রামায়ণ : কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড – বালির সহিত সুগ্রীবের যুদ্ধ ও সুগ্রীবের পরাজয়
শ্রীরাম বলেন, কি বিলম্বে প্রয়োজন।
বালির সহিত ঝাট করাহ দর্শন।।
দেখিলে শত্রুরে মারি ঘুচাইব ডর।
সুখে রাজ্য করিবে তোমরা মিত্রবর।।
সুগ্রীবের দেন রাম আশ্বাস বচন।
সাতজন কিষ্কিন্ধ্যায় করেন গমন।।
রাজদ্বার নিকটে বলেন রাম ধীরে।
বৃক্ষ আড়ে লুকাইয়া থাকি দুই বীরে।।
বালি দ্বারে সুগ্রীব ছাড়িবে সিংহনাদ।
তাহাতে অবশ্য বালি শুনিবে সংবাদ।।
করিবে তোমার সঙ্গে সমর আরব্ধ।
এক বাণে বালিকে করিব আমি স্তব্ধ।।
বালি-দ্বারে সুগ্রীব ছাড়িল সিংহনাদ।
বাহির হইল বালি দেখিয়া প্রমাদ।।
বীরদর্প করে বালি অতি ভয়ঙ্কর।
বিক্রমে আক্রমণ করে সুগ্রীব উপর।।
হাতে হাতে মাথে মাথে বাধিল সমর।
দুই ভাই মল্লযুদ্ধ করে বহুতর।।
ক্ষণে হেঁটে পড়ে বালি, ক্ষণেক উপরে।
ক্ষিতি টলমল করে উভয়ের ভরে।।
দুই সিংহ যুদ্ধে যেন ছাড়ি সিংহনাদ।
দুই ভাই যুদ্ধ করে নাহি অবসাদ।।
দেখেন শ্রীরাম বাণ করিয়া সন্ধান।
উভয়ের বেশ ভূষা বয়স সমান।।
চিনিতে নারেন রাম সুগ্রীব বানরে।
বালিকে মারিতে পাছে নিজ মিত্র মরে।।
সুগ্রীবের মারে বালি বজ্রসম চড়।
সহিতে না পারি তাহা উঠি দিল রড়।।
মহাবল বালিরাজা অতুল প্রতাপ।
তাহার সহিত যুদ্ধ সহে কার বাপ।।
বড় বড় বীরগণে করে যে সংহার।
যুদ্ধারম্ভে সুগ্রীব বানর কোন্ ছার।।
তখনি সে সুগ্রীবের বধিত পরাণ।
সহোদর ভাই বলি দিল প্রাণদান।।
রক্তে রাঙ্গা অঙ্গ ভাঙ্গা পলায় সুগ্রীব।
আগে যায় ফিরে চায়, প্রায় সে নির্জীব।।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতে সুগ্রীব পলাইল।
মুনিশাপ বালি মনে করিয়া ফিরিল।।
না পারিয়া সুগ্রীবের প্রাণ বিনাশিতে।
ঘরে যায় বালি রাজা গর্জ্জিতে গর্জ্জিতে।।
ভাল পলাইয়া গেলি লইয়া জীবন।
কি জোরে করিস রে আমার সঙ্গে রণ।।
ভাল হৈল পলাইলে, হয়ে মোর ভাই।
প্রাণেতে মারিব, যদি পুনঃ দেখা পাই।।
সিংহাসনে বসি বালি ভাবে মনোদুঃখে।
সুগ্রীব জর্জ্জর ঘায়ে, রহে ঋষ্যমূকে।।
আছে হেঁট মুখেতে সুগ্রীব অপমানে।
চলিলেন শ্রীরাম প্রভৃতি সেইখানে।।
মাথা তুলি সুগ্রীব রামেরে নাহি দেখে।
বহু অনুযোগ করে সবার সম্মুখে।।
আজি যদি মরিতাম বালির সংগ্রামে।
কি করিত রাজ্যভোগ, কি করিত রামে।।
মারিতে নারিবে আগে না বলিলে কেনে।
বালি সঙ্গে তবে কেন প্রবেশিব রণে।।
তখনি বলেছি বালি বিষম দুর্জ্জয়।
তাহারে সংহার করা ক্ষুদ্র কর্ম্ম নয়।।
বড় বড় বীর যত মধ্যে পৃথিবীর।
বালিকে মারিতে পারে হেন কোন্ বীর।।
আছুক যুদ্ধের কাজ, দরশনে ভাগে।
কোন জন যুদ্ধ করে সে বালির আগে।।
কেন বা গেলাম, পাইলাম অপমান।
এতক্ষণ থাকিলে বধিত মোর প্রাণ।।
ঋষ্যমূক পর্ব্বত নিকটে ছিল সেই।
এ সঙ্কটে রক্ষা আমি পাইলাম তেঁই।।
বালিকে মারিবে বলি করিলে আশ্বাস।
আমাকে ফেলিয়া রণে হৈলে এক পাশ।।
এখনি মারিবা বাণ, হেন মোর মনে।
কোথা বাণ, কোথা রাম, ভাগ্যে আছি প্রাণে।।
শ্রীরাম বলেন, মিত্র না বল বিস্তর।
উভয়েরে দেখিলাম একই সোসর।।
বয়সে সাহসে বেশে একই সমান।
মিত্রবধ ভয়ে নাহি এড়িলাম বাণ।।
চিহ্ন দিয়া মিত্র তুমি রণে গেলে চিনি।
বালিকে মারিব, রাজা হইবা আপনি।।
পুনঃ যুদ্ধে গেলে যবে আসিবেক বালি।
যুচাইব তখনি মনের যত কালি।।
বঞ্চিল সুগ্রীব রাত্রি রামের আশ্বাসে।
রচিল কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।