Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভালো করে এখনো ভোর হয়নি, মোটে সোয়া পাঁচটা বাজে। আকাশের রং ছানার জলের মতন, হাওয়া দিচ্ছে ঠাণ্ডা শিরশিরে। এরই মধ্যে কিছু কিছু লোক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, কেড্স পরে বুড়োরা ছুটছে, তিন-চারটি করে মেয়ে দল বেঁধে কলকল করে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, ওরা লোকের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। ঝাঁকামুটেরা নিয়ে যাচ্ছে বাজারের সবজি।

ঠিক করে রেখেছিলুম, রতনকে ডেকে বলব ট্যাক্সিটা বার করতে। কিন্তু ঠনঠন শব্দ করতে করতে একটা ট্রাম এসে গেল। এত ভোরে ট্রাম চলে?

মুমু আর আমি গিয়ে বসলুম একেবারে সামনের সিটে।

মুমুর চোখ-মুখে এখনও ঘুম লেগে আছে। একটা লাল রঙের ফ্রক পরেছে, কাঁধে ঝোলানো একটা এয়ারব্যাগ। আমি অবশ্য সঙ্গে কোনো ব্যাগ-ট্যাগ নিইনি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসেছি। আসবার সময় মাকেও জাগাইনি। শুধু আমাদের কাজের ছেলেটি উঠে পড়েছিল, একটা চিঠি লিখে দিয়ে এসেছি তার হাতে। রঘু সত্যিই কাজের ছেলে, ও সব ঠিক ঠিক মনে রাখে।

মুমু বলল, সকালবেলায় কলকাতা শহরটাকে পরিষ্কার দেখায় খুব!

আমি বললুম, ভোরে সবকিছুই সুন্দর দেখায়

মুমু বলল, রাস্তাটাও কত বড় মনে হচ্ছে?

আমি বললুম, অন্য সময় রাস্তায় এত মানুষ থাকে যে তার জন্যই সব রাস্তা ছোট হয়ে যায়। এরকম ফাঁকা রাস্তা তো আমরা কখনো দেখি না!

মুমু বলল, আমার যখন পাঁচ-ছ’ বছর বয়েস, তখন একবার এত ভোরে উঠে রেল স্টেশনে গিয়েছিলুম।

আমি বললুম, জীবনে কখনো এত ভোরে আমার ঘুম ভাঙে না।

মুমু বলল, তাহলে আজ উঠলে কী করে? তোমাকে তো ডাকতে হয়নি।

আমি বললুম, সারা রাত জেগে থেকেছি। আরও যতবার আমাকে এত ভোরে কোথাও যেতে হয়েছে, সারা রাত জেগেছি। আমার এক-একদিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে ভালো লাগে, আবার এক-একদিন সারা রাত জাগতেও ভালো লাগে।

এসপ্লানেডে এসে নেমে পড়লুম ট্রাম থেকে

হাওড়া কিংবা শিয়ালদা দিয়ে যাবার চেষ্টা না করাই ভালো। চন্দনদা-লালুদা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত হাসপাতাল-থানাপুলিশ করেছে। পুলিশ হয়তো হাওড়া—শিয়ালদায় নজর রাখতে পারে।

এসপ্লানেড থেকে অনেকগুলো দূরপাল্লার বাস ছাড়ে। এর মধ্যেই সেখানে অনেক যাত্রী এসে ভিড় করেছে।

প্রথম বাস ছাড়ছে দুর্গাপুরের। ঠিক আছে, দুর্গাপুরই সই। ভাগ্যের জোরে এবারেও সামনের দিকে একটা জোড়া সিট পাওয়া গেল।

মুমু জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আমি বললুম, বাঃ, নিরুদ্দেশে। তাই তো কথা আছে!

মুমু বেশ খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেখানেই যাব। এই ব্লু, বলো না, নিরুদ্দেশ কত দূর?

আমি বললুম, দূর আছে। নিরুদ্দেশ অনেক জায়গায় হয়। আমি তোকে দিকশূন্যপুর বলে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। খুব চমৎকার জায়গা, গিয়ে দেখবি!

—সেখানে কী আছে?

–সেখানে পাহাড় আছে, নদী আছে, জঙ্গল আছে, এসব তো আছেই। তাছাড়া সেখানে কেউ কারুর ওপর রাগ করে না, হুকুম চালায় না। সেখানে পয়সারও হিসেব রাখতে হয় না। কোনো দোকানও নেই।

—দোকান নেই? তাহলে জিনিসপত্র পাওয়া যায় কী করে?

-সেই তো মজা! দোকান নেই, অথচ সবই পাওয়া যায়। খুব যা দরকার, সেই সবই। তা বলে কি আর পাউডার, ক্রিম, চকোলেট এসব পাওয়া যাবে!

—চকোলেট পাওয়া যায় না?

—চকোলেট আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি যত ইচ্ছে। এত ভোরে তো দোকান খোলেনি। রাস্তায় কোনো জায়গা থেকে কিনে নেব।

—নিরুদ্দেশ মানে কি দা প্লেস অফ নো রিটার্ন?

—ইচ্ছে করলে ফিরেও আসা যেতে পারে। কেউ বারণ করবে না!

–তুমি সেই দিকশূন্যপুরে যাও, আবার ফিরে আস?

—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খুব যখন মন খারাপ হয়, তখন কারুকে কিছু না জানিয়ে টপ করে চলে যাই দিকশূন্যপুর। সেখানে সবাই আমাকে ভালোবাসে। আমাকে থেকে যেতে বলে।

—তবে তুমি সেখানে থেকে যাও না কেন?

—আমার যে পায়ের তলায় সরষে! নীললোহিতরা মুসাফির হয়। তারা এক জায়গায় থেমে থাকে না। মুসাফির কাকে বলে জানিস?

—হ্যাঁ, ট্রাভলার।

—ইটারনাল ট্রাভেলার বলতে পারিস। কোথাও বেশিদিন থেমে থাকলেই তাদের পা কুটকুট করে।

–আমিও মুসাফির হবো

—মুমু, তোর সামনের বুধবার থেকে পরীক্ষা। এবার বোধহয় পরীক্ষা দেওয়া হলো না।

—না হলো তো বয়েই গেল! ভারি তো কোয়ার্টার্লি টেস্ট! আমি আর পড়বই না। পড়ার বই একটাও আনিনি। শুধু গল্পের বই দুটো এনেছি মোটে। আচ্ছা, নীলকাকা, তোমার ঐ দিকশূন্যপুরে গল্পর বই পাওয়া যায়?

—হ্যাঁ পাওয়া যায়, সেজন্য চিন্তা নেই।

–দোকান নেই, তবু বই পাওয়া যাবে কী করে?

—সবাই নিজেদেরটা বদলাবদলি করে। যে-কোনো বাড়িতে গিয়ে চাইলেই তাদের পড়া বইটা দিয়ে দেয়।

হাওড়া ব্রীজ পার হবার সময় আমি পকেট থেকে একটা দশ পয়সা বার করে খুব জোরে ছুঁড়ে দিলুম গঙ্গায়।

মুমু জিজ্ঞেস করল, তুমি পয়সা জলে ছুঁড়লে কেন?

আমি বললুম, মুসাফিরদের দিতে হয়। নদীর সঙ্গে মুসাফিরদের বন্ধুত্ব। একদিন কোনো একটা নদীতে ডুব দিলে হয়তো এই পয়সাটা খুঁজে পেয়ে যাব।

মুমু বলল, তা হলে আমিও পয়সা ফেলব। আমায় দশ পয়সা দাও!

—তোর নিজের পয়সা নেই? অন্যের পয়সা ছুঁড়লে কোনো লাভ হয় না!

মুমু তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট ব্যাগ বার করল তারপর অপরাধীর মতন হেসে বলল, আমার মোটে পাঁচ টাকা আছে। এর মধ্যে আর জমেনি। মোটে এই কটা টাকা দিয়ে নিরুদ্দেশে যাওয়া যাবে?

আমি বললুম, দে, তোর ঐ পাঁচ টাকা আমি ভাঙিয়ে দিচ্ছি। দিকশূন্যপুরে একবার পৌঁছে গেলে আর পয়সাই লাগবে না। শুধু এই বাসভাড়াটাই যা লাগছে, সে আমার কাছে আছে।

সত্যি, এবার আমার কাছে প্রায় আড়াইশো টাকা আছে। অনেক টাকা।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁরে মুমু, তুই যে পাইপ বেয়ে নামলি বারান্দা থেকে, তোর ভয় করল না?

মুমু বলল, ভয় করবে কেন? ওপরতলায় পাপুদা আর রিন্টুদার সঙ্গে আমি আগে দু’তিনবার নেমেছি! স-র-র-র-র করে! একটুও ভয় লাগে না!

—রাত আটটা সাড়ে আটটায় রাস্তায় কত লোক থাকে। তোকে কেউ দেখতে পায়নি? দেখতে পেলে চোর বলে ঠ্যাঙাত!

—আমি দেখে নিয়েছিলুম, কখন লোক নেই। তাও নেমে আসতেই দেখি একটা বুড়ো লোক হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেই নীচে এসেছি, বুড়োটা বলল, এই খুকি, কী করছ? আমি বললুম, বেশ করেছি! বুড়োটা বলল, ঘোর কলি, ঘোর কলি! ততক্ষণে আমি এক দৌড়ে রাস্তার ওপারে!

