হিল্লোল তুলিয়া বলিল-আজ কিন্তু মাল খাওয়াতে হবে দারোগাবাবু! পাকী মাল! বলিয়াই সে বাহির হইয়া গেল ঘাটের দিকে।
শ্ৰীহরির খিড়কির পুকুরের পাড় ঘন জঙ্গলে ভরা। বাঁশের ঝাড়, তেঁতুল, শিরীষ প্রভৃতি গাছ। এমনভাবে জন্মিয়াছে যে দিনেও কখনও রৌদ্র প্রবেশ করে না। নিচেটায় জন্মিয়াছে ঘন কাঁটাবন। চারিদিকে উইঢ়িবি। ওই উইগুলির ভিতর নাকি বড় বড় সাপ বাসা বাঁধিয়াছে। শ্ৰীহরির। খিড়কির পুকুর সাপের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ চন্দ্রবোড়া সাপের জন্য। সন্ধ্যার পর হইতেই চন্দ্রবোড়ার শিস শোনা যায়। পুকুরঘাটে আসিয়া দুর্গা জলে নামিল না, সে প্রবেশ করিল ওই জঙ্গলে। নিশাচরীর মত নিঃশব্দে নিৰ্ভয় পদক্ষেপে দ্রুতগতিতে সে জঙ্গলটা অতিক্ৰম করিয়া আসিয়া নামিল এপাশের পথে। এখান হইতে অনিরুদ্ধের বাড়ি কাছেই। ওই মজলিসের আলো দেখা যাইতেছে। ছুটিয়া আসিয়া দুর্গা চকিতে ছায়াছবির মত অনিরুদ্ধের খিড়কির দরজা দিয়া বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া গেল।
প্রজা-সমিতির সভাপতি পরিবর্তনের কাজ তখন শেষ হইয়াছে। অনিরুদ্ধ চা পরিবেশন করিতেছিল, জগন ডাক্তার ভাবিতেছিল—বিদায়ী সভাপতি হিসাবে সে একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিবে। দেবু ভাবিতেছিল নূতন কর্মভারের কথা। সহসা একটি মূর্তি অন্ধকারের মধ্যে চকিতে অনিরুদ্ধের খিড়কির দরজার দিকে চলিয়া যাইতে সকলে চমকিয়া উঠিল। আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা, দ্রুত পদধ্বনির সঙ্গে আভরণের ঠুনঠান শব্দ!—কে? কে? কে গেল?
অনিরুদ্ধ দ্রুত বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। পদ্ম? এমন করিয়া সে কোথা হইতে ছুটিয়া আসিল? কোথায় গিয়াছিল সে?
–কর্মকার!
–কে?
–দুর্গা। দুর্গার কণ্ঠস্বর। ক্রোধে বিরক্তিতে অধীর হইয়া অনিরুদ্ধ দুর্গার সম্মুখীন হইল—কি?
দুর্গা সংক্ষেপে শ্ৰীহরির বাড়িতে জমাদারের আগমন সংবাদটা দিয়া যেমন আসিয়াছিল তেমনি দ্রুতপদে আভরণের মৃদু সাড়া তুলিয়া বিলীয়মান রহস্যের মত চকিতে মিলাইয়া গেল। ছুটিয়া সে আবার সেই পুকুরপাড়ের জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল।
ঘাটে হাত-পা ধুইয়া যখন শ্রীহরির ঘরে সে প্রবেশ করিল—তখন বোধহয় ঘরে-আগুন-দেওয়ার মামলা মিটিয়া গিয়াছে। জমাদারের চোখে প্ৰসন্ন দৃষ্টি। জমাদার দুর্গার দিকে চাহিয়া বলিল–হাঁপাচ্ছিস কেন?
আতঙ্কে চোখ বিস্ফারিত করিয়া দুর্গা বলিল—সাপ!
–সাপ! কোথায়?
–খিড়কির ঘাটে। এই প্রকাণ্ড বড়! চন্দ্রবোড়া। এই দেখুন জমাদারবাবু! বলিয়া সে ডান পা-খানি আলোর সম্মুখে ধরিল। একটা ক্ষতস্থান হইতে কাঁচা রক্তের ধারা গড়াইয়া পড়িতেছিল।
জমাদার এবং শ্রীহরি উভয়েই আতঙ্কিত হইয়া উঠিল। কি সৰ্বনাশ! জমাদার বলিলবাধ, বাঁধ! দড়ি, দড়ি! পাল, দড়ি নিয়ে এস!
শ্ৰীহরি দড়ির জন্য ভিতরে যাইতে যাইতে বিরক্তিভরে বলিল—কি বিপদ! কোথা থেকে বাধা এসে জুটল দেখ দেখি! দড়ি আনিয়া ভূপালের হাতে দিয়া শ্ৰীহরি বলিলবাধ। জমাদারবাবু, আসুন চট করে ওদিকের কাজটা সেরে আসি।
দুর্গা বিবৰ্ণমুখে করুণ দৃষ্টিতে জমাদারের দিকে চাহিয়া বলিল—কি হবে জমাদারবাবু?–চোখ তাহার জলে ছলছল করিয়া উঠিল।
জমাদার আশ্বাস দিয়া বলিল—কোনো ভয় নাই। ভূপালের হাত হইতে দড়ি লইয়া সে নিজেই বাঁধিতে বসিল; ভূপালকে বলিল—এক দৌড়ে থানায় গিয়ে লেক্সিন নিয়ে আয়। আর ওঝা কে আছে ডাক—এক্ষুনি।
দুর্গা বলিল—আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও, জমাদারবাবু। ওগো আমি মায়ের কোলে মরব গো।
শ্ৰীহরি বলিল—সেই ভাল। ভূপাল ওকে বাড়িতে দিয়ে আসুক। দী ওঝা আর মিতে গড়াঞীকে ডাক। ছুটে যাবি আর আসবি। চলুন জমাদারবাবু।
অনিরুদ্ধের দাওয়ায় তক্তপোশের উপর যতীন একা বসিয়া ছিল।
জমাদারকে সংবর্ধনা করিয়া বলিল—ছোট দারোগাবাবু! এত রাত্রে?
জমাদার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল গিয়েছিলাম অন্য গ্রামে। পথে ভাবলাম আপনার মজলিসটা দেখে যাই। কিন্তু কেউ কোথাও নেই যে!
যতীন হাসিয়া বলিল-আপনি এসেছেন—ঘোষমশায় এসেছেন, আবার বসুক মজলিস। ওরে উচ্চিংড়ে, চায়ের জল চড়িয়ে দে তো!
ভূপাল দুর্গাকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া ঔষধ ও ওঝার জন্য চলিয়া গেল। দুর্গার মা হাউমাউ আরম্ভ করিয়া দিল। তাহার চিৎকারে পাড়ার লোক আসিয়া জুটিয়া গেল। পাতুর বৌ সকরুণ মমতায় বারবার প্রশ্ন করিলকি সাপ ঠাকুরঝি? সাপ দেখেছ?
দুর্গা অত্যন্ত কাতর স্বরে বলিল–ওগো তোমরা ভিড় ছাড় গো! সে ছটফট করিতে আরম্ভ করিল। এ-পাড়ার মাতব্বর সতীশ, সে সত্যই মাতব্বর লোক। সে অনেক ঔষধপাতির খবর রাখে। সাপের ঔষধও সে দুই-চারিটা জানে। সতীশ একরূপ ছুটিয়াই বাহির হইয়া গেল–ঔষধের সন্ধানে। কিছুকাল পর ফিরিয়া আসিয়া একটা শিকড় দিয়া বলিল—চিবিয়ে দেখ দেখি–তেতো লাগছে না মিষ্টি লাগছে?
দুৰ্গা সেটাকে মুখে দিয়া পরক্ষণেই ফেলিয়া দিল—থু-থু-থু।
সতীশ আশ্বস্ত হইয়া বলিল—তেতো যখন লেগেছে তখন ভয় নাই।
দুৰ্গা ধুলায় গড়াগড়ি দিয়া বলিল—মিষ্টিতে গা বমি-বমি করছে গো। বাবা গোওই কে আসছে—ওঝা নাকি গো!
ওঝা নয়। জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল, অনিরুদ্ধ এবং আর কয়েকজন।
হরেন ঘোষাল চিৎকার করিয়া উঠিল—হঠ যাও, হঠ যাও। সব হঠ যাও।
জগন তাড়াতাড়ি বসিয়া দুর্গার পাখানা টানিয়া লইল–হুঁ! স্পষ্ট দাঁতের দাগ।
পাতুর চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল; সে বলিল—কি হবে ডাক্তারবাবু?
পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া ডাক্তার বলিল-ওষুধ দিচ্ছি, দাঁড়া। অনিরুদ্ধ, এই পারমাঙ্গানেটের দানাগুলো ধর দেখি। আমি চিরে দি–তুই দিয়ে দে।
দুর্গা পাখানা টানিয়া লইল–না, না গো।
—না কি?
–না না না। মড়ার উপর আর খাড়ার ঘা দিয়ো না বাপু।
–ঘোষাল! ধর তো পাখানা।
ঘোষাল চমকিয়া উঠিল। সে এই অবসরে পাতুর বউয়ের সঙ্গে কটাক্ষ বিনিময় করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিল।
দুর্গা আবার দৃঢ়স্বরে বলিল–না না না।
জগন বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল—তবে মর।
দুর্গা উল্টাইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া বোধ করি নীরব কান্নায় সারা হইয়া গেল। তাহার সমস্ত দেহটাই কান্নার আবেগে থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল।
অনিরুদ্ধের চোখেও জল আসিতেছিল—কোনোমতে আত্মসংবরণ করিয়া সে বলিল—দুগ্গা! দুগ্গা! ডাক্তার যা বলছে শোন!
দুর্গার কম্পমান দেহখানি অস্বীকারের ভঙ্গিতে নড়িয়া উঠিল।
জগন এবার রাগ করিয়া চলিয়া গেল। অনিরুদ্ধ চলিয়া গেল ওঝার সন্ধানে। কুসুমপুরে একজন ভাল মুসলমান ওঝা আছে। হরেন একটি বিড়ি ধরাইল।
অনতিদূরে একটি আলো আসিয়া দাঁড়াইল। আলোর পিছনে জমাদার ও শ্ৰীহরি। ঘোষালও এইবার সরিয়া পড়িল।
দারোগা সতীশকে প্রশ্ন করিল—কেমন আছে?
–আজ্ঞে ভাল লয়। একেবারে ছটফট করছে।
–গড়াঞী আসে নাই?
–আজ্ঞে না।
—ঘোষ, আপনি আর একটা লোক পাঠিয়ে দিন। আমি থানা থেকে লেক্সিন পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসুন।
দারোগা ও শ্ৰীহরি চলিয়া গেল।
দুর্গা আরও কিছুক্ষণ ছটফট করিয়া খানিকটা সুস্থ হইল; বলিল—সতীশ দাদা, তোমার ওষুধ ভাল। ভাল লাগছে আমার। আরও কিছুক্ষণ পর সে উঠিয়া বসিল।
সতীশ বলিল-উষুধ আমার অব্যৰ্থ।
দুর্গা বলিল-আমাকে নিয়ে ওপরে চল, বউ!
উপরে বিছানায় বসিয়া দুর্গা মাথার খোঁপার একটা বেলকুঁড়ির কাটা খুলিয়া আলোর সম্মুখে তাহার অগ্রভাগটা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল।
পাতুর বউ বলিল—সাপ তুমি দেখেছ, ঠাকুরঝি? কি সাপ?
দুর্গা বলিল—কালসাপ!
অতি প্রচ্ছন্ন একটি হাসির রেখা তাহার ঠোঁটের কোণে কোণে খেলিয়া গেল। সাপে তাহাকে কামড়ায় নাই। কর্মকারের বাড়ি হইতে ফিরিবার পথেই সে মনে মনে স্থির করিয়া ঘাটে আসিয়া বেলকুঁড়ির কাঁটাটা পায়ে ফুটাইয়া রক্তমুখী দংশনচিহ্নের সৃষ্টি করিয়াছিল। নইলে কি সকলে পালাইবার অবকাশ পাইত, না জমাদার তাহাকে নিষ্কৃতি দিত? মদ খাইয়া জমাদারের যে মূর্তি হয় মনে করিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। একটা ভয় ছিল, লোকে তাহার অনিরুদ্ধের বাড়ি যাওয়ার কথাটা প্রকাশ করিয়া ফেলিবে। ভাগ্যক্রমে সে কথাটা কাহারও মনেই হয় নাই।
কিন্তু নজরবন্দি, জামাই-পতি তাহার এ অবস্থার কথা শুনিয়া একবার তাহাকে দেখিতেও আসিল না?
কেহই তো সত্য কথা জানে না, তবু আসিল না? নজরবন্দির না-হয় রাত্রে বাহির হইবার হুকুম নাই। জমাদার হাজির ছিল গ্রামে, ছিরু পাল রহিয়াছে, তাই নজরবন্দির না আসার কারণ আছে। কিন্তু জামাই-পণ্ডিত? জামাই-পণ্ডিত একবার আসিল না কেন?
অভিমানে তাহার চোখে জল আসিল। জগন ডাক্তার আসিয়াছিল, অনিরুদ্ধ আসিয়াছিল, জামাই-পণ্ডিত একবার আসিল না।
পাতুর বউ প্রশ্ন করিল-ঠাকুরঝি, আবার জ্বলছে?
–যা বউ, যা তুই। আবার একটুকুন শুই।
–না। ঘুমুতে তুমি পাবে না আজ।
দুর্গা এবার রাগে অধীর হইয়া বলিলঘুমোব না, ঘুমোব না। আমার মরণ হবে না, আমি মরব না। তুই যাতুই যা এখান থেকে।
পাতুর বউ এবার রাগ করিয়া উঠিয়া গেল। দুর্গা বালিশে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া রহিল।
–কে? নিচে কে ডাকিতেছে?
–-পাতু, দুৰ্গা কেমন আছে রে?
হ্যাঁ, জামাই-পণ্ডিতের গলা। ওই যে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।
–কেমন আছিস দুর্গাঃ পাতুর সঙ্গে দেবু ঘরে ঢুকিল।
দুর্গা উত্তর দিল না!
–দুৰ্গা!
দুর্গা এবার মুখ তুলিল, বলিল—যদি এতক্ষণে মরে যেতাম জামাই-পণ্ডিত।
দেবু বলিল—আমি খবর নিয়েছি, তুই ভাল আছিল। রাখালছোঁড়া দেখে গিয়ে আমাকে বলেছে।
দুর্গা আবার বালিশে মুখ লুকাইল; রাখালছোঁড়া খবর করিয়া গিয়াছে? মরণ তাহার।
দেবু বলিলবাড়ি গিয়ে বসেছি আর মহাগ্রামের ঠাকুরমশায় হঠাৎ এলেন। কি করি? এই তাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
—মউগাঁয়ের ঠাকুরমশায়!
দুর্গার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না।
মহাগ্রামের ঠাকুরমশায়! মহামহোপাধ্যায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন সাক্ষাৎ দেবতার মত মানুষ। রাজার বাড়িতেও যিনি পদার্পণ করেন না, তিনি?
ন্যায়রত্ন দেবুর বাড়িতে আসিয়াছিলেন। ইহাতে দেবুর নিজেরই বিস্ময়ের সীমা ছিল না। নিতান্ত অতর্কিতভাবে যেন তিনি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ব্যাপারটা ঘটিয়াছিল এই
যতীনের ওখান হইতে আসিয়া সে ঘরে বসিয়া দুর্গার কথাই ভাবিতেছিল। ভাবিতেছিল দুর্গা বিচিত্ৰ, দুর্গা অদ্ভুত, দুর্গা অতুলনীয়। বিলু সমস্ত শুনিয়া দুর্গার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া দুর্গার কথাই বলিতেছিল। বলিতেছিল–গল্পের সেই লক্ষহীরে বেশ্যার মত–দেখো তুমি, আসছে। জন্মে ওর ভাল ঘরে জন্ম হবে, যাকে কামনা করে মরবে সেই ওর স্বামী হবে।
ঠিক সেই সময়েই বাহির দরজায় কে ডাকিল—মণ্ডলমশায় বাড়ি আছেন?
কণ্ঠস্বর শুনিয়া দেবু ঠাহর করিতে পারিল না—কে? কিন্তু সে কণ্ঠস্বর আশ্চর্য সম্পূর্ণ। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলকে?
বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই বাহির হইয়া আসিল।
আমি। আলো হাতে একটি লোকের পিছন হইতে বক্তা উত্তর দিলেন—আমি বিশ্বনাথের পিতামহ।
দেবু সবিস্ময়ে সম্ভ্ৰমে হতবাক হইয়া গেল। তাহার সর্বাঙ্গে কটা দিয়া উঠিল। বিশ্বনাথের পিতামহ পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় শিবশেখর ন্যায়রত্ব! তাহার শরীর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। পরক্ষণেই আপনাকে সংযত করিয়া সেই পথের ধুলার উপরেই সে ন্যায়রত্নের পায়ে প্ৰণত হইল।
—তোমাকে আশীর্বাদ করতেই এসেছি। কল্যাণ হোক, ধর্ম যেন তোমাকে কোনোকালে পরিত্যাগ না করেন। জয়স্তু। তোমার জয় হোক।
বলিয়া তাহার মাথার উপর হাত রাখিলেন। বলিলেন ঘরটা খোল তোমার, একটু বসব।
দেবুর এতক্ষণে খেয়াল হইল। সে তাড়াতাড়ি ঘর খুলিয়া দিল; দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া বিলু সব দেখিয়াছিল, শুনিয়াছিল। সে ভিতরের দিক হইতে বাহিরের ঘরে আসিয়া পাতিয়া দিল
তাহার ঘরের সর্বোত্তম আসনখানি। তারপর একটি ঘটি হাতে আসিয়া দাঁড়াইল।
ন্যায়রত্ন বলিলেন–পা ধুইয়ে দেবে মা? প্রয়োজন ছিল না।
বিলু দাঁড়াইয়া রহিল। ন্যায়রত্ন এবার পা বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন–দাও।
বিলু পা ধুইয়া দিয়া সযত্বে একখানি পুরাতন রেশমি কাপড় দিয়া পা মুছিয়া দিল।
আসন গ্রহণ করিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন তোমার ছেলেকে আন মণ্ডল। তাকে আমি আশীর্বাদ করব।
বিস্ময়ে যেন দেবুর চারিপাশে এক মোহজাল বিস্তার করিয়াছিল; কোন্ অজ্ঞাত পরমভাগ্যে তাহার কুটিরে এই রাত্রির অন্ধকারে অকস্মাৎ নামিয়া আসিয়াছেন স্বর্গের দেবতা; পরম কল্যাণের আশীর্বাদ-সম্ভার লইয়া আসিয়াছেন তাহার ঘর ভরিয়া দিতে!
বিলু ঘুমন্ত শিশুকে আনিয়া ন্যায়রত্নের পায়ের তলায় নামাইয়া দিল।
ন্যায়রত্ন শিশুটির দিকে চাহিয়া দেখিয়া সস্নেহে বলিলেন–বিশ্বনাথের খোকা এর চেয়ে ছোট। এই তো সবে অন্নপ্রাশন হল, তার বয়স আট মাস।
তারপর ঘুমন্ত শিশুর মাথায় হাত দিয়া বলিলেন দীর্ঘায়ু হোক, ভাগ্য প্ৰসন্ন হোক।
কথা শেষ করিয়া গায়ের চাদরের ভিতরের খুঁট খুলিয়া বাহির করিলেন দুই গাছি বালা। হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন-ধর।
দেবু ও বিলু অবাক হইয়া গেল—এ বালা যে খোকারই বালা! আজই বন্ধক দেওয়া হইয়াছে।
–ধর। আমার কথা অমান্য করতে নেই। ধর মা, তুমি ধর।
বিলু হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিল হাত তাহার কাঁপিতেছিল।
–ছেলেকে পরিয়ে দাও মা। আজ অশোক-ষষ্ঠীর দিন, অশোক আনন্দে সংসার তোমাদের পরিপূর্ণ হোক।
তারপর হাসিয়া বলিলেন–বিশ্বনাথের স্ত্রী, আমার রাজ্ঞী শকুন্তলা। তিনি এসে আমায় সংবাদটা দিলেন। বাউরি-বায়েনদের গরু খোঁয়াড়ে দেওয়ার সংবাদ আমি পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম কাউকে পাঠিয়ে দিগরুগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে আসুক। গো-মাতা ভগবতী অনাহারে থাকবেন। আর ওই গরিবদের হয়ত যথাসর্বস্ব যাবে গরুর মাসুল দিতে। এমন সময় সংবাদ পেলাম-দেবু মণ্ডল গরুগুলি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। আশ্বস্ত হলাম। মনে মনে তোমাকে আশীর্বাদ করলাম। মনে হল-বচব, আমরা বাঁচব। মনে হল সেই গল্পের কথা। সঙ্কল্প করলাম—একদিন তোমাকে ডাকব, আশীর্বাদ করব। সন্ধ্যার সময় বিশ্বনাথের স্ত্রী এসে বললে—দাদু, শিবকালীপুরের পণ্ডিতের কাজ দেখুন তো! ষষ্ঠীর দিন আজ সে ছেলের হাতের বালা বন্ধক দিয়েছে আমাদের চাটুজ্যেদের গিন্নির কাছে। গিনি আমায় দেখিয়ে বললে—দেখ তো নাতবউ, পনের টাকায় ভাল হয় নাই? আমার মনটা আবার ভরে উঠল, মণ্ডলমশায়, অপার আনন্দে। মনে মনে বারবার তোমাকে আশীর্বাদ করলাম। তবু মন খুতখুঁত করতে লাগল। ষষ্ঠীর দিন, শিশুর অলঙ্কার, অলঙ্কারের জন্য শিশু হয়ত কেঁদেছে। আমি তৎক্ষণাৎ নিয়ে এলাম ছাড়িয়ে। কারও হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতে প্রবৃত্তি হল না। নিজেই এলাম। তোমাকে আশীর্বাদ করতে এলাম। তুমি দীর্ঘজীবী হও, তোমার কল্যাণ হোক। ধর্মকে তুমি বন্দি করে রাখ কর্মের বন্ধনে। তোমার জয় হোক। দাও মা; বালা পরিয়ে দাও ছেলেকে। মণ্ডল, টাকা যখন তোমার হবে, আমায় দিয়ে এসো; তোমার পুণ্য, তোমার ধর্মকে আমি ক্ষুণ্ণ করতে চাই না।
টপ টপ করিয়া দেবুর চোখ হইতে জল ঝরিয়া পড়িল।
বিলুর চোখ হইতে ধারা বহিতেছিল। সে বালা দুই গাছি ছেলেকে পরাইয়া দিল।
ন্যায়রত্ন বলিলেনকেঁদো না, একটা গল্প বলি শোন।
এমন সময় যতীন আসিয়া ডাকিল—দেবুবাবু!
–যতীনবাবু আসুন—আসুন!
ন্যায়রত্ব হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন–ইনি?
দেবু যতীনের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিল।
যতীন কয়েক মুহূর্ত ন্যায়রত্নকে দেখিল; তারপর তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল—আপনার নাতি বিশ্বনাথবাবুকে আমি চিনি।
ন্যায়রত্ন প্রথমে নমস্কার করিয়া, পরে যতীনকে আশীর্বাদ করিলেন। তারপর প্রশ্ন করিলেন-চেনেন তাকে? আপনাদের সঙ্গে সে বুঝি সমগোত্রীয়?
এ প্রশ্নে যতীন প্রথমে একটু বিস্মিত হইল; তারপর অর্থটা বুঝিয়া হাসিয়া বলিল—গোত্র এক, গোষ্ঠী ভিন্ন।
ন্যায়রত্ন চুপ করিয়া রহিলেন, কোনো উত্তর দিলেন না।
যতীন বলিল—তারা নাপিত আমায় সংবাদ দিলে, আমি ছুটে এলাম। আপনাকে দেখতে এলাম।
–দেখবার বস্তু আর কিছু নাই—দেশেও নাই মানুষেও নাই। প্ৰকাণ্ড সৌধ, বটবৃক্ষ জন্মে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। চোখেই তো দেখছেন। তারপর হাসিয়া বলিলেন—তাই মধ্যে মধ্যে যখন দুর্যোগে বজ্রাঘাতের আঘাতকে প্রতিহত করতে দেখি সেই সৌধের কোনো অংশকে, তখন। আনন্দ হয়। আজ মণ্ডল আমাকে সেই আনন্দ দিয়েছে।
দেবু কথাটা পরিবর্তন করিবার জন্য বলিল—আপনি একটা গল্প বলবেন বলছিলেন।
–গল্প? ফাঁ বলি শোন।–-এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, মহাকর্মী, মহাপুণ্যবান। জ্যোতির্ময় ললাট, সৌভাগ্যলক্ষ্মী স্বয়ং ললাট-মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি কর্ম ছিল মহৎ এবং প্রতি। কৰ্মেই ছিল সাফল্য; কারণ যশোলক্ষ্মী আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর কর্মশক্তিতে। তাঁর কুল ছিল। অকলঙ্ক, পত্নী-পুত্র-কন্যা-বধূর গৌরবে অকলঙ্ক কুল উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল—কারণ কুললক্ষ্মী তার কুলকে আশ্রয় করেছিলেন। পাপ অহরহ ঈর্ষাতুর অন্তরে ব্রাহ্মণের বাসভূমির চারিদিকে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার সহ্য হয় না। বহু চিন্তা করে সে একদিন সঙ্গে করে আনল অলক্ষ্মীকে। বাড়ির বাইরে থেকে ব্রাহ্মণকে ডাকলে। ব্রাহ্মণ বললেন—কি চাও বল?
পাপ বলল—আমি বড় দুর্ভাগা। দুঃখ-কষ্টের সীমা নাই। আমার সঙ্গিনীটিকে আপনি কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিন—এই আমার প্রার্থনা।
ব্রাহ্মণ বললেন-আমি গৃহস্থ, আশ্রয়প্রার্থী দুস্থকে আশ্রয় দেওয়া আমার ধৰ্ম। বেশ, থাকুন। উনি। বধূ-কন্যার মতই যত্ন করব। ইচ্ছা হলে যতদিন দুর্ভাগ্যের শেষ না হয়, ততদিন তুমিও থাকতে পার। এস, তুমি এস।
আহ্বান সত্ত্বেও পাপ কিন্তু পুরপ্রবেশ করতে সাহস করল না। কারণ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে রয়েছেন ধর্ম।
যাক অলক্ষ্মীকে আশ্রয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয় ঘটল। ফলবান বৃক্ষগুলির ফল যেন নীরস হয়ে গেল, ফুল ম্লান হল।
রাত্রে ব্রাহ্মণ জপ করছেন—এমন সময় শুনতে পেলেন এক করুণ কান্না। কেউ যেন করুণ সুরে কাঁদছে। বিস্মিত হয়ে জপ শেষ করে উঠতেই তিনি দেখলেন তারই ললাট থেকে বেরিয়ে এল এক জ্যোতি, সেই জ্যোতি ক্রমে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। তিনিই এতক্ষণ কাঁদছিলেন।
ব্ৰাহ্মণ প্রশ্ন করলেন-কে মা তুমি?
রমণী মূর্তি বললেন—আমি তোমার সৌভাগ্যলক্ষ্মী। এতদিন তোমার ললাটে আশ্রয় করেছিলাম, তোমায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তাই কাছি।
ব্ৰাহ্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—একটা প্রশ্ন করব, মা? আমার অপরাধ কি হল?
—তুমি আজ অলক্ষ্মীকে আশ্রয় দিয়েছ। ওই মেয়েটি অলক্ষ্মী। অলক্ষ্মী এবং আমি তো একসঙ্গে বাস করতে পারি না।
ব্রাহ্মণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। সৌভাগ্যলক্ষ্মীকে প্রণাম করলেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। তিনি চলে গেলেন।
পরদিন সকালে দেখলেন বৃক্ষের ফল খসে গেছে, ফুল শুকিয়ে গেছে। সরোবর হয়েছে। ছিদ্ৰময়ী, জল ছিদ্রপথে অদৃশ্য হয়েছে। ভূমি হয়েছে শস্যহীনা, গাভী হয়েছে দুগ্ধহীনা। গৃহ হয়েছে শ্ৰীহীন।
রাত্রে আবার সেই রকম কান্না। আবার দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এক দিব্যাঙ্গনা। তিনি বললেন—আমি তোমার যশোলক্ষ্মী। অলক্ষ্মীকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ, ভাগ্যলক্ষ্মী তোমাকে পরিত্যাগ করেছেন, সুতরাং আমিও তোমাকে পরিত্যাগ করে যাচ্ছি।
ব্ৰাহ্মণ নীরবে তাকে প্রণাম করলেন। তিনিও চলে গেলেন।
পরদিন তিনি শুনলেন-লোকে তার অপযশ ঘোষণা করছে—ব্রাহ্মণ লম্পট, ওই যে। মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছে—তার দিকে তার কুদৃষ্টি পড়েছে। তিনি প্রতিবাদ করলেন না।
সেদিন রাত্রে আর এক নারীমূর্তি তাঁর দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি তার কুললক্ষ্মী। বললেন—অলক্ষ্মী এসেছে, ভাগ্যলক্ষ্মী চলে গেছেন, যশোলক্ষ্মী চলে গেছেন, লোকে তোমার কলঙ্ক রটনা করছে; আমি কুললক্ষ্মী, আর কেমন করে থাকি তোমাকে আশ্রয় করে? তিনিও চলে। গেলেন।
পরদিন ব্রাহ্মণের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন আর এক মূর্তি। নারী নয়—পুরুষ মূর্তি। দিব্য ভীমকান্তি, জ্যোতির্ময় পুরুষ।
ব্ৰাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলেন-আপনি কে?
দিব্যকান্তি পুরুষ বললেন আমি ধর্ম।
–ধর্ম? আপনি আমাকে পরিত্যাগ করছেন কোন অপরাধে?
–অলক্ষ্মীকে আশ্রয় দিয়েছ তুমি।
–সে কি আমি অধর্ম করেছি?
ধর্ম চিন্তা করে বললেন–না।
তবে?
–ভাগ্যলক্ষ্মী তোমায় ত্যাগ করেছেন।
—আশ্রয়প্রার্থী বিপদগ্রস্তকে আশ্রয় দেওয়া যখন অধর্ম নয়, তখন আমার অধর্মের জন্য তিনি আমায় পরিত্যাগ করেন নি। পরিত্যাগ করেছেন অলক্ষ্মীর সংস্পর্শ সইতে না পেরে।
–হ্যাঁ।
—ভাগ্যলক্ষ্মীকে অনুসরণ করেছেন যশোলক্ষ্মী, তার পেছনে গেছেন কুললক্ষ্মী, আমি প্রতিবাদ করি নি। কারণ ওই তাদের পন্থা। একের পিছনে এক আসেন, আবার যাবার সময় একের পিছনে অন্যে যান। কিন্তু আপনি আমাকে পরিত্যাগ করবেন কোন অপরাধে?
ধর্ম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ব্রাহ্মণ বললেন-আপনাকে আমি যেতে দিতে পারি না; কারণ আপনাকে অবলম্বন করেই আমি বেঁচে রয়েছি। আপনাকে আমি যেতে না বললে আপনার যাবার অধিকার নাই। আমিই আপনার অস্তিত্ব।
ধর্ম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, নিজের ভ্রম বুঝলেন। তারপর ব্রাহ্মণকে বললেন—তথাস্তু। তোমার জয় হোক। বলে তিনি আবার ব্রাহ্মণের দেহে প্রবিষ্ট হলেন।
ন্যায়রত্নের গল্প বলার ভঙ্গি অতি চমৎকার। প্রথম জীবনে তিনি নিয়মিত ভাগবত কথকতা করিতেন। তাঁহার বর্ণনায়, স্ব-মাধুর্যে, ভঙ্গিতে একটি মোহজালের সৃষ্টি করিয়াছিল। তিনি স্তব্ধ হইলেন।
কিছুক্ষণ পর যতীন বলিল–তারপর?
–তারপর? ন্যায়রত্ন হাসিলেন, বলিলেন—
তারপর সংক্ষিপ্ত কথা। ধর্মের প্রভাবে সেইদিন রাত্রে উঠিল আবার এক ক্রন্দনধ্বনি। ব্ৰাহ্মণ দেখলেন সেই অলক্ষ্মী মেয়েটি এসে বলছে—আমি যাচ্ছি। আমি চললাম।
ব্রাহ্মণ বললেন—তুমি স্বেচ্ছায় বিদায় চাও?
–স্বেচ্ছায়। স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। সে মিলিয়ে গেল।
সেই দিন রাত্রেই ফিরলেন ভাগ্যলক্ষ্মী, ফিরলেন তারপর যশোলক্ষ্মী, তারপর কুললক্ষ্মী।
যতীন বলিল—চমৎকার কথা। লক্ষ্মীই দেয় যশসে-ই পবিত্র করে কুল। তাই তাকে নিয়ে এত কাড়াকাড়ি। লক্ষ্মীই সব।
—না, ন্যায়রত্ন বলিলেন না, ধর্ম। মণ্ডল, সেই ধর্মকে তুমি অবলম্বন করেছ বলেই আজ। আশা হচ্ছে। সেই আনন্দেই আমি ছুটে এসেছি। আচ্ছা, আমি চলি আজ, মণ্ডল।
ঠিক এই সময়ে সংবাদ আসিল দুর্গাকে সাপে কামড়াইয়াছে। রাখালছোঁড়াটা বলিল–ভাল আছে। উঠে বসেছে।
দেবু ন্যায়রত্নকে আগাইয়া দিতে বাহির হইল। পথে যতীন বিদায় লইয়া আপন দাওয়ায় উঠিয়া তক্তপোশের উপর স্তব্ধ হইয়া বসিল।