কৈশোর
সামনের দিকের এবড়ো-খেবড়ো বারান্দাটায় কোনো আলো নেই। হরিলালের ঘরখানা খুঁজে একটা ছোট্ট মোম পেয়েছিলুম, এতক্ষণে সেটারও নিবু নিবু অবস্থা এরপর অন্ধকারে কি আর বসে থাকা যাবে?
আমার হ্যাণ্ডব্যাগটায় একটা টর্চ আছে, কিন্তু সেটাও তো এখন বার করবার উপায় নেই। অসম্ভব রাগ হচ্ছে হরিলালের ওপর। ব্যাটা পঁচিশটা টাকা নিয়ে ভেগে পড়ল?
মুমু আমার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে এসেও ও অনেকক্ষণ কেঁদেছে। কান্নার সঙ্গে ঘুমের একটা সম্পর্ক আছে। কান্না আর ঘুম যেন যমজ ভাইবোন।
আশ্চর্য ব্যাপার, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে ছেলেমেয়েরা অনেক কিছুই শেখে না তা আমি জানতুম, কিন্তু তা বলে তারা সাপও চেনে না? পায়ের কাছে অত বড় একটা সাপ দেখেও ভয় পায়নি, নিরীহভাবে নাকী সুরে বলছিল, এটা কী?
শহরের ছেলেমেয়েরা বোধহয় সাপের কথা কখনো চিন্তাও করে না!
সাপটা কি শতরঞ্চির মধ্যেই দলা পাকিয়ে ছিল? অসম্ভব কিছু নয়, সাপেরা দারুণ অলস হয়। যাদবলাল শতরঞ্চিটা কোলে করে আনল, আমার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল, আমি সেটা ঘরে নিয়ে গেলুম, মুমু সেটাকে না খুলে ওপরে বসে রইল অতক্ষণ, এর মধ্যে যে-কোনো সময় সাপটা ওকে বা আমাকে কামড়ে দিতে পারত! যাদবলালের কথা ছেড়েই দিলুম, সে ব্যাটা সাপসমেত শতরঞ্চি এনেছে মাতাল অবস্থায়, দোষটা তার নয়, তার নেশার।
অবশ্য, ঘরের মধ্যেই সাপটা আগে থেকেই ঢুকে পড়তে পারে। নতুন বাড়িতে, ইঁটের পাঁজায় সাপ থাকে, এরকম আমি আগে শুনেছি। যদিও আমি শতরঞ্চির তলা থেকেই ওকে মাথা বার করতে দেখলুম।
বেশ বড় সাপ, চ্যাপটা মতন ফণা, নির্ঘাৎ বিষ আছে। কামড়ালে আর দেখতে হতো না। জীবনে বোধহয় এত ভয় পাইনি! মুমুকে কামড়ালে আমি চন্দনদা আর নীপা বৌদিকে কী করে সান্ত্বনা দিতুম!
ঘরের মধ্যে সাপটাকে কোনোরকমে বন্দী করা গেছে, এখন সারা রাত আমাদের বাইরে কাটাতে হবে। কিন্তু মোমবাতিটা শেষ হয়ে গেলে, এখানেও যে আর একটা সাপ আসবে না, তার কি কোনো ঠিক আছে? অন্য জন্তু-জানোয়ার বা ডাকাতদের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল!
এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই, আমাকে চোখের দৃষ্টি যত দূর সম্ভব তীব্র করে একবার সামনের বারান্দাটুকু, আর একবার দূরের অন্ধকারের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে। পিঠের দিকে দেয়াল। একটা লাঠি-ফাঠিও নেই, শুধু একখানা থান ইঁট রেখে দিয়েছি পাশে। ক্রমশ মনের জোর কমে আসছে। কিন্তু তা হলে তো চলবে না, এইভাবে আমাকে জেগে থাকতে হবে সারা রাত।
আকাশে অনেক তারা। মেঘের নামগন্ধও নেই, বাতাস এখনো গরম। এক হিসেবে গরমটাই ভালো। ঠাণ্ডা হাওয়া দিলে ঘুম এসে যেতে পারত!
বারান্দার এক কোণে হঠাৎ কিছু একটা নড়াচড়া করতেই চমকে উঠলুম। একটা ব্যাঙ! যদিও ব্যাঙ অতি গোবেচারা প্রাণী, আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু ব্যাঙ যে সাপের অতি প্রিয় খাদ্য। কান টানলেই যেমন মাথা আসে, তেমনি ব্যাঙের পেছনে সাপও আসতে পারে। এ কী বিপদে ফেললে ভগবান! ভগবান? হ্যাঁ, কাছাকাছি আর কোনো জনমনুষ্য নেই, এখন ভগবানকে ডাকা ছাড়া আর উপায় কী?
অন্ধকারের মধ্যে আলোর বিন্দু হয়ে ফুটে উঠল ভগবান।
হাতে একটা হ্যারিকেন ঝুলিয়ে কে যেন এইদিকেই আসছে মাঠ ভেঙে। কী যেন গান গাইছে। গেটের মধ্যেই ঢুকে পড়ল, হ্যাঁ, এই তো আমাদের হরিলাল। একেবারে সাক্ষাৎ হরি। তার হাতে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি।
নেশা করেছে যথেষ্ট, বেশ স্ফূর্তির মেজাজে আছে। প্রায় নাচতে নাচতে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে বলল, এসে গেছি সাব! আমার ঘরে তো মশল্লা নেই, তাই গাঁয়ে গিয়ে, মুরগি কাটিয়ে এক বাড়ি থেকে ঝোল রান্না করে এনেছি। এখন শুধু জলদি জলদি ভাত ফুটিয়ে নেব। তারপর খেয়ে নেবেন। বেশি দেরি হয়নি তো সাব?
উত্তর দেব কী, এখন আমার খাওয়ার ইচ্ছেটাই ঘুচে গেছে!
আমি বললুম, হরিলাল—সাপ!
হরিলাল সঙ্গে সঙ্গে ডেকচিটা নামিয়ে হ্যারিকেন ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, কোথায় সাপ?
আমি বললুম, এখানে না। ঘরের মধ্যে।
হরিলাল ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, ঘরের মধ্যে সাপ? শালে কো মার ডালুঙ্গা! দাঁড়ান!
দৌড়ে সে নিজের ঘরে গিয়ে একটা লাঠি নিয়ে ফিরে এলো।
তারপর বলল, চলুন তো দেখি!
মুমুর এমন ঘুম যে ধাক্কা দিলেও ওঠে না। তাকে এখানেও একা ফেলে রেখে যাওয়া যায় না। ওকে টেনে তুলে চাকাওয়ালা পুতুলের মতন হাঁটিয়ে নিয়ে গেলুম। আমার হাতে হ্যারিকেনটা দিয়ে হরিলাল বলল, আপনি একটু দূরে দাঁড়ান, সাব।
ছিটকিনিটা খুলে দরজাটায় একটা জোর ধাক্কা দিল সে। ভেতরে আলো জ্বলছে, সাপটা চোখে পড়ল না।
আমি বললুম, হরিলাল, সাবধান, শতরঞ্চির নিচে আছে নিশ্চয়ই!
হরিলাল ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আগে ভালো করে দেখে নিয়ে তারপর একটানে তুলে ফেলল শতরঞ্চিটা। সেটা জানলার ওপর রেখে বলল, কই, সাপ তো নেই!
আমি বললুম, হ্যাঁ, আছে। দেখো বোধহয় বাথরুমে ঢুকেছে!
হরিলাল মেঝেতে লাঠিটা ঠুকতে লাগল। নাচের ভঙ্গিতে বাথরুমের দরজাটায় একটা লাথি মারল। তারপর গান গাইতে গাইতে, লাঠি ঠুকে তাল দিয়ে বাথরুমটা খুঁজে এসে বলল, না, সাব, সাপ নেই। আপনি ভুল দেখেছেন!
সাপটা আমি ভুল দেখেছি? হতেই পারে না। চ্যাপটা মতন ফণা, শতরঞ্চির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল অনেকখানি, একবার ফোঁসও করেছে।
হরিলাল বলল, আপনি ঘরের মধ্যে এসে দেখুন, সাব! কিচ্ছু নেই।
হরিলাল এতখানি সাহস দেখালে আমার আর দ্বিধা করা চলে না। আমি মুমুকে ধাক্কা দিয়ে বললুম, এই মুমু, ওঠ! চোখ মেলে তাকা! সাপ চলে গেছে!
মুমু আমার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, উঁ?
সেই অবস্থায় তাকে নিয়ে এলুম ভেতরে। সত্যিই সাপটার কোনো চিহ্নমাত্র নেই। হরিলাল শতরঞ্চিটা দু’হাতে নিয়ে ঝাড়ল, তার থেকেও কোনো সৰ্প-বৃষ্টি হলো না। সে শতরঞ্চিটা যত্ন করে পেতে দিয়ে বলল, কোনো ভয় নেই। এখানে একটা দুটো সাপ আছে। কিন্তু কামড়ায় না। আমি একটু পরে ভাত এনে দিচ্ছি, খেয়ে-দেয়ে আরামসে ঘুমিয়ে পড়ুন।
তারপর সে ট্যাক থেকে কয়েকটা টাকা ও খুচরো পয়সা বার করে বলল, আপনার মুরগি নিয়েছে বারো টাকা, যে রান্না করল তাকে দিলুম তিন টাকা আর দু’পীস মাংস, ঠিক দু’পীস দিয়েছি সার, বেশি দিইনি, আর আমি সাড়ে চার টাকার মহুল খেয়েছি, আগে দু’টাকা বোতল ছিল, আজ দু’ বোতলে আট আনা বেশি নিল শালা! এই নিন সাব আপনার বাকি পয়সা।
আমি সাপ দেখার চেয়েও বেশি চমকিত হলুম। বাংলোর চৌকিদার টাকা ফেরত দিচ্ছে? এরকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার আজও ঘটে? এ যে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।
আমি বললুম, ঠিক আছে, ঐ পয়সা তুমি রাখো!
হরিলাল বলল, কেন সাব? দু বোতল মহুল খেয়েছি বলে রাগ করছেন?
-আরে না-না। খেয়েছ, বেশ করেছ! তুমি তো এর পর ভাত রাঁধবে, সে জন্য খরচ লাগবে না?
—আপনার পয়সায় মহুল খেয়েছি, আপনার কাছ থেকে ভাতের দাম নেব? ছি ছি, আমি এত নিমকহারাম নই স্যার!
—পয়সাটা তোমার কাছে রাখো না!
—আপনি রাগ করেননি বলুন, সাব! পয়সা কেন ফেরত নেবেন না? এ হচ্ছে মাতালের পেড়াপেড়ি। পয়সা সে ফেরত দেবেই ঠিক করেছে। কিছুতেই তাকে বোঝানো যায় না। শেষ পর্যন্ত টাকাপয়সাগুলো একবার আমি নিয়ে আবার তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললুম, এখন থাক, কাল সকালে হিসেব নেব। এখন তুমি চটপট ভাত রান্না করে আনো তো!
শতরঞ্চিটা পেয়েই মুমু সটান শুয়ে পড়েছে। হরিলাল চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে লাগলুম, সাপটা কোনখান দিয়ে পালাল। একটা জানলা রয়েছে, তবে বেশ উঁচুতে। সাপ তো আর দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে না। একমাত্র যেতে পারে বাথরুম দিয়ে। বাথরুমের নর্দমার ঝাঁঝরিটা আলগা। কিংবা কমোডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে কি না, তাই বা কে জানে!
একটা জলের বালতি ভেতরে এনে বাথরুমের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলুম। সারারাত ঐ বাথরুমে যাবার আর দরকার নেই বাবা! হিসি-টিসি পেলে দরজা খুলেই একটু দূরে যে বালির স্তূপটা রয়েছে, সেখানেই সেরে নেওয়া যাবে।
প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই হরিলাল গরম গরম ভাত আর মুরগির ঝোল এনে দিল। সঙ্গে বেশ ভালো প্লেট আর কাঁটা চামচ। সে জানাল যে কন্ট্রাক্টর বাবুরা মাঝে মাঝে দুপুরবেলা তার হাতের ভাত রান্না খায়। সেই জন্য তার কাছে বাসনপত্র রয়েছে।
হরিলালের মুখ দিয়ে ভক ভক করে মহুয়ার গন্ধ বেরুচ্ছে, হাঁটতে পারছে না ঠিক করে। কিন্তু তার কাজের কোনো ত্রুটি নেই। সব কিছু সাজিয়ে দিয়ে সে বলল, আপনারা খেয়ে-দেয়ে দরজা এঁটে ঘুমিয়ে পড়ুন। এঁটো বাসনপত্ৰ আমি কাল সকালে নিয়ে যাব। আর কিছু লাগবে না তো?
আমি জিজ্ঞেস করলুম, তোমার খাবার আছে তো?
সে হঠাৎ জিভ কেটে বলল, হাঁ সাব। রেখেছি। নিজেরটা আগেই তুলে রেখেছি।
তার জিভ কাটার মর্ম আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না। তবু আমি তাকে কিছুটা ভাত আর কিছুটা মাংস ফিরিয়ে দিলুম। এখনো যা রইল, আমাদের দু’জনের পক্ষে যথেষ্ট।
এইবার একটা সমস্যা হলো মুমুকে তুলে খাওয়ানো।
তাকে ধরে ঝাঁকালেও সে উঠতে চায় না, জোর করে তুলে বসিয়ে দিলেও ঢলে ঢলে পড়ে। যত তাকে বলি, মুমু, লক্ষ্মী মেয়ে, একটু খেয়ে নে, সে ততই উঁ উঁ করে। একবার তার মাথার চুল ধরে টানতেই সে চোখ মেলে বলল, কী? কী হয়েছে? আমাকে মারছ কেন?
আমি খুব নরম করে বললুম, মারব কেন রে? এই দ্যাখ, খাবার দিয়েছে, চট করে খেয়ে নে, তারপর ঘুমোবি!
মুমু বলল, আমি খাব না, খেতে ইচ্ছে করছে না।
অনেক বাড়িতে দেখেছি, এই বয়েসী ছেলেমেয়েদেরও তাদের মা খাইয়ে দেয়। সারাদিন অত্যধিক পড়াশুনোর চাপে বেচারিরা রাত আট-ন’টার সময়েই ঘুমিয়ে পড়ে, মায়েরা তাদের ডেকে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থাতেই মুখে কিছু খাবার গুঁজে দেয়।
আমি তো মুমুকে খাইয়ে দিতে পারব না। কিন্তু জানি ওর খিদে পেয়েছে। বিকেল থেকে কিছুই খায়নি। তাই বললুম, এই, তোর ভাত মেখে দেব ঝোল দিয়ে?
কোনো রকমে একটু চাঙ্গা হয়ে দু গেরাস ভাত খেল। তারপর আবার বসে রইল ঝিম মেরে। আমার বেশ খিদে চনমন করছে। আমি গরম ভাত-মুরগির ঝোল অবহেলা করতে পারি না। কিন্তু পাশে একজন অভুক্ত থাকলে কি খাবার রোচে?
ওকে একটা খোঁচা মেরে বললুম, এই, কী, হলো?
-আর খাব না। আর ভাত খাব না।
-তবে শুধু মাংস খা! মাংস কটা শেষ করে নে!
—তুমি খাও!
এবার আমি একটা মুরগির ঠ্যাং প্রায় জোর করে তুলে দিলুম মুমুর মুখে। ও সেটা মোটামুটি খেয়ে নিল। যাক, এই যথেষ্ট হয়েছে। বাকি মাংস চেটেপুটে শেষ করে দিলুম আমি।
মুমু বাথরুমের দরজা খুলতে যাচ্ছিল, আমি বললুম, ওটা খুলিস না। ওখান দিয়ে আবার সাপ আসতে পারে।
মুমু জিজ্ঞেস করল, পয়জনাস স্নেক?
আমি বললুম, হ্যাঁ, দারুণ পয়জনাস। ফণা আছে! মগে করে ঐ বালতির জল নিয়ে জানলার কাছে হাত ধুয়ে নে।
প্রায় আমাকেই মুমুর হাত-মুখ ধুইয়ে দিতে হলো। মুমু কুলকুচি করে জানলার বাইরে জল ফেলল। জানলাটা রাত্তিরে খোলা রাখতেই হবে। নইলে গরমে টেকা যাবে না। এখন এখান দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে।
মুমু তার ব্যাগ থেকে একটা চাদর বার করে বলল, পাখা নেই?
আমি বললুম, পাখা নেই, এয়ার কণ্ডিশনার লাগায়নি, কী আর করা যাবে বল! তুই এই গরমের মধ্যে আবার চাদর গায়ে দিবি নাকি?
—আমার চাদর গায় দিয়ে ঘুমোনো অভ্যেস! তুমি বুঝি আমার পাশে শোবে?
–কেন, এখনও তোর আপত্তি আছে নাকি? তা হলে তুই গিয়ে বাইরে শুতে পারিস! তুই কতক্ষণ আমার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমোলি, তা বুঝি খেয়াল নেই?—ঠিক আছে, তোমাকে অ্যালাউ করছি। কিন্তু তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না কিন্তু!
–তোর মতন একটা জেদি মেয়েকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে!
মুমু আমার দিকে গাঢ় চোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত অপলক। তারপর বলল, আমি কোনো দিন বিয়ে করব না। কোনো ছেলেকেই বিয়ে করব না!
সেই কথার মধ্যে বেশ একটা অভিমানের সুর ফুটে উঠল। সেই সুরটার জন্যই খটকা লাগল আমার। এইটুকু মেয়ের মাথায় বিয়ের চিন্তা কে ঢুকিয়েছে? এরই মধ্যে ওর প্রেম ও বিচ্ছেদ জাতীয় কিছু ঘটে গেছে নাকি? কিছুই বলা যায় না, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি এসে গেল বলে!
-কেন, ছেলেদের ওপর তোর এত রাগ কেন রে?
—পাজি লোকেরাই শুধু বিয়ে করে। আমি কিছুতেই বিয়ে করব না।
—পাজি মানে, কার মতন? রাজ বব্বর, মিঠুন চক্রবর্তী, না অমিতাভ বচ্চনের মতন?
—সব্বাই পাজি, সব্বাই! তুমিও!
—এই রে, আবার কান্নাকাটি শুরু করবি নাকি? থাক, থাক, আজ আর ওসব কথায় দরকার নেই। শুয়ে পড়। আলো জ্বালা থাকবে?
–না, আলোতে আমার ঘুম আসে না। নিভিয়ে দাও।
মুমু টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে, গায়ের ওপর চাদরটা টেনে দিয়ে পাশ ফিরল দরজার দিকে। আমি আলো নেভাবার আগে একটা সিগারেট ধরালুম।
তাতে দুটো টানও দিতে পারিনি, মুমু বলে উঠল, এই নীলকাকা, ঐ দ্যাখো, আবার এসেছে!
আমার চোখ দুটো যে কেন সকেট থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো না সেটাই আশ্চর্যের। দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি একটু আগে, এখন সেই দরজার তলা দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে করতে ঢুকে আসছে সাপটা।
চৌকাঠ তৈরি হয়নি, দরজার তলায় আধ ইঞ্চি মতন ফাঁক, সেখান দিয়ে যে কোনো সাপ ঢুকতে বা বেরুতে পারে, তা কল্পনাই করা যায় না। ফাঁকটা আগে চোখেও পড়েনি।
ওরে সর্বনাশ! এখন দরজা বন্ধ, এবার পালাবারও উপায় নেই আমাদের! এবারে মুমুও ভয় পেয়েছে। নিজেই লাফিয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, নীলকাকা, পয়জনাস স্নেক।
আমি ওকে ধরে চলে এলুম জানলার কাছে। এই জানলা দিয়ে বেরুবার কোনো প্রশ্নই নেই। একটু আগে আমি গ্রিলগুলো টেনে দেখেছি চোর-টোর ঢুকতে পারবে কি না!
সাপটা আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে এলো। ও কি আমাদের এঁটো-কাঁটা খেতে এসেছে? সাপ কি ভাত আর মুরগির হাড় চিবোনো খায়? বাইরে এত ব্যাঙ ঘুরছে……
বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে পড়ে গেল, সাপ কানে শুনতে পায় না। কিন্তু নড়াচড়া টের পেলেই কামড়াতে আসে।
আমি বললুম, মুমু, সাবধান, একটুও নড়বি না। খবর্দার!
তারপর আমি জানলা দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় চ্যাঁচালুম, হরিলাল! হরিলাল! জলদি আও! সাপ!
কোনো সাড়া নেই। সে বোধহয় এতক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নেশার ঘুম, সহজে ভাঙবে না!
তবু বাইরের দিকে মুখটা যথাসম্ভব নিয়ে ষাঁড়ের মতন চিৎকার করলুম, হরিলাল! হরিলাল! শিগগির এসো। বাঁচাও! সাপ!
এবার একটা ক্ষীণ উত্তর এলো, হাঁ!
হরিলাল এসে যদি দরজায় ধাক্কা দেয়, তা হলে সাপটা ভয় পেয়ে নিশ্চয় আমাদের দিকে চলে আসবে। সাপটা এখনো আমাদের দেখতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। খুব আস্তে আস্তে এদিকে-ওদিকে মাথা ঘোরাচ্ছে, কি যে সে চায় তা কে জানে!
আমি জানলা দিয়ে আবার বললুম, হরিলাল, এদিকে!
হরিলাল ঠিক এসে পৌঁছল জানলার কাছে। কিন্তু সে আমাদের বাঁচাবে কী করে? দরজাটাই যে খোলা যাবে না। আমি আর মুমু যখন অন্ধকার বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলুম, তখন সাপটা ঐখানেই ঘোরাফেরা করেছে। ওরেঃ বাবা!
হরিলাল বলল, কোথায় সাপ? হাঁ, হাঁ, ঠিক বটে। এ বহুৎ বদমাস সাপ। চন্দ্রবোড়া। আপনি দরজাটা খুলে দিতে পারবেন না?
-কী করে খুলব? দরজার কাছেই যে রয়েছে!
মুমু বলল, নীলকাকা, নীলকাকা, এদিকে তাকাচ্ছে! দেখতে পেয়েছে। হরিলাল দ্রুত জানলা দিয়ে তার লাঠিটা গলিয়ে দিয়ে বলল, সাব, মারুন! সত্যি কথা বলতে কি, আমার হাত কাঁপছে। জীবনে যা করিনি, তা কি হঠাৎ এক দিনে পারা যায়? বন্ধ ঘরের মধ্যে একটা সাপ মারা কি সোজা কথা? আমার প্রথম ঘা-টা যদি ফসকে যায়, তা হলেই সাপটা লাফিয়ে উঠে আমায় ছোবল মারবে না?
তবু লাঠিটা হাতে পেয়ে একটু ভরসা হলো। সাপটা একেবারে কাছে এসে আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করা যাবে!
হরিলাল আবার বলল, সাব মারুন!
আমি মুমুকে পেছনে রেখে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললুম, এখন পারব না। কাছে আসুক!
হরিলাল ব্যগ্রভাবে বলল, জুতার শব্দ করুন! জোরসে জোরসে! ও ভয় পাবে!
লোকটা বলে কি! সাপ কানে শুনতে পায় না। মাটিতে পা ঠুকলে সেই ভাইব্রেশান ও টের পেতে পারে। ইচ্ছে করে আমাদের দিকে ওর নজর ফেরাব? ভয় পাবার বদলে যদি তেড়ে আসে?
হরিলাল হাত বাড়িয়ে আমায় ঠেলা মেরে বলল, দু’জনে এক সাথে জুতার শব্দ করুন! লাফিয়ে লাফিয়ে!
এইসব ব্যাপারে হরিলাল আমাদের চেয়ে জ্ঞানী। তা ছাড়া তার কথার মধ্যে এমন একটা ব্যাকুলতা রয়েছে যে অগ্রাহ্য করা যায় না। মুমু আমাদের দিকে তাকাল, মুমুর খালি পা, আমার পায়ে এখনো চটি গলানো রয়েছে। দু’জনে একসঙ্গে ধপ ধপ শব্দ করলুম।
হরিলাল বলল, আরও জোরসে!
সাপটা সত্যি টের পেয়েছে, তার উঁচু করা ফণা থেকে চিড়িক চিড়িক করে বেরিয়ে আসছে জিভ। কোন্ দিকে তরঙ্গটা উঠছে সেটা বুঝে নিল, কিন্তু তেড়ে এল না। আমি লাঠিটা বাগিয়ে ধরে আছি, তেড়ে এলে ওকে না মেরে মরব না, এই একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
সাপটা আমাদের এই নাচন-কোঁদনে বেশ বিরক্তই মনে হলো। সে ফণাটা নামিয়ে দরজার তলায় ঢোকাল।
হরিলাল বলল, সাব, এবার ছুটে গিয়ে মারুন। কিংবা লাঠিটা আমাকে দিন! আমি লাঠিটা জানলা দিয়ে ফেরত পাঠাতেই হরিলাল ছুটে গেল দরজার দিকে। সাপটা প্রায় চোখের নিমেষেই বাইরে বেরিয়ে গেছে।
এবার আমরা শুনতে পেলুম দরজার বাইরে লাঠির ঠকঠক শব্দ আর হরিলালের নাচ। সেই সঙ্গে সে মনের ফুর্তিতে গানও গাইছে, ফাগুয়া কি বিটিয়া রে ফাগুয়া কি বিটিয়া, কাঁহা গেইলি পাগলী রে ফাগুয়া কি বিটিয়া!
ঘামে আমার শার্ট ভিজে গেছে। বেঁচে যে গেছি, এখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সাপটা এত সহজে চলে গেল? কে যেন বলেছিল সাপ আসলে অতি নিরীহ আর ভীতু প্রাণী, সেটা তা হলে মিথ্যে নয়। মাটিতে পা ঠোকার চোটে আমার একটা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে, যাক গে। সে কাল সকালে দেখা যাবে!
মুমু বলল, কী বিচ্ছিরি জায়গা! নীলকাকা, তুমি আলো নিভিয়ে দেবার পর যদি সাপটা ঢুকত?
ঠিকই তো! নেহাত সিগারেট টানার ইচ্ছে হয়েছিল বলেই তো একটু দেরি করছিলুম! এ কী ঘরে আমাদের শুতে দিয়েছে, যেখানে রাত্তিরবেলা সাপ ঘুরে বেড়াতে পারে!
গানের মাঝখানেই হরিলাল একবার চেঁচিয়ে বলল, দরজা খুলে দেখুন, সাব, ব্যাটাকে ধরেছি! কোনো ভয় নেই।
মুমুই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
সাপটাকে এখনো মেরে ফেলেনি হরিলাল। সাপের ঘাড় নেই, কিন্তু যেখানে ঘাড় থাকার কথা, সেরকম জায়গায় দু’খানা থান ইঁট চাপা দিয়েছে। সাপের ল্যাজের দিকটা ছটফট করে চটাস চটাস শব্দ করছে মাটিতে, আর মাথার দিকটায় হরিলাল লাঠি দিয়ে একটু একটু খোঁচাচ্ছে বলে ফোঁস ফোঁস শব্দ বেরুচ্ছে বেশ জোরে। এই দৃশ্য দেখে আমার গা শিরশির করে উঠল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলুম। হরিলাল জিজ্ঞেস করল, খতম করে দেব!
আমি বললুম, না, মেরো না!
মুমু বলল, হ্যাঁ, মারো। মেরে ফেলো।
হরিলাল তিন-চার ঘা জোর লাঠির ঘা দিয়ে থেঁতলে দিল মাথাটা। আমার বেশ খারাপ লাগল। সাপটা শেষ পর্যন্ত তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি।
আমি ফিসফিস করে বললুম, ইস, মেরে ফেললে!
হরিলাল বলল, দিদিমণি যে বলল। শালা, ঘরে ঢুকেছিল!
মুমু বলল, এরকম আর কটা আছে?
আমি চমকে গেলুম! এটা খুব দামি কথা বলেছে তো। এই সাপটাই আগের সাপটা কি না তা কে জানে? এটা যদি দ্বিতীয় সাপ হয়, তা হলে তৃতীয় এবং চতুর্থও থাকতে পারে। তারা রাত্তিরে দরজার তলা দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতে পারে ইচ্ছে করলেই।
তা হলে কোথায় শোওয়া নিরাপদ, ঘরের মধ্যে, না বাইরে?
হরিলাল বলল, খুব গরম পড়েছে তো, তাই শালারা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে!
আমি বললুম, কী রকম ঘর তৈরি করেছ হরিলাল, দরজার তলা দিয়ে সাপ ঢোকে?
হরিলাল কাঁচুমাচু করে বলল, এখনও পুরা তৈয়ারি হয়নি, সাব! আপনাদের আগে এই ঘরে কেউ থাকেনি রাত্তিরে। আমি ইঁট এনে চৌকাঠ বানিয়ে দিচ্ছি, খুব টাইট করে দিব, আর সাপ ঢুকতে পারবে না!
মরা সাপটা সে লাঠির ডগায় করে নিয়ে গেল। ফিরে এল কয়েকটা থান ইঁট নিয়ে।
জঙ্গল কেটে, পাহাড় কেটে মানুষ নিজেদের জন্য ঘরবাড়ি বানাচ্ছে। বেচারা সাপ আর জন্তু-জানোয়ারেরা যাবে কোথায়? এই সাপটা বুঝতেও পারল না, ও কোন দোষে মরল! অবশ্য মাস ছয়েকের মধ্যে যখন এই বাংলোটা সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যাবে, আরও ঘর হবে, অনেক আলো জ্বলবে, পাশের জঙ্গল সাফ হয়ে যাবে, গর্ত বুজবে, রোজ মানুষজনের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাবে, তখন সাপেরাও জেনে যাবে যে এই বাড়িতে যখন তখন এরকম ভাবে ঢোকা উচিত না!
এমন ভাবে ইটগুলো সাজিয়ে দিল হরিলাল যে একটুও ফাঁক রইল না। এরপর আর সাপ তো দূরের কথা, একটা টিকটিকিও ঢুকতে পারবে না।
হরিলালকে আমার মনে হলো যেন দেবতা। নেশা করে এলেও ওর কর্তব্যে একটুও ফাঁকি নেই, বরং কত উৎসাহ। আমার ডাকে যদি ও আজ না সাড়া দিত, তা হলে কী হতো আমাদের?
হরিলালের মতন একজন সাহসী, সৎ, বিশ্বাসী এবং কত রকমের কাজ জানা লোক একটা গেস্ট হাউসের নিছক চৌকিদার হয়ে সারাটা জীবন কাটাবে। আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি হরিলালকে মন্ত্রী করে দিতাম। এই সব লোক মন্ত্রী হলে সত্যিকারের দেশের কাজ হতে পারে। কিংবা, একবার মন্ত্রিত্ব পেলে হরিলালরা লালহরি হয়ে যায়?
আমি হরিলালের হাত জড়িয়ে ধরে বললুম, তুমি আজ আমাদের বাঁচালে! সে একটা বাচ্চার মতো লাজুক মুখ করে বলল, না-না, কী যে বলেন! আপনাদের কিছু হতো না। আমি একলা দরজা খুলে শুয়ে থাকি গরমে, কখনো তো সাপে কাটে না!
আমি জিজ্ঞেস করলুম, এদিকে কেউ সাপের কামড়ে মরেনি এ পর্যন্ত? হরিলাল দার্শনিক ভাবে বলল, হ্যাঁ, মরে, যার দিন ফুরিয়ে যায়। আজ এই সাপটারই মরার দিন ছিল!
দরজা বন্ধ করে আর একবার ভালো করে দেখে নিলুম। আর কোনো উপদ্রব হবার আশঙ্কা নেই মনে হয়।
মুমু শুয়ে পড়ে বলল, নীলকাকা, আলো নিভিয়ো না।
–কেন রে, তোর এখন ভয় করছে?
-ঘরের মধ্যে এখনো একটা ফোঁস শব্দ হচ্ছে মনে হচ্ছে!
—না রে না। আর কিছু নেই। আমি খুব ভালো করে দেখছি। বাথরুমের দরজাও বন্ধ।
—সাপটা দেখে ঘেন্না-ঘেন্না লাগছে। আচ্ছা, সাপ একবার কামড়ালেই মানুষ মরে যায়?
—হ্যাঁ, ওটা বেশ বিষাক্ত সাপ ছিল। তবে মানুষ দেখলেই যে সাপ ছুটে এসে কামড়ায় না তার আজ প্রমাণ পেলুম!
—আমাকে ঘুমের মধ্যে কামড়ে গেলে বেশ হতো!
—ছিঃ, ও কি কথা! হঠাৎ তোর এরকম ইচ্ছে হচ্ছে কেন?
আর কোনো উত্তর না দিয়ে মুমু চোখ বুজল। আমি বসে রইলুম আলো জ্বেলে, তখন সিগারেটটা খাওয়া হয়নি। আলো নিভিয়ে দেবার পর সাপটা ঘরে ঢুকলে যে কী হতো, তা ভেবে এখনও বুক কেঁপে উঠল একবার। বোকা সাপটা হয়তো চলে আসত শতরঞ্চির কাছে, ঘুমের মধ্যে ওর গায়ে আমাদের কারুর হাত পড়লেই দিত একখানা কামড়! মুমুই দরজার দিকে শুয়েছে। মুমু কেন ঐ কথা বলল? সত্যি সত্যি এই বয়েসে কারুর প্রেমে পড়েছে নাকি!
চোখ বুজে আছে, এখন মুমুর মুখে ফুটে উঠেছে সরল লাবণ্য। বয়েসের তুলনায় খানিকটা বড় দেখালেও আসলে তো ও একটা বালিকা। এখন ওর মুখে আর রাগ রাগ ভাবটা নেই। চোখ বুজে থাকলেই বুঝি মানুষের আসল রূপটা ফুটে ওঠে।
একটু বাদে মুমু চোখ খুলে বলল, নীলকাকা, আমার ঘুম আসছে না।
—ঘুমটা চটে গেছে। খাওয়ার সময় তুই চোখ খুলতে পারছিলি না, তারপর এই কাণ্ডটা হলো তো!
—ঘুমোবার সময় মা আমার মাথায় রোজ হাত বুলিয়ে দেয়!
—আমি বুলিয়ে দিলে হবে?
অল্পবয়েসিদের চুলে বেশ নরম সিল্ক সিল্ক ভাব থাকে। যে হাত বুলোয় তারও আরাম লাগে। নীপা বৌদি কোনো ঘুমপাড়ানি গান শোনান কিনা জানি না, আমার গলায় তো আর গান আসবে না।
মুমুর চোখের পাতা দু-একবার কাঁপল। তারপর দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে এলো। আমার বুকটা মুচড়ে উঠল। আহা, এই বয়েসি একটি মেয়ে আপন মনে কেন কাঁদে? কে ওকে দুঃখ দিয়েছে? সে কত বড় পাষণ্ড!
আমি ফিসফিস করে ডাকলুম, মুমু, মুমু, কী হয়েছে?
মুমু কোনো সাড়া দিল না। ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনে মনে হলো ঘুমিয়েই পড়েছে। ও কাঁদছে স্বপ্নের মধ্যে। থাক, ওকে জাগাবার দরকার নেই।
মুমুই আমাকে ঠেলে ঠেলে জাগিয়ে তুলল!
চমকে চোখ মেলে দেখি ঘরের দরজা, বাথরুমের দরজা সব খোলা। ঘরের মধ্যে প্রচুর রোদ্দুর। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, এখন কটা বাজে? আমার হাতে ঘড়ি থাকে না, মুমুরও ঘড়ি নেই।
কাল রাত্তিরে সাপ-টাপ নিয়ে বিরাট কাণ্ড কি সত্যিই হয়েছিল, না স্বপ্ন? দিনের আলোয় কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই
উঠে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বললুম, কী ব্যাপার, ইয়াং লেডি, এত তাড়াতাড়ি জেগে গেছ?
মুমু বলল, তাড়াতাড়ি? এর মধ্যে আমার চান করা হয়ে গেছে। কাল একটা সাপ ছিল এই শতরঞ্চির মধ্যে, সেখানে আমি শুয়েছি, এঃ, এমন ঘেন্না লাগছিল!
সাপের ব্যাপারটা তা হলে স্বপ্ন নয়!
আমি হাঁক দিলুম, হরিলাল, চা দাও!
মুমু জানাল যে হরিলাল এর মধ্যে একবার এসে বলে গেছে যে তার কাছে চা নেই। চা খেতে হলে বাস ডিপোতে যেতে হবে।
সকালবেলা চা না খেয়ে বাড়ির বাইরে বেরুনোটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। হরিলাল কেটলি করে চা আনতে পারবে না? অত দূর থেকে চা আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে? কুছ পরোয়া নেই, এখানে এনে আবার গরম করে দেবে! রাজভোগ চাইছি না, বেকন-ডিমসেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট চাইছি না, শুধু বিছানায় বসে একটু চা খাওয়ার বিলাসিতাও করতে পারব না?
হরিলাল আসতেই তাকে উদারভাবে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললুম, তিন-চার কাপ চা এনে দাও ভাইটি!
হরিলাল বলল, এখন তো যাওয়া যাবে না, সাব। অফিসের বাবুরা এক্ষুনি এসে পড়বেন। আমায় থাকতে হবে।
—তুমি আমাকে একটু চা খাওয়াবে না?
—আপনারা শতরঞ্চি গুটিয়ে নিন। যাদবলাল একবার এসে বলে গেছে। এই ঘর খালি করে দিতে হবে, বাবুরা এসে বসবেন।
কাল সন্ধে থেকে আমাদের কতরকমভাবে সেবা ও উপকার করেছে যে হরিলাল, এখন তার কথাবার্তা কেমন যেন শুকনো আর কাটা কাটা। সে আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলছে। চন্দনদা না ফিরলে আমরা যাব কোথায়?
এবারে একটু ভারিক্কি চাল নিয়ে আমাকে বলতে হলো, অফিসের বাবুরা আসুক, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলব। আমরা ঘোষালসাহেবের আত্মীয়! তিনি না ফেরা পর্যন্ত আমাদের এখানেই থাকতে হবে।
কথাটা হরিলালের ঠিক যেন পছন্দ হলো না। আমরা এক-দু’ দিনের চিড়িয়া, আমাদের তুলনায় সে এখানকার অফিসের বাবুদের বেশি খাতির করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই তার ডিউটি। কাল রাত্তিরে মহুয়ার নেশা করে সে একজন উদার হৃদয় মানুষ হয়ে গিয়েছিল, এখন সে নেহাতই একজন অল্প মাইনের চৌকিদার।
হরিলাল মুখ গোঁজ করে চলে গেল।
আমি মুমুকে বললুম, তা হলে কী করা যায় বল তো? আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলছে যে!
মুমু বলল, আমরা চলে যাব! জোর করে থাকব নাকি এই পচা জায়গায়? আমার বয়ে গেছে!
—বাবার সঙ্গে দেখা না করেই ফিরে যাবি? মানে, চন্দনদা না ফিরলে আমরা যাবই বা কী করে? দু’জনের ট্রেন ভাড়া নেই আমার কাছে।
—এবার বিনা টিকিটে যাব বললুম যে কাল? তুমি আগে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে নাও।
এইসব বলতে বলতেই একটা জিপ গাড়ির আওয়াজ হলো বাইরে। মুমু ছুটে গেল জানলার কাছে। তারপর সে বাইরেই চেয়ে রইল।
—কারা এল রে মুমু?
মুমু কোনো উত্তর দিল না, এদিকে মুখও ফেরাল না।
একটা জুতোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, সিঁড়ি, চাতাল, বারান্দা পার হয়ে এই দরজার দিকেই আসছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে চুলগুলোর মধ্যে একটু আঙুল চালিয়ে ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করলুম খানিকটা। অফিসবাবুটি আবার কেমন হবে কে জানে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন চন্দনদা!
ফিটফাট পোশাক, সাদা প্যান্টের ওপর মেরুন রঙের হাওয়াই শার্ট, পালিশ করা জুতো। হাতে একটা না-ধরানো চুরুট। চন্দনদা ধূমপান ছেড়ে দিচ্ছেন বলে প্রায় বছরখানেক ধরেই হাতে একটা চুরুট রাখেন সকাল থেকে, সেটা জ্বালেন সন্ধের পর, অর্থাৎ দিনে ঐ একটাই।
চন্দনদা বললেন, কী রে, নীলু, তুই হঠাৎ এদিকে এলি যে?
-এই চলে এলুম পাকেচক্রে। তুমি যে এখানে আছ এখন, তা তো জানতুমই না!
—আমি আজ ভোরের ট্রেনে ফিরেছি। আমার জন্য স্টেশনে গাড়ি গিয়েছিল। ফিরেই শুনি যে কে একজন বাবু এসেছে আমার খোঁজ করতে।
—তুমি হঠাৎ এখানে ট্রান্সফার নিয়ে এলে, চন্দনদা?
–কেন, এই জায়গাটা ভালো নয়? কাছাকাছি অনেক সুন্দর বেড়াবার জায়গা আছে। এসেছিস যখন, থেকে যাবি নাকি দু’-একদিন?
কী অদ্ভুত ব্যাপার, চন্দনদা কি মুমুকে দেখতে পাননি? নিজের আদরের মেয়েকে এখনো কিছু না বলে আমার সঙ্গেই কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমি বললুম, চন্দনদা, ঐ যে মুমু। কাল রাত্তিরে যা কাণ্ড হয়েছে…
আমাকে থামিয়ে দিয়ে চন্দনদা একটু ভেতরে এসে গম্ভীরভাবে বললেন, আমি কলকাতায় গিয়ে মুমুর স্কুলে দেখা করতে গেসলুম। মুমু স্কুলে যায়নি। স্কুল খোলা, তবু তোকে এখানে কে আসতে বলেছে মুমু? স্কুল ফাঁকি দেওয়া আমি একদম পছন্দ করি না!
মুমু মুখ ফিরিয়ে তীব্র গলায় বলল, আমি দেখতে এসেছি, তুমি বেঁচে আছ, না মরে গেছ! আমি তোমাকে আর দেখতে চাই না, চাই না, চাই না। কোনোদিন না!
তারপর ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে মুমু ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দনদা আমাকে বললেন, কোথায় গেল, একটু দ্যাখ তো নীলু। দৌড়ে গিয়ে ধর।