–তোর মেয়ে না হয়ে ছেলে হওয়াই উচিত ছিল। ভুল করে মেয়ে হয়েছিস। একেবারে টম বয়!

—নীলকাকা, ঘোর কলি মানে কী?

—কলি হচ্ছে কলিকাল। শাস্ত্রে নাকি আছে, আমি অবশ্য পড়িনি, আমি তো আর সংস্কৃত জানি না, ঐসব খটোমটো বইয়ের অনুবাদও পড়তে ইচ্ছে করে না, তবে কার মুখে যেন শুনেছি, এখনকার সময়টাকে বলে কলিকাল, এই কালে মেয়েরা ছেলেদের মতন পোশাক পরবে আর মাথার চুল ছোট করে কেটে ফেলবে। দেখতেই পাচ্ছিস, সেটা মিলে গেছে, অনেক মেয়েই জিনস পরে আর মাথার চুল ছেঁটে ফেলে। বোধহয় মেয়েদের জলের পাইপ বেয়ে নামার কথাও শাস্ত্রে লেখা আছে!

—মেয়েরা যে সিগারেট খায়, সে-কথা লেখা আছে?

–আগেকার দিনেও গ্রামের, মেয়েরা হুঁকো খেত। ওটা বোধহয় দোষের নয়!

—বর আর বউ ঝগড়া করে যে ডিভোর্স করে, সেটা?

—আগেকার দিনে কী ছিল জানিস? এক-একজন লোক চারটে-ছটা-দশটা বিয়ে করত! কোনো বউ একটু ঝগড়া করতে এলেই তাকে চাবুক দিয়ে পেটাত! তবু মেয়েদের ডিভোর্স করার উপায় ছিল না। সেটা কি ভালো? তুই যদি সেই যুগে জন্মাতি, এতদিনে তোর বিয়ে হয়ে যেত!

-আমায় মারতে এলে আমিও মারতুম। ছেড়ে দিতুম নাকি?

রাস্তার দু’ ধারে জল জমে আছে। বৃষ্টিতে বেশ কয়েকদিন ধুয়ে যাবার পর বোঝা যায়, সব গাছপালার রঙই একরকম সবুজ নয়। সবুজেরও কত বৈচিত্র্য এদিকে বোধহয় কাল রাতে ঝড় উঠেছিল। একটা মস্ত বড় শিমুল গাছ উল্টে পড়ে আছে এক জায়গায়।

মুমুর সঙ্গে নানারকম গল্প করতে করতে পথ আর সময় কেটে যেতে লাগল হু হু করে। দুর্গাপুরে পৌঁছে গেলুম এগারোটার মধ্যে।

বাস থেকে নেমে মুমু বলল, এইটা নিরুদ্দেশ? সব দিকে এত বাড়িঘর?

আমি বললুম, না রে, আরও বাস বদলাতে হবে, আরও অনেক দূরে যেতে হবে। চল, আগে কিছু খেয়ে নিই। তোর খিদে পায়নি?

কাল রাতে মুমু এক গেলাশ দুধ ছাড়া কিছুই খায়নি। মা ভাত খাবার জন্য জোর করেছিল, কিন্তু মুমুর কিছুতেই খেতে ইচ্ছে হয়নি, এক গেরাশ ভাত মুখে দিয়েই সে বমির মতন ওয়াক তুলেছিল। মনের ওপর খুব চাপ পড়লে খিদে নষ্ট হয়ে যায়। মুমুর ক্ষুদ্র হৃদয়ে কম চাপ পড়েনি।

আমার কাছে মুমু তার বাবা আর মা সম্পর্কে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলছিল। আমি ওকে সাবধান করে দিয়েছিলুম আমার মাকে কিছু না জানাতে। মায়ের কাছেই ওকে শুতে হবে। সবচেয়ে ভালো, ঘুমের ভান করে এক্ষুনি শুয়ে পড়া। মুমু তার বদলে আমার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল, ওর বাবা—মা এসে পড়লে আমি যাতে কিছুতেই ধরিয়ে না দিই!

চন্দনদা-লালুদারা মুমুকে বহু জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছে, কিন্তু আমার বাড়িতে খোঁজ নেওয়ার কথা ওদের মনে আসেনি। মাকে বুঝিয়েছিলুম যে মুমু ইস্কুলের মেয়েদের সঙ্গে একটা গার্ল গাইডের ক্যাম্পে যাচ্ছে, ভোরবেলা তাকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেবার ভার আমার ওপরে দিয়েছে চন্দনদা আর নীপাবৌদি, সেইজন্যই মুমু রাত্তিরটা আমাদের এখানে থাকতে এসেছে। মুমুকে নিয়ে আমি কলকাতা ছেড়ে পালাব, মা কি তা কল্পনাও করতে পারে? মার চোখে তো মুমু ‘এক ফোঁটা’ মেয়ে!

ঐরকম বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুমুর পালানোই উচিত। মুমুকে সাহায্য করতে আমার একটুও দ্বিধা হয়নি। ওদের ভালোমতন শিক্ষা হওয়া দরকার।

ব্যাসস্ট্যাণ্ড থেকে বেরিয়ে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় বসলুম। মেঘলা মেঘলা দিন, একটুও গরম নেই, বেড়াবার পক্ষে চমৎকার।

টোস্ট, ডবল ডিমের ওমলেট আর এক টুকরো করে কেক খাওয়া হলো। লালুদার দেওয়া টাকাগুলো সৎ কাজেই খরচ হচ্ছে।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কেনা হলো গোটা সাতেক চকোলেট বার, পাঁচ শো গ্রাম টফি, এক প্যাকেট নোনতা বিস্কুট। শস্তায় আপেল পাওয়া যাচ্ছে, তাই এক কিলো আপেল কিনতেও দ্বিধা হলো না। রীতিমতন পিকনিকের বাজার।

উঠে পড়লুম আর একখানা বাসে। দিনের আলোয় ভারতবর্ষের কি আর কোনো বাস খালি থাকে! মুমুর জন্য অতিকষ্টে একটা জায়গা পাওয়া গেল, আমি দাঁড়ালুম তার পাশে। এইমাত্র অত কিছু খেয়েও মুমু একটা চকোলেটের রাংতা ছাড়িয়ে কামড় দিল। আজ তার মন ভালো আছে। তাই তার খিদেও বেশি। অবশ্য চকোলেট খাবার জন্য খিদের দরকার হয় না।

মুমু তার পাশের মহিলাটির দিকে বক্রভাবে তাকাচ্ছে। তিনি নেমে গেলে আমি সেখানে বসতে পারি। কিন্তু সেই মোটাসোটা মহিলাটির নামবার কোনো লক্ষণও নেই, তিন চতুর্থাংশ জায়গা জুড়ে তিনি গ্যাঁট হয়ে বসেছেন।

যে-বাসে অনেক লোক দাঁড়িয়ে যায়, সে বাসে গোলমালও বেশি হয়। এখন আর মুমুর সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। মাঝে মাঝে চোখে চোখে কথা হচ্ছে।

এই বাসটা থেমে গেল বাঁকুড়া শহরে এসে।

আমি বললুম, এবারে আর একখানা বাসে উঠতে হবে। মুমু তাতে বেশ খুশি। গতির ছোঁয়া লেগেছে ওর। তাছাড়া কলকাতা থেকে যে অনেক দূরে চলে যাওয়া হচ্ছে, সেটাই ওর ভালো লাগছে।

এবারের বাসটি ভাঙা ঝড়ঝড়ে, তাতে আগে থেকেই গাদাগাদি করে লোক উঠে বসে-দাঁড়িয়ে আছে। পরের বাস ছাড়বে দু’ ঘণ্টা বাদে, সুতরাং এটাতেই চড়তে হলো। এবারে মুমুও বসবার জায়গা পেল না।

আমি হ্যাণ্ডেল ধরে দাঁড়ালুম, মুমু ধরে রইল আমার কাঁধ। বাসটা চলতে শুরু করার পর মুমু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, নীলকাকা, এত লোক কোথায় যাচ্ছে? এরা কি সবাই নিরুদ্দেশে যাবে?

আমি বললুম, পাগল নাকি? নিরুদ্দেশে কি বাসে করে পৌঁছনো যায়? আমরা মাঝপথে এক জায়গায় নেমে পড়ব, তারপর হাঁটতে হবে অনেকটা। তুই হাঁটতে পারবি তো?

মুমু বলল, তোমার থেকে বেশি পারব!

ভাঙা রাস্তায় বাসটা লাফাতে লাফাতে চলেছে। আমার খালি একটাই ভয়, হঠাৎ চেনাশুনো কারুর সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়। এইসব অঞ্চলে আমি বহুবার এসেছি, অনেকের সঙ্গেই সাময়িক আলাপ হয়েছে।

এক-এক জায়গায় বাস থামছে, আর আমি নিচু হয়ে দেখছি। ঠিক জায়গাটা না পেরিয়ে চলে যায়।

ঠিক যা ভয় করছিলুম তাই হলো। একবার বাসটা সামনের একটা গরুকে বাঁচাতে আচমকা ব্রেক কষতেই আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লুম সামনের একটা লোকের ওপরে। তার পা মাড়িয়ে দিতে হলো বাধ্য হয়েই। লোকটি আমাকে গালাগাল দেবার জন্য রাগত মুখখানা ফিরিয়েই চোখ বড় বড় করে বলল, আরে, নীলুবাবু? এদিকে কোথায় চললেন?

এইরে, মুজিবুর রহমান, এখানকার একটা প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার। একবার এদিকে এসে ওর বাড়িতে এক রাত কাটিয়ে ছিলুম। খুবই যত্ন-টত্ন করেছিল সেবার।

আমি মুমুর হাতে চিমটি কেটে ইঙ্গিত করলুম, সে যেন আমার গা-টা ছেড়ে দেয়। সে আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তা যেন এই লোকটি বুঝতে না পারে।

মুমুর বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সে শুধু আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল না, সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল বাসের সামনের দরজার দিকে।

মুজিবর রহমান মুসলমানদের মধ্যে একটা বহু প্রচলিত নাম। আমি এই নামের আরও দু’জনকে প্রত্যক্ষভাবে চিনি। এই রহমান সাহেবকে তার সহকর্মীরা অনেক সময় বঙ্গবন্ধু বলে ডাকে।

আমি রহমান সাহেবের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললুম, আরে, কেমন আছেন? ভাবী আর ছেলেমেয়েরা সব ভালো তো?

রহমান সাহেব বলল, বেশ লোক আপনি! গত শীতে আমার ওখানে আপনার আসার কথা ছিল না?

আমি পাল্টা অভিযোগ করে বললুম, আর আপনি যে বলেছিলেন, কলকাতায় গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন? ঠিকানা-টিকানা সব দিয়েছিলুম!

রহমান সাহেব লজ্জিত হয়ে বলল, কলকাতায় গেলে ঠিক দিশা পাই না। এমন ভাবে ঘাড়ের উপর দিয়ে ট্রাম-বাস যায়। রাস্তায় হাঁটতে ভয় হয়। অত ভিড়ের মধ্যে আপনারা থাকেন কী করে?

আমি বললুম, সেই জন্য তো আপনাদের এদিকে ফাঁকার মধ্যে প্রায়ই চলে আসি!

—চলেন, আমাদের বাড়িতে থাকবেন তো? আমার ছোট ছেলেটা প্রায়ই আপনার কথা বলে। আপনি তার সাথে লুডো খেলেছিলেন।

—নিশ্চয়ই আপনার বাড়িতে যাব। তবে এখন না। এদিকে একটা ইস্কুলে আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি। যদি পেয়ে যাই, তাহলে তো আপনাদের কাছাকাছিই থাকব।

—কোন্ ইস্কুলে!

—পাথরচাপা সুরেন্দ্রমোহিনী। তার আগে সেই স্কুল কমিটির একজন মেম্বারকে একটু ধরাধরি করতে হবে। এখানকার এম এল এ-র কাছ থেকে একটা চিঠি জোগাড় করেছি।

আর তিনটি স্টপ পর্যন্ত এরকম অনর্গল বানিয়ে গেলুম। মাঝে মাঝে মুমুর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হচ্ছে। পরের বার বাসটা থামবার উপক্রম করতেই আমি বেশ চেঁচিয়ে বললুম, রোককে, রোককে! কণ্ডাকটারদাদা, এখানে নামব!

মুমুও অন্য দরজা দিয়ে ঠিক নেমে পড়েছে। প্রয়োজন হলে এইটুকু মেয়েও কত কিছু শিখে যায়। সে আমাকে না চেনার ভান করে এগোতে লাগল সামনের দিকে। আমি রহমান সাহেবকে হাত নেড়ে টা-টা করলুম। তারপর রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়লুম মাঠের মধ্যে।

মুমু কোনাকুনি দৌড়ে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলল, এবার এই দিকে নিরুদ্দেশ?

আমি বললুম, এইবারই তো শুরু হবে মজা! ঐ বিচ্ছিরি বাসে করে যেতে তোর ভালো লাগছিল?

মুমু বলল, ঐ দ্যাখো দূরে একটা পাহাড়। ঐ পাহাড় পেরুলেই কি দিকশূন্যপুর!

আমি বললুম, না রে, দিকশূন্যপুর আরও অনেক দূরে। চল, ঐ পাহাড়টার কাছে আগে যাই। ওখানেই কয়েকদিন থেকে গেলে কেমন হয়?

মুমু বলল, খুব ভালো হয়। ওখানে ঝরনা আছে!

আমি বললুম, হ্যাঁ, ঝরনা আছে। একজন সাধুর আশ্রম আছে। দু’একটা ক্যাম্পও আছে। মুমু, তুই সাঁতার জানিস?

মুমু ঘাড় নেড়ে বলল, না তো!

আমি বললুম, দিকশূন্যপুর যেতে হলে দু’তিনটে পাহাড় ডিঙোতে হবে, সাঁতার কেটে একটা নদী পার হতে হবে। এসব না শিখলে তো সেখানে যাওয়া যাবে না!

—অ্যাই ব্লু, তুমি এসব কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?

—বাঃ। এই পাহাড়ের কাছে থাকাটাও তো নিরুদ্দেশ। বলেছি না, নিরুদ্দেশ অনেক রকম হয়! আগে তুই পাহাড়ে চড়া শিখবি, সাঁতার শিখবি, সেটাও কত মজার।

—পাহাড়ের কাছে গিয়ে আমরা কোথায় থাকব? যখন বৃষ্টি পড়বে?

—তাঁবুতে থাকব। সে ব্যবস্থা করা যাবে। তুই কখনো তাঁবুতে থেকেছিস? কী দারুণ ভালো লাগে। রাত্তির বেলা শুয়ে শুয়ে মাটির তলায় গুমগুম শব্দ শোনা যায়! তাঁবুর গায়ে যখন বৃষ্টি পড়ে, তখন ঠিক মনে হয়, কেউ যেন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, এই পাহাড়ে অনেক ময়ূর আছে। ভোরবেলা ময়ূরের ডাক শুনে ঘুম ভাঙবে।

-ময়ূর দেখতে পাওয়া যায়?

—হ্যাঁ। এখন বর্ষার সময় তো, হঠাৎ দেখতে পাবি, ময়ূর পেখম মেলে নাচছে। যেরকম ঠিক ছবিতে দেখা যায়। জঙ্গলে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ দু’ একটা হরিণও দেখে ফেলতে পারিস। এই জঙ্গলে অবশ্য বাঘ নেই।

–কেন, বাঘ নেই কেন?

—একটাই মোটে বাঘ ছিল। ঝরনার কাছে যে সাধুজী থাকেন, তিনি সেই বাঘটাকে পোষ মানিয়েছিলেন। আমি দেখেছি সেই বাঘটাকে। তারপর কি হলো জানিস, একবার একটা সার্কাস পার্টি এসে সেই বাঘটাকে চুরি করে নিয়ে গেল। কী দুঃখের কথা বল তো!

মুমু তার ঝোলা থেকে আর একটা চকোলেট বার করে আধখানা ভেঙে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, তুমি খাও!

আজ ভোর থেকে এ পর্যন্ত মুমু একটাও খারাপ কথা বলেনি। উৎসাহে—আনন্দে তার মুখখানি ঝলমল করছে।

আরও কিছুটা এগোবার পর মুমু জিজ্ঞেস করল, নীলকাকা, এই পাহাড়টার নাম কী? এর নাম নেই?

আমি বললুম, হ্যাঁ। এর নাম শুশুনিয়া। এখানে কত অ্যাডভেঞ্চার করা যায়। অনেক আগে এখানে একটা রাজ্যের রাজধানী ছিল। এখন এখানে মাউন্টেনীয়ারিং ট্রেইনিং হয়। তুই পাহাড়ে চড়া শিখবি বলেছিলি!

–তুমি আর আমি এক তাঁবুতে থাকব?

–না, তা বোধহয় হবে না রে!

—যদি তাঁবুর মধ্যে সাপ আসে?

—ধ্যাৎ, এখানে সাপ কোথায়? তাঁবু যেখানে খাটানো হয়, তার চারপাশে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে রাখে। সাপ নেই, ব্যাঙ নেই, আরশোলা নেই, মাকড়সা নেই। তবে প্রজাপতি আছে। আর কত টিয়াপাখি!

পাহাড়ের বাঁ দিকে এগোতেই এক জায়গায় দেখা গেল পর পর সাত আটটি তাঁবু। রোহিণী সেনগুপ্তকে খুঁজতে হলো না, সে একদল কিশোরী মেয়েকে নিয়ে ভলিবল খেলছে। সে পরে আছে জিনসের ওপর হলুদ রঙের জামা, কী স্মার্ট দেখাচ্ছে তাকে। যদিও গায়ের রং মাজা মাজা। তবু তাকে মনে হচ্ছে মেমসাহেবের মতন!

আমাদের দেখতে পেয়ে রোহিণী নিজেই খেলা থামিয়ে এগিয়ে এল। অনেকখানি কৌতূহল নিয়ে সে বলল, কী ব্যাপার, আপনারা?

আমি মুচকি হেসে বললুম, দেখুন, ঠিক পৌঁছে গেছি! মুমুকে আপনার এখানে ভর্তি করে নিতে হবে!

রোহিণী বলল, দেখেছ কাণ্ড! এরকম হঠাৎ কেউ আসে? আগে থেকে খবর দেননি? আমাদের এখানে মাত্র আঠেরোটি মেয়েকে ট্রেইনিং দেওয়ার কোটা। সব যে ভর্তি হয়ে গেছে।

আমি বললুম, তাতে কী হয়েছে? আঠেরোর জায়গায় উনিশ হলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না! আপনার যদি মুমুর মতন একটা মেয়ে থাকত কিংবা ছোট বোন থাকত, আপনি তাকে সঙ্গে আনতে পারতেন না?

রোহিণী মুমুর কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলল, আপনি কি পাগল? হঠাৎ চলে এলেন? নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন যে আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না। এত মিষ্টি মেয়ে। কী মুমু, তুমি এখানে থাকলে তোমার বাবা-মা আপত্তি করবেন না? আমি উত্তর দেবার আগেই মুমু জোর দিয়ে বলল, না! আমি পাহাড়ে চড়া শিখব!

রোহিণী বলল, চটি পরে এসেছ। পাহাড়ে ওঠার ট্রেইনিং নিতে গেলে স্পেশাল জুতো লাগে। এখানে জুতো কোথায় পাব? সেই বাঁকুড়ায় লোক পাঠাতে হবে।

আমি বললুম, আহা, এখানে আঠেরোটা মেয়ে রয়েছে, তাদের কারুর কাছে একস্ট্রা জুতো নেই? ইচ্ছে থাকলে সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে যায়! আর যদি বলেন তো বাঁকুড়া থেকে আমি জুতো কিনে আনছি!

রোহিণী হেসে বলল, ইচ্ছে থাকলে সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে যায়, তাই না? দাঁড়ান, একটু টেস্ট নিই। এই আরতি, একটা স্কিপিং লাইন নিয়ে এসো তো!

আরতি নামে অন্য একটি মেয়ে স্কিপিং-এর দড়ি নিয়ে এল। রোহিণী সেটার এক দিক ধরে বলল, মুমু, চটিটা খুলে লাফাও! আমরা কিন্তু দড়িটা মাঝে মাঝে উঁচু করব, সেই বুঝে তোমাকে লাফাতে হবে।

গুনে গুনে পঞ্চাশবার নির্ভুলভাবে লাফাল মুমু।

রোহিণী বলল, ঠিক আছে। আর একটা টেস্ট আছে।

পকেট থেকে সে একটা স্টপ ওয়াচ বার করে বলল, মুমু, ঐ যে দূরের বড় শাল গাছটা দেখছ, ঐ পর্যন্ত দৌড়ে যাবে, গাছটা ছুঁয়েই ফিরে আসবে। যত পার জোরে ছুটবে কিন্তু। আমি টাইমিং দেখব।

মুমু দৌড় লাগাতেই আমি রোহিণীকে বললুম, ও বাড়ির জলের পাইপ বেয়ে ছাদ থেকে নীচে নামতে পারে। ও পাহাড়েও উঠতে পারবে।

রোহিণী বলল, তাই নাকি? ছোটবেলায় আমারও এইরকম স্বভাব ছিল। চন্দননগরে থাকার সময় আমি বড় বড় গাছে চড়ে বসে থাকতুম!

ফিরে আসার সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে মুমু আছাড় খেয়ে পড়ে গেল আমাদের পায়ের কাছে এসে। আমি তাকে তুলতে যেতেই রোহিণী বলল, উঁহু, ওকে ধরবেন না। এমন কিছু হয়নি, শুধু একটু হাঁটু ছড়ে গেছে। পাহাড়ে চড়তে গেলে ওরকম অনেকবার হবে। এক্সেলেন্ট টাইমিং। ভেরি গুড, মুমু! ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। আজ তিনটের সময়েই একটা ওপরে ওঠার ট্রেইনিং আছে, তুমি তাতে যোগ দেবে, রেডি হও! আরতি, ওকে নিয়ে যাও তো আমার টেণ্টে।

আমার দিকে ফিরে রোহিণী বলল, আপনি এখন কী করবেন? এদিককার লাস্ট বাস সাড়ে চারটের সময়।

আমি বললুম, আপনার এখানে চাকর কিংবা দারোয়ান হিসেবে আমি থেকে যেতে পারি না? আমি রান্নাও করতে পারি।

রোহিণী মাথা নেড়ে বলল, না, আপনার থাকা চলবে না। আমরা ছেলেদের কোনো সাহায্য নিই না। আপনি ইচ্ছে করলে মুকুটমণিপুর কিংবা বাঁকুড়ায় গিয়ে থাকতে পারেন। রোজ একবার করে দেখে যাবেন। কিংবা, তার দরকার কী? মুমু, এখানে তোমার বয়েসী এত মেয়ে আছে, সবাই মিলে থাকবে, দেখো, একটুও হোমসিক ফিল করবে না। সাতটা দিন থাকতে পারবে না?

মুমু বলল, হ্যাঁ পারব!

আমি বললুম, তা হলে মুমু, তোকে আমি সাতদিন পরে নিয়ে যাব! তারপর রোহিণীকে বললুম, ওর ট্রেইনিং-এর জন্য কত খরচ লাগবে? আমি

কিন্তু দেড়শো টাকার বেশি দিতে পারছি না আপাতত

রোহিণী বলল, এখন কিছু দিতে হবে না। সব ধার রইল।

আমি বললুম, আপনার ধার কোনোদিন শোধ করা যাবে কি?

রোহিণী বলল, আর তো সময় নেই। এক্ষুনি সবাইকে লাইন আপ করাতে হবে। মুমু ঠিক থাকবে, কিছু চিন্তা করবেন না।

আমি মুমুকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললুম, এটাও কিন্তু নিরুদ্দেশ। তোর ভালো লাগছে তো? কত নতুন বন্ধু হবে। পাহাড়ে চড়া শিখে যাবি। তারপর একদিন এভারেস্টেও উঠে যেতে পারিস।

মুমু টলটলে চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ।

তারপর আমার ঠোটে একটা আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, ব্লু, ঠিক সাত বছর বাদে। আই প্রমিস! তুমি যেন তখন ভুলে যেও না!

পাহাড় থেকে আমি নেমে এলুম লাল ধুলোর রাস্তায়। এখানে কিছু নতুন শাল গাছ পোঁতা হয়েছে। কচি কচি পাতাগুলোকে কিশোর কিশোরীদের মুখের লাবণ্যের মতন মনে হয়। এখন আকাশে ঝকঝক করছে রোদ। এদিকে বৃষ্টি হয়নি তেমন।

মাঠ ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে আমি এগোলুম বড় রাস্তার দিকে। ফেরার বাস আসতে অনেক দেরি আছে, তাড়া নেই কিছু! এবার আমি কোথায় যাব? দিকশূন্যপুরে একবার ঘুরে এলে হয়। দিকশূন্যপুর মাঝে মাঝেই আমাকে হাতছানি দেয়। বন্দনাদি, রোহিলা, সেই আর্টিস্ট…

মুমুকে দিকশূন্যপুরে নিয়ে যাওয়াটা উচিত হতো না। যদি মুমু আর ফিরতে না চাইত সেখান থেকে? না, চন্দনদা আর নীপাবৌদিকে এত কঠিন শাস্তি দেওয়া যায় না।

বড় রাস্তার কাছাকাছি এসে একটা মস্ত বড় ছাতার মতন কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে একখণ্ড পাথরের উপরে বসলুম আমি। এই রকম মাঠের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকাটা আমার বড্ড মোহময় লাগে। আমার হাতে এত সময়, তবু আমার সময় কাটাবার কোনো সমস্যা নেই। গাছতলায় একাকী বসলে গাছের সঙ্গেও কত কথা বলা যায়।

মুমুর মুখটা মনে পড়ছে বারবার। আমি সেটা মন থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। আমি মুসাফির, এত মায়া ভালো নয়। মুমু এখানে ভালোই থাকবে। আমি একটা ঝুঁকি নিয়ে মুমুকে এখানে এনেছিলুম, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই পরিবেশ, এক সঙ্গে প্রায় সমবয়েসি এতগুলো মেয়ের সঙ্গে থাকাটা মুমুর পছন্দ হয়ে যাবে। রোহিণীকে তো সে আগেই পছন্দ করেছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে বাঁকুড়ার দিক থেকে ধুলো উড়িয়ে এল একটা জিপ প্রচণ্ড স্পীডে। খানিকটা দূরে থেমে গেল। ড্রাইভারটা মুখ ঝুঁকিয়ে পথচলতি একজন সাঁওতালকে জিজ্ঞেস করল পাহাড়ের দিকের রাস্তা।

আমি উঠে চট করে লুকোলাম গাছের আড়ালে। এত তাড়াতাড়ি ওরা পৌঁছে গেল! রঘু তাহলে খুব সকাল সকাল চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে।

জিপের স্টিয়ারিং-এ বসে আছে তপনদা। তার পাশে চন্দনদা। পেছনে নীপাবৌদি আর লালুদা।

রোহিণী কি এখন ছাড়বে মুমুকে? মুমু কোর্স শেষ না করে ফিরে আসতে চাইবে? সে ওদের ব্যাপার, এবার ওরা বুঝে নিক। আমি আর ওসব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে থাকতে চাই না। আমি দিকশূন্যপুরে চলে যাব, এখন বেশ কিছুদিন আমার পাত্তাই পাবে না চন্দনদারা!

মুমু এখন পাহাড়ে উঠছে। আশা করি আর কোনোদিন ও বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে চাইবে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 10 of 10 ): « পূর্ববর্তী1 ... 89 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress