রামেশ্বরবাবুর উইল
ব্যোমকেশের টেলিফোন পাইয়া ডাক্তার অসীম সেন আসিয়াছেন। নলিনী ও দেবনাথকে সঙ্গে লইয়া। ঘরের মেঝোয় আগুনের আংটা ঘরের বাতাবরণকে আরও উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছে।
ব্যোমকেশ চিঠিখানি সযত্নে হাতে ধরিয়া বলিতে আরম্ভ করিল–
‘রামেশ্বরবাবু হাস্যরসিক ছিলেন, উপরন্তু মহা বুদ্ধিমান ছিলেন। কিন্তু তাঁর শরীর অসমর্থ হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা তাঁর ছিলন। তিনি ছেলে আর পুত্রবধূর হাতের পুতুল হয়ে পড়েছিলেন।
‘তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে আসছে, তখন তাঁর ইচ্ছা হল মেয়েকেও কিছু ভাগ দিয়ে যাবেন। কিন্তু মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ দিতে গেলে উইল করতে হয়, বর্তমান আইন অনুসারে মেয়ের পিতৃ-সম্পত্তির ওপর কোনো স্বাভাবিক দাবি নেই। রামেশ্বরবাবু স্থির করলেন তিনি উইল করবেন।
‘কিন্তু শুধু উইল করলেই তো হয় না; তাঁর মৃত্যুর পর উইল যে বিদ্যমান থাকবে তার স্থিরতা কি? কুশেশ্বর আর লাবণ্য সম্পত্তির ভাগ নলিনীকে দেবে না, তারা নলিনীকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। তারা নলিনীকে বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না, সর্বদা রামেশ্বরবাবুকে আগলে থাকে; তিনি যে-সব চিঠি লেখেন তা খুলে তদারক করে, চিঠিতে সন্দেহজনক কোনো কথা থাকলে, চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
‘তবে উপায়? রমেশ্বরবাবু বুদ্ধি খেলিয়ে উপায় বার করলেন। সকলে জানে না, পেঁয়াজের রস দিয়ে চিঠি লিখলে কাগজের ওপর দাগ পড়ে না, লেখা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু ওই অদৃশ্য লেখা ফুটিয়ে তোলবার উপায় আছে, খুব সহজ উপায়। কাগজটা আগুনে তাতালেই অদৃশ্য লেখা ফুটে ওঠে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন ম্যাজিক দেখানোর শখ ছিল; অনেকবার সহপাঠীদের এই ম্যাজিক দেখিয়েছি।
‘রামেশ্বরবাবু এই ম্যাজিক জানতেন। তিনি আবদার ধরলেন, কাঁচা পেঁয়াজ খাবেন। তাঁর ছেলে-বৌ ভাবল ভীমরতির খেয়াল; তারা আপত্তি করল না। রামেশ্বরবাবু হামানদিস্তায় পান ছেচে খেতেন; তাঁর পান খাওয়ার শখ ছিল, কিন্তু দাঁত ছিল না। পেঁয়াজ হাতে পেয়ে তিনি হামানদিস্তায় থেতো করলেন; গঁদের শিশি থেকে গদ ফেলে দিয়ে তাতে পেঁয়াজের রস সঞ্চয় করে রাখলেন। কেউ জানতে পারল না। তাঁর প্রাণে হাস্যরস ছিল; এই কাজ করবার সময় তিনি নিশ্চয় মনে মনে খুব হেসেছিলেন।
‘পয়লা বৈশাখ তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখতেন। এবার নববর্ষ সমাগত দেখে তিনি চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। আমাকে প্রতি বছর চিঠি লেখেন, এবারও লিখলেন; তারপর চিঠির পিঠি অংশ পেঁয়াজের রস দিয়ে উইল লিখলেন। এই সেই চিঠি আর উইল।‘
ব্যোমকেশ খাম খুলিয়া সাবধানে চিঠি বাহির করিল, চিঠির ভাঁজ খুলিয়া দুই হাতে তাহার দুই প্রান্ত ধরিয়া আংটার আগুনের উপর ধীরে ধীরে সঞ্চালিত করিতে লাগিল। আমরা শ্বাস রুদ্ধ করিয়া সেইদিকে তাকাইয়া রহিলাম।
এক মিনিট রুদ্ধশ্বাসে থাকিবার পর আমাদের সমবেত নাসিকা হইতে সশব্দ নিশ্বাস বাহির হইল। কাগজের পিঠে বাদামী রঙের অক্ষর ফুটিয়া উঠিতেছে।
পাঁচ মিনিট পরে কাগজখানি আগুনের উপর হইতে সরাইয়া ব্যোমকেশ একবার তাহার উপর চোখ বুলাইল, তারপর তাহা ডাক্তার সেনের দিকে বাড়াইয়া বলিল, ‘ডাক্তার সেন, রামেশ্বরবাবু আপনাকে যে উইলের কথা বলেছিলেন, এই সেই উইল। —পড়ুন, আমরা সবাই শুনব।’
ডাক্তার সেন একবার উইলটা মনে মনে পড়িলেন, তাঁহার মুখে স্মরণাত্মক হাসি ফুটিয়া উঠিল। তারপর তিনি গলা পরিষ্কার করিয়া মন্দ্বকণ্ঠে পড়িতে আরম্ভ করিলেন–
নমো ভগবতে বাসুদেবায়। আমি শ্রীরামেশ্বর রায়, সাকিম, ১৭ নং শ্যামধন মিত্রের লেন, বাগবাজার, কলিকাতা, অদ্য সুস্থ শরীরে এবং বাহাল তবিয়াতে আমার শেষ উইল লিখিতেছি। অবস্থা গতিকে উইলের সাক্ষী যোগাড় করা সম্ভব হইল না, তাই নিজ হস্তে আগাগোড়া উইল লিখিতেছি। আমার বুদ্ধিভ্রংশ বা মস্তিষ্ক বিকার হয় নাই, ডাক্তার অসীম সেন তাহার সাক্ষী। এখন আমার শেষ ইচ্ছা অর্থাৎ Last will and testament লিপিবদ্ধ করিতেছি।
কলিকাতায় আমার যে আটটি বাড়ি আছে এবং ব্যাঙ্কে যত টাকা আছে, তন্মধ্যে হ্যারিসন রোডের বাড়ি এবং নগদ পঁচাত্তর হাজার টাকা আমার কন্যা শ্ৰীমতী নলিনী পাইবে। আমার স্ত্রী শ্ৰীমতী কুমুদিনী যাবজ্জীবন আমার শ্যামপুকুরের বাড়ির উপস্বত্র ভোগ করবেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ওই বাড়ি আমার কন্যা নলিনীকে আসিবে। আমার বাকী যাবতীয় সম্পত্তি, ছয়টি বাড়ি এবং ব্যাঙ্কের টাপা পাইবে আমার পুত্র শ্ৰীকুশেশ্বর রায়। স্বনামধন্য সত্যান্বেষী শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী ও বিখ্যাত ডাক্তার অসীম সেনকে আমার উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিয়া যাইতেছি; তাঁহারা যথানির্দেশ ব্যবস্থা করিবেন এবং আমার এস্টেট হইতে প্রত্যেকে পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাইবেন।
তারিখ পয়লা বৈশাখ
১৩৬০
স্বাক্ষর বকলম খাস
শ্রীরামেশ্বর রায়
উইল পড়া শেষ হইলে কেহ কিছুক্ষণ কথা কহিল না, তারপর আমরা সকলে একসঙ্গে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিলাম। নলিনী গলদশ্রু নেত্ৰে ছুটিয়া আসিয়া ব্যোমকেশের পদধূলি লইল। গদগদ স্বরে বলিল, ‘আপনি আমাদের নতুন জীবন দিলেন।’
ব্যোমকেশ করুণ হাসিয়া বলিল, তা তো দিলাম। কিন্তু এ উইল কোর্টে মঞ্জুর করানো যাবে কি?’
ইন্সপেক্টর হালদার আসিয়া সবেগে ব্যোমকেশের করমর্দন করিলেন, বলিলেন, ‘আপনি ভাববেন না। ওরা উইল contest করতে সাহস করবে না। যদি করে আমি সাক্ষী দেব।’
ডাক্তার অসীম সেন বলিলেন, ‘আমিও।’