Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মিনুর কাকিমার এ খুঁটিনাটি জেরার পরদিন থেকে শরৎ ভয়ে আর সামনে বেরুতে চায় না সহজে৷ সে জানত না, গিন্নির কাছে তার সম্বন্ধে লাগানোর কথা৷ কিন্তু আবার কোনোদিন বাপের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে হয়তো বসবে বৌটি—হয়তো যে আশ্রয়টুকু আছে, তাও যাবে৷ তার চেয়ে সামনে না যাওয়া নিরাপদ৷

কিন্তু শরৎ এড়িয়ে যেতে চাইলেও মিনুর কাকিমা অত সহজে শরৎকে রেহাই দিতে রাজি নয় দেখা গেল৷ শরৎকে সে পছন্দও করে না—অথচ পছন্দ না করার মধ্যেই শরৎ সম্বন্ধে ওর কেমন এক ধরনের উগ্র কৌতূহল৷

একদিন শরৎকে ডেকে বললে, ও বামনী—শোনো—

শরৎ কাছে গিয়ে বললে, কি বলছেন?

—তোমার হাতের রান্না বেশ ভালো৷ কোন জেলায় বাপের বাড়ি বললে সেদিন যেন—

শরতের মুখ শুকিয়ে গেল৷ এই বুঝি আবার—

সে বললে—যশোর জেলা৷

—যশোর জেলা৷ বাঙাল দেশের নিরিমিষ্যি রান্না বাপু তোমাদের ভালোই৷ তোমার বয়েস কত?

—সাতাশ বছর৷

—না, তার চেয়ে বয়েস বেশি৷ বত্রিশ-তেত্রিশের কম না৷ তোমাদের হিসেব থাকে না৷

শরৎ চুপ করে রইল৷ এর কোনো উত্তর নেই৷

—তোমার বিয়ে হয়েছিল কোথায়?

—আমাদের গাঁয়ের কাছেই৷

—কতদিন বিধবা হয়েছ?

এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে শরতের মনে বড় কষ্ট হয়৷ যা ভুলে গিয়েছে, যা চুকেবুকে গিয়েছে কতদিন আগে, সে-সব দিনের কথা, সে-সব পুরনো কাসুন্দি—এখন আর ঘেঁটে লাভ কি?

—তবু সে বললে, অনেকদিন আগে৷ আমার তখন আঠার বছর বয়েস৷

—সেই থেকে বুঝি কলকাতায়—মানে, চাকরি করছ?

—না, দেশেই ছিলাম৷

শরৎ খুব সতর্ক ও সাবধান হল৷ তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল৷

—কলকাতায় কতদিন আগে এসেছিলে?

—বেশিদিন না৷

—গাঁ থেকে কার সঙ্গে—মানে কলকাতায় আনলে কে?

শরতের জিব ক্রমশ শুকিয়ে আসছে৷ তার মুখে কথা আর যোগাচ্ছে না৷ কাঁহাতক বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে সে?

—কালীঘাট এসেছিলাম মা—গৌরী-মার কাছে সেই থেকে ছিলাম৷

সেদিন মিনু এসে পড়াতে তার কাকিমার জেরা বন্ধ হল৷ শরৎ মুক্তি পেয়ে সামনে থেকে সরে গেল৷

পরদিন বাসার সকলে মিলে উষ্ণকুণ্ডে স্নান করতে গেল৷ শরৎ ছেলেমেয়েদের সামলে নিয়ে পেছনে পেছনে চলল৷ মিনুর মা সেদিন যান নি৷ মিনুর কাকিমার সঙ্গে যে আয়া এসেছিল, সে যেন এখানে এসে ছুটি পেয়েছে—খাটুনি যত কিছু শরতের ঘাড়ে৷ কাকিমার দুটি ছেলেমেয়ে যেমন দুষ্ট তেমনি চঞ্চল—তাদের সামলাতে সামলাতে শরৎ হয়রান হয়ে পড়ে৷

মিনুর কাকিমা বলে, ও বামনী, ওই মিন্টুকে চার পয়সার গরম জিলিপি কিনে এনে দাও তো বাজার থেকে—

বাজারে সকলের সামনে দোকান থেকে জিনিস কেনা শরতের অভ্যেস নেই৷ চুপি চুপি মিনুকে বললে, মিনু দিদি, যাবি আমার সঙ্গে?

