মাকড়ার কাণ্ড
দ্যাকো, দ্যাকো মাকড়ার কাণ্ড দ্যাকো তোমরা–পাঁচু ধমকে উঠল বিলাসকে। বলল, আরে গুয়োটা, তিবড়ি নিবে তোর ভূস হল, ওদিকে কী দেখছিস তুই তাকে তাক্কে, অ্যাঁ? শহর দেখিসনি কখনও?
বিলাস চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, সত্যি, তিবড়ির কাঠ ছাই হয়ে গেছে কখন। ধমক শুনলে রাগ হয়। কিন্তু লজ্জাও হয়। অনেকক্ষণ ধরে খেয়ালই নেই তার। শহর দেখেছে। অবশ্য দুবার। তবে মাছ ধরতে এসে নয়। কলকাতার বাজারের ফড়েরা যায়। তাদের ওদিকে চাষিদের কাছে। চাষিরাও আসে মাঝে মাঝে কলকাতায়। সে চাষিদের সঙ্গে দুবার পালিয়ে এসেছিল। একবার এসেছিল খুবই ছোট থাকতে। আর একবার এসেছিল বড় হয়ে। প্রথম বারে পিঠে পড়েছিল বেড়ন আর দ্বিতীয় বারে গালাগাল। ডাগর শরীরে হাত তোলা যায় না। পালটা গায়ে হাত তোলার অলীক ভয় থাকে মানুষের। আসলে ওটা বাপ-দাদার আপনি সমাজের ভয়। মনে মনে মারতে হয়, মুখে বলতে হয়।
কিন্তু বিলাসের বড় শহরের টান। বেড়ানে গালাগালে তার শেষ হয়নি। দুবারের দুই পাকে তৃষ্ণাটা বরং বেড়েছে বিলাসের। শহরে থাকবার যে সাধ আছে বিলাসের, তা নয়। শহরের মানুষের উপর তো তার টান নেই। আপন-জন নেই, টানবে কে। শহর ঘেঁটে দেখবার বড় শখ। তা সে হবার জো নেই। বলে, ছেলে বিকে যাবে। খেতে হবে মাছ মেরে, তার আবার অত শহরটান কীসের।
মাছ মারতে জানে বিলাস। অনেক কিছু জানে। সমুদ্রেও ঘুরে এসেছে দুবার এর মধ্যেই। তাও অনেক করমকষ্যি করে। ওই যে, বাপ মরেছে। সমুদ্রে। বাপ মরেছে তো ছেলের আর সমুদ্রের ধারে কাছেও যেতে নেই। তবে কি, তোমাদের হাতে পুতুল হয়ে থাকতে হবে নাকি। শহর দেখব না, সমুদ্রে যাব না। রাজা হয়ে গেলুম আর কি। মটমট করে কাঠ ভেঙে, তিবড়ির মুখে ঠেলে দিল বিলাস। দিয়ে তলতা বাঁশের নল দিয়ে ফুঁ দিতে লাগল। ধোঁয়া উঠল কুণ্ডলী পাকিয়ে।
পাশের এক নৌকা থেকে একজন জিজ্ঞাসা করল, কী বলছি পাঁচদা। পাঁচু জবাব দিল বিলাসের দিকে চোখ রেখেই, এই বলছি যা বলার। বলে বিলাসের দিকে ফিরে আবার বলল, ডাল সেদ্ধ হয় নাই এখনও?
বিলাস ফুঁ দিতে দিতেই বলল, কেন, খিদের জ্বালায় আর থাকতে পারতেছ না।–ওই শোনো কথা। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। ওর বাপ হলেও বোধহয় এমনি করেই বলত। ওতে যে রাগ আছে খুব বেশি, তা নয়। স্বভাব। মটমট করে কাঠ ভাঙবে। কটকট করে কথা বলবে। বাপের মতো বুকের ছাতি। গাছের গুড়ির মতো চওড়ায় আর পাশে। নড়লে চড়লে মাংসপেশি সারা অঙ্গে কেউটের মতো। ওঠে কিলবিলিয়ে। যদি বলো, কোথায় চললি রে। মন ভাল না থাকলে বলবে, দক্ষিণে। অথাৎ মরতে। যমের দোর ওই দিকে যে। মন ভাল থাকল সেইখানেই বসে পড়ে বলবে, এই তোমার কাছেই।
মা-খুড়িরাও হেসে খুন। আমরণ! বলল হয়তো, দুখানা কাঠ চেলা করে দে দিনি।
মেজাজ ঠিক থাকল তো ভাল। নইলে, যত কাঠ আছে। ঘরে, সব উঠোনে ছড়িয়ে চলবে কুড়োল কোপানো। মা-খুড়ি চেঁচাবে, আ মুখপোড়া, আ মরণ রে। রােখ রাখা ড্যাকরা, তোকে আর কাঠ ফাড়তে হবে না।
আর হবে না বললে কে শুনছে। বলবে, কাঠ আর তোদের আ-চেলা রাখব না। আমি। রোজ রোজ এক কথার নিকুচি করেছে। কেন, দুখানা কেন, সবই ফাড়ব আজ।
পাঁচুর বাপ, অর্থাৎ বিলাসের ঠাকুরদা দাওয়া থেকে চেঁচাবে, রক্ত, রক্ত, রক্তের দোষগুলান যাবে কমনে? বাপ যা করেছে, তাই করবে তো।
বিলাস বলবে, তবে কি সুরানের বাপের মতো করব?
