নবান্নের ঘটনা
দেবু স্তব্ধ হইয়া ভাবিতেছিল অনেক কথা। ওই নবান্নের ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর।
চণ্ডীমণ্ডপেই গ্রাম্য পাঠশালা বসে; পাঠশালার প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন হইতে চণ্ডীমণ্ডপই পাঠশালার নির্দিষ্ট স্থান। সে বহুকাল আগের কথা। তখন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড ছিল না, ইউনিয়ন বোর্ড ছিল না। পাঠশালা ছিল গ্রামের লোকের। লোকেরা পণ্ডিতকে মাসে একটা করিয়া সিধা দিত এবং ছেলে পড়াইত। চণ্ডীমণ্ডপে সেকালে কালী ও শিবের নিত্যপূজার ব্যবস্থা ছিল, এবং ওই পূজক ব্রাহ্মণই তখন ছিল পাঠশালার পণ্ডিত। পরবর্তীকালে পূজকের দেবোত্তর জমি কেমন করিয়া কোথায় উবিয়া গেল কে জানে। লোকে বলে জমিদারের পূর্ববর্তী এক গোমস্তা দেবোত্তর জমিকে নামমাত্র খাজনায় বন্দোবস্ত করিয়া নিজের জোতের অন্তর্গত করিয়া লইয়াছে। এমন কৌশলে লইয়াছে যে, সে আর উদ্ধারের কোনো উপায় নাই। এমনকি চিহ্নিত জমিগুলাকে কাটিয়া এমনি রূপান্তরিত করিয়াছে যে, সে জমি পর্যন্ত খুঁজিয়া বাহির করা দুঃসাধ্য। তাহার পরও গ্রাম্য-পৌরোহিত্য, দেব-সেবা এবং পাঠশালাকে অবলম্বন করিয়া এক ব্রাহ্মণ অনেকদিন এখানে ছিল; আজ বৎসর কয়েক আগে সে-ও চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছে। শিক্ষা বিভাগের নূতন নিয়মানুযায়ী অযোগ্যতা হেতু তাহাকে বরখাস্ত করিয়া নূতন বন্দোবস্ত হইয়াছে। সম্প্রতি বছর তিনেক পাঠশালার ভার পড়িয়াছে দেবুর হাতে।
এককালে দেবুও এই পাঠশালায় সেই পুরোহিত-পণ্ডিতমশায়ের কাছে পড়িয়াছে। পণ্ডিত একদিকে পূজা করিত জয়ন্তী মঙ্গলা কালী অকস্মাৎ মন্ত্ৰ বন্ধ করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিত—এ্যাঁই এ্যাঁই চণ্ডে, পাঁচ তেরম পঁচাত্তর নয়, পাঁচ তেরম পয়ষট্টি। ছয় তেরম আটাত্তর। হ্যাঁ–
ওই অনিরুদ্ধও তখন তাহার সঙ্গে পড়িত। পণ্ডিত তাহাকে বলিত এ দেশের লোহাতে চেকন কাজ হয় না বাবা, কর্মকার, তুমি বিলাত যাও, বিলাতে কলকারখানার কারবার, আলপিন সুচ তৈরি হয় লোহা থেকে। বিলাতি পণ্ডিত না হলে তোমাকে পড়ানো আমার কর্ম নয়;–
ছিরু দেবুর জ্ঞাতি, সম্বন্ধে ভাইপো, কিন্তু বয়সে অনেক বড়। সে প্রথমে তাহার কয়েক ক্লাস উপরে পড়িত; শেষে এক এক ক্লাসে দুই-তিন বৎসর করিয়া বিশ্রাম লইতে লইতে যেদিন দেবুকে সহপাঠীরূপে দেখিতে পাইল, সেইদিনই সে পাঠশালার মোহ জন্মের মত বিসর্জন দিল। তারপরই সে বিবাহ করিয়া সংসারী হইয়াছে—ক্রমে বিষয়-বুদ্ধিতে পচখানা গ্রামের লোককে বিস্মিত করিয়া দিয়াছে। সে আজ গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রামের মাতব্বর।
অনিরুদ্ধ এবং এই ছিরু পাল—এই দুজনেই গ্রামখানার সমস্ত শৃঙ্খলা ভাঙিয়া দিল। ওই সঙ্গে গিরিশ ছুতার, তারা নাপিতও আছে। দেবু আশ্চর্য হইয়া ভাবিতেছিল—অনিরুদ্ধ ওই যে দম্ভভরে সামাজিক নিয়ম উপেক্ষা করিয়া চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ভোগ উঠাইয়া লইয়া গেল, অথচ সমাজের কেহ তাহাকে প্রতিরোধ করিতে পারিল না, ইহার কি কোনো প্রতিকার নাই? এ কয়েকদিন সে নিজেই লোকের দুয়ারে দুয়ারে ফিরিয়াছে, গ্রামের লোক তাহাকে ভালবাসে, অনেকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু এক্ষেত্রে সকলেই বলিয়াছে এক কথা—এর আর করবে কি দেবু? উপায় কি বল? যদি থাকে তা হলে তুমি কর! তবে বুঝচ কিনা—উ হবে না! কি সমাজ সমাজ করছ? সমাজ কই?
