ক্ষৌরকর্ম
কোন এক এক রবিবারে সনাতনমামা ভর দুপুরের আগেই সটান ভেতর বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেন। মুখে হাসি, হাতে কালো টিনের এক বাক্স। ছোট্ট আমি ও দিদি, পিঠের বোতাম খোলা ফ্রক –ছুট্টে গিয়ে উঠোনে উবু হয়ে বসতাম, চোখেমুখে উপচে পড়া কৌতুহল।
বাড়িটি ছিল আমাদের দাদুর আর বিধবা দিদিমা ছিলেন আমার “মা” আর দিদির “বড়োমা”।
সনাতনমামা তার কর্ম করে যেতেন চেয়ারে বসা মামার চুল কাটা ইত্যাদিতে। আমাদেরও মাঝেমধ্যে চুল ছেঁটে দিতেন, তবে ইচ্ছে করেই (এখন মনে হয়) কালো বাক্সটি খুলে রাখতেন । আমরা অবাক চোখে দেখতাম নানা রঙের ও নানান আকারের কতো চিরুনি, খুর, নরুন, বিভিন্ন রকম কাঁচি, ছুড়ি, ব্রাশ,সাবান, ধবধবে সাদা এক পাথর বলে নাকি ফিটকিরি, পাউডার, কালো হ্যান্ডেলওয়ালা যন্ত্র নাম নাকি ক্লিপ, কাপড় টুকরো—- সব সযত্নে সাজানো । আমরা শুধু দেখতাম, শাসনঅভ্যাসে হাত কখনোই দিতাম না।
সনাতনমামা কাজ করতেন আর নানা গল্প করতেন আর সকলেই শ্রোতা।
হঠাত্ একদিন আমরা দুবোনে দেখলাম বাক্সে মধ্যে বেড়ালের নখের মতোই বিশাল দুটি নখ, বিস্ময় নিরসন করলেন সনাতনমামা । বললেন, ” ও , ওতো বাঘের নখ, আজ জঙ্গলে গিয়ে কেটে এলাম ত —একটা বাঘের।” অনেক গল্প শুনি সনাতনমামার কিন্তু এ গল্পে আমাদের দুবোনের বিস্ময় আর কাটে না। বাঘ নাকি সনাতনমামাকে কিছু বলে না নিজেই হাত পা বাড়িয়ে দেয়। সনাতনমামা আমার কাছে তখন ” হিরো”
তারপর দেখতে পেতাম কালো মোটা লম্বা মতো চুল , ঘোড়ার লেজ ছাটতে হয় ত। আবার থাকত কোনদিন একগুচ্ছ বাদামী লোম —কুকুরের, আমাদের দেখাবার জন্য থাকত খরগোশের গোঁফ বেড়ালের গোঁফ । এগুলো সব বাড়ির পোষা প্রাণীর ।
তখন আমাদের কাছে “নাছু ” ঘুরঘুর করলেই বলতাম , “যা ভাগ এখান থেকে”। আমি চাইতাম না নাছুর গোঁফ কাটা হোক।
তারপর? আমরা কেমন বড়ো হয়ে গেলাম আর সনাতনমামা বুড়ো , আমাদের প্রতি সম্ভ্রম ।
কলকাতা এলাম , কলেজ —- তখন তিনটি কথা খুব চালু ছিল “রোডেশিয়ান কুকুর,”, “এগারো নম্বর বাস” আর “ইটালিয়ান সেলুন”। কত সেলুন এদিক ওদিক । “পার্লার ফর মেন” ।
কিন্তু সনাতনমামা আর একটা কালো বাক্সের ঋণ? শিশুমনে সে বোঝা যে কত ভারী —- বুড়ো বয়সেও তা শোধ হলো নি।