মা-খুড়ি আর বোনেরা হাসবে আড়ালে। যে সুরীনের বাপের কথা বলছে, সে লোকটি জাতে মৎস্যজীবী হয়েও আসলে সিঁদকাটা চোর। তাই বিলাসের কথা শুনে, পাঁচুর রাগ হল না। ওই কথার মধ্যে বিষ নেই। আসলে মিষ্টতা নেই ছোঁড়ার গলায়, কথা বলতে শেখেনি একেবারে। কথা বলেও কম। চুপচাপ-ই থাকে বেশি। বললে ওইরকম। অবিশ্যি নিজের জনকে। অচেনা মানুষ দেখলে তো ঠোঁট আজও বুজল, কালও বুজল। নতুন লোকে বলে যায়, লোকটা বোবা নাকি হে।
পাঁচু বলল, তা, পেট জ্বলবে না ক্ষিদেয়? সেই তো কোন বেলায় খেয়ে এসেছি খাল-গেটে।
আর কথা নেই মুখে। কাঠ জ্বলে উঠেছে গানগন করে। সেই আলোয় যেন দপদপ করছে। কালো কুচকুচে নাগ।
সবাই চেনে একটু আধটু বিলাসকে। তেঁতলে বিলেসকে। সবাই জানে, বড় রগচটা আর গোঁয়ার। গায়ে শক্তিও তেমন। বলে, নিবারণ মালো বসানো একেবারে। ভাবসাবও সেই রকমের। এ সব ছেলেকে নিয়ে ফ্যাসাদ হয় মহাজনের কাছে। সে মাছমারার বাপ-চৌদোপুরুষের ধার ধারে না। এই পৌষ মাসে হল এক কাণ্ড। ঘরে একটি দানা নেই। ঘরে চলছে পোষ-পোড়া। পাঁচু নিজে যেতে পারেনি মহাজনের কাছে। বিলাসকে বলে পাঠিয়েছে, পাল মশাইকে বলিস, দশটা টাকা যেন অতি অবিশ্যি দেন। এদিকে ছেলে দড়ো। যা বলবে, ঠিক তেমনটি বলবে। গিয়ে বলেছে।
মহাজনেরও বোধহয় মন-মেজাজ খারাপ ছিল। বলেছে, টাকা দিতে পারব না।
–কেন?
আ মালো। কেন কী রে! বল, আজ্ঞে দয়া করুন। তা নয়, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। মহাজন তো চটেই অস্থির। খেঁকিয়ে উঠেছে, আমার খুশি।
—তবে আর মরতে মহাজন হওয়া কেন? মাছ হয়ে জন্মালেই হত?
— মাছ?
—হ্যাঁ, তবে খুশিমতো চলাফেরা করতে পারতে।
আর যায় কোথায়। মহাজন এই মারে তো এই মারে। তবে, ওই যে তেঁতলে বিলেস উনি। মারামারি করে আসতে একটুও চিন্তা-ভাবনা নেই।
পালমশাই ছুটতে ছুটতে একেবারে পাঁচুর কাছে। বাড়ির সকলে মিলে ক্ষমা চেয়ে তবে উদ্ধার পায়। কিন্তু তিনদিন ভাত খেল না বিলাস। ওর মা যে বলেছিল, গিলতে পারিস, আর এ বুদ্ধিটুকু নেই ঘটে?
ওর বাপ ছিল বাছাড়। সে সব আগের দিনের বিষয়। চার-পাঁচ মনের তালগাছের গুঁড়ি একদিকে ধরে তুলে, টেনে যে সবচেয়ে বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারবে, তাকে সবাই সম্মান দেয়, বাছাড় বলে। সে সব খেলা আজকাল উঠেই গেছে। তা গত সনে গঙ্গাপুজোর দিনে হঠাৎ আবার সেই খেলা হয়ে গেল। সবাই টানলে। গাঁয়ের বুড়োরা খুব খুশি। এক সময়ে পাঁচুও আসরে নেমেছে। তবে, বাছাড় হতে পারেনি কোনওদিন।
গত সনে, বাছাড় হত পুরোখোঁড়গাছির পঞ্চাশ বছরের জোয়ান কেদমে পাঁচু। অথাৎ কদমতলার পাঁচু। কিন্তু তেঁতুলে বিলেস কাত করলে শেষ পর্যন্ত। কেদমে পাঁচুর মুখ দেখে বড় কষ্ট হল পাঁচুর। আর রাগ গিয়ে পড়ল ভাইপো বিলাসের উপর। বাড়ি এসে বেজে বললে, এঃ, ভারী একেবারে বাছাড়ের পো বাছাড় হইয়েছেন।
বিলাস অবাক হয়ে বললে, বাছাড়ের পো বাছাড় হবে না তো প্যাঁচা হবে নাকি? কী কন্নু তোমার?
পাঁচু বললে, বুড়ো মানুষটার মুখ হাসাবার কী ছেল। সবাই জানে তেঁতলে বিলেস ষণ্ডা।
যাঃ বাবা! বিলাস তার অপরাধ না বুঝে গুম খেয়ে গেল। ঝাল পড়ল। অন্যের উপরে। ওরই বন্ধু সয়ারাম অর্থাৎ সখারাম পর দিন এসে ডাক দিলে, কই গো বাছাড়।
বিলাস বেরিয়ে এসে তাকে কষলে দুই চড়। বাছাড় কেন, ষণ্ডা বলতে পারো না? সয়ারাম গালে হাত দিয়ে বললে, যাঃ বাবা! ঘরে বসে আড়াল থেকে পাঁচুও মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে বললে, যাঃ বাবা! ছোঁড়ার উপর রাগ করারও জো নাই।
কেদমে পাঁচুর মুখ দেখে যতই কষ্ট হোক, ভাইপোর জন্যে যে আনন্দ হয়নি তা নয়। খুব আনন্দ হয়েছিল। তবে দিনকাল অন্য রকম হয়ে গেছে। কী হবে। আর এ সব করে। এত বড় সংসার দেখবে কে? আজও এক ফোঁটা জমি নেই। মাছমারারা সবাই নজর দিয়েছে ওই দিকে। অনেকে চাষ-আবাদ ধরেছে। মাছের কাজে নেই। আর তারা। এখানে জীবন বড় সংশয়। বাঁচা-মরা জলের হাতে। যা দেন সবই তাঁর দয়া। না দিলে জল মইয়ে ফেললেও কিছু হবে না। এই বুড়ো বয়সে বড় ভয় হয়েছে পাঁচুর। জগৎ সংসারের তিন ভাগটাই জলে জলময়। কিন্তু এ জলের সবটাই বড় অনিশ্চিত। তিনি রাজা করেছেন কাউকে। কাউকে দিয়ে ড়ুবিয়েছেন। তাঁর লীলা অন্য রকম। চাষের কাজেও কম বেশি তাই। তবু লাঙল চালিয়ে, কাদা মাঠে নিজের হাতে চারা পুঁতে দেওয়ার মধ্যে কোথায় যেন একটু ভরসা আছে।
আজ, আজ মনে হয় সে কথা। বড় ভয়ে আর দুর্বল মুহূর্তে সে কথা মনে হয়। কিন্তু, অতীতে কেন, এখনও মন গায়, মীনের রাজ্যে চলাফেরার জন্যে জন্মেছি। তার গহিন স্রোতের অন্ধি-সন্ধি জানি আমি, তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ সম্পর্ক। আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পালাতে পারবে না। আমার সীমানা পেরিয়ে সে একদিন চলে যাবে দূর সমুদ্রে। আর একদিন তাকে ফিরতে হবে। নির্ঘাত ফিরতে হবে, ধরা দিতে হবে। আমার জীবন আর তোমার জীবন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। জন্মকাল থেকে।
তবু, একফোঁটা জমির মধ্যে কোথায় যেন একটি বাঁধা সুখের ঠিকানা লেখা রয়েছে। মানুষের মন ওই রকম। বাঁধা সুখের সন্ধান করে সে। আবার মনে হয়, চাষের জীবনে বা বাঁধা সুখ কোথায়। লোকগুলি হাঁপিয়ে মরে জলের জন্যে। কখনও জলকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য প্ৰাণ দেয়। তার নৌকাও নেই, বাঁধাও থাকে না মহাজনের কাছে। কিন্তু গোটা আবাদি জমিখানি থাকে। সে দাদন নেয় না। ফড়ে ব্যাপারির কাছ থেকে। তবে ঋণ করে শোধ দিয়ে আসে। সারা বছরের ফসল।
তবু, তবু। জলের পোকারও মাটির স্বাদ পাওয়ার বড় বাসনা। বড় ভয় পাঁচুর। নিজের বউ-বোঠান ছেলে-পুলের জন্ম দিলে বড় দেরিতে। দেবেই তো। বিয়ের বয়সে যখন বিয়ে দিলে বাবা মা, তখন বউয়ের বয়স পাঁচ কি ছয়। সে বউ না পারে রাঁধতে বাড়তে, না জানে জাল বুনতে, সেলাই করতে। স্বামীর সঙ্গে শোয়া তো দূরের কথা। এক্কা দোক্কা খেলছে, পিটুলির গোটা দিয়ে খেলছে ঘুটি। শ্বশুর-শাশুড়ির বকুনি আর মার খেয়ে কেঁদোছে বসে ঠ্যাং ছড়িয়ে। কাজ-কর্মের ঘরে অত ছোট মেয়ে হলে কি চলে।।
ডাগর মেয়ের দরকার এ সব ঘরে। কাজ করবে, বিয়োবে বছর না ঘুরতেই। বাপের রক্তে টান ধরতে না ধরতে, মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ছেলে। কাঁড়ারে বসে দাঁড় টানবে, গলুয়ে বসে ধরবে হল। যেমন ঘর তার তেমনি কাজ।
তা নয়, চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেল। এখনও বিয়োচ্ছে বউ।। ঘরে একপােল কুঁচো। ভরসা যা কিছু বিলাস। পাঁচুর নিজের যেটি বড় ছেলে, বিলাসের সঙ্গে নৌকায় আসতে তাকে এখনও কম করে আরও দু-সন ঘরের খেতে হবে।
সেই জন্যেই বিলাসকে নিয়ে বড় ভাবনা পাঁচুর। নিবারণ সাইদারের ছায়া। সব বিষয়ে এর মধ্যেই টেক্কা মারতে চায় খুড়োকে। খুড়োর উপর বিদ্বেষ পুষে নয়। কাজকর্মের চেহারাই অমনি। ভাবও উড়ু উড়ু, আর এমন কিছু নয়। সংসারের আরশি যেমন রাখবে, মুখটি তেমনি দেখবে।
পাড়ার অমর্ত অথাৎ অমৃতটা চিরকালের শোস বাতের রুগি। বাপ বেঁচে থাকতে কিছু জমিজমা করে গেছল। সেই দৌলতে ন্যালাপ্যাংলা অমর্ত বিয়ে করে নিয়ে এল খাস চন্দননগরের পুব পারের এক মালোর ঘরের জাঁহাবাজ খান্ডার মেয়েকে। বড় চটক মেয়েটার, সাজতে-গুজতেও জানে। তাদের কি এই পুবের মাছমারাদের ঘরে মানায়। তবে কেন বিয়ে হল এখানে? না, গায়ে গতরে খেটে মেয়ে দুটি খেয়ে বাঁচবে। বাঁচা কি শুধু দুটি পেটে খাওয়ার জন্যে? মনুষ্যজন্ম নিয়েছ তুমি। সংসারধর্ম চাই তোমার। মেয়েমানুষের ধরিত্রী। জল হলে সে মাছ দেয়, তৃষ্ণা মিটায়। মাটি হলে দেয়। ফসল। না হলে সে আগাছার পোড়ামাটি হয়, নর্দমার জল হয়ে যায়।
অমর্তর বউ তাই হল। অমর্ত তো সংসারধর্ম করতে পারে না। পরের মুখ চেয়ে বেঁচে থাকা। বউ হল দেখনবাউ। তা বললে কি হয়। সে মেয়েমানুষ। তুমি যেমন ইছামতীকে ছেড়ে গঙ্গায় যাও, মাছের সন্ধানে, সেও তেমনি সন্ধানে খর করল দু চোখ। আজন্ম সাধ তার অপূর্ণ রয়েছে। সে পূর্ণ করতে চায়। এইটা যাবৎ জীবের ধর্ম।
কিন্তু এ সংসার প্রথম বিষ দিল।অমর্তের বউকে। অমর্তের কয়েক বিঘা জমি আছে, তাই অমর্তের হাতে তুমি দিলে জোয়ান মেয়েমানুষ। সেই বিষের ক্রিয়া হল। সে ভুল পথে পাড়ি দিল গঙ্গায়। আদর সোহাগ, ভাব ভালবাসা ছেড়ে, সে চাইল শরীর জুড়োতে।
সে হল বাঘিনী। বাঘিনী দিবানিশি থাবা মেরে ফেলে রাখে অমর্তকে। রক্ত খোঁজে বাইরে। কেন না, চাল দেখলে বোঝা যেত, রক্তের স্বাদ পেয়েছে সে আগে।
তা হ্যাঁ, এর মধ্যে দুঃখ আছে মেয়েমানুষের। কিন্তু চরিত্র খারাপ করলে দুঃখ কি দূর হয়। হয় না। সে মেয়ে লাগলে বিলাসের পেছনে। তেঁতলে বিলেসকে দেখলে আর ঘরে থাকতে পারে না। সে। নাম শুনলে, কথা শুনলেই ছুটে বেরিয়ে আসবে। দশজনের সামনেই ঢলে পড়বে হেসে। দাঁড় করিয়ে দুটি কথা বলবে। তাও সোজা কথা নয়, বাঁকা বাঁকা। চোখ ঘুরিয়ে, নাক তুলে ইশারা করে হাসবে।
সে ছোঁড়ারও তো ভয়-ডর নেই। তবে, বাঁকা কথা বোঝে না। কী বলে সেই মেয়েমানুষ, ঠোঁট বাঁকিয়ে, ঠারে ঠোরে, ধরতে পারে না। তখন যায় রাগ হয়ে। আরে ধুত্তোরি তোর নিকুচি করেছে। যা বলবি তা সাফ সাফ বল। কিন্তু জোয়ান ছেলে। রক্তে তার জ্বালা ধরে যায়। চোখে উঠে আসে। রক্ত। সেই মূর্তিকে সবাই প্রয় ভয় পায় এই তল্লাটে। কিন্তু অমর্তর বউ খেলা করে।
সব খবরই পেত। পাঁচু সয়ারামের কাছ থেকে। ঘরে বসে রাগে আর ভয়ে মরে মা-খুড়ি। পাঁচুও তাই। কিন্তু বিলাসের সে সব ভাবনাও নেই। পাঁচু জিজ্ঞেস করে সয়ারামকে, কীরে, কী খবর?
সয়ারাম হেসে বলে, কী খবর আর। বুঝলে খুড়ো, ছেলে তোমাদের হয়। হাঁদা, নয়তো ভগবান। গাঁয়ের অন্য ছেলে হলি কবে গে অমর্তর ঘরে রাত কাটে আসত।
তা ঠিক। তবে এ যে আগুন নিয়ে খেলা। বিষদাঁতওয়ালা সাপ নিয়ে খেলা। কখন কী হয়, কে বলতে পারে।
যে পথে যাবে বিলাস, সেই পথেই অমর্তের বউ। বাঁশঝাড়ে, বাওড়ে, খালের ধারে, পথে বিপথে। মেয়েমানুষের শরীর, তা কী বেহায়া পুষ্টি তার! চোখে লাগে কটকট করে। বুড়ো মানুষেরও লাগে। যত খিলখিল হাসি, ততই যেন শরীরের বাঁধুনিতে আর বাগ মানতে চায় না। ভরা জোয়ারের জল তার সীমা ছাড়িয়ে যেতে চাইছে।
সামনে পেলে, বিলাসকে বলবে, দেখতেই পাও না যে গো!
বিলাস বলবে, এই তো দেখছি! আবার কেমন করে দেখব।
—কই, মনে তো হচ্ছে না যে, দেখছ।
বিলাসের রাগ হয় মনে মনে। অমর্তর বউ প্ৰথম থেকেই বাঁকা। সহজ করে হেসে কয়ে যে মানুষ ভাব ভালবাসা করে, এ তা নয়। চরিত্রে দোষ দাঁড়িয়ে গেছে কিনা। নইলে গামালি পাঁচি যে তাকে দেখে হাসে, তাতে তো বিলাসের রাগ হয় না। এক পাড়াতেই সাতটা মেয়ের নাম পাঁচি। একটাকে ডাকলে সাতটা সাড়া দেয়। ওই তেঁতলে বিলেসের মতো। পাড়ায় বিলেস আছে তিনটি। তেঁতুলতলার বিলেস, তেঁতলে। তেমনি গাম্বিলতলার পাঁচি, গামালি পাঁচ। আসলে গামলিটা গাম্বলি। সে পাঁচির হাসির মধ্যে কী আছে কে জানে। বিলাসের ভারী আনন্দ হয়। বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। খারাপ লাগে না একটুও। ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে।
আর অমর্তের বউ শুধু জ্বালা ধরায় বুকে। যেন ফোঁসফোঁস করছে সাপের মতো। কখন কাকে ছোবলাবে।
পাশ কাটায় বিলাস।
অমর্তের বউ বলে, কী হল গো তেঁতুলে বিছে?
বিলাস বলে, হুল খাওনি তো তেঁতুলে বিছের? খেলে মজাটা টের পাবে।
বিলাস তো হাসতে জানে না। মেয়েমানুষটাও রেগে যায়। বলে ভ্রূ কুঁচকে, হুল ফোটাবার মুরোদ চাই, বুঝলে হে?
–তাই মাকি?
—নয়তো কী?
এক নজরে চেয়ে চেয়ে কী যে করে মেয়েমানুষটা। যেন সাপের মন্ত্র পড়ে। আর নিজেকে দেখাবার কত ছলা-কলা জানে।
কখনও পান খেয়ে ঠোঁট দুটি লাল টুকটুকে করে এসে দাঁড়াবে। অর্ধেক চুল পিঠে রেখে বাকি চুল দেবে বুকের উপর এলিয়ে। ঘোমটার বালাই তো কারুর সামনেই নেই। ও সব চল গাঁয়ে কেউ কোনওদিন দেখেনি।
জামার কী বাহার, কত রকমের শাড়ি। মুখেও নাকি কী সব মাখে। পাশ দিয়ে গেলে সুগন্ধটি নাক থেকে মগজে গিয়ে থাকবে লেগে।
সন্ধ্যাবেলা যদি বিলাসের ও-পথে ফেরার কথা থাকে, তবে, শহরের মতো কাপড় পরে পায়ে জুতো চাপিয়ে দাঁড়ায় দরজার মুখে।
—আহা, সাঁজবেলায় এন্টু দাঁইড়েই যাও না হয়।
–গেলে কী হবে?
কী কাট-কাট কথা রে বাবা। গামালি পাঁচির কথা শুনেছে অমর্তর বউ। তার চেয়ে কি নিরেস নাকি সে।
যদি বা সরেস হলে, ভাবি কই। অ-ভাবের গোড়াই যত স্বভাবটা বাঁকা করে দেয়। বলে, কত দেমাক তোমার, তাই এটু দেখব চেয়ে চেয়ে।
—আরও কিছু দেখাতে পারি।
বলে বিলাস চলে যায়। অমর্তের বউ বলে দূর থেকে, ক্ষ্যামতা আছে?
তারপর একদিন শেষ হয়ে গেল। পাঁচু ভাবে সংসার কী বিচিত্ৰ! সংসারের এই জলময় রূপ। তলে তার কত বিচিত্র বিস্ময়। কত রকম তার জীব, কত রকম তার জীবনধারণ। কী বিচিত্র তার লীলা। ভাবতে ভাবতে বিশ্বের এই সর্ব চরাচরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে অবশ হয়ে যায়। মানুষও যে কত বিচিত্ৰ! নিজের দাদাকে দিয়ে বুঝেছে। বিলাসকে দিয়ে বুঝেছে। বুঝেছে অমর্তর বউকে দিয়েও।
একদিন ঘোর দুপুরে ফিরছিল বিলাস। মেজাজ বড় খারাপ। পাঁচু পাঠিয়েছিল মহাজনের কাছে নৌকা বাঁধা আছে। আরও বিশটা টাকা। যদি এখন দেয়, খেয়ে বাঁচে। দেয়নি, বরং দুটো কথা শুনে ফিরছিল।
অমর্তর বউ গোয়ালের পাশ থেকে বলে উঠল, কাঁটা দিয়ে রেখেছি পথে।
বিলাস দাঁড়িয়ে বলল, কীসের কাঁটা?
–মনের কাঁটা।
—মনের কাঁটা? রাগ হয়ে গেল বিলাসের। যেন ফণা তুলে বলল, কোন পথে?
-তোমার পথে।
–কেন?
ঠোঁট টিপে বলল অমর্তের বউ, বিধবে তোমার চলতে ফিরতে।
ও, গুণ করেছ তা হলে। হেসে বিলাস চলে যাচ্ছিল।
অমর্তর বউ বলল, কী হল। কাঁটায় মরবে, তার চেয়ে এক দণ্ড থেমে যাও।
থেমে গেল বিলাস। এল হনহন করে গোয়ালের কাছে, একেবারে অমর্তের বউয়ের গায়ের পর।
কোথায় গেল হাসি-মশকরা। পুরুষ দেখেছে। অনেক অমর্তের বউ। এমন দপদপে নাগ দেখেনি। ভয়ে এক পা পেছুল সে।
বিলাস কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো তার হাত ধরে বলল, পালাচ্ছ কেন, কাঁটার গুণ দেখে যাও। বলে টেনে নিয়ে ফেলল গোয়ালের বিচুলি গাদার অন্ধকারে। …
রাইমঙ্গলের জোয়ার এসেছে তখন, যত হাজা-মজা ফালি-ফ্যাকড়া নদীর বুট নেড়ে, বুক ড়ুবিয়ে। ইছামতী তার জোয়ারের ঠোঁটে নিয়ে এসেছে চৈত-টোটার বাতাসের শাসনি। নির্জন দুপুরটা বাতাসের মারে উলটিপালটি খেতে লাগল।
সেই থেকে অমর্তর বউ একেবারে ঠাণ্ডা। আর কোনওদিন পথ আটকায়নি বিলাসের। এ যেন গহিন জলের বিস্ময়।
সবদিকে, একেবারে চেহারায় চরিত্রে বাপ বসানো। বড় ভাবনা হয় এ ছেলেকে নিয়ে পাঁচুর। সংসারে নানান রকম দোষগুণ আছে ছড়িয়ে। তার হাত থেকে কেউ-ই পাের পায় না। শুধু দোষের মানুষকে নিয়ে কেবল ঘৃণা। শুধু গুণের মানুষকে নিয়ে সংসারে অচল হতে হয়। বিলাস দোষ-গুণের মানুষ। ওর উপরে রাগ করতে পারেনি পাঁচু।
ছেলেটা কাজে কর্মে খুবই দড়ো। শুধু যে চেহারায় বাপের মতো, তা নয়। এর মধ্যেই আকাশ-বাতাস চিনেছে। কোন মেঘ জল ঢালবে, কোন মেঘ ঢালিবে না, বুঝেছে। জল চিনেছে, জলের লীলা বুঝেছে, গোন কোটাল ধরতে শিখেছে। সব শিখল এই পাঁচুর হাত দিয়ে।
বিলাসকে দেখতে দেখতে পাঁচুর সেই রাম মালোর গল্পের বাদার প্রথম পুরুষের কথা মনে পড়ে। বিলাস তার ভক্তির পাত্র নয়। কিন্তু পাঁচুর বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ভয় ও বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিলাস। তবে আজকালকার দিনে সাইদার হওয়া কঠিন। সে রকম ওজনের মানুষ হওয়া দরকার। তোমার মুখ দেখে তো আড়তদার কারবারি পাঁচ-সাত হাজার টাকা ছেড়ে দেবে না। সেই ওজনের মানুষ হতে হবে। জনাজনের মাথার উপরে দাঁড়াতে হবে। কইয়ে বলিয়ে হিসেবি হওয়া চাই। যাতে সবাই মানে। আবার সমুদ্রের কারসাজি বুঝতে হবে। দশ-বিশ গণ্ডা নৌকা নিয়ে যাবে। তুমি। এতগুলি লোকের কীসে আপদ-বিপদ সে সব তোমার জানা দরকার।
তা ছাড়া ওই যে বংশে একটা কাঁটা পড়ে গেছে। একজন সমুদ্রের গর্ভে গেল। টাকির ঠাকুর মশাই বলেছেন, আর কাউকে সমুদ্রে পাঠিয়ো না পাঁচু। তোমাদের বংশে আর কারুর সমুদ্রযাত্রা নেই।
যদি যাত্রা করে?
তবে আসল জীবের নজর খাড়া আছে, একটা সর্বনাশ হতে পারে। এ তো আর তোমার আনাড়ি গাঁজাড়ি মানুষের কথা নয়। মাটিতে ষোলো ঘর কেটে, সমুদ্রের শমনকে বেঁধেছে। ছেড়েছে কথা আদায় করে। রীতিমত অ্যােকজোক কষার ব্যাপার। একে ঠাকুর, তায় গুণিন। অব্যর্থ শুলুক সন্ধান করে বলেছে।
তা কে শুনছে। সে কথা। শ্ৰীমানের এর মধ্যে দুবার ঘুরে আসা হয়েছে। সমুদ্রে। ওঁর যে বড় নেশা। বড় টান। একবার যাকে ধরেছেন। উনি, সে তো আর থর থাকতে পারবে না। ওঁয়ার ডাক যে কেমন করে কখন আসে সে পাঁচু টের পেয়েছে অনেক বার। নিজেকে দিয়ে নয়, দাদা নিবারণকে দিয়ে। এই গঙ্গাতে নৌকোর গলুইয়ে বসে বসে দেখেছে, কাঁড়ারে বসে দাদা তার দক্ষিণ দিকে চেয়ে রয়েছে গালে হাত দিয়ে। যে বারে বিশেষ করে, মা গঙ্গা নির্দয় হতেন। মা গঙ্গার নির্দয় হওয়া যে কী বস্তু, সে জানে তারা, যাদের জীবনমরণ গঙ্গার গহ্বরে। এই তাবৎ চব্বিশ পরগনা, হুগলি, নদিয়া, ওদিকে খুলনার পশ্চিম, যশোরের দক্ষিণ-পশ্চিমের মাছমারারা সব আসে গঙ্গায়। এখন দেশ ভাগাভাগি হয়েছে। পূরবির হিন্দু মাছমারারা সবাই এখন সার করেছে গঙ্গা।
গঙ্গা-ই আসল। বিশেষ এই মরশুমে। টানের দিনে সমুদ্রে পাটাজালের সাই দমে ভারী হয়ে ফেরে না। পাটাজালের সাই ইলিশের চক খোঁজে। পানসা জালের সাই হল টানের সমুদ্রের আগল।
যে মরশুমে গঙ্গা নির্দয় হয়েছে, নিবারণ মালো চেয়ে থেকেছে দক্ষিণে। আর থেকে থেকে বলেছে না, আর ফিরে কোটালটা দেখা চলবে না রে পাঁচু। ফিরে গে আড়তদারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিই।
ওই! ওই বোঝা গেল, ডাক পড়েছে।
সেই ভয় পাঁচুর, ভাইপোকে নিয়ে। সে যে মুখ দেখলে বুঝতে পারে, ও ছোড়াও ডাক শুনতে পায়। ওই যে কান খাড়া করে একবার। এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়, এ সব ভাবভঙ্গি যে পাঁচুর নখদর্পণে। তার মানে, ছোঁড়ার মন দিবানিশি উথালি পাথালি। শুধু সমুদ্রে যাবার জন্যে নয়, সব কিছুতেই।
যার তুমি সবটুকু দেখেনি, জানো না, চেনো না, সেই দিকেই তোমাকে টানে। তার দিকেই বার বার তুমি চোখ তুলে তাকাও। মন মানে না। শহর, সমুদ্র, গঙ্গা, মানুষ, সব কিছুতেই বড় বেশি ঔৎসুক্য বিলাসের।
যা ওর মন বলে তা না করে ও ছাড়ে না। যা প্ৰাণ চায়, তা ছাড়বে না প্ৰাণ থাকতেও। তা নইলে আর মালোর ছেলে হবে কেন।
ওই যে বলে না, ঝালো আর মালো, দুই ভাই। এক মায়ের সন্তান, জন্ম নিলে ভগবানের গলার মালা থেকে। কে করেছে আর পাঁজিপুঁথির তত্ত্ব-তল্লাশ। গাঁয়ে ঘরের লোকে বলে, শোনেও গাঁয়ে ঘরের লোকে। তা ও দুই ভাই-ই, ভগবানের বিধেনে হয়েছে মাছমারা। মা-মনসার বৃত্তান্তের মধ্যেও আছে দুই ভাইয়ের কথা।
এক জায়গা থেকে জন্ম নিলে দুই ভাই কিন্তু এক ভাই হলে পতিত। তার জল চলে না। সমাজে। কী বা আছে জাতের। তবে, ওই একটা কথা। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছ, তোমার একটা বৃত্তান্ত থাকবেই।
পতিত হল মালো। কেন? না, ওই যে, যা মন চাইল, তা-ই ভাল। যা চাইল না, তার কাছে আর নয়।
সে বহুদিন আগের কথা। ঝালো-মালোর ঘরে এসেছেন তাদের গুরুদেব। গুরুদেব বলে কথা। সাক্ষাৎ ভগবান-তুল্য। সেবা করো, ভক্তি করো। তখন মালো পতিত নয়। দুই ভাই ভক্তিভরে সেবা করলে গুরুর।
তারপর গুরুদেবের ভোজন হল। নিদ্রা দিয়ে উঠে গুরুদেব গেলেন পায়খানায়। বললেন, মালোরে মালো, জলটা একটু এগিয়ে নিয়ে আয়।
গুরুর আদেশ। তার ওপরে তো কথা চলে না। কিন্তু মালো যে! জল সরবেন গুরুদেব, তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। তবে রইল গুরুর আদেশ। আমার দ্বারা হবে না।
গুরুর আদেশ অমান্য। ওরে মালো, পতিত হবি যে! হই হব। তবু, ওটি আমার দ্বারা হবে না। গুরুরও এক কথা, মালোরও এক কথা। যা পারব না, তা পারব না।
ঝালো গিয়ে তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দিল গুরুদেবকে। গুরুদেব খুব খুশি। সেই থেকে মালো গেল পতিত হয়ে। না, পাঁজিপুথির কথা জানিনে, বাপ-ঠাকুদ্দার মুখে শোনা কথা। আমরা জানি, এই আমাদের বৃত্তান্ত।
তা বিলাস হল সেই মালোর ঘরের ছেলে। গুরু মানে না, বাপ-খুড়ো মানে না। আর যদি মানে, সে ওর শমন হলেও প্ৰাণ সঁপে দেবে তার পায়।
বড় ভয় পাঁচুর। এই ছেলের হাতে সঁপে দিয়ে যেতে হবে গোটা গেরস্থি সংসার। এই ছেলেকে নিয়ে, একটু জমির স্বপ্ন দেখছে সে। সেই বাঁধা সুখের ঠিকানা। গত পাঁচ বছর ধরে, এই গঙ্গাই পাড়ি দিয়েছে সে বিলাসকে নিয়ে। কোনও রকমে গোটা সংসারের কয়েক মাসের খোরাকি নিয়ে ফিরে গেছে। যা দিয়েছেন। গঙ্গা, তাই নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু উপচে পড়েনি কোনওদিন। যে ওপচানোটুকু দিয়ে, একটু জমির বন্দোবস্ত করতে পারবে।
—নেও, বাস সে। কলায়ের থালায় ভাত বেড়ে দিল বিলাস পাঁচুকে। চুড়চুড় করে বেড়েছে। ভাত। এখনও মুখ গোমড়া করে রয়েছে। আর একবারও ফিরে তাকায়নি। শহরপারের দিকে।
জাল সরিয়ে রেখে, গঙ্গার জলে হাতমুখ ধুয়ে, খেতে বসল। পাঁচু। ভাতের মাঝখানে গর্ত করে মুসুরি ডাল ঢেলে দিয়েছে।
পাঁচু বলল, তুও বসে যা।
—বসছি।
পাঁচু আবার বলল, কতটা চাল ফুট্টেছিস?
বিলাস নিজের ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, পাঁচপো।
ওর কমে হয় না। দুটো মানুষের। কুল্যে আর বিশ দিনের ভাত আছে নৌকায়।
পাশের এক নৌকায় ছিল কেদমে পাঁচু। জিজ্ঞেস করল এই পাঁচুকে, বসে গেলে নাকি পাঁচদা।
পাঁচু বলল, হ্যাঁ ঠাকুরের নাম নে। এদিকে তো সময় যায়। জোয়ার এলে তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারব না। ত্যাতক্ষেণে আর এটুস জিরেন হয়ে যাবেখনি। তোমাদের কদ্দুর?
জবাব এল, এই বসলুম বলে। তো পাঁজি-টাজি দেখে এয়েছ এবারে? পাঁজি কী বলে?
পাঁচু মুখের গরাস গিলে বললে, আজকালকার পাঁজিগুলানও হয়েছে তেমনি। গেছলুম একবার পুবের বাউনবাড়িতে। নতুন ঠাউর দেখে বললে, এট্টাতে বলছেন দশ, আর এট্টাতে পাঁচ। নেও এখন, বোঝা ঠ্যালা।
তাও বটে। যাবৎ সংসারের সব কিছু ঘোষণা করেন আগে পঞ্জিকা। বড় বড় পণ্ডিতেরা বলেন সব গুনে গেথে।। ওঁয়ারা হলেন আবার গুণিনের বাপ।। ভূত প্ৰেত দানো, সে সব ছাড়াও জগতে কত জল আসবেন এ বছরে, কত ধান শস্য মৎস্য, সব লেখা আছে ভাগের ভাগ। মায় তোমার সাপ শ্বাপদ, মারি মড়ক, কোনও হিসেব বাদ নেই।
পঞ্জিকা বেরুবার আগে থেকে মাছমারারা ছটফট করে। দশটা কথায় আজকাল একটা মিলতে চায় না। তবু ওই যে পেট থেকে পড়ে, বাপ-পিতামোর আমল থেকে দেখে আসছে। লেখার সঙ্গে কাজের মিল না হলে বোঝে, অদৃষ্টের লিখন খারাপ হয়েছে। নইলে, যুগযুগান্ত ধরে শুনে আসছি, আজ ফলে না কেন সব? মাছমারাদের পাপ ঘটেছে নিশ্চয়।
তাই, পঞ্জিকাখানি এলে আগে দেখবে খুলে, মা-গঙ্গা এবার মাছ দিয়েছেন কত। কিন্তু তার মধ্যেও আজকাল আবার নানান ফ্যাকড়া দেখা দিয়েছে। দশ জনের হয়েছে দশটা পাঁজি। তা না হয় হল, গুনে গেঁথে সবাই এক কথা লেখো। না, তা লিখবে না। দশ জনের দশ রকম, নানা মুনির নানা মত। ভেবে মরে মাছমারারা। যদি বলো, দেখো কেন দশটা, একটা দেখলেই পারো। তা কি হয়। তুমি না দেখলে তোমাকে এসে শোনাবে আর একজন।
তবে হ্যাঁ, শেষবেলায় আসল মার্জি মাছের। মন চাইল তো সে গোটা সমুদ্র ছেকে আসবে তোমার কাছে। নয়তো একেবারেই কানা। এমনও হয়েছে কত বার।
কেদমে পাঁচু বলল, এ পাঁজি-লিখিয়েদের ভাবসাব বাপু কিছু বুঝতে পারিনে। কলকাতার সেই পুরনো পাঁজিটা কত লিখেছে?
পাঁচু বলল, সে লিখেছেন পাঁচ। নতুন পুরনো, সবই তোমার কলকাতার। নতুনটা লিখেছেন দশ।
এতক্ষণে বলে উঠল বিলাস, পাঁচ দিলেও তোমার আর দশ দিলেও তোমার। পাঁজিপুতির কথা ছাড়ান দেও। ও সব বাজার গরম করা কথা।
ওই শোনো কথা। বাপ-খুড়োর কোনও কথাতেই প্রত্যয় নেই। না ফলুক সব কথা, তারা এতদিন বিশ্বাস করে এসেছে। মাছমারার ব্যাটা মাছমারা, তুও বিশ্বেস যা। তা হবে না। রাগ হয়ে গেল পাঁচুর। বলল, তবে কি ওগুলান মাঙনা মাঙনা লেখা হচ্ছে?
বিলাস বলল, মাঙনা হবে কেন? মাছের চে কি পাঁজি বিক্কির কম হয়? ট্যাঁকের টাকা খসিয়েই হয়।
—গুয়োটা কমনেকার! খেঁকিয়ে উঠল। পাঁচু। —আরো মাকড়া, আমি তোর পয়সার মাঙনা-মাঙনির কথা বলিনি। বলছি ঘটের বুদ্ধির কথা। মাঙনা বুদ্ধিতে তো আর ওগুলান লেখা হয়নি।
—আর সে বুদ্ধি নে? আমি মালুম ফাঁপরে। কী আমার শখ রে!
ঢকঢক করে জল খেল বিলাস ঘটি কাত করে। পাঁচুর মনে হল। ঠাস করে এক চড় কষায় ছেলেটার গালে! আবার বলল, যা আসবে, তা আমার জালে আসবে। পাঁজি লিখলেও আসবে, না লিখলেও আসবে। ও সবই তোমার জলের মর্জি। কী বলো পাঁচকা।
কেদমে পাঁচুকেও বিলাস কাকা বলে। কেদমে পাঁচুর মনটা আবার তেমন প্ৰসন্ন ছিল না বিলাসের উপর। সেই যে সে বারে বাছাড়া হয়ে গেল বিলাস, সেই দুঃখে। খালি বলল, হ্যাঁ, যেমন দিনকাল পড়েছে—
আবার বলল বিলাস, এতখানি বয়স হল, কোনওদিন তো দেখলাম না যে পাঁজি একেবারে অব্যাখ কথা লিখেচে।
-এঃ, বড় তোর বয়স হয়েছে।
–ওই যা হয়েছে, তাই কে সামলায়।
দেখো, দেখো কথার ছিরি।
আবার বলল, ও পাঁজির কথা পাঁজিতে থাক। জলে আছি, জলের কথা বলে।
পাঁচু বলল, নে নে, তোর ব্যক্তিমে রাখা দি নি। সব তুলে পেড়ে ফ্যাল। ভারী একবারে দিগগজ। এসে গেছেন।
এঁটো থালা গঙ্গায় ডুবিয়া ডুবিয়ে ধুতে ধুতে জলের দিকে তাকিয়েই নির্বিকার গলায় জবাব দিল বিলাস, তা বাপ-খুড়োরা যা্যাখন এতখানি দিগগজ করেছ
ওই রকম গা-জ্বালানে কথা ছেলেটার। খুড়োকে রাগাবার জন্যে যে এমন করছে, তা নয়। বলে দিল, যা মুখে এল। তোমার কতখানি লাগল, কতখানি রািগলে, সে বোঝাগে তুমি।
পাঁচু রেগে বলল, মরবি কিন্তু গুঁতো খেয়ে।
বিলাস তখন গুনগুন করছে, শহরের আলো-কাঁপানো গঙ্গার দিকে তাকিয়ে।
কলকেটি নিজে সাজিয়ে হুঁকোয়া চড়িয়ে টানলে খানিকক্ষণ পাঁচু। টেনে ছইয়ের মুখছাটে বুলিয়ে রেখে, কাঁড়ারে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বসল জাল নিয়ে। বিলাস হুঁকোটি নিয়ে বসল গলুয়ে, অন্য দিকে মুখ করে।
পাঁচু বলল কাঁড়ার থেকে, তোর মা যে স্যাংলোখানা বুনে দিয়েছিল, সেটা কোথায় রেখেছিস?
বিলাস বলল, ছাঁইয়ের মধ্যে আছে।
স্যাংলো হল ইলিশ মাছের হাতে জাল।
গুড়গুড় করে শব্দ হচ্ছে হুঁকোয়। গঙ্গার পারের শহর অন্ধকার হচ্ছে একটু একটু করে। আছে শুধু রাস্তার বাতিগুলি। বিজলি গাড়ির শব্দ আর নেই ঘন ঘন। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাচ্ছে দু-একটা স্টিমালঞ্চ, ছোট স্টিমার।
কৃষ্ণপক্ষের আজ ষষ্ঠী। চাঁদ উঠেছে, ঢাকা পড়ে রয়েছে মেঘের কোলে। মেঘের আড়ালে আড়ালে উঠছে, লুকোচুরি খেলছে, নইলে যেন ধরবে তাকে খপ করে।
তবে ঢাকা কি থাকে। সোনার চাঁদ বলে কথা। কালো মেঘও ফরসা দেখাচ্ছে তার রোশনাইয়ে।
নৌকা অনেকখানি নেমেছে। ভাঁটার টান এখনও মন্দ না। ঢেউ লেগেছে খুব। জল কমেছে কিনা। তার মানে বয়স কমল। এখন ছেলেমানুষের মতো কলকল ছলছল হচ্ছে। আবার যখন ভরে হবে টইটম্বর, তখন দেখবে, মুখে আর বাক্যি নেই। সংসারের নিয়ম। এই গঙ্গার বুকে বসে কখনও তোমারও বাক্যি হরে যাবে। জোয়ার কখনও দুখের, কখনও সুখের। মাছমারারা তার মনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে গঙ্গার সুখ-দুঃখ। সুখে নয়, দুঃখে জোয়ার হলে, এমনিই হয়। বুকখানি ভরে যায়। প্ৰাণখনি টাইটুম্বুর হয়ে, ফুলে ওঠে। শুধু কথা সরে না মুখে।
এখন যেন ঝাঁপাই ঝুড়ছে গঙ্গা। তার সঙ্গে আছে দক্ষিণা বাতাস। বাতাসে ঠিক সেই গন্ধটি পায়
পাঁচু, সেই ডাক শুনতে পায়। দক্ষিণের ডাক। যেন বুকে বান ডাকে,-পাঁ-চু!…
বয়স হল বইকী দক্ষিণে যাওয়ার। ওই যে দেখা যায়, আকাশের পুব কোণে, কে যেন চিকচিক করে হাসছে। বোঝে পাঁচু, খালি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মালোর পো, সময় হয়ে এল যে! যেন মীনচক্ষুর হাসি। বলছে, এইটাই সংসারের খেলা। মাছমারা, এবার তোমার পালা এসেছে! বিদ্যুতের চিকচিক চিকুর সেই কথাটার চমক দিয়ে যায়।
পালা আসবেই। শুধু বিলাসকে নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হতে চায় পাঁচু। মরণের ভয় তো মাছমারার নেই। মরণ ও মারণ, ওই যে তার প্রত্যক্ষ জীবনের পথ।