সরিৎ
বাবুন আজকাল স্কুলের সাপ্তাহিক পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট কহে। খাতায় কোনওখানে একটুও দাগ পড়ে না। তার স্কুলটি খুবই ভাল, কলকাতার একেবারে শ্রেষ্ঠ স্কুলগুলির একটি। সেখানে ছেলে ভর্তি করতে লোককে মাথা কুটতে হয়। সেখানকার বেশির ভাগ ছেলেই ব্রিলিয়ান্ট। তাদের মধ্যেও বাবুন আলাদা রকমের ব্রিলিয়ান্ট। স্কুলের কর্তৃপক্ষতার দিকে বিশেষ নজর রাখছে। স্কুলের শেষ পরীক্ষায় সে কোনও দারুণ ঘটনা ঘটাতে পারে।
সরিৎ খুব মন দিয়ে বাবুনের স্কুলের খাতাপত্র দেখল। দু-একটা প্রশ্ন করল। ছেলের সঙ্গে সে কখনও বাংলায় কথা বলে না। বাপ আর ছেলে কেবল ইরিজিতেই বাক্যালাপ করে। তাতে অভ্যাস ভাল থাকে। তা বলে বাবুন বাংলায় কাঁচা নয়। খাতা দেখে গভীর তৃপ্তির একটা শ্বাস ফেলে বাবুনের দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইল। তখন বাবুন আস্তে করে ইংরিজিতে বলল, আজ মা কাঁদছিল দয়ী আন্টির কাছে।
সরিৎ খুব নিচু গম্ভীর গলায় বলল, কেন?
ঠিক শুনতে পাইনি। বোধহয় বলছিল সবাইকে সে ভয় পায়।
সেটাই পাওয়া উচিত।
দয়ী আন্টি মায়ের পক্ষে।
আমি জানি।
আন্টি বলছিল আমাকে নাকি মারা উচিত।
সাহস থাকে তো মারুক না। বাড়ি থেকে দুজনকেই বের করে দেব।
সরিৎ রাগে ফুঁসে ওঠে। সমস্ত শরীর জ্বলে যায় তার। এত সাহস কোত্থেকে পায় এরা? এরা তো কোনও দিক দিয়েই তার বা বাবুনের সমকক্ষ নয়। মার্কামারা ওভার মেয়ে। একটা এক মস্তানের সঙ্গে ভেগেছিল, অন্যটা পুরুষ নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। দয়ীর ইতিহাস বেশ কিছুটা জানে সরিৎ। ওদের পাড়ার একটা ছেলে সরিতের ডিপার্টমেন্টে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। মাঝে মাঝে সে অনেক খবর দেয়। আগে ভয়ে মুখ খুলত না। কিন্তু তার ভয় ভেঙে দিয়ে মুখ খুলিয়েছে সরিৎই।
গা গরম হয়ে আছে এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মে, তার ওপর রাগ। সরিৎ বাথরুমে আজ অনেকক্ষণ শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে স্নান করল। স্নান করতে করতেই ক্ষীণ কলিং বেলের আওয়াজ পেল। বিনয় এল বুঝি!
দয়ীকে আজ এ বাড়িতে ডেকে পাঠানোর মূলে যে একটা ষড়যন্ত্র আছে তা সরিৎ আন্দাজ করেছে। পরশু মৃন্ময়ী যখন টেলিফোন করছিল দয়ীকে তখন বাকু সবটা শোনে এবং পরে বাবাকে বলে দেয়।
তখনই সরিৎ বলেছিল, চিনে রয়্যাল মাই ফুট। দে হ্যাভ আদার মোটিভস।
এমনকী বিনয়কে নেমন্তন্ন করার ইচ্ছেও সরিতের ছিল না। সে সামাজিক ভদ্রতা সৌজন্যর ধার ধারে না। বরং বাইরের কোনও লোক বাড়িতে এলে সে বিরক্তি আর অস্বস্তি বোধ করে। সে চায় সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নভাবে থাকতে। এই উটকো ঝামেলা জুটিয়েছে মৃন্ময়ী। একদিন বলল, কিয়কে আমাদেরও নেমন্তন্ন করা উচিত। প্রেস্টিজের ব্যাপার।
মৃন্ময়ী সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায়। তবে আকাশ বাতাসকে উদ্দেশ করে যা বলার বলে।
শুনে প্রথমে পাত্তা দেয়নি সরিৎ। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, মৃন্ময়ী কিছু অন্যায় বলেনি। বিনয় মৃন্ময়ীর জন্য দামি সিনথেটিক শাড়ি আর সেন্ট এনেছে আমেরিকা থেকে, বাবুনকে ভিউ মাস্টার আর সরিৎকে স্যুটের কাপড় দিয়েছে। বিনয় তার পিসতুতো ভাই হলেও তাদের পরিবারেরই মানুষ। পিসিমা ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা, বাবা তাকে নিজের পরিবারে এনে রাখেন। সুতরাং কৃতজ্ঞতাবশে বিনয় এটুকু দিতেও পারে। কিন্তু সরিৎ আর একটা কথাও ভেবেছে। তার ইচ্ছে স্কুলের পড়া শেষ করেই বাবুনকে বিদেশ পাঠিয়ে দেবে। বিনয়ের সঙ্গে একটা এ ধরনের কথাও হয়েছে। সুতরাং বিনয়কে একদিন নেমন্তন্ন খাওয়ালে মন্দ হয় না। বাবুন ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও কিছুর ওপর তার তেমন আকর্ষণ নেই। তার যা কিছু স্বার্থ তা বাবুনকে ঘিরে। বাবুনের জন্য সে সব কিছু করতে পারে।
আর একটুক্ষণ জলের ধারার নীচে দাঁড়ালে ভাল লাগত। কিন্তু দেরি করতে মন সরল না। ওদিকে এতক্ষণে বিনয়ের সঙ্গে দয়ীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই মৃন্ময়ী। কিছু বলা যায় না, এলেমদার মেয়ে দয়ী হয়তো প্রথম দর্শনটাই কাজে লাগিয়ে দেবে। ব্যাপারটায় বাধা দেওয়া খুব জরুরি। মৃন্ময়ীর বাড়ি থেকে কোনও মেয়েই আর তাদের বাড়ির বউ করে আনা ঠিক নয়।
পাজামা পাঞ্জাবি পরে সরিৎ বাইরের ঘরে এসে একটু অবাক হয়। বিনয় সোফায় বসে কেবল মৃন্ময়ীর সঙ্গে কথা বলছে। দয়ী কাছে-পিঠে নেই।
বিনয় তার বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তুমি তো এমনিতে স্মোক করো না। এটা একটা খেয়ে দেখবে নাকি? নরম টোব্যাকো।
খুব শখ হলে এক আধটা কখনও কখনও খায় সরিৎ। তবে ধোঁয়াটা কখনও গেলে না। তাছাড়া ছেলের সামনে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে তার ভারী সঙ্কোচ। তবু আজ একটা ধরাল। বলল, পাত্রী পছন্দ করেছিস?
কই পাত্রী? কত দেখলাম।
একজনও পাশমার্ক পেল না?
খুঁজে দাও না। আমার তো বেশি সময়ও নেই।
মৃন্ময়ী সরিতের সামনে খুবই অপ্রতিভভাবে বসে ছিল। হঠাৎ বলল, পাত্রী ঠিক পাবে। চিন্তা কোরো না।
হাতে আছে নাকি?- বিনয় জিজ্ঞেস করে। তারপর বলে, রোজ দু-দশটা করে চুল পেকে উঠছে। থাকলে আর বেশি দেরি কোরো না বউদি। এটাই ইন্ডিয়ান মেয়েদের শেষ চান্স। এখানে পছন্দমতো না পেলে ফিরে গিয়ে একজন আমেরিকানকেই বিয়ে করব।
না না! খুব সিরিয়াস গলায় প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে মৃন্ময়ী। তারপর সরল মনে বলে দেয়, আমার মেজো বোনকে দেখে যাও। খারাপ লাগবে না।
কই সে? জিজ্ঞেস করে বিনয়।
আছে। আজ ওর হাতের রান্নাই তো খাবে।
বিনয় অবাক হয় না। বোধহয় নিমন্ত্রণের ছলে এরকম আরও বেশ কয়েকবার তাকে পাত্রী দেখতে হয়েছে। দুটো পা সামনে টান করে মেলে দিয়ে পিছনে হেলে বসে বলে, যাক বাবা বাঁচা গেল। তোমার বোন তো, সে নিশ্চয়ই তোমার মতো ভাল স্বভাবের হবে। না দেখেই ফিফটি পারসেন্ট পছন্দ করছি। এবার ডাকো।
চা নিয়ে আসছে। এই দয়ী। বলে ডাক দিয়ে উঠে যায় মৃন্ময়ী।
বিশ-বাইশ বছর বয়সে অনেক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিয়ে প্রথম জার্মানিতে গিয়েছিল বিনয়। দীর্ঘকাল অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ শিখেছে সেখানে। তারপর সুযোগ বুঝে চলে গেছে আমেরিকায়। সাত ঘাটের জল খেয়ে এখন সে প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত। মেদহীন রুক্ষ চেহারা, চালচলনে খুব চটপটে, প্রচণ্ড সময়নিষ্ঠ, সরল ও সৎ। জীবনে কোনও কাজে ফাঁকি দেয়নি বিনয়। মস্ত কোনও ডিগ্রি নেই, কিন্তু হাতে-কলমে কাজ করার মহার্ঘ্যতম অভিজ্ঞতা আছে। সরিৎ নিজে ইঞ্জিনিয়ার, সে অভিজ্ঞতার মূল্য বোঝে। সাহেবরা আরও বোঝে। এই খাঁটি ছেলেটির গলার দয়ীকে ঝুলিয়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়।
গ্রীষ্মের দীর্ঘ বেলা এমনিতেই সহজে ফুরোতে চায় না, তার ওপর সাততলায় যেন আরও কিছুক্ষণ আলোর রেশ থেকে যায়। সাড়ে ছটা বেজে যাওয়ার পরও ঘরের আলো জ্বালাবার তেমন দরকার পড়ছে না। কিন্তু মৃন্ময়ী আলো জ্বালল। দপদপ করে লাফিয়ে জ্বলে ওঠে দু-দুটো স্টিক লাইট আর একটা একশো পাওয়ারের বালব।
অপ্রতিভ হাসিমুখে মৃন্ময়ী বলে, এই আমার বোন দয়াময়ী।
ট্রে হাতে দয়াময়ী এগিয়ে আসে লঘু পায়ে। খুব যে সেজেছে তা নয়। চালাক মেয়ে, সাজতে জানে। হালকার ওপর প্রসাধনের সামান্যতম প্রলেপ দিয়েছে মাত্র। পরনে তাদের সাদা খোলের শাড়ি। কিন্তু শাড়িটার নকশাওয়ালা পাড় এতই চওড়া যে জমি প্রায় ছাড়ই পায়নি। তাছাড়া আছে সুন্দর মস্ত মস্ত বুটির কাজ। ব্লাউজটা খুবই তুচ্ছ একটা ন্যাকড়া মাত্র। এত ছড়িয়ে কাটা যে পুরো কাধ, পিঠ এবং স্তনের ঢেউ পর্যন্ত অনেকখানি দেখা যায়। আদুড় রয়েছে পেটের অনেকটা অংশ। দেখে চোখ সরিয়ে নেয় সরিৎ। সিগারেটে মৃদু টান দেয় এবং আনাড়ির মতো ধোঁয়া ছাড়ে।
দয়াময়ীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিনয়। দুহাত জড়ো করে খুব গভীর আন্তরিকতায় ভরা নমস্কার জানিয়ে বলে, ভারী খুশি হলাম পরিচয় হয়ে।
দয়ী খুব চমৎকার একটা স্মার্ট হাসি হেসে বলে, ওটা তো গ্ল্যাড টু মিট ইউ-এর অনুবাদ। আমাকে দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমি একদম খারাপ। জামাইবাবুর কাছে হয়তো আমার অনেক নিন্দা শুনবেন।
কথাটা বলে একঝলক তাকায় দয়ী। সেই দৃষ্টিটা বুলেটের মতো লাগে সরিতের বুকে। এটা কি দয়ীর খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ? খুবই চালাক মেয়ে। মৃন্ময়ীর মতো বোকা আর সরল নয়। ও আঁচ করে নিয়েছে, জামাইবাবু এ বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করবে।
বিনয় মৃদু হাসছিল। বলল, বুধোদার মুখে বড় একটা নিন্দে শুনিনি কারও। তাছাড়া আপনি তো অনিন্দ্য।
সরিতের ভিতরে মৃদু দহন শুরু হয়। খুব ধীরে ধীরে জেগে ওঠে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ঘৃণা। খুব আনাড়ির মতো আর একবার ধোয়া ছেড়ে আস্তে করেই বলে, আমিও তাই বলি। ওর নিন্দে করবে কে? দয়ীর কত অ্যাডমায়ারার!
বিনয় হাসিমুখে দয়ীকে বলে, আপনার অ্যাডমায়ারারদের লিস্টে আজ থেকে আমাকেও ধরে রাখুন।
সরিৎ চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্ট্র্যাটিজিটা ভেবে নিল। তারপর আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, দয়ীর অ্যাডমায়ারারদের মধ্যে হাজার রকমের ভ্যারাইটিও আছে। প্রায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ছাত্র, অধ্যাপক, রাজনীতির মস্তান, পাড়ার গুন্ডা, বুড়ো কামুক, কে নয়? ও প্রায় কাউকেই হতাশ করে না।
বলে কথাটার প্রতিক্রিয়া দয়ীর মুখে খুঁজে দ্যাখে সরিৎ। দয়ী তার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তাতে ভয় নেই, অপ্রতিভ নেই, আছে ভীষণ রকমের একটা ঘেন্না। সরিৎ আপনমনে হাসল। খুশি হল সে। এরকমটাই সে চায়।
ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তির হাওয়া বইছে। বিনয় যতদূর সম্ভব নির্বিকার মুখে আস্তে করে বলে, বাবুনকে দেখছি না।
ডাইনিং টেবিলের পাশে কাঠের পর্দাটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়ী। প্রবল হতাশায় নীচের ঠোঁট ওপরের দাঁতে কামড়ে ধরছে মাঝে মাঝে। সে আজকাল রাগ করতে ভয় পায়। তার আছে কেবল হতাশা।
দয়ী সবশেষে নিজের কাপে চা ছেকে নিচ্ছিল মাথা নিচু করে। বিনয়ের কথার জবাবে বলল, বাবুন বোধ হয় ছাদে। দাঁড়ান, ডেকে আনছি।
তার দরকার কী? খেলছে খেলুক। চলুন বরং আমরাই একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। গরমে বসতে ইচ্ছে করছে না এখানে।-বলে নিয় একটু নড়ে বসে।
এই কথায় সরিৎ নিজের ভিতরে একটা পরাজয় টের পায়। ওরা ছাদে যাবে? তার মানে তো অনেকখানি। সে একবার দয়ীর দিকে তাকায়। দয়ীও ঠোঁটে ধরে থাকা পেয়ালার কানার ওপর দিয়ে একঝলক তাকায় সরিতের দিকে। সেই চোখে জয়ের ঝিকিমিকি।
যেন কিছুই ঘটেনি এমন শান্তস্বরে সরিৎ বলল, দয়ী, তোমার সেই অ্যাডমায়ারারটির কী যেন নাম! মলয় না? ওঃ বিনয়, সে ছেলেটা দয়ীর জন্য যা পাগল না! যে কাউকে খুন করতে পারে ছোকরা। ছেলেটা কিলার টাইপেরই। নকশাল ছিল। ছোকরার দোযও নেই। দয়ীর সঙ্গে নাকি ডাকবাংলো-টাংলোয় রাত-টাতও কাটিয়েছে। কাজেই এখন তার অধিকারবোধ জন্মেছে।
সিনেমা থিয়েটারে যেমন ফ্রিজ শট বা দৃশ্যের চলন হয়েছে আজকাল, সরিৎ লক্ষ করল, ঘরের তিনটে প্রাণী তেমনি নিথর শিলীভূত হয়ে গেল।
সেই অনড় দৃশ্যের মধ্যে প্রথম নড়ল বিনয়। আস্তে করে বলল, বুধোদা ইউ শুড নট…।
কথাটা শেষ করল না বিনয়। সরিৎ আর একটা সিগারেট ধরায়। তারপর বলে, আমি জাস্ট সিচুয়েশনটা জানিয়ে রাখছি। আমি কিছু ভুল বলিনি তো দয়ী? বলে সরিৎ দয়ীর দিকে তাকায়।
দয়ীর হাত সামান্য কাঁপছে। চলকাচ্ছে কাপের চা। বুদ্ধিমতী দয়ী কাপটা রেখে দিল টি-পয়ে।
তারপরই হঠাৎ হাসিমুখ তুলে নিয়কে বলল, ছাদে যাওয়ার কথা ছিল যে! যাবেন না?
বিনয় ধেয়ে-পেয়ে উঠে পড়ে। বলে, নিশ্চয়ই।
দয়ী চিমটি কাটা হাসি হেসে বলে, এ ঘরটা বড্ডই গরম।
দুজনে প্রায় ঘরবন্দি পাখির মতো হঠাৎ একটু ফোকর পেয়ে প্রাণপণ পাখা ঝাঁপটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সরিৎ জানে, আজ রাতে দয়ী কাঁদবে। মেয়েরা অপমানিত হলে কাঁদে, দোষ ধরা পড়লে কাঁদে। ও কাঁদবে।
সরিৎ তৃপ্ত মনে চায়ের তলানি শেষ করে পট থেকে আরও এক কাপ ঢেলে নেয়। চা-টা এবার ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, কিন্তু লিকার আরও গাঢ়, চনমনে।
ঘরে যে আর কেউ আছে তা গ্রাহ্যই করেনি সে। কিন্তু না থেকেও মৃন্ময়ী আজ ছিল। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল, দয়ীর অত খবর তুমি জানলে কী করে?
সরিৎ তার স্ত্রীর দিকে পারতপক্ষে তাকায় না। তার সামনেই বিশাল দেওয়ালজোড়া দরজাটা খোলা। বাইরে আকাশে তখনও খানিকটা পাশুটে আলো। সে তাই দেখছিল। চোখ না ফিরিয়েই বলল, প্রমাণ আছে।
মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বলে, কীসের প্রমাণ? দয়ী আমার মতো নয়।
তোমরা সবাই সমান। এখন বেশি কথা বোলো না, আমার ভাল লাগছে না।
মৃন্ময়ী হয়তো ভয় পেল, তবু আজ ছাড়ল না। দয়ীর পরিত্যক্ত সোফায় বসে বলে, বিয়েটা তো ভেঙেই দিলে, তাহলে আর বলতে দোষ কী?
সরিৎ বহুকাল বাদে মৃন্ময়ীর দিকে একবার তাকায়। পরমুহূর্তেই ফিরিয়ে নেয় চোখ। আজকাল তার কী যে হয়েছে, কারো চোখেই দুদণ্ড চোখ রাখতে পারে না। আপনা থেকেই চোখ ফিরে আসে। সরিৎ অন্যদিকে তাকিয়ে টবের মানিপ্ল্যান্ট দেখতে দেখতে বলে, মলয়ের লেখা একটা চিঠি আমার হাতে এসেছে।
মৃন্ময়ী বলল, কী করে এল?
তাতে তোমার দরকার কী? এসেছে যেভাবেই হোক।
মৃন্ময়ী একটুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, মলয়কে আমি চিনি। দয়ীর বন্ধু। আজকাল বন্ধুদের মধ্যে ওসব হয় না।
সবই হয়।
চিঠিটা আমাকে দেখাবে?
সরিতের এবার বুঝি একটু লজ্জা করে। বলে, দেখার কিছু নেই। যা বলেছি তা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে পারো।
মৃন্ময়ী খুব নিবিড় চোখে লক্ষ করছে সরিৎকে। বলে, অবিশ্বাস করিনি। শুধু দেখতে চাইছি। একটা কারণ আছে।
কী কারণ?
কদিন আগে বাবুনকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বাবুন সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল। তখন পকেট থেকে ভাজকরা একটা কাগজ বের করে পড়ছিল দেখেছি। আমি কিছু বুঝতে পারিনি তখন। মলয়ের চিঠি কি বাবুনই তোমাকে এনে দিয়েছে?
সরিৎ আর একবার স্ত্রীর দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু এবার তাকাতেই পারল না। তবে গলায় প্রচণ্ড ঝর তুলে বলল, দিলে কী করবে? মারবে?
তা কেন? বাকুনকে মারব সে সাধ্যি কি আমার আছে?
সাধ্যি না থাকাই মঙ্গল। দয়ীকেও সেটা বুঝিয়ে দিয়ে। ও নাকি আজ বাবুনকে মারার কথা তোমাকে বলছিল। ওকে বলে দিও ওর বাপ যত বড় ভাই হোক আমার বাবুনের গায়ে যদি কেউ হাত তোলে তার হাতখানা আমি কেটে দেব।
মৃন্ময়ী খুবই বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এ কথার কোনও জবাব দিল না। সরিতের হঠাৎ চাগিয়ে-ওঠা রাগটা পড়ে যাওয়ার জন্য সময় দিল। তারপর বলল, বাবুনকে কেউ মারবে না। এখন বলো তো, চিঠিটা কি বাকুন তোমাকে চুরি করে এনে দিয়েছিল?
চুরি করতে যাবে কেন? সাম হাউ অর আদার চিঠিটা ওর হাতে এসে গিয়েছিল, ও পকেটে করে নিয়ে এসে আমাকে দেয়।
অন্যের চিঠি জেনেও সেটা আনা কি বাবুনের উচিত হয়েছে?
সে বিচার আমি করব। বাবুন কিছু অন্যায় করেনি। চিঠিটা সে আমার হাতেই এনে দিয়েছে।
তা হোক, তবু সেটা অন্যায়। তুমিই বা দয়ীর চিঠি পড়তে গেলে কেন? কেন বাবুনকে শাসন করলে না?
সরিৎ প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলে, দয়ী যা করে বেড়াচ্ছে সেটা বেশি অন্যায়, না চিঠি পড়াটা বেশি অন্যায়? এই বাজে ক্যারেকটারের মেয়েটাকে আমার ভাইয়ের গলায় ঝোলাতে চাইছ, সেটাও কি অন্যায় নয়?
সরিতের চিৎকারে মৃন্ময়ী মিইয়ে গেল। সরিৎ লাল হয়ে যাচ্ছে রাগে, ঠোঁটে ফেনা জমছে, কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল মৃন্ময়ী। তারপর আস্তে করেই বলল, দয়ীর কথা নাই বা ভাবলে। ও খারাপ ভাল যাই হোক, তোমার বা বাবুনের দিকটা তো ভাববে! ও কেন চিঠিটা পড়ল? কত বাজে কথা থাকে প্রেম ভালবাসার চিঠিতে। ও সেগুলো পড়েছে ভাবতেই যে গা ঘিনঘিন করে।
অন্য হাতে টর্চ। একেবারে কাছাকাছি এসে ছোকরা আমাকে দেখে হয়তো থমকে গিয়েছিল। দুপ করে টর্চের আলো মুখে ফেলে মুখটা চিনে নিয়েই একদম পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করলাম। ফাঁকা মাঠে গুলির শব্দটা প্রায় শোনাই গেল না। ছোকরা কোস করে একটা শব্দ করে কুঁকড়ে পড়ে গেল। আর দেখার কিছু ছিল না। মুখ ফেরাতেই দেখি আমার পিঠ ঘেষে দয়ী দাঁড়িয়ে আছে। স্থির-চোখে কিছুক্ষণ ছোকরার মৃত্যুযন্ত্রণার ছটফটানি দেখল, তারপর আমার দিকে মুখ ফেরাল। শান্ত মুখ, চোখে সম্মোহিত মুগ্ধ দৃষ্টি। আমার ভয় ছিল, দয়ী হয়তো চেঁচামেচি করবে, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাবে। আশ্চর্য, তার কিছুই হল না। আমি স্পট থেকে কখনও দৌড়ে পালাই না। তাতে বেশি বিপদ ঘটে। খুব স্বাভাবিক চালে একটু ঘুরপথ হয়ে আমরা বড় রাস্তায় উঠলাম এবং যেন বেড়িয়ে ফিরছি ঠিক এমনভাবে বাজারের ভিতর দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরে এলাম। পথে একটা চায়ের দোকানে বসে চাও খেলাম। কপাল ভাল বলতে হবে। খুনটা নিয়ে হইচই হলেও আমাকে কেউ সন্দেহ করেনি। করার কারণও ছিল না। গিধনিতেও তখন দুদঙ্গলে ঝগড়াঝাটি মারপিট চলছিল কী নিয়ে। সন্দেহ গিয়ে পড়ল বোধহয় সেই ছোকরার উলটো দলের ওপর। সে যাকগে। সেই রাতে দয়ী আমাকে শরীর দিয়েছিল। কিন্তু আমার সেদিন একরত্তি ইচ্ছেও ছিল না। মনটা ভার ছিল। এই প্রথম আমি নন-পলিটিক্যাল কারণে, কেবলমাত্র একটা মেয়েকে খুশি করতে একজনকে মারলাম। কিন্তু দয়ীর হল উলটোরকম। সেই রাতের মতো খুশি, আনন্দিত এবং উত্তেজিত দয়ীকে আমি আর কখনও দেখিনি। মনে মনে সেইদিনই ঠিক করি, দয়ীর পুরো সাইকোলজিটা আমাকে জানতে হবে। সারাজীবন ধরে বিশ্লেষণ করে, গবেষণা করে আমি দেখব দয়ীর জেনারেশনের মেয়েরা কতখানি নষ্ট হয়ে গেছে। রুকু, দয়ীকে আমার ছাড়া চলে না। আমার কাছে ওর অনেক ঋণ। আমি ওকে ভালবাসি বা না বাসি দয়ীকে আমি অনেক দাম দিয়ে কিনে নিয়েছি। ব্যাপারটা হয়তো তুই ঠিক বুঝতে পারবি না। ইউ আর এ ব্র্যান্ডেড রোমান্টিক মাস্টারবেটার।
এবার রুকু আর ততটা অপমান বোধ করল না। কানটা লাল হল, মাথা নুয়ে এল ঠিকই, তবু মনে হল, মলয় তাকে এরকম অপমান করার অধিকার রাখে।
.
রুকু
রাতে রুকুর ভাল ঘুম হল না। শেষ রাতে সে একেবারেই জেগে গেল। এই এজমালি বাড়িতে ছাদে ওঠা বারণ, বারান্দা নেই। ফলে বাইরেটা দেখতে হলে সদর খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়।
ঘামে ভেজা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রুকু। মাথাটা বড্ড গরম। পাগলের মাথায় যেমন হাজারও ভেঁড়া টুকরো স্মৃতি ও কথা ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে বেড়ায় তার মাথাটাও আজ অমনি। আধো-ঘুমে বারবার একটা সুরে বাঁধা গানের লাইন ঘুরে বেড়াচ্ছিল মাথায় ধুলায় হয়েছে ধূলি। ধুলায় হয়েছে ধূলি। কোন গানের লাইন তাও ঠিক মনে নেই। এখন জেগেও সে টের পাচ্ছে, প্রচণ্ড একটা বিষণ্ণতায় ভারাক্রান্ত তার মাথা ভাঙা রেকর্ডে নি আটকে যাওয়ার মতো গানের সেই কলিটা জপ করছে, ধুলায় হয়েছে ধূলি।
মলয়ের মতো কুকুর কোনও যৌনজীবন নেই। সে কখনও মেয়ে-মানুষের স্বাদ পায়নি। বরাবরই সে ভিতু, লাজুক। কলকাতায় এসে তার মেয়ে বন্ধু জুটেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কারও খুবই ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। কিন্তু কী এক আশ্চর্যজনক কারণে তার ব্যক্তিগত যৌনক্ষুধাকে। আজও অধিকার করে আছে সেই কবেকার সামান্য একটি মৃত মেয়ে তাপসী। এই অস্বাভাবিকতার কোনও ব্যাখ্যাও সে খুঁজে পায় না। কিন্তু বুঝতে পারে, এটা এক ঘোর বিকৃতি। বুদ্ধিমান মলয় সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল।
নিজেকে নিয়ে আজ ভারী মুশকিল হল রুকুর। এই ভোরের পরিষ্কার সুন্দর পরিবেশে সদর খুলে সে রাস্তায় পায়চারি করতে করতে কেবলই চাইছে রুকুর সঙ্গে সহাবস্থান ছিন্ন করতে। নিজেকে সে সহ্য করতে পারছে না মোটেই। বড় ছোট লাগছে, তুচ্ছ লাগছে, হাস্যকর মনে হচ্ছে।
সকাল হলে রুকু যখন দাড়ি কামাতে বসল তখন ছোট আয়নায় আজ বড় শীর্ণ ও লাবণ্যহীন দেখল নিজেকে। চোখ কোটরাগত, গাল বসা, দৃষ্টিতে দীপ্তি নেই।
কিছুই ভাল লাগল না আজ।
অফিসে এসে সে ফোন করল দয়ীকে।
দয়ী, আমি রুকু।
বলো।
মলয়ের সঙ্গে দেখা করেছি।
দয়ী খুব সিরিয়াস গলায় বলল, মলয় কিছু বলল?
সে অনেক কথা। এ কাজটার ভার আমাকে দিয়ে তুমি ভাল করোনি। মলয় কাল আমাকে খুব অপমান করেছে।
তোমাকে? তোমাকে অপমান করবে কেন? তুমি তো কিছু করোনি!
রুকু আচমকা জিজ্ঞেস করে, তুমি কোনওদিন মলয়ের সঙ্গে গিধনি গিয়েছিলে দয়ী?
প্রশ্নের আকস্মিকতায় দয়ী বোধহয় একটু থতমত খায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে, শুধু গিধনি কেন, আরও অনেক জায়গায় গেছি।
রুকু সামান্য ধৈর্য হারায়। বিরক্তির স্বরে বলে, কথাটা এড়িয়ে যেয়ো না দয়ী। তুমি যে মলয়ের সঙ্গে অনেক জায়গায় গেছ সে আমি জানি, তুমিও বহুবার বলেছ। তবু আমি পার্টিকুলারলি গিধনির কথাটা জানতে চাই।
দয়ী সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কোনও কারণে রেগে আছ কুকু? তোমাকে আমি কখনও রাগতে দেখিনি, মাইরি বলছি।
রুকু একটু লজ্জা পায়। গলা নামিয়ে বলে, রেগেছি কে বলল?
গলা শুনে মনে হচ্ছিল। মলয় কি তোমাকে খুব অপমান করেছে? দেখা হলে ওকে বলব তো।
কিছু বোলো না দয়ী, প্লিজ।– কাতর স্বরে বলে রুকু।
দয়ী একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি গিধনির কথা কী জানতে চাইছিলে?
রুকু সতর্কভাবে তার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নেয়। ফোনের কাছাকাছি কেউ নেই। কেউ শুনছে না। একটু চাপা গলায় সে বলে, গিধনিতে তোমাকে খুশি করার জন্য মলয় একটা মার্ডার করেছিল দয়ী, মনে পড়ে?
মার্ডার! দয়ী আকাশ থেকে পড়া গলায় বলে ওঠে, মার্ডার? কী বলছ তুমি?
রুকু একটু ঘাবড়ে যায়। তারপর মিনমিন করে বলে, সেখানে শালবনে নাকি তোমাদের সঙ্গে একদল ছেলের গণ্ডগোল হয়েছিল?
দয়ী অবাক গলায় বলে, তা তো হয়েছিলই। ছেলেগুলো আমাকে আওয়াজ দেওয়ায় ঝগড়া লাগে। আমি একটা ছেলেকে চটিপেটা করেছিলাম। ওরা আমাদের ঘিরে ধরেছিল।
তারপর কী হয়েছিল দয়ী?
কী আবার হবে। সেই রাত্রে অপমানে আমি খুব কেঁদেছিলাম।
মলয়কে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেনি?
বলেছি। তাতে কী?
পরদিন সন্ধ্যাবেলায় মলয় কি ছেলেদের সর্দারকে গুলি করে মারেনি?
স্নান করে খেয়ে অফিসে বেরোনোর সময়ে সে আকাশের পশ্চিম ধারে পিঙ্গল ঝোড়ো মেঘ দেখতে পেল। বাতাস কিছু জোরালো, খুব ধুলো উড়ছে। কয়েকদিনই পর পর বৃষ্টি হয়ে গেছে কলকাতায়। যেখানে বৃষ্টির দরকার সেখানে অর্থাৎ গ্রামে-গঞ্জে তেমন হচ্ছে না।
ভ্রু কুঁচকে কথাটা ভাবতে ভাবতে সে তাদের বড় গ্যারাজে ঢুকে মোটর-সাইকেলটা হিঁচড়ে বের করল। প্রচণ্ড ভারী আর বিপুল চেহারার এই জগদ্দলটা যে প্রাণ পেলে কী ভীষণ গতিতে ছুটতে পারে তার ধারণাই অনেকের নেই; মোটরসাইকেলে স্টার্টারে পা রেখেই সে প্রশান্ত আত্মতৃপ্তি বোধ করে।
ঝোড়ো হাওয়া আসছে, বৃষ্টির গন্ধে মাখামাখি বাতাস। পারবে কি সে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টেরিটিবাজারের অফিসঘরে পৌঁছোতে?
ক্র্যাশ হেলমেটটা মাথায় এঁটে নিয়ে স্টার্টারে লাথি মারে মলয়। খিদিরপুরের ঘিঞ্জি পেরিয়ে রেসকোর্সের গা ঘেঁষে অর্ধবৃত্তাকার চওড়া ফাঁকা রাস্তার ওপর হোভা পৃথিবীর সব গতিকে যেন ছাড়িয়ে গেল। আইনস্টাইন বলেছেন, আলোর গতি প্রাপ্ত হলে যে-কোনও বস্তুই পর্যবসিত হয়। মলয় তেমনি এই বিদ্যুতের গতিতে যেতে যেতে তড়িতায়ত হয়ে গেল। সে আর তার মোটরসাইকেল দুয়ে মিলে যেন একটিই প্রাণ এক সত্তা। অবশ্য কলকাতার রাস্তায় গতির সুখ বড়ই ক্ষণিক। ডালহৌসি ঘুরে লালবাজার স্ট্রিট দিয়ে এসে সে ধরল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। নাজ সিনেমার কাছাকাছি বাঁ হাতের গলিতে খানিক গিয়ে এক মস্ত পুরনো বাড়ি। ভিতরে এক বাঁধানো চত্বর ঘিরে বড় বড় টিনের গুদামঘর। সামনের দিকে পাঁচতলা বাড়ির তেতলায় তার অফিসঘর চত্বরে মোটর-সাইকেল রেখে ওপরে ওঠে মলয়।
সে না থাকলে অফিস সামলাবার দায়িত্ব পুণ্যর।
তাকে দেখে পুণ্যর সদাবিষণ্ণ মুখে ভাব একটুও বদলাল না। রোগা কালো ছোটখাটো নিরীহ পুণ্য লোহার চেয়ারে পা তুলে বসেছিল। মলয়কে দেখে শুধু পা দুটো নামিয়ে বসল।
মলয় জিজ্ঞেস করে, সব খবর ভাল তো?
হু।
কে কে এসেছিল লিস্ট করে রেখেছ?
হু।
দেখি।
পুণ্য একটা বাঁধানো একসারসাইজ বুক এগিয়ে দেয়। মলয় দেখতে থাকে। শেষ পৃষ্ঠায় নামের বদলে ছোট একটু লেখা: তোর সঙ্গে দরকার ছিল। আজ বিকেলে অফিসে থাকিস। রুকু।
মলয় তার হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে সস্তায় কেনা রিভলভিং চেয়ারে বসল। বলল, জল।
বশংবদ পুণ্য নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বারান্দায় রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে আনে কাঁচের গ্লাসে। জল খেয়ে মলয় বারোয়ারি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বসে এবং পুণ্যর দিকে কয়েকপলক তাকায়। কী করে পূণ্য এক হাতে গ্লাস ধরে সেই হাতেই জল গড়িয়ে আনে তা কখনও দেখেনি মলয়। তবে দরকার হলে মানুষ সবই পারে। কিছুকাল আগেও সে দেখেছিল কনুই থেকে দু হাত কাটা একটা লোক দূরপাল্লার ট্রেনে সোড়া লেমনেড় ফেরি করছে। মস্ত ভারী লেমনেড বোঝাই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে চলন্ত গাড়ির এ কামরা থেকে ও কামরায় অনায়াসে যাতায়াত করত, ওই দুটো ঠুটো হাতেই বোতলের ঢাকনা খুলে স্ট্র ভরে লেমনেডের বোতল ধরত খদ্দেরের মুখের সামনে, পয়সা গুনে নিয়ে গেজেতে ভরে রাখত। পুণ্যর তো তবু একটামাত্র হাত নেই।
যে-সব গাঁয়ের ছেলে ভাল করে না বুঝেই পলিটিকসে নেমেছিল, পুণ্য তাদের একজন। খপুরকঁথি রাস্তায় নারায়ণগড়ে তার বাড়ি। বেশ ভাল ছবি আঁকত, তবলা বাজানোর হাত ছিল, কমার্স স্ট্রিমে সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কাঁথি কলেজে ভর্তিও হয়েছিল সে। একদিন ভাবের বশে দশক মুক্তির আন্দোলনে নেমে পড়ল। প্রতিপক্ষের বোমায় ডান হাতটা উড়ে যাওয়ার পর থামল এবং টের পেল, ডান হাতের সঙ্গে সঙ্গেই উড়ে গেছে তার ছবি আঁকা, তবলা বাজানো, লেখাপড়া এবং রাজনীতি। ক্ষত শুকিয়ে ওঠার পরও বেশ কয়েক মাস পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল পুণ্য। বেশ কয়েক বছর আগে আহত পুণ্যকে কাথি হাসপাতালে দেখে এসেছিল মলয়। পরে যখন সার আর কীটনাশকের ব্যবসাদার হয়ে সে আবার নারায়ণগড়ে যায় তখন দেখে, আধপাগলা পুণ্য বসে থাকে সারাদিন রাস্তার ধারের এক চায়ের দোকানের বেঞ্চে। কথা বলে না, বিড়বিড় করে আর তোক দেখলেই মাথা নিচু করে মুখ লুকোয়।
মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখলেই মলয় গলে পড়ে না বা বিমর্ষ হয় না। তার মন অত নরম তো নয়ই, বরং সে পৃথিবীর লোকসংখ্যা বোমা মেরে কমিয়ে ফেলারই পক্ষপাতী। পুণ্যর অবস্থা দেখে তার মোটেই দুঃখটুঃখ হয়নি। তবে তার কেমন মনে হয়েছিল আধ-পাগলা লোকেরা বড় একটা অসৎ হয় না। তাই পুণ্যকে তুলে আনল মলয়। একশো টাকা মাইনে দিত। এমনিতে পুণ্য তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। হিসেবে ভুল করে, অনেক কথা ভুলে যায়, অন্যমনস্ক থাকে। তবে পুণ্যর ধ্যানজ্ঞান এই অফিসটাই। একদিন সে মলয়কে বলল, আপনাদের বেয়ারাটাকে ছাড়িয়ে দিন না, জল চা আমিই দিতে পারব। মাইনে কিছু বেশি দিতে হবে। মলয়ের তাতে আপত্তি হয়নি। আগে বাইরে থেকে চা আসত। পণ্য এখন সে পাট তুলে দিয়ে একটা জনতা স্টোভ আর চায়ের সরঞ্জাম কিনে নিয়েছে। বাইরের দিককার বারান্দার কোণে একটু টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গা করে এক হাতে দিব্যি চা বানায়। তার জন্য আলাদা পয়সা নেয়। মলয়ের কোনও আপত্তি নেই। এই অফিসেই চব্বিশ ঘণ্টা থাকে পণ্য। লোহার আলমারির পিছনে চটে জড়ানো তার একটা বিছানা আছে। রাতে হাফ সেক্রেটারিয়েটের ওপর বিছানাটা পেতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। দুশো টাকার মতো আয় করে। তা থেকে অর্ধেক বাড়িতে পাঠায়। অপদার্থ পুণ্যর এটাই ঢের সাফল্য।
নামের লিস্ট ধরে ধরে মলয় কয়েকটা টেলিফোন করে। বেশির ভাগই কাজ-কারবারের কথা। সবশেষে ফোনটা করল কুকে। বার চারেক ডায়াল করার পর পেল।
রুকু, তুই এসেছিলি?
যা, একটু দরকার ছিল।
কী দরকার?
গিয়ে বলব।
বিকেলে আমি হয়তো অফিসে থাকব না। দিন সাতেক ছিলাম না, অনেকগুলো অর্ডার পিছিয়ে আছে।
কিন্তু টেলিফোনে তো বলা যাবে না।
কথাটা কী নিয়ে তা তো বলবি?
দয়ী।
দৈ? কীসের দৈ?
দয়ী দয়ী। দয়াময়ী।
ও। দয়ীর আবার কী হল?
সেটাই তো বলতে আসব।
ধ্যাৎ! সিরিয়াস কিছু থাকলে বল। মেয়েছেলে নিয়ে কথা বলার কী আছে! ইজ এনিথিং রং?
একটু দ্বিধা করে কু বলে, তেমন কিছু নয়। আমি আসছি আজ। তুই থাকিস।
বলছি তো, থাকার অসুবিধে আছে।
রুকু একটু হাসল। বলল, অসুবিধে হলেও বোধহয় তোকে থাকতেই হবে। বাইরের দিকে চেয়ে দ্যাখ কী ভীষণ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।
বাস্তবিকই মলয় চোখ তুলে দেখল বাইরে পাঁশুটে আলো। ধুলোর ঝড়ের সঙ্গে এইমাত্র বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি এল। মলয় বলল, ইডিয়েট। বৃষ্টি হলে আমি না হয় বেরোতে পারব না, কিন্তু তুই-ই বা বেরোবি কী করে? আমার অফিসে তোকে তো আসতে হবে।
রুকু একটু চুপ করে থেকে বলে, সেটাও কথা। তবু তুই থাকিস। দয়ী আমাকে ওর পক্ষের উকিল হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। মক্কেলকে ফেরাতে পারিনি।
কিন্তু মামলাটা কীসের?
গিয়ে বলব। জানিস তো অফিসের টেলিফোন খুব সেফ নয়।
জ্বালালি। আচ্ছা আয়।
বলে ফোন রাখল মলয়। বস্তুত বন্ধুদের মধ্যে রুকু তার সবচেয়ে প্রিয়। তার প্রিয় হওয়ার মতো কোনও কারণ রুকুর নেই। কোনও বিষয়েই তাদের মেলে না। রুকু শান্ত, চিন্তাশীল, রাজনীতি থেকে শত হাত দূরের লোক, হীনমন্যতায় ভোগে। তবু প্রিয়। বোধহয় অসহায় বলেই প্রিয়।
ঝড়বৃষ্টির দামাল ঝাপটা থেকে ঘর বাঁচাতে পুণ্য গিয়ে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করল। ঘরের পাখাটা মলয় না বলতেই চালিয়ে দিল। কিন্তু পাখা ঘুরল না। কারেন্ট নেই। কিন্তু সেটা লক্ষ করল না মলয়।
মলয় ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের তেলোর দিকে চেয়ে থাকে। আজ আর কাজ কিছু হবে না। বৃষ্টিতে কোনও পার্টিই আসবে না। একঘেয়ে অফিসঘরে বন্দি থাকার মতো শাস্তি তার কাছে আর কিছু নেই।
না বলতেই খুব বিনীত ভঙ্গিতে চা করে নিয়ে এল পুণ্য। মলয় ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। পুণ্যর সঙ্গে আড্ডা মারার চেষ্টা বৃথা। কথা বললে অর্ধেকের জবাব দেয় না, বাকি অর্ধেকের জবাব দেয় হুঁ হ্যাঁ না করে। বেশ বোকাও আছে পুণ্য, তার ওপর পাগল। মলয় কথা বলার চেষ্টা করে না ওর সঙ্গে, শুধু কী করতে হবে তা বলে দেয়। পুণ্য সব সময়েই আদেশটা পালন করে। ও শুধু হুকুম তামিল করতে জানে।
মলয় চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, আলোটা জ্বালিয়ে দাও।
জ্বালানোই আছে। কারেন্ট নেই। পুণ্য মাথা নিচু করে বলে।
এই ঝড়বৃষ্টির দুপুরে আর কেউ না আসুক, যে মারোয়াড়ি ছোকরা তার ব্যবসায় টাকা খাটাতে চাইছে সেই সইকুমার এসে হাজির। বর্ষাতিটা দরজার কোনায় টাঙিয়ে ঘরে এল। হাই বলে মারকিন কায়দায় উইশ করে চেয়ার টেনে বসল। খুবই দামি ঝকঝকে হাওয়াই শার্ট আর ট্রাউজারস পরনে। বৃষ্টিতে একটু ভিজেছে। সইকুমার বাংলা হিন্দি দুটো ভাষাই জানে, কিন্তু কথা বলে ইংরিজিতে। কলকাতার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা যেমন বদহজমের মতো গোল্লা গোল্লা ইংরিজিতে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে কথা বলে তেমনি তার ইংরিজি। বলা বাহুল্য, সইকুমারও মধ্য কলকাতার এক নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছিল। তবে পরবর্তীকালে সে কয়েকবার বিদেশেও ঘুরে এসেছে। সে প্যারিস আর টোকিয়োর মেয়েমানুষদের কথা বলতে ভালবাসে।
সইকুমার বসেই বলল, আই ওয়েন্ট টু ব্যান্ডেল লাস্ট উইক। গট এ গুড সাইট ফর ইয়োর ল্যাবরেটরি। এ লিটল ওভার ফিফটিন থাউস্যান্ড অ্যান্ড এক্সপেনসেস।
মলয় কথা বলল না। তাকিয়ে রইল।
সইকুমার টেবিলে মুই রেখে ঝুঁকে বসে মলয়ের দিকে খুব বন্ধুর মতো তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসে। তারপর বলে, ইউ আর গেটিং কোয়াইট বিগ অর্ডার্স। হোয়াই ডোন্ট ইউ টেক সাম এফিসিয়েন্ট অ্যাসিস্ট্যান্টস? দ্যাট হাফ উইট অব ইয়োরস, দ্যাট বাস্টার্ড পুণ্য ইজ গুড ফর নাথিং। আই কেম লাস্ট ইভনিং টু আস্ক অ্যাবাউট ইউ অ্যান্ড দ্যাট ইডিয়ট অফ এ ম্যান জাস্ট কেপট মাম।
ইংলিশ মিডিয়ামের কৃপায় গোল্লা ইংরিজিতে মলয়ও একসময়েও কথা বলতে ভালবাসত। তারপর গাঁ গঞ্জে ঘুরে ঘুরে চাষিবাসীর সঙ্গে কথা বলে বলে সে রোগটা গেছে। সে পরিষ্কার বাংলায় বলল, দ্যাখো সইকুমার, পুণ্য কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারি পাশ, ইংরিজি বোঝে। একদিন তোমার না থেঁতো করে দেবে।
সরি সরি। নো হার্ড ফিলিং!–বলে সইকুমার সোজা হয়ে বসে। ফরসা টকটকে তার রং, ছিপছিপে চেহারার সুদর্শন তরুণ। খুবই স্মার্ট। হেসে বলল, নাউ টু বিজনেস। ব্যান্ডেলের সাইটটা কবে দেখতে যাবেন?
মলয় উদাস হয়ে বলে, তাড়া কী?
তাড়া আছে। ব্যান্ডেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেলটের মধ্যে। ওখানে জমি বেশিদিন পড়ে থাকবে না। ইনফ্যাক্ট জায়গাটা আমার এত পছন্দ হয়েছে যে, আমি ফাইভ থাউস্ট্যান্ড অ্যাডভান্সও করে এসেছি।
এই সব বদান্যতার পিছনে কী কূটকৌশল আছে তা নিজে ব্যাবসাদারের ছেলে হয়েও ঠিক বুঝতে পারছে না মলয়। দিনকাল যত এগোচ্ছে ততই মানুষ নানারকম নতুন প্যাঁচ বের করছে মাথা থেকে। সইকুমার নিজে টাকা ঢেলে তাকে প্রোডাকশনে নামাতে চায়, সেটা নিশ্চয়ই তাকে শিল্পপতি বানানোর জন্য নয়। পুরো ফিনান্সটা থাকবে ওর হাতে, মলয় হবে শিখন্ডী- এরকমটাই ভেবেছে কি সইকুমার! নাকি মলয় নিজে থেকে প্রোডাকশনে নেমে একটা কিছু করে বসে সেই ভয়ে সইকুমার সেফটি ভালভ হিসেবে নিজে ওর ভিতরে ঢুকে বসতে চাইছে?
ভাবতে ভাবতে মলয় বলল, জায়গাটা তো আমার পছন্দ নাও হতে পারে।
কোনও ডিফিকালটি নেই। পছন্দ না হলে ছেড়ে দেব। ফাইভ থাউস্যান্ড ইজ নাথিং। না হয় তো জায়গাটা কিনে ফের বেচে দেওয়া যাবে। কাস্টমারের কমতি নেই। আজকাল লোক সব কিছু কেনে। জমি, বাড়ি, এনি সর্টস অব গুডস। বিজনেসম্যানরা বেচতে বেচতে হয়রান হয়ে যাচ্ছে।
মলয় হাসল না, কিন্তু মজা পেল। চারদিকে উদভ্রান্ত ক্রেতাদের ভিড় দিনরাত সেও তো দেখছে। বাজার গরম। সে বলল, এখনও আমি কিছু ঠিক করিনি সইকুমার। এজেন্সির জন্যই মেলা খাটতে হচ্ছে। প্রোডাকশনে গেলে আরও খাটুনি।
পয়সার জন্য খাটতে তো হবেই। কিন্তু প্রোডাকশনে আমি আছি, আপনার চিন্তা কি? এক্সপেরিয়েন্সড লোক রেখে দেব। এ লিমিটেড কোম্পানি ওয়ান্স এস্টাব্লিশড গোজ অন ইটসেলফ।
তারপর কী হবে সইকুমার? লিমিটেড কোম্পানি হবে, নিজে থেকে চলবে, প্রোডাকশন হবে, মাল বিক্রি হবে, কিন্তু তারপর কী হবে?
সইকুমার হাসল। ঝকঝকে দাঁত। বলল, ইট গোজ বিগার অ্যান্ড বিগার।
তারপর?
মার্কেট পেয়ে যাবেন, প্রোডাকশন বাড়তে থাকবে, এর মধ্যে কোনও তারপর নেই। এজেন্সির চেয়ে প্রোডাকশনের ইজ্জত বেশি।
মলয় তা জানে। তবু মনশ্চক্ষে সে একটা দাবার ছক দেখতে পায়। প্রতিপক্ষ খুব ভাল মানুষের মতো আপাততুচ্ছ চাল দিচ্ছে। সেই চাল কতটা বিপজ্জনক তা তাকে ভেবে দেখতে হবে। সইকুমারকে সোজাসুজি না বলতেও সে পারছে না। কারণ, ইচ্ছে করলে ও নিজের টাকাতেই প্রোডাকশনে নামতে পারে। কিন্তু যেহেতু মলয়কে টানতে চাইছে সেইজন্যই মলয়ের লোভ এবং সন্দেহ।
নিঃশব্দে পুণ্য এসে সইকুমারকে চা দিয়ে গেল। সঙ্গে দুটো বিস্কুট।
সহকুমার তার ডান হাতের ঢিলা ব্যান্ডে বাঁধা মস্ত ঘড়িটার দিকে চাইল। বিদঘুঁটে ঘড়ি। ডায়ালের মধ্যে ছোট ছোট আরও গোটা কয়েক ডায়াল। একগুচ্ছের টাকা গেছে। সইকুমার বলল, দি ওয়েদার ইজ হেল। আজ গাড়ি নিয়ে ফেঁসে যাব।
চা খেয়ে সইকুমার উঠল। বলল, তা হলে ব্যান্ডেল কবে যাবেন? গাড়িতে ম্যাকসিমাম ওয়ান আওয়ারস জার্নি। একটু আউটিংও হবে। হাউ অ্যাবাউট নেক্সট সানডে?
দেখছি। আমি তোমাকে ফোনে জানাব।
সইকুমার চলে গেলে মলয় ধৈর্যভরে টেলিফোন করে করে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন মালের অর্ডার দিল। বাঁকুড়ার বহু এজেন্ট তার হাতে এসে গেছে। সঙ্গে করে সে প্রায় দুলাখ টাকার অর্ডার অনেছে, অনেক কাজ। আবহাওয়া এরকম না হলে সে নিজে গিয়ে কয়েকটা সাপ্লায়ারের সঙ্গে দেখা করত। বইরে ঝড় কমেছে বটে, কিন্তু চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে তুলে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। দরজার কাঁচে জল জমে আছে। অন্ধকার এবং বদ্ধ বাতাসের ভ্যাপসা গরম আটকে আছে ঘরের মধ্যে। আগে বৃষ্টিকে সে বৃষ্টি হিসেবেই দেখত। আকাশ থেকে জল পড়ছে আজকাল রোদ বা বৃষ্টির সঙ্গে চাষবাস এবং তার নিজের ব্যাবসাকে জড়িয়ে সে হিসেব করে।
চিঠিপত্রের একটা ছোটখাটো ডাই জমেছে। মলয় আবছা আলোয় কয়েকটা খুলে দেখল। ভাল পড়া যায় না। তাই আর চেষ্টা করল না। বসে বসে রুকুর কথা ভাবতে লাগল। রুকুর এমন কী জরুরি দরকার?
ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিটও যায়নি, রুকু এসে হাজির। ছাতাটা মুড়ে দরজায় ঠেসান দিয়ে রাখতেই সেটা থেকে অঝোর জল ঝরে পড়তে থাকে। রুকুর জামাকাপড়ও সপসঙ্গে ভেজা। ছাতায় বৃষ্টি তেমন আটকায়নি বোঝা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই বলল, আজ আর বাড়ি ফেরা যাবে না দেখছি। রাস্তায় গোড়ালি সমান জল জমে গেছে। ট্রাফিক জ্যাম। ট্রাম বন্ধ।
মলয় স্থির চোখে চেয়ে দেখছিল রুকুকে। কোনও কথা বলল না। বৃষ্টিতে কলকাতার কী দুর্দশা হতে পারে তা তার চেয়ে বেশি আর কে জানে?
রুকু এক গাল হেসে বলল, সারা পথ ভিজতে ভিজতে এলাম, আর যেই তোর অফিসের দোরগোড়ায় এসেছি অমনি বৃষ্টি থামল।
থেমেছে!–বলে লাফিয়ে ওঠে মলয়। গিয়ে এক ঝটকায় বারান্দার দরজা খুলে ফেলে। হা হা করে ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে ঘরে ঢোকে। দু-একটা জলকণাও সঙ্গে আসে বটে, তবে বৃষ্টি বাস্তবিকই থেমেছে।
মলয় ঘড়ি দেখে বলল, এখনও সময় আছে। দু-একটা অফিসে ঢু মারতে পারা যায়। তোর কথাটা চটপট সেরে ফেল।
রুকু দুঃখিত মুখ করে বলে, পুরনো বন্ধুকে এভাবে ঘাড়ধাক্কা দিতে হয়! দয়ী ঠিকই বলে, তুই আর আগের মতো নেই।
আগের মতোই চিরকাল যারা থেকে যায় তারা ইন্মাচুয়োরড। আমার কাজ-কারবার সবার আগে, তারপর সময় থাকলে ফ্রেন্ডশিপ। এখন গা তোল তো বাপ।
কোথায় যাবি?
চল তো।
রুকু ওঠে। অফিস থেকে বেরিয়ে বাঁ হাতে কিছু দূর হেঁটে মলয় তাকে একটা দেড় তলার রেস্তরাঁয় নিয়ে আসে। টেরিটিবাজারে এমন চমৎকার ছিমছাম রেস্তরাঁ আছে তা যারা না জানে তারা ভাবতেও পারবে না।
মলয় টেবিলে কনুই রেখে ঝুঁকে বসে বলল, বল এবার।
রুকু কোনও ভণিতা করার সময় পেল না। চিরকালই মলয় কাঠখোট্টা গোছের। সোজা কথা বলতে এবং শুনতে পছন্দ করে। রুকু তাই চোখ বুজে বলে ফেলল, তুই দয়ীর পিছনে লেগেছিস কেন?
তোকে কি দয়ী একথা বলেছে?
বলেছে এবং বলছে। প্রায় রোজই টেলিফোন করে।
কী বলছে?
বলছে তুই ওকে বিয়ে করতে চাস। ও রাজি নয়।
তুই কি ওর সেভিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছিস? আমি ওকে বিয়ে করতে চাইলে তুই ঠেকাতে পারবি?
রুকু সামান্য অবাক হয়ে বলে, এটা গুহামানবদের যুগ নয় মলয়। নেগোশিয়েশনের যুগ। গা-জোয়ারি করছিস কেন? চাইলে বিয়ে করবি। তাতে কী? কিন্তু দয়ীরও তো মতামত আছে।
এবার মলয় সামান্য হাসল। টেবিলের কাছে একটা বেয়ারা এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আলুর চপ, ঘুগনি আর চায়ের কথা বলে মলয় কিছুক্ষণ পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে রুকুর দিকে চেয়ে বলল, সারাদিন দয়ীর কথা আমি পাঁচ মিনিটও ভাবি না। আমি কস্মিনকালেও দয়ীর প্রেমে পড়িনি। তবু আমি মনে করি দয়ীর আমাকেই বিয়ে করা উচিত।
কেন?
কারণ দয়ী আমার সঙ্গে একাধিকবার শুয়েছে।
শুনে রুকু কিছুক্ষণ কথাটার নির্লজ্জতায় স্তম্ভিত হয়ে রইল। তারপর বলল, সেটাই কি যথেষ্ট কারণ?
সেটাই একমাত্র কারণ রুকু।
দয়ী তো এই কারণকে আমল দিচ্ছে না।
দেওয়া উচিত। শরীরটা তো ফ্যালনা নয় যে শরীরের সম্পর্কটা উড়িয়ে দিতে হবে।
রুকু করুণ একটু হেসে বলল, দয়ী তোকে শরীর হয়তো দিয়েছে, কিন্তু মন বলেও তো একটা কথা আছে!
মলয় মাথা নেড়ে বলে, মন বলে দয়ীর কিছু নেই। দয়ী কেন, দয়ীর জেনারেশনের কারও নেই। ওসব বস্তাপচা শব্দ। ইউজলেস। আমি যদি দয়ীকে বিয়ে করি তবে সেটা ওরই সৌভাগ্য।
রুকু মোলায়েম স্বরে বলে, তুই হঠাৎ দয়ীর জন্য খেপে গেলি কেন বল তো!
খেপেছি কে বলল?
তুই নাকি ওকে প্রেমপত্র লিখিস? আর তাতে নাকি সব ভাবের কথা থাকে।
মলয় মৃদু হাসল। মাথা নেড়ে বলল, প্রেমপত্র লিখি বটে তবে কথাগুলো আমার নয়। চৌরঙ্গীর এক বুকস্টল থেকে ফেমাস লাভ লেটার্সনামে একটা বই কিনেছিলাম। সেটা থেকে অনুবাদ করে দিই। প্রেমপত্র লেখার এলেম আমার কই? সময়ও পাই না।
রুকুর হাসি পেল না। গম্ভীর মুখে বলল, দয়ীকে ছেড়ে দে না মলয়। বেচারা এ বিয়ে চাইছে না। রিসেন্টলি ও নাকি একজন টেবল লোককে পেয়ে গেছে। সে বিয়ে করে দয়ীকে আমেরিকা নিয়ে যাবে। কিন্তু দীর ভয়, তুই নাকি ঠিক সেই সময়ে বাগড়া দিবি। আফটার অল তুই যে ঘ্যাম নকশাল ছিলি সেটা ও ভুলতে পারছে না।
নকশাল ইজ এ ডেড পাস্ট। ওসব কথা ওঠে না। নকশাল ছাড়া কি ভয়ংকর লোক নেই? আমি নকশাল না হলেও ওর সুবিধে হত না।
তুই কী করতে চাস?
কিছু করব তো বটেই। তবে সেটা যে কী তা এখনও ঠিক করিনি। দয়ীকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়?
ইয়ার্কি মারিস না। কিডন্যাপ করলে পুলিশ-কেস।
বেয়ারা চপ আর ঘুগনি রেখে গেল। দারুণ ভাল গন্ধ ছাড়ছে। রুকু আর মলয় খেতে লাগল। খেতে খেতেই মলয় মুখ তুলে বলল, আমার চেহারাটা কেমন রে?
রুকু এক ঝলক চেয়ে দেখে গম্ভীর মুখেই বলে, চোয়াড়ের মতো। ইয়েট খানিকটা অ্যাপিল আছে।
অ্যাপিলটা কীসের? সেক্স?
ননা!
তবে?
খুব শক্তপোক্ত চেহারা। বোধহয় তোর মতো মানুষের ওপর মেয়েরা নির্ভর করতে পারে।
তবে দয়ী নির্ভর করতে চাইছে না কেন?
দয়ীও যে খুব শক্ত মেয়ে। ও চায় এমন পুরুষ যে ওর ওপরই নির্ভর করে।
ভ্রু কুঁচকে মলয় বলে, তা হলে আমাদের ম্যাচ করে না বলছিস?
বোধ হয় না।
তা হলে আমেরিকা থেকে দয়ীর ভাল পাত্তর এসেছে।
তাই তো বলছে।
খামোখা একটা গা-জ্বালানো হাসি হাসছিল মলয়। বলল, দয়ী আমাকে চায় না কেন জানিস?
আমাকে খুব একটা ভেঙে কিছু বলেনি। তবে বলছিল বন্ধুকে কি বিয়ে করা যায়।
সেটা কোনও কথা নয়। আমি একটা জিনিস মানি। ও যখন আমাকে শরীরটা দিয়েছে তখন বাকিটাও দেওয়া উচিত।
রুকু সহজে বিরক্ত হয় না। এবার হল। বলল, শরীরের কথা বার বার তুলছিস কেন? দয়ী হয়তো তোকে ছাড়াও আর কাউকে শরীর দিয়েছে। তা বলে সবাইকে বিয়ে করতে হবে নাকি?
খুব চোখা নজরে রুকুকে দেখল মলয়। তারপর বলল, তোর ধৈর্য কমে যাচ্ছে রুকু। আগের মতো তোর সহনশীলতা নেই।
রুকু লজ্জা পেল। তবে স্বীকার করল না।
বলল, তুই অত শরীর নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?
মলয় স্থির চোখে চেয়ে বলে, তোর একটা সুবিধে আছে রুকু। তোর শরীর লাগে না। তুই বোধহয় এখনও সেই কবেকার গুলি খেয়ে মরা তাপসীকে ভেবে মাসটারবেট করে যাচ্ছি।
এই অপমানে রুকুর মুখের সুস্বাদু ঘুগনি ছাইয়ের মতো বিস্বাদ হয়ে গেল। চামচটা নামিয়ে রেখে কিছু সময় মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে চেয়ে রইল সে। তারপর প্রবল মানসিক চেষ্টায় মুখ তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
মলয় সামান্য তেরছা হাসি হেসে বলল, কথাটা উড়িয়ে দিস না। মাসটারবেট যারা করে তাদের চেহারায় লাবণ্য থাকে না, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, এবং ক্রমে ক্রমে তাদের চিন্তাশক্তি, নার্ভের জোর আর মানসিক ভারসাম্য কমে আসে। তোর মধ্যে সব কটা লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি।
রুকু সাদা মুখে মড়ার মতো হাসে একটু। কথাটা অপমানকরই শুধু নয়, সত্যও। তাই তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায় উপযুপরি গুলি খেয়ে। কোনও কথাই আসে না মুখে।
মলয় তেমনি শান্ত, নিরুদ্বেগ, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বলে, আমি তোকে থরোলি জানি রুকু। তোর বোর্ডিং-এ এক বিছানায় আমি অনেক রাত কাটিয়েছি। তোকে খামোক অপমান করার জন্য তাপসীর কথা তুলিনি। আমি জানি তুই এখনও সেই মরা মেয়েটাকে নিয়ে ঘুমোতে যাস। আমি ষোলো বছর বয়স থেকে রক্তমাংসের তরতাজা মেয়েমানুষ ঘাঁটছি। আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই। তবু আমি দয়ীকে বিয়ে করার কথা কেন ভাবছি জানিস?
রুকু নিজের ভিতরের শূন্যতায় ডুবে বসেছিল। একটা কথাও তার কানে ঢুকছিল না। তবু মলয় কিছু জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পেরে মুখ তুলল।
মলয় বলে, বেশ কয়েক বছর আগে দয়ী আমার দারুণ অ্যাডমায়ারার ছিল। তখন আমি বিপ্লবী ছাত্রনেতা। দয়ী প্রায়ই বলত, তোমার মতো ভয়ংকর পুরুষকেই আমি সবচেয়ে ভালবাসি। কিছু মনে করিস না, দয়ীর হয়তো খানিকটা ফাদার অবসেশনও ছিল। ওর বাবা ছিল ফোর্থ গ্রেড গুন্ডা। যাই হোক, সে সময়ে একদিন দয়ী খুব সাহস করে আমাকে বলল, চলো বাইরে কোথাও কদিন বেরিয়ে আসি। আমি ইঙ্গিতটা বুঝলাম। দয়ী শরীরের সম্পর্ক চাইছে! আনইউজুয়াল কিছু নয়। ঝাড়গ্রাম ছাড়িয়ে গিধনি নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে আমার এক বন্ধু রেলে চাকরি করে। প্রায়ই যেতাম। রেল কোয়ার্টারের দু-একটা সব সময়েই খালি পড়ে থাকে। কোনও অসুবিধে ছিল না, একদিন দয়ীকে নিয়ে গিয়ে সেখানে উঠলাম। কিন্তু প্রথম দিনই শালবনে বেড়াতে গিয়ে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেল। কয়েকটা ছেলে-ছোকরা আমাদের পিছনে লেগেছিল একটু। সেটাও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কলকাতায় এরকম তো কত হচ্ছে। আমি মাইন্ড করিনি। ওরা তেমন খারাপ কিছু বলেওনি। একজন বলে উঠেছিল, দ্যাখ দ্যাখ, কলকাতার মাল দ্যাখ। শালা গিধনিতে মজা লুটতে এসেছে। কিন্তু দয়ী ব্যাপারটা উড়িয়ে না দিয়ে ভীষণ ফুঁসে উঠল। ফিরে দাঁড়িয়ে ইডিয়েট, গ্রাম্য, কোনওদিন মহিলা দ্যাখেনি, ব্লান্ট হেডেড ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে লাগল। ছেলেগুলোও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ওটা ওদেরই তো জায়গা। তারাও রুখে উঠে বলতে লাগল, কেরানি বের করে দেব, গিধনিতে মজা করতে আর আসতে হবে না। কলকাতার ফুটানি কলকাতায় গিয়ে দেখাবেন। আমি মাঝখানে পড়ে থামানোর চেষ্টা করি, কিন্তু দয়ী ছাড়বার পাত্রী নয়। যে ছোকরাটা দুকদম এগিয়ে এসে বেশি তেজ দেখাচ্ছিল, দয়ী ছুটে গিয়ে পায়ের স্লিপার খুলে তার গালে ঠাস করে বসিয়ে দিল। তারপর যা হয়। ছোকরারা আমাদের ঘিরে ফেলল চোখের পলকে। কিল ঘুসি লাথি চলতে লাগল সমানে। আমি এসব ছোটখাটো ঝুট ঝামেলা পছন্দ করি না। তবু দয়ীর সম্মান রাখতে অনিচ্ছের সঙ্গেও লড়তে হল। ছেলেগুলো কিছুক্ষণ খামচাখামচি করে হাফাতে থাকে। তারপর শাসায়। আমি তখন তাদের গায়ে-টায়ে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা করি। ব্যাপারটা মিটেও যায়। কিন্তু সেই থেকে দয়ী বেঁকে বসল। সেই রাত্রেই আমাদের প্রথম একসঙ্গে শোওয়ার কথা। কিন্তু দয়ী কিছুতেই রাজি নয়। কেবল কাঁদে আর বলে, ওই বদমাশরা আমার শরীরের লজ্জার জায়গায় হাত দিয়েছে, মেরেছে, আর তুমি ওদের তোয়াজ করলে! তুমি কি পুরুষ মানুষ? আমি এতদিন তোমাকে নিয়ে অন্য স্বপ্ন দেখতুম। সারা রাত চোখের জল আর খোঁচানো কথা দিয়ে দয়ী আমাকে যথেষ্ট তাতিয়ে তুলল। এ কথা সত্যি যে, আমি পলিটকসের জন্য কয়েকটা খুন করেছি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও কারণে মানুষকে মেরে ফেলার কথা আমি ভাবতেও পারি না। কিন্তু সেই রাতে দয়ী শরীর দেয়নি বলে কামে ব্যর্থ হয়ে আমি খেপে উঠেছিলাম। দয়ী আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, ছোরাদের পালের গোদাকে ফিনিশ করব। পরদিন একটু খোঁজ নিতেই ছোকরার পাত্তা মিলল। পশ্চিমধারে মস্ত একটা মাঠের গায়ে নির্জন জায়গায় তার বাড়ি। সন্ধের মুখে একটু গা ঢাকা দিয়ে দয়ী আর আমি গিয়ে বাড়ির কাছাকাছি ঝোপ জঙ্গলে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর দয়ীর তখন কী উত্তেজনা! বার বার আমার হাত চেপে ধরছে, এমনকী চুমুও খাচ্ছে। কখনও পাগলের তো হাসছে, কখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে। একটু পরেই একটা খুন করতে হবে ভেবে আমি দয়ীর দিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। তবু আমার একটা চোখ সারাক্ষণ দয়ীকে লক্ষ করছিল। আমার মন বলছিল, এ খুনটা কেবলমাত্র দয়ীর শরীরের জন্যই আমাকে করতে হচ্ছে না তে! যদি তাই হয় তবে দয়ীর শরীরের জন্য আমাকে অনেকটাই মূল্য দিতে হল। ভাববার বেশি সময় ছিল না। আচমকা দেখলাম, নির্জন মাঠের পথ ধরে একা হেঁটে আসছে একটা ছেলে। খুবই আবছা দেখাচ্ছিল তাকে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ালাম। এক হাতে রিভলভার, সরিতের একটু লজ্জা করছিল। ভিতরে বেলুন চোপসানোর মতো একটা ক্লান্তিকর হতাশা। এদিকটা সে কখনও ভেবে দ্যাখেনি। চিঠিটা পেয়ে একটা মস্ত যুদ্ধাস্ত্র পেয়ে যাওয়ার আনন্দে সরিৎ সেটা নিয়ে সোজা এক ফোটোগ্রাফারের দোকানে গিয়ে ছখানা ফোটোটাস্ট কপি করায়। চিঠিখানা সযত্নে রেখে দেয় স্টিলের আলমারিতে। ইচ্ছে ছিল দয়ী এবং শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে এগুলোকে সে কাজে লাগাবে।
সরিৎ কোনও জবাব দিল না দেখে মৃন্ময়ী বলে, তুমিও কাজটা পুরুষের মতো করোনি।
সরিৎ ধমকে উঠল না বটে কিন্তু বিষ মেশানো শ্লেষের হাসি হেসে বলল, তাই নাকি? তোমাদের রক্তে যে দোষ রয়েছে সেটা বললেই বুঝি পুরুষত্বের অপমান হবে?
মৃন্ময়ী আর কথা বলল না, উঠে চলে গেল।
বাইরে অন্ধকার ঘনাল। ঘরটা হয়ে উঠল আরও উজ্জ্বল। সরিৎ বিনয়ের রেখে যাওয়া প্যাকেট থেকে অনভ্যাসের হাতে আর একটা সিগারেট বের করে ধরাল। ছাদে ওরা কী করছে? দ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকে সরিৎ।