খুন করা সহজ
গোল্ডফিশটাকে মেরে ফেলতে কোনও কষ্ট হয়নি।
কাচের জারের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মাছটার ছন্দময় অলস সাঁতার দেখছিলাম, তারপর জলের মধ্যে ঢেলে দিলাম ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড। প্রথমে কয়েক ফোঁটা–তাতে মাছটার সাঁতারের গতি অনেক দ্রুত হল–আর তারপর একেবারে গোটা বোতলটা উপুড় করে দিলাম। আমার হাত দস্তানায় ঢাকা। যদি অ্যাসিড লেগে যায়! চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে লাগলাম, কীভাবে অ্যাসিড ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছে জলে, উদ্গত ফেনা ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে জারের কিনারা থেকে।
মাছটা চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বৃত্ত রচনা করল ওপরে-নীচে। আমার মনে পড়ে গেল মেলায় দেখা নাগরদোলার ঘূর্ণি-খাওয়া কাঠের ঘোড়ার কথা। অ্যাসিড চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতেই মাছটা যেন পাগল হয়ে উঠল। অ্যাসিড ওটাকে কুরেকুরে খেতে লাগল, ক্রমশ ঢুকে পড়ল ওটার শরীরের ভেতরে।
কাকাতুয়াটা আর কখনও কাউকে বিরক্ত করবে না। ওটা জারের কাছে এসে দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াত, মাথা কাত করে দেখত গোল্ডফিশটাকে, যেন এখুনি জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করবে।
কাকাতুয়াটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে খাওয়ার ঘরের টেবিলে রাখা ফলের রস তৈরির যন্ত্রটার দিকে তাকালাম। একদিকে ফল ঢুকিয়ে হাতল ঘোরালেই অন্যদিক দিয়ে রস বেরিয়ে আসে।
কাকাতুয়াটাকে মেরে ফেলতে কোনও কষ্ট হয়নি। খাঁচায় হাত ঢোকাতেই ওটা কঁকিয়ে উঠেছিল। আমি ওটাকে চেপে ধরলাম দস্তানা পরা হাতে। যদি কামড়ে দেয়! রস তৈরির যন্ত্রের মুখে ওটার মাথাটা ঢুকিয়ে যখন চেপে ধরলাম, তখনও ওটা চেঁচাচ্ছে। ধীরে-ধীরে হাতল ঘোরাতে শুরু করলাম। কুড়মুড় কুড়মুড় শব্দ হল। ওর শরীরের থকথকে লাল অবশেষ টেবিলে গড়িয়ে পড়তেই কাকাতুয়াটা চুপ করে গেল। ওটার ছোট্ট কচি হাড়গুলো মড়মড় করে ভাঙতে লাগল। আমি হাতল ঘুরিয়ে চললাম।
কাকাতুয়াটার পালক আর রক্তমাখা থকথকে ঘন অবশেষ হাতে করে চেঁছে তুলে নিলাম। একটা ঠোঙায় ওগুলো ভরে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলাম।
বেড়ালটা আর কখনও কাউকে বিরক্ত করবে না। ওটা কেবলই খাঁচার পাশে রাখা চেয়ারে লাফিয়ে উঠত আর একটা থাবা কাকাতুয়াটার খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করত।
বেড়ালটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে জ্বলন্ত উনুনের দিকে তাকালাম।
বেড়ালটাকে মেরে ফেলতে কোনও কষ্ট হয়নি।
ওটাকে তুলে নিয়ে গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে উনুনের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর–একদম আলতো করে ওটাকে বসিয়ে দিলাম উনুনের গনগনে আঁচে। সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ালটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু ভারী সাঁড়াশিটা দিয়ে ওটাকে চেপে ধরলাম গরম কয়লার সঙ্গে। পোড়া লোমের কটু গন্ধে ঘর ভরে গেল। মাঝে-মাঝে গরম কয়লাগুলো ফটফট শব্দে ফাটতে লাগল।
আরও কিছু কয়লা এনে উনুনে চাপিয়ে দিলাম, বেড়ালটার দগ্ধ হাড়-মাংসের ওপরে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘরে নাচতে শুরু করল।
কুকুরটা আর কখনও কাউকে বিরক্ত করবে না। ওটা দিনভর উঠোনে-বাড়িতে বেড়ালটাকে তাড়া করে বেড়াত, ঘেউঘেউ করত বিচিত্র সুরে। অবশেষে বেড়ালটা গাছ বেয়ে উঠে পড়ত, হয়তো লাফিয়ে পড়ত পাশের বাড়ির ছাদে বাঁচার জন্যে।
কুকুরটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে রঙের টিনটার দিকে তাকালাম।
কুকুরটাকে মেরে ফেলতে কোনও কষ্ট হয়নি।
তবে কুকুরটা বেড়ালটার চেয়েও বেশি ধস্তাধস্তি করেছিল। কারণ, ওটার কখনও কোলে চড়া অভ্যেস ছিল না। ওটাকে কোলে তুলে এক হাতে চেপে ধরে অন্য হাতে রঙের টিনটা তুলে নিতেই বড়-বড় আকুতি ভরা চোখে সে আমার দিকে তাকাল। আধ টিন ঘন নীল রং ঢেলে দিলাম কুকুরটার চোখে-মুখে। ওটা বিচিত্র শব্দ করে বমি করল, পা ছুঁড়তে লাগল বীভৎসভাবে। ওটাকে চেপে ধরে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু উপায় কী! বাকি আধ টিন রং তো ঢালতে হবে!
বমি মেশানো আঠালো নীল রং গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, আমার গায়ে। অবশেষে ওটা মারা গেল। ওকে ছেড়ে দিতেই নীল রং মাখা ছোট্ট দেহটা শব্দ করে পড়ে গেল মেঝেতে।
কুকুরটার জন্যে আমার বউ খুব দুঃখ পাবে–সেইসঙ্গে বেড়ালটার জন্যেও, মাছটার জন্যেও, কাকাতুয়াটার জন্যেও। সবাইকে ও ভালোবাসত। ওদের জন্যে আমার বউটার বড় কষ্ট হবে। আমি আত্মহত্যা করলে ও দুঃখ পেত। আমি মরে গেলে আর কাকে ও দিন-রাত অপমান করবে, যন্ত্রণা দেবে? শাসন করার, বিরক্ত করার আর তো কেউ থাকবে না।
মাছটা, কুকুরটা, কাকাতুয়াটা, বেড়ালটার মতো আমাকেও যদি আমার বউ ভালোবাসত, তা হলে কত ভালো হত! অনেক ভালো হত।
এই তো, দরজায় কে কড়া নাড়ছে। আমার বউ এসে গেছে। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিই।
আমার বউয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনের রাস্তায় দাঁড় করানো সিমেন্ট মেশানোর যন্ত্রটার দিকে তাকালাম।
আমার বউটাকে মেরে ফেলতে কোনও কষ্ট হবে না।