গঙ্গার পাড়ে বটতলায় এক সাধুবাবা
গঙ্গার পাড়ে বটতলায় এক সাধুবাবা ধুনি জ্বেলে বসে আছেন, এটা নতুন কোনও দৃশ্য নয়। হাজার-হাজার বছর ধরে পবিত্র নদী গঙ্গার সঙ্গে সাধুসন্ন্যাসীদের অস্তিত্ব ঐতিহ্যাঁনুগত। তাকে পুরনো বাঙালি শাস্ত্রকারের উক্তি, গঙ্গার পশ্চিম কুল/বারাণসী সমতুল।
সাধুবাবার পাশে একটা ত্রিশূল পোঁতা এবং ডগায় একফালি লাল কাপড় এলোমেলো উড়ছে। বাবার পরনে বাঘছাল। আসন হরিণের চামড়ার। চেহারাটি দেখলে গা ছমছম করে ভয়ে ও ভক্তিতে। তবে এদিকটায় বসতি কম। শুধু জঙ্গল, ধ্বংসস্তূপ। ঐতিহাসিক কিংবদন্তি, এখানেই ছিল মোগল ফৌজদার গুরগন খায়ের সামরিক ঘাঁটি। পরে একটা গঞ্জ হয়ে ওঠে। ফরাসিরা মোগল বাদশাহের কাছে জায়গির পেয়েছিল। আঠারোশতকে ফরাসি সায়েব কুঠিয়ালদের ডেরা ছিল এখানটাতেই। ইংরেজরা ছিল ফরাসিদের শত্রু। মুর্শিদাবাদের নবাব ফরাসিদের সহায়। ইংরেজরা এঁটে উঠতে পারত না। পরে নাকি গঙ্গার ভাঙনে ফরাসিদের গঞ্জ খানিকটা ভাটিতে সরে যায়।
সাধুবাবা ইতিহাস পড়েই এসেছেন। চোখ বুজে আসন করে বসেছেন। মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ব্যোম কালী! বাবা শৈবও বটেন, শাক্তও বটেন। যিনি শিব, তিনিই কালী। কয়েকজন স্নানার্থী-সানার্থিনীর চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। তারা হাউসিং কলোনির বাসিন্দা এবং বয়স্ক মানুষ। করজোড়ে এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন। সাধুবাবা উদাত্ত স্বরে আওড়াচ্ছিলেন :
কস্তুরিকাঁচনলেপনায়ৈঃ শ্মশান
ভস্মাঙ্গ বিলেপনায় চ
সকুণ্ডলায়ৈঃ মণিকুণ্ডলনায় নমঃ
শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥
সবাই চলে গেলেন। কিন্তু ইভনিং ভিলার কাল্লু বসে রইল। সাধুবাবা চোখ কটমটিয়ে বললেন, কৌন বে শালে?
কাল্লু গাঁজা প্রসাদ পাওয়ার লোভে এসেছিল। কিন্তু সাধুবাবা কিছুতেই প্রথা অনুসারে ছিলিম বের করছেন না। কাল্লু করজোড়ে বলল, বাবা, আমি কাল্লু।
তু ম্লেচ্ছ খ্রীস্টানবাড়িকি নোকর আছিস? ভাগ, ভাগ।
না বাবা! ও বাড়িতে থাকি এইমাত্র। আমি হিন্দুর ছেলে বাবা! কাল্লু ভক্তিতে করুণ হয়ে বলল। পোড়া পেটের দায়ে নোকরি করি। গঙ্গাজলে না চান করে কি এসেছি আপনার চরণদর্শনে? মাইরি! আপনার দিব্যি।
সাধুবাবা একটু নরম হয়ে বললেন, কিন্তু হুঙ্কারটা জমল না।
তেরা নাম কী আছে বেটা?
আজ্ঞে, হারাধন পাত্র। ডাকনাম কালু। সবাই আমাকে কাক্কু বলে।
সাধুবাবা ব্যোম কালী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, বেটা কাল্লু! হা দেখতা, তেরা বহত দুর্ভাগ্য হ্যাঁয়! উও কোঠি খ্রীস্টান ম্লেচ্ছ লোকের কোঠি আছে। হ ইয়ে ভি দেখতা পাতা কি উও কোঠিমে বহত পাপ হ্যাঁয়।
কাল্লু একটু ভড়কে গিয়ে বলল, কী পাপ দেখতা হ্যাঁয়, বাবা?
সাধুবাবা জটা দুলিয়ে হাসলেন। তুভি পাপী হ্যাঁয়। আবে, ম্যায় ত্রিকালজ্ঞ হুঁ।
কাল্লু আরও ভড়কাল। বাবা, মাইরি বলছি, আমি হুকুমের নোকর। ড্যাং সায়েব যা বলে, তা না মানলে নোকরি তো যাবেই, জেলও খাটতে হবে।
কৌন উও ড্যাংসায়েব?
হিন্দু ছিল, বাবা! মেমসায়েব বে করে খেরেস্তান হয়েছে। তাই ওঁর মামা রায়সাহেব খুব চটে আছে। কিন্তু চটলে কী হবে? সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি।
কাল্লু ফিসফিস করে বলল, চোরাই মাল বেচে, বাবা!
সাধুবাবা আবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী!
কাল্লু একটু উসখুস করে বলল, একটু প্রসাদ পাই বাবা। আজ্ঞা হোক!
আবে যা যা! ভাগ! ম্যয় রাতমে কারণবারি পিউঙ্গা! ইয়ে মড়াকা খুলিমে। রাতমে আ যা! বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটি দেখালেন!
কাল্লু একগাল হেসে বলল, হুকুম হলে আমি এনে দেব বাবা। খাঁটি বিলিতি কারণবারি। ইস্কচের বোতল ড্যাংসায়েবের ঘরে আছে।
আবে শালে! ম্যয় ম্লেচ্ছ কারণবারি নেহি পিউঙ্গি! সাধুবাবা বাঁকা মুখে বললেন।
কাল্লু দাঁত বের করে বলল, বাবা, শিবের জটা চলে না?
ক্যা?
কাল্লু হাতের তালুতে গাঁজা ডলার ভঙ্গি করে হাসতে লাগল।
যত সাধুবাবা দেখেছি, সব্বাই শিবের জটা আনেন। খাঁটি পাহাড়ি মুল্লুকের মাল। আপনি আনেননি বাবা?
সাধুবাবা অট্টহাসি হাসলেন। জরুর আনা! লেকিন তুঝকো নেহি দেউঙ্গি!
কেন বাবা?
তু পাপী আছে। উও পাপপুরী আছে। ম্যয় ত্রিকালজ্ঞ হুঁ! উও কোঠিমে বহত চোট্রালোক আনাযানা করত।
কাল্লু চাপা গলায় ব্যস্তভাবে বলল, এখন আর আসে না। কদিন আগে দুদুটো মাডার হলো। পুলিশ……
মার্ডার!
আপনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ। আপনি সবই জানেন। তবে পুলিশ ধানি দিয়েছে সায়েবকে। এদিকে মেমসায়েবও ধাতাচ্ছেন। ওঁর দিদি এলে বিহিত করবেন বলে শাসাচ্ছেন। খুব ঝগড়া, বাবা, খু-উ-ব! কাল্লু খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল।
সাধুবাবা ভুরু কুঁচকে বলেন, কোন মার্ডার কিয়া? তা জানি না। তবে ড্যাবসায়েব পেছনে আছে। কিসকো মার্ডার কিয়া? কাঁহাপর?
কলকাতায়। দুদুটো… কাল্লু থেমে গেল। ইভনিং ভিলার জানালায় ড্যানি ঘোষের মুখ। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ফের, রাত্তিরে এসে কারণবারি প্রসাদ পাই যেন বাবা! আমি খানিক শিবের জটাও আনব। পাহাড়ি মুল্লুকের চেয়ে সরেস জিনিস। দুটোকে মেশালে জম্পেশ হবে, বাবা!
সাধুবাবা হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী। ব্যোম! ব্যোম ভোলা! ব্যোম!
কাল্লু চলে গেল। তখন সাধুবাবা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডটপেন আর নোটবই বের করলেন আসনের তলা থেকে। খচখচ করে লিখলেন, টু মার্ডারস ইন ক্যালকাট্টা! ড্যানি ঘোষ।…….
চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে নকল বাগছাল, হরিণের চামড়ার আসন, মড়ার খুলি এবং ত্রিশূল কিনেছিলেন গোয়েন্দা কে কে হালদার। সারাটা দিন বৃথা গেল। তেমন সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলেন না ড্যানি ঘোষের বাড়ি ঢুকতে। এই কাল্লু সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন কর্নেল। কিন্তু নেহাত গোবেচারা মনে হচ্ছে।
তবে সমস্যা হলো, রাতে ব্যাটাচ্ছেলে গাঁজার প্রসাদ চাইলেই বিপদ। একপাত্তর স্কচ হুইস্কিতে আপত্তিতে নেই হালদারমশাইয়ের। কিন্তু গাঁজা বড় বাজে জিনিস।
দুপুরে এক ভক্ত একগাদা আপেল আর এক ঘটি দুধ দিয়ে গেছেন। খিদেয় পেট চনচন করছে। রাত্তিরটা কাটিয়ে চলে যাবেন। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখছেন না।
সন্ধ্যার মুখে একদঙ্গল ভক্ত এসে প্রণাম করে গেল কলোনি থেকে। আড়চোখে দেখলেন, সব মিলিয়ে যা প্রণামী পড়েছে, তাতে চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে কেনা জিনিসগুলোর দাম প্রায় উসুল হয়ে যাবে। এটাই আনন্দের কথা।
ভিড় হটিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ম্যয় ধেয়ান করুঙ্গা। আভি মুঝকো একেলা রহনে দে। যাঃ! যা সব! ভাগ, ভাগ!
ভক্তরা কেটে পড়ল। অদূরে একটা শ্মশান। সেখানে হরিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। কেমন গা ছমছম করে।
একটু পরে ইভনিং ভিলার সামনে মোটরগাড়ির আলোর ছটা। সাধুবাবা ঝটপট নোটবই পেন বের করলেন। বাড়িটার গেটের মাথায় আলো আছে। এক দিশি সাহেব নামলেন। চেহারার বর্ণনা নোট করে নিলেন।
ধুনির আগুন উসকে দিলেন। শুকনো কাঠকুটোর অভাব নেই এখানে। কিছুক্ষণ পরে কাঙ্গু এল। মুখে একগাল হাসি। সাষ্টাঙ্গে নমো করে বসল। হাফপ্যান্টের পকেট থেকে গাঁজার পুরিয়া বের করল এবং কাঁধের ঝোলা থেকে সত্যিই একটা স্কচের বোতল।
বলল, আগে প্রসাদ করুন বাবা!
সাধুবাবা বোতল খুলে মড়ার খুলিতে একটু র স্কচ ঢেলে চোখ বুজে গিললেন। গলা জ্বলে গেল। এমন গণ্ডগোলে কখনও পড়েননি। কিন্তু ওইটুকুতেই মাথা টলছে। খালি পেটে স্কচ! গলা ঝেড়ে হুঙ্কার দলেন, ব্যোম কালী! কিন্তু হুঙ্কারটা জমল না।
কাল্লু গাঁজার পুরিয়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ছুঁয়ে দেন বাবা! আমি মাল তৈরি করি। আপনি ছিলিম বের করুন।
কী বিপদ! ছিলিমের কথা মনে ছিল না সাধুবাবার। দরকার হবে মনে হয়নি আসলে। তাছাড়া গাঁজা খাওয়া…….সর্বনাশ! হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ছিলম গঙ্গামাইজি লে লিয়ি! তু খা। হম্ নেহি পিউঙ্গা! মাইজিকি মানা হ্যাঁয়।
কাল্লু গাঁজা ডলতে ডলতে বলল, তবে আপনি কারণবারি খান, বাবা। খান, খান। তবেই তো ধ্যানে মন বসবে।
পাছে কাল্লু সন্দেহ করে, আরেক চুমুক র স্কচ টানতে হলো। মাথার ভেতরটা কেমন করছে। তবে স্ফূর্তি হচ্ছে খুব। ঘনঘন হুঙ্কার ছাড়লেন সাধুবাবা, ব্যোম! ব্যোম কালী! ব্যোম! ব্যোম ভোলা!
স্কচের নেশা বেশ টান ধরায়। ঝোঁকের মাথায় আরও এক চুমুক এবং হুঙ্কার। তারপর চোখ নাচিয়ে বললেন, ঔর এক পাপী আয়া তোরা কোঠিমে। কৌন হ্যাঁয় বে?
ড্যাংসায়েবের মামা রায়সায়েব। মামাভাগ্নে মাল টানছে আর তক্ক হচ্ছে।
কি নিয়ে?
কাল্লু ছিলিম এগিয়ে ধরল দুহাতে। চিমটে নেই? বলে সে নিজেই একটুকরো অঙ্গার ধুনি থেকে তুলে ছিলিমে রাখল এবং বলল, প্রসাদ, বাবা! প্রসাদ।
নেশার ঝোঁকে সাধুবাবা ছিলিম নিয়ে এক টান দিলেন। তারপর কী হতে থাকল, বুঝতে পারছিলেন না। মনে হলো, শূন্যে ভেসে চলেছেন। কখনও মনে হলো, পাতালে তলিয়ে যাচ্ছেন। আবার মনে হলো, উড়ে বেড়াচ্ছেন আকাশে।……
.
চোখ খুলে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলেন না হালদারমশাই, কোথায় আছেন। ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে। কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টি স্বচ্ছ হলো। কিন্তু শরীরে ব্যথা। একটা ঘুপচি ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে। হাত এবং পা দুটো শক্ত করে বাঁধা। তারপর সব মনে পড়ল।
কিন্তু পরনে খালি জাঙ্গিয়া! ঝুলিতে পোশাক ছিল। অতিকষ্টে ডাকলেন, কাল্লু! বেটা কাল্লুয়া!
দরজা খুলে গেল। কাল্লুয়া ঢুকল। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল সে। আতঙ্কে হালদারমশাই দেখলেন, তার হাতে একটা চাকু। বললেন, কী বে শালা টিকিটিকি? জ্ঞানবুদ্ধি হলো? নাকি এক খোঁচা দেব?
হুঁ, ধূর্ত কালুর কাছে ধরা পড়ে গেছে। নেশা করিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় এখানে এনে ফেলে রেখেছে। হালদারমশাই কাতরস্বরে বলল, ইয়ে ক্যা হ্যাঁয় বেটা?
চুপ শালা! এখনও ন্যাকামি? বলে কাল্লু তার পাশে বসে গলায় ছুরির ডগা ঠেকাল। ড্যাংসায়েবের চোখরে কঁকি দেবে? আমি না হয় বোকা। ড্যাংসায়েব ঠিকই ধরেছে। দেব শ্বাসনালী ঘেঁদা করে?
হালদারমশাই আঁ আঁ করে উঠলেন আতঙ্কে।
এই সময় দরজা খুলে ড্যানি ঘোষ ঢুকল। দরজা বন্ধ করে বলল, জ্ঞান ফিরেছে শালার?
কাল্লু বলল, হ্যাঁ! সোল ঘণ্টা কেটে গেল। তিন বালতি জল ঢেলেছি গায়ে।
খুনখারাবি করিসনে। ওকে তুলে বসা। জেরা করে দেখি।
কাল্লু হাত-পায়ের বাঁধন খুলে গোয়েন্দাকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসাল। গোয়েন্দা বললেন, বিশ্বাস করুন, আমি পুলিশের লোক নই।
নোস। তুই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার। ঝুলিতে তোর আইডেন্টিটি কার্ড আর রিভলবার পেয়েছি। ড্যানি ঘোষ বলল, শুওরের বাচ্চা! কাল তোকে আমি হায়ার করতে গণেশ অ্যাভেনিউতে তোর অফিসে গিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, মোটা ফি দিয়ে তোকে কাজে লাগাব! বল, কে তোকে অ্যাপয়েন্ট করেছে? ডেভিড হারামি? না অন্য কেউ?
হালদারমশাই বললেন, ডেভিড কে আমি চিনি না, মিঃ ঘোষ!
চুপ। সত্যিকথা বল্!
কর্নেলসায়েব। বিশ্বাস করুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার…
হুঁ! তা-ই বটে। বুড়ো ঘুঘুকে ফাঁদে ফেলেছি এবার। শিগগির ওর ডেডবডি দেখবি।
হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, মুশকিল করে দিল বুড়া। আমার আপত্তি নাই ঘোসায়েব। তবে কথা দিচ্ছি, বিনা ফি-তে আপনার কাম করুম। কন, কী করতে হইব?
চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলক কোথায় আছে জানিস?
ড্যানি ঘোষ প্রশ্নটা করেই কাল্লুকে ইশারা করল। কাল্লু আবার গোয়েন্দার গলায় ছুরি ঠেকাল। গোয়েন্দা ছটফট করে বললেন, মা কালীর দিব্যি! কী কন, কিছু বুঝি না। বুড়া আমারে কিছু কইয়া দেয় নাই। শুধু কইছিল, বাড়ির দিকে নজর রাখবা। ঘোষসায়েব, প্লিজ! বিশ্বাস করেন।
ফের চালাকি? বল, ফলক কোথায়?
মাইরি আপনার দিব্যি, আমারে বুড়া কিছু কয় নাই।
কাল্লু!
ইশারা পেয়ে কাল্লু ছুরির ডগায় একটু চাপ দিল। হালদারমশাই আর্তনাদ করলেন, গেছিরে বাবা! গেছি! গেছি!
অমনি ভেজানো দরজা খুলে গেল এবং এমার আবির্ভাব ঘটল। সে ক্রুদ্ধ। স্বরে বলল, ড্যানি! হোয়াটারায়ু ডুইং? দিস ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং, ইফ ইউ ডোন্ট স্টপ দিজ শর্টস অফ ন্যাস্টি থিংস, আই মাস্ট…..
এমা!
শাট আপ! আই অ্যাম গোয়িং টু কল দা পোলিস!
এমা! ডোন্ট ইন্টারফেয়ার!
আই মাস্ট! আই মাস্ট নট টলারেট…ইট ইজ বিয়ন্ড মাইই টলারেশন। লেট মাই সিস্টার কাম ব্যাক।
ড্যানি ঘোষ নরম হয়ে বলল, প্লিজ এমা!
নো। লেট হিম গো ফ্রি!
বাট হি উইল গো টু দা পোলিস। অ্যান্ড গেস, হোয়াট উইল হ্যাঁন।
হালদারমশাই বললেন, আমারে হায়ার করুন! আমারে হায়ার করুন। আমি ফলক উদ্ধার করিয়া দিমু! আই অ্যাম আ প্রাইভেট ডিটেকটিভ ম্যাডাম! বলে তিনি মেমসায়েবকে সেলামও ঠুকলেন।
এমা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, শাট আপ! ইউ আর আ ফুল! গিভ আপ দা প্রফেশন! গো অ্যান্ড ওয়াশ দা ফিট অব ইওর ওয়াইফ।
রাগ হজম করলেন গোয়েন্দা। বউয়ের পা ধুইয়ে দিতে বলছে ঊ্যাস ফিরিঙ্গি মেয়ে। ফিরে গিয়ে দেখাচ্ছি মজা! কে কার পা ধুইয়ে দেয়।
তবে মুক্তি পাওয়া গেল। মেমসায়েব টেনে তুলে বের করে দিল ঘর থেকে। বেরিয়ে গোয়েন্দা করজোড়ে বললেন, ঘোষসায়েব, দয়া করে আমার ঝুলিটা……
মেমসায়েব হাসি চেপে জাঙ্গিয়া-পরা গোয়েন্দাকে কটাক্ষ করে পাশের ঘরে ঢুকল। ড্যানি ঘোষ বলল, ভাগ! ভাগ!
আমার রিভলবারটা…….
কাল্লু! এই বেড়ালটাকে জলে চুবিয়ে দে!
কাল্লু ছুরি হাতে এগিয়ে এসে হালদারমশাইয়ের ঘেঁটি ধরল। গায়ে একফেঁটা জোর নেই। নয় তো এই হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরা নেংটি ইঁদুরকে কুপোকাত করে ছাড়তেন। কী আর করা যাবে।
কিন্তু সত্যি কি জলে চুবোতে নিয়ে যাচ্ছে কাল্লু? থামলেই পিঠে ছুরির খোঁচা। কেটে-ছড়ে গেল হয়তো। চিনচিন করছে।
সর্বনাশ! জাঙ্গিয়া-পরা হালদার মশাইকে ঠেলে গঙ্গায় ফেলে দিল কালু। দু হাত তুলে তিনি চিক্কুর ছাড়লেন, বাঁচাও! বাঁচাও!
অক্টোবরের ভরা গঙ্গা। নদীনালার দেশের মানুষ কে কে হালদার। সাঁতার জানেন। পুলিশে চাকরি করলেও সবই শিখতে হয়। কিন্তু গায়ে যে জোর নেই। মরিয়া হয়ে আবার চেঁচালেন, বাঁচাও! বাঁচাও!……
লালবাজার পুলিশ হেড কোয়াটার্সে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী কার্ডটা দেখে বললেন, ডাকো! সাদা পোশাকের পুলিশ সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল।
একটু পরে আগন্তুক ঢুকে সেলাম ঠুকলেন সামরিক কায়দায়। বোঝা গেল, মিলিটারি-কায়দা-রপ্ত।
অরিজিৎ লাহিড়ী বললেন, হ্যাল্লো মিঃ প্যাটার্সন! বসুন। আশা করি, কোনও দুঃসংবাদ নিয়ে আসেননি কবরখানা থেকে?
ডেভিড প্যাটার্সন বসে বললেন, কর্নেল নেই। তাই আপনার দ্বারস্থ হলুম স্যার!
বলুন।
কবরখানায় দিনদুপুরে রহস্যময় কাণ্ড ঘটছে। আমার এবার মনে হচ্ছে, পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা না থাকলেন আবার কী ঘটে যাবে। হয়তো আমিই……ঔ জেসাস! বলে বুকে ক্রস আঁকলেন ডেভিড।
কী ঘটছে?
ডেভিড্ গতকাল গির্জার ভেতর যা-যা ঘটেছিল, কর্নেলকে নিয়ে গিয়ে যা যা দেখিয়েছেন, সব ঘটনা ইনিয়েবিনিয়ে বর্ণনার পর আজকের ঘটনা শোনালেন। আজও একই ঘটনা। আজ বাড়তি সংযোজন হলো ঢিল। পাথরকুচি ছুড়ছিল ভূতেরা। ঘর থেকে বেরুতেই পারেননি ডেভিড। যখনই বেরুতে পা বাড়িয়েছেন, তখনই ঝাঁকে ঝাঁকে ঢিল। গিয়ে স্বচক্ষে দেখতে পারেন পুলিশের গোয়েন্দারা। এবার গির্জার সদর দরজার তালাও ভেঙেছে। ভেতরকার আসবাবপত্র ওলট পালট করেছে। জঙ্গুলে কবরখানা, তার ওপর সেকেল কবর সব। একেকটি খুদে স্থাপত্য। আড়ালে লোকজন চলাফেরা করলে বা ঘাপটি পাতলে দেখতে পাওয়া যায় না।
অরিজিৎ বললেন, ঠিক আছে। আবার পুলিশ মোতোয়েন করছি। আপনার সঙ্গেই পাঠাচ্ছি। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন।
ডেভিড বেরিয়ে গেলে অরিজিৎ কর্নেলের বাড়ি রিং করলেন। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের কাল রাত্রি থেকে পাত্তা নেই। কিছু বলেও যাননি। বাইরে গেছেন নাকি।
ষষ্ঠীচরণ ফোন ধরেই বলে দিল, বাবামশাই নেই! একশোবার লোকে জ্বালাতন করছে কাল রাত্তির থেকে। বলছি, নেই, নেই, নেই, নেই!
অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, আমি নালবাজারের নাহিড়ীবাবু, ষষ্ঠী।
অমনি ষষ্ঠির স্বর বদলে গেল। আজ্ঞে স্যার, আপনি? নমস্কার স্যার! তা আগে বললে…স্যার, দোষ নেবেন না। কে একজন খালি জ্বালান করছে……তাই স্যার…….
তোমার বাবামশাই কিছু বলে যাননি?
আজ্ঞে, না। আপনাকে বলে গেছেন ভাবছি। বলেননি?
না তো!
স্যার, স্যার! হঠাৎ ষষ্ঠী উত্তেজিত হয়ে উঠল।
কী হলো, ষষ্ঠী?
বাবামশাই সত্যি রাঁচি যাননি তো?
রাঁচি? রাঁচি কেন?
বাবামশাই ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ষষ্ঠী, তুই বলিস আমি নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছি। বিড়বিড় করে বকি। ঠিক বলেছিস! বলে বাবামশাই বললেন, এবার আমি রাঁচিই চলে যাব। সেখানে পাগলাগারদ আছে জানিস তো? আজ্ঞে স্যার, ভেবে দেখুন কথাটা।
ষষ্ঠী, তুমি বুদ্ধিমান। কবে এ কথা বলছিলেন কর্নেল?
আজ্ঞে, পরশু স্যার! গতকালকেও সন্ধ্যায় বেরুনোর সময় জিজ্ঞেস করলুম, কখন ফিরবেন। অমনি রাগ করে বললেন, পাগলাগারদে যাচ্ছি।
ঠিক আছে। হাসতে হাসতে ফোন রাখলেন অরিজিৎ লাহিড়ী। তারপর গম্ভীর হলেন। কর্নেল হঠাৎ নিপাত্তা হলেন কোথায়? ফের চন্দননগরের ওদিকে গিয়ে ড্যানি ঘোষের পাল্লায় পড়েননি তো? একটু উদ্বিগ্ন হলেন অরিজিৎ। ড্যানি ঘোষের রেকর্ড খারাপ। পুলিশ ওকে বহুদিন থেকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। ধূর্ত লোক।
ডেভিডসায়েবের সঙ্গে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে চন্দননগর থানায় ফোন করলেন অরিজিৎ। ও সি ভবেশ রুদ্র ফোন ধরলেন। ফোনেই সেলামবাজি করে বললেন, বলুন স্যার!
ভবেশবাবু, আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের নাম শুনেছেন?
নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। তবে……
দ্যাখেননি?
না স্যার! কেন…
সাদা দাড়ি, মাথায় টাক, প্রকাণ্ড মানুষ। গলায় বাইনোকুলার, ক্যামেরা ঝোলে। পাখি দেখা, প্রজাপতি ধরা, অর্কিড পাড়া বাতিক আছে। খ্রীসমাসের সান্তা ক্লজ! মাতায় কখনও টুপিও থাকে। ফর্সা রং। সায়েব বলে মনে হয়। খাঁটি বাঙালি। ভবেশবাবু, চন্দননগরের ব্রিটিশ এরিয়ায় বিস্তর গাছপালা আছে। ড্যানি
ঘোষের বাড়ির কাছে……
স্যার! কর্নেলসায়েব ইদানীং দাড়ি কামাননি তো?
অসম্ভব।
স্যার, একটা লম্বা বডি গঙ্গা থেকে উদ্ধার করেছে লোকেরা। তবে ফর্সা নয়।
ডেডবডি?
প্রায় সেই অবস্থা। হাসপাতালে আছেন। জাঙ্গিয়া-পরা বডি। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে বলছেন, রিভলবার। বড় মিসটিরিয়াস!
লম্বা নাক, শ্যামবর্ণ, ঢ্যাঙা?
হ্যাঁ, স্যার! সেই রকমই।
গোঁফ নেই?
না তো।
রিভলবার বলছেন?
হ্যাঁ। যখনই জ্ঞান ফিরছে, তখনই রিভলবার বলে ফের অজ্ঞান। এখানকার কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারছে না।
ভবেশবাবু, নাকের পাশে জডুল আছে কি?
আছে! আছে!
অরিজিৎ হাসতে লাগলেন।
কী হলো স্যার?
ভবেশবাবু, তা হলে উনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার। রিটায়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টর। গণেশ অ্যাভেনিউতে হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। ওঁর। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, উনি গঙ্গায় জাঙ্গিয়া পরে ঝাঁপ দিলেন কেন? এনিওয়ে, ওঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। তারপর জবানবন্দি নিয়ে অ্যাকশন নিন। সামথিং মিসটিরিয়াস হ্যাঁজ হ্যাঁপনড়। থরোলি ইনভেস্টিগেট। আমি কুঁচড়োয় পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করছি।
ওক্কে স্যার!……
ফোন রেখে অরিজিৎ আবার হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মাত্রেই ছিটগ্রস্ত, অথবা ছিটগ্রস্তরাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হন। দুই মেরুর দুই নিদর্শন, কর্নেল এবং হালদারমশাই। একজন হয়তো রাঁচি চলে গেলেন হঠাৎ, অন্যজন দিলেন জাঙ্গিয়া পরে গঙ্গায় ঝাঁপ! কী অদ্ভুত!…..
.
চন্দননগর হাসপাতালে হালদারমশাই চোখ খুলে পিটপিট করে তাকালেন। সাদা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। আলো জ্বলছে। তিনি কোথায়? কিছু মনে পড়ছে না।
হঠাৎ টের পেলেন নাকে কী ঢুকে আছে। বেজায় চটে গেলেন। তাঁর নাকে কী ঢুকিয়েছে কেউ। সুড়সুড় করছে। আধ মিনিট পরে কালুর কথা মনে পড়ল। সেই ব্যাটাছেলের কাজ না হয়ে যায় না। খাপ্পা হয়ে নাক থেকে জিনিসটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন। উঠে বসলেন। নার্স হ, করে দৌড়ে এলেন।
হালদারমশাই রাগী চোখে চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন, আমি এখানে ক্যান? আমার তো অন্যত্র থাকনের কথা। ব্যোম কালী! ব্যোম শিব!
নার্স ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সিস্টারকে ডাকতে গেলেন।
হালদারমশাই দেখলেন, তার পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবি। ছা ছা! সে উঠলেন, কোন হালায় এগুলান পরাইল?
তারপর বালিশের পাশেই নিজের সেই ঝুলিটি আবিষ্কার করলেন। ঝটপট হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, রিভলবারটি রয়েছে। বের করে বললেন, গুলি করুম। সব হালারে গুলি করুম!
রোগীরা উঠে বসেছিল বেডে। পাশের বেডে স্যালাইন দেওয়া রোগীটিও ভয়ে চোখের কোনা দিয়ে তাকাল। সিস্টার, নার্সের বাহিনী, জমাদার-জমাদারনি ছুটে আসছিলেন। থমকে দাঁড়ালেন জলে-ডোবা রোগীর হাতে রিভলবার দেখে। এক তরুণ ডাক্তার তক্ষুণি ব্যস্তভাবে পুলিশে ফোন করতে ব্যস্ত হলেন। মুখে তার প্রচণ্ড আতঙ্ক।
হঠাৎ হালদারমশাই ফাঁচ করে হাসলেন। পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! বলে ঝুলিতে হাত ভরে নস্যির ডিবেটি খুঁজে বের করলেন। রিভলবার ঝুলিতে ঢুকিয়ে দুটিপ নস্যি নিয়ে বিকট হাঁচার সঙ্গে সঙ্গে তার মগজ পরিষ্কার হয়ে। গেল।
সিস্টার এবং হাসপাতালবাহিনী সাহস করে কাছে এলেন। সিস্টার বললেন, প্লিজ! আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার এখনও অক্সিজেন দরকার!
হালদারমশাই পুনঃ ফাঁচ করলেন। ব্রেন ইজ ক্লিয়ার নাও! আই অ্যাম কে কে হালদার, দা ফেমাস প্রাইভেট ডিটেকটিভ! আই মাস্ট গো নাও টু দা পোলিস! বলে উঠে দাঁড়লেন।
জমাদাররা ধরে শুইয়ে দিতে এলেন শাসিয়ে বললেন ফেল, ডোন্ট টাচ! রিভলবার বের করুম।
তারা ভয়ে সরে গেল। সিস্টার নার্সকে বললেন, এই ব্যাগটা এল কোত্থেকে? কখন কে আনল জানো ঊষা?
নার্স করুণস্বরে বললেন, একটা লোক কিছুক্ষণ আগে এসে রেখে গেল। বলল, আমি ওঁর আত্মীয়।
তুমি দেখলে না ওতে কী আছে?
নার্স আরও করুণস্বরে বললেন, ভাবলুম খাবার-টাবার আছে। হাসপাতালে বাইরের খাবার তো রোগীদের জন্য অ্যালাউড।
হালদারমশাই বললেন, বাথরুম কোথায়? এই বেঢপ পাঞ্জাবি-পাজামার নিকুচি করেছে। আমার ড্রেস পরব। ছ্যা ছ ছা।
বলে নিজেই বাথরুম আবিষ্কার করে সটান গিয়ে ঢুকলেন। একটু পরে প্যান্ট-শার্ট পরে বেরিয়ে এসে পাঞ্জাবি-পাজামা ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন, যাই গিয়া! ডাক্তারবাবুরা, সিস্টার বোন, নার্স বোনটি, সক্কলেরে আমার বিদায় নমস্কার। আমি কৃতজ্ঞ। তবে কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে….. বলে। রিভলবার বের করলেন। আবার আতঙ্কের হিড়িক পড়ে গেল। পুলিশ আসতে বড্ড দেরি করছে। ডাক্তার এখনও ফোনের কাছে।
রিভলবার তাক করে পিছু হটে বেরিয়ে গেলেন হালদারমশাই। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। বাইরে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে বললেন, স্টেশন!…
.
বললেন, কফি ভাইটি। ভাগ্যিস বাবা অসুর দুধ। আগে চাঙ্গা হইলে
রাত সাড়ে নটায় দরজা খুলে ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইকে দেখে হাসি চাপল। ওঁকে দেখলেই তার হাসি পায়। সে বলল, বাবামশাই তো গতকাল থেকে বাইরে।
হালদারমশাই সোজা ড্রইংরুমে ঢুকে সোফায় বসে বললেন, কফি ভাইটি! কড়া কফি আর প্রচুর দুধ। আগে চাঙ্গা হই, তারপর মা গঙ্গার কথা। বাপ! ভাগ্যিস বাবা ভোলার নাম জপছিলুম, তাই মা গঙ্গা ভয় পেয়ে…….ফাঁচ! অর্থাৎ হাসি।
ষষ্ঠী যেতে যেতে ঘুরে বলল, হালদারমশাই, আপনার গোঁফ? কাটছিলাম! হালদারমশাই গোঁফের জায়গায় হাত বুলিয়ে বললেন, একবার, একবার নয়, দুবার সাধু সেজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। গোঁফে গোঁফ আটকে যায়। যাক সে কথা। আগে কফি, পরে কথা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইয়ের জন্য বিশেষ কফি আনল। উনি চুমুক দিয়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার বলল ভাইটি, কর্নেলস্যারের খবর কী?
ষষ্ঠী বলল, বাবুমশাই কি কখনও বলে যান? তবে এবার যেন মনে হলো রাঁচি যাচ্ছেন। আচ্ছা হালদারমশাই, রাঁচিতে পাগলাগারদ আছে না?
আছে। তবে কর্নেলস্যার পাগলাগারদে যদি যান, তা হলে জানবে কোনও ক্লু পেয়েছেন। কবরখানায় যে মাইয়াডা খুন হইছে, সেই খুনী পাগলাগারদে পাগল সেজে আছে। সিওর!
হালদারমশাই! আজ ডেভিডসায়েব এসেছিলেন কবরখানায় থাকেন বললেন, ডেভিডসায়েব। সেখানে আবার কী ভুতুড়ে ব্যাপার হয়েছে। তো……
হালদারমশাই বললেন, এক্ষুণি যাচ্ছি। ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করিয়া দিমু, দেখবা!
ষষ্ঠী মনে করিয়ে দিল, আপনার গোঁফ?
কইলাম না গোঁফে গোঁফ আটকাইয়া যায়! গোঁফ গেছে, গোঁফ গজাবে। ভেবো না।
বলে কফি শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন হালদারমশাই। এবার লক্ষ্য ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রি, যেখানে পাগল সেজে ঘুরেছেন। সব চেনা হয়ে গেছে। একদিনেই।
পৌঁছুতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কিন্তু মেঘও আছে। রেলইয়ার্ড ঘুরে সেই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে কবরখানায় ঢুকলেন।
চুপিচুপি কবর ও ঝোপজঙ্গলের আড়ালে এগিয়ে গির্জার কাছে গেলেন। কারা ওপাশে চাপাস্বরে কথা বলছে। গেটের কাছে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে। তাদের এদিকে দৃষ্টি নেই। খৈনি ডলছে।
কিন্তু কথা বলছে কারা? রহস্যময় ব্যাপার। রিভলবার বের করে পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। কেয়ারটেকারের ঘরের বারান্দায় আলো জ্বলছে। লোক নেই।
লোক নেই, অথচ কথা শোনা যাচ্ছে। আরও রহস্যময় ব্যাপার।
দেবদারু গাছের পেছনে যেতেই তার ওপর টর্চের আলো পড়ল। আচম্বিতে। তারপরই পেছন থেকে কেউ তাকে ধরে ফেলল। মুচড়ে রিভলবার কেড়ে নিল। হালদারমশাই চেঁচালেন, পুলিশ! পুলিশ!
ততক্ষণে তাকে ঠেলতে ঠেলতে কেয়ারটেকারের ঘরের সামনে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। হালদারমশাই অবাক। পুলিশরক্ষীরা ঘুরেও তাকাল না! হাল ছেড়ে দিলেন হালদারমশাই।
কেয়ারটেকার ডেভিড বেরিয়ে বললেন, সোয়াইন! ব্লাডি! রাস্কেল! হালদারমশাই চটে গিয়ে বললেন, ইউ সোয়াইন! ইউ ব্লাডি! ইউ রাস্কেল?
সাদা পোশাকের পুলিশ তার ঘাড়ে থাবা হাঁকড়ে বলল, চো-ও-প বে শালে! চোট্টা!
হালদারমশাই বললেন, শাট আপ! তুম জানতা হম্ কৌন হ্যাঁয়? প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার!
আবে কৌন হালদার? তেরা বাপকো আভি ডিটেকটিভ দেখা দুঙ্গা! বৈঠ! হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে! সেমসাইড!
সাদা-পোশাকের দ্বিতীয় পুলিশ তার চুল খামচে ধরে বলল, চো-ও-প্! বৈঠ শালে লোক।