কেদার রাজা (Kedar Raja) : 04
শীত কমে গিয়েছে—বসন্তের হাওয়া দিতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সজনে গাছে থোকা থোকা ফুল দেখা দিয়েছে৷
কেদার নিজের গ্রামেই একটি কৃষ্ণযাত্রার দল খুলেছেন৷ সম্প্রতি এ অঞ্চলে কৃষ্ণযাত্রার একটা হিড়িক এসে পড়েছে—গত পুজোর সময় থেকে এর সূত্রপাত ঘটে, বর্তমানে মহামারীর মতো গ্রামে গ্রামে হুজুক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কেদার হটবার পাত্র নন, তাঁর গ্রামকে ছোট হয়ে থাকতে দেবেন কেন—জেলেপাড়া, কামারপাড়া এবং কুমোরপাড়ার লোকজন জুটিয়ে তিনিও এক দল খুলে মহা উৎসাহে মহলা আরম্ভ করেছেন৷ স্নানাহারের সময় নেই তাঁর, ভারি ব্যস্ত৷ সম্প্রতি তাঁর দলের গাওনা হবে চৈত্রমাসে অন্নপূর্ণা পূজার দিন, গ্রামের বারোয়ারি তলায়৷ বেশি দেরি নেই, দেড় মাস মাত্র৷
সীতানাথ জেলের বাড়ির বাইরে বড় ছ-চালা ঘর৷ যাত্রার দলের মহলা এখানেই রোজ বসে৷ অন্য সকলের আসতে একটু রাত হয়, কারণ সবাই কাজের লোক—কাজকর্ম সেরে আসতে একটু দেরিই হয়ে পড়ে৷ কেদারের কিন্তু সন্ধ্যা হতে দেরি সয় না, তিনি সকলের আগে এসে বসে থাকেন৷
সীতানাথ বাড়ি নেই—শীতকালের মাঝামাঝি নৌকো করে এখান থেকে পাঁচ দিনের পথ চূর্ণী নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছে—এখনও দেশে ফেরে নি৷
সীতানাথের বড় ছেলে মানিক বাড়িতে থাকে ও গ্রামের নদীতেই মাছ ধরে স্থানীয় হাটে বিক্রি করে সংসার চালায়৷ আজ পুরো মহলা হবে বলে সে সকাল সকাল নদী থেকে ফিরে এসে বাইরের ঘরে বড় বড় খানকতক মাদুর ও চট পেতে আসর করে রেখেছে৷
কেদারকে বললে, বাবাঠাকুর, তামাক কি আর এক বার ইচ্ছে করবেন?
—তা সাজ না হয় একবার৷ হ্যাঁরে মানকে, এরা এখনো সব এল না কেন?
—আসছে বাবাঠাকুর, সবাই কাজ সেরে আসছে তো, একটু দেরি হবে৷
—তুই তামাক সেজে একবার দেখে আয় দিকি বিশু কুমোরের বাড়ি৷ ওর ছেলেটাকে না হয় ডেকে আন৷ সে রাধিকা সাজবে, তার গানগুলো ততক্ষণ বেহালায় রপ্ত করে দিই—
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে জন দুই অভিনেতা ঘরে ঢুকল—একজন ছিবাস মুদি আর একজন হৃষিকেশ কর্মকার৷
কেদার খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে ছিবাস যে! এই যে রিষিকেশ, এসো এসো—তোমরা না এলে তো রিয়্যাশাল আরম্ভ হয় না৷ বেশ ভালো করেছ—বসো৷
মানিক ততক্ষণ তামাক সেজে কেদারের হাতে দিয়ে বললে, তামাক ইচ্ছে করুন!
কেদারের মনে অকস্মাৎ তুমুল আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল৷ বাইরের ঝিরঝিরে মিঠে ফাল্গুনের হাওয়ায় আমের বউলের সুঘ্রাণ, একটা আঁকোড় ফুলের গাছে সাদা ফুল ধরেছে—সামনে এখন অর্ধেক রাত পর্যন্ত গানবাজনার গমগমে আসর, কত লোকজন, ছেলে-ছোকরা আসবে, মানুষের জীবনে এত আনন্দও আছে!
তামাক খেতে খেতে কেদার খুশির আতিশয্যে বলে উঠলেন, ওহে রিষিকেশ, এদিক এসো—ততক্ষণ তোমার আয়ান ঘোষের পার্টটা একবার মুখস্ত বলে যাও শুনি—
কেদারের হুকুম অমান্য করবার সাধ্য নেই কারো এ আসরে৷ হৃষিকেশ কর্মকার দু-একবার ঢোঁক গিলে, দু-একবার ঘরের আড়ার দিকে তাকিয়ে বিপন্ন মুখে বলতে শুরু করলে—‘অদ্য পৌর্ণমাসি রজনী, যমুনা পুলিনের কি অদ্ভুত শোভা! কিন্তু অহো! আমার হৃদয়ে সহস্র বৃশ্চিকদংশনের মতো এরূপ মর্মঘাতী জ্বালা অনুভব করিতেছি কেন?—কোকিলের কুহু-ধ্বনি আমার কর্ণকুহরে—’
—আঃ দাঁড়াও দাঁড়াও, অমন নামতা মুখস্ত বলে গেলে হবে না৷ থেমে দমক দিয়ে দিয়ে বলো—কাঠের পুতুলের মতো অমন আড়ষ্ট হয়ে থাকার মানে কি? হাত-পা নড়ে না?
এই সময় কয়েকজন লোক এসে ঢুকল৷ কেদারের ঝোঁক গানবাজনার দিকে, শুধু বক্তৃতার তালিম তাঁর মনে পুরো আনন্দ দিতে পারে নি এতক্ষণ, নবাগতদের মধ্যে বিশ্বেশ্বর পালের ছেলে নন্দকে দেখে তিনি হঠাৎ অতিমাত্রায় খুশি হয়ে উঠলেন৷
—আরে ও নন্দ, এত দেরি করে এলি বাবা, তবেই তুই রাধিকা সেজেছিস! বারোখানা গান তোমার পার্টে, আজই সব তালিম দেওয়া চাই, নইলে আর কবে কি হবে শুনি? বোস, বেয়ালা বেঁধে নি—গানগুলো আগে হয়ে যাক৷
দু-একজন ক্ষীণ আপত্তি তুলবার চেষ্টা করলে৷ ছিবাস মুদির নন্দ ঘোষের পার্ট, সে বললে, এ্যাকটোর সঙ্গে সঙ্গে গান চললে একানে গানগুলো ভালো রপ্ত হয়ে যেত বাবাঠাকুর—নইলে এ্যাকটো আড়ষ্ট মেরে যাবে যে!
কেদার মুখ খিঁচিয়ে বললে, থামো না ছিবাস৷ বোঝ তো সব বাপু—কিসে কি হয় সে আমি খুব ভালো জানি৷ একানে গান আগে না তালিম দিয়ে নিয়ে নিলে শেষকালে এ্যাকটোর সময় গান গাইতে গেলে ভয়েই গলা শুকিয়ে যাবে৷ তুমি তোমার নিজের পাট দ্যাখো গিয়ে বাইরে বসে—
ছিবাস ধমক খেয়ে অপ্রতিভ হয়ে গেল৷ এর পরে আর কেউ কোনো প্রকার প্রতিবাদ করতে সাহস করলে না, কেদারের মুখের ওপর প্রতিবাদ কখনো বড় একটা করেও না কেউ৷
সুতরাং গান-বাজনা চলল পুরোদমে৷
ক্রমে সব লোক এসে জড় হয়ে গেল—ঘরে বসবার জায়গা দিতে পারা যায় না৷ বাইরের দাওয়ায় গিয়ে অনেকে বসলো৷ বাইরে যাবার আরও একটা কারণ এই, এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেছোকরা ও বাইশ-তেইশ থেকে ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক, এরা কেদারের সামনে বিড়ি বা তামাক খায় না—অথচ বেশিক্ষণ ধূমপান না করে তারা থাকতেও পারে না, বাইরের দাওয়া আশ্রয় করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই৷
গানে বাজনায় বক্তৃতায় গল্পে এবং সঙ্গে সঙ্গে তামাক ও বিড়ির ধোঁয়ায় মহলাঘরের বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে, এমন সময় দূরে কিসের চিৎকার শোনা গেল৷
কে একজন বললে, ও ছিবাস জ্যাঠা—চৌকিদার হাঁকছে যে বামুনপাড়ায়, অনেক রাত হয়েছে তবে!
দু-একজন উৎকর্ণ হয়ে শুনে বললে, তাই তো, রাতটা বেশি হয়ে গিয়েছে৷ বাবাঠাকুর, আজ বন্ধ করে দিলে হত না? আপনি আবার এতটা পথ যাবেন—
বিশু কুমোরের ছেলে এ পর্যন্ত গোটা আষ্টেক গানের তালিম দিয়ে এবং কেদারের কাছে বিস্তর ধমক খেয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল—সে করুণ দৃষ্টিতে কেদারের দিকে চাইলে৷
কেদার বললেন, ঘুম আসছে, না? তোর কিছু হবে না বাবা৷ কুমোরের ছেলে, চাক ঘোরাবি, ভাঁড় আর তিজেল হাঁড়ি গড়বি, তোর এ বিড়ম্বনা কেন বল দিকি বাপু? সেই সন্দে থেকে তোকে পাখিপড়া করছি, এখনও একটা গানও নিখুঁত করে গলায় আনতে পারলি নে—তোর গলায় নেই সুর তার কোত্থেকে কি হবে? বেসুরো গলা নিয়ে গান গাওয়া চলে?
আসলে তো একথা ঠিক নয়৷ বিশু ছেলেটি বেশ সুকণ্ঠ গায়ক, সবাই জানে, কেদারও তা ভালোই জানেন—কিন্তু তিনি বড় কড়া মাস্টার এবং তাঁর কথা বলবার ধরনই এই৷ ছেলেটির এ রকম তিরস্কার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, সুতরাং সে কেদারের কথায় দুঃখিত না হয়ে বললে—দাদাঠাকুর, বাড়িতে মার অসুখ—বাবা সকাল সকাল যেতি বলে দিয়েল—
—তা যা যা৷ আজ তবে থাক এই পর্যন্ত, কাল সবাই সকালে সকালে আসা হয় যেন৷ চল হে ছিবাস, চল হে রিষিকেশ—
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও কেদার উঠে পড়লেন, হুঁশ না করিয়ে দিলে তিনি আরও কতক্ষণ এখানে থাকতেন কে জানে!
কিন্তু মহলা-ঘরের বাইরে পা দিয়ে তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন, একি, হ্যাঁ ছিবাস, জ্যোৎস্না উঠে গিয়েছে যে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ বাবাঠাকুর, তাই তো দেখছি—
—তাই তো হে, আজ নবমী না? কৃষ্ণপক্ষের নবমী, ওঃ অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তা হলে!
পথে কিছুদূর পর্যন্ত একসঙ্গে এসে বিভিন্ন পাড়ার দিকে একে একে সবাই বেরিয়ে গেল কেদারকে ফেলে৷ দু-তিনজন কেদারকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাইলে—কিন্তু কেদার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একাই বাড়ির দিকে চললেন৷ গড়ের খাল পার হবার সময় নিশীথ রাত্রির জ্যোৎস্নালোকিত বন-ঝোপের দিকে চেয়ে চেয়ে কেদারের বেশ লাগল৷ কেদারের পিতামহ রাজা বিষ্ণুরামের স্বহস্তে রোপিত বোম্বাই আমের গাছে প্রচুর বউল এসেছে এবার—তার ঘন সুগন্ধে মাঝরাত্রির জ্যোৎস্নাভরা বাতাস যেন নেশায় ভরপুর, ভারি আনন্দে জীবনের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে মোটের উপর তাঁর৷ সকাল থেকে এত রাত পর্যন্ত সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় তা তিনি বুঝতে পারেন না৷
কি চমৎকার দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায় এই গড়বাড়ির জঙ্গল, ভাঙা ইট-পাথরের ঢিবিগুলো! সবাই বলে নাকি অপদেবতা আছে, তিনি বিশ্বাস করেন না৷ সব বাজে কথা!
কই এত রাত পর্যন্ত তো তিনি বাইরে থাকেন, একাই আসেন বাড়ি, কখনো কিছু তো দেখেন নি! বাল্যকাল থেকে এই বনে-ঘেরা ভাঙা বাড়িতে মানুষ হয়েছেন, এর প্রত্যেক ইটখানা, প্রত্যেক গাছটি, বনের লতাটি তাঁর প্রিয় ও পরিচিত৷ তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে এরা জড়ানো, তিনি যে চোখে এদের দেখেন, অন্য লোকে সে চোখ পাবে কোথায়?
কষ্ট হয় শরতের জন্যে৷
ওকে তিনি কোনো সুখে সুখী করতে পারলেন না৷ ছেলেমানুষ, ওর জীবনের কোনো সাধ পুরলো না৷ সারাদিনের কাজকর্ম ও আমোদ-প্রমোদের ফাঁকে ফাঁকে শরতের মুখখানা যখন তাঁর মনে পড়ে হঠাৎ, তখন বড় অন্যমনস্ক হয়ে যান কেদার৷ যেখানেই থাকুন, মনে হয় এখনি ছুটে একবার তার কাছে চলে যান৷
আহা, এত রাত পর্যন্ত মেয়েটা একা জঙ্গলে-ঘেরা বাড়ির মধ্যে থাকে, কাজটা ভালো হচ্ছে না—ঠিক নয় কেদারের এতক্ষণ বাইরে থাকা!
দোরে ঘা দিয়ে কেদার ডাকলেন, ও শরৎ, মা ওঠো, দোর খোলো—
দু-তিনবার ডাকের পর শরতের ঘুমজড়িত কণ্ঠের ক্ষীণ সাড়া পাওয়া গেল৷
—উঠে দোর খুলে দে—ও শরৎ—
শরৎ বিরক্তিভরা মুখে দোর খুলতে খুলতে বললে, আমি মরব মাথা কুটে কুটে তোমার সামনে বাবা৷ পারি নে আর—সন্দে হয়েছে কি এ যুগে! রাত কাবার হয়ে গেল—এখন তুমি বাড়ি এলে! পুবে ফর্সা হবার আর বাকি আছে?
—না না, আরে এই তো বামুনপাড়ার চৌকিদার হেঁকে গেল—রাত এখনও অনেক আছে৷ আর বকিস নে, এখন ভাত দে দিকি৷ খিদে পেয়েছে যা—
কেদার খেতে বসলে শরৎ ঝাঁঝের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
—কোথায় আর থাকব? আমাদের দলের মহলা হচ্ছে, সেখানে আমি না থাকলেই সব মাটি৷ যেদিকে আমি না যাব সেদিকেই কোনো কাজ হবে না৷
শরৎ একটু নরম সুরে বললে, যাত্রা কোথায় হবে? আমি কিন্তু যাব তোমার সঙ্গে৷
—তা ভালোই তো৷ বাড়ির মেয়েদের জন্যে চিক দিয়ে দেবে, যাবি তো ভালোই৷
শরৎ একটু চুপ করে থেকে বললে, বাবা, আজ প্রভাসদা এসেছিল৷
কেদার বিস্ময়ের সুরে বললেন, কোথায়? কখন?
—তুমি বেরিয়ে চলে গেলে, তার একটু পরেই৷ এখানে এসে বসলো৷ তার সঙ্গে আর একজন ওর বন্ধু৷ দু-জনকে চা করে দিলাম—খাবার কিছু নেই, কি করি—একটুখানি ময়দা পড়েছিল, তাই দিয়ে খানকতক পরোটা ভেজে দিলাম৷
—বেশ বেশ৷ কতক্ষণ ছিল?
—তা অনেকক্ষণ—প্রায় ঘণ্টাতিনেক৷ সন্ধ্যা হবার পরও খানিকক্ষণ ছিল৷
—কি বলে গেল?
—বেড়াতে এসেছিল৷ প্রভাসদা’র বন্ধু কলকাতার কোনো বড়লোকের ছেলে, বেশ চেহারা৷ নাম অরুণ মুখুজ্জে৷ আমাদের গড়বাড়ির গল্প শুনে সে এসেছিল প্রভাসদা’র সঙ্গে দেখতে৷ অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলে৷
—বড়লোকের কাণ্ড, তুইও যেমন! ঘরে পয়সা থাকলেই মাথায় নানা রকম খেয়াল গজায়৷ তার পর, দেখে কি বললে?
—খুব খুশি৷ আমাদের এখানে এসে কত রকম কথা বলতে লাগল, অরুণবাবু আবার আসবে, ফটোগ্রাফ নিয়ে যাবে! কি লিখবে নাকি আমাদের গড়বাড়ি নিয়ে৷ আমায় তো একেবারে মাথায় তুললে৷
—ওই তো বললাম, বড়লোকের যখন যেটি খেয়াল চাপবে! কলকাতায় মানুষের অভাব নেই—আমাদের মতো দুঃখ-ধান্দা করে যদি খেতে হত—
শরতের হাসি পেল বাবার দুঃখ-ধান্দা করে খাবার কথায়৷ জীবনে তিনি তা কখনো করেন নি৷ কাকে বলে তা এখনও জানেন না৷ কিসে কি হয় তা শরৎ ভালো করেই জানে৷
যেমন আজকের দিনের কথা৷ শরৎ হুবহু সত্য কথা বলে নি৷ ঘরে কিছুই ছিল না৷ ওরা গেল৷ ভাঙা ইট কাঠ দেখতে, গড়বাড়ি ঘুরতে—সেই ফাঁকে শরৎকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হল রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি ময়দা ও ঘি ধার করতে৷ সেখানে পাওয়া গেল তাই মান রক্ষে৷ সব দিন আবার সেখানেও পাওয়া যায় না৷
রাজলক্ষ্মী ওদের কথা শুনে দেখতে এসেছিল৷ সে-ই চা ও খাবার পরিবেশন করেছিল প্রভাস ও তার বন্ধুকে৷
আর একটা কথা শরৎ বলে নি বাবাকে৷ প্রভাস ওকে একটা মখমলের বাক্স দিয়ে গিয়েছে৷ কেমন চমৎকার বাক্সটা৷ তার মধ্যে গন্ধতেল, এসেন্স পাউডার আরও সব কি কি! না নিলে প্রভাসদা কি মনে করবে, সে বাক্সটা হাত পেতে নিয়েছিল—কলকাতার ছেলে, ওরা হয়তো বোঝে না যে বিধবা মানুষের ওসব ব্যবহার করতে নেই৷ তার যে কোনো বিষয়ে কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই, সব বিষয়ে সে নিস্পৃহ, উদাসী—কেমন এক ধরনের! এ বয়সেই মেয়ের সন্ন্যাসিনী মূর্তি—তার বাবার ভালো লাগে না৷ শরৎ তা জানে৷ বাবাকে বলে কি হবে বাক্সটার কথা, যখন সেটা সে রাখবে না৷
কেদার আহারান্তে তামাক খেতে বসলেন বাইরের দাওয়ায়৷
শরৎ বলল, বাইরে কেন বাবা, ঘরে বসে খাও না তামাক, আজকাল রাত্তিরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে৷ দিনে গরম রাতে ঠাণ্ডা যত অসুখের কুটি৷
গভীর রাত্রি৷
বিছানায় শুয়ে একটা কথা তার মনে হল বার বার৷ এর আগেও অনেক বার মনে হয়েছে৷ প্রভাস-দার বন্ধু অরুণবাবুর চেহারা বেশ সুন্দর, অবস্থাও ভালো৷ রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়া যেত!
রাজলক্ষ্মী এল তিনদিন পরে৷
সে গড়ের বনে সজনে ফুল কুড়ুতে এসেছিল, কোঁচড় ভর্তি করে ফুল কুড়িয়ে বাড়ি ফিরবার পথে শরতের রান্নাঘরে উঁকি মেরে বললে, ও শরৎদি, সজনে ফুল রাখবে নাকি? কত ফুল কুড়িয়েছি দ্যাখো—তোমাদের ওই পুকুরের কোণের গাছে!
শরৎ রান্না চড়িয়েছিল, ব্যস্তভাবে খুশির সুরে বললে, ও রাজলক্ষ্মী আয় আয়, দেখি কেমন ফুল? আয় তোকে আমি খুঁজছি ক’দিন৷ কথা আছে তোর সঙ্গে৷
একটা ছোট চুবড়ি এনে বললে, দে এতে চাট্টি ফুল৷ বেশ কুঁড়ি কুঁড়ি ফুলগুলো, ভাজব এখন৷ বাবা বড্ড খেতে ভালোবাসেন৷
—শরৎদি, আমাদের ওদিকে তুমিও তো যাও না ক’দিন?
—না ভাই, বাবার পায়ে বাত মতো হয়ে ক’দিন কষ্ট পেলেন৷ তাঁর তাপসেঁক—আবার এদিকে সংসারের ছিষ্টি কাজ, এর পরে সময় পাই কখন যে যাব বল! চা খাবি?
—না শরৎদি, বেলা হয়ে গেল—আর বেশিক্ষণ থাকলে এবেলা ফুলগুলো ভাজা হবে কখন? এ বেলা যাই—ও বেলা বরং আসব৷
—দাঁড়া, তোর জন্যে একটা জিনিস রেখে দিয়েছি, নিয়ে যা—
শরৎ মখমলের বাক্সটা এনে ওর হাতে দিয়ে বললে, দ্যাখ তো কেমন? খুলে দ্যাখ—
অপ্রত্যাশিত আনন্দে ও বিস্ময়ে রাজলক্ষ্মীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক মুহূর্তে৷ বাক্সটা খুলতে খুলতে বললে, কোথায় পেলে শরৎদি?
—প্রভাসদা দিয়ে গিয়েছিল সেদিন৷
রাজলক্ষ্মী শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, তা তুমি রাখলে না?
শরৎ মৃদু হেসে বললে, ওর মধ্যে দ্যাখ না কত কি—পাউডার, মুখে মাখবার ক্রিম—আমি কি করব ও সব! তুই নিয়ে গিয়ে রাখলে আমার আনন্দ হবে৷
রাজলক্ষ্মী কিছু ভেবে বললে, যদি মা জিজ্ঞেস করে কোথায় পেলি?
—বলিস আমি দিয়েছি!
—এ নিয়ে কেউ কিছু বলবে না তো? জানো তো নিমু ঠাকরুণকে, গাঁয়ের গেজেট৷ প্রভাসবাবুর কথা বলব না—কি বলো?
—সত্যি কথা বলছি, এতে আর ভয় কি? নিমু ঠানদি এতে বলবে কি? বলিস প্রভাসবাবু দিয়েছিল শরৎদিকে৷
—ভারি খারাপ মানুষ সব শরৎদি৷ তুমি যত সহজ আর ভালো ভাবো সবাইকে, অত ভালো কেউ নয়৷ আমার আর জানতে বাকি নেই৷ সেবার যে এখানে প্রভাসবাবু এসেছিল, এ কথা গাঁয়ে রটনা হয়ে গিয়েছে৷ কাল যে এসেছিল আবার—তা নিয়েও কাল কথা হয়েছে৷
শরৎ বিস্ময়ের সুরে বললে, বলিস কি রে? কি কথা হয়েছে?
—অন্য কথা কিছু নয় শরৎ দিদি৷ শুধু এই কথা যে প্রভাসদা তোমাদের বাড়ি আসা-যাওয়া করছে আজকাল৷ তুমি না হয়ে অন্য মেয়ে যদি হত, তা হলে অনেকে অন্য রকম কথাও ওঠাতো—নিমু ঠাকরুণ, আমার জ্যাঠাইমা, হীরেন কাকার মা, জগন্নাথ দাদু—এরা৷ কিন্তু তুমি বলেই কেউ কিছু বলতে সাহস করে না৷
শরৎ যাত্রার দলের সুর নকল করে টেনে টেনে হাত নেড়ে বললে, দেশের রাজকন্যার নামে অপকলঙ্ক রটাবে, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? সব তা হলে গর্দান নেব না দুরাচারদের?
রাজলক্ষ্মী হি হি করে হেসে লুটিয়ে পড়ে আর কি! মুখে কাপড় গুঁজে হাসতে হাসতে বললে, উঃ, এত মজাও তুমি করতে জানো শরৎদি! হাসিয়ে মারলে—মাগোঃ—
শরৎ হাসিমুখে বললে, তবে একটু বসে যা লক্ষ্মী দিদি আমার৷ দুটো মুড়ি খেয়ে যা—
রাজলক্ষ্মী দুর্বল সুরের প্রতিবাদ জানিয়ে বললে, না শরৎদি—ফুল ভাজা হবে কখন তা হলে এবেলা? আমায় আটকো না—
—বোস৷ আমিও খাচ্ছি দুটো মুড়ি—নারকেল-কোরা দিয়ে৷ তুইও খাবি৷ যেতে দিলে তো? সজনে ফুলের দুর্ভিক্ষ লাগে নি গড়শিবপুরে—
খানিক পরে শরৎ মুড়ি খেতে খেতে বললে, শোন রে, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে৷ অরুণবাবু এসেছিল প্রভাসদা’র সঙ্গে, দেখেছিস তো? ওর সঙ্গে তোর বিয়ের কথা পাড়ব প্রভাসদা’র কাছে? অরুণবাবুরা বেশ অবস্থাপন্ন৷ বেশ ভালো হবে৷
রাজলক্ষ্মী সলজ্জ দৃষ্টিতে শরতের মুখের দিকে চেয়ে বললে, কি যে তুমি বলো শরৎদি! এক-এক সময় এমন ছেলেমানুষ হয়ে যাও!
—ছেলেমানুষ হওয়া কি দেখলি?
—ওরা আমায় নেবে কেন? আমার কি রূপগুণ আছে বলো! তুমি যে চোখে আমায় দ্যাখো—সকলে কি সে চোখে দেখবে?
—সে ভাবনায় তোর দরকার নেই৷ তুই শুধু আমায় বল, প্রভাসদা’র কাছে কথা আমি পাড়ব কিনা৷ অরুণবাবুকে পছন্দ হয়?
—দূর—কি যে বলো! শরৎদি একটা পাগল—
—সোজা কথাটা কি বল না?
—ধরো যদি বলি হয়—তুমি কি করবে?
—তাই বল৷ আমি প্রভাসদা’র কাছে তা হলে কথাটা পেড়ে ফেলি৷
রাজলক্ষ্মী চুপ করে রইল৷ শরৎ বললে, বাড়িতে বা অন্য কারো কাছে বলিস নে কোনো কথা এখন৷
রাজলক্ষ্মী হাত নেড়ে বললে, হ্যাঁ, আমি বলে বেড়াতে যাই, ওগো আমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে সবাই শোনো গো৷ একটা কথা, জ্যাঠামশাইকে যেন বোলো না শরৎদি৷
—বাবাকে? ও বাপ রে! এখুনি সারা গাঁ পরগণা রটে যাবে তা হলে৷ পাগল তুই, তা কখনো বলি?
রাজলক্ষ্মী বিদায় নিয়ে বাড়ি যাবার পথে গড়ের খাল পার হয়ে দেখলে, কেদার একটা চুপড়িতে আধ-চুপড়ি বেগুন নিয়ে হন হন করে আসছেন৷
ওকে দেখে বললেন, ও বুড়ি, ওঃ কত সজনে ফুল রে!—কোত্থেকে? তা বেশ৷ শরতের সঙ্গে দেখা করে এলি তো?
—হ্যাঁ জ্যাঠামশায়, শরৎদির সঙ্গে দেখা না করে আসবার জো আছে? আর না খাইয়ে কখনো ছাড়বে না!
—হ্যাঁঃ, ভারি তো খাওয়া! কি খেতে দিলে?
—মুড়ি মাখলে, ও খেলে, আমি খেলাম৷
—তা যা মা—বেলা হয়ে গেল আবার—
রাজলক্ষ্মী দূর থেকে কেদারকে আসতে দেখে মখমলের বাক্সটা কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল—সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল৷ কথা শেষ করে কেদারের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলো সে৷
কিন্তু কিছু দূর যেতেই সে শুনলে কেদার তাকে পেছন থেকে ডাকছেন—ও বুড়ি, শুনে যা৷ একটু দাঁড়িয়ে যা—
—কি জ্যাঠামশায়?
—এই বেগুন ক’টা আনলাম গেঁয়োহাটির তারক কাপালির বাড়ি থেকে৷ তুই নিয়ে যা দুটো৷ সজনে ফুলের সঙ্গে বেশ হবে এখন—
রাজলক্ষ্মী বিব্রত হয়ে পড়ল৷ এক হাতে সে বাক্সটা ধরে আছে, অন্য হাতে ফুলে ভর্তি আঁচল৷ বেগুন নেয় কোনো হাতে? কিন্তু কেদার সদাই অন্যমনস্ক, কোনোদিকে ভালো করে লক্ষ করে দেখবার সময় নেই৷ কোন রকমে গোটাচারেক বেগুন রাজলক্ষ্মীর সামনে নামিয়ে রেখে তিনি চলে যেতে পারলে যেন বাঁচেন, এমন ভাবে দেখালেন৷
রাজলক্ষ্মী ভাবলে—জ্যাঠামশায় বড় ভালো৷ এ গাঁয়ে ওঁদের মতো মানুষ নেই৷ শরৎদি কি ভালোই বাসে আমায়৷ এ গাঁ থেকে যদি বিয়ে হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাই, শরৎদিকে না দেখে কি করে থাকব তাই ভাবি৷ পাছে বাড়িতে জ্যাঠাইমা টের পায়, এজন্যে রাজলক্ষ্মী বাক্সটা সন্তপর্ণে লুকিয়ে বাড়ি ঢুকল৷ মাকে ডেকে বললে, এই দ্যাখো মা—
রাজলক্ষ্মীর মা বাক্সটা হাতে নিয়ে বললে, বাঃ দেখি দেখি—কোথায় পেলি রে? শরৎ দিলে? চমৎকার জিনিসটা৷ আমরা বাপু সেকেলে লোক, কখনো চক্ষেও দেখি নে এসব৷ শরৎ কোথায় পেলে রে?
রাজলক্ষ্মী বললে, ওকে প্রভাসদা কাল দিয়েছিল৷ তা ও তো এসব মাখবে না—জানো তো ওকে৷ তাই আমায় বললে, তুই নিয়ে যা৷ এ কথা কাউকে বোলো না কিন্তু মা৷
দু-দিন পরে কেদার একদিন সকালে বললে, শরৎ মা, আমি আজকে একবার তালপুকুর যাব খাজনা আদায় করতে, আমার আসতে একদিন দেরি হতে পারে, একটু সাবধানে থেকো৷
শরৎ বলল, বেশি দেরি কোরো না বাবা, তুমি যেখানে যাও আসবার নামটি করতে চাও না তো! আমি একলা থাকব মনে করো৷
কেদার একবার বাড়ির বার হলে ফিরবার কথা ভুলে যান, একথা শরৎ ভালোভাবেই জানে৷ মুখে বললেও শরৎ জানে বাবা এখন দিন দু-তিনের মতো গা-ঢাকা দিলেন৷ সেদিন সে রাজলক্ষ্মীকে বলে পাঠালো একবার দেখা করতে৷
দুপুরের পর রাজলক্ষ্মী এসে বললে, কি শরৎ দিদি, ডেকেছিলে কি জন্যে?
—বাবা গিয়েছেন তালপুকুরে খাজনা আদায় করতে, আমাদের বাড়ি দু-দিন রাত্রে শুবি?
রাজলক্ষ্মী বললে, মা থাকতে না দিলে তো থাকা হবে না৷ আচ্ছা, বলে দেখব এখন৷
—এইখানেই খাবি কিন্তু এবেলা—
—ওই তো তোমার দোষ শরৎদি, কেন, বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারি নে?
—পারবি নে কেন, তবে দুজনে মিলে খেলে বেশ একটু আনন্দ পাওয়া যায়৷ খাবি ঠিক বললাম কিন্তু৷
দুপুরের অনেক পরে রাজলক্ষ্মী এসেছে৷ বেলা প্রায় গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল৷ পুকুরঘাটে ছাতিমবনের দীর্ঘ ছায়া পড়ে গিয়েছে, যখন ওরা দুজনে পুকুরঘাটে এসে বসলো৷
মুখে বিদেশে যাবার যত ইচ্ছেই ওরা প্রকাশ করুক, এই গ্রাম ওদের অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে এর ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস নিয়ে, ঘুঘু ও ছাতারে পাখির ডাক নিয়ে, প্রথম হেমন্তে গাছের ডালে ডালে আলকুশী ফলের দুলুনি নিয়ে—এর সমস্ত রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে৷ শরৎ যখনই এই দিঘির বাঁধা ঘাটের পাড়ে বসে ছাতিমবনের দিকে তাকায়, তখন মনে হয় ওর, সে কত যুগ থেকে এই গ্রামের মেয়ে, তার সমস্ত দেহমন-চেতনাকে আশ্রয় করে আছে এই ভাঙা গড়বাড়ি, এই কালো পায়রার দিঘি, এই পুরনো আমলের মন্দিরগুলো, এই ছাতিমবন, ইটের স্তূপ৷
ঋতুতে ঋতুতে ওদের পরিবর্তনশীল রূপ ওর মন ভুলিয়েছে৷ শরৎ অত ভালো করে বোঝে না, ঋতুর পরিবর্তন সম্বন্ধে তার মন তত সজাগ নয়, তবুও ভালো লাগে৷ বুদ্ধি দিয়ে না বুঝলেও অন্য একটা অনুভূতি দিয়ে তার মন এর সৌন্দর্যকে নিতে পারে৷
শরৎ পুকুরপাড়ে বাসন নামিয়েই বললে, রাজলক্ষ্মী, পাতাল-কোঁড় তুলে আনবি? ওই উত্তর দেউলের ওদিকের জঙ্গলে সেদিন অনেক ফুটেছিল—চল দেখে আসি৷
—এখন বর্ষাকাল নয়, এখন বুঝি পাতাল-কোঁড় ফোটে?
—ফুটে বনের তলা আলো করে আছে, বলে ফোটে না! চল না দেখবি—
—আমার বড্ড ভয় করে শরৎদি ও বনে যেতে, তুমি চলো আগে আগে—
বাসন সেখানেই পড়ে রইল৷ গড়শিবপুরে এ পর্যন্ত কোনো জিনিস ফেলে রাখলে চুরি যায় নি৷ কতদিন এমন দিঘির ঘাটে এঁটো বাসন জলে ডুবিয়ে রেখে চলে যায়, সারারাত হয়তো পড়ে থাকে—তার পরদিন সকালে সে-সব বাসন মাজা হয়—একটা ছোট তেলমাখা বাটিও চুরি যায় নি৷ শরৎদি’র ঘরে বেশি জায়গা নেই বলে কত জিনিসপত্র বাইরেই পড়ে থাকে দিনরাত৷ শুধু গড়ের মধ্যে বলে যে এমন তা নয়, এ-সব পল্লীঅঞ্চলে চোরের উপদ্রব আদৌ নেই৷
ঘন নিবিড় বনের মধ্যে রাজলক্ষ্মীর গা ছমছম করতে লাগল৷ শরৎদি শক্ত মেয়েমানুষ, ওর সাহস বলিহারি—ও সব পারে৷ বাবাঃ, এই বনে মানুষ ঢোকে পাতালকোঁড়ের লোভে?
—ও শরৎ দিদি, সাপে খাবে না তো? তোমাদের গড়ের ইটের ফাটলে ফাটলে সাপ বাবা—
শরৎ কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বললে, অমন করে আমার বাপের বাড়ির নিন্দে করতে দেব না তোকে—আমাদের এখানে যদি সাপ থাকত তবে আমায় এতদিন আস্ত থাকতে হত না৷ আমার মতো বনে-জঙ্গলে তো তুমি ঘোরো না! কি বর্ষা, কি গরমকাল, ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, অন্ধকার নেই—একলাটি বনের মধ্যে দিয়ে যাব উত্তর দেউলে সন্দে পিদিম দিতে—তা ছাড়া এই বনে কাঠ কুড়িয়ে বেড়াই, বাবা কি যোগাড় করে দেন?
এক জায়গায় রাজলক্ষ্মী থমকে দাঁড়িয়ে বললে, দ্যাখো দ্যাখো শরৎ দিদি, কত পাতাল কোঁড়—বেশ বড় বড়—
শরৎ তাড়াতাড়ি এসে বললে, কই দেখি?
পরে হেসে বলে উঠল—দূর! ছাই পাতাল কোঁড়—ও সব ব্যাঙের ছাতা, অত বড় হয় না পাতাল-কোঁড়—ও খেলে মরে যায় জানিস? বিষ—
—সত্যি শরৎদি?
—মিথ্যে বলছি? ব্যাঙের ছাতা বিষ—
—আমি খেলে মরে যাব—
—বালাই ষাট—কি দুঃখে?
—বেঁচে বা কি সুখ শরৎদি? সত্যি বলছি—
—কেন, জীবনের উপর এত বিতেষ্টা হল যে হঠাৎ?
—অনেকদিন থেকেই আছে৷ এক এক সময় ভাবি আমাদের মতো মেয়ের বেঁচে কি হবে শরৎদি? না আছে রূপ, না আছে গুণ—এমনি করে কষ্টস্রেষ্ট করে ঘুঁটে কুড়িয়ে আর বাসন মেজেই তো সারাজীবন কাটবে?
—সুখ যদি জুটিয়ে দিই? তা হলে কিন্তু—
—তোমার সেই সেদিনের কথা তো? তুমি পাগল শরৎদি—
—তুই রাজি হয়ে যা না!
—সেই জন্যে আটকে রয়েছে৷ তোমার যেমন কথা—
—এবার প্রভাসদাকে বলব, দেখিস হয় কি না—
হঠাৎ রাজলক্ষ্মী উৎকর্ণ হয়ে বললে, চুপ শরৎদি, বনের মধ্যে কারা আসছে—
শরতের তাই মনে হল৷ কাছের পায়ের শব্দ বনের ওপাশে৷ শরৎ ও রাজলক্ষ্মী একটা গাছের আড়ালে লুকুলো৷ দুজন লোক বনের মধ্যে কি করছে৷ কিসের শব্দ হচ্ছে যেন৷ শরৎ চুপি চুপি বললে, কারা দেখতে পাচ্ছিস?
—না শরৎদি, চলো পালাই—
—পালাবো কেন? বাঘভাল্লুক তো না—তুই দাঁড়া না—
একটু সরে শরৎ আবার বললে, দেখেছিস মজা? রামলাল কাকার ছেলে সিদু আর ওপাড়ার জীবন শুঁড়ির ভাই হরে শুঁড়ি৷
হঠাৎ শরৎ কড়া গলায় সুর চড়িয়ে বললে, কে ওখানে?
দুপ দুপ দ্রুত পদশব্দ৷ তারপর সব চুপচাপ৷
শরৎ বললে, আয় তো গিয়ে দেখি—কি করছিল মুখপোড়ারা—
রাজলক্ষ্মী চেয়ে দেখলে শরতের যেন রণরঙ্গিণী মূর্তি৷ ভয় ও সঙ্কোচ এক মুহূর্তে চলে গিয়েছে তার চোখমুখ থেকে৷ রাজলক্ষ্মী ভয় পেয়ে বললে, ও শরৎদি, ওদিকে যেয়ো না—পরে শরৎ নিতান্তই গেল দেখে সে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে চলল৷ খানিকদূর দিয়ে দুজনেই দেখলে, যেখানে উত্তর দেউলের পুব কোণে একটা ভাঙা পাথরের মূর্তি পড়ে আছে ঘন লতাপাতার ঝোপের মধ্যে—সেখানে একটা লোহার শাবল পড়ে আছে, কারা খানিকটা গর্ত খুঁড়েছে আর কতকগুলো মাটিতে পোঁতা ইট সরিয়েছে৷
শরৎ খিল খিল করে হেসে বললে, মুখপোড়াদের বিশ্বাস গড়ের জঙ্গলে সর্বত্র ওদের জন্যে টাকার হাঁড়ি পোঁতা রয়েছে৷ গুপ্তধন তুলতে এসেছিল হতচ্ছাড়া ড্যাকরারা, এরকম দেখে আসছি ছেলেবেলা থেকে কেউ এখানে খুঁড়েছে, কেউ ওখানে খুঁড়েছে—আর সব খুঁড়বে কিন্তু লুকিয়ে৷ পাছে ভাগ দিতে হয়! যাক—শাবলখানা লাভ হয়ে গেল৷ চল নিয়ে চল—
রাজলক্ষ্মীও হেসে কুটিপাটি৷ বললে, ভারি শাবলখানা নিয়ে পালাতে পারলে না! তোমার গলা শুনেই পালিয়েছে—তোমাকে সবাই ভয় করে শরৎদি—
বনের পথ দিয়ে ওরা আবার যখন দিঘির ঘাটে এসে পৌঁছলো, তখন বেলা বেশ পড়ে এসেছে৷ আর রোদ নেই ঘাটের সিঁড়িতে, তেঁতুল গাছের ডালে দু-একটা বাদুড় এসে ঝুলতে শুরু করেছে৷ ওরা তাড়াতাড়ি বাসন মেজে নিয়ে বাড়ির দিকে চলল৷
শরৎ বললে, এবার কিছু খা—তার পর বাড়ি গিয়ে বলে আয় খুড়িমাকে এখানে থাকবার কথা রাতে৷
রাজলক্ষ্মী ব্যস্তভাবে বললে, না শরৎদি, সন্দের আর দেরি নেই৷ আমি আগে বাড়ি যাই৷ অনেকক্ষণ বেরিয়েছি বাড়ি থেকে, মা হয়তো ভাবছে—
—বোস আর একটু—একটু চা করি, খেয়ে যা—
শাবল ফেলে ওদের পালানো ব্যাপারটাতে শরৎ ও রাজলক্ষ্মী খুব মজা পেয়েছে৷ তাই নিয়ে হাসিখুশি ওদের যেন আর ফুরোতে চায় না৷
রাজলক্ষ্মী বললে, তোমার সাহস আছে শরৎ দিদি, আমি হলে পালিয়ে আসতাম—
—এই রকম না করলে হয় না, বুঝলি? সব সময় ভীতু হয়ে থাকলে সবাই পেয়ে বসে—আর কখনো ওরা আসবে না দেখিস৷
—যদি আমার না আসা হয়, একলা থাকতে পারবে শরৎদি?
শরৎ হেসে বললে, কতবার তো থেকেছি৷ এমনিতেই বাবা এত রাত করে বাড়ি ফেরেন, এক একদিন আমার একঘুম হয়ে যায়৷ বাবার কি কোনো খেয়াল আছে নাকি?
তার পর সে ঈষৎ লাজুক মুখে মুখ নিচু করে বললে, বাবার জন্যে মন কেমন করছে—
—ওমা, সে কি শরৎ দিদি! আজ তো জ্যাঠামশাই সবে গেলেন—
—সেজন্যে না৷ বিদেশে কোথায় খাবেন কোথায় শোবেন, উনি বাড়ি থেকে বেরুলেই আমার কেবল সেই ভাবনা৷
—জলে তো আর পড়ে নেই? লোকের বাড়ি গিয়েই উঠেছেন তো—
—তুই জানিস নে ভাই—ওঁর নানান বাচবিচার৷ এটা খাবে না ওটা খাবে না—দুনিয়ার আদ্ধেক জিনিস তাঁর মুখে রোচে না৷ আমায় যে কত সাবধানে থাকতে হয়, তা যদি জানতিস! পান থেকে চুণ খসলেই ভাতের থালা ফেলে উঠে গেলেন৷ আমার হয়েছে ওঁকে নিয়ে সব চেয়ে বড় ভাবনা৷ একেবারে ছেলেমানুষের মতো!
রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে বললে, তোমার বুড়ো ছেলেটি শরৎ দিদি—আহা কোথায় গেল, মায়ের প্রাণ, ভাবনা হবে না?
শরতের চোখ ছলছল করে উঠল৷ আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললে, তাই এক এক সময় ভাবি, ভগবান আমায় যেন এর মধ্যে টেনে নিয়ো না৷ বুড়ো বয়সে বাবা বড় কষ্ট পাবেন৷ ওঁকে ফেলে আমার স্বর্গে গিয়েও সুখ হবে না—উনি মারা যান আগে, তার পর আমি কষ্ট পাই দুঃখ পাই, যা থাকে আমার ভাগ্যে৷
—আমি এবার যাই শরৎদি—সন্দের আর দেরি কি?
—তুই কিন্তু আসবি ঠিক—খুব চেষ্টা করবি, কেমন তো? একলা আমি থাকতে পারি, সেজন্যে না৷ দুজনে থাকলে বেশ একটু গল্পগুজব করা যেত—মুখ বুজে এই নিবান্দা পুরীর মধ্যে থাকতে বড় কষ্ট হয়৷
রাজলক্ষ্মী চলে গেলে শরৎ সলতে পাকাতে বসলো—তার পর শাঁখ বাজিয়ে চৌকাঠে জলের ধারা দিয়ে তার অভ্যাসমতো ছোট্ট একটি প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে উত্তর দেউলে সন্ধ্যাদীপ দিতে চলল৷ সঙ্গে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেউলে বসে প্রদীপ জ্বালানোও চলে বটে, কিন্তু এদের বংশের নিয়ম ঘরের সন্ধ্যাদীপ থেকে জ্বালিয়ে নিয়ে যেতে হয় মন্দিরের প্রদীপ৷ তবে যদি ঝড়েবৃষ্টিতে পথে সেটা নিবে যায়, অগত্যা সেখানে বসেই জ্বালাতে হয়—উপায় কি?
উত্তর দেউলের পথে শরতের কেবলই মনে হচ্ছিল, আবার হয়তো সেইখানে খুঁড়তে আরম্ভ করেছে৷ সে একবার গিয়ে দেখবে নাকি? তা হলে বেশ মজা হয়—
কথাটা মনে আসতেই শরৎ আপনমনেই হি-হি করে হেসে উঠল৷
—উঃ শাবল ফেলেই ছুট দিলে! এ গুপ্তধন না তুললে নয় মুখপোড়াদের! ওদের জন্যে আমার ঠাকুরদাদা কলসি কলসি মোহর পুঁতে রেখে গিয়েছে! যদি থাকে তো আমরা নেব আমাদের জিনিস—তোরা মরতে আসিস কেন হতভাগারা?
শরৎ হঠাৎ থমকে দাঁড়াল এবং একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে একটা নতুন সিগারেটের বাক্স পড়ে আছে উত্তর দেউলের পৈঠার ওপরেই৷ এ বনের মধ্যে সন্ধ্যাবেলা সিগারেট খেয়েছে কে? এখানকার লোকে সিগারেট খাবে না, তাদের তামাক জোটে না সিগারেট তো দূরের কথা! বাক্সটা হেলাগোছা ভাবে ফেলা নয়, কে যেন তা যাবার পথে ইচ্ছে করে রেখেছে!
প্রদীপ দেখিয়ে এসে ও সিগারেটের বাক্সটা হাতে তুলে নিলে, খালি বাক্স অবিশ্যি৷
রাংতাটা আছে ভেতরে৷ বেশ পাওয়া গিয়েছে৷ সিগারেটের রাংতা বেশ জিনিস৷ তবে এ গাঁয়ে মেলে না, কে আর সিগারেট খাচ্ছে!
শরতের হাত থেকে সিগারেটের বাক্সটা পড়ে গেল৷ তার মধ্যে একটানা চিঠি৷ শরৎ বিস্ময়ে ও কৌতূহলে পড়ে দেখলে, লেখা আছে—
‘‘আমি তোমার জন্যে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা মন্দিরের পেছনে কতক্ষণ
বসেছিলাম৷ তুমি এলে না৷ তোমাকে কত ভালোবাসি, তা তুমি জানো না৷
যদি সাহস দাও, লক্ষ্মীটি, তবে কালও এই সময় এইখানেই থাকব৷’’
শরৎ খানিকটা অবাক হয়ে থেকে চারিদিকে চেয়ে চেঁচিয়েই বললে, আ মরণ চুলোমুখো আপদগুলো! আচ্ছা, আবার চিঠি লেখা পর্যন্ত শুরু করেছে—হ্যাঁ? এ-সব কি কম খ্যাংরার কাজ? কাল এসো, থেকো না জঙ্গলের মধ্যে, থেকো! বঁটি দিয়ে একটা নাক যদি কেটে না নিই, তবে আমার নাম নেই—যমে ভুলে আছে কেন তোমাদের, ও মুখপোড়ারা?
রাগে গরগর করতে করতে শরৎ বাড়ি এসে দেখলে রাজলক্ষ্মী বসে আছে৷ বাড়ি থেকে সে একটা লণ্ঠন নিয়ে এসেছে৷ শরৎ খুশি হয়ে বললে, এসেছিস ভাই!
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, না, একেবারে আসি নি শরৎ দিদি৷ মা বললে, বলে আয়, রাত্তিরে থাকা হবে না৷
—সত্যি?
—সত্যি শরৎদি৷ আমি কি বাজে কথা বলছি?
—তবে তুই আর কষ্ট করে এলি কেন?
—কথাটা বলতে এলাম শরৎ দিদি৷ তুমি আবার হয়তো কি মনে করবে, তাই৷ রাজকন্যে তুমি৷
রাজলক্ষ্মীর কথা বলার ধরনে শরতের সন্দেহ হল৷ সে হেসে বললে, যাঃ, আর চালাকি করতে হবে না! আমি আর অত বোকা নই—বুঝলি?
রাজলক্ষ্মী খিল খিল করে হেসে উঠে বললে, কিন্তু তোমায় প্রথমটা কেমন ভাবিয়েছিলাম বলো না?
শরৎ বললে, যাঃ, আমি গোড়া থেকেই জানি৷ খুড়িমা এখানে রাত্তিরে থাকতে না দিলে তোকে আলো নিয়ে আসতে দিতেন না৷ ও রাজলক্ষ্মী…একটা মজা দেখবি ভাই?
বলেই শরৎ চিঠিখানা রাজলক্ষ্মীর হাতে দিয়ে বললে, পড়ে দ্যাখ—
রাজলক্ষ্মী পড়ে বললে, এ কোথায় পেলে?
—উত্তর দেউলের সিঁড়ির ওপর একটা সিগারেটের খোলের মধ্যে ছিল৷
—আশ্চর্য, আচ্ছা কে লিখলে বলো তো শরৎদি?
—তাই যদি জানব, তা হলে তো একেবারে শ্রাদ্ধের চাল চড়িয়ে দিই তাদের—
—তুমি আগে যাদের কথা বলেছিলে—
—তারাও হবে হয়তো৷ নাও হতে পারে৷ সিগারেট খাবে কে এ গাঁয়ে?
—কাউকে দেখলে, কি পায়ের শব্দ শুনলে?
শরৎ সুর বদলে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, বাদ দে ও-সব কথা! বাবা নেই কিনা বাড়িতে, বাবা না থাকলেই ওদের বিদ্ধি বাড়ে আমি জানি৷ যদি দেখতে পেতাম তবে না কথা ছিল৷
রাজলক্ষ্মী বললে, আচ্ছা যদি আমি না আসতাম, তবে তুমি ভয় পেতে না শরৎদি, এই সব চিঠি পেয়ে—জ্যাঠামশায় নেই বাড়ি—?
—দূর, কি আর ভয়! আমার ও-সব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে—
—একলাটি তো থাকতে হত?
—থাকিই তো৷ ভয় করে কি করব? চিরদিনই যখন একা—
—তোমার বলিহারি সাহস শরৎদি! এই অরুণ্যি বনের মধ্যে—
—ঘরে বঁটি আছে, দা আছে—এগুক দিকি কে এগুবে শরৎ বামনীর সামনে—ঠাণ্ডা করে ছেড়ে দেব না? কি খাবি বল রাত্রে—ও কথা যাক৷ ভাত না রুটি?
—যা হয় করো৷ তুমি তো ভাত খাবে না, তবে রুটিই করো—দুজনে মিলে তাই খাব৷
—বাইরে বসে আটাটা মেখে ফেলি—
—তুমি যাও শরৎদি, আমি মাখছি আটা—
দু’জনে গল্পগুজবে রাঁধতে খেতে অনেক রাত করে ফেললে৷ তার পর দোর বন্ধ করে দু’জনে যখন শুয়ে পড়ল৷ তখন খুব সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে৷ বেশি রাত্রে শরৎ ঘুম ভেঙে উঠে রাজলক্ষ্মীর গা ঠেলে চুপি চুপি বললে, ও রাজলক্ষ্মী, ওঠ—বাইরে কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে যেন—
রাজলক্ষ্মী ঘুমে জড়িত কণ্ঠে ভয়ের সুরে বললে, কোথায় শরৎদি?
—চুপ, চুপ, ওই শোন না—
রাজলক্ষ্মী বিছানায় উঠে বসে উৎকর্ণ হয়ে শোনবার চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পেলে না৷
শরৎ উঠে আলো জ্বাললে৷ তার ভয়-ভয় করছিল৷ তবু সে সাহস করে আলো হাতে দোর খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করাতে রাজলক্ষ্মী ছুটে এসে ওর হাত ধরে বললে, খবরদার বাইরে যেয়ো না৷ শরৎদি, কার মনে কি আছে বলা যায় না৷ তোমার দুটি পায়ে পড়ি—
শরৎ কিন্তু ওর কথা না শুনেই দোর খুলে দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়াল৷ ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না, কেউ কোথাও নেই! তবুও তার স্পষ্ট মনে হল খানিক আগে কেউ এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার কোনো ভুল নেই৷
হঠাৎ তার মনে পড়ল, আজ ত্রয়োদশী তিথি৷
তাদের এখানে প্রবাদ আছে, বারাহী দেবীর পাষাণ-মূর্তি ত্রয়োদশী থেকে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত তিন দিন, গভীর রাত্রিকালে নিজের জায়গা থেকে নড়েচড়ে বেড়ায় গড়বাড়ির নির্জন বনজঙ্গলের মধ্যে৷ সেই সময় যে সামনে পড়ে, তার বড় অশুভ দিন৷
শরতের সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল৷
যদি সত্যিই তাই হয়?
যদি সত্যিই বারাহী দেবীর বুভুক্ষু ভগ্ন পাষাণ-বিগ্রহ রক্তের পিপাসায় তাদেরই ঘরের আনাচে-কানাচে শিকার খুঁজে বেড়াতে বার হয়ে থাকে?
শরৎ ভয় পেলেও মুখে কিছু বললে না৷ ধীরভাবে ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে দিলে৷
রাজলক্ষ্মী কলসি থেকে জল গড়িয়ে খাচ্ছিল, বললে, কিছু দেখলে শরৎদি?
—না কিছু না৷ তুই শুয়ে পড়৷
পরদিন বৈকালের দিকে প্রভাস ও আর একটি তরুণ সুদর্শন যুবক হঠাৎ এসে হাজির৷
রাজলক্ষ্মী তখন সবে কি একটা ঘরের কাজ সেরে দিঘির ঘাটে শরতের কাছে যাবার যোগাড় করছে—এমন সময় ওদের দেখে জড়সড় হয়ে উঠল৷
প্রভাস বললে, খুকি, তুমি কি এ বাড়ির মেয়ে? না, তোমাকে তো কখনো দেখি নি? বাড়ির মানুষ সব গেল কোথায়?
রাজলক্ষ্মী সলজ্জমুখে বললে, শরৎদি দিঘির পাড়ে৷ ডেকে আনছি৷
—হ্যাঁ, গিয়ে বলো প্রভাস আর অরুণবাবু এসেছে৷
শেষের নামটা উচ্চারিত হতে শুনে রাজলক্ষ্মীর মুখ তার নিজের অজ্ঞাতসারে রাঙা হয়ে উঠল৷ সে জড়িত পদে কোনো রকমে ওদের সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে আড়ালে এনে এক ছুটে ঘাটের পাড়ে গিয়ে খবরটা দিল শরৎকে৷
শরৎ অবাক হয়ে বললে, তুই দেখে এলি?
—ও মা, দেখে এলাম না তো কি! এসো না—
শরৎ ব্যস্তভাবে দিঘির ঘাট থেকে উঠে এল৷ প্রভাস ততক্ষণ নিজেই মাদুর পেতে বসে পড়েছে ওদের দাওয়ায়৷ হাসিমুখে বললে, আবার এসে পড়লাম৷ এখন একটু চা খাওয়াও তো দিদি—
—বসুন প্রভাসদা৷ এক্ষুনি চা করে দিচ্ছি—
প্রভাস পকেট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বার করে বললে, ভালো চা এনেছি৷ আর এতে আছে চিনি—
—আবার ও-সব কেন প্রভাসদা? আমরা গরিব বলে কী একটু চা দিতে পারি নে আপনাদের?
—ছিঃ অমন কথা বলতে নেই৷ সে ভেবে আনি নি, এখানে সব সময় ভালো চা তো পাওয়া যায় না পয়সা দিলেও৷ আর এ চিনি সে চিনি নয়, এ চায়ে খাওয়ার আলাদা চিনি৷ দ্যাখো না—এ পাড়াগাঁয়ে কোথায় পাবে এ চিনি?
শরৎ হাতে করে দেখলে চৌকো লেবেঞ্চুসের মতো জিনিসটা৷ এ আবার কি ধরণের চিনি! কখনো সে দেখেই নি৷ শহর বাজারে কত নতুন জিনিস আছে!
প্রভাস বললে, কাকাবাবু কোথায় গেলেন?
—বাবা গিয়েছেন খাজনার তাগাদায়৷ দু-তিন দিন দেরি হবে ফিরতে৷
প্রভাস হতাশমুখে বললে, তিনি বাড়ি নেই! এঃ, তবে তো সব দিকেই গোলমাল হয়ে গেল!
—কেন, কি গোলমাল?
—আমি এসেছিলাম তোমাদের কলকাতা ঘুরিয়ে আনতে৷ মোটর ছিল সঙ্গে৷ সেই ভেবেই অরুণকে সঙ্গে নিয়ে এলাম৷
—তাই তো, সে এখন কি করে হয়?
—নিতান্তই আমার অদৃষ্ট৷
—সে কি, আপনার অদৃষ্ট কেন প্রভাসদা, আমাদের অদৃষ্ট৷
—তা নয় দিদি, মুখে যাই বলো, প্রাচীন রাজবংশের মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে বেড়ানোর মধ্যে যে আনন্দ আছে—তা কি সকলের ভাগ্যে ঘটে শরৎদি? বিশেষ করে তুমি আর কাকাবাবু যখন কখনো কলকাতাতে যাও নি!
—কোথাও যাই নি—তার কলকাতায়!
অরুণ এবার কথা বললে৷ সে অনেকক্ষণ থেকে একদৃষ্টে শরতের দিকে চেয়ে ছিল৷ শরতের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরুণ জিভ ও তালুর সাহায্যে একপ্রকার খেদসূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললে, ও ভাবলে একদিকে কষ্ট হয়, একদিকে আনন্দ হয়৷ আপনার এই সরলতার তুলনা নেই৷ অভিজ্ঞতা সব জায়গাতেই যে পুজো পাবে তা পাবে না৷ অনভিজ্ঞতার মূল্য অনেক সময় অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেক—অনেক বেশি৷
প্রভাস বললে, তাই তো, বড় ভাবনায় পড়া গেল দেখছি!
—ভাবনা আর কি, অন্য এক সময় নিয়ে যাবেন প্রভাসদা৷
প্রভাস কিছুক্ষণ বসে ভেবে বললে, আচ্ছা, কোনো রকমেই এখন যাওয়া হয় না? ধরো তুমি আর কাউকে নিয়ে না হয় আমাদেরই সঙ্গে গেলে—
—আমি একাও আপনার সঙ্গে যেতে পারি প্রভাসদা৷ আমার মন তেমন নীচ নয়৷ কিন্তু সেজন্যে নয়—বাবার বিনা অনুমতিতে কোথাও যেতে চাই নে৷ যদিও আমার মনে হয় আপনি নিয়ে গেলে বাবা তাতে অমত করবেন না৷
অরুণ এবার বললে, তবে চলুন না কেন, গাড়ি রয়েছে—কাল সকালে বেরুলে বেলা বারোটার মধ্যে কলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে৷ ইচ্ছে করেন, কাল রাতেই আবার আপনাকে এখানে পৌঁছে দেব, কি বলেন প্রভাসবাবু?
প্রভাস ঘাড় নেড়ে বললে, তা তো বটেই৷ তাই চলো যাওয়া যাক—অবিশ্যি যদি তোমার মনের সঙ্গে খাপ খায়৷ কাল সকালে আমরা আসব এখন আবার—
এরা উঠে গেলে রাজলক্ষ্মী দেখলে শরৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে৷ কি যেন ভাবছে আপন মনে৷ কিছুক্ষণ পরে শরৎ নিজেই বললে, তুই তো সব শুনলি, তোর কি মনে হয়—যাব ওদের সঙ্গে? খুব ইচ্ছে করছে৷ কক্ষনো দেখিনি কলকাতা শহর—
—তোমার ইচ্ছে শরৎদি৷ তুমি আমার চেয়ে বুদ্ধিমতী৷
—তুই যাবি?
—আমার যেতে খুব ইচ্ছে—কিন্তু আমার যাওয়া হবে না শরৎদি৷ বাবা মা যেতে দেবে না৷
—আমার সঙ্গে যাবি, এতে আর দোষ কি?
—তুমি যদি যাও, লোকে কোনো কথা ওঠাতে সাহস করবে না শরৎদি৷ কিন্তু আমায় কেউ ছেড়ে কথা বলবে না৷ শেষকালে বাপ-মা মুশকিলে পড়ে যাবে বিয়ে দেবার সময়৷
—বাবাঃ, এর মধ্যে এত কথা আছে? ধন্যি সব মন বটে!
—তুমি থাকো গাঁয়ের বাইরে৷ তা ছাড়া তুমি যে বংশের মেয়ে, তোমার নামে এ অঞ্চলের লোকে কিছু রটাতে সাহস করবে না৷ আমার বেলায় তা তো হবে না!
আরও কিছুক্ষণ পরে রান্না শেষ হয়ে গেল৷ শরৎ রাজলক্ষ্মীকে খেতে দিয়ে একটা বাটিতে চিঁড়েভাজা তেল-নুন দিয়ে মেখে নিয়ে খেতে বসলো৷
রাজলক্ষ্মী খেতে খেতে বললে, ও সাত-বাসি চিঁড়ে-ভাজা কেন খাচ্ছ শরৎদি? আমার জন্যে তো সেই কষ্ট করলেই, রান্না করলে, এখন নিজের জন্যে না হয় খানকতক পরোটা কি রুটি করে নিলেই পারতে?
শরৎ সলজ্জ হেসে বললে, ময়দা আর ছিল না৷ প্রভাসদা আর অরুণবাবুকে তখন দুখানা করে পরোটা করে দিলাম—যা ছিল সব ফুরিয়ে গেল৷
—আমায় বললে না কেন শরৎদি? ওই তোমার বড় দোষ৷ আমায় বললে আমি বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম৷
—থাক গে, খাওয়ার জন্যে কি? এখন কলকাতায় যাওয়ার কি করা যায় বল! আর শোন, ওই অরুণবাবু, দেখলি তো? পছন্দ হয়? এবার তবে কথাটা পাড়ি প্রভাসদা’র কাছে?
রাজলক্ষ্মী জবাব দিতে একটু ইতস্তত করে সঙ্কোচের সঙ্গে বললে, তা তোমার ইচ্ছে৷ কিন্তু ও আমাদের কখনো হয়? বলে বামন হয়ে চাঁদে হাত—
—যদি ঘটিয়ে দিতে পারি?
রাজলক্ষ্মী মনে মনে ভাবলে, শরৎদি’র বয়সই হয়েছে আমার চেয়ে বেশি, কিন্তু এদিকে সরলা৷ অনেক জিনিসই আমি যা বুঝি, ও তাও বোঝে না৷ চিরকাল গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে বাস করে এলো কিনা৷
সে মুখে বললে, দিতে পারো ভালোই তো৷ বেশ কথা৷
—ঘটকালির বখশিশ দিবি কি?
—যা চাইবে শরৎদি৷
—দেখিস তখন যেন আবার ভুলে যাস নে—
রাজলক্ষ্মীর খাওয়ার প্রবৃত্তি চলে গিয়েছিল শরৎকে বাসি চিঁড়েভাজা খেতে দেখে৷ তার ওপর যখন আবার শরৎ গরম দুধের বাটি এনে তার পাতের কাছে নামাতে গেল, সে একেবারে পিঁড়ির ওপর থেকে উঠে পড়ল৷ দুধটুকু থাকলে তবুও শরৎদি খেতে পাবে৷
—ও কি, উঠলি যে?
রাজলক্ষ্মী ভালো করেই চেনে শরৎকে৷ সে যদি এখন আসল কথা বলে, তবে শরৎ ও দুধ ফেলে দেবে, তবু নিজে খাবে না৷ সুতরাং সে বললে, আর আমার খাওয়ার উপায় নেই শরৎদি, পেট খুব ভরে গিয়েছে৷ মরব নাকি শেষে একরাশ খেয়ে?
—দুধ যে তোর জন্যে জ্বাল দিয়ে নিয়ে এলাম? কি হবে তবে?
রাজলক্ষ্মী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, কি হবে তা কি জানি৷ না হয় তুমি খেয়ে ফেল ওটুকু৷ আমার আর খাওয়ার উপায় দেখছি নে৷ জানোই তো আমার শরীর খারাপ, বেশি খেতে পারি নে৷
অগত্যা শরৎকেই দুধটুকু খেয়ে ফেলতে হল৷
পরদিন সকালেই প্রভাস ও অরুণ আবার এসে হাজির৷
প্রভাস বললে, কি ঠিক করলে দিদি?
—ও এখন হয়ে উঠবে না প্রভাসদা৷ আপনারা যাবেন না, বসুন৷ চা আর খাবার করে দি, বসে গল্প করুন৷
শরৎ কাল রাত্রে ভেবে ঠিক করেছে, রাজলক্ষ্মীর বিবাহের প্রস্তাবটাও আজই প্রভাসের কাছে উত্থাপিত করে দেখবে কি দাঁড়ায়৷ রাজলক্ষ্মীকে এজন্যে সে সরিয়ে দেবার জন্যে বললে, ভাই, তোদের বাড়ি থেকে এত ক’টা আটা কি ময়দা দৌড়ে নিয়ে আয় তো? কাল রাত্রে আমাদের ময়দা ফুরিয়েছে৷ প্রভাসদা ও অরুণবাবুকে চায়ের সঙ্গে দুখানা পরোটা ভেজে দিই৷
প্রভাস যেন একটু হতাশার সুরে বললে, তা হলে যাওয়া হল না তোমার? এবার গেলেই বেশ হত৷
শরৎ বললে, না, এবার হবে না৷
—তোমার বন্ধুটিকে নিয়ে চলো না কেন?
—কে? রাজলক্ষ্মীর কথা বলছেন?…আচ্ছা, একটা কথা বলব? রাজলক্ষ্মীকে কেমন লাগল আপনাদের?
প্রভাস একটু বিস্ময়ের সুরে বললে, কেন বলো তো? ভালোই লেগেছে৷
—গরিব বাপ-মা, বিয়ে দিতে পারছে না৷ ওর জন্যে একটা পাত্র দেখে দিন না কেন প্রভাসদা৷ বড্ড উপকার করা হবে৷ একটা কথা শুনুন প্রভাসদা—
প্রভাস শরতের পিছু পিছু বাড়ির পিছনদিকে গেল৷
শরৎ বললে, আচ্ছা প্রভাসদা, অরুণবাবুর সঙ্গে রাজলক্ষ্মীর বিয়ে দিন না কেন জুটিয়ে? পালটি ঘর৷ চমৎকার হবে—
প্রভাস যেন ঠিক এ ধরণের কথা আশা করে নি শরতের মুখ থেকে৷ সে আশাহতের সুরে বললে, তা—তা দেখলেও হয়৷
শরতের যদি কিছুমাত্র সাংসারিক ও সামাজিক জ্ঞান থাকত তবে প্রভাসকে চিনে নিতে সে পারত এই এক মুহূর্তেই৷ কিন্তু শরৎ যদিও বয়সে যুবতী, সারল্যে ও ব্যবহারিক অনভিজ্ঞতায় সে বালিকা৷ সুতরাং সে প্রভাসের স্বরূপ ধরতে পারলে না৷
সে আরও আগ্রহের সঙ্গে বললে—তাই দেখুন না প্রভাসদা? আপনি করলে অনেক সহজ হয়ে যায় কাজটা—
প্রভাস অন্যমনস্কভাবে কি একটা কথা ভাবছিল৷ দু-একবার যেন কোনো একটা কথা বলবার জন্যে শরতের মুখের দিকে চাইলেও—কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললে না৷
দুজনকে চা করে দিয়ে শরৎ পথের দিকে চেয়ে আছে—এমন সময় দেখা গেল রাজলক্ষ্মী ফিরে আসছে৷ সে দাওয়া থেকে নেমে রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়ে বললে—এনেছিস ময়দা? দে আমার কাছে৷
—আমি যাই শরৎদি, মা বলে দিয়েছে বাড়ি ফিরতে—
—কেন বল তো? প্রভাসদারা এখানে বসে আছে বলে?
রাজলক্ষ্মী অপ্রতিভ মুখে বললে—তাই শরৎদি, জানোই তো, আমরা গরিব, এখানে ওদের সঙ্গে বসে থাকলে হয়তো কথা উঠবে৷ মা বড় ভয় করে ওসব৷
—তাহলে তুই যা—গিয়ে মান বজায় রাখ—
রাজলক্ষ্মী হাসতে হাসতে চলে গেল৷
প্রভাসদের খাবার করে দিতে বেলা প্রায় আটটা বেজে গেল৷ ওরা উঠতে যাবে এমন সময় শরৎ গড়ের খালের দিকে চেয়ে আহ্লাদের সঙ্গে বলে উঠল—বাবা আসছেন৷ প্রভাস ও অরুণ দুজনেই যেন চমকে উঠে সেদিকে চেয়ে দেখলে৷ ওদের মুখ দেখে মনে হবার কথা নয় যে কেদারের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনে তারা খুব খুশি৷
তবুও প্রভাস এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কেদারের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে৷ কেদার আনন্দের সঙ্গে বলে উঠলেন—এই যে প্রভাস, কখন এলে, ভালো সব?..আমি—হ্যাঁ—তাই বেরিয়েছিলাম বটে৷ সাংকিনী ও মাকড়ার বিলে বাচ হচ্ছে খবর পেলাম পথেই৷ খাজনা আদায় করতে যখন যাওয়া—আর সবাই জেলে প্রজা—বাচ শেষ না হলে কাউকে বাড়ি পাওয়া যাবে না তাও বটে—আর মস্ত কথা হচ্ছে বাচ না মিটে গেলে ওদের হাতে পয়সা আসবে না৷ তাই ফিরে এলাম৷
প্রভাস বললে, ভালোই হল৷ শরৎ তো ছোটবোনের মতো—আপনাদের কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে আসব বলে মোটর এনেছি এবার৷ আপনি ছিলেন না বলে একটু মুশকিল ছিল৷ শরৎদি বলেছিল যাবে৷ আমার সঙ্গে যাবে এ আর বেশি কথা কি? নিজের দাদার মতো—তবুও আপনি এলেন—বড় ভালোই হল৷ কাল সকালে চলুন কাকাবাবু কলকাতায়৷
শরৎ প্রভাসের কথা শুনে একটু অবাক হয়ে ভাবল—কই, সে কখন প্রভাসদা’র সঙ্গে কলকাতায় যাবে বললে? প্রভাসদা’র ভুল হয়েছে শুনতে—কিন্তু সে তো দুবার তিনবার বলেছে তার যাওয়া হবে না৷
কেদার বললেন, তা বেশ কথা৷ চলো না, ভালোই তো৷ অনেককাল থেকে কলকাতায় যাব যাব ভাবি, তা হয়ে ওঠে না৷ মন্দ কি?
প্রভাস ও অরুণ একসঙ্গে খুশির সঙ্গে বলে উঠল—কাল সকালেই চলুন তবে! সে কথা তো আমরাও বলছি৷
—কখন গিয়ে পৌঁছবে?
—বেলা বারোটার মধ্যে৷ কোনো কষ্ট হবে না আপনাদের, যাতে সব রকম সুবিধে হয়—
—এখানে কাল সকালে তোমরা খাবে—খেয়ে গাড়িতে ওঠা যাবে৷
শরৎ বাবার অনুরোধে যোগ দিয়ে বললে, হ্যাঁ প্রভাসদা, অরুণবাবুকে নিয়ে কাল সকালে এখানেই খাবেন৷ না, কোনো কথা শুনব না৷ এখানে খেতেই হবে—
প্রভাস বললে, রাজলক্ষ্মী বলে সেই মেয়েটি যাবে নাকি? তারও জায়গা হয়ে যাবে৷ বড় গাড়ি৷
শরৎ বললে, না, তার যাবার সুবিধে হবে না৷ আমায় সে বলে গেল এই মাত্র৷
প্রভাস বললে, তা হলে কাকাবাবু কাল সকালেই আসব তো?
—হ্যাঁ, এখানে তোমরা খাবে যে সকালে৷ তারপর রওনা হওয়া যাবে৷ অরুণকেও নিয়ে এসো—
দুপুরের পরে রাজলক্ষ্মী এল৷ শরৎ দাওয়ায় বসে পুরনো টিনের তোরঙ্গটা থেকে তার ও বাবার কাপড় বার করতে ব্যস্ত৷ রাজলক্ষ্মীকে দেখে বললে, এই যে আয় রাজলক্ষ্মী, সব কাপড়ই ছেঁড়া, যেটাতে হাত দিই৷ আমার তবু দুখানা বেরিয়েছে, বাবার দেখছি আস্ত কাপড় বাক্সে একখানাও নেই৷ কি নিয়ে যে যাবেন কলকাতায়—
—তা হলে যাচ্ছ সত্যিই শরৎদি? কাকাবাবু কোথায়?
—যাই, একবার বেড়িয়েই আসি৷ বসে বসে বাবার কাপড়গুলো এখন সেলাই করব— কেনবার পয়সা নেই যে নতুন একজোড়া ধুতি কিনে নেব—বেশি ছেঁড়া নয়, একটু-আধটু সেলাই করলে কেউ টেরও পাবে না৷ বাবা নেই বাড়ি, এইমাত্র পাড়ার দিকে গেলেন৷
শরতের মনে খুব আনন্দ বাইরে বেড়াতে যাবার এই সুযোগ পেয়ে৷ সে বসে বসে কেবল সেই গল্পই করতে লাগল রাজলক্ষ্মীর কাছে৷ কতকাল আগে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল—ভালো মনেও পড়ে না—সে-ও বেশি নয়, টুঙি-মাজদে গ্রামের কাছে বল্লভপুরের ভাদুড়ীদের বাড়ি৷ মাজদিয়া স্টেশনে নেমে তিন ক্রোশ গরুর গাড়িতে গিয়ে কি একটা ছোট্ট নদীর ধারে৷ তাদেরও অবস্থা খারাপ, আগে একসময় ও অঞ্চলের ভাদুড়ীদের নামডাক ছিল, সে নাকি অনেককাল আগে৷ এখন সতেরো সরিকে ভাগ হয়ে আর সবাই মিলে খেয়ে বেজায় গরিব হয়ে পড়েছে৷
রাজলক্ষ্মী বললে, সেখানে তোমায় নিয়ে যায় না শরৎদি?
—কে নিয়ে যাবে ভাই?
—তোমার দেওর ভাশুর নেই?
—আপন ভাশুরই তো রয়েছেন৷ হলে হবে কি, তাঁর বেজায় পুরী পাল্লা—সাত মেয়ে, পাঁচ ছেলে—নিজেরগুলো সামলাতে পারেন না—খেতে দিতে পারেন না—আমাকে নিয়ে যাবেন! আজ তেরো বছর কপাল পুড়েছে, কখনও একখানা থানকাপড় দিয়ে খোঁজ করেন নি৷ আর খোঁজ করলেও কি হত, আমি কি বাবাকে ফেলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি? সে গাঁয়ে আমার মনও টেঁকে না৷
—যদি এখন তারা নিতে আসে শরৎদি?
—আমি ইচ্ছে-সুখে যাইনে—তবে ভাশুর যদি পেড়াপীড়ি করেন—না গিয়ে আর উপায় কি?
—কতদিন থাকতে পারো? বলো না শরৎদি?
—কেন বল তো, আজ আবার তুই আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে পড়লি কেন?
রাজলক্ষ্মী মুখে আঁচল দিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে উঠল৷ তার পর বললে, দাও গুছিয়ে দিই কি জিনিসপত্তর আছে—মা বলছিল—
—কি বলছিলেন খুড়িমা?
—ভাগ্যিস কাকাবাবু এসে গিয়েছেন তাই৷ নইলে তোমার একা যাওয়া উচিত হত না প্রভাসবাবুর সঙ্গে—
শরতের চোখ দুটি যেন ক্ষণকালের জন্যে জ্বলে উঠল৷ মুখের রং গেল বদলে—রাজলক্ষ্মী জানে শরৎ দিদি রাগলে ওর মুখ রাঙা হয়ে ওঠে আগে৷ রাজলক্ষ্মী ভয় পেল মনে মনে, হয়তো তার এ কথা বলা উচিত হয় নি, কিন্তু বলতে তাকে হবেই শরৎদির ভালোর জন্যে৷ না বলে সে পারে না৷ কতবার তার মনে হয়েছে—শরৎ দিদি তার ছোট বোন, সে-ই এই সংসারানভিজ্ঞা বালিকাপ্রকৃতির দিদিকে সব বিপদ থেকে, কলঙ্ক থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে বেড়াবে৷
শরৎ কড়া সুরে বললে, কেন উচিত হত না, একশো বার হত৷ খুড়িমাকে গিয়ে বোলো রাজলক্ষ্মী, শরৎ যেখানে ভালো ভাবে, সেখানে আপনার লোকের মতোই ব্যবহার করে—পর ভাবে না৷ তার মন যেখানে সায় দেয় সেখানে যেতে তার এতটুকু ভয় নেই—আমি কারো কথা—
রাজলক্ষ্মী সভয়ে বললে, ওকি শরৎদি, তোমার পায়ে পড়ি শরৎদি, অমন চলে যেয়ো না, ছিঃ—
—তবে তুই এমন কথা বলিস কেন, খুড়িমাই বা কেন বলেন? তিনি কি ভাবেন—
—শোনো আমার কথা৷ মা সে কথা বলে নি৷ কিন্তু একা মেয়েমানুষ যদি বিপদে পড় তখন তোমায় দেখবে কে? সেই কথাই মা বলছিল৷ তুমি যত ভালো ভাব লোককে, সকলেই অত ভালো নয়৷ তুমি সংসারের কি বোঝ? মার বয়েস তোমার চেয়ে তো কত বেশি— সেদিক থেকে মা যা বলেছে মিথ্যে বলে নি৷ লক্ষ্মী দিদি, অমন রাগে না, রাগলে সংসারে কাজ চলে? আমি তোমায় কত ভালোবাসি, মা কত ভালোবাসে—তা তুমি বুঝি জানো না? মা আমায় গাঁয়ে কারোর বাড়ি যেতে দেয় না—কিন্তু তোমাদের বাড়ি আসতে চাইলে কখনো কোনো আপত্তি করে নি৷
শরতের রাগ ততক্ষণ চলে গিয়েছে৷ সে রাজলক্ষ্মীর হাত ধরে বললে, কিছু মনে করিস নে রাজী—
—না, মনে তো করি নে, আমি জানি শরৎদি ছেলেমানুষের মতো, এই রেগে উঠল, এই জল হয়ে গেল৷ রাগ তোমার বেশিক্ষণ শরীরে থাকে না—গঙ্গাজলে ধোয়া মন যে৷ সাধে কি বড়বংশের মেয়ে বলে তোমাকে শরৎদি?
শরৎ সলজ্জ-মুখে বললে, যা যা বকিস নে—থাম তুই৷
এই সময় দূর থেকে কেদারকে আসতে দেখে রাজলক্ষ্মী বললে, কাকাবাবু আসছেন, শরৎদি—ও-সব কথা থাক, কি কি কাজ করতে হবে, কি গুছিয়ে দিতে হবে বলে দাও৷
—কি আর গুছিয়ে দিবি৷ দু-পাঁচ দিনের জন্যে তো যাওয়া৷ হ্যাঁ রে, উত্তর দেউলে সন্দে-পিদিম দেওয়ার জন্যে বামী বাগ্দীকে ঠিক দিতে পারবি? আমি এসে তাকে চার আনা পয়সা দেব৷
রাজলক্ষ্মী বললে, বলে দেখব—কিন্তু সে রাজি হবে না৷ সন্দেবেলা সে ঘেঁষবে উত্তর দেউলের অরুণ্যি বিজেবনে? বাপরে! তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না কেন? আমি তোমার সন্দে দেব রোজ রোজ—
শরৎ বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে, তুই দিবি সন্দে-পিদিম—উত্তর দেউলে?
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কেন হবে না? পানুকে সঙ্গে নিয়ে আসব—আর সন্দের এক ঘণ্টা আগে আলো জ্বেলে রেখে চলে যাব৷ তোমাদের ঘরবাড়িও তো দেখাশুনো করতে হবে আমায়? অমনি দিয়ে যাব পিদিম জ্বেলে৷
—তা হলে তো বেঁচে যাই রাজলক্ষ্মী৷ ওই একটা মস্ত ভাবনা আমার, তা জানিস? মনে মনে ভাবি, আমি বেঁচে থাকতে পূর্বপুরুষের দেউলে আলো জ্বলবে না—তা কখনই হতে দেব না প্রাণ ধরে৷ আর একটা কথা শিখিয়ে দি, যখন পিদিম হাতে নিয়ে দেউলে যাবি তখন বেতবনের জঙ্গলে বারাহী দেবীর যে ভাঙা মূর্তি আছে সেখানটাতে একবার পিদিমটা তুলে দেখাবি৷
রাজলক্ষ্মীর মুখে কেমন ভয়ের ছায়া নামলো—সে বললে, ওই ভাঙা কালীর মূর্তি! ওখানে যেতে ভয় করে৷
—কালী নয়—ও বারাহী বলে এক পুরনো আমলের দেবীমূর্তি৷ বহুকাল পুজোও হয় নি৷ কেমন চড়কের সময় সন্নিসিরা একবার ওখানে এসে নেচে যায় দেখিস নি?
—তা যাক নেচে৷ আমি ওখানে যেতে পারব না শরৎদি৷ মাপ করো৷
—তুই যদি না পারিস—তবে আমার যাওয়া হবে না৷ আমি বারাহী দেবীকে ফেলে রেখে যেতে পারব না৷
রাজলক্ষ্মী বললে, না দিদি, সত্যি কিছু ভালো লাগছে না৷ তুমি চলে যাবে, আমার মন কাঁদবে সত্যিই৷ তাই বলছিলাম পারব না, যদি তোমার যাওয়ায় বাধা দিতে পারি৷ কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, এ কাজ ভালো না৷ শরৎ দিদি কখনো কোনো জায়গায় যায় না, কিছু দেখে নি—ও-ই যাক৷ ঘুরে আসুক৷
কেদার গামছা পরে পুকুর থেকে স্নান করে এসে বললেন, ওমা শরৎ , একটা ডাব খাওয়াতে পারবি?
—না বাবা, একটা ছোট্ট ডাব ওবেলা ঠাকুরদের দিয়েছি—এবেলা আর কিছু নেই৷ পুণ্য বাগদিকে ডেকে নিয়ে আসব?
—না থাক মা, সব গুছিয়ে নিয়ে রাখো—রাজলক্ষ্মী মা এলি কখন? তা তুই একটু সাহায্য কর না!
—ও তো করছেই বাবা৷ ও উত্তর দেউলে পিদিম দেবে পর্যন্ত বলছে৷ ও গাঁয়ের মধ্যে আর কেউ এতদূর আসেও না, খোঁজখবরও নেয় না৷ ও আছে তাই, তবু মানুষের মুখ দেখতে পাই৷
পরদিন প্রভাসের মোটর সামনের বারুইদ’র বিল পার হয়ে যাওয়ার পরে কেদারের মুখে প্রথম কথা ফুটলো৷ পেছনের সিটে তিনি মেয়েকে নিয়ে বসেছেন—সামনের সিটে বসেছে অরুণ ও প্রভাস—অরুণ গাড়ি চালাচ্ছে৷
কেদার মাঝে মাঝে বিস্ময়সূচক দু-একটা রব করছিলেন এতক্ষণ, এইবার মেয়েকে সম্বোধন করে প্রথম কথা বললেন৷
—ও শরৎ, কি জোরে যায় বটে মোটর গাড়ি, বারুইদ’র বিল গড়শিবপুর থেকে পাক্কা চার ক্রোশ রাস্তা৷ হেঁটে আসলে দু-ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার কম পৌঁছুনো যায় না—আর এই দ্যাখো, চোখের পাতা পাল্টাতে না পাল্টাতে এসে হাজির বারুইদ’র বিলে—
—হাজির কি বাবা, বিল পেরিয়েও তো গেল!
—ও, মানুষ না পাখি? কি জোরেই যায় তাই ভাবছি৷
—হ্যাঁ বাবা, কলকাতা কতদূর বললে প্রভাসদা?
—বেলা বারোটা কি একটার মধ্যে যাব বলছে৷ ত্রিশ ক্রোশ হবে এখান থেকে কলকাতা৷
প্রভাস সামনের সিটে বসে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বললে, কাকাবাবু কখনো কলকাতায় এসেছিলেন?
কেদার বললেন, তা দু-বার এর আগে কলকাতা ঘুরে এসেছি৷ তবে সে অনেকদিন আগের কথা৷ প্রায় দু-যুগ হল৷
অরুণ বললে, সে কলকাতা আর নেই, গিয়ে দেখবেন৷ শরৎদি, আপনি কখনো যান নি কলকাতায় এর আগে?
—নাঃ, আমি কোথাও যাই নি৷
—কলকাতাতেও না?
কলকাতা তো কলকাতা! বলে এখনো রানাঘাট কি রকম শহর তাই দেখি নি! রাজি হয়ে গেল বাবা তাই, নইলে আমার আসা হত না৷ পিদিম দেখানোর জন্যেই তো যত গোলমাল৷
আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য৷ ধর্মদাসপুরে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে ছায়ায়৷ এখনি এল ধর্মদাসপুরে! কেদার খাজনা আদায় করতে বেরিয়েছেন সকালে—বেলা এগারোটার কমে ধর্মদাসপুরে পৌঁছুতে পারেন নি৷ আর সেই ধর্মদাসপুর পার হয়ে গেল বড় জোর চল্লিশ মিনিটে—কি তারও কমে!
শরৎকে বললেন, মা, এই দ্যাখো ধর্মদাসপুর গেল, সেই যে একবার ওল এনেছিলাম মনে আছে? সে এখানে থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ কি জোরে যাচ্ছে একবার ভেবে দ্যাখো দিকিন?…হ্যাঁ, গাড়ি বের করেছে বটে সায়েবরা!
শরৎ ক্রমাগত ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করতে লাগল, বাবা—আর কত দেরি আছে কলকাতা? কতক্ষণে আমরা কলকাতা পৌঁছবো?
প্রায় ঘণ্টাচারেক একটানা ছোটার পরে একটা শহরে বাজারের মতো জায়গায় গাড়ি ঢুকল৷ কেদার বললেন, এটা কি জায়গা?
প্রভাস বললে, এটা বারাসাত৷ আর বেশি দূর নেই কলকাতা৷ এখান থেকে একটু চা খেয়ে নেবেন কাকাবাবু?
কেদার বললেন, কেন, এখানে কি তোমার কোনো জানাশুনো লোকের বাড়ি আছে নাকি? চা খাবে কোথায়?
—না, জানাশুনো কেউ নেই৷ দোকানে খাব৷ চায়ের দোকান আছে অনেক—
—না বাপু৷ তোমরা খাও, আমি দোকানের চা কখনও খাই নি, ও আমার ঘেন্না করে৷ আমি বরং একটু তামাক ধরিয়ে খাই, অনেকক্ষণ তামাক খাওয়া হয় নি৷
দোকানের চা শরৎও খেলে না৷ অরুণ ও প্রভাস নিজেরা গাড়ির গাছে চা আনিয়ে খেলে৷ কেদার আরাম করে হুঁকো টানতে টানতে বললেন, চা ভালো?
প্রভাস ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে, কেন, মন্দ না! খাবেন, আনব?
—না, আমি সেজন্যে বলছি নে৷ আমি দোকানের চা কখনো খাই নি, ও খাবও না কখনো৷ তোমরা খাও৷ আমরা সেকেলে মানুষ, আমাদের কত বাছবিচার৷
গাড়ি ছেড়ে যশোর রোড দিয়ে অনেকখানি এসে একটা বড়লোকের বাগানবাড়ির মধ্যে ঢুকল৷ ফটক থেকে লাল সুরকির রাস্তা সামনের সুদৃশ্য অট্টালিকাটির গাড়িবারান্দাতে গিয়ে শেষ হয়েছে৷ পথের দু-ধারে এরিকা পামের বড় বড় চারা গাছ, ক্রোটন, শেফালি, চাঁপা, আম, গোলাপজাম প্রভৃতি নানারকম গাছ৷
প্রভাস বললে, আপনারা নামুন—এবেলা এখানে থাকবেন আপনারা৷ এটা অরুণদের বাগানবাড়ি, ওর দাদামশায়ের তৈরি বাড়ি এটা৷
কেদার ও শরৎ দুজনেই বাড়ি দেখে আনন্দে ও বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন৷ এমন বাড়িতে বাস করবার কল্পনাও কখনো তাঁরা করেন নি৷ মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেজে, ছোট বড় আট-দশটা ঘর৷ বড় বড় আয়না, ইলেকট্রিক পাখা, আলো, কৌচ, কেদারা৷ তবে দেখে মনে হয় এখানে যেন কেউ বাস করে নি কোনো দিন, সব জিনিসই খুব পুরনো—দু-একটা ঘর ছাড়া অন্য ঘরগুলোতে ধুলো, মাকড়সার জাল বোঝাই৷
কেদার কথাটা বললেন প্রভাসকে৷
প্রভাস বললে, ওর দাদাবাবু শৌখিন লোক ছিলেন, তিনি মারা গিয়েছেন আজ বছর কয়েক৷ এখন মাঝে মাঝে অরুণরা আসে—সব সময় কেউ থাকে না৷
শরৎ বললে, এটাই কলকাতা প্রভাসদা?
—না, এটাকে বলে দমদম৷ এর পরেই কলকাতা শুরু হল৷ তোমরা বিশ্রাম করো—ওবেলা কলকাতা বেড়িয়ে নিয়ে আসব৷ এখুনি ঝি আসবে, যা দরকার হয় বলে দিয়ো ঝিকে—সব গুছিয়ে এনে দেবে৷ ঠাকুর আসবে এখন—
শরৎ বললে, কি ঠাকুর?
—রান্না করতে আসবে ঠাকুর৷
—বাবা ঠাকুরের হাতে রান্না খেতে পারবেন না প্রভাসদা, ঠাকুর আসবার দরকার নেই৷ আমি আছি তবে কি জন্যে?
—কলকাতায় এলে, একটু বেড়াবে না, বসে বসে রান্না করবে গড়শিবপুরের মতো? বাঃ—
—তা হোক গে৷ আমার রান্না করতে কতক্ষণ যাবে বলুন তো? কজন লোকের রান্না করতে হবে?
প্রভাস ও অরুণ শরতের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললে৷ প্রভাস বললে—কজন লোকের রান্না আবার৷ তোমাদের দুজনের, আবার কে আসবে তোমার এখানে খেতে? তুমি তো আর রাঁধুনী বামনী নও যে দেশসুদ্ধ লোকের রেঁধে বেড়াবে? আচ্ছা, আমরা এখন আসি কাকাবাবু, বিকেলে ছ’টার সময় আবার আসব৷ মলঙ্গা লেনে আমাদের যে বাড়ি আছে সেখানে নিয়ে যাব ওবেলা৷
ওরা গাড়ি নিয়ে চলে গেলে কেদার আর একবার তামাক সাজতে বসলেন৷
শরৎ চারিদিকে বেড়িয়ে এসে বললে, বাঃ চমৎকার জায়গা! ওদিকে একটা বাঁধা ঘাটওয়ালা পুকুর, দেখবে এসো না বাবা! তোমার কেবল তামাক খাওয়া আর তামাক খাওয়া! এই তো একবার খেলে বারাসাত না কি জায়গায়!
কেদার অগত্যা উঠে মেয়ের পিছু পিছু গিয়ে পুকুর দেখে এলেন৷ বাঁধা ঘাট অনেক দিনের পুরনো—কতকাল এ ঘাট যেন কেউ ব্যবহার করে নি৷ পুকুরের ওপারেও বাগান, কিন্তু ওদিকটাতে আগাছার জঙ্গল বড় বেশি৷
শরৎ বললে, বাবা, খিদে পেয়েছে?
—নাঃ—
—ঠিক পেয়েছে বাবা৷ উড়িয়ে দিলে শুনব না৷ ভাঁড়ার জিনিসপত্র সব আছে দেখে এসেছি—হালুয়া আর লুচি করে আনি?
কেদার চুপ করে তামাক টানতে লাগলেন, মেয়ের কাজে বাধা দেবার বিশেষ কোনো লক্ষণ প্রকাশ করলেন না অবিশ্যি৷ শরৎ কিন্তু অল্প একটু পরে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বললে—বাবা, মুশকিল বেধেছে—
—কি রে?
—এখানে তো দেখছি পাথুরে কয়লা জ্বালানো উনুন৷ কাঠের উনুন নেই৷ কয়লা কি করে জ্বালতে হয় জানি নে যে বাবা! ঝি না এলে হবেই না দেখছি৷
শরৎ ছেলেমানুষের মতো আনন্দে বাগানের সব জায়গায় বেড়িয়ে ফুল তুলে ডাল ভেঙে এ গাছতলায় লোহার বেঞ্চিতে বসে ও গাছতলায় লোহার বেঞ্চিতে বসে বসে উৎপাত করে বেড়াতে লাগল৷ বেশ সুন্দর ছায়াভরা বাগান৷ কত রকমের ফুল—অধিকাংশই সে চেনে না, নামও জানে না৷ কেদার মেয়ের পীড়াপীড়িতে এক জায়গায় গিয়ে লোহার বেঞ্চিতে খানিকটা বসে কলের পুতুলের মতো দু-একবার মাথা দুলিয়ে বলতে লাগলেন—বাঃ, বেশ—বাঃ—
বেলা যখন বেশ পড়ে এসেছে, তখন প্রভাস মোটর নিয়ে এসে বললে—আসুন কাকাবাবু, চলো শরৎ—কাকাবাবুকে কিছু খাইয়েছ?
শরৎ হেসে বললে, তা হয় নি৷ ঝি তো মোটেই আসে নি৷
—তুমি তো বললে তুমিই করবে? জিনিসপত্র তো আছে—
—কয়লার উনুনে জ্বাল দিতে জানি নে, কয়লা ধরাতে জানি নে! তাতেই তো হল না৷
প্রভাস চিন্তিতমুখে বলল, তাই তো! এ তো বড় মুশকিল হল!
কেদার বললেন, কিছু মুশকিল নয় হে প্রভাস৷ চলো তুমি, ফিরে এসে বরং জলযোগ করা যাবে—
প্রভাস বললে, যদি নিকটের ভালো দোকান থেকে কিছু মিষ্টি কিনে আনি, তা আপনার চলবে না কাকাবাবু?
শরৎ হেসে বললে, বাবা ও-সব খাবেন না প্রভাসদা, তা ছাড়া আমি তা খেতেও দেব না৷ কলকাতা শহরে শুনেছি বড় অসুখ-বিসুখ, যেখান সেখান থেকে খাবার খাওয়া ওঁর সইবে না৷
অগত্যা সকলে মোটরে উঠে বসলেন, গাড়ি ছাড়লো৷
প্রথমে যশোর রোডের দু-ধারে বাগানবাড়ি ও কচুরিপানা-বোঝাই ছোট বড় জলা ছাড়িয়ে বেলগেছের মোড়ের আলোকোজ্জ্বল দৃশ্য দেখে পিতাপুত্রী বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়ল৷ ওদের দুজনের মুখে আর কোনো কথা নেই৷ গাড়ি ওখান থেকে এসে পড়ল কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে—এবং দু-ধারে দোকানপসার, থিয়েটার সিনেমা, ইলেকট্রিক আলোর বিজ্ঞাপন, দোকানের বাইরে শো-কেসে বহুবিচিত্র কাপড়, পোশাক, পুতুল, আয়না, সেণ্ট, সাবান, স্নো প্রভৃতির সুদৃশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে গাড়ি এসে পড়ল হ্যারিসন রোডের মোড়ে এবং এখান থেকে গাড়ি ঘুরে গেল হাওড়ার পুলের ওপর, ওপার হয়ে হাওড়া স্টেশনের গাড়িবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল৷
পুল পার হবার সময় প্রভাস বললে, এই দেখুন হাওড়ার পুল, নিচে গঙ্গা—আমরা যাচ্ছি হাওড়া স্টেশনে৷
এবারও কেদার বা শরৎ কারো মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলো না৷
প্রভাস গাড়ি থামিয়ে বললে, কাকাবাবু, চলুন স্টেশনের রেস্টোরেণ্ট থেকে আপনাকে চা খাইয়ে আনি—খাবেন কি?
কেদারের কোনো আপত্তি ছিল না—কিন্তু মেয়ে বাপের পরকালের দিকে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে—বাবা নাস্তিক মানুষ—ওঁর এ বয়সে কোনো অশাস্ত্রীয় অনাচারের সংস্পর্শে কখনো সে আসতে দেবে না কেদার তা ভালো জানতেন৷ তিনি মেয়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইলেন বটে, কিন্তু শরৎ তাঁর মুখের দিকে ভালো করে না চেয়েই বললে, চলুন প্রভাসদা, উনি ওখানে খাবেন না—
অগত্যা প্রভাস আবার গাড়ি ছেড়ে হাওড়ার পুলের ওপর এল এবং আস্তে আস্তে চলতে লাগল৷ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ওই দেখুন সব জাহাজ, শরৎদি দ্যাখো সমুদ্রে যে সমস্ত জাহাজ যায়, ওই দাঁড়িয়ে আছে৷
স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে গাড়ি এল আউট্রাম ঘাটে৷ ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে প্রভাস আউট্রাম ঘাটের জেটিতে গিয়ে একখানা বেঞ্চিতে বসলো৷ সামনের গঙ্গাবক্ষে ছোট বড় স্টীমার বাঁশি বাজিয়ে চলেছে, বড় বড় ভড় ও বজরা ডাঙার দিকে নোঙর করে রেখেছে, সার্চলাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাল একখানা বড় স্টীমার আস্তে আস্তে যাচ্ছে নদীর মাঝখান বেয়ে, সুবেশা নরনারীরা জেটির ওপর বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে—চারিদিকে একটা যেন আনন্দ ও উৎসাহের কোলাহল৷
একটা বড় বয়া ঢেউয়ের স্রোতে দুলছে দেখে শরৎ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ওটা কি?
প্রভাস বললে, জাহাজ বাঁধে ওই আংটাতে, বয়া বলে ওকে৷ আরও অনেক আছে নদীতে—
এতক্ষণে ওদের দু-জনের কথা যেন ফুটলো৷ কেদার নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাপ রে, এ কি কাণ্ড! হ্যাঁ শহর তো শহর, বলিহারি শহর বটে বাবা!
শরৎ বললে, সত্যি বাবা, এমন কখনো ভাবি নি৷ এ যেন জাদুকরের কাণ্ড! আচ্ছা, এখানে জলের ওপর ঘর কেন?
প্রভাস বুঝিয়ে দিয়ে বললে, শরৎদি, কাকাবাবুকে এবার চা খাওয়ানো চলবে এখানে? খুব ভালো বন্দোবস্ত৷
শরৎ রাজি হল না৷ বাবাকে পরকালে যমের বাড়ি সে কখনো পাঠাতে পারবে না৷ যা নাস্তিক উনি, এমনি কি গতি হয় ওঁর কে জানে! তার ওপর রাশ আলগা দিলে কি আর রক্ষা আছে? বাবা ধেই ধেই করে নৃত্য করে বেড়াবেন এই কলকাতা শহরে!
প্রভাসের নির্বন্ধাতিশয্যে শরৎ একটু বিরক্তই হল৷ সে যখন বলছে বাবা যেখানে সেখানে খাবেন না, তখন তাঁকে অত প্রলোভন দেখাবার মানে কি?
বললে, আচ্ছা প্রভাসদা, ওঁকে খাইয়ে কেন বাবার জাতটা মারবেন এ কদিনের জন্যে? ও কথাই ছেড়ে দিন৷
এবার কিন্তু কেদার বিদ্রোহ ঘোষণা করে বললেন, হ্যাঁঃ, যত সব! একদিন কোথাও চা খেলেই একেবারে নরকে যেতে হবে! নরক অত সোজা নয়, পরকালও অমন ঠুনকো জিনিস নয়৷ চলো সবাই মিলে চা খেয়ে আসা যাক হে—
শরৎ দৃঢ়স্বরে বললে, না, তা কখনো হবে না৷ যাও দিকি—সন্দে-আহ্নিক তো করো না কোনোকালে, আবার ছত্যিশ জাতের জল না খেলে চলবে না তোমার বাবা?
কেদারের সাহসের ভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে গেল৷ প্রভাসও আর অনুরোধ করলে না, তিনিও আর যেতে চাইলেন না৷ ওখান থেকে সবাই এল ইডেন গার্ডেনে৷ রাত প্রায় সাড়ে আটটা, বহু সুসজ্জিত সাহেব-মেমকে বেড়াতে দেখে শরৎ তো একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত৷ এত সাহেব-মেম একসঙ্গে কখনো দেখা দূরে যাক, কল্পনাও করে নি কোনো দিন! শরৎ হাঁ করে একদৃষ্টে এরিকা পামের কুঞ্জের মধ্যে বেঞ্চিতে উপবেশন-রত দুটি সুবেশ, সুদর্শন সাহেব ও মেমের দিকে চেয়ে রইল৷ হঠাৎ কি ভেবে তার চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়তেই আঁচল দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে সে মুছে ফেললে৷ শরতের মনে পড়ল, গ্রামের লোকের দুঃখদারিদ্র্য, কত ভাগ্যহত, দীনহীন ব্যক্তি সেখানে, কখনো জীবনে আনন্দের মুখ দেখলে না৷ ব্যান্ডস্ট্র্যান্ডে ব্যান্ড বাজছিল অনেকক্ষণ থেকে৷ শরৎ অনেকক্ষণ বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনলে৷ কিন্তু ওর ভালো লাগল না, সবই যেন বেসুরো, তার অনভ্যস্ত কানে পদে পদে সুরের খুঁৎ ধরা পড়ছিল৷
প্রভাস বললে, সিনেমা দেখবে তো বলো নিয়ে যাই!
শরৎ কখনো না দেখলেও সিনেমা সম্বন্ধে গড়শিবপুরে থাকতেই শহর-প্রত্যাগত নববিবাহিতা বালিকা কিংবা বধূদের মুখে অনেক গল্প শুনেছে৷ বাবাকে এমন জিনিস দেখাতেই হবে, সে নিজে দেখুক না দেখুক, কিন্তু আজ আর নয়—বাবার কিছু খাওয়া হয় নি বিকেল থেকে৷ একবার তার মনে হল বাবা চা খেতে চাইছেন, খান বরং কোনো ভালো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকানে বসে! কি আর হবে! বাবা না নাস্তিক, এত বয়েস হল, একবার পৈতেগাছটা হাতে করে গায়ত্রী জপটাও করেন না কোনোদিন, পরকালে ওঁর অধোগতি ঠেকাবার সাধ্যি হবে না শরতের—সুতরাং ইহকালে যে ক’দিন বাঁচেন, অন্ততঃ সুখ করে যান৷ ইহকালে পরকালে দু-কালেই কষ্ট করে আর কি হবে?
শরৎ বললে, বাবাকে চা খাইয়ে নিই কোনো দোকানে বসে৷ ভালো দোকান দেখে—ব্রাহ্মণের দোকান নেই?
কেদার অবাক হয়ে মুখের দিকে চাইলেন৷ প্রভাস বিপন্ন মুখে বললে, ব্রাহ্মণের দোকান—তাই তো—ব্রাহ্মণের দোকান তো এদিকে দেখছি নে—আচ্ছা হয়েছে—এক উড়ে বামুন ঘড়া করে চা বেচে ওই মোড়টাতে, ভাঁড়ে করে দেয়—সেই সবচেয়ে ভালো৷ চলুন নিয়ে যাই৷
চা-পান শেষ করে ওরা আবার মোটরে চৌরঙ্গী পার হয়ে পার্ক স্ট্রীটের মোড় পর্যন্ত গেল৷ এক জায়গায় এসে কেদার বললেন, এখানটাতে একটু নেমে হেঁটে দেখলে হত না প্রভাস? বেশ দেখাচ্ছে—
গাড়ি এক জায়গায় রেখে ওরা পায়ে হেঁটে চৌরঙ্গীর চওড়া ফুটপাথ দিয়ে আবার ধর্মতলার মোড়ের দিকে আসতে লাগল৷ দোকান-হোটেলগুলির আলোকোজ্জ্বল অভ্যন্তর ও শো-কেসগুলির পণ্যসজ্জা ওদের একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে—শরৎ তো একেবারে বিস্ময়বিমুগ্ধ৷
কতকাল মেয়েমানুষ হয়েও সে জিনিসপত্রের লোভ করে নি৷ জিনিসপত্র অধিকার করে রাখবার মেয়েদের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি চেপে চেপে রাখে মনের মধ্যে, শরতের সে-সব বহুদিন চলে গিয়েছিল মন থেকে মুছে—কিন্তু আজ যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তারা৷
একটা দোকানে ক্রিস্ট্যালের চমৎকার ফুলদানি দেখে শরৎ ভাবলে—আহা, একটা ওইরকম ফুলদানি কেনা যেত!—বুনোফুল কত ফোটে এই সময় কালো পায়রা দিঘির পাড়ের জঙ্গলে, সাজিয়ে রাখত সে রোজ রোজ৷ একটা চমৎকার পুতুল সাদা পাথরের, একটা কি অদ্ভুত কাঁচের বল, তার মধ্যে বিজলির আলো জ্বলছে…কি চমৎকার শাড়ি একটা বাঙালির দোকানে, রাজলক্ষ্মীর জন্যে ওইরকম শাড়ি একখানা যদি নিয়ে যাওয়া যেত! জন্মে সে এরকম পাড়ের শাড়ি কখনো দেখে নি৷
প্রভাস বললে, এটাকে বলে নিউমার্কেট৷ চৌরঙ্গী ছাড়িয়ে এলাম—চলুন শরৎদির জন্যে কিছু ফল কিনি৷
শরৎ বললে, না, আমার জন্যে আবার কেন খরচ করবেন প্রভাসদা? ফল কিনতে হবে না আপনার৷
প্রভাস ওদের কথা না শুনে ফলের দোকানের দিকে সকলকে নিয়ে গেল৷ এর নাম ফলের দোকান! শরৎ ভেবেছিল, বুঝি ঝুড়িতে করে তাদের দেশের হাটের মতো কলা, পেঁপে, বাতাবিনেবু বিক্রি হচ্ছে রাস্তার ধারে—এরই নাম ফলের দোকান! কিন্তু কি এ ব্যাপার? এত স্তূপীকৃত বেদানা, কমলালেবু, কিশমিশ, আনারস, আঙুর যে এক-জায়গায় থাকতে পারে, এ কথা সে জানত এখানে আসবার আগে? তবুও তো এগুলো তার পরিচিত ফল, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে—অন্য কতশত প্রকারের ফল রয়েছে যা সে কখনো চক্ষেও দেখে নি—নামও শোনে নি!
শরৎ জিজ্ঞেস করলে, কাগজে জড়ানো জড়ানো ওগুলো কি ফল প্রভাসদা?
—ও আপেল, কালিফোর্নিয়া বলে একটা দেশ আছে আমেরিকায়, সেখান থেকে এসেছে৷ তোমার জন্যে নেব শরৎদি? আর কিছু আঙুর নিই, কাকাবাবু আনারস ভালোবাসেন?
একটা বড় ঠোঙায় ফল কিনে ওরা নিউমার্কেটের বিভিন্ন দিকে বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় এল—সেখানে একটা আস্ত বাঘের হাঁ-করা মুণ্ডু মেঝের ওপর দেখে শরৎ চমকে উঠে বাবাকে দেখিয়ে বললে, বাবা, একটা বাঘের মাথা!
কেদারও অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সেদিকে৷
প্রভাস বললে, এরা জন্তুর চামড়া আর মাথা এরকম সাজিয়ে বিক্রি করে৷ এদের বলে ট্যাক্সিডারমিস্ট৷ এরকম অনেক দোকান আছে৷
এইবার সত্যি সত্যি একটা জিনিস পছন্দ হয়েছে বটে শরতের৷ ওই বাঘের মুণ্ডুসুদ্ধ ছালখানা৷ তার নিজের শাড়ির দরকার নেই, গহনার দরকার নেই—সে-সব দিন হয়ে গিয়েছে তার জীবনে৷ কিন্তু এই একটা পছন্দসই জিনিস যদি সে নিজের দখলে নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখতে পারত, তবে সুখ ছিল পাঁচজনকে দেখাবার মতো জিনিস বটে৷
মুখ ফুটে সে প্রভাসকে দামটা জিজ্ঞেস করলে৷ প্রভাস দোকানে ঢুকে বললে, ওটা বিক্রির জন্যে নয়৷—দোকান সাজাবার জন্যে৷ তবে এরকম ওদের আছে,—আড়াইশো টাকা দাম৷
অরুণ বললে, এখন কোথায় যাওয়া হবে?
প্রভাস বললে, কেন, সিনেমায়? কি বলেন কাকাবাবু—
শরতের যদিও সিনেমা দেখবার আগ্রহ খুবই প্রবল, তবুও সে যেতে রাজি হল না৷ বাবা সেই কোন সকালে দুটো খেয়ে বেরিয়েছেন, এখন গিয়ে রান্না না চড়িয়ে দিলে আবার তিনি কখন খাবেন?
অগত্যা সকলে মোটরে আলোকোজ্জ্বল কলিকাতা নগরীর বিরাট সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে এল আবার সেই বেলগেছের পুলের মুখে৷
শরৎ এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এইবার বললে, বাবাঃ, কত বড় শহর৷ কূলও নেই, কিনারাও নেই!
প্রভাস হেসে বললে, শরৎদি, একি আর তুমি ধর্মদাসপুর পেয়েছ? গড়শিবপুর থেকে ধর্মদাসপুর যত বড়—ততখানি লম্বা হবে কলকাতা৷ আজ চলো, কাল আবার ভালো করে দেখো৷ আমাদের মলঙ্গা লেনের বাড়িতেও নিয়ে যাব৷
বেলগেছের পুল ছেড়ে দু-ধারের দৃশ্য যেন অনেকটা পাড়াগাঁয়ের মতো৷ বড় বড় বাগানবাড়ির ঘন বৃক্ষশ্রেণীর অন্তরালে দু-চারটি বিজলি বাতি, কোনো কোনো বাগানবাড়ি একদম অন্ধকার৷ এখানে এক পশলা বৃষ্টি আসতে গাড়ির জানলার কাঁচ উঠিয়ে দেওয়া হল হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে—খাড়া সোজা পথ তীব্র হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চোখের সামনে—দ্রুতগামী মোটর লম্ভে লম্ভে যেন সে সুদীর্ঘ পথটার খানিকটা করে অংশ এক এক কামড়ে গিলে খাচ্ছে৷ শরৎ হাঁ করে চেয়ে রইল৷
ওদের বাগানবাড়িটার ফটক দিয়ে গাড়ি ঢুকল ভেতরে৷
এ বাগানটা যেন আরও অন্ধকার৷ তবে সব ঘরেই বিজলি বাতির বন্দোবস্ত৷
প্রভাস কি টিপলে—পুটুস—পুটুস—এ ঘরে আলো জ্বলে উঠল সবুজ কাঁচের বড় চিমনির মধ্যে দিয়ে—বারান্দায় পুটুস পুটুস—দীর্ঘ বারান্দায় এদিক থেকে ওদিকে তিনটে আলো জ্বলে উঠল৷
শরৎ বললে, আমায় দেখিয়ে দিন প্রভাসদা কি করে জ্বালাতে হয়—
পুটুস—বাতি নিবে গেল—একদম অন্ধকার৷
—এইটে হাত দিয়ে টেপো শরৎদি—এই দেখো—এই জ্বললো—আবার উঠিয়ে দাও—এই নিবে গেল—
শরৎ বালিকার মতো খুশিতে বার বার সুইচ টিপে আলো একবার জ্বালিয়ে একবার নিবিয়ে দেখতে লাগল৷
—বাবা, দ্যাখো কি রকম, তুমি এরকম দ্যাখো নি—
কেদার তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ওসব তুমি দ্যাখো মা৷ আমি এর আগেও এসেছি, ওসব দেখে গিয়েছি—
শরৎ বললে, সে কবে বাবা? তুমি আবার কবে কলকাতায় এসেছিলে শুনি?
—তুই তখন জন্মাস নি৷ কলকাতায় তখন ঘোড়ার ট্রাম চলত৷ তোর মার জন্যে বড়বাজার থেকে ভালো তাঁতের ডুরে-শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই দেখে তোর মার কি আহ্লাদ!…তখন ইলেকটিরি আলো সব রাস্তায় ছিল না, দু-একটা বড় রাস্তায় দেখেছিলাম৷ লোকের বাড়িতে তখন গ্যাস জ্বলত—
প্রভাস বিস্ময়ের সুরে বললে, সত্যি কাকাবাবু, আপনি যা বলছেন ঠিক তো! আমি বাবার মুখেও শুনেছি প্রথম হ্যারিসন রোডে ইলেকট্রিক লাইট জ্বলে, তখন—
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই যে রাস্তা বললে, ওখানেই আমি দেখেছি—অনেক দিনের কথা৷
ইতিমধ্যে ঝি এসে জানাল, উনুনে আঁচ দেওয়া হয়েছে৷ শরৎ তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে গেল—যাবার সময় বলে গেল, বোসো বাবা, ভালো করে চা করে আনি—প্রভাসদা, অরুণবাবু যাবেন না চা না খেয়ে৷
রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে ক্ষিপ্তহস্তে রান্না-বাড়া সাঙ্গ করে শরৎ বাবাকে খাওয়ার ঠাঁই করে দিলে৷ প্রভাস ও অরুণ তার অনেক আগে চা-পান করে বিদায় নিয়েছে৷
শরৎ মাথা দুলিয়ে বললে, ভাত কিন্তু নয় বাবা—লুচি—
—যা হয় দাও মা৷ লুচি কেন?
—লুচির বন্দোবস্ত দেখি করে রেখেছে৷ ঘি, আটা—চাল আনে নি—
—বেশ ভালোই হল—তুই খেতে পাবি এখন—
—বোসো, গরম গরম আনি—
পরম তৃপ্তির সহিত প্রায় বিশ-বাইশখানা লুচি অনর্গল খেয়ে যাওয়ার পরে কেদারের মনে পড়ল, আর বেশি খাওয়া ঠিক হবে না—মেয়ের লুচিতে টান পড়বে৷
শরৎ আবার যখন দিতে এল, বললে, নাঃ আর না, থাক৷
—কেন দিই না এই দুখানা গরম গরম—
—তোমার জন্যে আছে তো?
—ওমা, সে কি! প্রায় আধসেরের ওপর আটা—একপোয়া আটার লুচি আমি খেতে পারি না, তুমি পারো?
—খুব পারি, ওকথা বলো না মা—এক সময়ে…
—তোমার তো বাবা কেবল এক সময়ে আর এক সময়ে৷ এখন পারো না তো আর?
—খুব পারি—
—পারলেও আর দেব না৷ খেয়ে ওঠো—বিদেশবিভুঁই জায়গা—দাঁড়াও দইটা নিয়ে এসে দিই—দই আছে, মিষ্টি আছে—
আহারাদি সেরে পরিতৃপ্তির সহিত তামাক টানতে টানতে কেদার মেয়েকে বললেন, প্রভাস ছোকরা ভালো৷ বেশ যোগাড় আয়োজন করেছে খাওয়ার—কি বলিস মা?
—চমৎকার, আবার কি করবে?
—ফলগুলো কেটেছিস নাকি?
—না বাবা, কাল সকালে কাটব, তোমায় দেব৷ আজ তো লুচি ছিল, তাই খেলাম৷
—বড্ড নির্জন বাগানটা—না?
—গড়ের জঙ্গলের চেয়ে নির্জন নয় তা বলে৷ ওই তো রাস্তা দিয়ে মোটরগাড়ি যাচ্ছে, আর গড়ের জঙ্গলে যে-সময়ে শেয়াল ডাকে, বাঘ বের হয়!
—তা যা বলিস বাপু, সেখানে যতই জঙ্গল হোক, জন্মভূমি তো বটে৷ সেখানে ভয় হয়—তুই সত্যি করে বল তো?
—ভয় হলে কি থাকতে পারতাম বাবা? ছেলেবেলা থেকে কাটালাম কি করে তবে?
—কিন্তু এখানে কেমন যেন ভয় করে মা৷ কলকাতা শহর যেমন, তেমন গুণ্ডা-বদমাইশের জায়গা৷
সারাদিন মোটর ভ্রমণের ক্লান্তির ফলে রাত যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল৷
পরদিন সকালে শরৎ বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিয়ে বাবার জন্যে চা আর খাবার করতে বসল৷ অনেকদিন পরে সে বাবাকে ভালো করে খাওয়ানোর সচ্ছল উপকরণ হাতের কাছে পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷
কেদার বললেন, প্রভাস আর অরুণের জন্যে খাবার করে রাখো মা, যদি ওরা সকালে এসে পড়ে?
কিন্তু তারা সকালের দিকে এল না৷
দুপুরের পর কেদার একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ তাঁর দিবানিদ্রা অভ্যাস নেই—অথচ রাস্তাঘাট না চেনার দরুন কোথাও যেতেও পারেন না৷ এই বাগানবাড়ির চতুঃসীমায় বন্দী-জীবন যাপন করার মতো লোক নন তিনি৷
শরৎকে ডেকে বললেন, হ্যাঁ মা, গঙ্গা কোনদিকে ঝিকে জিজ্ঞেস করো তো?
শরৎ ঘুরে এসে বললে, গঙ্গা নাকি এখান থেকে দুক্রোশ পথ বাবা৷ কেন, গঙ্গা কি হবে?
—না, একটু বেড়িয়ে আসতাম গঙ্গার ধারে৷
বেলা তিনটের পর প্রভাস একা মোটর হাঁকিয়ে এল৷
বললে, ওবেলা কাজ ছিল জরুরী—আসতে পারলাম না৷ কোনো অসুবিধে হয় নি তো কাকাবাবু?
—নাঃ, অসুবিধে কি হবে? অরুণ এল না?
—তার সঙ্গে দেখাই হয় নি আজ সারাদিন৷ তবে সেও কাজে ব্যস্ত আছে মনে হচ্ছে৷ নইলে নিশ্চয় আসত৷
—তুমি চা খেয়ে নাও শরৎ মা, তোমার প্রভাসদাকে—
আধ ঘণ্টার মধ্যে কেদার চা-পান শেষ করে মেয়েকে নিয়ে মোটরে উঠলেন৷ বললেন, কলকাতার দিকে না গিয়ে এবার চলো না বেশ গঙ্গার ধারে নির্জন জায়গায়—
—পেনেটিতে দ্বাদশ শিবের মন্দিরে যাবেন?
শরৎ আগ্রহের সুরে বললে তাই চলো প্রভাসদা, দেখি নি কখনো৷
কেদার শিবমন্দির দেখবার কোনো আগ্রহ দেখালেন না—তীর্থদর্শনে পুণ্যঅর্জন করবার ওপর লোভ জীবনে তাঁর কোনো দিনই দেখা যায় নি৷
বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে পড়ে মোটর তীরবেগে পেনিটির দিকে ছুটল৷ রাস্তার দুধারে কত বিচিত্র উদ্যানরাজি, কত সুন্দর বাড়ি—কলকাতার বড়লোকদের ব্যাপার৷ পেনিটির দ্বাদশ শিবের মন্দির দেখে শরৎ খুব খুশি৷ সামনে গঙ্গা, ওপারে কত কলকারখানা, মন্দির, ঘরবাড়ি৷ এপারে সারি সারি বাগানবাড়ি—বিকেলের নীল আকাশ গঙ্গার বিশালবক্ষে ঝুঁকে পড়েছে— নৌকো স্টীমারের ভিড়৷
শরৎ অবাক হয়ে গঙ্গার বাঁধাঘাটে রানার ওপর দাঁড়িয়ে দেখে দেখে বললে—এমন কখনো দেখি নি বাবা, ওপারের দিকটা কি চমৎকার!
প্রভাস বললে, ভালো লাগছে, শরৎদি?
—উঃ, ইচ্ছে করে এখানেই সব সময় থাকি আর গঙ্গাস্নান করি—ভালো কথা প্রভাসদা, কাল গঙ্গা নাওয়াও না কেন?
—বেশ ভালোই তো৷ কোন সময়ে আসব বলো—কোথায় নাইবে?
—এখানেই এসো৷ এ জায়গা আমার ভারি ভালো লেগেছে—
—এখানেই আসবে? না কালীঘাটে? কাকাবাবু কি বলেন?
—তুমি যেখানে ভালো বোঝো৷ বাবার কথা ছেড়ে দাও—উনি ওসব পছন্দ করেন না৷
সন্ধ্যার আগে অস্ত-দিগন্তের চিত্রবিচিত্র রঙিন আকাশের ছায়া গঙ্গার জলে পড়ে যে মায়ালোক সৃষ্টি করল, শরৎ সে-রকম দৃশ্য জীবনে কোনোদিন দেখে নি৷ গড়শিবপুর জলের দেশ নয়—এত বড় নদী, জলের বুকে এমন রঙিন মেঘের প্রতিচ্ছায়া সে এই প্রথম দেখল৷ রাজলক্ষ্মীর জন্যে মনটা কেমন করে উঠল শরতের—সে বেচারি কিছু দেখতে পেলে না জীবনে, আজ সে সঙ্গে থাকলে আনন্দ অনেক বেশি হত৷
বাড়ি ফিরে শরৎ রান্নাঘরে ঢুকল—প্রভাস কিছুক্ষণ বসে কেদারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল৷
কথায় কথায় কেদার বললে, হ্যাঁ হে, এখানে কোথাও গান-টান হয় না?
আসলে কেদারের এসব খুব ভালো লাগছিল না—শহর, দেবমন্দির, গঙ্গা, দোকান, ট্রাম—এসব খুব ভালো জিনিস৷ কিন্তু তিনি একটু গান-বাজনা চান, চিরকাল যা করে এসেছেন৷ শরৎ ছেলেমানুষ, তার ওপর মেয়েমানুষ—ও শহর বাজার, ঠাকুর দেবতা দেখে খুশি থাকতে পারে—কেদারের এখন সে বয়েস নেই৷ মেয়েমানুষও নন যে পুণ্যের লোভ থাকবে৷
প্রভাস বললে, কি রকম গান-বাজনা বলুন?
—এই ধরো কোনো গান-বাজনার আড্ডা—শুনেছি তো কলকাতায় অনেক বড় বড় গানের মজলিশ বসে বড়লোকের বাড়ি৷ একদিন সে-রকম কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারো?
প্রভাস একটু ভেবে বললে, তা বোধ হয় পারব—দেখি সন্ধান নিয়ে৷ কাল বলব আপনাকে—
—অনেক শুনেছি বড় বড় ওস্তাদ আছে কলকাতায়, কোথায় থাকে জানো? তাদের গান শোনবার সুবিধে হয়?
—আমি দেখব কাকাবাবু৷ অরুণকে জিগগেস করি কাল—ও অনেক খোঁজ রাখে—
প্রভাস মোটর নিয়ে চলে যাচ্ছে, এমন সময় শরৎ এসে বললে—ও প্রভাসদা, যাবেন না—
—কেন শরৎদি?
—আপনার জন্যে একটা জিনিস তৈরি করছি—
—কি বলো না?
—এখন বলছি নে—আসুন, খাবার সময় দেব—
—খুব দেরি হয়ে যাবে শরৎদি—
—কিছু দেরি হবে না, হয়ে গেল—গরম গরম ভেজে দেব—
কিছুক্ষণ পরে শরৎ একখানা রেকাবিতে খানকতক মাছের কচুরি এনে বললে—খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে৷ এবেলা ঝি ভালো পোনামাছ এনেছে প্রায় আধসের৷ অত মাছ রান্না করে কে খাবে? তাই ভাবলাম বাবার জন্যে খান-কতক কচুরি ভাজি—
প্রভাস বললে, কাকাবাবুকে দিলে না?
—তাঁকে এখন না৷ এখন খেলে রাত্রে আর খেতে পারবেন না৷ তখন একেবারে দেব—
প্রভাস খাওয়া শেষ করে বিদায় নেওয়ার আগে বললে—কাল শরৎদি গঙ্গা নাওয়াবো তোমায়৷ ভেবে রেখো কালীঘাট না পেনিটি কোথায় যাবে?
কেদার বললেন, আমার কথাটা যেন মনে থাকে, প্রভাস৷ ভালো গান-বাজনার সন্ধান পেলেই খবর দেবে—
—সে আমার মনে আছে কাকাবাবু৷
পরদিন সকালে উঠে কেদার দেখলেন মেয়ে তাঁর আগেই উঠে বাগানে ফুল তুলে বেড়াচ্ছে৷ বাবাকে দেখে বললে—ওঠো বাবা, আমি আজ পুজো করব ভেবে ফুল তুলছি৷ কি চমৎকার চমৎকার ফুল ফুটে আছে পুকুরের ওপাড়ে! তুমি চেনো এসব ফুল? বিলিতি না কি ফুল—দেখিই নি কখনো—
কেদার বললেন, বেশ বাগানবাড়িটা, না মা শরৎ? কিন্তু—
—কিন্তু কি বাবা?
—এখানে বেশিদিন মন টেঁকে না৷ আমাদের গড়শিবপুরের সেই জঙ্গলা ভালো—না মা?
—যা বলেছ বাবা৷ বাগানের পুকুরটা দেখে আমার এইমাত্র কালো পায়রার দিঘির কথা মনে পড়ছিল—
—আর কতদিন থাকবে এখানে? প্রভাস কিছু বলেছে?
—তুমি যে ক’দিন বলো বাবা৷ এখনও কালীঘাট দেখি নি, বায়স্কোপ দেখি নি—দেখি সেগুলো? আর কি কি আছে দেখবার বাবা?
—চিড়িয়াখানাটা আমার সেবারও দেখা হয় নি—এবার দেখব৷
—সেবার মানে কি বাবা? হয়তো ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগেকার কথা৷ আমার জন্মাবার অনেক আগে—না?
—হ্যাঁ—তা হবে৷ তোমার মায়ের জন্যে একখানা শাড়ি, বেশ ভালো ডুরে শাড়ি কিনে নিয়ে যাই, মনে আছে৷
—তুমি হাত ধুয়ে নাও বাবা, আমি চা করে আনি—খাবার কি খাবে?
এমন সময় গেটের পথে মোটরের শব্দ শোনা গেল—সঙ্গে সঙ্গে প্রভাসের মোটর এসে বারান্দার সামনের লাল কাঁকরের পথের ওপর এরিকা-পাম কুঞ্জের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল৷ প্রভাস নেমে এসে বললে, চলুন কাকাবাবু, কালীঘাটে নিয়ে যাই—শরৎদি তৈরি হয়ে নাও৷
শরৎ খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললে, সে বেশ হবে প্রভাসদা, চলো বাবা, চা করে নিয়ে এলাম বলে, বসো সব৷
সত্যিই এ ক’দিন অদ্ভুত উত্তেজনা ও আনন্দের মধ্যে শরতের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে৷ কেদার বৃদ্ধ হয়েছেন, নতুন জায়গা এখন আর তাঁর তেমন ধাক্কা দেয় না, জীবনের সমস্ত আকাশটা জুড়ে গড়শিবপুরের ভাঙা রাজ-দেউড়ি ও বনজঙ্গলে ঘেরা গড়খাই সেখানে পূর্ণ অধিকারের আসন পেতেছে, আর আছে ছিবাস মুদির দোকান, ওপাড়ার কৃষ্ণযাত্রার আখড়াইয়ের আসর—তার সঙ্গে হয়তো সতীশ কলুর দোকান—তাদের ছোট্ট খড়ের বাড়িখানা৷ এ বয়সে নতুন কোনো জিনিস জীবনে স্থান দখল করতে পারে না৷ জীবনের বৃত্ত পরিধিকে শেষ করে ওদিকের বিন্দুতে মিলবার চেষ্টায় রয়েছে—নব অনুভূতিরাজির সঞ্চার এ বয়সে সম্ভব কবি ও বৈজ্ঞানিকের পক্ষে, প্রতিভাবান শিল্পীর পক্ষে, কেদার সে দলে পড়ে না৷
প্রভাসের মোটর এবার স্ট্র্যান্ড রোড ধরে চলল হ্যারিসন রোড দিয়ে৷ প্রভাস বললে, ইডেন গার্ডেনটা একবার দেখিয়ে নিয়ে যাই আপনাদের?
কেদার বললেন, সেটা কি বাবাজি?
—আজ্ঞে একটা বাগান, বেশ ভালো, সবাই বেড়াতে আসে৷
—ও বাগান-টাগান আমরা আর কি দেখব, বন-বাগান তো দেখেই আসছি, তুমি বরং আমাদের কালীঘাটটা নিয়ে চল৷
কালীঘাটে কালীমন্দিরের সামনের চত্বরে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পেয়ে শরৎ খুশির সুরে বললে—বাবা, ওই অরুণবাবু, ডাকুন না প্রভাসদা?
প্রভাস বললে, এখানে আমাদের সঙ্গে মিশবার কথা ছিল ওর৷ ও অরুণ—এই যে!
শরৎ কালী-গঙ্গায় স্নান সেরে মন্দিরে দেবী দর্শন করে এল৷ সঙ্গে রইল প্রভাস৷ কেদার মোটরে বসে চারিপাশের ভিড় দেখতে লাগলেন৷ অরুণ একটা ছোট ঘর ভাড়ার চেষ্টায় গেল, কারণ প্রভাস ও অরুণ দুজনে শরৎকে বিশেষ করে ধরেছে, এখানে চড়ুইভাতি করতে হবে৷
শরৎ বড় অস্বস্তি বোধ করে একটা ব্যাপারে৷ এখানকার লোকে এমনভাবে তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে কেন? শহরের লোকের এমন খারাপ অভ্যাস কেন? আজ ক’দিন থেকেই সে লক্ষ করছে৷ অপরিচিতা মেয়েদের দিকে অমনভাবে চেয়ে থাকা বুঝি ভদ্রতা? শরতের জানা ছিল কলকাতার লোকে শিক্ষিত, তাদের ধরনধারণ খুব ভদ্র হবে, তাদের দেখে গড়শিবপুরের মতো পাড়াগাঁয়ের লোকেরা শিখবে৷ এখন দেখা যাচ্ছে তার উল্টো৷
অরুণ বাড়ি ঠিক করে এসে কেদারকে বললে, এরা কই? চলুন এবার, সব ঠিক করে এলাম৷
একটু পরে প্রভাসের সঙ্গে শরৎ মন্দির থেকে ফিরল৷ ওরা সবাই মিলে ভাড়াটে ঘরে গিয়ে শতরঞ্জি পেতে বসল৷ হোগলার ছাওয়া, দরমার বেড়া দেওয়া সারি সারি অনেকগুলো খুপরির মতো ঘর৷ ছোট্ট একটুখানি নিচু দাওয়ায় মাটির উনুন৷ প্রভাস মোটরের ক্লিনারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে প্রচুর বাজার করে নিয়ে এল, এমন কি প্রসাদী মাংস পর্যন্ত৷ কেদার খুব খুশি৷ মেয়েকে বললেন—ভালো করে মাংসটা রাঁধিস মা, একটু ঝাল দিস৷
—সে কি বাবা, ঝাল যে তুমি মোটে খেতে পারো না?
—তা হোক, কচি পাঁটার মাংস ঝাল না দিলে ভালো লাগে না৷
রান্না-খাওয়া মিটতে বেলা তিনটে বাজল৷ অরুণদের আবার কে একজন বন্ধু এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলে৷ লোকটি এসেই বলে উঠল—এই যে প্রভাস, আরে অরুণ এনেছিস তো জুত করে! ভালো চিজ বাবা, তোদের সাহস আছে বলতে হবে!
প্রভাস তাড়াতাড়ি তাকে চোখ টিপে দিলে, শরৎ দেখতে পেল৷ সে কিছু বুঝতে পারলে না, লোকটা অমন কেন, এসেই চিৎকার করে কতগুলো কথা বলে উঠল—যার কোনো মানে হয় না! কলকাতা শহরে কত রকম মানুষই না থাকে!
কি জানি কেন, লোকটাকে শরতের মোটেই ভালো লাগল না৷ মোটা মতো লোকটা, নাম গিরীন, বয়সে প্রভাসের চেয়েও বড়, কারণ কানের পাশের চুলে বেশ পাক ধরেছে৷
তিনটের পরে ওখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে গিয়ে প্রভাস একটা বাগানের সামনে গাড়ি রেখে বললে—এই চিড়িয়াখানা কাকাবাবু, নেমে দেখুন এবার—
শরৎ সব দেখেশুনে সমস্ত দিনের কষ্ট ও শ্রম ভুলে গেল৷ কেদারও এমন, একটা জিনিস দেখলেন, যা তাঁর মনে হল না দেখলে জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেত৷ পৃথিবীতে যে এত অদ্ভুত ধরণের জীবজন্তু থাকতে পারে, তার কল্পনা কে করেছিল? কেদার তো ভাবতেই পারেন না৷ পিতাপুত্রীতে মিলে সমবয়সী বালক-বালিকার মতো আমোদে পশুপক্ষী দেখে বেড়াল৷ এ ওকে দেখায়, ও একে দেখায়৷ কী ভীষণ ডাক সিংহের? জলহস্তী—এর নাম জলহস্তী? ছেলেবেলায় ‘প্রাণী-বৃত্তান্ত’ বলে বইয়ে কেদার এর কথা পড়েছিলেন বটে৷ ওই দ্যাখো শরৎ মা, ওকে বলে উঠপাখি৷
—কতবড় ডিম বাবা উঠপাখির! আচ্ছা ও খায়, প্রভাসদা? বিক্রি হয়?
ফেরবার সময় গেটের কাছে এসে গিরীন প্রভাস ও অরুণের সঙ্গে কি সব কথা বললে৷ প্রভাস এসে বললে, কাকাবাবু, এবার চলুন সিনেমা দেখে আসি, মানে বায়োস্কোপ৷ কাছেই আছে—
কেদার বললেন, তা চলো, যা ভালো হয়৷
বাইরে এসে ওরা একটা ফাঁকা মাঠের ধারে মোটর থামিয়ে রেখে কেদার ও শরৎকে নেমে হাওয়া খেতে বললে৷ এরই নাম গড়ের মাঠ৷ সেদিনও নেমেছিল শরৎ৷ তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে—রাস্তার ধারে গ্যাসের আলো এক-একটা করে জ্বেলে দিচ্ছে৷ শরৎ জিজ্ঞাসা করলে—সে বায়োস্কোপ কতক্ষণ দেখতে হবে? প্রভাস বললে, এই সাড়ে ন’টা পর্যন্ত৷
শরৎ ভেবে দেখলে, অত রাত্রে গিয়ে রান্না চড়ালে বাবা খাবেন কখন? তা ছাড়া বাবা আজ সারাদিন এখানে ওখানে বেড়িয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন—বুড়ো বয়সে অত অনিয়ম করলে যদি শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে বিদেশে—তখন ভুগতে হবে তাকেই৷ সে বললে, আজ থাক প্রভাসদা, আজ আর বায়োস্কোপ দেখে দরকার নেই৷ বাবার খেতে দেরি হয়ে যাবে৷
গিরীন তবুও নাছোড়বান্দা৷ সে বললে, কিছু ক্ষতি হবে না—মোটরে যেতে আর কতটুকু লাগবে?
আজই দেখা যাক৷
শরৎকে অত সহজে ভোলানো যাবে তেমন প্রকৃতির মেয়ে নয় সে৷ নিজের বুদ্ধিতে সে যা ঠিক করে, ভালো হোক, মন্দ হোক, তার সে সঙ্কল্প থেকে নড়ানো গিরীনের কর্ম নয়—গিরীন শীঘ্রই তার পরিচয় পেলে৷ প্রভাসকে সে ইংরেজিতে কি একটা কথা বললে, প্রভাস ও অরুণ দুজনে অনুচ্চস্বরে কি বলাবলি করল৷
প্রভাস বললে, কাকাবাবু কি বলেন?
কেদার নিজের মত অনুসারে চলবার সাহস পান গড়শিবপুরে, এখানে মেয়ের মতের বিরুদ্ধে যেতে তাঁর সাহসে কুলোয় না৷ সুতরাং তিনি বললেন, ও যখন বলছে, তখন আজ না হয় ওটা থাকগে প্রভাস, কাল যা হয় হবে৷
অগত্যা প্রভাস ওদের নিয়ে মোটরে উঠল—কিন্তু বেশ বোঝা গেল ওদের দল তাতে বিরক্ত হয়েছে৷