কুসুম কোরক – পর্ব- 3
ঝাঝড়ি হাতে মালী গাছে গাছে জল দিতে শুরু করলো। মালীর সারাদিন কাজ আর কাজ। আর মাঝে মাঝেই কুসুম দিদিদের সাথে গল্প করা। রাতের ঘুম টাও ভাল হয় না। কখন ফুল চোর বাগানে ঢুকে যায়। অন্ধকার থাকতে ফুল চোর বেড়িয়ে পড়ে। চৌকিদার নাক ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। সব ফুলে হাত দিলে ও গোলাপ দিদির কাছে কেউ যায় না।হয়তো কাঁটা লাগার ভয়ে নয়তো গোলাপ অতি স্পর্শ কাতর। তাই মালী কেই চৌকিদারের কাজ করতে হয়। ফুল চোরদের দয়া মায়া নেই। একেবারেই গাছ মুচড়ে ফুল নেয়। পরদিন গাছ টা যে মরে যাবে, সে কথা ভাবে না। আরে বাবা গাছের ও তো প্রাণ আছে! মালী সকালে পাহারা দেয় বলে, সকালের ফুল চোর সন্ধ্যা বেলায় ফুল চুরি করা শুরু করলো । মালীর চোখ চোরদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এমন সময় চামেলী র গলা শোনা গেল।
চামেলী বলল- ও মালী দাদা, পদ্মকে নিয়ে যাচ্ছে।
মালী ছুটে গেল পদ্ম গাছের দিকে। রোজ ফুল চোরেরা পদ্ম ফুলের কুঁড়ি তুলে নিয়ে যায়। কই, কারোকে তো দেখা যাচ্ছে না।
মালতী বলল- ও মালী দাদা, আঁকশি দিয়ে পদ্ম কে নিচ্ছে।
এক লাফে পাঁচিল ডিঙালো মালী। ধরে ফেললো তিন ফুল চোর কে। চৌকিদার এতক্ষণে গোঁফ পাকাতে পাকাতে ছুটে এল।
চৌকিদার বলল- কৌন হ্যায়!পাকড়ো চোর কো।
পদ্ম বলল- মালী, ওদের আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি বিচার করবো ওদের। ওদের হাত থেকে কুঁড়ি গুলো নিয়ে নাও।
ফুল চোরদের পদ্ম রানীর কাছে হাজির করা হল।
চৌকিদার বলল- পদ্ম রানী, আসামী হাজির হ্যায়।
পদ্ম- তোমার নাম কি?
১নং আসামী- আজ্ঞে, আমি নিত্যানন্দ। আর আমার সাথে আমার ভাই হৃষিকেশ।
পদ্ম- ফুল চুরি কেন করছো?
নিত্যানন্দ- আজ্ঞে, আমি বামুন। পুজো করি। দেবী পূজো করতে একশত শতদল চাই। তাই চুরি করছিলাম।
পদ্ম- তাই বলে পদ্মের কলি চুরি করবে?
নিত্যানন্দ- সারারাত জলে ফেলে রাখলে সকালে ফুটে যাবে। তাই দিয়ে কাল পুজো করবো।
পদ্ম- তোমার কচি ছেলেকে যদি সারারাত জলে ফেলে রাখা হয় তোমার কষ্ট হবে না?
নিত্যানন্দ- আমার ছেলের সাথে একটা ফুলের কলির তুলনা? আমার ছেলে মানুষ। তার প্রাণ আছে। পদ্ম কলির প্রাণ নেই। ফুল তো পুজো করার জন্য ই ফোটে।
পদ্ম- নিত্যানন্দ, এই বিশ্বে লতা-পাতা,ফুল, ফল, বৃক্ষ, পশু পাখি ,মানুষ, সবার সমান দরকার। মানুষ হল উন্নত শ্রেণীর জীব। তুমি মানুষ, তাই তোমাকে সবার কথা ভাবতে হবে।
নিত্যানন্দ- আমার ও সব ভেবে কাজ নেই। আমার একশত শতদল চাই।
পদ্ম- ভগবান তোমায় বুদ্ধি দিয়েছেন। দু হাত, দু পা,দু চোখ দিয়েছেন কাজ করার জন্য। উপকার করার জন্য। ফুল গাছেই সুন্দর থাকে । অকাজ করার জন্য ফুলের বংশ নাশ করো না । ফুল তোলার সময় গাছের কাছে অনুমতি নিতে হয়। গাছ কে বলো,” হে বৃক্ষ, আমি তোমার ফুল চাই “।
নিত্যানন্দ- আমি চাই বললে হবে?মালী আমায় ফুল নিতে দেবেনা।
পদ্ম- মালী ঠিক ই করে । তোমার মতো যারা নিজের স্বার্থে ফুল নেয় তাকে ফুল দেওয়া ঠিক নয়। এ তোমার কিসের পূজা ?একশত পদ্ম তুলে বাগান শূণ্য করা?পদ্ম ,জাতীয় ফুল তা জানো?তোমাদের জন্য পদ্মের বংশ নাশ হচ্ছে।
নিত্যানন্দ- কি ঝামেলা ! পদ্ম না হলে তো ভগবান পাবো না । শতদল আমার চাই ই চাই।
পদ্ম- চৌকিদার, এই বামুন গুলোকে ধরে হাজতে ভরো। এবার দেখছি তোমাদের পুজো কেমন করে হয়।
নিত্যানন্দ- পদ্ম, তুমি তো সাদা হয়ে ফোটো। সূর্য ওঠার পর গোলাপী হয়ে ওঠো। তারপর শুকিয়ে টুপ টাপ করে মাটিতে পড়ো।আমি কলি নিলেই যত দোষ?
পদ্ম- হ্যাঁ, দোষ হয়। প্রকৃতির নিয়মে ঝড়া ফুল থেকেই বংশ বৃদ্ধি হয় ।তুমি কলি তুলে আমার বংশ নাশ করছো। চৌকিদার, এই গাঁয়ের যত বামুন আছে সব গুলোকে হাজতে ভরো ।
দারোয়ান দুই বামুন কে নিয়ে চলল কারাগারে।
পদ্ম- দুই নম্বর আসামীকে ডাক।
দুই নম্বর আসামী- মা, আমি মধু কোবরেজ। নীল গাঁয়ে থাকি ।
পদ্ম- পদ্ম ফুল চুরি করছিলে কেন?
মধু কোবরেজ- মা, আমি পদ্ম ফুলের মধু বার করে ওষুধ তৈরি করি ।
পদ্ম- পদ্ম মধু?
মধু কোবরেজ- হ্যাঁ মা,তোমার অসীম গুন। এতে চোখ ভাল থাকে। আমি ওষুধ বানাই।
পদ্ম- ব্যবসা করো?
মধু কোবরেজ- না মা,পয়সা নেই না । গাঁয়ের মাস্টার চোখে দেখতে পেত না । এখন পদ্ম মধু লাগিয়ে ভাল আছে । সে অন্ধ হলে গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা মুখ্যু হয়ে থাকত । মা, আমায় যা শাস্তি দেবে দাও । কিন্তু মধু যেন আমি পাই।
পদ্ম- মালী, প্রতিদিন মধু কোবরেজ যেন একশত পদ্ম পায় । আর পদ্ম চাষের ব্যবস্থা করো যাতে পদ্ম মধু তৈরি হয় । তুমি মানুষের উপকার করো তাই তোমার মতো উপকারী লোক তৈরি করো।
শত পদ্ম নিয়ে জয় জয় মা পদ্ম রানীর জয় বলতে বলতে মধু কোবরেজ নীল গাঁয়ে চলে গেল। ওদিকে, গাঁয়ের পঁচিশ জন বামুন ও তাদের ছেলে পেলে তে হাজত ভরে গেল। মাঝে মাঝেই কান্নার শব্দ আসছে হাজত ঘর থেকে।
মালী চৌকিদার কে বলল- কি ঝামেলা বলোতো?একটা বামুন, তার চারটে বৌ। আর সতেরো টা ছেলেপেলে।
চৌকিদার- ভাল ই তো তোমায় আর খাটতে হবে না । ওদের কাজে লাগিয়ে দাও।
মালী- কি কাজ?
চৌকিদার- বামুন দের দিয়ে মাটি কোপাও ।আর ছেলে গুলোকে বীজ সংরক্ষণের কাজে লাগাও । ওদের দিয়েই পদ্মের চাষ করাও।
মালী- ঠিক বলেছ তো। ওরা অনেক পদ্ম নষ্ট করেছে। ওদের দিয়েই পদ্মের চাষ করাবো। ওরা অনেক ফুল নষ্ট করেছে।
পরদিন সকাল থেকেই বামুনদের দিয়ে মাটি কোপানো শুরু হলো । মাথার ওপর সূর্য । বেশ কষ্ট হচ্ছিল বামুনদের।
নিত্যানন্দ বলল- হৃষিকেশ, এ কি ঝামেলায় পড়লাম। মাটি কাটা কি আমাদের কাজ?
হৃষিকেশ বলল- বেশ হয়েছে। তোমাদের ঐ এক কথা। শতদল দিলে মা দেখা দেবে। এখন তোমার মা কোথায়?অনেক শতদল তো মাকে দিয়েছ।
নিত্যানন্দ- তুই থাম দেখি।পূজো করে লোকের দেওয়া চাল,কলা, সন্দেশ, ঘি দিয়ে বেশ খাওয়া চলছিল। সোনা দানা ও জুটছিল । এখন চাষাদের মতোই খাটছি।
হৃষিকেশ- গাঁয়ের লোক ঠকিয়ে আমাদের বাপ ঠাকুরদা রা আরামে বসে খেত। খুব চালাক ছিল ওরা। বামুন নাকি উঁচু জাত। ওদের ভক্তি ছেদ্দা করতে হয়।
নিত্যানন্দ- ঠিক বলেছিস হৃষিকেশ । চাষীরা রোদে জলে চাষ করে । ধান থেকে চাল তৈরি করে। আর আমরা আয়েস করে পায়েস খাই।
হৃষিকেশ- তখন কার দিনে রাজারাও বামুনদের ভয় করতো । বামুনরা অভিশাপ দিলে নাকি ফলবে। আরে দাদা জাত টাত ওসব কিছুই না । সবই ঐ ‘মনু’ ব্যাটার চালাকি।
নিত্যানন্দ- ঠিক বলেছিল। ওদের মতোই খাটবো। ভাল কাজ করার জন্য কোবরেজ ছাড়া পেল। আমরাও লোকের উপকার করবো । খেটে খাবো। কাউকে কষ্ট দেবো না।
দূরে চৌকিদার গোঁফে তা দিচ্ছে আর হাসছে।চৌকিদার কে হাসতে দেখে মালী বলল- কি গো হাসছো কেন?
চৌকিদার বলল – হাসবো না? চোরদের ভাল শাস্তি হয়েছে। মাটি কাটতে কাটতে ঘেমে গেছে । পূজো করবি?ভগবান বলেছে ফুল দিতে? দেখ কেমন ভাল হলো? তোকে বাঁচাতে তোর ভগবান কি এলো ?
মালী- একটা বামুনের সতেরো টা ছেলে মেয়ে! বল তো পঁচিশ টা বামুনের কয়টা ছেলে মেয়ে?
চৌকিদার (গোঁফে তা দিয়ে বলল)- অত কি গোনা যায়?
মালী- পঁচিশ এর সাথে সতেরো গুন কর।
চৌকিদার- কি করে জানলে?
মালী- হৃষিকেশ আমাকে পড়তে শিখিয়েছে।
চৌকিদার- আমিও কাল থেকে পড়া শিখবো ।
মালী- কাল কেন?বল আজ। “কল করে যো, আজ করে সো। আজ করে যো, অব্ করে সো। “