নাই! দেবু নিজেই বুঝিয়াছে, নাই! সেকালে যেসব মানুষ এই সমাজ গড়িয়াছিল, এই সমাজ শাসন করিত, এ সমাজকে ভাল করিয়া জানিত, বুঝিত—সে-সব মানুষই আর নাই। সে শিক্ষাও নাই, সে দীক্ষাও নাই, সে দৃষ্টি নাই। এসব মানুষ আর এক জাতের মানুষ। আর এক ধাতের মানুষ। মানুষের নামে অমানুষ।
জগন ডাক্তার সেদিন বলিয়াছিল—ধরে এনে বেটাচ্ছেলে কামারকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে লাগাও ঘা-কতক।
জগনের ও-প্রস্তাবে দেবু সায় দিতে পারে নাই। ছি! মানুষকে শিক্ষা দেবার অধিকার আছে, ক্ষেত্রবিশেষে মনুষ্যোচিত শাসন করিবার অধিকারও সে স্বীকার করে; কিন্তু অত্যাচারই একমাত্র শাসন নয়। জীবনে তাহার আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের জন্য হীন কৌশল, অত্যাচার ও অন্যায়কে অবলম্বন করিতে সে চায় না। জীবনে তাহার একটি আদর্শবোধও আছে। পাঠ্যাবস্থায় আপনার ভাবী জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠার কামনায় সেই বোধটিকে দেবু গড়িয়া তুলিয়াছিল। মহাপুরুষদের দৃষ্টান্তের সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গঠিত সেই আদর্শবোধ। বাল্যজীবনের কতকগুলি ঘটনা হইতে কয়েকটি ধারণা তাহার বদ্ধমূল হইয়া আছে। বারংবার নিরপেক্ষ বিচার-বুদ্ধি-শাণিত যুক্তির আঘাত দিয়াও সেধারণাগুলি আজও তাহার খণ্ডিত হয় নাই।
জমিদারকে, ধনী মহাজনকে সে ঘৃণা করে। তাহাদের প্রতিটি কর্মের মধ্যে অন্যায়ের সন্ধান করা যেন তাহার স্বভাবের মধ্যে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। তাহাদের অতি-উদার দান-ধ্যান-ধর্মকর্মকেও সে মনে করে কোনো গুপ্ত গো-বধের স্বেচ্ছাবৃত চান্দ্ৰায়ণ প্ৰায়শ্চিত্ত বলিয়া। তাহার অবশ্য কারণ আছে।
তাহার বাল্যকালে একবার জমিদারবাবুরা বাকি খাজনা আদায়ের জন্য তাহার বাবাকে সমস্ত দিন কাছারিতে আটক রাখিয়াছিল। আতঙ্কিত দেবু তিনবার বাবুদের কাছারিতে গিয়া। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিয়াছিল; দুইবার চাপরাশীর ধমক খাইয়া পলাইয়া আসিয়াছিল। শেষবার বাবু তাহাকে দেখিয়া বলিয়াছিল—এবার যদি আসবি ছোঁড়া, তবে কয়েদখানায় বন্ধ করে রেখে দেব। চাপরাসীটা তাহাকে টানিয়া আনিয়া একটা অন্ধকার ঘরও দেখাইয়া দিয়াছিল। বাবুদের অবশ্য কয়েদখানার জন্য স্বৰ্গধাম কি বৈকুণ্ঠজাতীয় কোনো মহল বা ঘর কোনোদিনই ছিল না। নিতান্তই ছোট জমিদার তাহারা, দেবুকে নিছক ভয় দেখাইবার জন্য ও-কথাটা বলা হইয়াছিল—সেটা দেবু আজ বোঝে। কিন্তু জমিদার অত্যাচারী—এ ধারণা তাহাতে একবিন্দু ক্ষুণ্ণ হয় নাই।
জমিদারের ওই বাকি খাজনা শোধের জন্য তাহার বাপ কঙ্কণার মুখুজ্জে বাবুদের কাছে ঋণ করিয়াছিল। তাহারা তিন বৎসর অন্তে হ্যান্ডনেটের নালিশ করিয়া অস্থাবর ক্রোকী পরোয়ানা আনিয়া, গাই-বাছুরথালা-গেলাস ও অন্যান্য জিনিসপত্র টানিয়া রাস্তায় যেদিন বাহির করিয়াছিল সেদিনের সেই লাঞ্ছনা-বিভীষিকা দেবু কিছুতেই ভুলিতে পারে না। তাহার পর অবশ্য ডিক্রির টাকা আসল করিয়া তমসুক লিখিয়া দেবার প্রতিশ্রুতি দিলে বাবুরা অস্থাবর ছাড়িয়া দিয়াছিল। সেটাকা তাহার বাবার মৃত্যুর পর সে শোধ করিয়াছে। এই বাবুরা অবশ্য বে-আইনী কখনও কিছু করে না, হিসাবের বাহিরে একটি পয়সা অতিরিক্ত লয় না। লোকে বলে—মুখুজ্জে বাবুদের মত মহাজন বিরল। টাকা আদায়ের জন্য জোরজুলুম নাই, অপমান নাই, সুদ শোধ করিয়া গেলে নালিশ কখনও করিবে না; লোকের সম্পত্তির উপর তাদের প্রলোভন নাই। নিলাম করিয়ালওয়ার পরও টাকা দিলেই বাবুরা সম্পত্তি ফেরত দেয়। ইহার একবিন্দু অতিরঞ্জন নয়। তবু দেবু মহাজনকে ক্ষমা করিতে পারে না।
এ-সবের ওপর আরও একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা তাহার মনে অক্ষয় হইয়া আছে। স্কুলে সে ছিল সর্বাপেক্ষা দুইটি ভাল ছেলের একটি। তাহার নিচের ক্লাসে পড়িত মহাগ্রামের মহামহোপাধ্যায় ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথ,সে ছিল দ্বিতীয় জন। শিক্ষকরা প্রত্যাশা করিতেন—এই ছেলে দুইটি স্কুলের মুখোজ্জ্বল করিবে। কিন্তু দেবু আজও ভুলিতে পারে না যে, সে ছিল শিক্ষকদের সস্নেহ করুণার পাত্র, ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথ পাইত স্নেহের সহিত শ্রদ্ধা আর কঙ্কণার বাবুদের মধ্যম মেধার কয়েকটি ছাত্র পাইত স্নেহের সহিত সম্মান। এমনকি ছিকেও স্কুলের হেডপণ্ডিত তোষামোদ করিতেন,কারণ প্রয়োজনমত ছিরুর বাপের কাছে তিনি কখনও তালগাছ, কখনও জামগাছ, ক্রিয়াকর্মে দশ-পনের সের মাছ চাহিয়া লইতেন। ইহা ছাড়া ঘি, চাল, ডাল, গুড় প্রভৃতি তো নিয়মিত উপহার পাইতেন।
ওই পণ্ডিতটির নির্লজ্জ ললাভের কথা মনে করিলে দেবুর সর্বাঙ্গ রি-রি করিয়া ওঠে। বিশ বৎসর বয়সে ছিরু স্কুলের ফিফথ ক্লাস হইতে বিদায় লইলে পণ্ডিত ছিরুর বাপকে বলিয়াছিল–ছেলেকে সংস্কৃত পড়াও মোড়ল।
ছিরুর বাপ ব্রজবল্লভ ছিল শক্তিশালী চাষী-নিজের পরিশ্রমের সাধনায় সে ঘরে লক্ষ্মীর কৃপা আয়ত্ত করিয়াছিল, কিন্তু নিজে ছিল মূৰ্খ। তাই বড় সাধ ছিল ছেলেটি তাহার পণ্ডিত হয়। ছিঃ বিশ বৎসর বয়সে পশু-স্বভাব-সম্পন্ন হইয়া ওঠায় বেচারার মনস্তাপের সীমা ছিল না। পণ্ডিতের কথায় সে ছেলেকে পণ্ডিতের ছাত্র করিয়া দিল। ছিরু প্রথমটা আপত্তি করে নাই। পণ্ডিত পড়াইতে আসিয়া গল্প করিতেন। বিশেষ করে বয়স্ক বিবাহিত ছাত্রের কাছে তিনি আদিরসাশ্রিত সংস্কৃত শ্লোকের ব্যাখ্যা করিয়া এবং ওই ধরনের গল্প বলিয়া বৎসর চারেক নিয়মিতভাবেই বেশ প্ৰসন্ন গৌরবের সঙ্গে গ্লানিহীন চিত্তে বেতন লইয়াছিলেন। অবশ্য বেতন বেশি নয়, মাসিক দুই টাকা। চারি বৎসর পর ছিরু আবার বিদ্রোহ করিল। ছিরু র বাপ কিন্তু নাছোড়বান্দা। হিরু তখন। পণ্ডিতের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য বুলি ধরিল—সংস্কৃত পড়িয়া কি হইবে? পড়িতে হইলে সে ইংরেজিই পড়িবে।
ইংরেজি পড়াইবার গৃহশিক্ষক কিন্তু পণ্ডিতের ডবল বেতন দাবি করিল। হিরু তখন ধরিল—সে স্কুলেই পড়িবে। চব্বিশ বৎসর বয়সে সে আবার আসিয়া ফিফথ ক্লাসে বসিল। দেবুও তখন ফিফথ ক্লাসে উঠিয়াছে। হঠাৎ ছিরু র নজর পড়িল দেবুর উপর। দেবুর পাশে অনিকামার। স্কুলে পড়িবার কথা যখন বলিয়াছিল—তখন এই কথাটা ছিরুর মনে হয় নাই। তাহার কল্পনা ছিল অন্য রকম। স্কুলে পড়িবার নাম করিয়া সে কঙ্কণার অথবা স্বগ্রামের নীচ জাতীয়দের পল্লীতে দিনটা কাটাইয়া আসিবে। কিন্তু দেবুকে এবং অনিরুদ্ধকে ক্লাসে দেখিয়া সে আর মাথা ঠিক রাখিতে পারিল না। সঙ্গে সঙ্গে সে বই-খাতা লইয়া উঠিয়া চলিয়া আসিল। বাড়ি চলিয়া আসিল না। সেই পথে-পথেই সে গিয়া উঠিল তাহার মাতামহের বাড়ি। সেখানে গিয়াই সে তাহার জীবনের আদর্শ গুরু ত্রিপুরা সিংকে পাইয়াছিল। তাহার জীবনে পথ দেখায় যে—সেই মানুষের গুরু, মাতামহের মনিব ত্রিপুরা সিংকে দেখিয়া ছিরু তাহাকেই মনে মনে গুরুপদে বরণ করিয়া নিজের কর্মজীবন-যাত্রা শুরু করিল। কিন্তু চব্বিশ বৎসর বয়সে ছি যেদিন ক্লাসে আসিয়া বসিয়াছিল—সেদিনও পণ্ডিত আসিয়া বলিয়াছিলেন—খবরদার, ছিরু কে দেখে কেউ হেসো না। তাহার মধ্যে ব্যঙ্গ ছিল না—ছিল খাতির। সে কথা দেবুর আজও মনে আছে।
স্কুলের মধ্যে সকলের চেয়ে সম্মানের পাত্র ছিল কঙ্কণার মুখুজ্জেদের মূৰ্খ ছেলেটা। তিনতিন জন গৃহশিক্ষক সত্ত্বেও কোনো বিষয়ে তাহার পরীক্ষার নম্বর চল্লিশের কোঠায়ও পৌঁছিত না। একবার সে সঙ্গীদের মধ্যে রহস্য করিয়া বলিয়াছিল–গাধা পিটে কখনও ঘোড়া হয় না। কথাটা ছেলেটার কানে উঠিতেই সে শোরগোল তুলিয়া ফেলিল। সেই সোরগোলে একেবারে শিক্ষকমণ্ডলী পর্যন্ত কাঁপিয়া উঠিলেন। আপিসে ডাকাইয়া আনিয়া হোস্টার তাহাকে ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। একজন শিক্ষক বলিয়াছিলেন—গাধা রে, গাধা নয়, হাতি-হাতির বাচ্চা। গজেন্দ্ৰগমন একটু একটু ধীরই বটে। আজ বুঝবি না, বড় হলে বুঝবি।…
সে কথাটা এখন সে মর্মে মৰ্মে বুঝিতেছে। বাবুদের সেই ছেলেটি বারদুয়েক ফেল করার পর শেষে তৃতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করিয়া আজ লোকাল বোর্ড, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বর, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। প্রতি মাসে দেবুকে ইউনিয়ন বোর্ডে গিয়া পাঠশালার সাহায্যের জন্য তাহার সম্মুখে হাত পাতিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হয়। ছিরু পালও সম্প্রতি ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে সে-ও আসিয়া জিজ্ঞাসা করে—কি গো, পাঠশালা চলছে কেমন?
দেবুর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিয়া ওঠে।
সেদিন একখানা ছেলেদের বইয়ে একটা ছড়া দেখিল–লেখাপড়া করে যেই, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই। দেবু সেই লাইনটি বার বার কলম চালাইয়া কাটিয়া দিল। তারপর বোর্ডের উপর খড়ি দিয়া লিখিয়া দিল—লেখাপড়া করে যেই–মহামানী হয় সেই।
তারপর আরম্ভ করিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গল্প।
মধ্যে মধ্যে তাহার মনে হয়, সে যদি ইউনিয়ন বোর্ডের ওই প্রেসিডেন্টের আসনে বসিতে পারিত, তবে সে দেখাইয়া দিত ওই আসনের মর্যাদা কত! কতকত—কত কাজ সে করিত। সে কল্পনা করিত অসংখ্য পাকা রাস্তা। প্রতি গ্রাম হইতে লাল কাঁকরের সোজা রাস্তা বাহির হইয়া মিলিত হইয়াছে এই ইউনিয়নের প্রধান গ্রামের একটি কেন্দ্রে, সেখান হইতে একটি প্রশস্ত রাজপথ চলিয়া গিয়াছে জংশন শহরে। ওই রাস্তা দিয়া চলিয়াছে সারি সারি ধান-চালে বোঝাই গাড়ি, লোকে ফিরিতেছে পণ্য বিক্রয়ের টাকা লইয়া, ছেলেরা স্কুলে চলিয়াছে ওই পথ ধরিয়া। সমস্ত গ্রামের জঙ্গল সাফ হইয়া-ডোবা বন্ধ হইয়া একটি পরিচ্ছন্নতায় চারিদিক ভরিয়া উঠিয়াছে। সমস্ত স্থানগুলিতে ছড়াইয়া দিয়াছে দোপাটি ফুলের বীজ; দোপাটি শেষ হইলে গাদার বীজ। ফুলে ফুলে গ্রামগুলি আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। প্রতি গ্রামের প্রতি পল্লীতে একটি করিয়া পাকা ইদারা খোঁড়া হইয়াছে। কোনো পুকুরে এককণা আবর্জনা নাই, কালো জল টলটল করিতেছে—পাশে পাশে ফুটিয়া আছে শালুক ও পানাড়ীর ফুল। কোৰ্ট বেঞ্চের সুবিচারে সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবিধান হইয়াছে কঠিন হস্তে সে মুছিয়া দিতেছে উৎপীড়ন ও অবিচার। এই সমস্তই সে সম্ভব করিয়া তুলিতে পারে, সুযোগ পাইলে সে প্রমাণ করিয়া দিতে পারে যে, স্থূলকায় মন্থরগতি চতুষ্পদ হইলেই সে হাতি নয়, সোনার খুর-বধানো হৃষ্টপুষ্ট হইলেও গর্দভ চিরদিনই গর্দভই।
ঈর্ষার উত্তেজনায়, কর্মের প্রেরণায় সে অধীর হইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়, দ্রুতপদে ঘুরিয়া বেড়ায়, মধ্যে মধ্যে হাতখানা ভজিয়া অতি দৃঢ় মুঠা বাঁধিয়া পেশি ফুলাইয়া কঠিন কঠোর করিয়া তোলে। সকল দেহমন ভরিয়া সে যেন শক্তির আলোড়ন অনুভব করে।
তাহার স্ত্রীটি বড় ভাল মেয়ে। ধবধবে রঙ, খাদা নাক, মুখখানি কোমল-অতি মিষ্টি তাহার চোখের দৃষ্টি। আকারে ছোটখাটো, মাথায় একপিঠ চুল-সরল সুন্দর তাহার মন। তাহার উপরে দেবুর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বামীর সংস্পর্শে আসিয়া আপনাকে সে একেবারে হারাইয়া ফেলিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দেবুর এই মূর্তি দেখিয়া সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেও কি হচ্ছে গো? আপনার মনে–
দেবু হাসিয়া বলে–ভাবছি আমি যদি রাজা হতাম।
–রাজা হতে! সে কি গো?
–হ্যাঁ! তা হলে তুমি হতে রানী।
–হ্যাঁ!–তাহার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। কিন্তু কথাগুলি ভারি মজার কথা।
তাই তো—পণ্ডিত রাজা হইলে সে রানী হইত ইহা তো ঋটি সত্য কথা।
দেবু আরও খানিকটা গোল পাকাইয়া বলিল—কিন্তু রানী হলেও তোমার গয়না থাকত না। অভিভূত হইয়া গেল দেবুর বউ সে স্তব্ধ হইয়া গেল।
দেবু হাসিয়া বলে—এ রাজার রাজ্য আছে, কিন্তু রাজা তো প্রজার কাছে খাজনা পায় না। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, বুঝেছ? লোকের কাছে ট্যাক্স নিয়ে গ্রামের কাজ করতে হয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হয়।
অন্তরে শুভ আকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চ কল্পনা থাকিলেই সংসারে তাহা পূর্ণ হয় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থাটাই পৃথিবীতে বড় শক্তি। বার বার চেষ্টা করিয়া দেবু সেটা উপলব্ধি করিয়াছে। শীতকালে বর্ষা নামিলেও ধানের চাষ অসম্ভব। বর্ষার সময় খুব উঁচু জমি দেখিয়া দেবু একবার আলুর চাষ করিয়াছিল; কিন্তু আলুর বীজ অঙ্কুরিত হইয়াই জলের স্যাতসেঁতানিতে মরিয়া গিয়াছিল। যে দুই-চারটি গাছ বাঁচিয়াছিল—তাহাতে যে আলু ধরিয়াছিল, তাহার আকার মটর কলাইয়ের মত বলিলে বাড়াইয়া বলা হইবে না। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে রুদ্ধ রাখিয়া সে নীরবে পাঠশালার কাজ করিয়া যায়। এবং নিজের গ্রামখানির একটি ভবিষ্যৎ রূপকে মাতৃগর্ভের ভ্রণের মত বিধাতার কল্পনায় লালন করিয়াও যায় মনে মনে। গ্রামের ছোটখাটো সকল আন্দোলন হইতে সে নিজে যথাসাধ্য পৃথকই থাকিতে চায়। সে জানে ইহাতে তাহার মত অবস্থার লোকের ক্ষতিই হয়। পাঠশালার বাঞ্ছিত দলাদলিতে তাহার না থাকাই উচিত—তবু সকল চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া তাহার আকাঙ্ক্ষা কল্পনা এমনি ধারায় আন্দোলন উত্তেজনা স্পৰ্শ পাইবামাত্র নাচিয়া বাহির হইয়া আসে। গ্রামখানির যাবতীয় অভাব-অভিযোগ, ত্রুটি-বিশৃঙ্খলা তাহার নখদর্পণে। গ্রামের সামাজিক ইতিহাস সে আবিষ্কারকের মত খুঁজিয়া খুঁজিয়া সংগ্রহ করিয়াছে। গ্রামের কামার, ছুতার, নাপিত, পুরোহিত, দাই, চৌকিদার, ধোপা প্রভৃতির কাহার কি কাজ, কি বৃত্তি, কোথায় ছিল তাহাদের চাকরান জমি, সমস্তই সে যেমন জানিয়াছে এমনটি আর কেহ জানে না। বিগত পাঁচ পুরুষের কালের মধ্যে গ্রামের পঞ্চায়েতমণ্ডলীর কীর্তি-অপকীর্তির ইতিহাসও আমূল তাহার কণ্ঠস্থ।
চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায় বসিয়া পাঠশালায় পড়াইতে পড়াইতে দেবু ঘোষ চণ্ডীমণ্ডপটির কথা ভাবে। এই চণ্ডীমণ্ডপটি একদিন ছিল গ্রামের হৃৎপিণ্ড, সমস্ত জীবনীশক্তির কেন্দ্ৰস্থল। পূজাপার্বণ, আনন্দ-উৎসব, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ—সব অনুষ্ঠিত হইত এইখানে। অন্যায়-অবিচার-উৎপীড়ন, বিশৃঙ্খলা-ব্যভিচার-পাপ গ্রামের মধ্যে দেখা দিলে এই চণ্ডীমণ্ডপেই বসিত পঞ্চায়েত। এই আসরে বসিয়া বিচার চলিত, শাসন করিয়া সে সমস্ত দূর করা হইত। গ্রামের ঠিক মধ্যস্থলে স্থাপিত এই চণ্ডীমণ্ডপ হইতে হাক দিলে গ্রামের সমস্ত ঘর হইতে সে ডাক শোনা যায়, সে ডাক উপেক্ষা করিবার কাহারও সামর্থ্য ছিল না। আরও তাহার মনে আছে, চণ্ডীমণ্ডপের পাশ দিয়া। সেকালে যে যতবার যাইত প্ৰণাম করিয়া যাইত। আজকাল আর মানুষ প্রণামও করে না। মধ্যে। মধ্যে তাহার মনে হয় দেবতাকে ঈশ্বরকে উপেক্ষা করিয়াই তাহারা এই পরিণতির পথে। চলিয়াছে। দেবু নিত্য নিয়মিত তিনসন্ধ্যা এখানে প্রণাম করে। আপনি আচরি ধর্ম নীরবে সে পরকে শিখাইতে চায়।
নাস্তিকতার পরিণাম সম্পর্কে এই ঘটনার কাহিনী তাহার অন্তরে অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করিয়া রহিয়াছে। তাহার অবশ্য শোনা কথা, তাহার জীবনকালে ঘটিলেও সে তখন ছিল নিতান্তই শিশু। তাহার বাল্যবন্ধু বিশ্বনাথ মহাগ্রামের মহামহোপাধ্যায় ন্যায়রত্নের পৌত্র। বিশ্বনাথের পিতা পণ্ডিত শশিশেখরের কাহিনী সেটি। পণ্ডিত শশিশেখর তাহার পিতা ওই ঋষিতুল্য ন্যায়রত্নের অমতে ইংরেজি শিখিয়া নাস্তিক হইয়া উঠিয়াছিলেন। এ দেশে ব্ৰাহ্মণসভা ডাকিয়া পুরাতন কালের কুসংস্কার বর্জনের একটা চেষ্টা করিয়াছিলেন। অধিবেশনটার তিনিই ছিলেন উদ্যোক্তা। সেই অধিবেশনে তিনি সর্বাগ্রে নারায়ণশিলা স্থাপন করিয়া অৰ্চনা না করার জন্য ন্যায়রত্ন শিহরিয়া উঠিয়া প্রতিবাদ করেন। নাস্তিক শশিশেখর নাস্তিকতাবাদের যুক্তিতে পিতার সহিত তর্ক করেন। ফলে সভা পণ্ড হয়। শুধু তাই নয়, উদ্ভ্রান্ত শশিশেখরের মৃত্যু হয় অপঘাতে, রেল ইঞ্জিনের তলায় তিনি স্বেচ্ছায় কাটা পড়েন। ঘটনার সংঘটন তাই বটে, কিন্তু দেবু ঘোষ তাহার মধ্যে দেখিতে পায় কর্মফলের অলঞ্জ বিধান। দেবুর সবচেয়ে বড় দুঃখ–এই পরিণতি জানিয়াও ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথও নাস্তিক হইয়া উঠিয়াছে। সে এখন কলিকাতায় এম-এ পড়ে। যখন আসে তখন দেবুর সঙ্গে দেখা করে। এমএ ক্লাসের ছাত্র হইয়াও কিন্তু বিশ্বনাথ এখনও তাহার বন্ধুই আছে। বয়সে সে দেবুর পাঁচ-ছয় বৎসরের ছোট হইলেও দেবুর বন্ধু সে; স্কুলে ভাল ছেলে বলিয়া তাহাদের পরস্পরের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন বিশ্বনাথ তাহাকে দেবুদা বলিত। বয়সের সঙ্গে দেবু আপনার ও বিশ্বনাথের সামাজিক পার্থক্য বুঝিয়া বলিয়াছিল—তুমি আমাকে দাদা বোলো না কিন্তু ভাই; আমার ওতে অপরাধ হয়। বিশু তখন হইতে দেবুকে বলে দেবুভাই। এখন তাহার বন্ধু—সত্যকারের বন্ধু। কখনও শ্রেষ্ঠত্বের এতটুকু তীক্ষা কণ্টক স্পর্শ সে তাহার সান্নিধ্যে অনুভব করে না। এই বিশ্বনাথও সন্ধ্যাক্কি করে না, এই চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়াও কখনও দেবতাকে প্রণাম করে না।
দেবু কিছুদিন আগে এই চণ্ডীমণ্ডপ সম্বন্ধে তাহার চিন্তার কথা বিশ্বনাথকে বলিয়াছিল; কি করিয়া এই চণ্ডীমণ্ডপটির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা যায়, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়াছিল। বিশ্বনাথ হাসিয়াছিল—সে আর হবে না, দেবু-ভাই। চণ্ডীমণ্ডপটা বুড়ো হয়েছে, ও মরবে এইবার।
—বুড়ো হয়েছে? মরবে মানে?
—মানে, বয়স হলেই মানুষ যেমন বুড়ো হয়, তেমনি চণ্ডীমণ্ডপটা কতকালের বল তো? বুড়ো হয় নি?
চাল-কাঠামোর দিকে চাহিয়া দেবু বলিয়াছিলভেঙে নতুন করে করতে বলছ?
বিশ্বনাথ হাসিয়াছিল; বলিয়াছিল রঙিন পেনীফ্রক পরলেই বুড়ো খোকা হয় না, দেবু-ভাই! এ যুগে ও চণ্ডীমণ্ডপ আর চলবে না। কো-অপারেটিভ ব্যাংক করতে পার? কর না ওই ঘরটাতে কোঅপারেটিভ ব্যাংক, দেখবে দিনরাত লোক আসবে এইখানে। ধরনা দিয়ে পড়ে থাকবে।
তারপর সে অনেক যুক্তিতর্ক দিয়া দেবুকে বুঝাইতে চাহিয়াছিল–টাকাই সব। সেকালের ধর্মমত সামাজিক ব্যবস্থার ভিতরেও অতি সূক্ষ্ম কৌশলে নাকি ওই টাকাটাই ছিল ধর্ম, কর্ম, স্বৰ্গ, মর্ত্য, নরক সমস্ত কিছুর ভিত্তি। ভিত্তির সেই টাকার মশলাটা আজ শূন্য হইয়া যাওয়াতেই এই অবস্থা!
দেবু বার বার প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছিল—না-না-না।
বিশ্বনাথ হাসিয়াছিল।
দেবু প্রতিবাদ করিয়া তীক্ষকণ্ঠে বলিয়া উঠিয়াছিল—ছি—ছি—ছি, বিশু-ভাই। তুমি ঠাকুর মশায়ের নাতি, তোমার মুখে এ কথা শোভা পায় না। তোমার প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত।
বিশ্বনাথ আরও কিছুক্ষণ হাসিয়া অবশেষে বলিয়াছিল—আমি কতকগুলো বই পাঠিয়ে দেব, দেবু-ভাই, তুমি পড়ে দেখো।
–না, ওইসব বই ছুঁলে পাপ হয়। ওসব বই তুমি পাঠিয়ো না।
সে প্রাণপণে আপন সংস্কারকে অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। তাহাকে সে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে চায়। তাই নবান্নের দিনে অনিরুদ্ধকে এই চণ্ডীমণ্ডপে পূজার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া তাহাকে সামাজিক শাস্তি দিবার জন্য জগনের সহিত মিলিত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সারা গ্রামটার আর একজনও কেহ তাহাদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল না। অনিরুদ্ধও বিনা দ্বিধায় অবলীলাক্রমে ভোগপূজার থালা তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল। অনিরুদ্ধের পিতৃ-পিতামহের কিন্তু এ সাধ্য ছিল না।
দেবু দিশাহারা হইয়া কয়েকদিন ধরিয়াই এইসব ভাবিতেছে। মধ্যে মধ্যে মনে হয় হয়ত দেবতা একদিন আপন মহিমায় জাগ্রত হইবেন—অন্যায়ের ধ্বংস করিবেন, ন্যায়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবেন। শাস্ত্রের বাণীগুলি সে স্মরণ করে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, কিছুক্ষণ পরেই সে হতাশায় অবসন্ন হইয়া পড়ে।
পাতু মুচি সেই একটি দিনের দিকে চাহিয়াই বাঁচিয়া আছে। সেই ভরসায় সে সমস্ত দুঃখকষ্টের বোঝা মাথায় লইয়া চলিয়াছে। কিন্তু দেবু যে তাহাদের মত কোনোমতেই ওই ভরসায় এমনি করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না।
পাঠশালায় ছুটি দিয়াও দেবু একা চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া ওইসব কথাই ভাবিতেছিল। পথ হইতে কে ডাকিল পণ্ডিতমশায় গো!
—কে?
–ওরে, বাস্ রে! বসে বসে কি এত ভাবছ গো?—মুচিদের দুৰ্গা দুধ বেচিতে যাইতেছিল, পথ হইতে দেবুকে ডাকিয়া সে-ই কথা বলিল।
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দেবু বলিল—সে খবরে তোর দরকার কি রে?
মেয়েটাকে সে দুচক্ষে দেখিতে পারে না; সে স্বৈরিণী—সে ভ্ৰষ্টাসে পাপিনী; বিশেষ করিয়া সে ওই ছিরুর সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। তাহাকে সে ঘৃণা করে।
দুর্গা হাসিয়া বলিলখবরে আমার দরকার নাই, দরকার তোমার বউয়ের। পথের পানে চোখ চেয়ে বিলু দিদি বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে।
তাই তো! দেবুর এতক্ষণে চমক ভাঙিল, সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পাড়াইল। ওঃ, এ যে অনেক বেলা হইয়া গিয়াছে! চণ্ডীমণ্ডপ হইতে নামিয়া সে হনহন করিয়া আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। ভাল মানুষ বউটি সত্যই পথ চাহিয়া বসিয়াছিল। সে বলিল রান্না হয়ে গিয়েছে, চান কর।
দেবুর জীবনে এই এক পরম সম্পদ। ঘরে তাহার কোনো দ্বন্দ্ব নাই, অশান্তি নাই। তাই বোধহয় বাহিরে বাহিরে সমগ্র গ্রামখানি জুড়িয়া দ্বন্দ্ব অশান্তি সন্ধান করিয়া ফিরিয়াও তাঁহার ক্লান্তি আসে না।
দেবু চলিয়া গেলেও দুর্গা অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, দেবু যে পথে গেল, সেই পথ-পানে চাহিয়াই দাঁড়াইয়া রহিল। পণ্ডিতকে তাহার ভাল লাগে খুব ভাল লাগে। ছিরু কে সে এখন ঘৃণা করে, সেই আগুন লাগানোর সংবাদ সে কাহাকেও বলে নাই; ঘৃণায় তাহার সহিত সংস্রব ত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু ছিরু র সহিত যখন তাহার ঘনিষ্ঠতা ছিল—তখনও তাহার পণ্ডিতকে ভাল লাগিত; ছিরু অপেক্ষা অনেক বেশি ভাল লাগিত। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, এই দুই ভাল লাগার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আজ পণ্ডিতকে পূর্বাপেক্ষা যেন আরও বেশি ভাল লাগিল।
পণ্ডিতের সহিত তাহার একটা সম্বন্ধও আছে। রক্তের সম্বন্ধ নয়, পাতানো সম্বন্ধ। দেবুর বউ বিলুকে তাহার মা এককালে কোলেপিঠে করিত। সেই কারণে সে বিলুকে দিদি বলে। দেবু পণ্ডিত তাহার বিলু দিদির বর।