Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কালো ঘোড়া || Syed Mustafa Siraj

কালো ঘোড়া || Syed Mustafa Siraj

কালো ঘোড়া

ব্যাপারটা নিছক স্বপ্ন, নাকি সত্যি সত্যি ঘটেছিল, বলা কঠিন। শুধু এটুকুই বলতে পারি, এ ঘটনা আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না। যা-যা ঘটেছিল, অবিকল তাই-তাই বর্ণনা করছি।

গত শরৎকালের কথা। তখন আমি মার্কিন মুলুকের কান্ট্রি এলাকা অর্থাৎ পাড়াগাঁয়ে এক ভদ্রলোকের অতিথি হয়ে আছি। ভদ্রলোকের নাম ডঃ হেরম্যান জুট্রাম! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে হিটলারের চেলারা ইহুদিদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে ডঃ জুট্রাম আমেরিকায় পালিয়ে আসেন। কারণ ইনি ইহুদি।

এলাকার নাম মুনভিলে। মানে করলে হয়তো দাঁড়ায় চন্দ্রপুরী। আসলে নিঃঝুম কয়েকটা বনে-ঢাকা ছোট্ট টিলার ওপর একটা করে বাড়ি। হাইওয়ে থেকে কষ্টেসৃষ্টে নজরে পড়ে। চারিদিকে ছড়ানো ঢেউ খেলানো মাঠ। কোথাও ধূসর হয়ে ওঠা ভূট্টাক্ষেত, কোথাও গোরু, শুয়োর বা ঘোড়ার বাথানচারিদিক কাঠের বেড়ায় ঘেরা।

–মুনভিলে কেন?

ডঃ জুট্রাম আমার প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন,–এই যে নিচের দিকে হ্রদটা দেখছ, ওটার গড়ন লক্ষ করো।

বাড়ির পূর্বে টিলাটা ফাঁকা এবং ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তারপর হ্রদ। পুবের ঘাসে লন ও ফুলবাগিচায় দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। দেখলাম, হ্রদটা অর্ধবৃত্তাকার, তার মানে অবিকল চন্দ্রকলার মতো। বলেছিলুম, হ্রদটার নাম হওয়া উচিত মুনলেক।

ঠিকই ধরেছ। ডঃ জুট্রাম হেসে উঠেছিলেন। ওটার নাম মুনলেক। তবে তার চেয়েও সুখের কথা, মুনলেকের ধারে জ্যোৎস্নারাতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করলে তুমি রূপকথার রাজপুকুরটি হয়ে উঠবে।

হাসতে-হাসতে বলেছিলাম, কিন্তু রাজপুতুরের যে একটা ঘোড়াও চাই। যেমন-তেমন ঘোড়া চলবে না, চাই একটি পক্ষীরাজ। সেই যে, যাদের ডানা আছে…

বলতে-বলতে একটু অবাক হয়ে থেমেছিলাম। ডঃ জুট্রামের লালচে মুখে হঠাৎ কেন অমন গাঢ় ছায়া। যেন হঠাৎ কী অসুখ বাধিয়ে বসেছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। চোখ নিষ্পলক।

ব্যস্ত হয়ে বলেছিলাম, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন ডঃ জুট্রাম?

উনি তখনই ঘুম থেকে ওঠার মতো কাঁধদুটো নাড়া দিয়ে আগের হাসিটা ফিরিয়ে এনেছিলেন।…হা, তুমি ঘোড়ার কথা বলছিলে তাই না?

–হ্যাঁ, ডঃ জুট্রাম।

–জানো? মুনলেকের অদ্ভুত-অদ্ভুত সব গল্প আছে। তার মধ্যে ওই ঘোড়ার গল্পটা সাংঘাতিক! মাঝে-মাঝে, বিশেষ করে জ্যোৎস্নার রাতে নাকি হ্রদের জল থেকে একটা কালো ঘোড়া উঠে আসে। ঘোড়াটা নাকি প্রাচীন যুগের এক রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের। নিছক ভুতুড়ে ব্যাপার।

বলে ডঃ জুট্রাম হাতঘড়িটা দেখে নিলেন এবং ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।কী কাণ্ড। আমাকে যে এক্ষুনি শহরে দৌডুতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সেমিনার আছে। তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

জুট্রাম পা বাড়িয়ে ফের বলেছিলেন, যাক গে, তোমার গিয়ে কাজ নেই। পণ্ডিতি কচকচি তোমার ভালো লাগবে না। তার চেয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোেগ করো। আয়ু বাড়বে।

হাসতে-হাসতে চলে গিয়েছিলেন ডঃ জুট্রাম। একটু পরে বাড়ির দক্ষিণে বনের গড়ানে রাস্তায় ওঁর সাদা গাড়িটা নেমে যেতে দেখেছিলাম। তখন বেলা সাড়ে তিনটে। টিলার মাথায় কাঠের দোতলা বাড়িটা আরও নিঃঝুম হয়ে গেল। গাছপালা থেকে ঝিঁঝিপোকার বিকট হাঁকডাক শোন যাচ্ছিল। মার্কিন ঝিঁঝিপোকার ডাক বড় বিরক্তিকর। মনেমনে খাপ্পা হয়ে বললাম, রোসো বাছাধনরা! পাতা ঝরার দিন শুরু হলেই তোমাদের বীরত্ব কোথায় থাকে, দেখা যাবে।

ডঃ জুট্রামের প্রকাণ্ড কুকুরটার নাম রেক্স। একে কুকুরে আমার প্রচণ্ড ভয়, তাতে রেক্স আমাকে যতবার দেখে, মাতৃভাষায় গালাগালি করে। বাঁধা না থাকলে আমাকে নিশ্চয় সোজা ভারতে ফেরত পাঠিয়ে ছাড়ত। কঁচুমাচু মুখে ডঃ জুট্রাম বলেছিলেন,-রেক্সের এই এক দোষ! বিদেশিদের দেখতে পারে না।

হাই তুলে ভয়ে-ভয়ে বারান্দায় উঠলাম। কিন্তু রেক্সের সাড়া পেলাম না। তখন দরজা খুলে বসার ঘরের ভেতর উঁকি দিলাম। সিঁড়ির পাশে কুকুরটা থাকে। সেখানে সে নেই। তাহলে ডঃ জুট্রামের লেকচার শুনতে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

দোতলায় আমার ঘর। বেলা দুটোয় লাঞ্চ খেয়েছি। বাঙালি স্বভাবে ভাতঘুম নামে আরাদায়ক একটা ব্যাপার আছে। সায়েবদের সংসর্গে সেটা বরবাদ হতে বসেছে। আজ এমন সুযোগ ছাড়া যায় না। অতএব সটান বিছানায় চিত হলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে বন্ধুবর ভাতঘুম এসে কোলাকুলি করলেন। তখন আঃ কী আনন্দ! কতদিন পরে দেখা।

কতক্ষণ পরে কার ডাকাডাকিতে চোখ খুলতে হল। তাকিয়ে দেখি, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আট-নয় বছরের একটা মেয়ে। গোলগাল পুতুল-গড়ন। একমাথা আঁকড়ামাকড়া সোনালি চুল। পরনে উজ্জ্বল নীল ফ্রক। গলায় সাদা স্কার্ফ জড়ানো। মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

তক্ষুনি মনে পড়ে গেল, আরে তাই তো! এরই ছবি বাড়ির ওপরে-নিচে সব ঘরে দেখেছি। ওই তো এ-ঘরের দেওয়ালেও রয়েছে।

ডঃ জুট্রামকে জিগ্যেস করব ভেবেছিলাম। ভুলে গেছি।

উঠে বসে মিষ্টি হেসে বললাম, হ্যালো।

আমার মার্কিনি সম্ভাষণের জবাবে ছোট্ট করে বলল, হাই। কিন্তু মুখের অবাক ভাবটা ঘুচল না। ঠোঁট কামড়ে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়ে একটু হাসল। হেসে বলল, তুমি নিশ্চয় বাবার অতিথি। তুমি কি বিদেশি?

সায় দিয়ে বললাম,-প্রথমে তোমার নাম বলল।

–জিনা।

তুমি নিশ্চয় শহরে থেকে পড়াশুনা করো, তাই না জিনা? ওর সঙ্গে খাতির জমাতে বসলাম।–তা এলে কার সঙ্গে? মায়ের সঙ্গে বুঝি? চলো, তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

ডঃ জুট্টাম তার স্ত্রী কিংবা মেয়ের কথা কিছু বলেননি। আমিও কিছু জানতে চাইনি। কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপার জানতে চাওয়া ভদ্রতাসম্মত নয়। উঠে দাঁড়িয়েছি, জিনা বলল, তুমি বললে না কোন দেশের লোক?

–আমি ইন্ডিয়ান। শু

নেই জিনা যেন চমকে উঠল। তুমি ইন্ডিয়ান কিন্তু!…

–কিন্তু কী বলল তো জিনা?

তোমার মাথায় পালকের টুপি নেই। গলায় রঙিন পাথরের মালা নেই। –জিনা বলতে থাকল, তোমার বর্শা কী হল, তোমার চুল কেটে ফেলেছ কেন? তুমি এমন বেঁটে মানুষ কেন?

ওকে থামিয়ে হাসতে-হাসতে বললাম, জিনা, জিনা! আমাকে বলতে দাও। ইন্ডিয়ান মানে আমি ইন্ডিয়া–ভারতের লোক। তুমি আমাকে রেড ইন্ডিয়ান ভেবেছ দেখছি। ভারতের নাম শোনোনি? পুবের দেশ।

জিনা কেমন যেন নিরাশ গলায় বলল,–ও! তুমি ওরিয়েন্টাল।

–ঠিক বলেছ। এবার চলল তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

জিনা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে বাস্কেটবল খেলবে?

–খেলব বইকী।

এসো। –বলে সে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। তার পেছনে-পেছনে নেমে নিচের ঘরে কাকেও দেখতে পেলাম না। ঘরের ভেতর ততক্ষণে হাল্কা আঁধার জমেছে। পুবের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি বেলা পড়ে গেছে, নীলচে কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে, গাছপালার মাথায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে বুনো হাঁসের ঝাক। নিচের দিকে একটু দূরে মুনলেকের জলে তখনও লালচে ছটা ছড়িয়ে আছে।

–হেই! এখানে চলে এসো।

ঘুরে দেখি লনের কোনায় বাস্কেটবল নিয়ে জিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে খেলায় মেতে গেলাম। মেয়েটি বড় চঞ্চল প্রকৃতির। আমার আনাড়িপনায় খিলখিল করে হেসে উঠল। আমাকে গোহারা করে হারিয়ে ছাড়ল। আবছা আঁধার হয়ে এলে বললাম, এই যথেষ্ট। সকালে আবার হবে। তখন তোমায় হারিয়ে দেব।

জিনা লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন আনমনা।

বললাম, জিনা-জিনা! অবিকল তোমার মতো আমার একটি মেয়ে আছে। তার নাম কী জানো? নিনা। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। ভারি মজার। এসো না।

সে গেট খুলে ঢালু সবুজ ঘাস ঢাকা জমি দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। চেঁচিয়ে বললাম,–জিনা আস্তে, আস্তে। দৌড়িও না, আছাড় খাবে।

ততক্ষণে সে লেকের ধারে বালির চওড়া বিচে পৌঁছে গেছে। আমার যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। পোঁছে টের পেলাম কনকনে ঠান্ডায় রক্ত জমতে শুরু করেছে। মেয়েটা কিন্তু দিব্যি ছোটাছুটি করছে বালিতে। হঠাৎ চোখ গেল হ্রদের ওপারে টিলার মাথায়। বাঁকা এক টুকরো চাঁদ উঠেছে। তখুনি জুট্রামের গল্পটা মনে পড়ল। কেমন অস্বস্তি জাগল। বললাম,–জিনা! এবার ফেরা যাক।

জিনা জবাব দিল না। জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সেই সময় হু হু করে একটা বাতাস এল। ঠান্ডাটা বেড়ে গেল। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম। কী শীত, কী শীত! দস্যি মেয়েটার পাল্লায় পড়ে শেষ অবধি না নিমোনিয়া বাধাই।

হ্রদের জলটা কাঁপছে। আবছা জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে সারা হ্রদ। তারপর একসঙ্গে অসংখ্য বুনো হাঁস প্যাকপ্যাক করে ডেকে উঠল। তারপর যা দেখলাম সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। শীতের কথা ভুলে গেলাম। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। স্বপ্ন দেখছি না তো?

যেন জলের ওপর দিয়েই হেঁটে এল একটা কালো ঘোড়া। হ্যাঁ, জলজ্যান্ত একটা কালো ঘোড়া।

ঘোড়াটা বিচে আসতেই জিনা কী দুর্বোধ্য শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর দেখি, কালো কালো ঘোড়াটার সঙ্গে সে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কখনও আমার সামনে দিয়ে, কখনও পিছন দিয়ে দুজনে ছোটাছুটি করতে থাকল। ঘোড়াটা আমার ওপর এসে পড়বে ভেবে আমি আতঙ্কে কাঠ। কিন্তু গলায় কী আটকে গেছে। জিনাকে বারণ করার সাধ্য নেই।

একটু পরে দেখলাম, জিনা কালো ঘোড়াটার ওপর চেপে বসেছে। ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় সারা বিচ জুড়ে খালি ঘোড়ার পায়ে চাপা শব্দ।

তারপর পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে শুনলাম। সেই সঙ্গে কুকুরের গর্জনও শুনতে পেলাম। টর্চের আলো ছড়িয়ে পড়ল আমার গায়ের ওপর। সেই আলোর ছটায় আবছা দেখলাম কালো ঘোড়াটা জিনাকে নিয়ে হ্রদের জলে নেমে যাচ্ছে। এতক্ষণে গলা দিয়ে স্বর বেরুল। চেঁচিয়ে উঠলাম–জিনা-জিনা-জিনা।

পেছনে ডঃ জুট্রাম বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কাম ব্যাক। কাম ব্যাক, ইউ ফুল।

তারপর আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। রেক্স জলের ধারে দাঁড়িয়ে গরগর করছে।

ঘণ্টাখানেক পরে ফায়ারপ্লেসের সামনে দুজনে চুপচাপ বসে আছি। এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডঃ জুট্রাম বললেন, তুমি, জিনা-জিনা বলে ডাকছিলে। তুমি কি ওকে সত্যিই দেখেছিলে? পরনে নীল ফ্রক, গলায় সাদা স্কার্ফ ছিল। তাই না?

–হ্যাঁ, আর সেই কালো ঘোড়াটাও।

কথা কেড়ে ডঃ জুট্টাম বললেন, দশ বছর আগে জিনা মুনলেকে ডুবে মরেছে। তার একবছর পরে ওর মা রোগে ভুগে মারা যায়। আমি মুনভিলেই মরতে চাই। তাই এখানে একা পড়ে আছি। বলতে পারো ওয়েটিং ফর দি ব্ল্যাক হর্স।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress