Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

লাঞ্চের পর কর্নেল

লাঞ্চের পর কর্নেল সুব্রত এবং কথাকলির প্রতীক্ষায় ছিলেন। আড়াইটে বাজার। পর ডোরবেল বাজল। কর্নেল নিজেই গিয়ে লুকিং গ্লাসে যাদের দেখলেন, একটু অবাক হলেন। যুধিষ্ঠির এবং টিনির মা।

দরজা খুললে যুধিষ্ঠির হকচকিয়ে গেল। বলল, আজ্ঞে আপনি স্যার…….

কর্নেল সহাস্যে বললেন, সি এম ডি এ অফিসার নই। ভেতরে এস। আসুন। সুরঞ্জনা দেবী!

দুজনে কুণ্ঠিতভাবে ড্রইংরুমে বসল। সুরঞ্জনা চোখ মুছে বললেন, আগে ক্ষমা চাইছি দাদা! আমার মাথার ঠিক ছিল না। ওই নচ্ছার খুনেগুলোর কথায় আমার বুদ্ধি সুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার বলুন! আমার ঠিকানাই বা কোথায় পেলেন, তা-ও বলুন!

যুধিষ্ঠির বলল, সুব্রতবাবু আজ গিয়েছিল। আপনার ঠিকানা দিয়ে বলল, ওঁর কাছে যান। দিদি আমাকে বললেন, যুবধা আমাকে নিয়ে চল। কিন্তু আমি স্যার, ভাবতেই পারিনি…..

তার কথার ওপর সুরঞ্জনা বললেন, তুমি থামো ত যুধোয় আমাকে বলতে দাও। ড্যানিসায়েব আর ওই গোমেশ পোড়ারমুখো আমার মেয়েকে খুন করেছে। দাদা, আমি ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারিনি। টিনির সঙ্গে ওদের চেনা ছিল। টিনিই বলেছিল, বিপদে-আপদে ড্যানিসায়েবকে বললে মাথার কাছে দাঁড়াবে। গোমেশ পাপের সাজা পেয়েছে। এবার ড্যানিসায়েবের পালা। আমাকে বারণ করেছিল অচেনা লোক কিছু জিজ্ঞেস করল যেন মুখ না খুলি। তারপর আমাকে সে-ই ক্যামাক স্ট্রিটে এক ফ্ল্যাটবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। বলল, পুলিশ জ্বালাতন করবে। এখানেই আপনি যতদিন খুশি থাকুন। কাল সন্ধ্যাবেলা বদমাশ হারামজাদা গুণ্ডা দিয়ে আমাকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিল। জিনিসপত্র ফুটপাতে ফেলে দিল। তখন কী আর করব? কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাড়িতে গেলুম।

যুধিষ্ঠির বলল, আমি বারণ করেছিলুম স্যার, দিদি শোনেনি।

কর্নেল বললেন, সুব্রত কখন আপনাদের কাছে গিয়েছিল আজ?

সুরঞ্জনা বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে। সঙ্গে ছিল কলি নামে একটা মেয়ে। টিনির বন্ধু। আপনার ঠিকানা দিয়ে বলল, এখনই কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করে সব বলুন।

কর্নেল হাসলেন। আস্তে বললেন, ড্যানিসায়েব বুঝতে পেরেছে, আপনাকে ক্যামাক স্ট্রিটে রেখে লাভ নেই। কারণ আপনার ঘরে পাথরের দামী ফলকটা নেই।

যুধিষ্ঠির চমকে উঠল। পাথরের দামী ফলক? সে কী জিনিস স্যার?

কবরখানার ফলক। কর্নেল মিটিমিটি হেসে টিনির মাকে বললেন, আপনাকে আপনার বাড়ি থেকে সরানোর কারণ, সে আপনার বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে চেয়েছিল। যুধিষ্ঠির হাজতে ছিল। কাজেই ইচ্ছেমতো খোঁজার সুযোগ পেয়েছে।

যুধিষ্ঠির আবার চমকে উঠে বলল, কাল রাত্তিরে স্যার, দিদির ঘরে চোর ঢুকেছিল। আমি চুপচাপ ছিলুম। নেবেটা কী? ঘরে তো লবডঙ্কাটি! সে হেসে ফেলল। চোর চলে গেলে খুব হাসলাম, স্যার!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে সুরঞ্জনাকে বললেন, ড্যানিসায়েব আপনার মেয়েকে খুন করেছে?

সুরঞ্জনা কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, যুধিষ্ঠির বলল, গোমেশ স্যার, গোমেশ! তবে ড্যানিসায়েব হয়তো পেছনে ছিল। খুন করেছে গোমেশ। আমার সামান্য বুদ্ধিতে তাই মনে হচ্ছে। গোমেশ প্রায়ই যেত টিনির কাছে। ফুসুরফুসুর করত।

কর্নেল বললেন, হুঁ, কিন্তু গোমেশকে কে খুন করল, যুধিষ্ঠির?

যুধিষ্ঠির এবং সুরঞ্জনা এক গলায় বললেন, ড্যানিসায়েব।

কর্নেল সুরঞ্জনা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন?

যুধিষ্ঠির কী বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে সুরঞ্জনা বললেন, আমি ভাবতুম, আমার মেয়েকে গোমেশ খুন করেছে, তারই গোধ নিয়েছে। কিন্তু আপনি কবরের দামী পাথরের ফলকের কথা বলেন। তাই এখন মনে হচ্ছে, আমার আমার বোকা মেয়ে ফাঁদে পা দিয়েছিল।

উত্তেজিত যুধিষ্ঠির বলল, রোজ খ্রীস্টান কবরখানায় যেত টিনি! সুব্রতও যেত। আজ সুব্রত বিপদে পড়ে ভাল মানুষ সেজেছে বটে, কিন্তু স্যার, সে-ও দলে ছিল মনে হয়। ঠেলায় না পড়লে তো বেড়াল গাছে চড়ে না!

কর্নেল হা হা করে হাসলেন। ঠিক, ঠিক বলেছ যুধিষ্ঠির! সুব্রত…….তবে আমার সন্দেহ…….না, খুলেই বলি, সুব্রত জানে, দামী পাথরের ফলক কোথায় আছে। আমিও হয়তো আঁচ করেছি, কোথায় সে ওটা রেখেছে। টিনি ওকে। রাখতে দিয়েছিল হয়ত।

যুধিষ্ঠির অবাক হলো। দামী পাথরের ফলক? কী রকম দাম হতে পারে স্যার?

তা বিদেশে বেচলে কোটি টাকা!

যুধিষ্ঠির কপালে চোখ তুলে বলল, ওরে বাবা! একশো হাজারে এক লাখ। একশো লাখে এক কোটি! মাথা খারাপ হয়ে যায় শুনলে। গোমেশ আর ড্যানিসায়েবের মাথা খারাপ হবারই কথা।

এবং সুব্রতরও।

আজ্ঞে। যুধিষ্ঠির সায় দিল। সুব্রত ডুবে ডুবে জল খায়। নইলে টিনির সঙ্গে রোজ সে কবরখানায় যেত কেন?

সুব্রত জানে, টিনি পাথরের ফলক কবরখানায় লুকিয়ে রেখেছে।

সুরঞ্জনা শ্বাস ছেড়ে বললেন, কাকে আর বিশ্বাস করব? অথচ সুব্রত আপনার কাছে আসতে বলল। ওর পেটে-পেটে বদমাইশি!

যুধিষ্ঠির বলল, আহা, আগে যদি জানতুম, ওই ফেরারি আসামীকে আজই ধরিয়ে দিতুম পুলিশের হাতে।

সুরঞ্জনা কাতর স্বরে বললেন, আমি বড় অভাগিনী, দাদা! আমার বড় ভয় করছে। আপনি এর একটা বিহিত করুন। আমার মেয়েকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু পালের গোদারা শাস্তি পাক।

কর্নেল আস্তে বললেন, পাবে। সুব্রতকে আগে ধরা দরকার।

যুধিষ্ঠির বলল, বমালসুদ্ধ স্যার! হাতেনাতে ধরা উচিত।

নিশ্চয়। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে। আমি একটু বেরুব। লালবাজারে পুলিশকে সব বলা দরকার। আগে ড্যানিসায়েবকে অ্যারেস্ট করতে হবে। সুরঞ্জনা দেবী! আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে থাকুন। আপনার আর ভয়ের কারণ নেই। চোরাই মাল তো, আপনার বাড়িতে নেই। কাজেই আর আপনার বিপদের আশঙ্কা নেই। চোরাই মাল কবরখানাতেই লুকোনো আছে।–সম্ভবত সুব্রত আজ রাতেই তা হাতাতে যাবে। তখন তাকে ধরে ফেলব।

সুরঞ্জনা এবং যুধিষ্ঠির চলে যাওয়া মাত্র কর্নেল ফোন তুললেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে চাইলেন। একটু পরে তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হাই ওল্ড বস! এনি নিউ ডেভালাপমেন্ট?

ইয়া। ডার্লিং! এখনই পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে কবরখানা পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ করে দাও। কুইক! এরিয়ার বাইরেও পুলশ মোতায়েন রাখতে হবে।

ব্যাপারটা কী?

তুমিও বেরিয়ে পড়ো। চলে এস আমার ডেরায়। এখনই দুজনে বেরুব।

ওক্কে। কিন্তু যাব কোথায়? কবরে নাকি?

ইয়া।

সর্বনাশ! এ বয়সে কবরে নিয়ে যাবেন আমাকে?

কুইক, অরিজিৎ, কুইক! আগে পুলিশ ফোর্স, ডোন্ট ফরগেট। এখনই পুলিশ না গেলে কেলেংকারি হবে। তুমি সোজা আমার কাছে এস। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।

ফোন রেখে কর্নেল দ্রুত পোশাক বদলাতে ঘরে গেলেন। তারপর ষষ্ঠীকে বললেন, যদি কেউ আসে, বলবি একটু অপেক্ষা করতে। আমি বেরুব। ফিরব আধঘণ্টার মধ্যে। যে-ই আসুক, অপেক্ষা করতে বলবি।

কর্নেল ড্রংইরুমে পায়চারি শুরু করলেন। উত্তেজিত, অস্থির। মঞ্চের উইংসের আড়ালে অভিনেতা যেমন অপেক্ষা করে, নাটকীয় ক্লাইমেক্সের দৃশ্যে ঢোকার মুহূর্তটির জন্য, তেমনি তীব্র প্রতীক্ষার ছাপ কর্নেলের মধ্যে। মিনিটগুলো অসম্ভব দীর্ঘ। সেকেন্ডগুলো যেন খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। মহাকাশযানের চরম উৎক্ষেপণ মুহূর্তের কাউন্টডাউন শুরু, এক…দুই…..তিন…

ডোরবেল বাজল। কর্নেল গিয়ে দরজা খুললেন। নাঃ, অরিজিৎ নন। কথাকলি এবং সুব্রত। কর্নেল ভেতরে নিয়ে এসে বসালেন। বললেন, অপেক্ষা করো। এখন কোনও কথা নেই। আধঘণ্টার জন্য বেরুচ্ছি। ফিরে কথা হবে। না, না, উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। জরুরি একটা কাজ পড়েছে। এখনই ফিরে আসছি, ডার্লিং! ষষ্ঠী! এঁদের কফি-টফি খাইয়ে দে! ইচ্ছে করলে ইউরোপিয়ান বা ভারতীয় ক্লাসিক্যাল কিংবা পপ মিউজিক শোনো! ওই রেকর্ডপ্লেয়ার! বলে দুজনকেই ভীষণ অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে নিচের লনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন।

.

অরিজিৎ এলেন দশ মিনিট পরে। মাই গড! আপনাকে সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। জাস্ট লাইক আ টাইগার অ্যাট দা মোমেন্ট অফ আ স্প্রিং ডাউন! যেন ঝম্পপ্রদান করে ঘাড় মটকাবেন।

কর্নেল তার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বললেন, কুইক! টু দা গ্রেভইয়ার্ড!

যেতে যেতে অরিজিৎ বললেন, একটু আভাস না পেলে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব। মন চঞ্চল।

ঐতিহাসিক ফলক উদ্ধার করা হবে।

অ্যাঁ!

অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ। কর্নেল একটু হাসলেন। একটু অসুবিধা আছে। তবে তোমার পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ট্রেইন্ড। কেউ না কেউ কাজটা পারবে।

কী কাজ?

আসল কাজ।

কী বিপদ!

হ্যাঁ, একটু বিপদ আছে। ঠ্যাং ভাঙার।

কী মুশকিল!

আমি ডার্লিং, এই দাড়িধারী লোকটি পীর মুশকিল আসান! যাঁহা মুশকিল তাঁহা আসান।

অরিজিৎ চুপ করে গেলেন।….. প্রাচীন ইস্টার্ন সাব-আর্বান খ্রস্টিয়ান সিমেট্রিতে পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। আশেপাশের বস্তি থেকে লোকেরা ভিড় করেছিল। পুলিশ ভিড় দূরে হঠিয়ে দিয়েছে। সবাই ভাবছিল, একটা খুনখারাপি হয়েছে।

রেলইয়ার্ডের দিকেও একদল পুলিশ। রেলপুলিশরাও এসে গেছে। তারাও জানে না কী ঘটছে। ডিউটি ইজ ডিউটি। তারা একদঙ্গল ভাঙা ওয়াগনের ভেতরে, আরও একদঙ্গল রেলইয়ার্ডে মালগাড়ির আড়ালে ওত পেতে আছে।

ডেভিড কেয়ারটেকারের ঘরের বারান্দায় পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে দেখে জীবন্ত হলেন। ফেস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, হোয়াট হ্যাঁড! ও মাই গড! আই ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইজ দিস!

চলে আসুন মিঃ প্যাটার্সন! একটি ঐতিহাসিক কীর্তির ঐতিহাসিক পুনরুদ্ধার দর্শন করবেন! বলে কর্নেল গির্জার পেছন দিকে দক্ষিণে গেলেন। অরিজিৎকে বললেন, তোমার লোকেদের মধ্যে গাছে চড়তে পারে, এমন কাউকে খুঁজে বের করো। কুইক!

অরিজিৎকে অবাক করে তিনি একটা দেবদারু গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে শকুনের বাসা দেখতে থাকলেন। অরিজিৎ পুলিশ অফিসারদের। কাছে দৌড়ে গেলেন।

ডেভিড কর্নেলকে বললেন, প্লিজ কর্নেল! এটা কী হচ্ছে?

কর্নেল দেবদারু গাছটির গায়ে খোদাই করা ক্রশ চিহ্নটি দেখিয়ে বললেন, আশা করি, এটি আপনার কীর্তি নয়?

ডেভিড বললেন, না। এ নিশ্চয় পাগলা গোমেশের কীর্তি!

অরিজিৎ কয়েকজন পুলিশ অফিসার এবং একজন বেঁটে গাড়োয়ালি সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তারপর কর্নেলকে বললেন, কুনাল সিং গাভোয়ালের লোক। বলছে, বাঙাল মুলুকের গাছ তার কাছে গাছই নয়। দেবদারু গাড়োয়ালেও আছে। তবে এ দেবদারু তার কাছে বেঁটে। ওর নিজের চেয়েও নাকি বেঁটে!

কুনাল সিং হাসল। বাংলা বোঝে। হাসিতে ওর চোখ ঢেকে গেল।

কর্নেল বললেন, কুনাল সিং! উও দেখ, গিধনিকি ডেরা। উহা এক পাথর হ্যাঁয়। হোঁশিয়ারিসে লে আনা ভাই! গির যানে সে সব বরবাদ হো যায়েগা!

কুনাল সিং ক্রশআঁকা গাছটাতে উঠে পড়ল। সে অবলীলাক্রমে ডগায় চলে গেল। একটা শকুন উড়ে পালাল ডানা ঝটপটিয়ে। কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন, পাখর হ্যাঁয়?

কুনাল সিং ওপর থেকে বলল, হ্যাঁয় সাব! ছোটা কালা পাথর!

হোঁশিয়ারিসে লেকে আও! তুরন্ত!

অরিজিৎ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। অরিজিৎ কাছে গিয়ে আস্তে বললেন, ইন দা ভালচারস্ নেস্ট! কী আশ্চর্য!

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, হ্যাঁ, দা ভালচারস নেস্ট!

কিন্তু আপনি কি ওটা বাইনোকুলারে আবিষ্কার করেছিলেন?

না ডার্লিং! এ কথা ঠিক যে আমি দেবদারু গাছের ডগায় শকুনের বাসা দেখতুম। রাগ হতো। কিন্তু শকুনের বাসায় লুকিয়ে রাখা ফলকের কথা জানতে পারি এই উপদেশাবলী থেকে। এই দেখ! বলে কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজ দিলেন।

অরিজিৎ পড়ে বললেন, এ থেকে কী ক্লু পেলেন? এ তো উপদেশ! কর্নেল বললেন, প্রতিটি লাইনের আদ্যক্ষর লক্ষ্য করো।

Vulgarity is a Common thing today.
Ultimatum to them who commit nuisance…
Learn what is good and what is bad.
Turn your face towards the Heaven.
Understand what I say to thee.
Remember what I said to thee.
Even the foolish person will know the Truth.
Satan is always following you, oh man!
Never submit yourself to him.
Eden Garden from where you had fallen;
Say, I must go back to that place!
Turn your face towards the Heaven.

অরিজিৎ পড়ে দেখলে কর্নেল বললেন, আদ্যক্ষর থেকে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, VULTURES NEST দৈবাৎ আমার একটা চুরুট কাগজটার ওপর রেখেছিলুম। সেটা লম্বালম্বি আদ্যক্ষরের ডান পাশে গাড়িয়ে যেতেই চমকে উঠে দেখি, লম্বালম্বি ভালচার্স নেস্ট-শকুনের বাসা কথাটি পড়া যাচ্ছে। আমার শকুনের বাসা দর্শনের তাৎপর্য বেরিয়ে পড়ল, ডার্লিং! তা ছাড়া ভ্যানিশিং ইংকে-এর মাথায় লেখা আছে To Colonel-কর্নেলের প্রতি! অমনি বুঝলুম, বুদ্ধিমান, গোমেশ বিপদের আশঙ্কা করে আমার জন্য এটা বাইবেলের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওঁর যদি কোনও বিপদ হয়, আমি এটা থেকেই ফলকটা উদ্ধার করতে পারব।

কুনাল সিং নামল। হাতে ফলক। কর্নেল সেটা নিয়ে বললেন, পহলভি সম্রাট আর্দশিরের ফলক! মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন! অরিজিৎ! এবার ডিসবার্স করে দাও তোমার বাহিনী। সবাই চলে যাক। আমাদের কাজ শেষ। ডেভিড, আশা করি সন্ধ্যার আগেই এই শয়তানের ডেরা ছেড়ে চলে যাবেন?

ডেভিড বললেন, ও! সিওর! বাট নাও আই আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট দা থিং দোজ থিভস্ হ্যাভ বিন সার্চিং!

অরিজিৎ অফিসারদের অর্ডার দিলেন, ডিসবার্স!

কিছুক্ষণ পরে অরিজিতের গাড়ি কর্নেলকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল। কর্নেল অরিজিতের পাশে এসে বললেন, তা হলে ফাঁদ পাতার আয়োজন করিগে। তোমাকে যা সব বলেছি, অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা চাই। না হলে আবার একটা খুনখারাপি হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট, ডার্লিং!

অরিজিৎ বললেন, ভাববেন না। আজ রাতে কবরের কফিন থেকে প্রেতাত্মাদের মতো আমার লোকজন বেরিয়ে পড়বে। আ রেজারেকশন। দেখবেনখন উইশ ইউ গুড লাক। বাই।

কর্নেল হাত নেড়ে বললেন, অ রিভোয়া! আবার দেখা হবে।

.

ড্রইংরুমে পপ মিউজিক বাজছে। সুব্রত চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু কথাকলিকে দেখে কর্নেলের মনে হলো, নাচছিল। ষষ্ঠীও মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলে গেল, ঘরের মধ্যে সিনেমা, বাবামশাই! কথাকলি রেকর্ডপ্লেয়ার বন্ধ করল।

কর্নেলকে দেখে সুব্রত কঁচুমাচু হাসল। আমি অনেক অন্যায় করেছি, কর্নেল! আমাকে রক্ষা করুন।

কথাকলি বলল, নিশ্চয় করেছ। প্রথমেই সব বলা উচিত ছিল তোমার। তুমি বোকার বোকা!

আহা, বকে না! কর্নেল সস্নেহে বললেন, আসলে সুব্রত ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কারণ সে একটা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। তাকে পুলিশ জড়াবে ভেবে তার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।

সুব্রত কথাকলির উদ্দেশে বলল, কিন্তু আমি যথেষ্ট ক্লু দিয়েছিলুম। টিনির বুকের মধ্যে পার্স গুঁজে…

শাট আপ। অসভ্য।

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, তুমি নিজের পার্সের ভেতর একটা লেখা ভরে মৃতা টিনির ব্লাউসের ভেতর গুঁজে দিয়েছিলে। তুমি বড্ড বেশি রোমান্টিক, সুব্রত। টিনির চমৎকার আর্টিস্টি জীবনচরিত লিখেছিলে। প্রচুর ক্লু ছিল ওতে। তোমাকে সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু টিনির পার্স কী হলো?

সুব্রত মুখ নামিয়ে বলল, ওর পার্সে দুশো টাকা ছিল। আমার টাকার খুব দরকার। লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু ভয় পেয়ে প্রথমে…….

প্রথমে পাশেই একটা ফাটলে ছুঁচোর গর্তে লুকিয়ে রেখেছিলে।

সুব্রত চমকে উঠল। আপনি জানেন!

পরে আমি গর্তটার খোঁজ পাই। যাই হোক, ওটা পরে নিয়ে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। শেষ অব্দি মনে হয়েছিল খামোকা দুশো টাকা নষ্ট হবে কিংবা পুলিশ খুঁজে পাবে। তার চেয়ে আমিই নিই।

তুমি টিনিকে গোমেশের মারফত চিঠি পাঠিয়েছিলে। টিনিকে রাতে কবরখানায় ডেকেছিলে কেন?

টিনি বলেছিল, ড্যানি ঘোষ কবরের পাথরের ফলক কেনে। অ্যান্টিক ভ্যালু আছে ওগুলোর। আমি যদি ওকে সাহায্য করি, একটা দামী পাথরের ফলক সে বেচবে। আমাকে ভাগ দেবে টাকার। আমি ওকে নিষেধ করেছিলুম প্রথমে। পরে আমারও লোভ হলো। ঠিক করলুম, সেরাতে ফলকটা উপড়ে তুলতে ওকে সাহায্য করব। তাই গোমেশকে চিঠি দিয়ে এলুম, টিনিকে যেন পৌঁছে দেয়। গোমেশের মারফত আমরা পরস্পরকে চিঠি লিখতুম। গোমেশকে বখশিস দিত টিনি। আমরা কবরখানায় গিয়ে আড্ডা দিতুম।

কথাকলি ফুঁসে উঠল, প্রেম করতে!

সুব্রত একটু হাসল। না কলি! ঠিক প্রেম নয়, আই জাস্ট… লাইকড় হার। . আই ট্রায়েড টু আন্ডারস্ট্যান্ড হার। ওর মধ্যে গানের প্রতিভা ছিল।

কর্নেল বললেন, হুঁ। আগে বলো, গোমেশ চিঠিটা ছিড়লেন কেন?

আমার পরামর্শে। চিঠিটা গেমেশ দিতে গিয়েছিল টিনিকে। ওকে বাড়িতে না পেয়ে ফিরে আসে। তারপর রাত দশটা নাগাদ কথামতো আমি রেলইয়ার্ড ঘুরে কবরখানায় ঢুকলুম। জ্যোৎস্না ছিল। ক্রিস্টিনার কবরের কাছে টিনি আর একটা লোককে দেখলুন, চাপা স্বরে কথা বলছে। আমার ভীষণ রাগ আর দুঃখ হলো। ভারি ট্রেচারাস মেয়ে তো! তক্ষুণি চুপিচুপি ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে চলে গেলুম গোমেশের কাছে। আমার কথা শুনে গোমেশ টর্চ নিয়ে বেরুলেন। আমি ওঁর সঙ্গে। টর্চের আলো দেখেই হয়তো ওরা পালিয়েছে ভাবলুম। তারপর ক্রিস্টিনার কবরের কাছে এসে দেখি, ওঃ! বীভৎস দৃশ্য! টিনি খুন হয়ে পড়ে আছে। অমনি গোমেশকে বললুম, আমরা এতে জড়িয়ে পড়ব। চিঠিটা যেন ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশে খবর দিতে বললুম। গোমেশ বললেন, এত রাতে খবর দিতে গেলে পুলিশের সন্দেহ হবে, ঘর থেকে এত রাতে অতদূরে ক্রিস্টিনার কবরে কেন গেল সে? তার চেয়ে সকালে খবর দেওয়াই ভাল। পুলিশের জেরার চোটে কী বলতে কী বলে ফেলবে।

টিনির পার্সে টাকা আছে কেমন করে জানলে?

আমারও লোভের কথা অস্বীকার করছি না, কর্নেল। আমি এখনও পার্মানেন্ট স্টাফ হইনি। ভাউচারে টাকা পাই। ট্রেনি জার্নালিস্ট মাত্র। ড্যানি ঘোষকে আমিও কবরের ফলক বেচতে চেয়েছিলাম। তখন ড্যানি বলেছিল, আজই সে টিনিকে দুশো টাকার কড়কড়ে নোট দিয়েছে। অ্যাডভান্স। আমি বরং টিনিকে

হেল্প করলে টাকার ভাগ পাব।

তাই তুমি চিঠি লিখে টিনিকে বলেছিলেন রাত দশটায় কবরখানায় যেতে?

হ্যাঁ।

বেশ। তারপর তুমি মৃতা টিনির পার্স বের করে নিজের পার্স ঢোকালে? কিন্তু নেলপালিশ, লিপিস্টিক…

কর্নেল, ওটা টিনির পিকিউলার অভ্যাস! সে হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করত না। একবার ছিনতাই হয়েছিল ওদেরই বস্তিতে।

কর্নেল হাসলেন। তা হলে আমি ভুল বুঝেছিলুম। এনিওয়ে, এবার বলো। টিনির ডেডবডি দেখার পর কী করলে তোমরা?

বললুম ত! গোমেশকে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়তে আর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে বললুম।

গোমেশ পাশের কোনও কবরের ওপর আলো ফেলে কিছু দেখেছিলেন?

আলো ফেলেছিল চারপাশে। কী দেখেছিল, জানি না। বলেনি কিছু।

টিনি তোমাকে বলেনি কোন কবরে ফলক চুরি করবে?

না। শুধু বলেছিল, একটা দামী পাথরের ফলক আছে, সে দেখেছে।

এবং তুমি ওকে প্রথমে নিষেধ করায় সে অন্য কারও সাহায্য নিয়েছিল। তাই তো?

ঠিক তা-ই।

ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও কারণে তার সঙ্গে টিনির বচসা হয়। ধস্তাধস্তিও হয়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ধস্তাধস্তির প্রমাণ চুড়ি ভাঙা! তুমি পদ্যে লিখেছিলে! তোমার টেবিলের ড্রয়ারে সেই পদ্য পাওয়া গেছে।

সুব্রত বিষণ্ণভাবে বলল, পার্স বদলাতে গিয়ে জ্যোৎস্নায় ভাঙা চুড়ি দেখতে পেয়েছিলুম, ঝিকমিক করছিল কবরে আর ঘাসে।

হুম। তুমি ভাঙা ওয়াগনের আড়াল থেকে আমাকে ঢিল ছুঁড়েছিল!

সুব্রত করুণ হাসল। আমার চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল। পরে পুলিশের ডগস্কোয়াডের কথা মনে পড়েছিল। আমি টিনিকে ছুঁয়েছি। কুকুর আমার চটি শুকে যদি…

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন, আমার পদ্ধতি ভিন্ন। আমি কুকুর পছন্দ করি। ওয়েল, যা হবার হয়েছে। এবার আমাকে খুনীকে ধরতে সাহায্য করো। আমি আজ রাতে ফাঁদ পততে চাই। একটু রিস্ক আছে। তবে তোমার কোনও ভয় নেই। শোনো, লেট মি এক্সপ্লেন…।

কথাকলি বলে উঠল, কিন্তু গোমেশবুড়োকে টিনির খুনী কেন খুন করল?

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, অনুমানও যুক্তিশাস্ত্রে সিদ্ধ। জাস্ট অঙ্ক, ডার্লিং! টিনি খুন হওয়ার পর টর্চের আলোয় গোমেশ সেই নির্দিষ্ট ফলকটিতে খোঁজার চিহ্ন দেখে থাকবেন, যা সুব্রতর চোখে পড়েনি। ফলে গোমেশ ফলকটি কোনও এক সময়ে চুপিচুপি খুঁড়ে হাতিয়েছিলেন। বেচার জন্য চন্দননগর গিয়েছিলেন। টিনির খুনী কবরখানায় গিয়ে ব্যাপারটা টের পায়। গোমেশকে সে রাত্রে গিয়ে ডাকে এবং খুন করে। ফলকের দামও দিতে চেয়েছিল হয়তো। গোমেশ সরাসরি নাকি ড্যানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এতে সে চটে যায়। ভয়ে গোমেশ ফলকটা লুকিয়ে ফেলেন। খুনীকে ধরতে পারলে জেরা করে জানা যাবে। যাই হোক, গোমেশকে খুন করে তারপর সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। ফলকটি পায়নি। বুদ্ধিমান গোমেশ সেটি অদ্ভুত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রাণের আশঙ্কা ছিল বলে সাংকেতিক ভাষায়…না। সব পরে শুনবে। আমার প্ল্যান নিয়ে বসা যাক। ষষ্ঠী! কফি! কফি না খেলে আমার মগজ চাঙ্গা হয় না। ষষ্ঠী। দেরি কেন?…..

.

কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটা বাজল। আকাশ এ রাতে পরিষ্কার। ভ্যাপসা গরম। গাছপালার পাতা চুপ করে আছে। কবরখানায় পোকামাকড় ডাকছে। একটা রাতপাখি ডাকল কোথাও। তারপর ক্রাও ক্রাও একটা প্যাঁচা গির্জা থেকে উড়ে গেল রেলইয়ার্ডের দিকে। সেখানে হুইল্ শোনা গেল। তারপর মালগাড়ির শব্দ কতক্ষণ ধরে। টেনে-হিঁচড়ে বিরক্তিকর ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যেতে ইঞ্জিনটা ফোঁস ফোঁস করে হাঁফাচ্ছে!

কৃষ্ণপক্ষের টুকরো চাঁদটা উঠেছে সবে। হালকা নরম সোনালি জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। ছায়াকালো একটা মূর্তি রেলইয়ার্ডের দিকের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে সাবধানে কবরখানায় চুল।

ছায়ামূর্তিটি গির্জার দিকে এগিয়ে এল। গাছের ছায়ায় কখনও সে মুছে যাচ্ছিল, আবার ফাঁকায় তাকে দেখা যাচ্ছিল।

মুর্তিটি সোজা গির্জার পুব দিকে এসে একটু কাশল।

গির্জার জানালার কাছে অন্য কেউ কেশে সাড়া দিল। তখন ছায়ামূর্তিটি হনহন করে এগিয়ে এল। চাপাস্বরে বলল, এনেছ?

এনেছি।

দাও।

টাকা?

সায়েব ওয়াগনের ওখানে আছে। বললে, সঙ্গে করে নিয়ে এস। টাকা। মিটিয়ে দেব।

চলো।

উঁহু, আমার হাতে মাল দাও আগে। মাল দেখি। আমি ওটা চিনি।

চলো না। ওয়াগনের ওখানে গিয়েই দেখবে আসল না নকল!

নাঃ। আগে দাও, দেখি। আমার কাছে টর্চ আছে।

টর্চ জ্বলল। হুঁ, ঠিক আছে। দাও। টর্চ নিভে গেল। দেরি কোরো না! দাও, দাও।

না। হাতে-হাতে টাকা চাই! নৈলে টিনির মতো আমাকেও……

শালা মরেছ তা হলে!

এবার ছায়ামূর্তি হাত তুলেছে। অমনি দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি টর্চ জ্বালল। আততায়ীর হাতে ভোজালি!

দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি একলাফে সরে গিয়ে চিৎকার করল, কর্নেল! কর্নেল!

অমনি চারদিক থেকে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। বাজখাই গলায় কে চেঁচিয়ে উঠল, হাত উঠাও! চারদিক থেকে বুটের শব্দ। দুদ্দাড় ধুপধুপ এবং তীব্র আলো আর আলো!

আততায়ী যেদিকে পালাতে যায়, আললা! হাত উঠাও শুওরকা বাচ্চা! সে দুহাত তুলে দাঁড়াল। ভোজালিটা পড়ে গেল হাত থেকে।

কর্নেল সাড়া দিলেন, সুব্রত! আর ইউ অলরাইট?

সুব্রত হাসল। অলরাইট, কর্নেল!

অরিজিৎ লাহিড়ী এগিয়ে এসে হতভম্ব হয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! এ তো সেই যুধিষ্ঠির!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, যুধিষ্ঠির। টিনি ওর সাহায্য চেয়েই বিপদটি বাধিয়েছিল। দুধ দিয়ে কালসাপ পোষা একেই বলে। গোমেশ ওকে টেক্কা দিয়ে সরাসরি ড্যানিকে ফলক বেচার চেষ্টা করেছিলেন। এতে যুধিষ্ঠিরের রাগ হওয়া স্বাভাবিক।

যুধিষ্ঠিরকে হাতকড়া পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, আচমকা হালদারমশাইয়ের গলা শোনা গেল, এই তো হেই থার্ড ক্লাস লোকটা! হেই বারের লোকটা! ড্যাং হালার লগে অরে দেখছিলাম!

কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, আরে হালদারমশাই যে! আপনি কোথায়?

হালদারমশাই গির্জার ভাঙা জানালা গলিয়ে বাইরে ঝাঁপ দিলেন। আমি। গির্জার ভেতর সার্চ করছিলাম। প্রথমে ফিসফিস, তারপর আলো আর চেঁচামেচি শুনে ভয়ে…..বাপস্!

কর্নেল হালদারমশাইয়ের করমর্দন করে বললেন, আপনি বরাবর ঝামেলা বাধান বটে, তবে এবারকার কেসে আপনিই লাস্ট ব্লু দিয়েছে। থার্ড ক্লাস লোকটা! হুঁ, আমার পুরো থিওরি আপনার ক্লু পেয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কনগ্রাচুলেশন!

একজন অফিসার হাঁফাতে হাঁপাতে এলেন। অরিজিৎকে স্যালুট ঠুকে বললেন, ড্যানি ঘোষ ইজ অ্যারেস্টেড স্যার! হি ওয়জ ওয়েটিং ইন আ কার নিয়ার দা স্লাম এরিয়া!

অরিজিৎ বললেন, গুড নিউজ! থ্যাংক য়ু মিঃ ঘটক। নাও ডিসবার্স দা ফোর্স! অল দা অফিসারস ব্যাক টু লালবাজার! সি পি ইজ অ্যাংকশাসলি ওয়েটিং! হুঁ, আগে রেডিও মেসেজ জানিয়ে দিন, দা ব্লু মুন অপারেশন ইজ সাকসেসফুল!

হালদারমশাই স্যালুট ঠুকে বললেন, ব্লু মুন ক্যান স্যার? দা মুন ইজ গোল্ডেন!

অরিজিৎ চোখ কটমটিয়ে বললেন, সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন! হালদারমশাই ভড়কে গিয়ে কর্নেলের সঙ্গ ধরলেন। চাপাস্বরে বললেন, ডি সি ডি ডি সায়েব আমারে লাইক করেন না ক্যান, বুঝি না। ব্লু মুন ক্যান কর্নেলস্যার?

কর্নেল হাসলেন। সরকারি আমলাতন্ত্রে ভাষা বোঝার সাধ্য আমারও নেই হালদারমশাই! ওসব নাকি কোড ল্যাংগোয়েজ ওঁদের শাস্ত্রে। ছেড়ে দিন। চলুন। আমার ঘরে গিয়ে ঘন দুধের কফি খাবেন। এস সুব্রত!

.

কর্নেলের ড্রইংরুমে পপ মিউজিক বাজছিল। থামল। ষষ্ঠী চুপিচুপি কর্নেলকে বলে গেল, এও এক মেম। সে কী নাচ, বাবামশাই! আবার, আমাকেও ডেকে বলে, এস ষষ্ঠীদা, নাচি! খি খি খি……

কর্নেল বললেন, কলি। তোমার জাস্ট আ ফ্রেন্ড-কে আস্ত ফিরিয়ে দিলুম। দেখ, অক্ষত আছে নাকি।

কথাকলি সলজ্জ হাসল। বলল, ধরা পড়েছে?

সুব্রত বলল, হ্যাঁ, তবে এক সেকেন্ড দেরি হলে ভোজালি ঝাড়ত। ওঃ! এখনও বুক ঢিপঢিপ করছে। আলো না জ্বালা অব্দি আমি চিনতেই পারিনি লোকটা যুধিষ্ঠির। কর্নেলের কথামতো আমি ড্যানসায়েবের নামে চিঠি লিখে রেখে এসেছিলুম রয়সায়েবের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য! যুধিষ্ঠির…..

কর্নেল বললেন, কোনও লোকের চেহারায় কিছু থাকে, দেখেই মনে খটকা বাধে। তবে আমার মূল পয়েন্ট ছিল, খুনী এমন কেউ, যে টিনির সুপরিচিত। টিনি খুব কাছের লোকের সাহায্য চাইবে পাথরটা হাতাতে। পাথরটা খুঁড়ে কবর থেকে ছাড়ানো ওর কর্ম নয়। এমন লোক দরকার, যে নিপুণভাবে আস্ত ফলক ওপড়াতে পারবে। অর্থাৎ সে হাতুড়ি চালাতে জানে। সেকেন্ড পয়েন্ট, টাকার বখরা কম দিতে হলেও টিনির ঘনিষ্ঠ লোক দরকার। এই ক্ষেত্রে টিনির অতি ঘনিষ্ঠ ছিল দুজন। সুব্রত আর যুধিষ্ঠির। সুব্রতকে খুনী সাব্যস্ত করা যায় না। তা হলে সে টিনির জীবনচরিত লিখে ক্লু দিত না। বাকি রইল যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির রোজ তাকে বারে পৌঁছে দিত এবং বাড়ি ফেরত আনত। স্বভাবত সুব্রত টিনিকে নিষেধ করায় সে যুধিষ্ঠিরকে বেছে নিতে বাধ্য। তার বাবার বন্ধু যুধিষ্ঠির। তাদের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু টাকার লোভে বড় লোভ। মানুষ ক্রমশ টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। টাকা টাকা টাকা! গোমেশও ফলকটা বেচে টাকা পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য! যাই হোক, এবার কফি! ষষ্ঠী!

হালদারমশাই আড়চোখে সুব্রত এবং কথাকলিকে দেখতে দেখতে ফাঁচ করে হাসলেন। কর্নেলস্যার! আমি ঘটকালি করুম! মাইয়াডা আর পোলাডারে যা মানায়!

কথাকলি ফুঁসে উঠল, ডোন্ট টক লাইক দ্যাট! উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস।

হালদারমশাই দ্রুত নস্যি নিয়ে বললেন, হঃ!

কর্নেল বিশাল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর আবার হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 8 of 8 ): « পূর্ববর্তী1 ... 67 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *