কুহেলিকা (Kuhelika)
ভোর না হইতেই একটা দুরন্ত কোকিলের ডাকে হারুণের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সারারাত্রি সে নেশাখোরের মতো ঘুমাইয়াছে, পাশ পর্যন্ত ফিরে নাই। কত সুখের, কত বেদনার যেসব স্বপন সে সারারাত্রি ভরিয়া দেখিয়াছে, তাহার আবেশ যেন তখনও তাহার আঁখিপাতায় জড়াইয়া আছে।
উন্মত্ত যৌবনের অভূতপূর্ব সুখের পীড়ায় তাহার সারা দেহমন তখন চড়া সুরে বাঁধা বীণার মতো টনটন করিতেছিল। তাহার রক্তে রক্তে মহুয়া নেশার মতো কী যেন একটা পুলক রিনিরিনি করিয়া ফিরিতেছিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া সে তাহার কবিতার ডালি সাজায় সেই হাওয়া-পরিকে আজ সে চায় না, আজ এই কোকিলডাকা দক্ষিণা-বাতাসবহা গ্রীষ্ম প্রভাতে সে চায় সেই মাটির মানবীকে – যাহার মধ্যে তাহার সমস্ত কবিতা নিঃশেষ হইয়া যাইবে।…
হঠাৎ তাহার স্বপ্ন টুটিয়া গেল। জাহাঙ্গীর তখনও সামনে পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে! সে জাহাঙ্গীরের নিকটে গিয়া দেখিল, তাহার দুই চক্ষু জবাসংকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, নিশিশেষের পাণ্ডুর গ্যাসের আলো পড়িয়া তাহার মুখ ভীষণ করুণ দেখাইতেছিল। অত্যন্ত প্রিয়জনকে স্বহস্তে হত্যা করিবার পর হত্যাকারীর মুখচোখ যেমন হয় তেমনি।
হারুণের কবি-মন হেরেমের কিশোরীর মতো, বন-মৃগীর মতো ভীরু, স্পর্শালু। কঠিন রূঢ় কোনো কিছুর স্পর্শ সে সহিতে পারে না; মারামারি তো দূরের কথা, কোথাও কলহ দেখিলেও সে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে, তার সকল দেহমন বিস্বাদ ভয় ও হতাশায় একেবারে এলাইয়া পড়ে! সে সকল অন্তর দিয়া প্রার্থনা করে, জিজ্ঞাসা করি বিধাতাকে, কেন এই কলহ, কেন এই কুৎসিত সংগ্রাম, কেন এই অশান্তি! কবে মানুষ, মানুষ হইবে! খোদা, ইহাদের শান্তি দাও! ইহারা তোমার সুন্দর সৃষ্টিকে ভয়াবহ করিয়া তুলিল! তোমার ধরণির পুষ্পকুঞ্জ মত্ত রাবণের মতো ইহারা ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল।…
আজও সে জাহাঙ্গীরের এই ভীষণ মূর্তি দেখিয়া ভীত শুষ্ককণ্ঠে কোনোরকমে শুধু বলিতে পারিল, ‘জাহাঙ্গীর!’ সে আর কিছু বলিতে পারিল না। সমস্ত শরীর অজানা শঙ্কায় বেতসপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। জাহাঙ্গীর চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘একী! হারুণ?’ বলিয়াই চারদিকে চাহিয়া লইয়া সলজ্জ অপ্রতিভ স্বরে বলিল, ‘ভোর হয়ে গেছে বুঝি? খুব ভয় পেয়ে গেছ তুমি, না? ও কিছু নয়, অমন আমার প্রায়ই হয়!’
হারুণ অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি সারা রাত জেগে পায়চারি করেছ? আর আমি ষাঁড়ের মতন পড়ে পড়ে আরাম করে ঘুমিয়েছি?’
জাহাঙ্গীর বাম করে হারুণের কণ্ঠ মালার মতো জড়াইয়া ধরিয়া শান্তস্বরে বলিল, ‘তাতে হয়েছে কী ভাই! চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি এই সময়। বেশ ঠান্ডায় ঠান্ডায় যাওয়া যাবে। কেমন? তুমি সব গুছোও, আমি স্টেশনের যে দুটো কুলিকে ঠিক করে রেখেছি আমাদের এই বোঁচকা-পুটুলি নিয়ে যাবার জন্যে, ওদের খুঁজে বের করি ততক্ষণ।’
জাহাঙ্গীর চলিয়া গেল। হারুণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিছানাপত্র গুছাইতে গুছাইতে ভাবিতে লাগিল জাহাঙ্গীরের এই অপূর্ব আত্মসংযমের মাধুর্য। হত্যাকারীর মতো ভীষণ রুক্ষ মুখ কেমন করিয়া চক্ষের পলকে এমন সুন্দর সহজ হাসিতে ভরিয়া উঠিতে পারে, তাহা সে কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিল না। সহসা তাহার মনে হইল, এই বেদনার এই দুঃখের বন্ধু জাহাঙ্গীর কাহাকেও করিতে চায় না – যত বড়ো অন্তরঙ্গ বন্ধু হোক সে, তাহাকেও জাহাঙ্গীর তার গোপন বেদনা-মন্দিরের সন্ধান বলিবে না। এইখানে সে একা – একেবারে একা! অমা-নিশীথিনীর অন্ধকারও সে রহস্যের সে বেদনার অন্ধকার পথে পথ না পাইয়া ফিরিয়া আসিবে!…
জাহাঙ্গীর যে এমন মিলিটারি-স্টাইলে এত জোরে – এতটা পথ হাঁটিয়া আসিতে পারিবে, হারুণ তাহা মনে করে নাই। কাজেই সারাটা রাস্তা জাহাঙ্গীরের সাথে প্রায় দৌড়াইয়া সে যখন তাহার স্বগ্রামের প্রান্তে আসিয়া পঁহুছিল, তখন আর থাকিতে না পারিয়া সে বলিল, ‘দোহাই ভাই, এই গাছতলায় একটু জিরিয়ে নিতে দাও! আর পারছিনে! বাপ! তুমি এতদিন ডাকহরকরা হওনি কেন? হাঁটা তো নয়, এ যেন হন্টন-প্রতিযোগিতার দৌড়!’ হারুণ বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর একেবারে শুইয়া পড়িয়া ঊর্ধ্বনেত্রে গাছের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কী সুন্দর ভাই তোমাদের এই দেশ! পূর্ববঙ্গের মতো একেবারে নিরবকাশ। গাছপালার ভিড় নেই। খানিকটা মাঠ, খানিকটা তেপান্তরের মতো শূন্য ডাঙা, খানিকটা বন জঙ্গল, দূরে দূরে গ্রাম, ক্ষীণাঙ্গী নদী – আমার কী ভালোই লাগছে, তা বলতে পারছিনে। কলকাতার ইটের পাঁজা থেকে বেরিয়ে গায়ে যেন একটু সুন্দর পবিত্র বাতাস লাগল। এমনই একটি ছোটো গাঁয়ে তোমার ওই বক্কেশ্বর নদীর ধারে যদি আমার একটি কুটির থাকত, তাহলে সারাদিন ওই ছেলেগুলোর সাথে গোরু চরিয়েই কাটিয়ে দিতে পারতাম।’
তাহার জন্মভূমির এই প্রশংসায় হারুণের বুক গর্বে খুশিতে ভরিয়া উঠিল। তাহার চক্ষু অকারণে জলে পুরিয়া উঠিল। সেই অশ্রু-পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা-আর্দ্র দৃষ্টি লইয়া হারুণ তাহার পল্লিজননীর পানে চাহিয়া রহিল। গণ্ড বাহিয়া দুই বিন্দু অশ্রুজলও বুঝিবা গড়াইয়া পড়িল। তাহার মনে হইতে লাগিল, তাহার এই গাঁয়ের পথের মাটি দুই হাতের অঞ্জলি পুরিয়া মাথায় মুখে মাখিয়া পবিত্র হইয়া লয়! লজ্জায় তাহা পারিল না, পার্শ্বেই জাহাঙ্গীর শুইয়া। সে অপ্রতিভ হইয়া বলিল, ‘জাহাঙ্গীর! সামনের পুকুরটাতে পা হাত ধুয়ে নাওনা ভাই! তোমার যে বুক পর্যন্ত ধুলো উঠেছে দেখছি! সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু তোমায় এই ধুলোর গেরুয়া রঙে রাঙা হয়ে। তুমি যেন ঘরছাড়া বাউল!’ মুগ্ধদৃষ্টি দিয়া সে জাহাঙ্গীরের উচ্ছৃঙ্খল কেশ-বেশ দেখিতে লাগিল!
পুকুরপাড়ের একটা অর্জুন গাছের ডালে যে সুন্দর নীল পাখিটা বসিয়াছিল, জাহাঙ্গীর তাহারই দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়াছিল। এত সুন্দর পাখি সে আর কখনও দেখে নাই। সে উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘না হারুণ তোমাদের দেশে মাসখানেক থাকলে আমি একেবারে কবি বনে যাব! এত দেশ থাকতে কেন তোমাদেরই দেশে জয়দেব-চণ্ডীদাস জন্ম নেন, তা অনেকটা বুঝছি।’
সে আবার শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘না ভাই। এ ধুলো আর ধুচ্ছিনে পথে। বাংলার পথের ধুলো, আমার জন্মভূমির বেদনাতুর পথিকের পায়ের ধুলো – ও শুধু বুক পর্যন্ত কেন মাথা পর্যন্ত উঠলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম! পবিত্র ধুলো কি এত তাড়াতাড়ি মুছতে আছে ভাই?’
বলিয়াই দিগন্তপ্রসারী মাঠের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘দেখো কবি, আমি কবিতা-টবিতা ভালো বুঝিনে! গোঁয়ার-গোবিন্দ লোক আমি। কিন্তু আমার আজ এই মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, এর চেয়ে ভালো কবিতা তোমাদের কোনো কবিই লিখে যেতে পারেননি। এই মাঠের আলোর ছন্দোবদ্ধ লাইনের বন্ধনে কখনও সবুজ কখনও সোনার রঙে যে কবিতা লেখা হয়, তার কি তুলনা আছে! ওই কৃষকের লাঙলের চেয়ে কি তোমাদের কালিভরা লেখনী বেশি ফুলের ফসল ফলাতে পারে? ওই মাঠের খাতায় নিরক্ষর কবির সৃষ্টির কাছে তোমাদের জগতের সবচেয়ে বড়ো কবি কি তাঁর পুথির বোঝা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন?
হারুণ দুই চক্ষে বিস্ময় ভরিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে চাহিয়া রহিল। এই কি সেই কঠোর বাস্তবব্রতী বস্তুবিশ্বের পূজারি জাহাঙ্গীর? কিন্তু ইহা লইয়া সে প্রশ্নও করিল না। উহাকে সে কোনো দিনই বুঝিতে পারে নাই, আজও পারিল না। সে অন্যমনস্কভাবে বলিল, সত্যি ভাই, এরাই সত্যিকার ফুলের কবি, আমরা কথার কবি। আমরা যখন ঘরের আঁধার কোণে বসে মাকড়সার মতো কথার ঊর্ণা বুনি এরা তখন সারা দেশকে ফুলের ফসলের মতো সুন্দর রঙিন করে তোলে! এদের শ্রমেই তো ধরণির এত ঐশ্বর্য-সম্ভার, এত রূপ, এত যৌবন!’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘তাই ভাবছি হারুণ, এত বিপুল শক্তি এত বিরাট প্রাণ নিয়েও এরা পড়ে আছে কোথায়। এরা যেন উদাসীন আত্মভোলার দল, সকলের জন্য সুখ সৃষ্টি করে নিজে ভাসে দুঃখের অথই পাথারে। এরা শুধু কবি নয় হারুণ, এরা মানুষ! এরা সর্বত্যাগী তপস্বী দরবেশ! এরা নমস্য।’
জাহাঙ্গীর দুই হাত তুলিয়া সসম্ভ্রমে মস্তকে ঠেকাইল। হারুণের চোখ শ্রদ্ধায় বেদনায় বাষ্পাতুর হইয়া উঠিল। এই কি সেই প্রভাতের হত্যাকারীর মতো ভয়াবহ জাহাঙ্গীর!
কুলি দুইজন এইবার উঠিবার জন্য তাড়া দিতে লাগিল। জাহাঙ্গীর উঠিয়া কুলির মাথা হইতে হারুণের বোঁচকা ও নিজের বেতের বাক্সটা হাতে লইয়া বলিল, ‘চল’। হারুণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘অন্যায় করেছি বন্ধু এক জন মানুষের বোঝা আমারই মতো আরেক জন মানুষের মাথায় চাপিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমরা এসে পড়েছি। অর্থ দিয়ে কি মানুষের হাতের সেবার, তার শ্রমের প্রতিদান দেওয়া যায়? এখন এই রাস্তাটুকু ওদের সুদ্ধ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেলেও এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।… মানুষের একটা নূতন বেদনার দিক দেখতে পেলাম আজ। এতদিন বইয়ের পাতায় যাকে দেখেছি, আজ চোখের পাতায় তার দেখা পেলাম।…’
হারুণ কিছুই বুঝিতে পারিল না। জাহাঙ্গীরের তাহার সাথে আসা হইতে আরম্ভ করিয়া এই রাস্তায় চলা পর্যন্ত যেসব ব্যাপার সে দেখিল, যাহা কিছু শুনিল, তাহাতে তাহার মধ্যে তাহার সমস্ত চিন্তা সমস্ত কিছু যেন একটা তাল পাকাইয়া গিয়াছে। সে নিঃশব্দে অভিভূতের মতো পথ চলিতে লাগিল।
গ্রামে প্রবেশ করিয়া দুই একটি বাড়ি পরেই তাহাদের জীর্ণ খোড়ো ঘর। হারুণ ঘরের দুয়ারে আসিয়া পঁহুছিতেই তাহার দুইটি বোন ছুটিয়া আসিয়া তাহার পায়ের ধুলা লইল। তাহারা তাহাদের আনন্দের আতিশয্যে হারুণের পিছনে জাহাঙ্গীরকে দেখিতে পায় নাই। হঠাৎ তাহার দিকে চোখ পড়িতেই তাহারা জিভ কাটিয়া ছুটিয়া পলাইল।
হারুণ বাহিরের ঘরের দরজা খুলিয়া দিয়া ভাঙা তক্তপোশে বিছানা পাতিয়া দিবার উদ্যোগ করিতেই জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দোহাই হারুণ, তোমার ভদ্রতা রাখো! তুমি নিরতিশয় অতিথিপরায়ণ, মেনে নিলাম। তুমি আগে তোমার বাবা-মা ভাই-বোনের সাথে দেখাশুনা করে এসো।’
হারুণ হাসিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল। এমন সময় তাহার মা আলুথালুবেশে চিৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘খোকা এসেছিস? খোকা এসেছিস? আমার জন্যে পালকি এনেছিস ? মিনার জন্য সাইকেল এনেছিস? মিনা যাবে সাইকেলে, আমি যাব পালকিতে – হুই গোরস্থানে! মিনার সাইকেল! মিনা!’ বলিয়াই আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
হারুণের জননী উন্মাদিনী। হারুণের আর একটি ভাই ছিল, হারুণের চেয়ে দু-বছরের বড়ো, ডাক নাম ছিল তার – মিনা। তেরো বৎসর বয়সে সে মারা যায়। তাহার পরেই তাহার মাতা পাগল হইয়া যান। তাহার পিতারও কিছুদিন আগে বসন্ত হয়, তিনি কোনোরকমে বাঁচিয়া যান, কিন্তু দুইটি চক্ষু চিরজন্মের মতো অন্ধ হইয়া যায়।
মৃত্যুর সময় মিনা বিকারগ্রস্ত অবস্থায় কেবলই কাঁদিয়াছিল, ‘আমি সাইকেল চড়ব, আমায় সাইকেল কিনে দাও!’ দুর্ভাগিনি মাতা পাগল হইয়া গেলেও ‘মিনা’ আর ‘সাইকেল’ এই দুটি কথা ভুলিতে পারেন নাই।
হারুণের দুইটি বোন ও ছোটো ভাইটির এই পাগলিনি মাতা ও অন্ধ পিতাকে লইয়া যে কী করিয়া দিন কাটে, তাহা ভাবিয়া জাহাঙ্গীরের শরীরের রক্ত হিম হইয়া যাইতে লাগিল। অথচ হারুণ একদিনও তাহার এই অসহায় অবস্থার কথা তাহার কাছে বলে নাই।
হারুণ তাহার মাতাকে লইয়া বিব্রত হইয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর আর থাকিতে না পারিয়া আগাইয়া আসিয়া পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, ‘মা ভিতরে চলুন!’
মাতা তাহার দিকে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখে চাহিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘মিনা এসেছিস? অ্যাঁ? তোর সাইকেল কই? আমার পালকি কই?’
হারুণ ও জাহাঙ্গীর ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে ঘরে আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিল। জাহাঙ্গীর চলিয়া আসিতেছিল, কিন্তু মাতা ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘মিনা চলে গেলি? ও খোকা? মিনাকে ধর ধর! পালাল পালাল!’
জাহাঙ্গীর চলিয়া আসিতেছিল দেখিয়া হারুণের দুই বোন আসিয়া মাতাকে ধরিয়াছিল, কিন্তু মায়ের এই ক্রন্দনে জাহাঙ্গীর ফিরিয়া আসিতেই তাহারা আবার উঠিয়া পলাইল। হারুণ একটু রাগিয়া বলিয়া উঠিল, ‘এ-সময় অত বিবি হতে হবে না তোদের! এ আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর। আমাকে দেখে যদি লজ্জা না করিস তো জাহাঙ্গীরকেও লজ্জা করবার কিছু নেই।’
এইবার তাহারা কোনোরকমে জড়সড় হইয়া মায়ের কাছে আসিয়া বসিল। হারুণ কী ইঙ্গিত করিতেই তাহারা দুই বোন জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিল। জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘কী দোওয়া করব? রাজরানি হও না অন্য কিছু?’ বলিয়াই দেখিল ঘোমটার আড়াল হইতে এক জোড়া উজ্জ্বল সুন্দর চক্ষু ভোরের তারার মতো তাহার দিকে চাহিয়া আছে। জাহাঙ্গীরের বুক কাঁপিয়া উঠিল, সে চোখ ফিরাইয়া লইল! মাতা তখন অনেকটা শান্ত হইয়াছেন। জাহাঙ্গীরের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে তিনি মাঝে মাঝে অস্ফুটস্বরে বলিতেছিলেন, ‘মিনা! বাবা আমার! তুই আর যাসনে। আমি সাইকেল কিনে দেব!’