মিনু সব সময়েই তার দিদিকে সাহায্য করতে রাজি৷

বললে, চলো দিদি—

জিলিপি কিনে ফিরে আসতেই মিনুর কাকিমা বললে, চলো কুণ্ডীতে কাপড়গুলো নিয়ে—সাবানের বাক্স নেও৷ নেয়ে আসি—

মিনু পেছন থেকে এসে সাবানের বাক্স নিজেই নিয়ে চলল৷

স্নান শেষ হয়ে গেল৷ সিক্ত বসনে সবাই উঠে এসে মেয়েদের কাপড় ছাড়বার ঘেরা জায়গার মধ্যে ঢুকল৷ শরৎও স্নান করে এল৷ সে লক্ষ করল, মিনুর কাকিমা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে৷ পশ্চিমের জলহাওয়ার গুণে হয়তো শরতের স্বাস্থ্য আরও কিছু ভালো হয়ে থাকবে, তার গৌর তনুর জলুস আরও খুলে থাকবে, সিক্তবসনা দীর্ঘদেহা সে তরুণীর মূর্তি এমন মহিমময়ী দেখাচ্ছিল যে রাস্তার কত লোক তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল৷

মিনু অপলক চোখে চেয়ে চেয়ে ভাবলে—দিদি যে বলে তাদের রাজার বংশ, মিথ্যে নয় কথাটা৷ ওই তো কাকিমা অত সেজেগুজে এসেছেন, দিদির পাশে দাঁড়াতে পারেন না—

মিনুর কাকিমাও বোধ হয় শরতের অদ্ভুত রূপে কিছুক্ষণের জন্যে মুগ্ধ না হয়ে পারলে না—কারণ সেও খানিকটা শরতের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷

সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন এক ধরনের ভাব হল মনে—সেই পুরাতন মনোভাব, সুন্দরী নারীর প্রতি সাধারণ নারীর ঈর্ষা৷

সে ধমকের সুরে বললে, একটু হাত চালিয়ে কাপড়টাপড়গুলো কেচে-টেচে নাও না বাপু, তোমার সব কাজেই ন্যাড়া-ব্যাড়া—

যেন শরতকে খাটো করে অপমান করে ওর নিজের মর্যাদা আভিজাত্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করলে৷

ফিরবার পথে মিনুর কাকিমা বললে, তুমি একটু আগে হেঁটে যাও বাপু, আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছি—তোমাকে আবার গিয়ে দিদির গরমজল চড়াতে হবে—কাপড়গুলো নিয়ে গিয়ে রোদে দাও গে—

বড় এক বোঝা ভিজে কাপড় শরতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাকিমা মিনুকে ও নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে পিছিয়ে পড়ল৷ মিনু বলল, দিদিকে আজ চমৎকার দেখাচ্ছিল নেয়ে উঠে, না কাকিমা?

কেন মিনু হঠাৎ একথা বললে? মিনুর কাকিমাও বোধ হয় ওই ধরনের কোনো কথাই ভাবছিল৷ হঠাৎ যেন চমকে উঠে মিনুর দিকে চেয়ে রইল অল্প একটু সময়ের জন্যে৷ পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, পরের ঘি-দুধ খেলে এমন সবারই হয় বাপু—তুই চল, নে—

বিকেলে আবার বৌটি ডাকলে শরতকে৷ বৌ নিজে স্টোভ ধরিয়ে চা করে এক পেয়ালা মুখে তুলে চুমুক দিচ্ছে, আর একটা ধূমায়মান পেয়ালা সামনে বসানো মেঝের ওপর৷ শরতকে বললে, ও বামনী, দিদিকে চা-টা দিয়ে এসো তো?

তার পরের কথাতে শরৎ বড় চমৎকৃত হয়ে গেল কিন্তু৷

বৌটি বললে, তোমার জন্যেও এক পেয়ালা আছে, ওটা দিদিকে দিয়ে এসো—এসে তুমি খাও—

শরৎ অগত্যা ফিরে এসে কলাই করা পেয়ালাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে, বৌটি বললে, এখানে বসে খাও না গো, তাড়াতাড়ির কি আছে?

শরৎ বসে চা খেতে লাগল কিন্তু কোনো কথা বললে না৷

মিনুর কাকিমা আবার বললে, তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি৷ দিদির কাছ থেকে তোমায় যদি আমি নিয়ে যাই, তুমি মাইনে নেবে কত?

শরৎ আরও অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে—আমাকে?

—হ্যাঁ গো—তোমাকে৷ বলো না মাইনে কত নেবে?

—গিন্নিমা যেতে দেবেন না আমায়৷

মিনুর কাকিমা মুখ নেড়ে বললে, সে ভাবনা তোমার না আমার? আমি যদি বলেকয়ে নিতে পারি! মানে আর কিছু না, যেখানে থাকি খোট্টা বামুনে রাঁধে, বাঙালীর মুখে সে রান্না একেবারে অখাদ্য৷ আমার নিজের ওসব অভ্যেস নেই—হাঁড়িহেঁসেল কখনো করি নি, বাপের বাড়িতেও না, শ্বশুরবাড়িতে এসে তো নয়ই৷ তোমাদের বাঙাল দেশের রান্না ভালো—তাই বলছিলাম—বুঝলে?

শরতের মুখ চুন হয়ে গেল৷

এমন একটা আশ্রয় পেয়ে সে যে কোথাও যেতে রাজি নয়, এদের ছেড়ে মিনুকে ছেড়ে৷ কিন্তু সে এখনও পরের দয়ার পাত্রী, তার কোনো ইচ্ছে বা দয়া এসব স্থলে খাটবে না, সে ভালোই বোঝে৷

সে চুপ করে রইল৷

মিনুর কাকিমা ভুল বুঝে বললে, আচ্ছা তাই তবে ঠিক রইল৷ মাইনের কথা একটা কিন্তু ঠিক করে ফেলা ভালো—তা বলছি৷ তখন যে বলবে—

শরৎ মিনুকে নিরিবিলি পেয়ে বললে, মিনু বেড়াতে যাবি?

—চলো দিদি—কোন দিকে যাবে?

—সোন ভাণ্ডারের গুহার দিকে চল—

নদীর ধারে ধারে বনাবৃত পথ গৃধ্রকূট শৈলের ছায়ায় ছায়ায় সোন ভাণ্ডার ছাড়িয়ে রাজগীরের প্রাচীনতর অঞ্চলে জরাসন্ধের মল্লভূমির দিকে বিস্তৃত৷ ওরা সেই পথে চলল৷ কত পাথরের নুড়ি পড়ে আছে পাহাড়ের তলায়, নদীর পাড়ে৷ সমতলবাসিনী শরৎ এখনও এই সব রঙচঙে নুড়ির মোহ কাটিয়ে ওঠে নি, দেখতে পেলেই কুড়িয়ে আঁচলে সঞ্চয় করে৷

মিনু বললে, তুমি একটা পাগল দিদি! কি হবে ওসব?

—বেশ না এগুলো? দ্যাখ এটা কেমন—

—কি করবে?

—ইচ্ছে কি করে জানিস! ওসব দিয়ে ঘর সাজাই—কিন্তু ঘর কোথায়?

—জড়ো করেছ তো একরাশ৷—তাতেই সাজিও—

—জানিস মিনু, তোর কাকিমা কি বলেছে?

—কি দিদি?

—আমায় নিয়ে যেতে চায় ওদের বাড়ি৷

—তোমার যাওয়া হবে না, আমি মাকে টিপে দেব!

—আমি তোদের ফেলে কোথাও যেতে চাই নে মিনু৷ যখন আশ্রয় পেয়েছি, যতদিন বাঁচি এখানেই থাকব৷

কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হল মিনুর কাকিমার সঙ্গে৷ মিনুর মা বললেন—যাও মা, ওরা কাশীতে যাচ্ছে, তোমার তীর্থ করা হবে এখন৷ আমি এর পরে তোমায় কাছে নিয়ে আসব৷

মিনুর কাকিমা সগর্বে অন্যান্য বোঁচকা, ট্রাঙ্ক, আয়া ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শরৎকেও নিয়ে গিয়ে কাশী নামল দিন-দশেক পরে৷ মাঝারি গোছের তেতলা বাড়ি, ছোট্ট সংসার, স্বামী-স্ত্রী আর এক দেওর৷ দেওর লাহোর মেডিকেল ইস্কুলে পড়ে, এবার পাশ দেবে৷ নীচে একঘর গরিব লোক থাকে ওদের ভাড়াটে৷

শরৎ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি, কিন্তু নতুন জায়গায় এসে তার এত খারাপ লাগছিল! একটা কথা বলবার লোকও নেই৷ মিনুর কাকিমা চাকর-বাকরকে আমল দেয় না, ছেলেমেয়েদেরও তার ভালো লাগে না৷ যেমন দুষ্ট, তেমনি একগুঁয়ে এগুলো৷ যা ধরবে তাই৷

একদিন মিনুর কাকিমা বললে—ও বামনী, এই ডালটুকু ওই নীচের তলার পটলের মাকে দিয়ে এসো—চেয়েছিল আমার কাছে, গরিব লোক—

শরৎ ডাল দিতে গিয়ে দেখল একটি বৌ রান্নাঘরে বসে ওর দিকে পিছন ফিরে রান্না করছে৷ ওর কথায় বৌটি ওর দিকে ফিরতেই শরৎ বললে, উনি ডাল পাঠিয়ে দিয়েছেন—রাখুন—

তার পরেই বৌয়ের চোখ দুটোর দিকে চেয়ে শরতের মনে কেমন খটকা লাগল৷

বৌটি হেসে বললে, তোমার গলা নতুন শুনছি৷ তুমি বুঝি ওদের এখানে নতুন ভর্তি হয়েছ? বলছিলেন কাল দিদি৷ বসো ভাই৷ আমি চোখে দেখতে পাইনে—বাটিটা রাখ এই সিঁড়ির কাছে৷

ও, তাই অমন চোখের চাউনি!

শরতের বুকের মধ্যে যেন কোথায় ধাক্কা লাগল৷

বৌটি আবার বললে, তোমার নাম কি ভাই? তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে বয়েস বেশি নয়৷

—আমার নাম শরৎ৷ বয়েস আপনার চেয়ে বেশিই হবে বোধ হয়—

—না ভাই, আমার বয়েস কম নয়৷ তা আমাকে তুমি আপনি আজ্ঞে কোরো না৷ আমি একা থাকি এই ঘরে—উনি তো বাইরের কাজেই ঘোরেন৷ তুমি এসো, দুজনে গল্প করব৷

—বেশ ভাই৷ তাহলে তো বেঁচে যাই—

শরতের মনের মধ্যে কাশী আসবার কথা শুনে একটু আগ্রহ না হয়েছিল এমন নয়৷ মিনুর মার কাছে এজন্যে সে না আসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নি৷ কাশী গয়া কজন বেড়াতে পারে? তাদের গাঁয়ের নীলমণি চাটুজ্জের মা শরতের ছেলেবেলায় কাশীতে এসে তীর্থ করে যান—সে গল্প বুড়ির এখনো ফুরলো না৷ আর বছরও সে গল্প বুড়ির মুখে শরৎ শুনেছে৷ সেই কাশীতে যদি এখন যাওয়া হয়—হোক!

কাশী এসে কিন্তু মিনুর কাকিমার ফরমাশ আর হুকুমের চোটে এতটুকু সময় পায় না শরৎ৷ সকালে উঠে হেঁসেলের কাজ শুরু৷ একদফা ছোটদের দুধবার্লি, একদফা বড়দের চা খাবার, বাজল বেলা আটটা৷ তার পরে রান্নার পালা শুরু হল এবং খাওয়ানো-দাওয়ানোর কাজ মিটতে বেলা দেড়টা৷ ওবেলা তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে আবার চা-খাবারের পালা৷ সন্ধ্যার সময় বাবুর বন্ধুরা বৈঠকখানায় এসে বসে, রাত নটা পর্যন্ত বিশ পেয়ালা চা-ই হবে৷

দুপুরবেলায় কাজকর্ম চুকিয়ে ফাঁক পেলে শরৎ এসে বসে একতলায় অন্ধ বৌটির কাছে৷ শরৎ তার পরিচয় নিয়েছে—ওর নাম রেণুকা, ওর বাবা কাশীতেই স্কুল-মাস্টারি করতেন৷ মা নেই, ভাই নেই, আজ কয়েক বছর আগে ওর বিয়ে দিয়েই বাবা মারা যান৷ ওরা ব্রাহ্মণ, স্বামী সামান্য মাইনেতে কি একটা চাকরি করে৷ সন্ধ্যার সময় ভিন্ন বাড়ি আসতে পারে না—সারাদিন রেণুকাকে একা থাকতে হয় বাসাতে৷

শরৎ বলে, তুমি বাংলা দেশে যাও নি কখনো?

—না ভাই, এখানেই জন্ম, বিশ্বনাথের চরণ ছেড়ে আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই৷

—দেশ ছিল কোথায় বাবার মুখে শোনো নি?

—হালিশহর বলদেঘাটা৷ এখনো আমার কাকারা সেখানে আছেন শুনেছি৷

দুজনে বসে সুখদুঃখের কথা বলে৷ রেণুকার অনেক কাজ শরৎ করে দেয়৷ বড় ভালো লাগে এই অন্ধ মেয়েটিকে৷ মন বড় সরল, অল্পেই সস্তুষ্ট, জীবন ওকে বেশি কিছু দেয় নি, যা দিয়েছে তাই নিয়েই খুশি আছে৷

রেণুকা বলে, একদিন আমার বাড়ি কিছু খাও ভাই—

—বেশ, আমি কি খাব না বলছি?

—রান্না তো খেতে পারবে না৷ নিরিমিষের হাঁড়ি নেই—সব একাকার৷ রান্না করে খাবে আলাদা?

—না ভাই, সে হাঙ্গামাতে দরকার নেই—তুমি ফল খাইও বরং—

রেণুকার স্বামী ছানা ফলমূল মিষ্টি কিনে রেখে গিয়েছিল৷ একদিন বিকেলে রেকাবি সাজিয়ে রেণুকা ওকে খেতে দিলে৷ চোখে দেখতে পায় না বটে—কিন্তু কাজকর্ম সবই করে হাতড়ে হাতড়ে৷

শরৎ একদিন মিনুর কাকিমাকে বলেকয়ে বিশ্বনাথ দর্শনের ছুটি নিলে৷ ওদের আয়া সঙ্গে গেল মন্দিরের পথ দেখানোর জন্য৷ শরৎ রেণুকাকে হাত ধরে নিয়ে গেল৷

বিশ্বনাথের গলির মধ্যে কি লোকের ভিড়! কত বৌ-ঝি, কত লোকজন! শরৎ অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে, তার কাছে সব কিছু নতুন, সবই আশ্চর্য৷ মন্দির থেকে বার হয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলো বিকেলবেলা৷ নিত্য উৎসব লেগেই আছে সেখানে৷ নৌকো আর বজরাতে কত লোক সাজগোজ করে বেড়াতে বেরিয়েছে৷

রেণুকা বললে, আমি এসব জায়গা দেখেছি ছেলেবেলায়৷ চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে অসুখে চোখ হারিয়েছি৷ এখনো সেইরকম আছে, কানে শুনে বুঝতে পারি৷

—ভারি ভালো জায়গা ভাই৷ কলকাতা শহর দেখে ভালো লেগেছিল বটে—কিন্তু সেখানে শান্তি পাই নি এমন৷ এখানে মন জুড়িয়ে গেল৷

—একদিন গঙ্গায় নাইতে এসো—

—সময় পাই নে, আসি কখন? কাল একবার বলব—

শরৎ আর রেণুকা একটু তফাৎ হয়ে বসে৷ চারিদিকের জন-কোলাহল ও সম্মুখে পুণ্যতোয়া জাহ্নবীর দিকে চেয়ে শরতের নতুন চোখ ফোটে৷ সত্যই সে বড় শান্তি পেয়েছে মনে৷

আয়া বললে, একদিন তোমাকে কেদার ঘাটে নিয়ে যাব—

শরৎ চমকে উঠে বললে, কি ঘাট?

—কেদার ঘাট৷ ওই দিকে—আমার সঙ্গে যেয়ো—

শরতের মন স্বপ্নঘোরে একমুহূর্তে কোন পথে চলে গেল পাহাড় পর্বত বনবনানীর ব্যবধান ঘুচিয়ে৷ গরিব বাবা কত কষ্টে চাল যোগাড় করে, নুন তেল যোগাড় করে এনে বলতেন ভালো করে রাঁধো, বাবা যে ছেলেমানুষের মতো, ঘরে কিছু নেই, তা বুঝবেন না—ভালো খাওয়াটি হওয়া চাই—নইলে অবুঝের মতো রাগ করবেন, অভিমান করবেন৷ এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারেন না বাবা৷ কোথায় গেলেন বাবা! জানবার জন্যে বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে, তিনি এখন কোথায় কি ভাবে আছেন! এমন জায়গা কাশী, সেই কতকাল আগের গল্প শোনা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট সব দেখা হল—কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় একথা আসে কেন, বাবা যে এসব কিছু দেখলেন না, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর এখন তীর্থধর্ম করবার সময়, অথচ বাবার অদৃষ্টে জুটল না কিছু! তিনি গোয়ালপাড়া বাগদিপাড়ায় বেহালা বাজিয়ে, গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন, ফিরে এসে অবেলায় হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছেন কিম্বা তাও খাচ্ছেন না, কে তাঁকে দেখছে, কে মুখের দিকে চাইবার আছে তাঁর!

কাশী গয়া সব তুচ্ছ—কিছু ভালো লাগে না৷

শরৎ বলে, আচ্ছা রেণুকা, কাশীতে দুজন লোকের কত হলে চলে?

রেণুকা ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে, তা কুড়ি টাকার কম তো কোনো মাস যেতে দেখলাম না৷ আমরা তো দুটো মানুষ থাকি৷ কেন ভাই?

শরৎ কি ভেবে কি কথা বলছে সে নিজেই জানে না৷ রেণুকা ভাবে, শরৎ হঠাৎ কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেল, না কি—আর ভালো করে কথা বলছে না কেন?

বাড়ি ফিরে মিনুর কাকিমার ফাইফরমাশ ও হুকুমের মধ্যে রান্নাঘরে রাঁধতে বসে সে ভাবে তার কোন জীবনটা সত্যি, গড়শিবপুরের ভাঙা গড়বাড়ির বনের সেই জীবন, না পরের বাড়ির হাঁড়ি-হেঁসেলের এ জীবন?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress