কৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ
সেদিন এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেছি। রবিবারের বিলম্বিত সকাল, দূরদর্শনে সদ্য মহাভারত শেষ হয়েছে। দেখলাম সে বাড়ির ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মাকে যথাক্রমে পিতাশ্রী মাতাশ্রী বলে সম্বোধন করছে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে দূরদর্শনে মহাভারত চিত্রমালার প্রত্যক্ষ প্রভাবে এরা এ রকম সম্বোধন করা শিখেছে।
টিভি রামায়ণের মতো টিভি মহাভারতও ক্রমশ অপরিসীম জনপ্রিয়তার দিকে ধাবমান হচ্ছে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যখন ঘরে ঘরে, রাস্তায় রাস্তায় গদাযুদ্ধ দেখা যাবে এবং যে কোনও মুদির দোকানে গদা কিনতে পাওয়া যাবে।
এখনই কোনও কোনও পাড়ায় মহাভারত প্রদর্শনের সময়ে পথে বিশেষ কোনও লোক থাকে না। বাজারহাট, রাস্তাঘাট—সব প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়, অঘোষিত মহাকাব্যিক কার্ফু জারি হয়।
সংস্কৃত মহাভারত প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষাতেই অনুদিত হয়েছে। বাংলায় পদ্যে কাশীরাম দাশ এবং গদ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ আর একালে রাজশেখর বসুর মহাভারত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। তবে এর কোনওটাতেই কৃষ্ণ চরিত্র প্রধান নয়, কৃষ্ণ নায়ক নন। পাণ্ডবদের বন্ধু এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অর্জুনের রথের সারথি-মূল মহাভারতের কৃষ্ণ কথা প্রায় এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মহাভারতের কৃষ্ণ নয়, শ্রীরামকৃষ্ণের কৃষ্ণ এবার আমাদের আলোচ্য বিষয়। আগেরবারের নিবন্ধ ছিল রাম ও রামকৃষ্ণ, এবারের বিষয় কৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ।
শ্রীরামের মতোই শ্রীকৃষ্ণের বিষয়েও পরমপুরুষের অজস্র সরস মন্তব্য ও আখ্যান। মহাভারতের কয়েকটি কাহিনীরও এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ উল্লেখ করেছেন।
যুধিষ্ঠির একবার স্থির করেছিলেন যে তাঁর সমস্ত পাপ কৃষ্ণকে সমর্পণ করে দেবেন এবং এই ভাবে তিনি পাপমুক্ত হবেন।
মধ্যমপাণ্ডব ভীম কিন্তু তখন যুধিষ্ঠিরকে বাধা দিলেন এবং সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘অমন কাজটি করতে যেয়ো না।’
ভীমের এ কথা শুনে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন?”
ভীম বললেন, ‘কৃষ্ণকে যা কিছু অর্পণ করা যাবে তাই সহস্রগুণ হয়ে যাবে। তাঁকে এক গুণ যা দেওয়া যায় তাই হাজারগুণ হয়ে যায়। কৃষ্ণকে পাপ সমর্পণ করলে সে পাপও সহস্রগুণ হয়ে যাবে।’
শ্রীরামকৃষ্ণের মন্তব্য, ‘তাই সব কাজ করে জলের গণ্ডুষ অর্পণ। কৃষ্ণে ফল সমর্পণ।’
পরমপুরুষের মহাভারত ও শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে অপর একটি গল্প কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়কার। এটা গীতার গল্প, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রারম্ভের।
অর্জুন শ্রীরামকৃষ্ণকে বললেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে পারব না। জ্ঞাতিবধ করা আমার দ্বারা হবে না।’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘কিন্তু অর্জুন তোমাকে এ যুদ্ধ করতেই হবে। তোমার স্বভাবই করাবে।’
এর পরেও অর্জুন যুদ্ধ করতে আপত্তি করেন। জ্ঞাতি-বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, গুরু ও গুরুজনদের সঙ্গে প্রাণক্ষয়ী, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে তিনি তাঁর অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন।
শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে দেখিয়ে দিলেন যে ‘তুমি যাদের হত্যা করবে বলে আপত্তি করছ তারা কিন্তু কেউই জীবিত নয়, এই সব লোক আগে থেকেই মরে রয়েছে।ֹ’
এটুকু তো সবাই জানে কিন্তু এই সূত্রে রামকৃষ্ণ শিখদের কথা বলেছেন। শিখরা ঠাকুরবাড়িতে এসেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ‘শিখদের মতে অশ্বথ গাছে যে পাতা নড়ছে সেও ঈশ্বর ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছা বই একটি পাতাও নড়বার জো নেই।’
শ্রীকৃষ্ণ রহস্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের কাজ আমরা ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে কী বুঝব?’ এই সূত্রে তিনি একাধিক আখ্যানকে উল্লেখ করেছেন।
ভীষ্মদেব শরশয্যায় শায়িত, দেহত্যাগের সময় হয়েছে। পাণ্ডবভ্রাতারা শ্রীকৃষ্ণকে সঙ্গে করে ভীষ্মের শরশয্যার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ তাঁরা দেখলেন যে পিতামহ ভীষ্মের চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
অর্জুন এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী, যিনি কিনা অষ্টবসুর এক বসু তিনিও দেহত্যাগের সময় সংসারের মায়ায় কাঁদছেন।ֹ’
শ্রীকৃষ্ণ তখন ভীষ্মদেবকে অর্জুনের এই কথা বলাতে ভীষ্মদেব বললেন, ‘কৃষ্ণ তুমি অবশ্যই জানো, আমি সে কারণে কাঁদছি না। যখন চিন্তা করছি যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে সারথি, তাদেরও দুঃখ-বিপদের শেষ নেই, তখন এই মনে করে কাঁদছি যে ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।’
শ্রীকৃষ্ণের ভগবানত্ব নিয়ে সমস্যা ছিল শুধু একজনার, তিনি মা যশোদা।
মা যশোদার প্রসঙ্গ রামকৃষ্ণ নানাসূত্রে বারবার টেনে এনেছেন।
যশোদা ভাবতেন আমি না দেখলে গোপালকে কে দেখবে, তাহলে গোপালের অসুখ হবে। কৃষ্ণকে ভগবান বলে যশোদার বোধ ছিল না।
উদ্ধব যশোদাকে বলেছিলেন, ‘মা তোমার কৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান। তিনি জগৎ চিন্তামণি। তিনি সামান্য নন। তাঁর কী হবে?’
যশোদা বললেন, ‘ওরে তোদের সাক্ষাৎ ভগবান বা চিন্তামণি নয়, আমি আমার গোপালের কথা বলছি, আমার গোপাল কেমন আছে?’
শ্রীরামকৃষ্ণ যশোদামায়ের আর একটি একই রকম গল্প বলেছেন।
শ্রীকৃষ্ণ একবার যশোদাজননীকে বললেন, ‘তোমাকে আমি নিত্যধাম দর্শন করাব। এসো যমুনায় স্নান করতে যাই।’
তাঁরা যেই ডুব দিয়েছেন, একেবারে গোলকদর্শন। অখণ্ড জ্যোতি দর্শন।
যশোদা কিন্তু এত সব দেখে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না, কৃষ্ণকে বললেন, ‘কৃষ্ণরে তোর ওই গোলকদর্শন, জ্যোতি দর্শন, ওসব আর দেখতে চাই না। এখন তোর সেই মানুষ রূপ দেখব। তোকে কোলে করব। তোকে খাওয়াব।’
রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘অবতারকে সকলে চিনতে পারে না। দেহধারণ করলে রোগ, শোক, ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবই আছে। মনে হয় আমাদেরই মতো।’
পরিশেষে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের এই শ্রীকৃষ্ণ কথামালার অন্তে আমার নিজের একটি তুচ্ছ কাহিনী যোগ করি।
গল্পটি পুরনো, শ্রীকৃষ্ণের বয়েস নিয়ে। এক বৃদ্ধা কৃষ্ণকথকতা শুনতে শুনতে কথকঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আচ্ছা ঠাকুরমশায় শ্রীকৃষ্ণের বয়েস কত ছিল।’
ঠাকুরমশায় স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘একেক সময়, একেক রকম। যখন ছোট শিশুটি ছিলেন তখন বয়েস ছিল এক-দুই, তারপর বড় হলেন বালক হলেন, কিশোর হলেন তখন বয়েস দশ-বারো-পনেরো হল, তারপর বাড়তে বাড়তে বিশ-পঁচিশ যুবক হলেন, তারপর যখন প্রৌঢ় হলেন…’
এই পর্যন্ত শুনে বৃদ্ধাটি বাধা দিলেন, ‘থাক, থাক, আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি।’