কাকচরিত্র : 02 – মিস শ্যামলী ও একটি ফুল
আমার গাড়িটা ফিয়াট। স্টিয়ারিং আমারই হাতে। কিন্তু কোথায় যেতে হবে, কর্নেল বলছেন না। দু’একবার প্রশ্ন করেও কোন স্পষ্ট নির্দেশ পাইনি। কর্নেল চোখ বুজে ঝিমোতে ঝিমোতে শুধু বলছেন–চলো তো!
গাড়ি পার্ক স্ট্রিটে ঢুকিয়েছি। ছুটির দিন রোববার। বেলা প্রায় নটা–এখনো অবশ্য ভো বাজেনি। কিন্তু এ এক বিদঘুটে অবস্থায় পড়া গেল দেখছি। অন্ধের মতো চলেছি যেন। চৌরঙ্গির মোড়ে একটা খালি লরি ঢনঢ়ন করে আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে এবং বেআইনিভাবে ওভারটেক করে আচমকা সামনে দাঁড়িয়ে গেল–রোড সিগনাল লাল। ঢু মারতে গিয়ে সামলে নিল আমার ক্রিমরঙা ফিয়াট। আমি লরির শূন্য খোলটার উদ্দেশে খুব চ্যাঁচামেচি করলুম। কর্নেল আচমকা ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতে চোখ খুলেছিলেন বন্ধ করলেন ফের। আলো সবুজ হলে অসভ্য লরিটাকে ডিঙিয়ে যাবার জন্যে বাঁদিকে মোড় নিলাম। পিছনের গাড়িগুলোর খিস্তি এবার আমাকে শুনতে হল। চৌরঙ্গি ধরে দক্ষিণে যাবার সময়, কর্নেল যেন নিজের মনে বললেন–ঠিকই যাচ্ছি।
বাঁদিকে থিয়েটার রোডে ঢুকলুম। কর্নেলের কোন সাড়া নেই। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো! আমি যেদিকে খুশি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতলব করলুম–তার ফলে দেখা যাক, কর্নেল বাধ্য হয়ে গন্তব্যস্থান বলে বসবেন নাকি।
খানিক এগিয়ে বাঁদিকে ছোট রাস্তায়, আবার বাঁদিকে ছোট রাস্তায়–তারপর বোঁও করে ঘুরে ক্যামাক স্ট্রিট, তারপর সামনের ছোটরাস্তায়। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। কর্নেল এবার নির্ঘাৎ জব্দ হচ্ছেন।
কিন্তু একজায়গায় হঠাৎ কর্নেল বলে উঠলেন–রোখো, রোখো!
গাড়ি দাঁড় করালুম। পুরো সাহেবপাড়া এটা। উঁচুতলার সাহেবসুবোরা বিশাল সব বাড়িতে এখানে বাস করেন। পাঁচিল, গেট, প্রাঙ্গণ, গাছপালা, সুইমিং পুল, ভাস্কর্য ইত্যাদি প্রতিটি বাড়ির বৈশিষ্ট্য। বাঁদিকে একটা গেট। কর্নেল দেখলাম দরজা খুলে নামলেন। তারপর আমার দিকে না ঘুরে গেটে চলে গেলেন। উর্দিপরা দারোয়ানকে কী বললেন। দারোয়ান সেলাম করে গেটটা পুরো খুলে দিল। কর্নেল আমার দিকে হাত নেড়ে ভিতরে গাড়ি নিয়ে যেতে ইশারা করলেন।
গাড়িতে আর চাপলেন না। পাশে পাশে এগিয়ে গেলেন উনি! লনের একপাশে তিনটে দেশী-বিদেশী সুদৃশ্য গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে। লনে গাড়ি রেখে বেরিয়ে এলুম। সামনে দেখি একটা স্কাইক্র্যাপার বাড়ি। চারপাশের বনেদী ঐতিহ্যের ওপর আধুনিক স্থাপত্যের টানা একফালি হাসি যেন–হাসিটা অতি উদ্ধত। কর্নেল আমাকে মুখ তুলে বাড়ির উচ্চতার দিকে তাকাতে দেখে বললেন–একালের সুর সুন্দরীদের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা, ডার্লিং!
কর্নেল স্ত্রী-পুরুষ নির্বিচারে ডার্লিং সম্বোধন করেন। আমি বললুম–কিন্তু কর্নেল, আমরা কার কাছে যাচ্ছি? কোন সুরসুন্দরীর কাছেই কি?
পরক্ষণে আমার ধাঁধা ঘুচে গেল আচমকা। আরে তাই তো!
এখানেই তো সেই ক্যাবারে নর্তকী মিস শ্যামলী থাকে! একটা সিনেমামাসিকে শ্যামলী সম্পর্কে কিছু মুখরোচক রেপোর্টাজ পড়েছিলাম বটে! অনেক অবান্তর বিষয় স্মৃতিতে আমরা দুয়ে কারণে রেখে দিই। মধ্য কলকাতায় এই ‘ইন্দ্রপুরী’ এবং মিস শ্যামলীর সেখানে অবস্থান অকারণে স্মৃতিতে স্পষ্ট ছিল।
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্তরঙ্গভাবে একটা হাত ধরলেন। দুজনে এগিয়ে গেলুম।
উদ্দেশ্যহীনভাবে অন্ধের মতো গাড়ি চালিয়ে শ্যামলীর ফ্ল্যাটে পৌঁছনো নিতান্তই আকস্মিক ঘটনা ছাড়া কী বলব? এখানে আসবার মতলব মোটেও আমার ছিল না। লিফটের সামনে একটু দাঁড়িয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তোমার উন্নতি হবে, জয়ন্ত। ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছ।
হেসে বললুম-মোটেও তা নয় কর্নেল। আমি নির্দিষ্ট কোথাও আপনাকে পৌঁছে দেবার জন্যে আসছিলুম না। এটা নেহাৎ আকস্মিক ঘটনা। আপনি গন্তব্যস্থানের কথা একবারও বললেন না। ফলে, উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলুম।
না ডার্লিং, মোটেও তা নয়। আমি ‘চলো তো’ বলার সঙ্গে তুমি ঠিক করে নিয়েছিলে এমন একটা গন্তব্যস্থান–যা আমাদের কেসের পক্ষে খুবই জরুরি।
বারে! আমি বলছি তো, উদ্দেশ্যহীনভাবে এসে পড়েছি দৈবাৎ!
-না, না…বলে কর্নেল লিফটের চাবি টিপলেন। লিফটা ওপরতলায় ছিল। জয়ন্ত, এই হচ্ছে মানুষের মনের রহস্য। যখনই তোমাকে ‘চলো তো’ বললুম এবং নির্দিষ্ট জায়গার নাম করলুম না, অমনি তোমার অবচেতনায় লক্ষ্যের কাটা মিস শ্যামলীর দিকেই প্রথমে নির্দিষ্ট হল। এই কেসে শ্যামলীকেই তুমি আগাগোড়া ‘ভাইটাল’ ধরে নিয়ে বসে আছো। সচেতন মনে যেহেতু যুক্তির দৌরাত্ম্য এবং কড়াকড়ি বেশি, তোমার অবচেতন মনের উদ্দেশ্যটা লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করল। তার ফলে যেটুকু পথ এলোমেলো গাড়ি চালিয়েছ–সবটাই তোমার সচেতন মনকে ভাওতা দিতে। নিজের সঙ্গে মানুষ এই ভাবেই লুকোচুরি খেলে।
গুম হয়ে রইলুম। লিফট এসে গেল। অটোমেটিক লিফট। ভিতরে ঢুকে কর্নেল ছনম্বর বোতাম টিপতেই দরজা বন্ধ হল এবং উঠতে শুরু করল। সাততলায় লিফট থেকে নামলুম আমরা। শ্যামলীর ফ্ল্যাট নম্বর আমি জানি না। শুধু জানি এই বাড়িতে সে থাকে।
কর্নেল, আশ্চর্য, ফ্ল্যাট নম্বর জানেন দেখছি! তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় বোতাম টিপলেন। কোন নামফলক নেই। না থাকা স্বাভাবিক।
ভিতরে পিয়ানোর বাজনার মতো মিঠে টুং টাং শব্দ হল। আমি চাপা গলায় বললুম-আপনি ওকে চেনেন নাকি?
কর্নেল জবাব দিলেন না। দরজার ফুটোর কাছে একটা চোখ আবছা ফুটে উঠল। তারপর খুলে গেল। স্বপ্নে শিউরে উঠলুম যেন। সেই শ্যামলী! যার বিলোল নাভিতরঙ্গ দেখে আমার এক কবিবন্ধু তেত্রিশটা পদ্য লিখে ফেলেছে এবং পত্রিকায় ছাপিয়েও নিয়েছে। মধ্যরাতে চৌরঙ্গি এলাকার হোটেলের মঞ্চে রহস্যময় আলোয় পিছলে বেড়ানো অপার্থিব একটুকরো মাংস–যা যৌনতার পোষা অন্ধ গণ্ডারটা ছেড়ে দিয়ে পুরুষগুলোকে এফোঁড়-ওফোড় করে ফেলে, সেই মাংসের টুকরোটা এখন স্নিগ্ধ এবং পার্থিব দেখাল।
আর মিস শ্যামলী এখন গৃহস্থকন্যার মতো আটপৌরে বেশভূষায় এত সাধারণ যে শ্যামবাজারের শশীবাবুর মেয়ে বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কর্নেলকে দেখেই তার মুখ যেন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।আসুন, ভেতরে আসুন!
কর্নেলের পিছনে পিছনে অবাক হয়ে ঢুকলুম। ঘরের ভিতর ঐশ্বর্য আর রুচির ছাপ রয়েছে। প্রকাণ্ড ড্রয়িংরুম। ঠিক মাঝখানে সোফাসেট এবং মেঝেয় সুরম্য কার্পেটে গিটার, পাখোয়াজ ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। এদিকের দেওয়ালে কমপক্ষে ছ’ফুট-চারফুট আকারের একটা বিশাল পোর্ট্রেট। দেখেই চিনলুম–হিতেন সেন!
আমরা দুজনে শোফায় বসলাম। শ্যামলী মেঝেয় পা দুমড়ে গ্রাম্য তরুণীর মতো বসল। হাসিমুখে আমার দিকে কটাক্ষ করে বলল–এঁকে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন–উ! দেখা স্বাভাবিক। ও সর্বচর। জয়ন্ত চৌধুরী–দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। জয়ন্ত, শ্যামলীকে তোমার বিলক্ষণ চেনা আছে।
পরম্পর নমস্কার করলুম। শ্যামলী হাসতে হাসতে বলল–সর্বনাশ! রক্ষে করুন কর্নেল! খবরের কাগজে যথেষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো দারোয়ানকে বলে রেখেছি প্রেসের লোক জানতে পারলে যেন……
কথাটা অসমাপ্ত রেখে সে ফের আমার দিকে কটাক্ষ করল। কর্নেল বললেন না, না, ও আমার সঙ্গে এসেছে। তা ছাড়া তোমার ব্যাপারে ও আমার ডানহাত এখন। জয়ন্ত খুব বুদ্ধিমান ছেলে। খুব ইয়ে। তা, যাই হোক, শ্যামলী, শোন– যেজন্যে এলাম। কাল রাতে তুমি তো আমার ওখান থেকে চলে এলে। আমার ঘুম হল না আর। তোমাকে ফোন করলুম ঘণ্টাখানেক পরে–পৌঁছলে কি না জানতে। কিন্তু তোমার লাইনটা মনে হল ডেড। ভাবলুম, কলকাতার টেলিফোনের ব্যাপার!
সকালে ফোন করলুম–একই অবস্থা! তখন ভাবছিলুম, একবার যাবো নাকি। তুমিও রিং করছ না কথামতো। একটু উদ্বিগ্ন হলুম। সেই সময় জয়ন্ত এল। তখনি বেরিয়ে পড়লুম।
শ্যামলীর মুখটা গম্ভীর দেখাল।–কী জানি কী হয়েছে ফোনের। কাল রাত থেকে ডেড ছিল।
–গোটা বাড়ির লাইন ডেড ছিল নাকি গতরাতে?
না তো! আমারটা এক্সটেনশান লাইন। খালি আমারটা ডেড ছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।
–কোন ফ্ল্যাটেই কারো নিজস্ব ডিরেক্ট লাইন নেই?
–জানি না। আছে নিশ্চয়। আমাকেও ডিরেক্ট নিতে হবে দেখছি। প্রাইভেসি রাখা মুশকিল হচ্ছে।
–যাক গে। কাল রাত থেকে এখন অব্দি তোমার দেবার মতো খবর থাকলে বলো।
-তেমন কিছু তো…
–আজ সকালে কেউ আসেননি?
–এসেছিল। সে আমার প্রফেশানের ব্যাপারে।
–ওঁদের কেউ আসেনি?
নাঃ। আর কেউ আসেনি। এলেও আমি বলে দিতুম–না, সম্ভব নয়। উইল ইজ উইল। আমি আমার লিগাল রাইটের সীমানা এক পাও পেরোতে চাইনে।
–মিসেস সেন আমাকে রিং করেছিলেন আজ সাড়ে সাতটায়।
শ্যামলী চমকে উঠল।–মিসেস সেন! চেনেন নাকি আপনাকে!
— না। কেউ পরামর্শ দিয়ে থাকবে। তবে তুমি ভেবো না ডার্লিং, আমি সবসময় সত্যের পক্ষে।
শ্যামলী উদ্বিগ্ন মুখে বলল–আচ্ছা কর্নেল, সত্যি কি আমাকে এখন কিছুদিন সাবধানে থাকতে হবে? কোথাও ফাংশান করা যাবে না?
–মানুষের এই পৃথিবীটা খুব জটিল, শ্যামলী।
–কিন্তু অতসব কন্ট্রাক্ট রয়েছে। আমাকে তো তা মিট আপ করতেই হবে। তা না হলে পার্টিরা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসবে।
কর্নেল হাসলেন–তুমি এখন কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবতী মহিলা, মাই ডিয়ার গার্ল!
শ্যামলী চিন্তিতমুখে কী ভেবে তারপর ম্লান হেসে বলল কিন্তু আমি এখনও আত্মরক্ষার কোন ব্যবস্থাই করিনি। যে কেউ যখন খুশি এসে আমাকে মেরে রেখে যেতে পারে।
কর্নেল সশব্যস্তে বললেন, না। তোমাকে কেউ দৈহিক দিকে হামলা করবে–আমি মোটেও তা বলিনি শ্যামলী।
–তাহলে সাবধানে থাকার কথা বললেন কেন?
কর্নেল ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন-তুমি যথেষ্ট কোমল হৃদয় বিশিষ্ট মেয়ে। আমার ভয় সেখানেই। তোমাকে সহজে কেউ কনভিনস করতে পারে।
শ্যামলী আশ্বস্ত এবং আনন্দিত মুখে বলল–মোটেও না। আমি খুব-খু-উব ভীষণ কোল্ডব্লাডেড। আমার হৃদয়-টিদয় মোটেও নরম নয়। অনেক তেতো অভিজ্ঞতার মধ্যে আমি বড় হয়েছি কর্নেল, ভুলে যাবেন না। বললুম তো–উইল ইজ উইল।
–যাক্ গে, শোন। মিসেস সেন ফোন করে বলেছিলেন, তার কিছু কথা আছে আমার সঙ্গে। খুলে কিছু বলেন না। ঠিক দশটায় যাবার কথা দিয়েছি। যাচ্ছি। তার আগে তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে এলুম। এগুলো গতরাতে আমার মাথায় আসেনি।
–বেশ তো, বলুন।
–হিতেনবাবু ২৩শে মার্চ সকালে তোমাকে ফোন করে বিলাসপুর যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তুমি যাওনি। কারণ, ফোনে কোন অচেনা লোক তোমাকে শাসিয়েছিল যে গেলে বিপদ হবে। তাই না?
-হ্যাঁ। আপনাকে তো বলেছি…
–কিন্তু তুমি কি সেজন্যেই যাওনি? নাকি–কেউ না শাসালেও তুমি যেতে না?
শ্যামলী নাকের ডগা খুঁটে জবাব দিল–ঠিক বলেছেন। আমি যেতুম না।
-কেন?
আমার প্রথমত ভীষণ অবাক লেগেছিল। ওভাবে পাবলিকলি মিঃ সেন আমার সঙ্গে মেলামেশা করবেন–বিশেষ করে ওঁর স্ত্রীর সামনে, আত্মীয়স্বজনও থাকবেন– তাদের সামনে! এটা অস্বস্তির কারণ হত আমার পক্ষে।
কিন্তু মিঃ সেন তোমার সঙ্গে কখনও, মানে–কোনরকম অভব্য আচরণ করেননি!
না। তা করেননি। খুব দূরত্ব রেখেই মিশতেন। আমিও খুব সমীহ করে চলতুম। তাহলেও তো আমি আসলে একজন ক্যাবারে গার্ল।
–কেন যেতে বলছেন, জিজ্ঞেস করেছিলে?
–হ্যাঁ। বলেছিলুম–আমি কী করব ওখানে গিয়ে?
–উনি কী বলেছিলেন?
–খুলে কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন যে আমার পক্ষে ওখানে উপস্থিত থাকা জরুরি। কেন জরুরি তা জানতে চাইলেও বলেননি।
–হুম্! কিন্তু ওর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর ২৪শে মার্চ সকালে তুমি। বিলাসপুর চলে গিয়েছিলে। এবারেও অজানা কেউ ফোনে তোমাকে মিঃ সেনের দুর্ঘটনার খবর দিয়েছিল। যাই হোক, বিলাসপুর যাবার কারণ কী শ্যামলী? মিঃ সেনের দুর্ঘটনা না ছবির সুটিং?
বলেছি তো! যাওয়াটা আকস্মিক। সিনেমা পরিচালক অতীন্দ্র বসুর নতুন ছবিতে আমি একটা রোল করছি। উনি ওইদিন সকালে এসে হাজির। আউটডোর সুটিং-এ যেতে হবে এখুনি। আমি জানতুম না। বিলাসপুরেই ওর লোকেশান। হিরো পার্থকুমার অলরেডি চলে গেছে। তাই গিয়ে পড়লাম যখন, তখন এক ফাঁকে খোঁজ নিয়ে অতীন্দ্রবাবু আর আমি মিঃ সেনের বাগানবাড়িটা একবার ঘুরে এসেছিলুম। নিছক একটা কৌতূহল। আর ফুলটা তো তখনই কুড়িয়ে পাই!
–ফুলটা যেখানে পড়েছিল, তুমি শুনলে যে ডেডবডিটা ওখানেই ছিল। কেমন?
-হ্যাঁ। একটু কৌতূহলী হয়েছিলুম, ফুলটার বোঁটায় চুল জড়ানো দেখে। অতীন্দ্রবাবু ওটা রাখতে পরামর্শ দিলেন। ওঁর পরামর্শেই আপনার কাছে গিয়েছিলুম তাও বলেছি আপনাকে।
তখনও তুমি উইলের ব্যাপারটা জানতে না বলেছ!
বলেছি। জানলুম কলকাতায় ফিরে সন্ধ্যাবেলা। উকিল সুশান্তবাবু এলেন আমার এখানে। বললেন–সুখবর আছে। তারপর আমি তো হতভম্ব। তখন…
–শ্যামলী, মিসেস সেনের সঙ্গে তোমার আলাপ ছিলনাকি অ্যাটর্নি চলে যাবার পর সেই প্রথম এলেন?
–সেই প্রথম। এসে একচোট শাসালেন। তারপর লোভ দেখাতে লাগলেন। আপস করার কথা তুললেন। বললেন কতটা নগদ পেলে আমি আমার অংশ ছাড়তে রাজি ইত্যাদি।
নিশ্চয় তুমি ওঁকে ফুলের কথা বলোনি?
–মোটেও না। আমি আপনার কাছে যাবার জন্য ব্যস্ত।
–মিসেস সেনের মুখের আধখানা ঢাকা ছিল বলেছ।
-হা কালো তাঁতের শাড়ির ঘোমটা পরা ছিল। আমি তাতে অবাক হইনি। কারণ, মিঃ সেনই একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন যে ওঁর স্ত্রীর মুখে একপাশটা এক দুর্ঘটনায় পুড়ে যায়। তার ফলে সেদিকটা ঢেকে রাখেন সবসময়।
–তা হলে মিসেস সেনের মুখটাও ঢাকা ছিল?
–হ্যাঁ।
–একপাশের চুল নিশ্চয় দেখা যাচ্ছিল?
–অতটা লক্ষ্য করিনি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–পার্থবাবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের রেজিস্ট্রেশান তো পনেরই এপ্রিল হচ্ছে?
শ্যামলী মুখ নামিয়ে ঈষৎ রাঙা হয়ে জবাব দিল–হ্যাঁ।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, তুমি উদীয়মান ফিল্ম হিরো পার্থকুমারের নাম নিশ্চয় শুনেছ?
–অবশ্যই! খুব ভাল অভিনয় করছেন ভদ্রলোক।
–শ্যামলী! তোমাদের বিয়ের তারিখটা কবে ধার্য করা হয়েছিল?
–গত ফেব্রুয়ারি মাসে। বাইশ তারিখে। ফিরপোতে পার্টি হয়েছিল ছোটখাটো। মিঃ সেনও উপস্থিত ছিলেন তাতে। অ্যাটর্নি সুশান্ত মজুমদারও ছিলেন।
মিঃ সেন নিশ্চয় খুশি হয়েছিলেন? তিনি তো বরাবর তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
–হ্যাঁ।
–শ্যামলী, আমরা উঠি তাহলে। সময়মতো দেখা হবে কেমন?
আমরা উঠে পড়লুম। বাইরে লিফট অব্দি এগিয়ে দিতে এল শ্যামলী। কর্নেল, লিফটে পা রেখে ফের বললেন–ইয়ে, সাবধানে থেকো। না না! তোমাকে কেউ খুনজখম করতে পারে, বলছি না। তাতে কারো লাভ হবে না। তোমার অংশের সম্পত্তি সটান চলে যাবে সরকারের হাতে। কারণ তোমার। কোন সন্তানাদি এখন নেই।
শ্যামলী মৃদু হাসল। আমরা খাঁচার মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলুম।
নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলুম। কর্নেল বললেন, কী মনে হচ্ছে জয়ন্ত?
গিয়ারে হাত রেখে জবাব দিলুমকাল রাত থেকে এত কাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছেন আমাকে বলেননি তো!
শ্যামলী যত চালাক, তত বোকা।…বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। ফের বললেন–হুম, কী যেন বলছিলে জয়ন্ত? তোমাকে কিছু জানাইনি–তাই না? আগে সব জানালে তোমার রিঅ্যাকশানটা অন্যরকম হত। তার ফলে আমার। একটা জিনিস জানা হত না। ঘটনার চেহারাটা দেখে কারো মনে আপনাআপনি সন্দেহ হয় কি না–জানবার উদ্দেশ্য ছিল আমার। দেখলুম, কোন সন্দেহ হয় না–অন্তত তোমার হল না। অথচ তুমি নিতান্ত নোভিস বা লেম্যান নও একজন উঁদে রিপোর্টার। কাজেই আমি সিদ্ধান্তে এলুম যে এই দুর্ঘটনার পিছনে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক রয়েছে।
কিন্তু শ্যামলীর সম্পত্তি পাওয়ার তথ্য জেনে আমি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলুম।
সে তো নিছক সন্দেহ। প্রেজুডিসড হয়ে পড়া–তোমার ভাষায় কিন্তু আমি আঙুল দিয়ে না দেখালে দুর্ঘটনার বিবরণে কি তোমার কাছে কোন অসঙ্গতি ধরা পড়েছিল? অস্বীকার করো না ডার্লিং!
–ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমরা এখন কোথায় যাব? এবারও কি অবচেতন মনের নির্দেশে গাড়ি চলবে?
-নো, নো!..কর্নেল হেসে উঠলেন।তাহলে তুমি সোজা এখন বিলাসপুরে নিয়ে তুলবে। আমি তো জানি। তাই এবার বলে দিই–আমরা যাব নিউ
আলিপুরে। মিসেস সেনের কাছে।