Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মিনুর কাকিমা শরৎকে প্রায়ই বেরুতে দেন না৷ আজ তিনি যাবেন মিছরিপোখরায় তাঁর বন্ধুর বাড়ি, শরৎকে বাড়ি আগলে বসে থাকতে হবে, কাল তিনি লকসাতে মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, শরৎ ছেলেমেয়ে সামলে বাড়ি বসে থাকবে৷

একদিন মিনুর কাকিমা বললে, পটলের বউয়ের ওখানে অত ঘন ঘন যাও কেন?

—কেন?

—আমি পছন্দ করি নে৷ ওরা গরিব লোক, আমাদের ভাড়াটে, অত মাখামাখি করা ভালো না৷

—আমি মিশি, আমিও তো গরিব লোক৷ এতে আর দোষ কি বলুন?

—তুমি বড় মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করেছ দেখছি৷ পটলের বউ মেয়ে ভালো নয়—তুমি জানো কিছু?

শরৎ এতদিন মিনুর কাকিমার কোনো কথার প্রতিবাদ না করে নীরবে সব কাজ করে এসেছে, কিন্তু অন্ধ রেণুকার নামে কটু কথা সে সহ্য করতে পারলে না৷ বললে—আমি যতদূর দেখেছি কোনো বেচাল তো দেখি নি৷ আমি যদি যাই, আপনাকে তাতে কেউ কিছু বলবে না তো!

—না, আমি চাই আমার বাড়ির চাকরবাকর আমার কথা শুনবে—যাও, রান্নাঘরের দিকে দ্যাখো গে—

শরৎ মাথা নামিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল৷ সেখানে গিয়েই সে ক্ষুণ্ণ অভিমানে কেঁদে ফেললে৷ আজ সে এ কথার জবাব দিত মিনুর কাকিমার, একবার ভেবেছিল দিয়েই দেবে উত্তর, যা থাকে ভাগ্যে৷

তবে মুখে জবাব না দিলেও কাজে সে দেখালে, মিনুর কাকিমার অসঙ্গত হুকুম সে মানতে রাজি নয়৷ রেণুকার বাড়ি সেই দিনই বিকেলের দিকে সে আবার গেল৷

রেণুকা ওকে পেয়ে সত্যিই বড় খুশি হয়৷ বললে—ভাই, আজ চলো আমরা নতুন কোনো জায়গায় যাই৷

—কোথায় যাবে?

—আমি রাস্তাঘাট চিনি নে, তুমি বাঙালীটোলায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে?

—কেন পারব না, চলো৷

—ছ’ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি—জিজ্ঞেস করে চলো যাওয়া যাক৷

একে ওকে জিজ্ঞেস করে ওরা ধ্রুবেশ্বরের গলিতে নির্দিষ্ট বাসায় পৌঁছলো৷ তারাও খুব বড়লোক নয়, ছোট দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রী, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে৷ বাড়ি অনেক দিন আগে ছিল ঢাকা জেলায় কি এক পাড়াগাঁয়ে, বাড়ির কর্তা বেনারস মিউনিসিপ্যালিটির কেরানি, সেই উপলক্ষে এখানে বাস৷

বাড়ির গিন্নির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ তিনি ওদের যত্ন করে বসালেন, চা করে খেতে দিলেন৷

তাদের বাড়িতে একটি চার-পাঁচ বছরের খোকা আছে, নাম কালো৷ দেখতে কি চমৎকার, যেমন গায়ের রং, তেমনি মুখশ্রী, সোনালি চুল, চাঁচাছোলা গড়ন৷

শরৎ বললে, এমন সুন্দর ছেলের নাম কালো রাখলেন কেন?

গিন্নি হেসে বললেন, আমার শ্বশুরের দেওয়া নাম৷ তাঁর প্রথম ছেলে মারা যায়, নাম ছিল ওই৷ তিনিই জোর করে কালো নাম রেখেছেন৷

প্রথম দর্শনেই খোকাকে শরৎ ভালোবেসে ফেললে৷

বললে, এসো খোকা, আসবে?

খোকা অমনি বিনা দ্বিধায় শরতের কাছে এসে বসলো৷

শরৎ বললে, আমি কে হই বলো তো খোকন?

খোকা হেসে শরতের মুখের দিকে চোখ তুলে চুপ করে রইল৷

খোকার মা বললেন, মাসিমা হন, মাসিমা বলে ডাকবে—

খোকা বললে, ও মাসিমা—

—এই যে বাবা, উঠে এসে কোলে বসো—

খোকার মা বললেন, সেই ছড়াটা শুনিয়ে দাও তোমার মাসিমাকে খোকন!

খোকা অমনি দাঁড়িয়ে উঠে বলতে আরম্ভ করলে—

এই যে গঙ্গা পুণ্য ঢারা

বিমল মুরটি পাগলপারা

বিশ্বনাটের চরণটলে বইছে কুটুহলে—

খোকা ‘ত’ এর জায়গায় ‘ট’ বলে, ‘ধ’ এর জায়গায় ‘ঢ’ বলে—শরতের মনে হল খোকার মুখে অমৃত বর্ষণ হচ্ছে যেন৷ অভাগিনী শরৎ সন্তানস্নেহ কখনো জানে নি, কিন্তু এই খোকাকে দেখে তার সুপ্ত মাতৃহৃদয় যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল৷ কত ছেলে তো দেখলে এ পর্যন্ত, মিনুর কাকিমারই তো এ বয়সের ছেলে রয়েছে, তাদের প্রতি স্নেহ তো দূরের কথা—শরৎ নিতান্তই বিরক্ত৷ এ ছেলেটির ওপর এমন ভাবের কারণ কি সে খুঁজে পায় না৷ কিন্তু মনে হল এ খোকা তার কত দিনের আপনার, একে দেখে, একে কোলে করে বসে ওর নারীজীবন যেন সার্থক হল৷

শরৎ সেদিন সেখান থেকে চলে এল বটে, কিন্তু মন রেখে এল খোকার কাছে৷ কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার মন হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়৷

গড়বাড়ির জঙ্গলে তাদের পুরনো কোঠা৷

বাবা বাড়ি নেই৷

—ও খোকন, ও কালো—

—কি মা?

—বেরিও না এই রোদ্দুরে হটর হটর করে—ঘরে শোবে এসো—

খিল খিল করে দুষ্টুমির হাসি হেসে খোকা ছুটে পালায়৷

হাঁড়ি-হেঁসেলের অবসরে নতুন আলাপী খোকনকে ঘিরে তার মাতৃহৃদয়ের সে কত অলস স্বপ্ন৷ যে সাধ আশা কোনোকালে পূর্ণ হবার নয়, ইহজীবনে নয়, মন তাকেই হঠাৎ যেন সবলে আঁকড়ে ধরে৷

দিন দুই পরে সে রেণুকাকে বলে—চল ভাই, কালোকে দেখে আসি গে—

কিন্তু সেদিন রেণুকার যাবার সময় হয় না৷ স্বামী দুজন বন্ধুকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছেন, রান্নাবান্নার হাঙ্গামা আছে৷

আরও দিনকয়েক পরে আবার শরতের অবসর মিলল—এবার রেণুকাকে বলেকয়ে নিয়ে গেল ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ দূর থেকে বাড়িটা দেখে ওর বুকের মধ্যে যেন সমুদ্রের ঢেউ উথলে উঠল—বড় বড় পর্বতপ্রমাণ ঢেউ যেন উদ্দাম গতিতে দূর থেকে ছুটে এসে কঠিন পাষাণময় বেলাভূমির গায়ে আছড়ে পড়ছে৷

খোকা দেখতে পেয়েছে, সে তাদের বাড়ির দোরে খেলা করছিল৷ সঙ্গে আরও পাড়ার কয়েকটি খোকাখুকি৷

শরতের বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল—খোকা যদি ওকে না চিনতে পারে!

কিন্তু খোকা তাকে দেখেই খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুধে-দাঁত বার করে একগাল হেসে ফেললে৷

শরতের অদৃষ্টাকাশের কোন সূর্য যেন রাশিচক্রের মধ্যে দিয়ে পিছু হঠতে হঠতে মীনরাশিতে প্রবিষ্ট হলেন, যার অধিপতি সর্বপ্রকার স্নেহপ্রেমের দেবতা শুক্র!

—চিনতে পারিস খোকা? আয়—

শরৎ হাত বাড়িয়ে দিলে ওকে কোলে নেবার জন্য৷ খোকা বিনা দ্বিধায় ওর কোলে এসে উঠল, বললে—মাছিমা—

—তাহলে তুই দেখছি ভুলিস নি খোকা—

খোকার মা ছুটে এসে বললেন, যাক, এসেছ ভাই? ও কেবল মাসিমা মাসিমা করে, একদিন ভেবেছিলাম রেণুকাদের বাড়ি নিয়েই যাই—দাঁড়াও ভাই, পাশের বকসীদের বাড়ির বড় বউ তোমাকে দেখতে চেয়েছে, ডেকে আনি—

বকসীদের বাড়ির দুই বউ একটু পরে হাজির৷ দুজনেই বেশ সুন্দরী, গায়ে গহনাও মন্দ নেই দুজনের৷ বড় বউ প্রণাম করে বললে—ভাই, আপনার কথা সেদিন দিদি বলছিলেন, তাই দেখতে এলুম—

—আমার কথা কি বলবার আছে বলুন?

—দেখে মনে হচ্ছে, বলবার সত্যিই আছে৷ যা নয় তা কখনো রটে ভাই? রটেছে আপনার নামে—

শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ কি রটেছে তার নামে? এরা কি কেউ গিরীন প্রভাসের কথা জানে নাকি? সে বললে, আমার নামে কি শুনেছেন?

বড় বউ হেসে বললে, না, তা আর বলব না৷

শরতের আরও ভয় হল৷ বললে, বলুনই না?

—আপনার চেহারার বড় প্রশংসা করছিলেন দিদি৷ আমায় বললেন, ভাই রেণুকাদের বাড়িও’লাদের বাড়িতে তিনি এসেছেন রান্না করতে, কিন্তু অনেক বড় ঘরে অমন রূপ নেই৷ সে যে সামান্য বংশের মেয়ে নয়, তা দেখলে আর বুঝতে বাকি থাকে না৷ তাই তো ছুটে এলাম, বলি দেখে আসি তো—

শরৎ বড় লজ্জা পায় রূপের প্রশংসা শুনলে৷ এ পর্যন্ত তা সে অনেক শুনেছে—রূপের প্রশংসাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল জীবনে, আজ এই দশা কেন হবে নইলে? কিন্তু সে-সব কথা বলা যায় না কারো কাছে, সুতরাং সে চুপ করেই রইল৷

কালোর মা বললেন, খোকা তো মাসিমা বলতে অজ্ঞান! তবু একদিনের দেখা! কি গুণ তোমার মধ্যে আছে ভাই, তুমিই জানো—

বকসীদের বড় বউ বললে, একটু আমাদের বাড়ি পায়ের ধুলো দিতে হবে ভাই—

—এখন কি করে যাব বলুন, ছুটি যে ফুরিয়ে এল—

—তা শুনব না, নিয়ে যাব বলেই এসেছি—দিদিও চলুন, রেণুকা ভাই তুমিও এসো—খোকাকে কোলে নিয়ে শরৎ ওদের বাড়ি চলল সকলের সঙ্গে৷

বড় বউ বললে, ভাই তোমার কোলে কালোকে মানিয়েছে বড় চমৎকার৷ ও যেমন সুন্দর, তুমিও তেমন৷ মা আর ছেলে দেখতে মানানসই একেই বলে—

ওদের বাড়ি যে জলযোগের জন্যেই নিয়ে যাওয়া একথা সবাই বুঝেছিল৷ হলও তাই, শরতের জন্যে ফলমূল ও সন্দেশ—বাকি দুজনের জন্যে সিঙাড়া-কচুরির আমদানিও ছিল৷ বউ দুটির অমায়িক ব্যবহারে শরৎ মুগ্ধ হয়ে গেল৷ খানিকক্ষণ বসে গল্পগুজবের পর শরৎ বিদায় চাইলে৷

বড় বউ বললে, আবার কিন্তু আসবেন ভাই, এখন যখন খোকার মাসিমা হয়ে গেলেন, তখন খোকাকে দেখতে আসতেই হবে মাঝে মাঝে—

—নিশ্চয়ই আসব ভাই—

খোকা কিন্তু অত সহজে তার মাসিমাকে যেতে দিতে রাজি হল না৷ সে শরতের আঁচল ধরে টেনে বসে রইল, বললে—এখন টুমি যেয়ো না মাছিমা—

—যেতে দিবি নে?

—না৷

—আবার কাল আসব৷ তোর জন্যে একটা ঘোড়া আনব—

—না, টুমি যেয়ো না৷

শরৎ মুগ্ধ হয় শিশু কত সহজে তাকে আপন বলে গ্রহণ করেছে তাই দেখে৷ যেন ওর কতদিনের জোর, কতদিনের ন্যায্য অধিকার৷ সব শিশু যে এমন হয় না, তা শরতের জানতে বাকি নেই৷

খোকা ওর ছোট্ট মুঠি দিয়ে শরতের আঁচলে কয়েক পাক জড়িয়েছে৷ সে পাক খুলবার সাধ্য নেই শরতের, জোর করে তা সে খুলতে পারবে না, চাকরি থাকে চাই যায়৷ শরতের হৃদয়ে অসীম শক্তি এসেছে কোথা থেকে, সে ত্রিভুবনকে যেন তুচ্ছ করতে পারে এই নবার্জিত শক্তির বলে, জীবনের নতুন অর্থ যে তার চোখের সামনে খুলে গিয়েছে৷ যখন অবশেষে সে বাড়ি চলে এল, তখন সন্ধ্যার বেশি দেরি নেই৷ মিনুর কাকিমা মুখ ভার করে বললেন, রোজ রোজ তোমার বেড়াতে যাওয়া আর এই রাত্তিরে ফেরা! উনুনে আঁচ পড়ল না এখনও, ছেলেমেয়েদের আজ আর খাওয়া হবে না দেখছি৷ আটটার মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়বে—

—কিছু হবে না, আমি ওদের খাইয়ে দিলেই তো হল—

—তোমার কেবল মুখে মুখে জবাব! এ বাড়িতে তোমার সুবিধে দেখে কাজ হবে না—আমার সুবিধে দেখে কাজ হবে, তা বলে দিচ্ছি৷ কাল থেকে কোথাও বেরুতে পারবে না৷

মুখোমুখি তর্ক করা শরতের অভ্যেস নেই৷ সে এমন একটা অদ্ভুত ধরনের নির্বিকার, স্বাধীন ভঙ্গীতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, একটা কথাও না বলে—যাতে মিনুর কাকিমা নিজে যেন হঠাৎ ছোট হয়ে গেল এই অদ্ভুত মেয়েটির ধীর, গম্ভীর, দর্পিত ব্যক্তিত্বের নিকট৷

মিনুর কাকিমা কিন্তু দমবার মেয়ে নয়, শরতের সঙ্গে রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে ঝাঁজালো এবং অপমানজনক সুরে বললে, কথার উত্তর দিলে না যে বড়? আমার কথা কানে যায় না নাকি?

শরৎ রান্নাঘরের কাজ করতে করতে শান্তভাবে বললে, শুনলাম তো যা বললেন—

—শুনলে তো বুঝলাম৷ সেই রকম কাজ করতে হবে৷ আর একটা কথা বলি, তোমার বেয়াদবি এখানে চলবে না জেনে রেখো৷ আমি কথা বললাম আর তুমি এমনি নাক ঘুরিয়ে চলে গেলে, ও-সব মেজাজ দেখিও অন্য জায়গায়৷ এখানে থাকতে হলে—ও কি, কোথায় চললে?

—আসছি, পাথরের বাটিটা নিয়ে আসি ওঘর থেকে—

মিনুর কাকিমার মুখে কে যেন এক চড় বসিয়ে দিলে৷ সে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল৷ এ কি অদ্ভুত মেয়ে, কথা বলে না৷ প্রতিবাদ করে না৷ রাগঝালও দেখায় না—অথচ কেমন শান্ত, নির্বিকার, আত্মস্থ ভাবে তুচ্ছ করে দিতে পারে মানুষকে! মিনুর কাকিমা জীবনে কখনো এমন অপমানিতা বোধ করে নি নিজেকে৷

শরৎ ফিরে এলে তাই সে ঝাল ঝাড়বার জন্যে বললে, কাল থেকে দুপুরের পর বসে বসে ডালগুলো বেছে হাঁড়িতে তুলবে৷ কোথাও বেরুবে না৷

মিনুর কাকা তাঁর স্ত্রীর চিৎকার শুনে ডেকে বললেন, আঃ কি দুবেলা চেঁচামেচি করো রাঁধুনীর সঙ্গে? অমন করলে বাড়িতে চাকরবাকর টিকতে পারে?

—কেন গো, রাঁধুনীর উপর যে বড্ড দরদ দেখতে পাই—

—আঃ, কি সব বাজে কথা বল! শুনতে পাবে—

—শুনতে পেলে তো পেলে—তাতে ওর মান যাবে না৷ ওরা কি ধরনের মানুষ তা জানতে বাকি নেই—আজ এসেছে এখানে সাধু সেজে তীর্থ করতে৷

—লোককে অপ্রিয় কথাগুলো তুমি বড্ড কটকট করে বলো৷ ও ভালো না—

মিনুর কাকিমা ঝাঁজের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললে, আমায় তোমার পাদ্রি সাহেবের মতো মর্মজ্ঞান শিখিয়ে দিতে হবে না—থাক—

মিনুর কাকাটিকে শরৎ দূর থেকে দেখেছে৷ সামনে এ পর্যন্ত একদিনও বার হয় নি৷ লোকটি বেশ নাদুস-নুদুস চেহারার লোক, মাথায় ঈষৎ টাক দেখা দিয়েছে, সাহেবের মতো পোশাক পরে আপিসে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে কখনো চেঁচামেচি হাঁকডাক করে না, চাকর-বাকরদের বলাবলি করতে শুনেছে যে লোকটা মদ খায়৷ মাতালকে শরৎ বড় ভয় করে, কাজেই ইচ্ছে করেই কখনো সে লোকটির ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না৷

সেদিন আবার তার মন উতলা হয়ে উঠল খোকাকে দেখবার জন্যে৷ খোকাকে একটা ঘোড়া দেবে বলে এসেছিল, হাতে পয়সা নেই, এদের কাছে মুখ ফুটে চাইতে সে পারবে না, অথচ কি করা যায়?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোকাকে খেলনা দেবার টানই বড় হল৷ সে মিনুর কাকিমাকে বললে—আমায় কিছু পয়সা দেবেন আজ?

মিনুর কাকিমা একটু আশ্চর্য হল৷ শরৎ এ পর্যন্ত কখনো কিছু চায় নি৷

বললে—কত?

—এই—পাঁচ আনা—

মিনুর কাকিমা মনে মনে হিসেব করে দেখলে শরৎ পাঁচ মাস হল এখানে রাঁধুনীর কাজ করছে, এ পর্যন্ত তাকে মাইনে বলে কিছু দেওয়া হয় নি, সেও চায় নি৷ আজ এতদিন পরে মোটে পাঁচ আনা চাওয়াতে সে সত্যিই আশ্চর্য হল৷

আঁচল থেকে চাবি নিয়ে বাক্স খুলে বললে, ভাঙানো তো নেই দেখছি, টাকা রয়েছে৷ ও বেলা নিয়ো—

শরৎ ঠিক করেছিল আজ দুপুরের পরে কাজকর্ম সেরে সে খোকার কাছে যাবে৷ মুখ ফুটে সে বললে, টাকা ভাঙিয়ে আনলে হয় না? আমার বিকেলে দরকার ছিল৷

—কি দরকার?

—ও আছে একটা দরকার—

—বলোই না—

—একজনের জন্যে একটা জিনিস কিনব৷

—কে?

শরৎ ইতস্তত করে বললে রেণুকা জানে—পটলের বউ—

মিনুর কাকিমা মুখ টিপে হেসে বললে, আপত্তি থাকে বলবার দরকার নেই, থাক গে৷ নিও এখন—

শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে ঘোড়া কিনতে গেল৷ এক জায়গায় লোকের ভিড় ও কান্নার শব্দ শুনে ও রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেখতে গেল৷ একটি আঠারো-উনিশ বছরের বাঙালির মেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে, আর তাকে ঘিরে কতকগুলো হিন্দুস্থানী মেয়েপুরুষ খেপাচ্ছে ও হাসাহাসি করছে৷

মেয়েটি বলছে, আমার গামছা ফেরত দে—ও মুখপোড়া, যম তোমাদের নেয় না, মণিকর্ণিকা ভুলে আছে তোদের? শালারা, পাজি ছুঁচোরা—গামছা দে—

শরৎকে দেখে ভিড় সসম্ভ্রমে একটু ফাঁক হয়ে গেল৷ কে একজন হেসে বললে, পাগলি, মাইজী—আপলোক হঠ যাইয়ে—

মেয়েটি বললে, তোর বাবা মা গিয়ে পাগল হোক হারামজাদারা—মণিকর্ণিকায় নিয়ে যা ঠ্যাং-এ দড়ি বেঁধে, পুড়ুতে কাঠ না জুটুক—দে আমার গামছা—দে—

যে ওকে পাগলি বলেছিল সে তার পুণ্যশ্লোক পিতামাতার উদ্দেশে গালাগালি সহ্য করতে না পেরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এইয়ো—মু সামহালকে বাত বোলো—নেই তো মু মে ইটা ঘুষা দেগা—

মেয়েটির পরনে চমৎকার ফুলনপাড় মিলের শাড়ি, বর্তমানে অতি মলিন—খুব একমাথা চুল তেল ও সংস্কার অভাবে রুক্ষ ও অগোছালো অবস্থায় মুখের সামনে, চোখের সামনে, কানের পাশে পড়েছে, হাতে কাঁচের চুড়ি, গায়ের রং ফর্সা, মুখশ্রী একসময়ে ভালো ছিল, বর্তমানে রাগে, হিংসায়, গালাগালির নেশায় সর্বপ্রকার কোমলতা-বর্জিত, চোখের চাউনি কঠিন, কিন্তু তার মধ্যেই যেন ঈষৎ দিশাহারা ও অসহায়৷

শরতের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল৷ রাজলক্ষ্মী? গড়শিবপুরের সেই রাজলক্ষ্মী? এর চেয়ে সে হয়তো দু-তিন বছরের ছোট—কিন্তু সেই পল্লীবালা রাজলক্ষ্মীই যেন৷ বাঙালীর মেয়ে হিন্দুস্থানীদের হাতে এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবে এই বিশ্বনাথের মন্দিরের পবিত্র প্রবেশপথে?

শরৎ সোজাসুজি গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে বললে, তুমি বেরিয়ে এসো ভাই—আমার সঙ্গে—

মেয়েটি আগের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমার গামছা নিয়েছে ওরা কেড়ে—আমি রাস্তায় বেরুলেই ওরা এমনি করে রোজ রোজ—তার পরেই ভিড়ের দিকে রুখে দাঁড়িয়ে বললে, দে আমার গামছা, ওঃ মুখপোড়ারা, তোদের মড়া বাঁধা ওতে হবে না—দে আমার গামছা—

ভিড় তখন শরতের অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে কিছু অবাক হয়ে ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম হয়েছে৷ দু একজন হি হি করে মজা দেখবার তৃপ্তিতে হেসে উঠল৷ শরৎ মেয়েটির হাত ধরে গলির বাইরে যত টেনে আনতে যায়, মেয়েটি ততই বার বার পিছনে ফিরে ভিড়ের উদ্দেশে রুদ্রমূর্তিতে নানা অশ্লীল ও ইতর গালাগালি বর্ষণ করে৷

অবশেষে শরৎ তাকে টানতে টানতে গলির মুখে বড় রাস্তার ধারে নিয়ে এল, যেখানে মনোহারী দোকানের সামনে সে রেণুকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল৷

রেণুকা চোখে না দেখতে পেলেও গোলমাল ও গালাগালি শুনেছে; এখনও শুনছে মেয়েটির মুখে—সে ভয়ের সুরে বললে, কি, কি ভাই? কি হয়েছে? ও সঙ্গে কে?

—সে কথা পরে হবে৷ এখন চলো ভাই ওদিকে—

মেয়েটি গালাগালি বর্ষণের পরে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যেন৷ সে কাঁদো কাঁদো সুরে বলতে লাগল—আমার গামছাখানা নিয়ে গেল মুখপোড়ারা—এমন গামছাখানা—

শরৎ বললে, ভাই রেণুকা, দোকান থেকে গামছা একখানা কিনে দিই ওকে—চল তো—

মেয়েটি গালাগালি ভুলে ওর মুখের দিকে চাইলে৷ রেণুকা জিজ্ঞেস করলে, তোমার নাম কি? থাকো কোথায়?

মেয়েটি কোনো জবাব দিলে না৷

গামছা কিনতে গিয়ে দোকানি বললে, একে পেলেন কোথায় মা?

শরৎ বললে, একে চেন?

—প্রায়ই দেখি মা৷ গণেশমহল্লার পাগলি, গণেশমহল্লায় থাকে—ও লোককে বড় গালাগালি দেয় খামকা—

পাগলি রেগে বললে, দেয়? তোর পিণ্ডি চটকায়, তোকে মণিকর্ণিকার ঘাটে শুইয়ে মুখে নুড়ো জ্বেলে দেয় হারামজাদা—

দোকানি চোখ রাঙিয়ে বললে, এই চুপ! খবরদার—ওই দেখুন মা—

শরৎ ছেলেমানুষকে যেমন ভুলোয় তেমনি সুরে বললে, ওকি, অমন করে না ছিঃ—লোককে গালাগালি দিতে নেই৷

পাগলি ধমক খেয়ে চুপ করে রইল৷

—গামছা কত?

—চোদ্দ পয়সা মা—আমার দোকানে জিনিসপত্তর নেবেন৷ এই রাস্তায় বাঙালি বলতে এই আমিই আছি৷ দশ বছরের দোকান আমার৷ হুগলী জেলায় বাড়ি, ম্যালেরিয়ার ভয়ে দেশে যাই নে, এই দোকানটুকু করে বাবা বিশ্বনাথের ছিচরণে পড়ে আছি—আমার নাম রামগতি নাথ৷ এক দামে জিনিস পাবেন মা আমার দোকানে—দরদস্তুর নেই৷ মেড়োদের দোকানে যাবেন না, ওরা ছুরি শানিয়ে বসে আছে বাঙালি দেখলেই গলায় বসিয়ে দেবে৷ এই গামছাখানা মোড়ের দোকানে কিনতে যান—চার আনার কম নেবে না৷

দোকানির দীর্ঘ বক্তৃতা শরৎ গামছা হাতে দাঁড়িয়ে একমনে শুনলে, যেন না শুনলে দোকানির প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অসৌজন্য দেখানো হবে৷ তার পর আবার রাস্তায় উঠে পাগলকে বললে, এই নেও বাছা গামছা—পছন্দ হয়েছে?

পাগলি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললে, খিদে পেয়েছে—

শরৎ বললে, কি করি রেণু, ছ’টা পয়সা সম্বল, তাতেই যা হয় কিনে খাক গে—

রেণুকা বললে, আমার হাঁড়িতে বোধ হয় ভাত আছে৷

—তাই দেখি গে চলো,—

পাগলিকে ভাত দেওয়া হল, কতক ভাত সে ছড়ালে, কতক ভাত ইচ্ছে করে ধুলোতে মাটিতে ফেলে তাই আবার তুলে খেতে লাগল, অর্ধেক খেলে ভাত, অর্ধেক খেলে ধুলোমাটি৷

শরতের চোখে জল এসে পড়ে৷ মনে ভাবলে—আহা অল্প বয়েস, কি পোড়া কপাল দেখো একবার! মুখের ভাত দুটো খেলেও না—

বললে, ভাত ফেলছিস কেন? থালায় তুলে নে মা—অমন করে না—

ঠিক সেই সময় রাজপথে সম্ভবত কোনো বিবাহের শোভাযাত্রা বাজনা বাজিয়ে ও কলরব করতে করতে চলেছে শোনা গেল৷ শরৎ তাড়াতাড়ি সদর দরজার কাছে ছুটে এসে দেখতে গেল, এসব বিষয়ে তার কৌতূহল এখনও পল্লীবালিকার মতোই সজীব৷

সঙ্গে সঙ্গে পাগলিও ভাতের থালা ফেলে উঠে ছুটে গেল শরৎকে ঠেলে একেবারে সদর রাস্তায়—শরৎ ফিরে এসে বললে, ওমা, একি কাণ্ড, ভাত তো খেলেই না, গামছাখানা পর্যন্ত ফেলে গেল! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও পাগলির আর দেখা পাওয়া গেল না৷

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress