কেদার রাজা (Kedar Raja) : 11
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে সঙ্গে নিয়ে শরৎ ফিরল নিজের বাসায়৷
বৃদ্ধ বললেন, এই বাড়ি? বেশ৷ কাল তুমি তৈরি হয়ে থেকো৷ তোমার এই বুড়ো ছেলের সঙ্গে কাল যেতে হবে তোমায়৷ পয়সাকড়ি না থাকে, সেজন্যে কিছু ভেবো না—ছেলের সে ক্ষমতা আছে মা-জননী৷
রেণুকা এতক্ষণ কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে গিয়েছিল, শরৎকে চুপি চুপি বললে, উনি কে ভাই?
—আমার জ্যাঠামশাই—
—তোমাকে দেশে নিয়ে যাবেন?
—তাই তো বলছেন৷
—হঠাৎ কালই চলে যাবে কেন, এ মাসটা থেকে যাও না কাশীতে৷ বলো তোমার জ্যাঠামশাইকে৷ খোকার সঙ্গে একবার দেখাও করতে হবে তো? আমাকে এত শীগগির ফেলে দিয়েই বা যাবে কোথায়?
শরৎ বৃদ্ধকে জানাল৷ কালই যাওয়া মুশকিল হবে তার৷ যেখানে কাজ করছে, যারা এতদিন আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল তারা একটা লোক দেখে নিলে সে যাবার জন্যে তৈরি হবে৷
বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে তাতে রাজি হলেন৷ পাঁচ দিনের সময় নিয়ে শরৎ রোজ রান্নাবান্নার পরে রেণুকাকে সঙ্গে নিয়ে খোকনদের বাড়ি যায়৷ কাশী থেকে কোন অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের পথে সে যাত্রা শুরু করবে তা সে জানে না—কিন্তু খোকনকে ফেলে যেতে তার সব চেয়ে কষ্ট হবে তা সে এ ক’দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝছে৷ খোকনের মা ওর যাবার কথা শুনে খুবই দুঃখিত৷
শরৎ বলে, ও খোকন বাবা, গরিব মাসিমাকে মনে রাখবি তো বাবা?
খোকন না বুঝেই ঘাড় নেড়ে বলে—হুঁ, তোমাকে একটা বল কিনে দেব মাসিমা—
—সত্যি?
—হ্যাঁ মাসিমা, ঠিক দেব৷
—আমায় কখনো ভুলে যাবি নে? বড় হলে মাসিমার বাড়ি যাবি, মুড়কি নাড়ু দেব ধামি করে, পা ছড়িয়ে বসে খাবি৷
খোকা ঘাড় নেড়ে বলে— হুঁ৷
বকসীদের বড় বউ ওর নামঠিকানা সব লিখে নিলে, খোকনের মার কাছে ওর নামঠিকানা রইল৷
ফেরবার পথে শরৎ গণেশমহল্লার পাগলির সন্ধানে ইতস্তত চাইতে লাগল, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না৷ রেণুকাকে বললে, ওই একটা মনে বড় সাধ ছিল, পাগলিকে একদিন ভালো করে রেঁধে খাওয়াব—তা কিন্তু হল না৷ আমি মাইনে বলে কিছু চেয়ে নেব মিনুর কাকির কাছ থেকে, যদি কিছু দেয় তবে তোর কাছে রেখে যাব৷ আমার হয়ে তুই তাকে একদিন খাইয়ে দিস—
রেণুকা ধরা গলায় বলে—আর আমার উপায় কি হবে বললে না যে বড়? তোমার ছত্র কবে এসে খুলছ কাশীতে—শরৎসুন্দরী ছত্র? গরিব লোক দুটো খেয়ে বাঁচি৷
শরৎ হেসে ভঙ্গি করে ঘাড় দুলিয়ে বললে, আ তোমার মরণ! এর মধ্যে ভুলে গেলি মুখপুড়ি? শরৎসুন্দরী নয়, কেদার ছত্তর—
—ও ঠিক, ঠিক৷ জ্যাঠামশায়ের নামে ছত্র হবে যে! ভুলে যাই ছাই—
—না হলেও তুই যাবি আমাদের দেশে৷ মস্ত বড় অতিথিশালা আছে৷ রাজারাজড়ার কাণ্ড! সেখানে বারো মাস খাবি, রাজকন্যের সখী হয়ে—কি বলিস?
—উঃ, তা হলে তো বর্তে যাই দিদিভাই৷ কবে যেন যাচ্ছি তাই বলো, জোড়ে না বিজোড়ে?
—তা কি কখনো হয় রে পোড়ারমুখি? জোড়ের পায়রা জোড় ছাড়া করতে গিয়ে পাপের ভাগী হবে কে?
মিনুর কাকিমাকে শরৎ বিদায়ের কথা বলতেই সে চমকে উঠল প্রায় আর কি৷ কেন যাবে, কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে—নানা প্রশ্নে শরৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল৷ তার কোনো কথাই অবিশ্যি মিনুর কাকিমার বিশ্বাস হল না৷ ওসব চরিত্রের লোকের কথার মধ্যে বারো আনাই মিথ্যে৷
শরৎ বললে, আমায় কিছু দেবেন? যাবার সময় খরচপত্র আছে—
—যখন তখন হুকুম করলেই কি গেরস্তর ঘরে টাকাকড়ি থাকে? আমি এখন যদি বলি আমি দিতে পারব না?
—দেবেন না৷ আপনারা এতদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ঢের৷ পয়সাকড়ির জন্যে তো ছিলাম না, গৌরী-মা বলে দিয়েছিলেন, সব ঠিক করে দিয়েছিলেন—তাই এখানে ছিলাম৷ আপনাদের উপকার জীবনে ভুলব না৷
মিনুর কাকিমা শরতের কথা শুনে একটু নরমও হল৷ বললে, তা—তা তো বটেই৷ তা আচ্ছা দেখি যা পারি দেব এখন৷
বিদায়ের দিন শরৎ মিনুর কাকিমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু-না-কিছু খেলনা ও খাবার জিনিস কিনে নিয়ে এল৷ রেণুকাকে তার ঘরে একখানা লালপাড় শাড়ি দিতে গিয়ে চোখের জলের মধ্যে পরস্পরের ছাড়াছাড়ি হল৷
রেণুকা বললে, এ শাড়ি আমার পরা হবে না ভাই, মাথায় করে রেখে দেব—
—তাই করিস মুখপুড়ি৷
—কেন আমার জন্যে খরচ করলে? ক’টাকা দাম নিয়েছে?
—তোর সে খোঁজে দরকার কি? দিলাম, নে—মিটে গেল৷ জানিস আমি রাজকন্যে, আমাদের হাত ঝাড়লে পর্বত?
রেণুকা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললে—তুমি আমায় ভুলে গেলে আমি মরে যাব ভাই৷
শরৎ মুখে ভেংচি কেটে বললে, মরে ভূত হবি পোড়ারমুখি! ভূত না তো, পেত্নী হবি! রাত্রে আমায় যেন ভয় দেখাতে যেয়ো না!
শরতের মুখে হাসি অথচ চোখে জল৷
আবার কলকাতা শহর৷…
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, এখানে বৃন্দাবন মল্লিকের লেনে আমাদের গাঁয়ের একজন লোক বাস করে, আপিসে চাকরি করে৷ চলো সেখানে গিয়ে উঠি দুজনে৷
খুঁজতে খুঁজতে বাসা মিলল৷ বাড়ির কর্তা জাতিতে মোদক, স্বগ্রামের প্রবীণ ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে সে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল৷ মাথায় রাখে কি কোথায় রাখে, ভেবে যেন পায় না৷ বললে—মা-ঠাকরুণ কে?
—আমার ভাইঝি, গড়শিবপুরে বাড়ি ওদের৷ তুমি চেন না—মস্ত লোক ওর বাবা৷
—তা চাটুজ্জে মশাই, সব যোগাড় আছে ঘরে৷ দিদি ঠাকরুণ রান্নাবান্না করুন, ওরা সব যুগিয়ে দেবে এখন৷ আমার আবার আপিসের বেলা হয়ে গেল—দশটায় হাজির হতেই হবে৷ আমি তেল মাখি—কিছু মনে করবেন না৷
বাড়ির গৃহিণী শরৎকে যথেষ্ট যত্ন করলেন৷ তাকে কিছুই করতে দিলেন না৷ বাটনা বাটা, কুটনো কোটা সবই তিনি আর তাঁর বড় মেয়ে দুজনে মিলে করে শরৎকে রান্না চড়িয়ে দিতে ডাক দিলেন৷
শরতের জন্যে মিছরি ভিজের শরবৎ, দই, সন্দেশ আনিয়ে তার স্নানের পর তাকে জল খেতে দিলেন৷
আহারাদির পর শরতের বড় ইচ্ছে হল একবার কালীঘাটে গিয়ে সে গৌরী-মার সঙ্গে দেখা করে৷ বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে শুনে বললেন, চলো না মা, আমারও ওই সঙ্গে দেবদর্শনটা হয়ে যাক৷
বিকেলের দিকে ওরা কালীঘাটে গেল৷ বাড়ির গৃহিণী তাঁর বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ওদের সঙ্গিনী হলেন৷ মন্দিরের প্রাঙ্গণে বিস্তৃত নাটমন্দিরে দু-তিনটি নূতন সন্ন্যাসী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন৷ গৌরী-মা তাঁর পুরনো জায়গাটিতেই ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন৷ শরৎকে দেখে তিনি প্রায় চমকে উঠলেন৷ বললেন, সরোজিনীরা কি কলকাতায় এসেছে?
শরৎ তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে সব খুলে বললে৷
গৌরী-মা বললেন, তোমার জ্যাঠামশাই? কই দেখি—
বৃদ্ধা চাটুজ্জে মহাশয় এসে গৌরী-মার কাছে বসলেন, কিন্তু প্রণাম করলেন না, বোধ হয় সন্ন্যাসিনী তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট বলে৷ বললেন—মা, আমি আপনার কথা শরতের মুখে সব শুনেছি৷ আপনি আশীর্বাদ করুন আমি ওকে যেন ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে পারি৷ আপনার আশীর্বাদ ছিল বলে বোধ হয় আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল কাশীতে৷
গৌরী-মা বললেন, তাঁর কৃপায় সব হয় বাবা, তিনিই সব করছেন—আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র৷
বাসায় ফিরে আসবার পথে শরতের কেবলই মনে হচ্ছিল, যদি কমলার সঙ্গে একবারটি পথেঘাটে কোথাও দেখা হয়ে যেত, কি মজাই হত তা হলে! কলকাতার মধ্যে যদি কারো সঙ্গে দেখা করবার জন্য প্রাণ কেমন করে—তবে সে সেই হতভাগিনী বালিকার সঙ্গেই আবার সাক্ষাতের আশায়৷
কাশীতে গিয়ে এই দেড় বৎসরে সে অনেক শিখেছে, অনেক বুঝেছে৷ এখন সে হেনাদের বাড়ি আবার যেতে পারে, কমলাকে সেখান থেকে টেনে আনতে পারে, সে সাহস তার মধ্যে এসে গিয়েছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় সে হেনাদের বাড়ির ঠিকানা জানে না, শহর বাজারে ঘরবাড়ির ঠিকানা বা রাস্তা না জানলে বের করতে পারা যায় না, আজকাল সে বুঝেছে৷
কলকাতায় এসে আবার তার বড় ভালো লাগছে৷ কাশী তো পুণ্যস্থান, কত দেউল-দেবমন্দির ঘাট, যত ইচ্ছে স্নান কর, দান কর, পুণ্য কর—স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের সেখানে অধিষ্ঠান৷ কিন্তু কলকাতা যেন ওকে টানে, এখানে এত জিনিস আছে যার সে কিছুই বোঝে না—সেজন্যেই হয়তো কলকাতা তার কাছে বেশি রহস্যময়৷ এত লোকজন, গাড়িঘোড়া, এত বড় জায়গা কাশী নয়৷
শরৎ বলে, জ্যাঠামশায় আপনি কোন কোন দেশে বেড়ালেন?
—বাংলা দেশের কত জায়গা পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি মা, বর্ধমানে গিয়েছি, বৈঁচি, শক্তিগড়, নারাণপুর গিয়েছি৷ রাঢ় দেশের কত বড় বড় মাঠ বেয়ে সন্দেবেলা সুমুখ আঁধার রাত্তিরে একা গিয়েছি৷ বড় তালগাছ ঘেরা দিঘি, জনমানব নেই কোথাও, লোকে বলে ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতের ভয়—এমন সব দিঘের ধারে সারাদিন পথ হাঁটবার পরে বসে চাট্টি জলপান খেয়েছি৷ একদিন সে কথা গল্প করব তোমাদের বাড়ি বসে৷
—বেশ জ্যাঠামশায়৷
—বেড়াতে বড় ভালো লাগে আমার৷ আগে বাংলাদেশের মধ্যেই ঘুরতাম, এবার গয়া কাশীও দেখা হল—
—আমারও খুব ভালো লাগে৷ বাবা কোনো দেশ দেখেন নি৷ বাবাকে নিয়ে চলুন আবার আমরা বেরুবো—
—খুব ভালো কথা মা৷ চলো এবার হরিদ্বারে যাব—
—সে কতদূর? কাশীর ওদিকে?
—সে আরও অনেক দূর শুনেছি৷ তা হোক, চলো সবাই মিলে যাওয়া যাক—বৃন্দাবন হয়ে যাব—তোমার বাবাও চলুন৷
—জ্যাঠামশায়?
—কি মা?
—বাবার দেখা পাব তো?
—আমি যখন কথা দিয়েছি মা, তুমি ভেব না৷ সে বিষয়ে নিশ্চিন্দি থাকো৷
পরদিন গোপেশ্বর চাটুজ্জে শরৎকে কলকাতায় তাঁর স্বগ্রামবাসী কৃষ্ণচন্দ্র মোদকের বাসায় রেখে দুদিনের জন্যে গড়শিবপুরে গেলেন৷ শরৎকে আগে হঠাৎ গ্রামে না নিয়ে গিয়ে ফেলে সেখানকার ব্যাপার কি জানা দরকার৷ গড়শিবপুরে গিয়ে সন্ধান নিয়ে কিন্তু তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল, যা শুনলেন সেখানে গ্রামের লোকে বললে, কেদার রাজা বা তাঁর মেয়ে আজ প্রায় দেড়-বৎসর দু-বৎসর আগে গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে যান৷ সেখান থেকে তাঁরা কোথায় চলে গিয়েছেন তা কেউ জানে না৷ কলকাতায় তাঁরা নেই একথাও ঠিক৷ যাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তারাই ফিরে এসে বলেছে৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে গ্রামের অনেককেই জিজ্ঞেস করলেন, সকলেই ওই এক কথা বলে৷ সেবার যে সেই মুদির দোকানে কেদারের সঙ্গে বসে বসে গান-বাজনা করেছিলেন সেখানেও গেলেন৷ কেদার গাঁয়ে না থাকায় গানবাজনার চর্চা আর হয় না, মুদি খুব দুঃখ করলে৷ গোপেশ্বরকে তামাক সেজে খাওয়ালে৷ অনেকদিন কেদার বা তাঁর মেয়ের কোনো সন্ধান নেই, আর আসবেন কিনা কে জানে!
বৃদ্ধ তামাক খেয়ে উঠলেন৷
গ্রামের বাইরের পথ ধরে চিন্তিত মনে চলেছেন, শরতের বাপের যদি সন্ধান না-ই পাওয়া যায়, তবে উপস্থিত শরতের গতি কি করা যাবে? কাশী থেকে এনে ভুল করলেন না তো?
এমন সময় পেছন থেকে একজন চাষা লোক তাঁকে ডাক দিলে—বাবাঠাকুর—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে ফিরে চেয়ে দেখে বললেন—কি বাপু?
—আপনি ক্যাদার খুড়ো ঠাকুরের খোঁজ করছিলেন ছিবাস মুদির দোকানে? আমিও সেখানে ছেলাম৷ আপনি কি তাঁর কেউ হন?
—হ্যাঁ বাপু, আমি তাঁর আত্মীয়৷ কেন, তুমি কিছু জান নাকি?
—আপনি কারো কাছে বলবেন না তো?
—না, বলতে যাব কেন? কি ব্যাপার বলো তো শুনি? আমি তাঁর বিশেষ আত্মীয়, আর আমার দরকারও খুব৷
লোকটা সুর নিচু করে বললে—তিনি হিংনাড়ার ঘোষেদের আড়তে কাজ করছেন যে! হিংনাড়া চেনেন? হলুদপুকুর থেকে তিন ক্রোশ৷ আমি পটল বেচতে যাই সেবার মাঘ মাসে, আমার সঙ্গে দেখা৷ আমায় দিব্যি দিয়ে দিয়েলেন, গ্রামের কাউকে বলতে নিষেধ করে দিলেন, তাই কাউকে বলি নি৷ আপনি সেখানে যাও, পুকুরের উত্তর পাড়ে যে ধান-সর্ষের আড়ত, সেখানেই তিনি থাকেন৷ আমার নাম করে বলবে, গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর সন্ধান দিয়েছে৷ আমাদের গাঁয়ের শখের যাত্রার দলে কতবার উনি গিয়ে বেয়ালা বাজিয়েছেন৷ আমায় বড্ড স্নেহ করতেন৷ মনে থাকবে— গেঁয়োহাটির ক্ষেত্তর কাপালি!
গোপেশ্বর চাটুজ্জে আশা করেন নি এভাবে কেদারের সন্ধান মিলবে৷ বললেন, বড্ড উপকার করলে বাপু৷ কি নাম বললে—ক্ষেত্র? আমি বলব এখন তাঁর কাছে—বড় ভালো লোক তুমি৷
সেই দিনই সন্ধ্যার আগে গোপেশ্বর চাটুজ্জে হিংনাড়ার বাজারে গিয়ে ঘোষেদের আড়ত খুঁজে বার করলেন৷ আড়তের লোকে জিজ্ঞেস করলে, কাকে চান মশাই? কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
—গড়শিবপুরের কেদারবাবু এখানে থাকেন?
—হ্যাঁ আছেন, কিন্তু তিনি মালঞ্চার বাজারে আড়তের কাজে গিয়েছিলেন—এখনও আসেন নি৷ বসুন৷
রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় কে তাঁকে বললে—মুহুরি মশায় ওই যে ফিরছেন—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে সামনে গিয়ে বললেন, রাজামশায়, নমস্কার৷ আমায় চিনতে পারেন?
গোপেশ্বরের দেখে মনে হল কেদারের বয়স যেন খানিকটা বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু হাবভাবে সেই পুরনো আমলের কেদার রাজাই রয়ে গিয়েছেন পুরোপুরিই৷
কেদার চোখ মিটমিট করে বললেন, হ্যাঁ, চিনেছি৷ চাটুজ্জে মশায় না?
—ভালো আছেন?
—তা একরকম আছি৷
—এখানে কি চাকরি করছেন? আপনার মেয়ে কোথায়?
—আমার মেয়ে? ইয়ে—
কেদার যেন একবার ঢোঁক গিলে, তারপর অকারণে হঠাৎ উৎসাহিত সুরে বললেন, মেয়ে কলকাতায়—তার মাসিমার—
গোপেশ্বর চাটুজ্জে সুর নিচু করে বললেন, শরৎ-মাকে আমার সঙ্গে এনেছি৷ সে আমার কাছেই আছে—কোনো ভয় নেই৷
এই কথা বলার পরে কেদারের মুখের ভাবের অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল৷ নিতান্ত নিরীহ ও নির্বোধ লোক ধমক খেলে যেমন হয়, তাঁর মুখ যেন তেমনি হয়ে গেল৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জের মনে হল এখুনি তিনি যেন হাতজোড় করে কেঁদে ফেলবেন৷
বললেন, আমার মেয়েকে—আপনি এনেছেন? কোথায় সে?
—কলকাতায় রেখে এসেছি৷ কালই আনব৷ বসুন একটু নিরিবিলি জায়গায়—সব বলছি৷ ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, কোনো ভয় নেই রাজামশায়৷ চলুন ওদিকে—বলি সব খুলে৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আপনার মেয়ে আগুনের মতো পবিত্র—
কেদার হা-হা করে হেসে বললেন, ও কথা আমায় বলার দরকার হবে না হে গোপেশ্বর৷ আমার মেয়ে, আমাদের বংশের মেয়ে—ও আমি জানি৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, রাজামশায় শেষটাতে কি এখানে চাকরি স্বীকার করলেন?
কেদার অপ্রতিভের হাসি হেসে বললেন, ভুলে থাকবার জন্যে, স্রেফ ভুলে থাকবার জন্যে দাদা৷ এরা আমার বাড়ি যে গড়শিবপুরে তা জানে না৷ বেহালা বাজাই নি আজ এই দেড় বছর— বেহালার বাজনা যদি কোথাও শুনি, মন কেমন করে ওঠে৷
—চলুন, আজই কলকাতায় যাই—
—আমার বড় ভয় করে৷ ভয়ানক জায়গা—আমি আর সেখানে যাব না হে, তুমি গিয়ে নিয়ে এস মেয়েটাকে৷ আজ রাতে এখানে থাকো—কাল রওনা হয়ে যাও সকালে৷ আমার কাছে টাকা আছে, খরচপত্র নিয়ে যাও৷ প্রায় সওয়া-শো টাকা এদের গদিতে মাইনের দরুন এই দেড় বছরে আমার পাওনা দাঁড়িয়েছে৷ আজ ঘোষ মশায়ের কাছে চেয়ে নেব৷
গোপেশ্বর চাটুজ্জে পরদিন সকালে কলকাতায় গেলেন এবং দুদিন পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে স্বরূপপুর স্টেশনে নেমে নৌকাযোগে বৈকালে হিংনাড়া থেকে আধক্রোশ দূরবর্তী ছুতোরঘাটায় পৌঁছে কেদারকে খবর দিতে গেলেন৷ শরৎ নৌকাতেই রইল বসে৷
সন্ধ্যার কিছু আগে কেদার এসে বাইরে থেকে ডাক দিলেন—ও শরৎ—
শরৎ কেঁদে ছইয়ের মধ্যে থেকে বার হয়ে এল৷ সে যেন ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল বাপের কাছে৷ অকারণে বাপের ওপর তাঁর এক দুর্জয় অভিমান৷
কেদার বড় শক্ত পুরুষমানুষ—এমন সুরে মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, যেন আজ ওবেলাই মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, যেন রোজই দেখাসাক্ষাৎ হয়৷
—কাঁদিস নে মা, কাঁদতে নেই, ছিঃ! কেঁদো না—ভালো আছিস?
শরৎ কাঁদতে কাঁদতেই বললে, তুমি তো আর আমার সন্ধান নিলে না? বাবা তুমি এত নিষ্ঠুর! আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তুমি এমনি করে ভুলে থাকতে পারতে?
দুজনেই জানে কারো কোনো দোষ নেই, যা হয়ে গিয়েছে তার ওপর হাত ছিল না বাবা বা মেয়ের কারো—রাগ বা অভিমান—সম্পূর্ণ অকারণ!
কেদার অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, তা কিছু মনে করিস নে তুই মা৷ আমার কেমন ভয় হয়ে গেল—আমায় ভয় দেখালে পুলিস ডেকে দেবে, তোমায় ধরিয়ে দেবে, সে আরও কত কিছু৷ আমার সব মনেও নেই মা৷ যাক যা হয়ে গিয়েছে, তুমি কিছু মনে করো না৷ চলো চলো আজই গড়শিবপুরে রওনা হই—দেড় বছর বাড়ি যাই নি!
গড়শিবপুরের রাজবাড়ি এই দেড় বছরে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে৷
চালের খড় গত বর্ষায় অনেক জায়গায় ধ্বসে পড়েছে৷ বাঁশের আড়া ও বাতা উইয়ে খেয়ে ফেলেছে৷ বাড়ির উঠোনে একহাঁটু বনজঙ্গল—আজ গোপেশ্বর চাটুজ্জে ও কেদার অনবরত কেটে পরিষ্কার করেও এখনও সাবেক উঠোন বের করতে পারেন নি৷
নিড়ানি ধরে সামনের উঠোনের লম্বা লম্বা মুথো ঘাস উপড়ে তুলতে তুলতে কেদার বললেন, ও মা শরৎ, আমাদের একটু তামাক দিতে পার?
গোপেশ্বর চাটুজ্জে উঠোনের ওপাশে কুকশিমা গাছের জঙ্গল দা দিয়ে কেটে জড়ো করতে করতে বলে উঠলেন—ও কি রাজামশাই, না না, মেয়েমানুষদের দিয়ে তামাক সাজানো—ওরা ঘরের লক্ষ্মী—না, ছিঃ—তামাক আমি সেজে আনছি গিয়ে—
ততক্ষণে শরৎ তামাক ধরিয়ে কলকেতে ফুঁ পাড়ছে৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া ঈষৎ দীর্ঘতর হয়েছে৷ বাতাসে সদ্য কাটা বনজঙ্গলের কটুতিক্ত গন্ধ৷ ভাঙা গড়বাড়ির দেউড়ির কার্নিসে বন্য পাখির কাকলি৷
কাশীতে যখন ছিল তখন ভাবে নি আবার সে দেশে ফিরতে পারবে কখনো, আবার সে এমনিতর বৈকালে বাবাকে নিড়ান হাতে উঠোনের ঘাস পরিষ্কার করতে দেখবে, বাবার তামাক আবার সাজবার সুযোগ পাবে সে৷
তামাক দিয়ে শরৎ বললে, বাবা, হিম হয়ে বসে থেকো না—এবেলা একটা তরকারি নেই যে কুটি, ব্যবস্থা আগে করো৷
কেদার কিছুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে বললেন, কেন, পুকুরপাড়ে ঝিঙে দেখে এলাম তো তখন!
কালোপায়রা দিঘির পাড়ে বাঁধানো ঘাটের পাশের ঝোপের মাথায় বন্য ঝিঙে ও ধুঁধুলের লতা বেড়ে উঠেছে, কেদারের কথার লক্ষ্যস্থল সেই বুনো ধুঁধুলের গাছ৷
—শুধু ঝিঙে বাবা?
—তাই নিয়ে এসে ভাতে দে—কি বল হে দাদা? হবে না?
গোপেশ্বর চাটুজ্জে বনজঙ্গল কাটতে কাটতে একটা ঝালের চারা দায়ের মুখে উপড়ে ফেলেছিলেন, সেটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে কিছুক্ষণ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন—খুব, খুব৷ রাজভোগ ভেসে যাবে৷
কেদার বললেন—তবে তাই করো মা শরৎ৷ তাই নিয়ে এসো৷
শরৎ কালোপায়রা দিঘির ধারে জঙ্গলে এল ঝিঙে খুঁজতে৷
আজই দুপুরবেলা ওরা গরুর গাড়ি করে এসে পৌঁছেছে এখানে৷ বাপ ও জ্যাঠামশায় সেই থেকে বনজঙ্গল পরিষ্কার নিয়েই ব্যস্ত আছেন৷ সে নিজে ঘরদোর পরিষ্কার করছিল—এইমাত্র একটু অবসর মিলেছে চোখ মেলে চারিদিকে চাইবার৷ কালোপায়রা দিঘির টলটলে জলে রাঙা কুমুদ ফুল ফুটেছে গড়বাড়ির ভগ্নস্তূপের দিকটাতে৷ এই তো বাঁধাঘাট৷ ঘাটের ধাপে শেওলা জমেছে, কুকশিমার জঙ্গল বেড়েছে খুব—কতকাল বাসন মাজে নি ঘাটটাতে বসে৷ কাল সকালে আসতে হবে আবার৷
ছাতিম বনের ছায়ার দিকে চেয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ছাতিম বনের ওপরে ওই দেউলের গম্বুজাকৃতি চূড়োটা বনের আড়াল থেকে মাথা বার করে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছায়া ওপার থেকে এপারে এসে পৌঁছেছে৷ চাতালের যে কোণে বসে শরৎ বাসন মাজত, এপারের বটগাছটার ডাল তার ওপরে ঝুঁকে পড়েছে৷ শরৎ যেন কতকাল পরে এসব দেখছে, জন্মান্তরের তোরণদ্বার অতিক্রম করে এ যেন নতুন বার পৃথিবীতে এসে চোখ মেলে চাওয়া বহু কালের পুরনো পরিচয়ের পৃথিবীতে৷ কালোপায়রা দিঘির ধারের এমনি একটি সুপরিচিত বৈকালের স্বপ্ন দেখে কতবার চোখের জল ফেলেছে কাশীতে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে করতে, দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় সন্ধ্যাবেলা রেণুকার সঙ্গে বসে, রাজগিরিতে গৃধ্রকূট পাহাড়ের ছায়াবৃত পথে মিনুর সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে৷
সে শরৎ নেই আর৷ শরৎ নিজের অনুভূতিতে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল৷ নতুন দৃষ্টি, নতুন মন নিয়ে ফিরেছে শরৎ৷ পল্লীগ্রামের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা যে শরৎসুন্দরীর দৃষ্টি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিল, আজ বহির্জগতের আলো ও ছায়া, পাপ ও পুণ্যের সংস্পর্শে এসে যেন শরতের মন উদারতর, দৃষ্টি নবতর দর্শনের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে৷
ঝিঙে তুলে রেখে শরৎ বার বার দিঘির ঘাটের ভাঙা চাতালে প্রাচীন বটতলায় নানা কারণে অকারণে ছুটে ছুটে আসতে লাগল শুধু এই নতুন ভাবানুভূতিকে বার বার আস্বাদ করবার জন্যে৷ একবার উপরে গিয়ে দেখলে গ্রামের জগন্নাথ চাটুজ্জে কার মুখে খবর পেয়ে এসে পৌঁছে গিয়েছেন৷ বাবা ও জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন৷
ওকে দেখে জগন্নাথ বললেন, এই যে মা শরৎ তা কাশী গয়া অনেক জায়গা বেড়িয়ে এলে বাবার সঙ্গে আর গোপেশ্বর ভায়ার সঙ্গে? ভালো—প্রায় দেড় বছর বেড়ালে৷
বুদ্ধিমতী শরৎ বুঝল এ গল্প জ্যাঠামশায়ই রচনা করেছেন তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ নির্দেশ করার জন্যে৷ শরৎ জগন্নাথ চাটুজ্জের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলে৷
—এসো, এসো মা, থাক৷ চিরজীবী হও—তা কোন কোন দেশ দেখলে?
কেদার বললেন, দেড় বছর ধরে তো বেড়ানো হয় নি৷ আমি মধ্যে চাকরি করেছিলাম হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তে৷ এই গোপেশ্বর দাদা সপরিবারে পশ্চিমে গেলেন, শরৎকে নিয়ে গিয়েছিলেন—
শরৎ বললে, চা খাবেন জ্যাঠামশায়, যাবেন না—বসুন৷ আমি বাসনগুলো ধুয়ে আনি পুকুরঘাট থেকে৷
আবার সে ছুটে এল কালোপায়রা দিঘির পাড়ে ছাতিমবনের দীর্ঘ, ঘন শীতল ছায়ায়৷ পুরনো দিনের মতো আবার রোদ রাঙা হয়ে উঠে গিয়েছে ছাতিম গাছের মাথায়৷ বেলা পড়ে এসেছে৷ এমন সময়ে দূর থেকে রাজলক্ষ্মীকে আসতে দেখে সে হঠাৎ লুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷
রাজলক্ষ্মীর হাতে একটি প্রদীপ, তেলসলতে দেওয়া৷
দুজনেই দুজনকে দেখে উচ্ছ্বসিত আনন্দে আত্মহারা৷
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, মানুষ না ভূত, দিদি?
—ভূত, তোর ঘাড় মটকাব!
তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলে৷
—শুনিস নি আমরা এসেছি?
—কারো কাছে না৷ কে বলবে? আমি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠে এই আসছি—
—কোথায় চলেছিস রে এদিকে?
—তোমাদের উত্তর দেউলে পিদিম দিচ্ছি আজ এই দেড় বছর৷ বলে গিয়েছিলে, মনে নেই?
—সত্যি ভাই?
—না মিথ্যে!
—আর জন্মের বোন ছিলি তুই, এই বংশের মেয়ে ছিলি কোনো জন্মে৷
—এতদিন কোথায় ছিলে তোমরা দিদি?
—কাশীতে৷ সব বলব গল্প তোকে৷ চল—
—আজ পিদিম তুমি দেবে দিদি?
—নিশ্চয়! ভিটেয় যখন এসেছি, তখন তোকে আর পিদিম দিতে হবে না৷ তবে আমার সঙ্গে চল—