লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ
কর্নেল শূন্যোদ্যানে দাঁড়িয়ে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের ওদিকে দেবদারু গাছের শীর্ষে শকুনের বাসা দেখছিলেন। বিরক্তিকর দৃশ্য। অথচ ক্ষত খোঁচানোর মধ্যে মানুষের যেমন কী একটা প্রবণতা আছে, এক্ষেত্রেও তা-ই। বিষদৃষ্টে একটি শকুনকে দেখতে দেখতে পেছনে শুনলেন, মর্নিং ওল্ড বস!
কর্নেল না ঘুরেই বললেন, মর্নিং ডার্লিং!।
টিনির হত্যাকারীকে দেখতে পাচ্ছেন বাইনোকুলারে? অরিজিৎ কৌতুকে বললেন, অসম্ভব নয়। বাইনোকুলার যে কত জরুরি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে বোঝাতে পারা গেল না ওঁদের মতে, ফাঁইন্যান্স দফতর আটকে দেবে। তা ছাড়া পুলিশ বাইনোকুলার নিয়ে দেখবেটা কী? পুলিশ কি মিলিটারি?
অরিজিৎ! কলকাতার মাথায় বিপদ সংকেত?
কী রকম?
শকুন, ডার্লিং, শকুন! কর্নেল ঘুরলেন। কলকাতা ভাগাড় হবে, এ তার লক্ষণ।
ওঃ! আপনার সেই শকুনতত্ত্ব? ষষ্ঠী বহুবার বলেছে? অরিজিৎ কাগজে মোড়া একটা জিনিস দিয়ে বললেন, রাতে আপনার ফোন পেয়ে তখনই ফোরেন্সিক এক্সপার্ট আপনার বন্ধু ডঃ মহাপাত্রের ল্যাবে গেলুম। ওঁর পরীক্ষা শেষ।
টিনির পার্স?
ইয়া।
ডঃ মহাপাত্র কী বললেন?
আশ্চর্য ব্যাপার, টিনির পার্স! টিনির ব্লাউসের ভেতর ছিল। অথচ টিনির আঙুলের ছাপ নেই। অন্য কারও আঙুলের ছাপ।
সুব্রতর আঙুলের ছাপ তো নিয়েছ!
টিনির পাসে সুব্রতর আঙুলের ছাপ পাওয়া নতুন কথা নয়। সে তার লেখাটি টিনির পার্সে ভরেছিল। কিন্তু টিনির পার্সে টিনির আঙুলের ছাপ না থাকাটা আশ্চর্য! এটা নতুন সূত্র। কর্নেল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
অরিজিৎ তাকে অনুসরণ করে বললেন, গোমেশের আঙুলের ছাপও নয়। মিলিয়ে দেখা হয়েছে। গোমেশের আঙুলের ছাপ আমরা নিয়েছিলুম।
ড্রইংরুমে নেমে কর্নেল গার্ডেনিং পোশাক খুলে বাথরুমে হাত ধুয়ে এলেন। অরিজিৎ সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। মোড়ক থেকে পার্সটা খুলে কর্নেল বললেন, হুঁ, আশ্চর্য!
উঁ?
ডার্লিং, এই পার্স টিনির না হওয়াই সম্ভব।
কিন্তু ওর ভেতরকার জিনিসগুলো দেখুন। সেফটিপিন, নেলপালিশ, লিপস্টিক, চুলের ক্লিপ…..
কর্নেল পার্স থেকে জিনিসগুলো বের করে অট্টহাসি হাসলেন।
আমি তোমাকে বলেছিলুম অরিজিৎ। এটা নিছক পার্স। মানিব্যাগ মাত্র! কোনও অতিচালাক একে নারীচরিত্র দেবার জন্য……হাঃ হাঃ হাঃ! বলে হঠাৎ গম্ভীর হলেন। সেফটিপিন, ক্লিপ যদি বা পার্সে থাকে, লিপস্টিক নেলপালিশ কেন? তা ছাড়া এগুলো সবই নতুন। সবই প্ল্যান্টেড, ডার্লিং!
তা হলে সুব্রতরই কাজ।
সম্ভবত তাই। সে জানত টিনি খুন হবে। লেখাটি ঠাণ্ডা মাথায় লিখেছিল। পাসটিও নতুন, জিনিসগুলো নতুন। তার মানে, টিনির হত্যাকাণ্ডের পরই সে টিনির ব্লাউসের ভেতর এটা গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায়। রেললাইনে চপ্পল ছিঁড়ে যায়। এনিওয়ে, এ সুব্রতরই কাজ।
তা হলে সে-ই খুনী।
জানি না ডার্লিং! বড় জটিল এই কেস। কর্নেল হাত বাড়ালেন এবং কফির পেয়ালা হাতে পৌঁছে গেল। ষষ্ঠী নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবকে অর্ঘ্যদানের মতো কফির পেয়ালা দিয়ে ভয়ে-ভক্তিতে চলে গেল।
একটু পরে কর্নেল বললেন, এবার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, টিনির পার্স কোথায় গেল? তার বাড়িতে কোনও পার্স পাওনি। কাজেই টিনি খুন হওয়ার আগেই তার পার্স চুরি যায় বা কেড়ে নেওয়া হয়।
কেন?
কড়কড়ে নোট ছিল হয়তো! পদ্যটা তুমিও পড়েছ।
অরিজিৎ সোজা হয়ে বসে বললেন, সুব্রত! সুব্রত! তাকে খুঁজে বের করবই। সে-ই খুনী। তা অভাব ছিল। প্রেম-ট্রেম বোগাস! কর্নেল, নিরীহ বোকাসোকা চেহারার মধ্যেও খুনী লুকিয়ে থাকে। কবিদেরও খুনী হওয়া সম্ভব। কবি র্যাঁবোকে খুন করতে কবি ভেরলেন গুলি ছুঁড়েছিলেন। নিজেকে খুন করেন হেমিংওয়ে। তারপর…..
কবি-সাহিত্যিকরাও মানুষ। তাদের কেউ অপরাধী হতেও পারেন। মহাকবি বাল্মীকি প্রথম জীবনে দস্যু ছিলেন। সোক্রাতেস বলেছিলেন, আমি সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল হতে পারতুম। কিন্তু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজেকে দার্শনিক করে ফেললুম। তো কথা হচ্ছে, সুব্রত কেন পার্সটা ঢোকাল টিনির ব্লাউসে?
আমাদের ভুল পথে চালাতে।
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, দ্যাট মে বি আ পয়েন্ট। কিন্তু…..মাই গুডনেস! হঠাৎ নড়ে উঠলেন কর্নেল। অরিজিৎ! গির্জার পেছনের দেবদারু গাছের মাথাতেও শকুনের বাসা আবিষ্কার করেছি আজ!
আবার শকুনতত্ত্ব! চলি।
আন্ডারটেকার ডেভিড প্যাটার্সনকে ওই কবরখানার কেয়ারটেকার করা হয়েছে। কর্নেল হাসলেন। অদ্ভুত ব্যাপার, উনি আনন্দের সঙ্গে চাকরিটা নিয়েছেন।
শুনেছি। কিন্তু অদ্ভুত বলছেন কেন?
ডেভিড বলতেন শয়তানের ডেরা। সেই ডেরাতেই এবার উনি প্রহরী!
উপরি রোজগার। ওঁর বউ নাকি আন্ডারটেকার সোসাইটির হেড হয়েছেন!
অরিজিৎ লাহিড়ী উঠলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, কোট একজিবিট আপনার জিম্মায় রইল–ওই পার্সটা পরে ফেরত চাইব।
অরিজিৎ বেরুনোর একটু পরে হালদারমশাইয়ের আবির্ভাব ঘটল। বসেই বললেন, বাস্! ভূত, ভূত, ভূত! কী সর্বনেশে জায়গা কর্নেলস্যার! ষষ্ঠীকে বলুন, বেশি দুধ দিয়ে কড়া কফি। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
ষষ্ঠী হালদারমশাইকে দেখলেই অস্থির হয়। সে কফি আনতে দৌডুল। কর্নেল বললেন, রাত্রে ছিলেন নাকি কবরখানায়?
সারা রাত! হালদারমশাই করুণমুখে বললেন। হালার মশায়…….সরি কর্নেলস্যার, মসকুইটো! একেকখানা রকেট। এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। এই দেখুন, শরীরের অবস্থা!
আপনার কষ্টের জন্য দুঃখিত, হালদারমশাই!
কিছু কষ্ট না। পুলিশের চাকরিতে কত মশা দেখেছি। এ কী মশা! বলে তিনি নস্যি নিলেন। ফাঁচ করে হেসে ফের বললেন, সায়েব তো সন্ধ্যাবেলা কেটে পড়ল। তখন ঢুকলুম। গির্জার পাশের ঘরের বারান্দায় পাগল শুয়ে আছে। নাকি। অনেক রাতে গির্জার ভেতর রহস্যজনক শব্দ। টর্চের আলো। গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের আড়ালে বসলুম। তিনজন লোক স্যার, আঙুল দেখালেন হালদারমশাই। একজন তাগড়াই, একজন বেঁটে, একজন মাঝারি। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। তার ওপর হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টি। ওদের একজন গেটের কাছে, একজন গির্জার জানালার ধারে, আরেকজন জানালা গলিয়ে গির্জার ভেতরে। কতক্ষণ পরে বেরিয়ে বলল, নাথিং। নেহি মিলা!
হুঁ, তারপর?
তারপর চলে গেল। বলে ষষ্ঠীর হাত থেকে কফি গ্রহণ করলেন হালদারমশাই। কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ভোররাত্তিরে বাড়ি ফিরলুম। স্নান করে হেভি ব্রেক ফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছি। এবার বলুন, আর দরকার আছে নাকি কবরখানায় নজর রাখার?
না। এই যথেষ্ট। কর্নেল নিভন্ত চুরুট ধরালেন।
হালদারমশাই বললেন, কিন্তু ওরা কী খুঁজছিল?
একটা দামী ফলক। পাথরটাও দামী।
হ। বুঝছি।
বুঝে থাকলে আর একটা দায়িত্ব দেব হালদারমশাই!
স্বচ্ছন্দে। হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, প্রাণ দিয়া দিমু কর্নেলস্যার কইলে। সেই সঙ্গে ফাঁচ করে হাসি।
কর্নেল একটা কাগজ নিয়ে নকশা এঁকে বললেন, চন্দননগরের বাইরে এই এলাকা। ইভনিং লজ নামে এই পুরানো বাড়ি। এই হলো গঙ্গার ধারে বটতলা। এখানে বসে বাড়িটার দিকে নজর রাখতে হবে। কে কেমন চেহারার লোক যাতায়াত করছে, তার ডিটেল জানতে চাই। শুধু সাবধান, ওই বাড়িতে কাল্লু নামে একটা লোক আছে। সে খুনে প্রকৃতির। পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। পালক দিয়ে কান চুলকোনো অভ্যাস। আবার বলছি, সে সাংঘাতিক লোক।
তাচ্ছিল্য করে হালদারমশাই বললেন, পুলিশলাইফে কত সাংঘাতিক লোকেরে দেখছি, কর্নেলস্যার! ভাববেন না।
ছদ্মবেশের দরকার হবে এবারও।
ঠিক করেই ফেলেছি। সাধু সেজে গঙ্গার ধারে বটতলায় ধুনি জ্বেলে বসব। ব্যস!
দারুণ!
হালদারমশাই সোৎসাহে চলে গেলেন।…
.
সুব্রত টিনিকে কবরখানায় রাতে যেতে বলেছিল। গোমেশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল।
নাকি গোমেশের কাছে চিঠিটা রেখে এসেছিল?
খুব চিন্তাযোগ্য পয়েন্ট এটা। গোমেশ টিনিদের বাড়ি গিয়েছিল। চিঠিটা দিতেই কি গিয়েছিল?
তা হলে গোমেশ চিঠি ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলবে কেন?
গোমেশ চিঠি দিতে টিনির কাছে নাকি অন্য কারণে গিয়েছিল? সুব্রত এবং টিনি প্রায়ই কবরখানায় যেত প্রেম করতে, এটা বোঝা যায়।
নাকি ছেঁড়া চিঠি জোড়তাপ্পি দিতে ভুল হয়েছে কর্নেলের? রাতে যেতে বলেছিল, না নিষেধ করেছিল? গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের বাকি টুকরোগুলি পেলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতো। গোমেশ সেগুলি পুড়িয়ে ফেলে।…
কর্নেল গাড়ির ব্রেক কষলেন বস্তির ভেতর। দুটো বাজে। উজ্জ্বল রোদ। গাড়ির কাছে উৎসুক একদল ছেলেমেয়ে ভিড় করল। কর্নেল তাদের মধ্যে লজেন্স চকলেট হরির লুঠ দিয়ে বলেন, তোমরা এই গাড়ি পাহারা দেবে। কেমন? ফিরে এসে আবার লজেন্স-চকোলেট!
ছেলেমেয়েরা খুব খুশিতে হাসতে লাগল। বয়স্ক লোকেরাও আমোদ পাচ্ছিল। সে রাতে এসে টিনিদের বাড়ি চিনে গেছেন কর্নেল। পোড়ো জমি, খোলা ড্রেন, আর এই পানের দোকান।
বেলা দুটোয় কারও সাহস হবে না তার ওপর হামলা করতে। তবু সাবধানে চারদিক দেখে নিলেন কর্নেল। বয়স্কদের উদ্দেশে বললেন, হম্ সি এম ডি এ
সে আতা হ্যাঁয় ভাই! ইয়ে মহল্লাকা ডেভালাপমেন্ট কাম হোনে লগে।
এতে কাজ হলো। যুবকেরাও এসে ভিড় করল। নানা অভিযোগ তাদের। কর্নেল সব নোট করার ভঙ্গি করলেন নোটবইতে। তারপর পা বাড়ালেন পোডড়া জমিটার দিকে। দলটি তাকে অনুসরণ করছিল। বললেন, ঠিক হ্যাঁয়। হম্ উও ড্রেন দেখনে যাতা ভাই! আপলোগোনে গাড়িকি পাশ ওয়েট কিজিয়ে!
তবু জনাকয়েক উৎসাহী যুবক তার সঙ্গ ছাড়ল না। তাদের মধ্যে বাঙালি অর্ধশিক্ষিত যুবকরাও আছে। তারা বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে থাকল। কর্নেল একতলা বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ও বাড়িটা কার?
একজন বলল, একটা খারাপ মেয়েছেলের স্যার! মার্ডার হয়ে গেছে।
কে থাকে বাড়িতে?
ওর মা থাকত, স্যার। আর থাকত যুধো নামে একটা লোক। সে হাজতে।
অপর একজন বলল, যুধোটাকে জামিনে ছেড়ে দিয়েছে। ভোরবেলা দেখলুম, রিকশো করে আসছে। পুলিশ হাড় ভেঙে দিয়েছে। খোঁড়াচ্ছে।
সবাই হাসতে লাগল। কর্নেল বুঝলেন, বস্তিবাসীদেরও কড়া নীতিবোধ আছে। এবং টিনি ছিল চক্ষুশূল। কর্নেল বললেন, ড্রেনটা বাড়িটার ধারে। একটা। প্রবলেম। যাই হোক, দেখি বাড়ির লোকেরা কী বলে।
একজন বলল, টিনির মা তো দুপুরে পাড়-ছেড়ে কোথায় চলে গেল স্যার! কোন মুখে আর এখানে থাকবে? যুবধা আছে।
টিনির মা চলে গেছেন? কর্নেল একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, তা হলে আপনাদের ওই যুদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
আপনি যান স্যার! ও বাড়িতে আমরা কেউ যাই না। আর যুধোর কথা বলছেন? ও শালা এক ঢ্যামনা স্যার। টিনিকে তো খারাপ রাস্তা সে-ই দেখিয়েছিল।
আরেকজন বলল, হমলোগ জানতা স্যার। যুদ্ধে বহত খারাপ আদমি। টিনিকো রোজ এক বারমে লেকে যাতা শালালোগ। টিনি নাচতি উঁহাপর! খারাব ছোঁকরি থি।
কর্নেল ড্রেন পরীক্ষার ছলে চোখে বাইনোকুলার রেখে এগিয়ে পিছিয়ে একটা ভঙ্গি করলেন। ক্যামেরায় শাটার টিপেও ছবি তোলার ভান করলেন। সবাই ভোলা ড্রেনের যাচ্ছেতাই নিন্দা শুরু করল। তাদের এবার বড় আশা, ড্রেনটার সংস্কার হবে।
এবার কর্নেল টিনিদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। পাশের ঘর খুলে একটা ভীত মুখ উঁকি দিল। রোগা, তোবড়ানো গাল, ঢ্যাঙা একটা লোক। ভিড়টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঘৃণার ছাপ।
কর্নেল বললেন, আপনি এ বাড়িতে থাকেন?
যুধিষ্ঠির তাঁর অমায়িক কণ্ঠস্বরে একটু আশ্বস্ত হলো। বলল, আপনি কে, স্যার?
আমি সি এম ডি এ থেকে আসছি। এই ড্রেনটা…..
যুধিষ্ঠির বেরিয়ে নমস্কার করে বলল, ড্রেনটা খুব নোংরা স্যার! ওটা ঢাকা। দিলে ভাল হয়।
তাকে পুলিশ পীড়ন করেছে বোঝা যাচ্ছিল। কর্নেলের আফসোস হচ্ছিল, অরিজিৎকে একটু বলে দিলে ভাল হতো। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে মনে হয়, সে তত কিছু খারাপ লোক নয়। কর্নেল বললেন, আপনি কি অসুস্থ?
যুধিষ্ঠির করুণ হাসল। না, স্যার। গরিবের কপাল। অসুস্থ করে দিল। ভগবান আছেন, এর বিচার করবেন। খামোকা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর…….
পুলিশ? সে কী! কেন?
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি টের পেয়ে যুধিষ্ঠির চোখ মুছে বলল, দয়া করে যদি ভেতরে আসেন স্যার, সব বলছি। আপনি আমাকে কাইন্ডলি একটু হেল্প করুন স্যার। আমি গরিব লোক টুকিটাকি কাজকর্ম করি। মেদিনীপুরে আমার ফ্যামিলি। তাদের আনলে বুড়ো বাবা-মাকে কে দেখবে? অতগুলো লোকের তো জায়গা হবে না এই ছোট্ট ঘরে। আসুন স্যার দয়া করে।
ঘরটা ছোট্ট। নেহাতই ঘর। পলেস্তারাখসা দেয়াল। কালিঝুলিতে ভর্তি। একটা খাঁটিয়ায় বিছানা। ঘরেই কুকার জ্বেলে রাঁধা হয়। সামান্য তৈজস। দেয়ালে কয়েকটা দেবদেবীর ক্যালেন্ডার। একটা তাকে সবই বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানের মিস্ত্রির নানারকম হাতিয়ার। একটা চটের থলেয় ভর্তি।
কর্নেলকে সে খাঁটিয়ার পাশে একটা ফোল্ডিং চেয়ার পেতে দিল বসতে। কর্নেল বললেন, পুলিশে ধরল কেন আপনাকে?
যুধিষ্ঠির যা বলল, তার সারমর্ম হলো…..
টিনির বাবা মধুবাবু ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল। যুধিষ্ঠিরের। হঠাৎ স্ট্রোকে মধুবাবু মারা যান। ব্যবসা কে দেখবে? দোকানে উঠে যায়। যুধিষ্ঠির এসে টিনিদের মাথার ওপর দাঁড়ায়। এই যে বাড়িটা টিকে আছে। তা যুধিষ্ঠিরের জোরে। টিনির মা ন্যালাভোলা মেয়ে। কত মারোয়াড়ি এসে টাকার লোভ দেখাত। টিনির মা বাড়ি বেচে দিতে এক পা ছিলেন। এ পাড়ায় থাকার ইচ্ছে ছিল না তার। না থাকারই কথা। যুধিষ্ঠিরও কি থাকতে চায়? যত মস্তান-চোর-ডাকাতের মহল্লা। তো, বাড়ি বেচলে সেই টাকায় ভাল এরিয়ায় মাটিটুকু মাত্র কেনা যাবে। বাড়ি আর উঠবে না। যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িবেচা ঠেকিয়েছিল।
এবার টিনির কথা।
টিনি স্কুল ফাঁইনালে পরপর দুবার ফেল করল। তবে গানের গলাটা ছিল। ভাল। এ পাড়ার ক্লাবে ফাংশন হলে নাচ-গাইত। সেউ সূত্রে পাশের পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হলো। ছেলেটাকে যুধিষ্ঠিরের ভাল মনে হতো। এখন বুঝতে পেরেছে, ভাল ছেলে ছিল না। সেই টিনিকে বারে গাইতে নিয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরকে টিনির মা অনুরোধ করেন, রোজ যেন কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে। যুধিষ্ঠির সামান্য টাকা পেত এজন্য। তারপর যুধিষ্ঠিরের খটকা লাগে। মাঝে মাঝে টিনির কাছে এক সায়েব লোক আসে কেন?
কর্নেল জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির বলল, শক্ত চেহারার গুফো লোক। টিনিকে জিগ্যেস করলে বলত, অন্য একটা বারের মালিক। সেখান গাইলে বেশি টাকা পাবে। তা টিনি যাচ্ছে না কেন? টিনি বলেছিল, তা হলে হারামজাদা যোশেফ তাকে খুন করবে।
কে যোশেফ?
যে বারে টিনি গাইতে যায়, তার মালিকের লোক। দত্যিদানোর মতো চেহারা। অ্যাংলো সায়েব। এদিকে দিশি সেই সায়েব লোক সম্পর্কে টিনির কাছে যুধিষ্ঠির বেশি কথা জানতে চাইলে টিনি খেপে যেত। বলত, তোমার ও নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার? তবে টিনির মুখে তার নাম শুনেছিল একদিন যুধিষ্ঠির। ড্যা……ড্যা……ড্যাং সায়েব না কী নাম।
ড্যানি?
আজ্ঞে স্যার! ড্যানি।
বেশ। তারপর?
সেই ছেলেটা স্যার রোজ রাত্তিরে টিনিকে নিয়ে আসার সময় একটা কবরখানার গেটে অপেক্ষা করত। টিনি বলত, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আসছি। বলে দুজনে কবরখানায় ঢুকত। যুধিষ্ঠিরের নাকের ডগা কুঁচকে গেল ঘেন্নায়।
ছেলেটার নাম কী?
সুব্রত, স্যার। লম্পট! লম্পটের ধাড়ি হারামজাদা!
কবরখানায় তো কেয়ারটেকার আছে। সে নিষেধ করত না?
গোমেশসায়েব? সে-ও তো টিনির কাছে আসত মাঝে মাঝে। যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলল ফের, কী একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। খামোকা পুলিশ আমাকে……
এসব কথা কি পুলিশকে বলেছেন?
সব বলেছি। বলব না কেন? যা জানি, সব বলে দিয়েছি।
কর্নেল গুম হয়ে গেলেন। অরিজিৎ তাকে এসব তথ্য গোপন করল কেন? তার সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা কষতে চায়? একটু ক্ষুব্ধ হলেন কর্নেল। এমনটি আরও একটা কেসে করেছিল। শেষে বলেছিল, দুষ্টুমি। বৃদ্ধ ঘুঘুমশাইয়ের সঙ্গে মগজের লড়াই করতে একটু সাধ জাগে। কর্নেল হেসে ফেললেন।
হাসলেন কেন স্যার?
পুলিশের কাণ্ড ভেবে।
পুলিশ স্যার মাথামোটা। খালি ডাণ্ডা চেনে। খামোকা আমাকে… যুধিষ্ঠির আবার চোখ মুছল।
টিনি খুন হয়েছে শুনলুম?
হয়েছে। হতোই। যুধিষ্ঠির ক্ষুব্ধভাবে বলল। আসল কথাটা বলে দিই স্যার! পুলিশকে বলিনি! বললে আরও ঠ্যাঙানি দিত আমাকে। ভাবত আমিও এর সঙ্গে আছি। বলে ফিসফিস করল, গোমেশসায়েব, ড্যানিসায়েব, সুব্রত আর টিনি কবরখানায় পাথর চুরির কারবার করত স্যার। ড্যানিসায়েবের বারটার নেই। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ড্যানিসায়েব কবরখানায় গোমেশসায়েবের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল এক রাত্রে। সুব্রত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। টিনি তার সঙ্গে কবরখানায় ঢুকল। আমি কী আর করি, গেলুম গোমেশ সায়েবের সঙ্গে গল্প করতে। গিয়ে দেখি ঘরের ভেতর ড্যানি আর গোমেশ। চুপিচপি ২৯ পাথরের দরাদরি হচ্ছে। দামী পাথর স্যার!
যুধিষ্ঠির কথাটি বলেই ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। ফের বলল, পুলিশ ধরুত না ড্যানিসায়েবকে। সাধ্যি আছে? বড়লোকের সব দোষ টাকার জোরে মাস।
খামোকা গরিবের ওপর অত্যাচার ভগবান এ কি সইবেন?
বলে সে করজোড়ে ঠাকুরের উদ্দেশে নমো করল।
টিনির মা চলে গেলেন কেন?
যুধিষ্ঠির বলল, ড্যানিসায়েব এসে নিয়ে গেছে। ভাল ফ্ল্যাট দিয়েছে। টিনির মা বলল, যুধোদা, তুমি বাড়িতে থেকে পাহারা দেবে। বাড়ি বেচে দেব। তোমাকে টাকা দেব, ভেবো না। স্যার, আর একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল ড্যানিসায়েব। টেম্পোগাড়ি স্যার! জিনিসপত্র নিয়ে গেল টিনির মা।
কর্নেল উঠে পড়লেন। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে একবার মনে হলো, সত্যি কথা বলছে, আমার মনে হলো, মিথ্যা বলছে। লোকটি নিরীহ এবং সরল, নাকি গভীর জলের মাছ? দামী পাথর নিয়ে দরাদরি করছিলেন গোমেশ! গোমেশকে তা হলে ড্যানি মারবে কেন?
সেদিন রাতে কর্নেল আবার চার্লস গ্রিয়ার্সনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী খুঁটিয়ে পড়ছেন, রাত দশটা পনের বাজে। টেলিফোন বাজল। অভ্যাসমতো ফোন তুলে সাড়া দিলেন।
মহিলাকণ্ঠে কথা ভেসে এল, টু নাইন সিক্স থ্রি নাইন ফাঁইভ?
ইয়া, ম্যাডাম।
প্লিজ হোল্ড অন! আ ট্রাঙ্ক কল ফ্রম ডালটনগঞ্জ।
কর্নেল জোরে সাড়া দিলেন। জয়ন্ত নাকি? হ্যালো ডার্লিং! হঠাৎ অমৃতসর ছেড়ে…
আমি সুব্রত চৌধুরি।
হোয়াট?
সুব্রত, কর্নেল! ডালটনগঞ্জ থেকে বলছি। একটা কথা…।
সুব্রত, তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
আমার কিছু কথা আছে। ফোনে বলা যাবে না। আপনি বেতলা ফরেস্টের ওখানে কোয়েল নদীর ধারে আসুন। একা আসবেন। জঙ্গল জায়গা। পুলিশ আনলে আমি গা ঢাকা দেব। মদনরাজার কেল্লার পুবে জঙ্গলের ঢালে। একা। পরশু বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা অব্দি অপেক্ষা করব।
এত ভয় কেন, সুব্রত?
কারণ আছে। আসুন। বলব। আপনাকে জানি বলেই……
হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
লাইন কেটে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর রিং হলো না। কর্নেল উত্তজনায় দাড়িতে আঙুলে চিরুনি টানতে শুরু করলেন। আশ্চর্য ছেলে তো সুব্রত! অত দূরে তাঁকে ডাকল কেন?
কিন্তু ডেকেছে যখন, তখন যেতেই হবে। কর্নেল আপন মনে একটু হাসলেন। যাবার আগে অবশ্য একটু মার্কেটিং করতে হবে। কিছু কেনাকাটা করে কিছু উপহার নিয়ে যাবেন। রাঁচি হয়ে যাওয়াই ভাল। রাঁচিতে তাঁর বন্ধু আছেন মেজর তারাপদ ভৌমিক। তার জিপ পাওয়া যাবে। হাওড়া-হাতিয়া এক্সপ্রেস রাত সাড়ে আটটায়। রাঁচি পৌঁছুবে সকাল নটা নাগাদ। মেজর ভৌমিক না থাকলে ওখানে বেতলা যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
বেতলা রিজার্ভ ফরেস্টের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হলেন কর্নেল। ক্রমশ উত্তেজনা থিতিয়ে স্মৃতির মাধুর্য ফিরে এল। ডিসেম্বরের কুয়াশা-ঢাকা ভোরে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে ভ্রমণ। জলাশয়ে বাষ্পের মতো কুয়াশার উত্থান, বড় মায়াময়। ওখানে একটা সিঙ্কোনা-ফার্ম আছে। বাঁ দিকের জঙ্গলে একটা হায়েনা দেখেছিলেন। হায়েনার চোখের বিস্ময় মনে পড়ে যায়। সে-ও কি কর্নেলকে দেখে ক্রিসমাসের সান্তা ক্লস ভেবেছিল? মদনরাজার কেল্লার ভেতর মসজিদ। সেখানে দাঁড়িয়ে হাতিদের ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
এই অক্টোবরে জঙ্গল ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে।……
সকালে শূন্যোদ্যান থেকে নেমে আসার পর ডেভিড প্যাটার্সনের আবির্ভাব ঘটল। খুব উত্তেজিত চেহারা। হাঁফাচ্ছেন। কর্নেল বললেন, কী হয়েছে মিঃ ডেভিড? এনিথিং রং?
সার্টেনলি রং, কর্নেল!
হোয়াটস দ্যাট?
ডেভিড কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, ওই কবরখানায় দিনদুপুরেই শয়তানের চেলার উপদ্রব। গির্জার ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ। পণ্টারজিস্ট! পল্টারজিস্ট!
জার্মান শব্দ পল্টারজিস্টের অর্থ, শব্দকারী ভূত–যে সবকিছু ফেলে দেয়। ভাঙচুর করে। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, কখন?
এইমাত্র। আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বারবারাকে যেন বলবেন না। শুনলে আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপে অস্থির করবে। কর্নেল!
ওক্কে। কিন্তু মিঃ ডেভিড, আপনি উঁকি মেরে দেখলেন না কেন?
দেখেছি। কিছু নেই।
ভেতরে ঢুকেছিলেন গির্জার?
ঢুকতে যাচ্ছি, কী একটা পড়ল গালে। অদৃশ্য হাতের থাপ্পড়।
চামচিকে বা পাখি নয় তো?
গালটা দেখুন! ডেভিড বাঁ গাল এগিয়ে দিলেন। এখনও জ্বালা করছে।
কর্নেল পরীক্ষা করে দেখে কিছু পেলেন না। তবে গালটা লাল হয়ে আছে বটে। বললেন, সাহস, মিঃ ডেভিড, সাহস! সাহস এবং বাইবেলের আবৃত্তি। আপনি এখনই ফিরে যান। বাইবেল হাতে জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢুকুন।
আপনি আমার সঙ্গে চলুন, প্লিজ! আমি একজন আন্ডারটেকার ছিলাম। কত মৃতদেহ গাড়িতে বয়ে নিয়ে গেছি। সৎকারের ব্যবস্থা করেছি। কখনও কোন আত্মা আমাকে জ্বালাতন করেনি। এ হচ্ছে শয়তানের চেলাদের কাজ। আপনি চলুন।
আমি গিয়ে কী করব?
আমি কেয়ারটেকার। গির্জার ভেতর চার্চ সোসাইটির কিছু জিনিসপত্র আছে। সেগুলোর জন্য আমি দায়ী। ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার কী অবস্থা হয়েছে। প্লি-জ!
অগত্যা কর্নেল উঠলেন।
ট্যাক্সি কবরখানায় দাঁড় করিয়ে রেখে কর্নেল বললেন, আমিই ভাড়া দের, মিঃ ডেভিড। সামান্য ব্যাপার। এই ট্যাক্সিতেই ফিরতে চাই।
.
গির্জার পুবের সেই জানলাটা ভেতর থেকে যথারীতি আটকানো। খড়খডি ফাঁক করে ছিটকিনি তুলে দিলেন কর্নেল। ডেভিড অবাক হয়ে বললেন, স্ট্রেইঞ্জ! আমি জানালা খোলা দেখেছিলাম।
ভেতরে গেলেন কর্নেল। ডেভিডও সাহস করে ঢুকলেন।
কর্নেলের প্রথমেই চোখ গেল বেদির পাশের সেই তাকে। বাইবেলগুলি নিচে পড়ে আছ। পুরনো বই। পাতা ছিঁড়ে মলাট ভেঙে পড়ে আছে। ডেভিড মাই গড বলে আর্তনাদ করে পবিত্র গ্রন্থগুলি গোছাতে ব্যস্ত হলেন।
সেই সময় কর্নেল দেখলেন ইংরেজি বাইবেলের কিং জেমস ভার্সনের ১৯১০ সালের সংস্করণটি দুভাগ হয়ে পড়ে আছে। তলায় একটুকরো কাগজ উঁকি দিচ্ছে। কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে বাইবেলটি তুলে রাখলেন।
ডেভিড বললেন, কী? কী? স্যাটানিক ভার্সেস অথবা সদুপদেশ! কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। কিংবা ধাঁধা।
দেখি, দেখি!
বাইরে গিয়ে দেখাচ্ছি। কেতাবগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে রাখুন। গির্জাঘরের ভেতর ধুলোয় একই লোকের জুতোর অনেকগুলো ছাপ। আগের ছাপে ধুলো পড়ে মিলিয়ে গেছে। তার ওপর নতুন ছাপ।
বাইরে গিয়ে দেবদারুতলায় দাঁড়িয়ে কর্নেল কাগজটা বের করলেন। ডেভিড সাগ্রহে র কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিলেন।
Vulgarity is a very common thing today.
Ultimatium to then who commit nuisances!
Learn what is good and what is bad.
Turn your face towards the Heaven.
Understand what I say to thee.
Remember what I said to thee.
Even the foolish person will know the Truth.
Satan is always following you, oh man!
Never submit your self to him.
Eden Garden from where you had fallen;
Say, I must go back to that place!
Turn your face towards the Heaven.
ডেভিড একটু হেসে বললেন, কোনও ভক্ত খ্রীস্টানের উপদেশ। স্যাটানিক ভার্সেস নয়।
ঠিক তাই। বলে কর্নেল কাগজটা পকেটে ঢোকালেন। তারপর বাইনোকুলারে পুবের দিকটা লক্ষ্য করতে থাকলেন।
এইমাত্র কে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে রেলইয়ার্ডের দিকে নামল। শুধু মাথার পেছনটা এক পলকের জন্য দেখা গেল।
কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে, সেখানে পৌঁছুলেন। সঙ্গে ডেভিড। তিনি ভীষণ উত্তেজিত। বারবার জিজ্ঞেস করছে, হোয়াটস দ্যাট? হোয়াটস দ্যাট? কর্নেল জবাব দিচ্ছেন না। আজ রেলইয়ার্ডে অসংখ্য মালগাড়ি। তেমন কাউকে দেখা গেল না।
বাড়ি ফিরে কর্নেল কাগজটা নিয়ে বসলেন। হুঁ, ডেভিড ঠিকই বলেছেন, কোনো ভক্ত খ্রীস্টানের সদুপদেশ। কোনও পাদ্রিসায়েবেরই হয়তো।
কিন্তু কাগজটা পুরনো হলেও লেখাটা খুব পুরনো মনে হচ্ছে না। হস্তাক্ষর আঁকাবাঁকা দ্রুত লেখা। ডটপেনে লেখা। বাংলা করলে মোটামুটি এই মানে দাঁড়ায় :
অশ্লীলতা আজকাল খুব সাধারণ ব্যাপার।
যারা অপকর্ম করে, তাদের প্রতি চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি,
মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।
বুঝে নাও কী তোমায় বলছি।
স্মরণ করো কী তোমায় বলেছি।
এমন কি, বোকারাও সত্যকে জানতে পারবে।
হে মানুষ, শয়তান সবসময় তোমার পিছনে।
তার কাছে কদাপি বশ মেনো না।
নন্দনকানন থেকে তুমি পড়েছিলে।
বলো, আমি আবার ফিরে যাবোই সেখানে।
মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।
হুঁ, ধর্মভীরু কোনও মানুষের উপদেশ। গোমেশের কি? তা হলে বলতে হবে, এটা তার নিজের প্রতি হুশিয়ারি। খ্রীস্টানদের মধ্যে পাপ বিষয়ে স্বীকারোক্তি বা কনফেসন-প্রথা চালু। এটা কনফেসন হওয়াই সম্ভব।
কর্নেল কাগজটা ড্রয়ারে রেখে রেলের টাইম-টেবিলের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। আজ রাতেই রাঁচি রওনা হওয়া দরকার। নির্জন অরণ্যে কোয়েল নদীর তীরে কী কথা বলবে ফেরারি আসামী সুব্রত চৌধুরি, জানার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
আবার ভাবলেন, কোনও ফাঁদ নয় তো? শরীর একটু শিউরে উঠল। উত্তেজনাটা থিতু হয়ে এলে ঠিক করলেন, আগে ট্রাংক কলে রাঁচিতে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে সব কথা খোলাখুলি আলোচনা করে নেওয়া দরকার।