Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রেনবো অর্কিড

মার্চে রূপগঞ্জ থেকে আনা রেনবো অর্কিডের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কর্নেল। এপ্রিলে চমৎকার রামধনুরঙা ফুল ফুটিয়েছিল। এখন বেমরশুমে ঝিমোচ্ছে। তবে বর্ষার পর এখন জাঁকালো চেহারা। যেন ধাড়ি মুরগি ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুতে সেই বসন্তকাল।

কিন্তু প্রকৃতির কেন এত সব আয়োজন? একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে নিষ্ঠুর হত্যা। সুন্দর অসুন্দরকে নিয়ে ডানহাত বামহাতে লোফালুফি। অদ্ভুত বৈপরীত্যের ছন্দের বাঁধা এই বিশ্বের সব কিছু। ডান হাতে দান, বাম হাতে কেড়ে নেওয়া– রবীন্দ্রনাথ চরম প্রশ্নটি ভুলে গেছেন, কিন্তু কেন?

সব চেয়ে অদ্ভুত লাগে, প্রকৃতি নির্বিকার। তার কাছে রক্ত এবং অশ্রুর কোনও পৃথক মূল্য নেই। প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দার্শনিকরা যথার্থ সত্যটিকে জেনেছিলেন। যিনি অন্নপূর্ণা, জীব পালন করেন স্নেহে, তিনিই কালী, ধ্বংস করে ফেলেন সব কিছু, সঙ্গে হিংস্র সহচরীরা। পায়ের তলায় জড়বৎ শিব। আবার সেই দার্শনিকরাই অন্যদিক থেকে সত্যকে জেনে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর স্রষ্টা পালক সংহারকর্তা এই তিন প্রতীক এঁকে রেখে গেছেন।

নিরীশ্বরবাদী মার্ক্স এঙ্গেলসও প্রকৃতিতে একই দ্বন্দ্ব দেখেছিলেন। থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস-তত্ত্বকে বাজিয়ে দেখলে একই ব্যাপার! জড়ে যেমন দ্বন্দ্বের ধারা, চৈতন্যেও তাই। দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্বহীন অবস্থা অকল্পনীয়। প্রকৃতি দ্বদ্বাকীর্ণ।

বাবামশাই!

কর্নেল ক্রুদ্ধ হয়ে ঘুরেই হেসে ফেললেন। মূর্তিমান রসভঙ্গ ষষ্ঠীচরণ!

আজ্ঞে, আর কেউ হলে ডিসটাব করি? নালবাজারের নাহিড়িসায়েবের ফোং!

অগত্যা নিচে ড্রয়িং রুমে যেতে হলো কর্নেলকে। মোটে সাতটা বাজে। আকাশ আজও নির্মেঘ। দেবদারুশীর্ষে শকুনগুলি দেখার ইচ্ছে ছিল। হঠাৎ তত্ত্বচিন্তার উপদ্রব।

বলো, ডার্লিং! সুব্রত……

রাতারাতি উধাও। বাড়িতে বলে গেছে, পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে যাচ্ছে-দার্জিলিঙ গোখা মুভমেন্ট কভারজে। কিন্তু……

পত্রিকার কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তাকে কোথাও পাঠানো হয়নি!

কী আশ্চর্য! জানেনই যদি, তাহলে কেন……

ওকে ডার্লিং! মুখ বন্ধ করলুম। গো অন, প্লিজ!

গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি কাল গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেই এই কাণ্ডটি বাধিয়েছেন?

অরিজিৎ, আমার ভয় হচ্ছে……

না! কোথাও কোন বডি পড়ার খবর নেই। পুলিশ নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভ। সব রাজ্যের পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। জাল ঘেঁকে মাছটি ভোলা হবে। ভাববেন না। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি, ছেলেটা যদি চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত না থাকবে এবং নির্দোষ হবে, তা হলে সে গা ঢাকা দিল কেন? কেন সে সব কথা বলল না আমাদের, যখন তারই প্রেমিকা খুন হয়েছে? সুব্রত সব জানে। জেনেও এমন আচরণ কেন? নিশ্চয় সে…….

আতঙ্ক, ডার্লিং! কবিসাহিত্যিকদের মন কোমল। স্পর্শকাতর। তাই তারা কলমে যতই খুনখারাবি করুক, বাস্তবে খুনখারাবি দেখলে দিশেহারা হয়ে পড়ে!

বোগাস! সুব্রত টিনির রক্তাক্ত বডি ঘেঁটেছিল। ভুলে যাচ্ছেন, তার ছেঁড়া জুতোয় রক্তের ছাপ। কাগজে রক্তের ছাপ।

মরিয়া হয়ে পড়েছিল সে। আমার ধারণা টিনির পার্সে পাওয়া এই লেখাটির মধ্যে আসলে কোনো সূত্র লুকোনো আছে। সুব্রত চেয়েছিল খুনী ধরা পড়ুক। কিন্তু খুনীকে তার প্রচণ্ড ভয়। এর দুটো কারণ থাকা সম্ভব। খুনী খুব শক্তিমান প্রভাবশালী লোক এবং সুব্রত তাকে চেনে।

লেখার জেরক্স কপি তো দিয়েছি। আপনি কিছু সূত্র পেলেন না এখনও?

না!

অথচ আপনার বিশ্বাস ওতেই খুনীকে চেনার সূত্র আছে!

ইউ আর ড্যাম রাইট! ওকে, ছাড়ি। পরে যোগাযোগ করব।

কর্নেল ফোন রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে টাকে হাত বুলিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বইয়ের র‍্যাক থেকে দা গ্রেট ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার্স বইটি বের করলেন। প্রকাণ্ড বই।

কর্নেল চার্লস গ্রিয়ার্সনের সংক্ষিপ্ত একটি জীবনী এবং কর্মকাণ্ড আছে ওতে। তিনি প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী রিচার্ড বার্টনের সঙ্গে করাচি সেনানিবাসে ছিলেন। পরে বার্টন মুসলিম ছদ্মবেশে মক্কায় যান। বই লেখেন দা পিলগ্রিমেজ টু মেক্কা। পরে আরব্য উপন্যাস অনুবাদ করেন। আরও পরে যান আফ্রিকায় নীলনদের উৎস সন্ধানে। আর গ্রিয়ার্সন সিপাহি বিদ্রোহের সময় পালিয়ে যান পারস্যে। সেজন্য তার শাস্তি হয়েছিল ছমাস জেল। পারস্য থেকে তাকে ধরে আনা হয়েছিল। জেলে আত্মজীবনী লেখেন। সেটির খোঁজ মেলেনি। তবে একটি নোটবই পাওয়া গিয়েছিল। তাতে এই কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে আছে এবং তার ওপরে আছে মধ্যযুগের পহলভি ফার্সিতে লেখা কিছু কথা! এই বইয়ে পুরো পাতাটির ব্লক করে ছাপানো হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদের বাংলা করলে দাঁড়ায় :

আমি, দিব্যজ্ঞানী, আর্দশের। অহু মাজদা আমাকে রক্ষা করতে এসেছিলেন।

পারস্যে পহলভি আমল খ্রীঃ পূর্ব ২৫০ থেকে খ্রীস্টাব্দ ১৯১ পর্যন্ত। তখনকার অগ্নিপূজক জোরাস্তার ধর্মাবলম্বী সম্রাট হ.-এর। তার লেখা আবিষ্কার করেছিলেন প্রিয়ার্সন?

নিশ্চয় তাহ। যে কালো দামী পাথরের ফল গ্রিয়ার্সনের কবরের মাথায় ছিল, সেটি কি সেই ফলক? তার উল্টো পিঠেই কি পহলভি লেখাটি ছিল?

তা হলে তো……

কর্নেল নড়ে উঠলেন। কেউ কি জানতে পেরেছিল এই গোপন সত্যটি? পাথরের নিজস্ব দামের চেয়ে সেটির ঐতিহাসিক দাম বহু লক্ষ টাকা বেশি। লক্ষ টাকা কেন, আজকাল কোনও ধনকুবের বিদেশী সেটি কোটি ডলার দামেও সংগ্রহ করতে চাইবেন। সম্রাট আর্দশেরের ফলকের দাম কম নয়।

কর্নেল বইটি র‍্যাকে রেখে হাঁকলেন, যষ্ঠী! আজ আটটায় ব্রেকফাস্ট খাব। বেরুব।…….

.

ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির পুলিশরক্ষীরা কর্নেলের কার্ড দেখেই সেলাম ঠুকে বসল। এস. আই. সঙ্গে আসতে চাইলেন বিনীতভাবে, যদি কোনও সাহায্য দরকার হয় কর্নেল সায়েবের! কর্নেল সহাস্যে বললেন, না, না। আমি জাস্ট পাখি দেখতে আর দুষ্টু প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

পুলিশমহলে কিংবদন্তির নায়ক বৃদ্ধ ঘুঘুর সঙ্গলাভে বঞ্চিত পুলিশ অফিসার একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বৈকি।

কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখতে দেখতে পুবের পাঁচিলের কাছে ক্রিস্টিনার কবরে এলেন। এখানেই টিনি খুন হয়েছিল। তার ডাইনে হাত সাত-আট দূরে গ্রিয়ার্সনের কবর। শূন্য ফলকের চৌকো স্থানটি চোখে খচখচ করে বিধছে। ক্রসটিও উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। তবে অনেক আগে। তার চিহ্ন স্পষ্ট।

শূন্য ফলকের নিচের ঘাসের দিকে ঝুঁকে বসলেন কর্নেল। আতস কাচ বের করে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে ঘাসের পাতা বেরুনো ঊটার খাঁজ, তলার মাটি পরীক্ষা করতে থাকলেন। বৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন থাকলে ধুয়ে যাওয়ার কথা। তবে লাইম কংক্রিটের গুঁড়ো প্রচুর। গুড়োগুলো ডাইনে এগিয়ে গেছে। হাত দশেক তফাতে আবার একই গুড়ো ঘাসের তলায়।

যে উপড়েছিল, সে গুঁড়ো ঝেড়ে সাফ করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল ফলকটা।

গতিপথ লক্ষ্য করে বুঝলেন ভাঙা গির্জাঘর। কিন্তু এর পর গুডোর ছড়াছড়ি সর্বত্র। আর পার্থক্য করা অসম্ভব। গির্জা ঘরের পেছনে একটা দরজা আছে। কপাট উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। সংকীর্ণ করিডর দিয়ে পুবের জানালার কাছে গেলেন কর্নেল। সেকেলে লম্বা খড়খড়ি দেওয়া জানালা। ভাঙাচোরা অবস্থা। হাত গলিয়ে মরচেধরা ছিটকিনি খুলে আস্তে টানলেন। একটা পাট খুলে গেল অদ্ভুত শব্দে। অশরীরী আত্মার ক্রুব্ধ কণ্ঠস্বর মনে হলো। প্রার্থনা গৃহের প্রায়শ্চিত্ত প্রার্থনায় রত কোনও আত্মা কি বিরক্ত হলো? কিন্তু তিনটে গরাদ নেই!

কর্নেল নিঃশব্দে উঠে ভেতরে ঢুকলেন। টর্চের আলো জ্বালার দরকার নেই। খোলা জানালা দিয়ে ছোট্ট গির্জার ভেতর সবটাই দেখা যাচ্ছে। একটা চেয়ারও অবশিষ্ট নেই। একপাশে আবর্জনার গাদার মতো চেয়ারগুলোর টুকরো। কতকাল এই গির্জায় কেউ প্রার্থনা করতে ঢোকেনি। মেঝেয় ধুলো। দেয়ালে ঝুলকালি। ফাটা ছাদ দিয়ে আলো ঢুকছে। লম্বা রোদের ফালি তলোয়ারের মতো বিঁধছে গির্জার বুকে।

কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে মেঝেয় টর্চের আলো ফেললেন। জুতোর ছাপ ইতস্তত পরিষ্কার। পুলিশের জুতোর চাপও থাকা স্বাভাবিক। পুলিশ গির্জার ভেতরও সূত্র খুঁজেছে। কিন্তু একটা ছাপ অন্যরকম। জুতোটার হিল পুলিশের নয়।

তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন সুরকিগুড়ো–এই গির্জার সুরকিগুঁড়োর সঙ্গে মেলে না। যাজকের বেদির বাঁ দিকে একটা তাক। তাতে কয়েকখণ্ড জীর্ণ বাইবেল বই। লাতিন, ইংরেজি, হিব্রুও।

একটা বই সরাতেই পেছনে সুরকিগুঁডোর একটা রেখা আবিষ্কৃত হলো।

হুঁ, ফলকটা প্রথমে এখানে এনে রাখা হয়েছিল। তারপর?

জানলায় হঠাৎ সেই পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের মাথা দেখা গেল। মুখে হাসি। বললেন, যামু স্যার? তখন কইলাম আমারে সঙ্গে লন। হ্যাঃ হাঃ হ্যাঁ। স্যার, কিছু ক্লু পাইলেন নাকি?

কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, নাঃ। ব্লু নয়, বাইবেলগুলো দেখছিলাম।

জানলা দেখি ভাঙা! খাইছে!

হ্যাঁ মরচেয় খেয়েছে আর কী!

স্যার! বেরিয়ে আসেন! কিছু বলা যায় না। ছাদের অবস্থা দ্যাখছেন না?

কর্নেল ছাদের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে হন্তদন্ত হয়ে জানালা দিয়ে বেরুলেন। অফিসার অবাক হয়ে তারিফ করলেন, এই বয়সেও এমন জিমন্যাস্টিক করা যায়, তার কল্পনায় আসে না। তবে কর্নেল সায়েবের সব কথাই তার জানা। শুধু চোখের দেখাটা দেখতে বাকি ছিল। তিনি এও স্বীকার করলেন, এই পড়ো পড়ো গির্জার ভেতর প্রাণ গেলেও তিনি ঢুকতে রাজি হতেন না।

কর্নেল শুধরে দিলেন, প্রাণ নয়, চাকরি বলুন।

অফিসার বেজায় হেসে বললেন, হ, ঠিক কইছেন স্যার, চাকুরী।

কর্নেল তাকে একটি চুরুট দিলে তিনি খুব খুশি হলেন। চুরুটটি জ্বেলে দিয়ে এবং নিজেরটি ধরিয়ে কর্নেল হনহন করে পুবে রেলইয়ার্ডের দিকে চলতে থাকলেন।

ভাঙা দেয়াল ডিঙিয়ে জংলা জমি পেরিয়ে রেলইয়ার্ডের সেই পরিত্যক্ত ওয়াগনটির ভেতরে ঢুকলেন কর্নেল। একবার ঘুরে কবরখানার ভাঙা দেয়ালের ওখানে সেই পুলিশ অফিসারের মাথাটি দেখতে পেলেন। দুটি গুলি গুলি চোখও।

ওয়াগনের ভেতর সাফ করা অংশে বৃষ্টি চুঁইয়ে পড়ে কাদাটে ভাব। ঘাস ও ঝোঁপের ভেতরটা প্রজাপতি ধরা জালের স্টিক দিয়ে সরিয়েই চমকে উঠলেন। একফালি রোদ্দুর পড়েছে এখানে। সেখানে কালচে রক্তের কয়েকটা ছোপ।

জেভিয়ারের বডি এখানে এনে খুনী বা খুনীরা অপেক্ষা করছিল সম্ভবত। তারপর বডিটা নিয়ে গিয়ে রেললাইনে ফেলে দেয়।

কর্নেল বেরিয়ে এলেন ওয়াগন থেকে। বেরিয়েই পড়লেন দুজন সেন্ট্রির মুখে। তারা বন্দুক তাক করে দৌড়ে এল। কর্নেল হাসতে হাসতে আঙুল তুলে কবরখানার ভাঙা দেয়ালের ওখানে পুলিশ অফিসারকে দেখালেন। তিনি দেয়াল গলিয়ে দৌড়ে এলেন চেঁচাতে চেঁচাতে ক্যা করতা হ্যাঁয়? কা করা। হ্যাঁয়?।

সেন্ট্রিদের একজন বলল, ত আপ সি আই ডি কা আদমি হ্যাঁয়? যাইয়ে সাব। ইহাঁপর হমলোগোনে ভি ডিউটি করতা হায়।

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বললেন, চলুন। ওদেরও তো ডিউটি করতে হবে।

অফিসার চাপাস্বরে বললেন, কিছু ক্লু পাইলেন স্যার?

নাঃ। একটা প্রজাপতি ঢুকেছিল। ধরতে পারলুম না। দুষ্টু প্রজাপতি!

ওই নামে একটা ফিল্ম দেখেছিলাম, স্যার! হ্যাঃ, হ্যাঃ হ্যাঃ!

বাড়ি ফিরে গিয়েই ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে ফোন করলেন কর্নেল। ওই উদ্ভট ব্যাপারটার অর্থ হয় না, ডার্লিং! কর্নেলের প্রথম বাক্যটি এই।

অরিজিৎ, কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে ওটার ভাব ছিল, উদ্ভট! কী উদ্ভট?

কবরখানায় পুলিশ মোতায়েন।

অরিজিৎ হাসছিলেন। বাপ! এমন উদ্ভট কথা নিজেই বলে আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছেন। এনিওয়ে, কবরখানায় পুলিশ মোতায়েন কেন আপনার চক্ষুশূল হলো? বাকি পাথর টাথরগুলো।…

অরিজিৎ! পুলিশ হঠাও!

কী আশ্চর্য! পুলিশ আমরা নিজেদের ইচ্ছেয় রাখিনি। কবরখানার মালিক প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ সোসাইটির কর্তৃপক্ষের অনুরোধ। তা ছাড়া, চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলক কবরখানাতে কোথাও লুকিয়ে রাখাও সম্ভব, আমার ডিপার্টের এক্সপার্ট ওপিনিয়ন। ডোন্ট ফরগেট কর্নেল, রয় কোম্পানিতে হানা দিয়েও তা খুঁজে পাইনি আমরা। কাজেই…….

পুলিশ হঠাও, ডার্লিং!

কী মুশকিল!

হ্যাঁ, মুশকিল। খুনী অর্থাৎ ফলকচোরের পক্ষে মুশকিল।

অরিজিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার হঠাৎ তাদের ওপর দয়া উথলে ওঠার কারণ?।

কর্নেল একটু হাসলেন। বেচারা এত কাণ্ড করেছে, তাকে একটু দয়া করা। অন্যায় নয়।

ওঃ! শুধু হেঁয়ালি! ডি সি ডি ডি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসলেন। ব্যাপারটা বলুন তো?

পুলিশ হঠাও!

বেশ। হঠালুম। তারপর?

আশেপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ রাখো। দ্যাট উইল বি এনাফ। বরং আমাদের হালদারমশাইকে কাজে লাগাও।

হালদারমশাই? মাই গুডনেস! সেই কে কে হালদার?

ইয়া। হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির হালদারমশাই। ডোন্ট ফরগেট, উনি তোমাদের পুলিশ ডিপার্টের রিটায়ার্ড অফিসার।

আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেল? হালদারমশাইকে এতদিন এত কাণ্ডের পরও চিনতে পারেননি? ভদ্রলোক সর্বক্ষেত্রে হিতে বিপরীত বাধিয়ে ছাড়েন। এমন একটা কেসে…..

না, ডার্লিং! ছদ্মবেশ ধরতে ওঁর জুড়ি নেই। তোমার গোয়েন্দারা ছদ্মবেশ ধরতে রাজি হবেন না। ধরো, যদি বলি, পাগলা সেজে কবরখানার আনাচে কানাচে ঘুরুন? ময়লা ন্যাকড়াকানিপরা পাগল, বিড়বিড় করে বকতে হবে ইত্যাদি।

হাঃ হাঃ হাঃ। কোনও মানে হয়? এ কি রহস্য উপন্যাস, না বাস্তব ঘটনা? ওসব রহস্য উপন্যাসে মানায়, বস্!

ঠিক আছে। আমি হালদারমশাইয়ের দায়িত্ব নিচ্ছি। তুমি পুলিশ হঠাও। চার্চ সোসাইটিকে বলো, তোমাদের পক্ষে আর একখানে দিনের পর দিন পুলিশ মোতায়েন সম্ভব নয়। এমনিতেই পুলিশ ফোর্সের অবস্থা টাইট। যাই হোক, প্লিজ ডু দ্যাট ডার্লিং!

একটু পরে অরিজিৎ লাহিড়ীর নৈরাশ্যমিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল ফোনে, ওকে। ঠিক আছে।……

কর্নেল আবার বেরুলেন।

.

গণেশ অ্যাভিনিউতে রাস্তা থেকে একটা তেতলা বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে সাইনবোর্ডটি দেখা যায় : হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। কৃতান্তকুমার হালদার পুলিশের সার্কেল অফিসার ছিলেন গ্রামাঞ্চলে। রিটায়ার করে এই লাইন ধরেছেন। ঢ্যাঙা মানুষ। প্রচণ্ড নস্যির নেশা। কর্নেলকে খুব খাতির করেন। ইতিপূর্বে কর্নেলের সঙ্গে বেশ কিছু কেসে সহযোগিতা করেছেন, যেচে পড়েও করেছেন। বিভ্রাটও বাধিয়েছেন। তবে লোকটি ঝুঁকি নিতে পারেন। ছদ্মবেশ ধরতে যেমন উৎসাহী, তেমনি দক্ষ।

ইদানীং কেস পাচ্ছেন না বলে মনমরা হয়েই ছিলেন। ছাদে অ্যাসবেস্টস চাপানো ছোট্ট ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে ঠ্যাং তুলে বলে ছিলেন। নাকে নস্যির ছোপ। কর্নেলের সাড়া পেয়েই চোখ খুললেন এবং প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, স্বপ্ন! স্বপ্ন!

স্বপ্ন নয় হালদারমশাই! রহস্য! টাটকা রহস্য! কবরখানায় দুদুটো খুন। দামী কবরের ফলক চুরি।

হালদারমশাই রহস্যের গন্ধ পেলেই শক্ত হয়ে যান। চোখ দুটো গোল করে। বললেন, হঃ!

হঃ কী? কাগজে পড়েননি?

পড়ছি! পড়ছি! হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। তারপর ঝটপট নস্যি নিয়ে ফাঁচ শব্দে স্বকীয়তাসম্পন্ন হাসিটি হাসলেন। কর্নেলস্যার! কী আশ্চর্য! আমি কি সত্যি স্বপ্ন দেখছি, না কর্নেলস্যারকে দেখছি গরিবালয়ে!কাইন্ডলি টেক ইওর সিট কর্নেলস্যার!

কর্নেল বুঝলেন, এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন প্রাইভেট গোয়েন্দা {ক কে হালদার। ড্রয়ার থেকে খাম বের করে ফেললেন। খামে লেখা সিমেট্রি মিস্ট্রি। ভেতরে খবরের কাগজের কাটিং। কর্নেল এ-ও বুঝলেন, এই কেসটিতে তাঁর নাক গলানোর খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও কোনও পক্ষ থেকে এঁকে ডাকা হয়নি। তবু প্রতীক্ষায় ছিলেন।

কর্নেল তাকে কাগজের খবরের বাড়তি কিছু বললেন না। বলে পরে অত্যুৎসাহী গোয়েন্দা ভদ্রলোক স্বভাবমতো কী বিভ্রাট বাধিয়ে বসবেন, বলা যায় না। তারপর বললেন, হালদারমশাই! আপনাকে পাগল সেজে ওই কবরখানার। আনাচে-কানাচে থাকতে হবে। অন্তত দুটো দিন। আমার ধারণা, গ্রিয়াসনের কবরের ফলক এখনও কবরখানায় কোথাও লুকানো আছে। কারণ গোমেশ জেভিয়ারের মৃত্যুর পরই পুলিশ পাহারা বসেছে। আজ থেকে পুলিশ সরে যাচ্ছে। এখন আপনিই প্রহরী। বুঝলেন কি কিছু?

হ। বুঝছি! বলে উত্তেজিত হালদারমশাই আরেক টিপ নস্যি নিলেন। উত্তেজনার ব্যাপার ঘটলেই তিনি পূর্ববঙ্গীয় মাতৃভাষায় কথা বলেন। বরাবর এই অভ্যাস।

কী বুঝলেন?

আমারে পাগল সাজতে হইব।

নজর রাখতে হবে…….

হাত তুলে হালদারমশাই বললেন, এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!

সশস্ত্র থাকতে হবে। আপনার রিভলবার…..

এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!

হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বেরিয়ে কর্নেল তার লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটির গতি সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউমুখী করলেন। জ্যাম ছিল পাতালরেলের কারণে। ম্যাডান স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছুতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল।

রয় অ্যান্ড কোম্পানির দোকান তাঁর চেনা। বিশাল হলঘরের ভেতর সেকেলে আসবাবপত্রের স্তূপ। একদা এগুলি সায়েসুবো রাজা-মহারাজা রইস লোকেদের গৃহশোভা ছিল, বোঝা যায়। চোখ জ্বলে যায় সৌন্দর্যের দীপ্তিতে, যদিও কালের ধূসর পাঞ্জার ছাপ পড়েছে গায়ে। কর্নেল ঘুরে ঘুরে জিনিসগুলি দেখছিলেন, ক্রেতার ভঙ্গি। কোন জিনিস কবে নিলাম হবে, তা স্লিপে লিখে আটকানো আছে।

শেষপ্রান্তে কোনার দিকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন কর্নেল। একটি ডিমালো আয়না। বেলজিয়াম কাঁচে তৈরি। অবিকল গোমেশের ঘরে দেখা সেই আয়নাটার মতো।

একই গড়নের আয়না অনেক থাকতে পারে। নিঃসংশয় হওয়ার জন্য ঝুঁকে গেলেন একটু। কোম্পানির লোক ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, উসকি নিলাম পরশু রোজ হোগি, সাব! খাস বিলয়তকি চিজ।

জেরা দেখনা চাহিয়ে ভাই!

দেখিয়ে। লোকটি দাঁত বের করল।

পেছনে কিছু লেখা ছিল সুন্দর হস্তাক্ষরে। ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে। দুটি ডবলিউ হরফের অস্পষ্ট চাপ। উইথ বেস্ট উইশেস? এর পর অস্পষ্ট একটা হরফের মাথা। জি। গোমেশে জি আছে। গোমেশ শব্দটি বিকৃত উচ্চারণ। শব্দটি পর্তুগিজ গোম্‌জ্‌। সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে গোম। কাল্লু গোমসায়েব গোমসায়েব বলেছিল। সে মেমসায়েবদের মুখে সঠিক উচ্চারণ শুনে থাকবে। হিব্রু জামে থেকে গ্রিক লাতিনে জেমস। পর্তুগিজ ভাষায় তাই বিকৃত গোমেজ।

হুঁ, সেই আয়নাটাই বটে। গোমেশ জেভিয়ারকে কেউ উপহার দিয়েছিল, সম্ভবত তার বিয়েতে। সেটা এত দিনে তিনি বেচে দিয়েছিলেন কেন? অস্ট্রেলিয়ায় ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু এই আয়না বেচে কি তত টাকা পাওয়া যায়?

তা হলে কি গোমেশই গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলকটা……

কর্নেল কয়েক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘুরে আস্তে পা বাড়ালেন। রয়সায়েবের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছায় এখানে আসা। তার অফিস দোতলায়। হলঘরের ভেতর থেকে কাঠের সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে দোতলায় উঠেছে। আসবাবপত্রের ভেতর দিয়ে এগিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মুনলাইট বারের সিনহার সঙ্গে। সিনহা বলে উঠলেন, হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!

একটা ফার্নিচার কেনার তালে আছি, মিঃ সিনহা!

আমিও। হাসিখুশি সিনহা বললেন। ভাবছি বারটা টোট্যালি রিমডেলিং করব। একটু পুরনো বনেদি চেহারা দেব। ভিক্টোরিয়ান শেপ। তাই রয়সায়েবের কাছে এসেছিলুম যদি তেমন কিছু পাই।

পেতে পারেন।

আশা দিলেন রয়সায়েব। ওক্কে চলি। বাই!

সিনহা হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। কর্নেল কার্পেট বিছানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন। রিসেপশনিস্ট মহিলা মিষ্টি গলায় বললেন, ক্যান আই হেল্প যু, স্যার?

কর্নেল বাংলায় বললেন, রয়সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

হ্যাভ য়ু এনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, স্যার? হি ইজ নাউ ভেরি বিজি।

কর্নেল একটু হাসলেন। কিন্তু আমার যে দেখা করা জরুরি। বলে তিনি এম রয় ফলক আঁটা ঘরটির দিকে পা বাড়ালেন। রিসেপশনিস্ট মহিলা বিব্রতমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কিন্তু দরজা ঠেলতেই দেখলেন টেবিলের ওধারে রয়সায়েব এবং এধারে তার ভাগ্নে ড্যানি ঘোষ বসে আছেন। ড্যানি ঘোষ ঘুরে কর্নেলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। ঘুষি পাকিয়ে বললেন, ইউ ওল্ড হ্যাগার্ড! গেট আউট! আউট!

রয়সায়েব বললেন, ঔ ড্যানি! ডোন্ট শাউট লাইক দ্যাট!

ডোঞ্চু নো হিম? হি ইজ আ ডিটেকটিভ!

সো হোয়াট? ড্যানি, ইউ গো টু ইওর চেম্বার প্লিজ!

ড্যানি ঘোষ চোখের আগুনে ঝলসে দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল বসে বললেন, আমি ডিটেকটিভ নই, মিঃ রয়। নিছক প্রকৃতিবিদ। পাখি প্রজাপতি দেখা আমার হবি। তাই আপনার ভাগ্নের চন্দননগরের ডেরার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন জানি না, উনি আমাকে ডিটেকটিভ ভাবলেন! ভাববার কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?

রয়সায়েব পাইপ ধরিয়ে বললেন, আমি ব্যস্ত। বলুন।

ইস্টার্ন সাপ-আর্বান সিমেট্রির কেয়ারটেকার গোমেশ জেভিয়রের আয়নাটা আপনারা কিনেছেন দেখলুম। গোমেশ আমাকে ওটা বেচতে চেয়েছিলেন। তো…….

তা হলে ড্যানি ইজ রাউট। আপনি ডিটেকটিভ।

আমি গোয়েন্দাগিরি করতে আসিনি মিঃ রয়। ওই আয়নাটা আমি কিনতে চাই।

নিলামের দিন কিনবেন।

প্লিজ মিঃ রয়। নিলামে দরাদরি আমার পোয় না বড্ড। বাজে লোকেদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার……

রয়সায়েব হাসলেন। আই নো, আই নো! দা নেম ইজ ওয়েলনোন। এবার সব স্পষ্ট হলো। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেলসায়েবের কথা কে না জানে? ওয়েল, আসল কথাটা বলুন। আমার বাড়ি, অফিস, গোডাউন সার্চের পর পুলিশ আপনাকে পাঠিয়েছে, আমি জানি। বলুন!

গোমেশসায়েবের আয়নাটা। আমি কিনতে চাই।

আই অ্যাম আ ম্যান অব প্রিন্সি! ট্রাই ইওর লাক অ্যাট দা অকশন।

কর্নেল উঠলেন। রয়সায়েব গম্ভীর। কাগজপত্রে মন দিলেন। কর্নেল বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, রিসেপশনিস্ট মহিলা করুণমুখে বসে আছেন। ড্যানি ঘোষ বকে দিয়েছে কি?

হলঘরে নেমে আবার আয়নাটির উদ্দেশে চললেন কর্নেল। আয়নাটি নেই। ওপর থেকে ফোনে নিচে রয়সায়েব জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা সরিয়ে ফেলো। কর্নেল হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। রয়সায়েব ভেবেছেন কি আয়নার মধ্যে গ্রিয়ার্সনের ফলকের কোনও সূত্র লিখে রেখে গেছেন গোমেশ এবং তিনি তা ধরে ফেলবেন? অদ্ভুত মানসিকতা! তবে গোমেশ ধুর্ত লোক ছিলেন নিঃসন্দেহে। তাকে হত্যা করার মোটিভ আবছা টের পাওয়া যাচ্ছে।…….

.

দুপুরে খাওয়ার পর সুব্রতর লেখা সেই টিনি বৃত্তান্তের জেরক্স কপিটি নিয়ে বসে ছিলেন কর্নেল। বারবার পড়ছিলেন।

ভুল পা ফেলে দৈবাৎ সেখানে পৌঁছুলেই সর্বনাশ।…মেয়েটি সেই ভুল। করে বসল।

সুব্রতর এই সব কথায় কি কোনও সূত্র লুকিয়ে আছে? কী ভুল করেছিল টিনি? তার একটা স্বপ্ন ছিল। আধুনিক জীবনযাত্রার স্বপ্ন। বস্তি এলাকা ছেড়ে কোনও ফ্ল্যাটবাড়িতে উঠে যাওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জন্যই কি টিনি এমন কিছু করে ফেলেছিল, যাতে মৃত্যুর সামনে গিয়ে পড়ল সে?

ঘটনার দিন সুব্রত গোমেশকে একটা চিঠি দেয়। চিঠিতে সুব্রত টিনিকে ক্রিস্টিনার কবরে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিল। তারপর সে খুন হয়ে যায়। সুব্রত পরে এসে তার ব্লাউসের ভেতর পার্সে এই লেখাটা গুঁজে রেখে যায়।

কিন্তু খুনের পর এমন হস্তাক্ষরে এমন গুছিয়ে কিছু লেখা যায় না। এটা টিনির মৃত্যুর আগেই লেখা। এখানেই সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুব্রত জানত টিনি খুন হবেই।

কী ভাবে জানতে পেরেছিল? পেরেছিল যদি, কেন বাধা দেয়নি তাকে কবরখানায় আসতে? টিনি কি তার নিষেধ শোনেনি? নাঃ, সুব্রতর চিঠিটা এই পয়েন্টটা নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সুব্রত তাকে কবরখানায় ডেকেছিল অন্যান্য দিনের মতো।

অথচ গোমেশ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। ছেঁড়া চিঠির টুকরো কর্নেল হাতিয়ে আনার পর তিনি উধাও হয়ে গেলেন চন্দননগরে। তারপর তাকে খুন করা হলো কবরখানার কোথাও।

গোমেশ টিনির বাড়ি গিয়েছিলেন, এও একটা পয়েন্ট।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি মুঠোয় চেপে দুলতে থাকলেন। দাঁতে চুরুট কামড়ানো।

বাবামশাই!

চোখ খুলে ষষ্ঠীকে দেখতে পেলেন। তার মুখে কাঁচুমাচু হাসি। কান চুলকোচ্ছে। কর্নেল বললেন, কী রে? কিছু বলবি?

ষষ্ঠী বলল, আজকাল আমার কেন যেন বড্ড ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে, বাবামশাই! মনে থাকছে না কিছু। নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব……

এসেছিল অরিজিৎ?

আজ্ঞে না। নোক পাইঠেছিলেন। এই খামখানা দিয়ে গেছে। আমি…

ভুইলে গেছিস, হতভাগা! কর্নেল হাসলেন। কৈ, দে!

ষষ্ঠী খামখানি দুহাতে দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ল। খামের মুখ ছিঁড়ে কর্নেল দুটো ভঁজ করা কাগজ বের করলেন। একটা অরিজিতের চিঠি। লেখা আছে : সুব্রতর অফিসের টেবিলে ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। সন্দেহজনক মনে হলো। বৃদ্ধ ঘুঘুমহাশয়ের প্রতি উপহার। ইতি–অল।

দ্বিতীয় কাগজটি নিউজপ্রিন্ট। ডটপেনে লেখা সুব্রতর একটি কবিতা। কবিতাও লিখত তা হলে! কিন্তু এ কী অদ্ভুত কবিতা!

॥ পতন ॥

চুপিসাড়ে এসেছে সে আলতো পা
বেড়াল ভূত কি পরী জানতো না।
অবশেষে আততায়ী হাতে ছুরি
কণ্ঠার হাড় কাটে ভাঙা চুড়ি
রেলগাড়ি ঝমাঝম বাঃ রে বাঃ
কড়কড়ে নোটগুলি মূল্য তা
নিয়ে ঘোরে দিব্যি তো ফালতো না।
হায় রে সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা
সে ছাড়া কেউ না আর কেউ তো না।

বারকতক পড়ার পর কবিতা থেকে একটি ছবি ফুটে উঠল। চুপিসাড়ে আসা একজন আততায়ী, একটা হত্যা, হাতের চুড়ি ভেঙে পড়া, রেলগাড়ির শব্দ, কিছু টাকা……। রেলগাড়ির শব্দ হয়েছিল হত্যার সময়, তাই টিনির আর্তনাদ শোনা যায়নি কি? সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা…। কিন্তু ক্রিস্টিনা তো মৃত। তার কবরের ওপর একটি হত্যা ঘটল। তবু সাক্ষী কেন সে? মৃতেরা চিরমূক। তা হলে সাক্ষী শব্দটা কেন? নিছক আলঙ্কারিক প্রয়োগ?

কর্নেল কাগজ খামে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন। তারপর পোশাক বদলে বেরুলেন। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার, ক্যামেরা, হাতে প্রজাপতিধরা নেটের স্টিকছড়ির মতো। তার চেনা মূর্তিটি।

গাড়ি নিয়েই বেরুলেন।

ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির গেটের সামনে এক নোংরা পোশাকপরা কালিঝুলি-মাখা পাগল দাঁড়িয়ে কাকে শাসাচ্ছে। বিড়বিড় করছে। কর্নেলের গাড়ি দেখেই সে ঘুরে ফাঁচ করে হাসল।

হালদারমশাই।

কর্নেল আস্তে বললেন, খুব মানিয়েছে।

গোয়েন্দা হালদারমশাই ফের অনবদ্য ফাঁচ করে বললেন, সন্দেহজনৰ তেমন কিছু দেখলুম না কর্নেলস্যার। তবে নতুন কেয়ারটেকার অ্যাপয়েন্ট করেছে। হালায় ঢুকতে দিচ্ছে না।

গাড়িটার দিকে লক্ষ্য রাখুন আপাতত।

বলে কর্নেল গেটে গেলেন। চার্চ সোসাইটি নতুন কেয়ারটেকার পাঠিয়েছেন। তাকে দেখেই কর্নেল, চেঁচিয়ে উঠলেন, হাই ডেভিড! আ সারপ্রাইজ ইনডিড! আ কেয়ারটেকার ফ্রম অ্যান আন্ডারটেকার!

ডেভিড প্যাটাসন খুব হেসে বললেন, আ টেকার ওনলি টেকস সামথিং গুড অর ব্যাড। বাট আ টেকার লাইক মি ওনলি টেক দা ডেডস!

ভালো। তবে এটা পদোন্নতি, না পদাবনতি সেটাই প্রশ্ন।

ডেভিড বললেন, আমার ক্ষেত্রে পদাবনতি। তবে পুষিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী বারবারার পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে আন্ডারটেকার।

আশা করি, বারবারা বেচারিকে ছেড়ে এই ভুতুড়ে কবরখানায় রাত কাটাবেন না?

ডেভিড হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, সোসাইটি পীড়াপীড়ি করছে, নিয়ম হচ্ছে নিয়ম। তবে আমি এই শয়তানের দরবার পাহারা দেব রাতবিরেতে? কখনও না। রাত নটাতেই কেটে পড়ব। আসব ফের সকাল সাতটায়।

কথা বলতে বলতে দুজনে কবরখানার ভেতর হাঁটছিলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখছিলেন। হঠাৎ পথ ছেড়ে কবরের জঙ্গুলে জায়গায় ঢুকে গেলেন। ডেভিড হুঁশিয়ারি দিলেন, সাবধান কর্নেল! সাপ থাকতে পারে। কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না।

উত্তর দিকে ঘুরে ঝোপঝাড় ঠেলে পুবে ক্রিস্টিনার কবরের কাছে গেলেন। দাঁড়িয়ে চারপাশে বাইনোকুলোরে খুঁটিয়ে দৃষ্টিপাত করলেন। দূরে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে বিরক্তির ছাপ। ভুরু কুঁচকে গেছে। গেটের ফাঁক গলিয়ে পাগল উঁকি দিচ্ছিল। কর্নেলস্যারের গোয়েন্দাগিরি লক্ষ্য করার জন্য পাগলের বড় কৌতূহল বরাবর। কিন্তু ডেভিড তেড়ে গেলেন তার দিকে।

ক্রিস্টিনার কবরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। সুব্রতর কবিতাটি সত্যিই কোনও সংকেতবহ কি না দেখা দরকার। আগের বার আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। এবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান শুরু করলেন।

একটু পরে কবরের ফাটলে ভাঙাচুড়ির কয়েকটি টুকরো আবিষ্কার করলেন কর্নেল।

কবরের দক্ষিণের অংশে নিচে ঘাসের ভেতরও দুটো টুকরো। মড মেয়ে হয়ে উঠেছিল টিনি। তারা আজকাল রঙবেরঙের চুড়ি পরে হাতে। প্লাস্টিকের চুড়িই।

চুড়ির টুকরো এগিয়ে গেছে গ্রিয়ার্সনের কবরের দিকে। গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছেও তিনটি টুকরো। কেন?

ক্রিস্টিনা এবং গ্রিয়ার্সনের কবরের মধ্যে একটা ঝোঁপের আড়াল। টিনি গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছে গিয়েছিল এবং সেখানেই কেউ তার হাত ধরে টেনে এনেছিল। এত জোরে চেপে ধরেছিল যে মুটমুট করে চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল?

সেটাই কি টিনির ভুল পথে পা বাড়ানো। ক্রিস্টিনার কবরের কাছে ফিরলেন কর্নেল। কবরটা আবার খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। উত্তর-পূর্ব কোণে ফাটলটা প্রায় সিকি ইঞ্চি। নিচের মাটিও ফেটে গেছে। ঘাস সরাতেই একটা টাটকা খোঁড়া গর্ত আবিষ্কৃত হলো।

গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা ছুঁচো। ছুঁচোর গর্ত। প্রজাপতি ধরা স্টিক দিয়ে গর্তের ভেতর খোঁচা দিলে আরও ছুঁচো বেরুল। কিচকিচ শব্দে গাল দিতে দিতে পালাল। কিন্তু ছুঁচোর গর্ত খুঁড়ল কে? কী ছিল ওর ভেতর? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কিছু লুকোনো ছিল। কেউ তুলে নিয়ে। গেছে……

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *