ব্যোমকেশ গল্প আরম্ভ করিল
নৈশ আহারের পর মণীশবাবু শয়ন করিতে গিয়াছিলেন; ফণীশ চুপি চুপি আসিয়া আমাদের ঘরে ঢুকিল। আজ আমাদের ঘরে তিনজনের শয়নের ব্যবস্থা, বিকাশের জন্য একটি ক্যাম্প খাট পাতা হইয়াছে।
ঘরে তিনজনেই উপস্থিত ছিলাম, বিছানায় শুইয়া সিগারেট টানিতেছিলাম; বিকাশ কি করিয়া শালদের ধরিল তাঁহারই গল্প বলিতেছিল। ফণীশকে দেখিয়া ব্যোমকেশ বালিশে কনুই দিয়া উঁচু হইয়া বসিল।
‘এস ফণীশ।’
ফণীশ ব্যোমকেশের খাটের পাশে চেয়ার টানিয়া বসিল, অনুযোগের সুরে বলিল, ‘কালই চলে যাবেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, শালাবাবুরা যে রকম শাসিয়েছে তাড়াতাড়ি কেটে পড়াই ভাল। তুমি যদি বৌমাকে নিয়ে কলকাতায় আসো নিশ্চয় আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। বৌমাকে সত্যবতীর খুব পছন্দ হবে।’ বলিয়া যেন পুরাতন কথা স্মরণ করিয়া একটু হাসিল।
ফণীশ ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, ‘গল্পটা শুনব।’
ব্যোমকেশ বিছানার উপর উঠিয়া বসিল, মাথার বালিশটা কোলের উপর টানিয়া লইয়া বলিল, ‘গল্প শুনবে-প্রাণহারির গল্প? বেশ, বলছি; কিন্তু গল্পটা গল্পই হবে, আগাগোড়া সত্য ঘটনা হবে। না। অনেকটা ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত।’
ফণীশ ভ্রূ তুলিয়া প্রশ্ন করিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝলে না? যাঁরা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন তাঁরা সরাসরি ইতিহাস লেখেন না, ইতিহাস থেকে গোটা-কয়েক চরিত্র এবং ঘটনা তুলে নিয়ে সেই কাঠামোর ওপর নিজের গল্প গড়ে তোলেন। আমি তোমাকে যে গল্প বলব সেটাও অনেকটা সেই ধরনের হবে। সব ঘটনা জানি না, যেটুকু জানি তা থেকে পুরো গল্পটা গড়ে তুলেছি; কল্পনা আর সত্য এ গল্পে সমান অংশীদার।–শুনতে চাও?’
ফণীশ বলিল, ‘বলুন।’
ব্যোমকেশ নূতন সিগারেট ধরাইয়া গল্প আরম্ভ করিল—
ভুবনেশ্বর দাসকে দিয়েই গল্প আরম্ভ করি। তার নাম শূনেও আমার সন্দেহ হয়নি যে সে বাঙালী নয়, ওড়িয়া। বাংলাদেশ আর উড়িষ্যার সঙ্গমস্থলে যারা থাকে তারা দুটো ভাষাই পরিষ্কার বলতে পারে, বোঝবার উপায় নেই বাঙালী কি ওড়িয়া। যদি বুঝতে পারতাম, সমস্যাটা অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত। কারণ মোহিনী উড়িষ্যার মেয়ে। দুই আর দুয়ে চার।
মোহিনী ভুবনেশ্বরের বৌ। যারা মেয়ে-মরদে গতর খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করে ওরা সেই শ্রেণীর লোক। ভুবন কাজ করত কটকের একটা মোটর মেরামতির কারখানায়। মোহিনী বাঙালী গৃহস্থের বাড়িতে দাসীবৃত্তি করত। আর দু’জনে দু’জনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো। এই ভালবাসাই হচ্ছে। এ গল্পের মূল সূত্র।
ভুবনের মনে উচ্চাশা ছিল, মোহিনীর দাসীবৃত্তি তার পছন্দ ছিল না। মোটর কারখানায় কাজ করতে করতে মিলিটারিতে ট্রাক-ড্রাইভারের চাকরি যোগাড় করে সে চলে গেল; মোহিনীকে বলে গেল-টাকা রোজগার করে ট্যাক্সি কিনব, তোকে আর চাকরি করতে হবে না।
বছর দুই ভুবনের আর দেখা নেই। ইতিমধ্যে মোহিনী কটকে প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়িতে চাকরি করছে; দিনের বেলা কাজকর্ম করে, রাত্তিরে বাপ-মায়ের কাছে ফিরে যায়।
প্রাণহরি লোকটা অতিবড় অর্থাপিশাচ। যেমন কৃপণ তেমনি লোভী। সারা জীবন টাকাটাকা করে বুড়ো হয়ে গেছে, জুছুরি দাগাবাজি ব্ল্যাকমেল করে অনেক টাকা জমা করেছে, তবু তার টাকার ক্ষিদে মেটেনি। স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তার মনে লোভ নেই, কিংবা বুড়ো বয়সে সে লোভ কেটে গিয়েছিল। কিন্তু মোহিনী যখন তার বাড়িতে চাকরি করতে এল তখন তাকে দেখে প্রাণহারির মাথায় এক কুবুদ্ধি গজালো, সে টাকা রোজগারের নতুন একটা রাস্তা দেখতে পেল। বড় মানুষের উদ্ধৃঙ্খল ছেলেরা তার বাড়িতে জুয়া খেলতে আসে, তাদের চোখের সামনে মোহিনীর মত মেয়েকে যদি ধরা যায়–
মোহিনীর দেহে যে প্রচণ্ড যৌন আকর্ষণ আছে তাই দেখে তার চরিত্র সম্বন্ধে প্ৰাণহারির মনে ভুল ধারণা জন্মেছিল। সে বড়মানুষের ছেলেদের ধাপ্পা দিয়ে মোহিনীর নাম করে টাকা নিত। কিন্তু মোহিনী ধরা-ছোঁয়া দিত না। কিছুদিন এইভাবে চলাবার পর বড়মানুষের ছেলেরা বিগড়ে গেল, তারা টাকা ঢেলেছে, ছাড়বে কেন? তারা প্ৰাণহারিকে প্রহার দেবার মতলব করল।
প্রাণহরি দেখল কটক থেকে কেটে না পড়লে মার খেতে হবে। কিন্তু মোহিনীকেও তার দরকার, এমন মুখরোচক টোপ সে আর কোথায় পাবে? সে মোহিনীর কাছে প্রস্তাব করল তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। মোহিনীর আপত্তি নেই; তার স্বামী বিদেশে, তাকে দাসীবৃত্তি করে খেতে মুকুতার কাছে কষ্টকও যা অন্য জায়গাও তাই। সে দেড়া মাইনেতে প্ৰাণহারির সঙ্গে যেতে রাজী হল।
কিন্তু তারা কটক ছাড়বার আগেই ভুবন ফিরে এল। ভুবন চাকরি করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছে, কিন্তু ট্যাক্সি কেনার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে পরামর্শ করল, তারপর ভুবন প্ৰাণহারির কাছে গেল।
ভুবন প্রাণহারিকে টাকার কথা বলল; তার কিছু টাকা আছে, আরও আড়াই হাজার টাকা পেলেই সে নিজের ট্যাক্সি কিনতে পারবে। প্রাণহরি ভেবে দেখল, টাকা ধার দিলে ভুবন আর মোহিনী দু’জনেই তার মুঠোর মধ্যে থাকবে; মোহিনীকে তখন হুকুম মেনে চলবে হবে। সে রাজী হল। রেজিস্ট্রি দলিল তৈরি হল, তাতে ধার-শোধের শর্ত রইল-মোহিনীর মাইনের পনরো টাকা কাটা যাবে, ভুবন তার ট্যাক্সির রোজগার থেকে মাসে পঁয়ত্ৰিশ টাকা দেবে, আর প্রাণহারি নিজের দরকারে ট্যাক্সি ব্যবহার করবে তার জন্য পঁচিশ টাকা দেবে।; এইভাবে প্রতিমাসে পচাত্তর টাকা শোধ হবে।
সকলেই খুশি। ভুবন ট্যাক্সি কিনল। তিনজনে কয়লা শহরে এল। তারপর প্রাণহরি শহরের হালচাল বুঝে নিয়ে তার অভ্যস্ত লীলাখেলা আরম্ভ করল।
কয়লা ক্লাব হচ্ছে বড়লোকের আস্তানা, প্ৰাণহরি সেখানে গিয়ে ছিপ ফেলল। চারটি বড় বড় রুই-কাৎলা তার ছিপে উঠল। সে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল।
জুয়া খেলার সময় মোহিনীকেও সকলে দেখল। বিশেষভাবে একজনের নজর পড়ল তার ওপর; অরবিন্দ হালদার চরিত্রহীন লম্পট, সে লোভে উন্মত্ত হয়ে উঠল। প্রাণহারি জুয়ায় চারজনকেই শোষণ করছিল, অরবিন্দ হালদারকে বেশি করে শোষণ করতে লাগিল। অরবিন্দকে সে জানিয়ে দিয়েছিল যে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া যায় না।
প্রাণহারির কাছে ছাড়পত্র পেয়ে অরবিন্দ হালদার সময়ে অসময়ে মোহিনীর কাছে আসতে লাগল। কিন্তু মোহিনী শক্ত মেয়ে, তাকে চোখে দেখে যা মনে হয় সে তা নয়। অরবিন্দের মতলব সে বুঝেছে, কিন্তু স্পষ্ট কথা বলে তাকে তাড়িয়ে দেয় না। সে তার সঙ্গে খাতির করে কথা বলে, হয়তো হাসি-মস্করাতেও যোগ দেয়, কিন্তু তার দেওয়া উপহার নেয় না। প্রাণহারি মোহিনীকে বোধ হয় ইশারা দিয়েছিল; ইশারায় যতখানি স্বীকার করা সম্ভব মোহিনী ততখানি স্বীকার করে চলত। প্রাণহোর ঘুঘু লোক, স্পষ্টভাবে মোহিনীকে কিছু বলেনি; ভেবেছিল ইশারাতেই কাজ হবে। হাজার হোক, মোহিনী নিম্নশ্রেণীর মেয়ে।
কিছুদিন চেষ্টা-চরিত্র করে অরবিন্দ বুঝল, এ বড় কঠিন ঠাই। ওদিকে জুয়াতেও তারা অনেক টাকা হেরেছে। তারপর একদিন প্রাণহোরর বেইমানি ধরা পড়ে গেল। জুয়া খেলা বন্ধ হল।
জুয়াতে যারা হেরেছিল তাদের সকলেরই রাগ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু অরবিন্দের রাগ হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ সে জুয়াতেই ঠকেনি, অন্য বিষয়েও ঠকেছিল। ঠকেছিল এবং অপমানিত হয়েছিল। তাই সে একদিন তার তিন সঙ্গীকে নিয়ে প্রাণহারিকে ঠেঙাতে গেল।
দৈবক্রমে যে ট্যাক্সিতে চড়ে তারা প্রাণহারিকে ঠেঙাতে গেল সে ট্যাক্সিটা ভুবন দাসের। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে অরবিন্দ বোধ হয় মোহিনীর সম্বন্ধে তার মনের আফসানি প্রকাশ করেছিল, ভুবন তার কথা শুনে বুঝল, প্রাণহরি দু’হাজার টাকা নিয়ে তার বৌকে বিক্রি করেছে।
কয়লা শহরে ভুবনের বাসা ছিল না; প্রাণহরিও তার বাড়িতে ভুবনকে থাকতে দেয়নি। কিন্তু আমার বিশ্বাস ভুবন ফুরসৎ পেলেই চুপিচুপি এসে মোহিনীর কাছে রাত কাটিয়ে যেত। স্বামী-স্ত্রীতে কথা হত; হয়তো মোহিনী স্বামীকে ইশারা দিয়েছিল-বুড়োটা লোক ভাল নয়। ভুবন মনে মনে প্ৰাণহারিকে ঘৃণা করত। খাতকের সঙ্গে মহাজনের ভালবাসা বড়ই বিরল। কিন্তু ভুবন সাবধানী লোক, সে বলত-ধারটা শোধ হলে ট্যাক্সি পুরোপুরি তার নিজের হয়ে যাবে, তখন তারা গাড়ি নিয়ে চলে যাবে, বুড়োর সঙ্গে তাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
প্রাণহরি যে এতবড় শয়তান তা ভুবন কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু যখন সে শুনল যে প্রাণহরি দু’হাজার টাকা নিয়ে তার বৌকে বিক্রি করেছে তখন তার মাথায় খুন চেপে গেল। দুনিয়ায় পয়সাওয়ালা লম্পট অনেক আছে পরাস্ত্রীর ওপর তারা নজর দেয়; তাদের ওপর ভুবনের রাগ নেই। কিন্তু ওই বুড়ো শয়তানটাকে সে খুন করবে।
খুন করবার সুযোগও হাতে হাতে এসে গেল। প্রাণহারির বাড়ির কাছাকাছি এসে চারজন আরোহী নেমে গেল। ভুবন ট্যাক্সির মুখ ঘুরিয়ে রাখল; তারপর সেও বেরুলো। তার হাতে মোটরের স্প্যানার।
ভুবন প্রাণহারির বাড়িতে প্রত্যহ দিনে রাত্রে দু’বার তিনবার এসেছে, সে জানতো বাড়ির পিছন দিকে ওপরে ওঠবার মেথরখাটা সিঁড়ি আছে। সে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে বাড়ির পিছন দিকে গেল, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দোরে টোকা মারল।
দু’দিকের দোর বন্ধ করে প্রাণহরি নিজের ঘরে ছিল; সে বোধহয় জানতে পারেনি যে, তাকে চারজনে ঠেঙাতে এসেছে। কিন্তু সে হুঁশিয়ার লোক; টোকা শুনে স্নানের ঘরে গেল। তারপর যখন জানতে পারল যে ভুবন এসেছে তখন সে দোর খুলে দিল। কারণ ভুবনের ওপর তার কোনো সন্দেহ নেই।
দু’জনে শোবার ঘরে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল।
তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়েছিল। কিনা জানি না। ভুবনের বাঁ হাতে ছিল স্প্যানার, সে আচমকা স্প্যানার তুলে মারলো প্রাণহারির মাথায় এক কোপ। প্রাণহরি মুখ খোলবার সময় পেল না; তৎক্ষণাৎ পতন ও মৃত্যু।
ভুবন তখন সাবধানে সামনের দরজা খুলল। তার বোধ হয় মতলব ছিল সামনের দিকে সাড়াশব্দ না পেলে সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে, পিছনের দরজা বন্ধ থাকবে। কিন্তু সামনে বোধহয় তখন এরা চারজন সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছিল। তাই ভুবন সামনের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যো-পথে এসেছিল। সেই পথে ফিরে গেল। স্প্যানারটা সঙ্গে নিয়ে গেল। এখন পরিস্থিতি দাঁড়াল, সামনের দরজাও খোলা, পিছনের দরজাও খোলা। প্রাণহোরর আততায়ী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে অনুমান করা শক্ত।
অরবিন্দ প্রথম বার প্রাণহোরর দরজা বন্ধ পেয়েছিল; দ্বিতীয় বার চারজনে উঠে দেখল। দরজা খোলা এবং প্রাণহরি পোদ্দার ইহলীলা সম্বরণ করেছে। তারা দুদ্দাড় শব্দে পালালো। ট্যাক্সির কাছে ফিরে গিয়ে দেখল ট্যাক্সি-ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। তারা ড্রাইভারকে জাগিয়ে শহরে ফিরে গেল।
ওদিকে মোহিনী রান্না করছিল, সে কিছুই জানতে পারেনি। রান্নার ছাকৈছোঁক শব্দে দুরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছিল। রান্না শেষ হবার পর সে যখন দেখল। বুড়ো খেতে নামছে না, তখন সে ওপরে গেল। সে দেখল প্ৰাণহরি মারে পড়ে আছে, সামনের এবং পিছনের দরজা খোলা। অরবিন্দের কথা তার মনে এল না। তার মনে এল ভুবনের কথা। যেখানে ভালোবাসা সেখানেই শঙ্কা। ভুবনকে সে ইশারা দিয়েছিল, বুড়ো লোক ভাল নয়। ভুবন বাইরে বেশ ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু তার ভিতরে আছে প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারের উগ্রতা। স্ত্রীর অমযদি সে সহ্য করবে না।
মোহিনী মেয়েটা ভারি বুদ্ধিমতী। মড়া দেখেও তার মাথা খারাপ হল না, সে চট্ট করে কর্তব্য স্থির করে ফেলল। খুন যেই করুক, তাকে যেন পুলিস ধরতে না পারে। হত্যাকারী স্নানঘরের দোর দিয়ে ঢুকেছে এবং সেই দিক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছে, মোহিনীর তাতে সন্দেহ নেই। সে পিছন দিকের দরজা দুটো ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল, তারপর ট্রাক-ড্রাইভার মারফত পুলিসে খবর পাঠালো। কী সাংঘাতিক মেয়ে দ্যাখো, একটুকু বাড়াবাড়ি করেনি। পুলিসকে ভুল রাস্তায় চালাবার জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু করেছে।
মোহিনী আমাদের আছে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে, কিন্তু কখনো অনাবশ্যক। মিথ্যে কথা বলেনি। ভুবনও তাই। আমার বিশ্বাস যে-রাত্রে খুন হয় সেই রাত্রেই কোনো সময় ভুবন ফিয়ে গিয়ে মোহিনীকে সব কথা বলেছিল এবং তারপর থেকে প্রায়ই গিয়ে দেখা করত। এই জন্যেই মোহিনী খুনের পর বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি। ভুবনের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখা নিতান্ত দরকার।
যাহোক, আমি যখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলাম তখন পুলিসের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি পড়েছে চারজন আসামীর ওপর। মোটিভ এবং সুযোগ এদের পুরোদস্তুর বিদ্যমান। হয় এরা চারজনে একজোট হয়ে খুন করেছে, নয়তো ওদের মধ্যে একজন খুন করেছে। অন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে।
পুলিসের সঙ্গে আমার মতভেদের কোনো কারণ ছিল না; তবু একজোট হয়ে খুন করার প্রস্তাবটা হজম করা শক্ত। সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা মধ্যভারতের ডাকাত নয়, তারা সমাজবাসী তথাকথিত সভ্য মানুষ। তারা দল বেঁধে খুন করবে না।
কিন্তু ওদের মধ্যে একজন অন্য তিনজনের চোখে ধুলো দিয়ে খুন করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, লোকটা কে? সবচেয়ে বেশি সন্দেহ অরবিন্দ হালদারের ওপর। সে শুধু জুয়াতেই ঠিকেনি, আর এক বিষয়ে ঠিকেছে; যার জন্যে তার লজার অবধি নেই; যে কথা সে কারুর কাছে স্বীকার করতে পারে না। লম্পটের লজ্জা এক বিচিত্র বস্তু; সে কেবল তখনি লজ্জা পায় যখন দুহাজার টাকা খরচ করেও সে তার নির্লজ্জ কামনার বস্তু পায় না।
অনুসন্ধান আরম্ভ করে আমার খটকা লাগল। প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমার মনে মাথা তুলল। সেটি হচ্ছে-মারণাস্ত্রটা গেল কোথায়? ডাক্তার ঘোষাল যে ধরনের বর্ণনা দিলেন সে রকম কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি; অরবিন্দের দলের কেউ যদি অস্ত্র আনতো তাহলে ফণীশ আর ভুবনের চোখ এড়াতে পারতো না। সুতরাং ওরা অস্ত্রটা আনেনি, নিয়েও যায়নি। তবে সেটা এল কোথেকে এবং গেল কোথায়?
দ্বিতীয় কথা, ডাক্তার ঘোষালের বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, হত্যাকারী লোকটা ন্যাটা। ভেবে দ্যাখো, প্রাণহারির শোবার ঘরে একটা চেয়ার পর্যন্ত নেই; সে আততায়ীর দিকে পিছন ফিরে তক্তপোশের কিনারায় বসেছিল একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আততায়ী তাকে মেরেছে, আঘাত লেগেছে মাথার ডানদিকে সিঁথির মত। সুতরাং আততায়ী ন্যাটা, তার বাঁ হাত বেশি চলে।
চারজন আসামীয় মধ্যে কে ন্যাটা খোঁজ করলাম। কয়লা ক্লাবে গিয়ে দেখলাম, মৃগেন মৌলিক ডান হাতে টেনিস খেলছে, মধুময় সুর আর অরবিন্দ হালদার ডান হাতে তাস ভেঁজে তাস বাঁটছে এবং খেলছে। তখন ফণীশের দিকে কাচের কাগজ চাপা গোলা ফেলে দেখলাম। সেও ডান হাতে গোলা ধরল। ওরা কেউ ন্যাটা নয়।
কিন্তু ন্যাটা না হোক, ওদের মধ্যে কেউ সব্যসাচী হতে পারে। কাজেই ওদের একেবারে ত্যাগ করতে পারলাম না। ওরা ছাড়া সন্দেহভাজন আর কেউ নেই। মোহিনী খুন করেনি, তার খুন করবার ইচ্ছে থাকলে সে প্রাণহারিকে বিষ খাওয়াতো; তার মোটিভও কিছু নেই।
আমি কোনো দিকে দিশা খুঁজে পাচ্ছি না, এমন সময় এক মুহুর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল; যেন মেঘে ঢাকা অন্ধকার রাত্রে বিদ্যুৎ চমকালো। দেখলাম ভুবন তার ট্যাক্সির চাকার তলায় জ্যাক বসিয়ে বাঁ হাতে ঘোরাচ্ছে!
খুনের রাত্রে ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভুবনেশ্বর দাস যে অকুস্থলে উপস্থিত ছিল তা আমরা সকলেই জানতাম, অথচ তার কথা একবারও মনে আসেনি। একেই জি. কে. চেস্টারটন বলেছেন, অদৃশ্য মানুষ–Invisible Man.
অস্ত্রের সমস্যা এক মুহুর্তে সমাধান হয়ে গেল। স্প্যানার দিয়ে ভুবন প্ৰাণহারিকে মেরেছিল; ডাক্তার ঘোষাল মারণাস্ত্রের যে বৰ্ণনা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে অবিকল মিলে যাচ্ছে।
ভুবন বৌকে নিয়ে পালিয়েছে। ভারি বুদ্ধিমান লোক, আমি তাকে চিনেছি তা বুঝতে পেরেছিল। কোথায় গিয়ে তারা আস্তানা গাড়বে জানি না; মাদ্রাজ বোম্বাই কত জায়গা আছে। আশা করি প্রমোদবাবু ভুবনকে খুঁজে পাবেন না। কারণ, যদি খুঁজে পান নিশ্চয় তাকে সোনার মেডেল দেবেন না।
আর কিছু বলবার নেই। যদি কোনো কথা বাদ পড়ে থাকে তোমরা আন্দাজ করে নিতে পারবে। ভুবন আর মোহিনী চিরজীবন ফেরারী হয়ে থাকবে, যদি না ধরা পড়ে। প্রাণহারি পোদ্দারের নিষ্ঠুর লোভ দুটো মানুষের জীবন নষ্ট করে দিল, এ কাহিনীর মধ্যে এইটেই সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।