Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কহেন কবি কালিদাস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

কহেন কবি কালিদাস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

নৈশ ভোজনের পর মণীশবাবু উপরে চলিয়া গেলেন‌, আমরা নিজেদের ঘরে আসিলাম। মাথার উপর পাখা খুলিয়া দিয়া আমি শয়নের উপক্রম করিলাম‌, ব্যোমকেশ কিন্তু শুইল না‌, প্রাণহোরর হিসাবের খাতা লইয়া টেবিলের সামনে বসিল। খেরো-বাঁধানো দুভাঁজ করা লম্বা খাতা‌, তাহাতে দেশী পদ্ধতিতে হিসাব লেখা।

ব্যোমকেশ হিসাবের খাতার গোড়া হইতে ধীরে ধীরে পাতা উল্টাইতেছে, আমি খাটের ধারে বসিয়া সিগারেট প্ৰায় শেষ করিয়া আনিয়াছি‌, এমন সময় ফণীশ আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া তাহাকে দেখিল‌, তারপর এক অদ্ভুত কাজ করিল। তাহার সামনে টেবিলের উপর একটি কাচের কাগজ-চাপা গোলক ছিল‌, সে চকিতে তাহা তুলিয়া লইয়া ফণীশের দিকে ছুঁড়িয়া দিল।

ফণীশ টপ করিয়া সেটা ধরিয়া ফেলিল‌, নচেৎ মেঝেয় পড়িয়া চুৰ্ণ হইয়া যাইত। ব্যোমকেশ হাসিয়া ডাকিল‌, ‘এস ফণীশ।’

ফণীশ বিস্মিত হতবুদ্ধি মুখ লইয়া কাছে আসিল‌, ব্যোমকেশ কাচের গোলাটা তাহার হাত হইতে লইয়া বলিল‌, ‘অবাক হয়ে গেছ দেখছি। ও কিছু নয়‌, তোমার রিফ্লেক্স পরীক্ষা করছিলাম। বোসো‌, কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

ফণীশ সামনের চেয়ারে বসিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুমি আজকাল ক্লাবে যাও না?’

ফণীশ বলিল‌, ‘ওই ব্যাপারের পর আর যাইনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাওনি কেন? হঠাৎ যাওয়া বন্ধ করলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’

ফণীশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, কাল থেকে যাব।’

‘আমরাও যাব। অতিথি নিয়ে যেতে বাধা নেই তো?’

‘না। কিন্তু—ক্লাবে আপনার কিছু দরকার আছে কি?’

‘তোমার তিন বন্ধুকে আড়াল থেকে দেখতে চাই।–আচ্ছা‌, একটা কথা বল দেখি‌, সেদিন তোমরা যে প্রাণহরি পোদ্দারকে ঠেঙাতে গিয়েছিলে তোমাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছু ছিল?’

‘অন্ত্র ছিল না। তবে মধুময়বাবুর হাতে একটা লম্বা টর্চ ছিল‌, মুণ্ডুওয়ালা টর্চ। আর মৃগাঙ্কবাবুর হাতে ছিল বেতের ছড়ি।’

‘কি রকম ছড়ি? মোটা‌, না লচপচে?

লচপাচে। যাকে swagger came বলে।’

‘হুঁ, তোমার হাতে কিছু ছিল না?’

‘না।’

‘অরবিন্দ হালদারের হাতে?’

‘না।’

‘কাপড়-চোপড়ের মধ্যে লোহার ডাণ্ডা কি ঐরকম কিছু লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল?’

‘না। গরমের সময়‌, সকলের গায়েই হাল্কা ড্রাম-কাপড় ছিল‌, ধুতি আর পাঞ্জাবি। কারুর সঙ্গে ওরকম কিছু থাকলে নজরে পড়ত।’

‘ই—ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া কিছুক্ষণ টানিল‌, শেষে বলিল‌, কোথা দিশা খুঁজে পাই না। তুমি যাও‌, শুয়ে পড়ো গিয়ে। —কবিতা আওড়াতে পারো? বৌমাকে বোলো-নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে।’

ফণীশ লজ্জিত মুখে চলিয়া গেল। আমি শয়ন করিলাম। ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ খাতা দেখিল‌, তারপর আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িল।

অন্ধকারে প্রশ্ন করিলাম‌, ‘খুব তো কবিতা আওড়াচ্ছ‌, আজ সারাদিনে কিছু পেলে?’

উত্তর আসিল‌, ‘তিনটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছি। এক-প্রাণহরি পোদ্দারকে যিনি খুন করেছেন তাঁর টাকার লোভ নেই; দুই-তিনি সব্যসাচী; তিন-মোহিনীর মত মেয়ের জন্য যে-কেউ খুন করতে পারে।–এবার ঘুমিয়ে পড়।’

সকালে ঘুম ভাঙিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ আবার হিসেবের খাতা লইয়া বসিয়াছে।

তারপর যথাসময়ে প্রাতরাশ গ্রহণ করিয়া বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ হিসাবের খাতটি সঙ্গে লইল।

থানায় পৌঁছিলে ইন্সপেক্টর বিরাট হাসিয়া বলিলেন‌, ‘এরই মধ্যে হিসেবের খাতা শেষ করে ফেললেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ খাতায় মাত্র দেড় বছরের হিসেব আছে‌, অর্থাৎ এখানে আসার পর প্রাণহরি নতুন খাতা আরম্ভ করেছিল।’

বরাট জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কিছু পেলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুনের ওপর আলোকপাত করে এমন কিছু পাইনি। কিন্তু একটা সামান্য বিষয়ে খাটুকা লেগেছে।’

‘কী বিষয়?’

‘একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে প্ৰাণহারির ব্যবস্থা ছিল‌, সে রোজ তাকে ট্যাক্সিতে বাড়ি থেকে নিয়ে আসত‌, আবার বাড়ি পৌঁছে দিত। মাসিক ভাড়া দেবার ব্যবস্থা ছিল নিশ্চয়। কিন্তু হিসেবের খাতায় দেখছি ঠিক উল্টো। এই দেখুন খাতা।’ ব্যোমকেশ খাতা খুলিয়া দেখাইল। খাতার প্রতি পৃষ্ঠায় পাশাপাশি জমা ও খরচের স্তম্ভ। খরচের স্তম্ভে এক পয়সা দুই পয়সার খরচ পর্যন্ত লেখা আছে‌, কিন্তু জমার স্তম্ভ। অধিকাংশ দিনই শূন্য। মাঝে মাঝে কোনও খাতক সুদ জমা দিয়াছে তাহার উল্লেখ আছে। ব্যোমকেশ আঙুল দিয়া দেখাইল‌, ‘এই দেখুন‌, ৩রা মাঘ জমার কলমে লেখা আছে‌, ট্যাক্সি-ড্রাইভার ৩৫ টাকা। এমনি প্রত্যেক মাসেই আছে। কিন্তু খরচের কলমে ট্যাক্সি বাবদ কোনো খরচের উল্লেখ নেই।’

হয়তো ভুল করে খরচটা জমার কলমে লেখা হয়েছিল।’

‘প্রত্যেক মাসেই কি ভুল হবে?

‘হুঁ। আপনার কি মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না। খাতায় জুয়া খেলার লাভ-লোকসানের হিসেবও নেই। একটু রহস্যময় মনে হয় না কি?’

‘তা মনে হয় বৈকি। এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে?’

ব্যোমকেশ ভাবিয়া বলিল‌, ‘প্ৰাণহরি যার ট্যাক্সিতে যাতায়াত করত তাকে পেলে সওয়াল জবাব করা যায়। তাকে চেনেন নাকি?’

বরাট বলিলেন‌, ‘না‌, তার খোঁজ করা দরকার মনে হয়নি। এক কাজ করা যাক‌, ভুবন দাসকে ডেকে পাঠাই‌, সে নিশ্চয় সন্ধান দিতে পারবে।’

‘ভুবন দাস?’ −

‘সো-রাত্রে ওদের চারজনকে যে ট্যাক্সি-ড্রাইভার প্রাণহারির বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তার নাম ভুবনেশ্বর দাস।’

‘ও-তাকে কি পাওয়া যাবে?

‘কাছেই ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড। আমি ডেকে পাঠাচ্ছি।’

পনেরো মিনিট পরে ভুবনেশ্বর দাস আসিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল। দোহারা চেহারা‌, খাকি প্যান্টুলুন ও শার্ট‌, মাথায় গার্ডসাহেবের মত টুপি। বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্ৰিশ‌, চোখ দু’টি অরুণাভ‌, মুখ গভীর। সন্দেহ হইল লোকটি নেশাভাঙা করিয়া থাকে।

বরাট ঘাড় নাড়িয়া ব্যোমকেশকে ইঙ্গিত করিলেন‌, ব্যোমকেশ ভুবন দাসকে একবার আগাপাস্তলা দেখিয়া লইয়া প্রশ্ন আরম্ভ করিল‌, ‘তোমার নাম ভুবন দাস। মিলিটারিতে ছিলে?’

ভুবন দাস বলিল‌, ‘আজ্ঞে।’

‘সিপাহী ছিলে?

‘আত্তে না‌, ট্রাক-ড্রাইভার।’

‘ট্যাক্সি চালাচ্ছে কত দিন?’

‘তিন-চার বছর।’

‘তিন-চার বছর এখানেই ট্যাক্সি চালোচ্ছ?

‘আজ্ঞে না‌, এখানে বছর দেড়েক আছি‌, তার আগে কলকাতায় ছিলাম।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘মেদিনীপুর জেলা‌, ভগবানপুর গ্রাম।’

‘তুমি সেদিন চারজনকে নিয়ে প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়িতে গিয়েছিলে?’

‘আজ্ঞে বাড়িতে নয়‌, বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে।’

‘বেশ। তোমার ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেছিল?’

ভুবন দাস একটু নীরব থাকিয়া বলিল‌, ‘বলেছিল। আমি সব কথায় কান করিনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, কিছু মনে আছে?’

ভুবন দাস আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘বোধ হয় কোনো মেয়েলোকের সম্বন্ধে কথা হচ্ছিল। চাপা গলায় কথা হচ্ছিল‌, ভাল শুনতে পাইনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা যাক। বল দেখি‌, তোমার চারজন যাত্রীর কারুর হাতে কোনো অস্ত্র ছিল?’

‘একজনের হাতে ছড়ি ছিল।’

‘আর কারুর হাতে কিছু ছিল না?’

‘লক্ষ্য করিনি।’

‘তুমি নেশা করা?’

‘আজ্ঞে না বলিয়া ভুবন দাস ইন্সপেক্টর বরাটের দিকে বক্র কটাক্ষপাত করিল।

‘শহরে তোমার বাসা কোথায়?’

‘বাসা নেই। রাত্তিরে গাড়িতেই শুয়ে থাকি।’

‘গাড়ি তোমার নিজের?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘শহরের অন্য ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে তোমার নিশ্চয় জানাশোনা আছে।’

‘জানাশোনা আছে‌, বেশি মেলামেশা নেই।’

বলতে পারো‌, কার ট্যাক্সিতে চড়ে প্ৰাণহরি পোদ্দার শহরে যাওয়া-আসা করতেন?

মনে হইল। ভুবন দাসের রক্তাভ চোখে একটু কৌতুকের ঝিলিক খেলিয়া গেল। সে কিন্তু গম্ভীর স্বরেই বলিল‌, ‘আজ্ঞে স্যার‌, আমার ট্যাক্সিতে।’

আমরা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। তারপর বিরাট কড়া সুরে বলিলেন‌, ‘একথা আগে আমাকে বলনি কেন?’

ভুবন বলিল‌, ‘আপনি তো সুধোননি স্যার।’

ব্যোমকেশ হাসি চাপিয়া পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিল। ট্যাক্সি-ড্রাইভার সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা খুব বিস্তীর্ণ নয়, কিন্তু লক্ষ্য করিয়াছি তাহারা অতিশয় স্বল্পভাষী জীব, অকারণে বাক্য ব্যয় করে না। অবশ্য ভাড়া লইয়া ঝগড়া বাধিলে স্বতন্ত্র কথা।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তুমি তাহলে প্ৰাণহরি পোদ্দারকে আগে থাকতেই চিনতে?

ভুবন বলিল‌, ‘আজ্ঞে।’

‘তিনি কি রকম লোক ছিলেন?’

‘ভাল লোক ছিলেন স্যার‌, কখনো ভাড়ার টাকা ফেলে রাখতেন না।’ ভুবনের কাছে ইহাই সাধুতার চরম নিদর্শন।

‘রোজ নগদ ভাড়া দিতেন?’

‘আজ্ঞে না‌, মাস-মাইনের ব্যবস্থা ছিল।’

‘কত টাকা মাস-মাইনে?’

‘পঁয়ত্ৰিশ টাকা।’

বরাটের সহিত ব্যোমকেশ মুখ-তাকাত কি করিল‌, তারপর ভুবনকে বলিল‌, ‘প্রাণহরি পোদ্দারের সম্বন্ধে তুমি কী জানো সব আমায় বল।’

ভুবন বলিল‌, ‘বেশি কিছু জানি না। স্যার। শহরে ওঁর একটা অফিস আছে। বছরখানেক আগে উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে মাস-মাইনেতে ট্যাক্সি ভাড়া করার কথা তোলেন‌, আমি রাজী হই। তারপর থেকে আমি ওঁকে সকালে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম‌, আবার বিকেলবেলা পৌঁছে দিতাম। বাংলা মাসের গোড়ার দিকে উনি আমাকে অফিসে ডেকে ভাড়া চুকিয়ে দিতেন। এর বেশি ওঁর বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

‘তুমি মাত্র পঁয়ত্ৰিশ টাকা মাস-মাইনেতে রাজী হয়েছিলে? লাভ থাকতো?’

‘সামান্য লাভ থাকতো। বাঁধা ভাড়াটে তাই রাজী হয়েছিলাম।’

ব্যোমকেশ খানিক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর প্রশ্ন করিল‌, ‘অন্য কোনো ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে প্রাণহারিবাবুর কারবার ছিল কিনা জানো?’

ভুবন বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, আমি জানি না।’

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, তুমি এখন যাও। যদি প্রাণহরি সম্বন্ধে কোনো কথা মনে পড়ে দারোগাবাবুকে জানিও।’

‘আজ্ঞে।’ ভুবন দাস স্যালুট করিয়া চলিয়া গেল।

তিনজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসিয়া রহিলাম। তারপর বরাট বলিলেন‌, ‘কিছুই তো পাওয়া গেল না। হিসেবের খাতায় হয়তো ভুল করেই খরচের জায়গায় জমা লেখা হয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিংবা সাংকেতিক জমা-খরচ।’

ভ্রূ তুলিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘সাংকেতিক জমা-খরচ কি রকম?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মনে করুন প্রাণহরি পোদ্দার কাউকে ব্ল্যাকমেলা করছিল। ভুকন দাস তাকে যত ভাল লোকই মনে করুক আমরা জানি সে প্যাঁচালো লোক ছিল। মনে করুন। সে মাসিক সত্তর টাকা হিসেবে ব্ল্যাকমেল আদায় করছে‌, কিন্তু সে-টাকা তো সে হিসেবের খাতায় দেখাতে পারে না। এদিকে ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে দিতে হয় মাসে পঁয়ত্ৰিশ টাকা। প্ৰাণহারি খাতায় সাংকেতিক হিসেব লিখল‌, সত্তর টাকা থেকে পঁয়ত্ৰিশ টাকা বাদ দিয়ে পঁয়ত্ৰিশ টাকা জমা করল। যাকে ব্ল্যাকমেল করছে তার নাম লিখতে পারে না‌, তাই ট্যাক্সি-ড্রাইভারের নাম লিখল। বুঝেছেন?’

বরাট বলিলেন‌, ‘বুঝেছি। অসম্ভব নয়। প্রাণহারির মনটা খুবই প্যাঁচালো ছিল‌, কিন্তু আপনার মন আরো প্যাঁচালো।’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘আচ্ছা‌, আজ উঠি। প্রাণহরি কাকে ব্ল্যাকমেল করছিল জানতে পারলে হয়তো খুনের একটা সূত্র পাওয়া যেত। কিন্তু ওর দলিল-পত্রে ওরকম কিছু বোধহয় পাওয়া যায়নি?

না। যে দু’চারটে কাগজপত্র পাওয়া গেছে তাতে বে-আইনী কার্যকলাপের কোনো ইঙ্গিত নেই।–আজ ওবেলা আসছেন নাকি?’

লোমকেশ বলি‌, ওবেলা আপনাকে আর বিরক্ত করব না। ফণীশের সঙ্গে কয়লা ক্লাবে যাচ্ছি।

কয়লা ক্লাবের বাড়িটি সুবিস্তৃত ভূমিখণ্ড দ্বারা পারিবেষ্টিত। সামনে বাগান ও মোটর রাখিবার পার্কিং লন‌, দুই পাশে ব্যাডমিণ্টন টেনিস প্রভৃতি খেলিবার স্থান। বাড়িটি একতলা হইলেও অনেকগুলি বড় বড় ঘর আছে। মাঝখানের হলঘরে বিলিয়ার্ড খেলার টেবিল; অন্য ঘরের কোনোটিতে পিংপং টেবিল‌, কোনোটিতে চার পাঁচটা তাস খেলার টেবিল ও চেয়ার। আবার একটা ঘরের মেঝোয় ফরাস পাতা‌, এখানে দাবা ও পাশা খেলার আসর। বাড়ির পিছন ভাগে দুইটি অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর; একটিতে ম্যানেজারের অফিস‌, অন্যটিতে পানাহারের ব্যবস্থা‌, টুকিটাকি খাবার‌, নরম ও গরম নানা জাতীয় পানীয় এখানে সভ্যদের জন্য প্রস্তুত থাকে।

আমরা যখন ক্লাবে গিয়া পৌঁছিলাম তখনও যথেষ্ট দিনের আলো আছে। অনেক সভ্য সমবেত হইয়াছেন। বাহিরে টেনিস কোর্টে খেলা চলিতেছে; চারজন খেলিতেছে‌, বাকি সকলে কোর্টের পাশে চেয়ার পাতিয়া বসিয়া খেলা দেখিতেছেন। ফণীশ আমাদের সেই দিকে লইয়া চলিল।

কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া খেলা দেখিবার পর ব্যোমকেশ ফণীশের কানে কানে বলিল‌, ‘তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ আছে নাকি?’

ফণীশ বলিল‌, ‘ঐ যে খেলছেন‌, তোয়ালের নীল গেঞ্জি আর শাদা প্যান্টুলুন‌, উনি মৃগেন মৌলিক।’

একটু রোগা ধরনের শরীর হইলেও মৃগেন মৌলিকের চেহারা বেশ খেলোয়াড়ের মত। খেলার ভঙ্গীতে একটু চালিয়াতি ভাব আছে‌, কিন্তু সে ভালই টেনিস খেলে। ব্যাকহ্যান্ড বেশ জোরালো; নেটের খেলাও ভাল।

ব্যোমকেশ খেলা দেখিতে দেখিতে বলিল‌, ‘বাকি দু’জন। এখানে নেই?’

ফণীশ বলিল‌, ‘না। চলুন‌, ভেতরে যাওয়া যাক।’

এই সময় পিছন হইতে কণ্ঠস্বর শোনা গেল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু-থুড়ি-গগনবাবু যে!’

ফিরিয়া দেখিলাম‌, আমাদের পূর্ব-পরিচিত গোবিন্দ হালদার ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া মধুর গেরিলা-হাস্য হাসিতেছেন।

ব্যোমকেশ কিন্তু হাসিল না‌, স্থির-দৃষ্টিতে গোবিন্দবাবুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আসল নামটা জানতে পেরেছেন দেখছি। কি করে জানলেন?’

গোবিন্দবাবু বলিলেন‌, ‘প্রথম দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর দুই আর দুয়ে মিলিয়ে দেখলাম ঠিক মিলে গেল। গগন-ব্যোমকেশ‌, সুজিত—অজিত।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমাদের নামকরণ ভাল হয়নি‌, কাঁচা কাজ হয়েছিল। কিন্তু আসল নামের বহুল প্রচার কি বাঞ্ছনীয়?’

গোবিন্দবাবু বলিলেন‌, ‘আমি প্রচার করছি না। নামটা আলটপকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। যা হোক‌, আমাদের ক্লাবে পদার্পণ করেছেন খুবই আনন্দের কথা। উদ্দেশ্য কিছু আছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার কি মনে হয়?’

গোবিন্দবাবুর মন্থর চক্ষু দু’টি একবার ফণীশের দিকে গিয়া আবার ব্যোমকেশের মুখে ফিরিয়া আসিল‌, ‘আপনি কাজের লোক‌, অকারণে আমোদ করে বেড়াবেন বিশ্বাস হয় না। কাজেই এসেছেন। কিন্তু কোন কাজ? কয়লাখনির রহস্য উদঘাটন?

ব্যোমকেশ আবার বলিল‌, ‘আপনার কি মনে হয়?’

গোবিন্দবাবুর চক্ষু দু’টি কুঞ্চিত হইয়া ক্রমে দুইটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হইল‌, ‘তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছি। দেখুন‌, আপনি স্থশিয়ার লোক‌, তবু সাবধান করে দিচ্ছি। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করবেন না।’ তাঁহার কুঞ্চিত চক্ষুযুগল একবার ফণীশের দিকে সঞ্চারিত হইল‌, তারপর তিনি টেনিস কোর্টের কিনারায় গিয়া চেয়ারে বসিলেন।

ফণীশের মুখে শঙ্কার ছায়া পড়িয়ছিল‌, সে স্বলিত স্বরে বলিল‌, ‘গোবিন্দবাবু অরবিন্দবাবুর বড় ভাই। উনি যদি বাবাকে বলে দেন—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভয় নেই‌, গোবিন্দবাবু কাউকে কিছু বলবেন না। উনি নিজের দুৰ্বত্ত ছোট ভাইটিকে ভালবাসেন।–চল‌, ভিতরে যাই।’

বাড়ির সামনের বারান্দায় একটি টেবিলে দৈনিক সংবাদপত্র সাপ্তাহিক প্রভৃতি সাজানো রহিয়াছে‌, আমরা সেইখানে গিয়া বসিলাম। ফণীশ একজন তকমাধারী ভৃত্যকে ডাকিয়া তিন গেলাস ঘোলের সরবৎ হুকুম করিল।

বরফ-শীতল সরবৎ চাখিতে চাখিতে দেখিতেছি‌, ঘোর ঘোর হইয়া আসিতেছে। বাহিরে টেনিস খেলা শেষ হইল। সভ্যেরা ভিতরে আসিতেছেন‌, নানা কথার ছিন্নাংশ কানে আসিতেছে। বাড়ির ভিতরে ঘরে ঘরে উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলিয়া উঠিয়াছে। টেবিল-টেনিসের ঘর হইতে খটখট শব্দ আসিতেছে। হঠাৎ কোনও সভ্য উচ্চকণ্ঠে হাঁকিতেছেন–এই বেয়ারা!

সম্ভ্রান্ত সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার একটি চলমান চিত্র।

সরবৎ নিঃশেষ হইলে আমরা সিগারেট ধরাইয়া বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম। মাঝের হলঘরে দুইজন নিঃশব্দ খেলোয়াড় নিরুদ্বেগ মন্থরতায় বিলিয়ার্ড খেলিতেছেন; প্রকাণ্ড টেবিলের উপর তিনটা বল তিনটি শিশুর মত লুকোচুরি খেলিতেছে। —এখানে আমাদের দ্রষ্টব্য কেহ নাই। এখান হইতে টেবিল-টেনিসের ঘরে গেলাম; দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া দেখিলাম‌, হাফ-ভলির খেলা চলিতেছে; খাটাখাট শব্দে বল টেবিলের এপার হইতে ওপারে ছুটোছুটি করিতেছে; ব্যস্ত-সমস্ত একটি শুভ্র বুদ্বুদ। এ ঘরেও আমাদের দর্শনীয় কেহ নাই।

ফরাস-পাত ঘর হইতে মাঝে মাঝে হাল্লার আওয়াজ আসিতেছিল। সেখানে পাশা বসিয়াছে‌, চারজন খেলোয়াড় ছক ঘিরিয়া চতুষ্কোণভাবে বসিয়াছেন। একজন দুহাতে হাড় ঘষিতে ঘষিতে আদূরে সুরে পাশাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন‌, ‘পাশা! বারো-পাঞ্জা-সতেরো! একবারটি বারো-পাঞ্জা সতেরো দেখাও! এমন মার মারব‌, পেটের ছানা বেরিয়ে যাবে।’ তিনি পাশা ফেলিলেন। বিরুদ্ধ পক্ষ হইতে বিপুল হর্ষধ্বনি উঠিল—‘তিনি কড়া! তিনি কড়া।’

আমরা দ্বারের নিকট হইতে অপসৃত হইয়া তাসের ঘরে উপনীত হইলাম।

তাসের ঘরে সব টেবিল এখনও ভর্তি হয় নাই; কোনও টেবিলে একজন বসিয়া পেশেন্স খেলিতেছেন‌, কোনও টেবিলে তিনজন খেলোয়াড় চতুর্থ ব্যক্তির অভাবে গলা-কাটা খেলা খেলিয়া সময় কাটাইতেছেন। একটি টেবিলে চতুরঙ্গ খেলা বসিয়াছে; চারজন খেলোয়াড় গভীর মনঃসংযোগে নিজ নিজ তাস দেখিতেছেন। একজন বলিলেন‌, ‘থ্রি হার্টস।’ কন্ট্র্যাক্ট খেলা।

ফণীশ ফিসফিস করিয়া বলিল‌, ‘যিনি ডাক দিলেন মধুময় সুর‌, আর তাঁর পার্টনার অরবিন্দ হালদার।’

ব্যোমকেশ টেবিলের কাছে গেল না‌, দূর হইতে সেইদিক পানে চাহিয়া রহিল। অরবিন্দ হালদার যে গোবিন্দ হালদারের ছোট ভাই‌, তাহা পরিচয় না দিলেও বোঝা যায়। সেই গেরিলাগঞ্জন রূপ‌, কেবল বয়স কম। মধুময় সুর ফিট্‌ফট শৌখিন লোক‌, চেহারায় ব্যক্তিত্বের অভাব গিলে-করা পাঞ্জাবি ও হীরার বোতাম প্রভৃতি দিয়া পূর্ণ করিবার চেষ্টা দেখা যায়।

খেলা আরম্ভ হইয়াছে‌, ডামি হইয়াছেন বিপক্ষ দলের একজন। ফ্ল্যামের খেলা‌, কাহারও অন্য দিকে মন নাই।

পাঁচ মিনিট খেলা দেখিয়া ব্যোমকেশ ইশারা করিল‌, আমরা বাহিরে আসিলাম। সে সম্ভাব্য আসামীদের দেখিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই‌, শুষ্ক স্বরে বলিল‌, ‘যা দেখবার দেখা হয়েছে‌, চল এবার বাড়ি ফেরা যাক।’

মোটরে বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী দেখলে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনটে মানুষকে দেখলাম‌, তাদের পারিবেশ দেখলাম‌, হাত-পা নাড়া দেখলাম।–ফণীশ‌, কাল সকালে আমরা ওদের বাড়িতে যাব। আলাপ-পরিচয় করা দরকার। আজ যা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কিছু পাব আশা করি না‌, তবু—’

‘আজ কিছু পেয়েছ তাহলে?’

‘পেয়েছি। যদিও সেটা নেতিবাচক।’

পরদিন সকালে ফণীশ বাপের সঙ্গে কয়লাখনিতে গেল না‌, মণীশবাবু একাই গেলেন। ফণীশ আমাদের গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল। গাড়িতে স্টার্ট দিয়া বলিল‌, ‘আগে কোথায় যাবেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার কারুর প্রতি পক্ষপাত নেই‌, যার বাড়ি কাছে তার বাড়িতে আগে চল।’

‘তাহলে মৃগেনবাবুর বাড়িতে চলুন।’

মৃগেন মৌলিকের বাড়িটি অতিশয় সুশ্রী‌, গৃহস্বামীর শৌখিন রুচির পরিচয় দিতেছে। আমাদের মোটর বাগান পার হইয়া গাড়ি-বারান্দায় উপস্থিত হইলে দেখিলাম মৃগেন মৌলিক বাড়ির সম্মুখে ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছে‌, তাহার পরিধানে চিলা পায়জামা ও সিঙ্কের ড্রেসিং গাউন। আমরা গাড়ি হইতে নামিলে সে কাগজ মুড়িয়া আমাদের পানে চোখ তুলিল। স্বাগত সম্ভাষণের হাসি তাহার মুখে ফুটিল না‌, বরঞ্চ মুখ অন্ধকার হইল। আমরা তাহার নিকটবর্তী হইলে সে রূঢ় স্বরে বলিল‌, ‘কি চাই?’

আমরা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। ফণীশ বলিল‌, ‘মৃগেনবাবু্‌, এঁরা আমার বাবার বন্ধু‌, কলকাতা থেকে এসেছেন–’

ফণীশের প্রতি তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া মৃগেন বলিল‌, ‘জানি। ব্যোমকেশ বক্সী কার নাম?’

ফণীশ থাতমত খাইয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি ব্যোমকেশ বক্সী। আপনার সঙ্গে দুটো কথা ছিল।’

মৃগেন মুখ বিকৃত করিয়া অসীম অবজ্ঞার স্বরে বলিল‌, ‘এখানে কিছু হবে না‌, আপনারা যেতে পারেন।’ বলিয়া নিজেই কাগজখানা বগলে লইয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল।

আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। ফণীশের মুখ অপমানে সিন্দূরবর্ণ ধারণ করিয়াছে‌, ব্যোমকেশের অধরে লাঞ্ছিত হাসি। সে বলিল‌, ‘গোবিন্দ হালদার দেখছি আসামীদের সতর্ক করে দিয়েছেন।’

ফণীশ বলিল‌, চলুন‌, বাড়ি ফিরে যাই।’ ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘না‌, যখন বেরিয়েছি তখন কাজ সেরে বাড়ি ফিরব। ফণীশ‌, তুমি লজ্জা পেও না। সত্যান্বেষণ যাদের কাজ তাদের লজ্জা, ঘৃণা‌, ভয় ত্যাগ করতে হয়; চল‌, এবার মধুময় সুরের বাড়িতে।’

মোটরে যাইতে যাইতে আমি বলিলাম‌, কিন্তু কেন? এরকম ব্যবহারের মানে কি? মৃগেন মৌলিক যদি নির্দোষ হয় তাহলে তার ভয় কিসের?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওদের ধারণা হয়েছে। আমি ফণীশের দলের লোক‌, ফণীশকে বাঁচিয়ে ওদের ফাঁসিয়ে দিতে চাই।’

মধুময় সুরের বাড়িটি সেকেলে ধরনের‌, বাগানের কোনও শোভা নাই। বাড়ির সদর বারান্দায় মধুময় সুর গামছা পরিয়া মাদুরের উপর শুইয়া ছিল এবং একটা মুস্কো জোয়ান চাকর তৈল দিয়া তাহার দেহ ডলাই-মলাই করিতেছিল। মধুময়ের শরীর খুব মাংসল নয়‌, কিন্তু একটি নিরেট গোছের ক্ষুদ্র ভূড়ি আছে! আমাদের দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল।

ফণীশ ক্ষীণ কুষ্ঠিত স্বরে আরম্ভ করিল‌, ‘মধুময়বাবু্‌, মাফ করবেন‌, এটা আপনার স্নানের সময়—’

মধুময় তাহার কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া আমাদের দিকে কয়েকবার চক্ষু মিটমিটি করিল‌, তারপর পাখি-পড়া সুরে বলিল‌, ‘আপনারা আমার কাছে কেন এসেছেন‌, আমি প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানি না। যদি কেউ বলে থাকে আমি তার মৃত্যুর রাত্রে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তবে তা মিথ্যে কথা। অন্য কেউ গিয়েছিল। কিনা আমি জানি না‌, আমি যাইনি।’ বলিয়া মধুময় সুর আবার শয়নের উপক্রম করিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ট্যাক্সি-ড্রাইভার কিন্তু আপনাকে সনাক্ত করেছে।’

মধুময় বলিল‌, ট্যাক্সি-ড্রাইভার মিথ্যাবাদী। —আসুন‌, নমস্কার।’

ব্যোমকেশ চন্টু করিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার একটা টর্চ আছে?’

মধুময় বলিল‌, ‘আমার পাঁচটা টাৰ্চ আছে। আসুন‌, নমস্কার।’

মধুময় শয়ন করিল‌, ভূত্য আবার তেল-মৰ্দন আরম্ভ করিল। আমরা চলিয়া আসিলাম।

অরবিন্দ হালদারের বাড়ির দিকে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা আসব মধুময় জানতো‌, আমাদের কী বলবে মুখস্থ করে রেখেছিল। যাই বল‌, মৃগেন মৌলিকের চেয়ে মধুময় সুর ভদ্র। কেমন মিষ্টি সুরে বলল-আসুন‌, নমস্কার। নিমচাঁদ দত্তের ভাষায়-ছেলেটি বে-তরিবৎ নয়।’

অরবিন্দ হালদার ও গোবিন্দ হালদার একই বাড়িতে বাস করেন‌, কিন্তু মহল আলাদা। অরবিন্দ নিজের বৈঠকখানায় ফরাস-ঢাকা তক্তপোশের উপর মোটা তাকিয়া মাথায় দিয়া শুইয়া সিগারেট টানিতেছিল‌, আমাদের দেখিয়া কনুই-এ ভর দিয়া উঠিল। তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ‌, কালো মুখে অক্ষৌরিত দাড়ির কর্কশতা। সে আমাদের পর্যায়ক্রমে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল‌, ‘এস ফণীশ।’

ফণীশ পাংশুমুখে বলিল‌, ‘এঁরা—’

অরবিন্দ বলিল‌, ‘জানি। বসুন আপনারা।’ বলিয়া সিগারেটের কোটা আগাইয়া দিল।

শিষ্টতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, তাই একটু ব্থতমীত হইলাম। ব্যোমকেশ তক্তপোশের কিনারায় বসিল‌, আমরাও বসিলাম। অরবিন্দ সহজ সুরে বলিল‌, ‘কাল রাত্রে মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এখনো খোঁয়ারি ভাঙেনি।–ওরে গদাধর।’

একটি ভূত্য কাচের গেলাসে পানীয় আনিয়া দিল‌, অরবিন্দ এক চুমুকে তাহা নিঃশেষ করিয়া গেলাস ফেরৎ দিয়া বলিল‌, ‘আপনাদের জন্যে কী আনাব বলুন। চা? সরবৎ? বীয়ার?

ব্যোমকেশ বিনীত কণ্ঠে বলিল‌, ‘ধন্যবাদ। ওসব কিছু চাই না‌, অরবিন্দবাবু; আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলবার সুযোগ পেলেই কৃতাৰ্থ হয়ে যাব।’

অরবিন্দ বলিল‌, ‘বিলক্ষণ! কি বলকেন বলুন। তবে একটা কথা গোড়ায় জানিয়ে রাখি। সুন্টু স্থাপনাকে কী বলেছে জানি না‌, কিন্তু প্রশস্ত্রর পোস্কারের মৃত্যুর রাত্রে আমি তার বাড়িতে যাইনি।’

ব্যোমকেশ একটু নীরব থাকিয়া বলিল‌, ‘অরবিন্দবাবু্‌, আমার কোনো কু-মতলব নেই। নির্দোষ বুক্সমুলা মামলায় ফাঁসালে আমার কাজ নয়‌, আমি সত্যান্বেষী। অবশ্য আপনি যদি অপরাধী হন–’

অরবিন্দ বলিল‌, ‘আমি নিরপরাধ। প্রাণহোরর মৃত্যুর রাত্রে আমি তার বাড়ির ত্ৰিসীমানায় যাইনি। এই কথাটা বুঝে নিয়ে যা প্রশ্ন করবেন করুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, ও প্রসঙ্গ না হয় বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু প্ৰাণহারির মৃত্যুর আগে আপনি কয়েকবার তার বাড়িতে গিয়েছিলেন।’

অরবিন্দ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আমরা চারজনে জুয়া খেলতে যেতাম।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জুয়া খেলার সময় ছাড়াও আপনি কয়েকবার একলা তার বাড়িতে গিয়েছিলেন।’

অরবিন্দের মুখে একটা বিশ্রী লুচ্চামির হাসি খেলিয়া গেল‌, সে বলিল‌, ‘তা গিয়েছিলাম।’

‘কি জন্যে গিয়েছিলেন?’

নির্লজভাবে দন্ত বিকাশ করিয়া অরবিন্দ বলিল‌, ‘মোহিনীকে দেখতে। তার সঙ্গে ভাব জমাতে।’

ব্যোমকেশ বাঁকা সুরে বলিল‌, ‘কিন্তু সুবিধে হল না?’

অরবিন্দের মুখের হাসি মিলাইয়া গেল‌, সে বড় বড় চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিল‌, ‘সুবিধে হল না—তার মানে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মানে বুঝতেই পারছেন। আপনি কি বলতে চান যে-?’

অরবিন্দ হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল‌, তারপর হাসি থামাইয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি মস্ত একজন ডিটেকটিভ হতে পারেন। কিন্তু দুনিয়াদারির কিছুই জানেন না। মোহিনী তো তুচ্ছ মেয়েমানুষ‌, দাসীবাদী। টাকা ফেললে এমন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কত টাকা ফেলেছিলেন?’

অরবিন্দ দুই আঙুল তুলিয়া বলিল‌, ‘দু’হাজার টাকা।’

‘মোহিনীকে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন? দাসীবাদীর পক্ষে দাম একটু বেশি নয় কি?’

‘মোহিনীকে দিইনি। মোহিনীর দালালকে দিয়েছিলাম। প্ৰাণহরি পোদ্দারকে।’ অরবিন্দের কথাগুলো বিষমাখানে।

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ও কথা যাক। প্রাণহরি পোদ্দার লোকটা কেমন ছিল?’

অরবিন্দ নীরসকণ্ঠে বলিল‌, ‘চামার ছিল‌, অর্থ-পিশাচ ছিল। সাধারণ মানুষ যেমন হয় তেমনি ছিল।’

সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে অরবিন্দের ধারণা খুব উচ্চ নয়। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জুয়াতে প্রাণহারি পোদ্দার আপনাদের অনেক টাকা ঠকিয়েছিল?’

অরবিন্দ তাচ্ছিল্যভরে বলিল‌, ‘সে জিতেছিল আমরা হেরেছিলাম। ঠকিয়েছিল কিনা বলতে পারি না।’

‘তবে তাকে ঠেঙাতে গিয়েছিলেন কেন?’

অরবিন্দ উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়া থামিয়া গেল‌, ব্যোমকেশকে একবার ভালভাবে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘কে বললে ঠেঙাতে গিয়েছিলাম? যারা গিয়েছিল তারা নিজের কথা বলুক‌, আমি কাউকে ঠেঙাতে যাইনি।’

আমি ফণীশের দিকে অপাঙ্গ-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। সে হেঁট মুখে শুনিতেছিল‌, একবার চোখ তুলিয়া অরবিন্দের পানে চাহিল‌, তারপর আবার মাথা হেঁট করিল।

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘আপনি যেটুকু বললেন‌, তাতেও গরমিল আছে‌, মোহিনীর কথার সঙ্গে আপনার কথা মিলছে না। হয়তো আপনার কথাই সত্যি। আচ্ছা‌, নমস্কার। আপনার দাদাকে বলবেন‌, পুলিসকে ঘুষ দিতে যাওয়া নিরাপদ নয়‌, তাতে সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। সব পুলিস অফিসার ঘুষখোর নয়।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress