Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কহেন কবি কালিদাস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

কহেন কবি কালিদাস – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

যে শহরে আমি ও ব্যোমকেশ হগুপ্তাখানেকের জন্য প্রবাসযাত্ৰা করিয়াছিলাম তাহাকে কয়লা-শহর বলিলে অন্যায় হইবে না। শহরকে কেন্দ্ব করিয়া তিন-চার মাইল দূরে দূরে গোটা চারেক কয়লার খনি। শহরটি যেন মাকড়সার মত জাল পাতিয়া মাঝখানে বসিয়া আছে‌, চারিদিক হইতে কয়লা আসিয়া রেলওয়ে স্টেশনে জমা হইতেছে এবং মালগাড়িতে চড়িয়া দিগবিদিকে যাত্ৰা করিতেছে। কর্মব্যস্ত সমৃদ্ধ শহর; ধনী ব্যবসায়ীরা এখানে আসিয়া আড্ডা গাড়িয়াছে‌, কয়েকটি বড় বড় ব্যাঙ্ক আছে‌, উকিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার দালাল মহাজনের ছড়াছড়ি। পথে মোটর ট্যাক্সি বাস ট্রাকের ছুটাছুটি। কাঁচা মালের সহিত কাঁচা পয়সার অবিরাম বিনিময়। শহরটিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেছে-কয়লা। চারিদিকে কয়লার কীর্তন‌, কয়লার কলকোলাহল। শহরটি মোটেই প্রাচীন নয়‌, কিন্তু দেখিয়া মনে হয় অদৃশ্য কয়লার গুড়া ইহার সর্বাঙ্গে অকালবার্ধক্যের ছায়া ফেলিয়াছে।

যাঁহার আহ্বানে আমরা এই শহরে আসিয়াছি তিনি ফুলঝুরি নামক একটি কয়লাখনির মালিক‌, নাম মণীশ চক্রবর্তী। কয়েক মাস যাবৎ তাঁহার খনিতে নানা প্রকার প্রচ্ছন্ন উৎপাত আরম্ভ হইয়াছিল। খনির গর্ভে আগুন লাগা‌, মূল্যবান যন্ত্রপাতি ভাঙ্গিয়া নষ্ট হওয়া ইত্যাদি দুর্ঘটনা ঘটিতেছিল; কুলি-কাবাড়িদের মধ্যেও অহেতুক অসন্তোষ দেখা দিয়াছিল। একদল লোক তাঁহার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই; এরূপ অবস্থায় যাহা মনে করা স্বাভাবিক তাহাই মনে করিয়া মণীশবাবু পুলিস ডাকিয়াছিলেন। অনেক নূতন লোককে বরখাস্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। শেষ পর্যন্ত গোপনে ব্যোমকেশকে আহ্বান করিয়াছিলেন।

একটি চৈত্রের সন্ধ্যায় আমরা মণীশবাবুর গৃহে উপনীত হইলাম। শহরের অভিজাত অঞ্চলে প্রশস্ত বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি। মণীশবাবু সবেমাত্র খনি হইতে ফিরিয়াছেন‌, আমাদের সাদর সম্ভাষণ করিলেন। মণীশবাবুর বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ‌, গৌরবর্ণ সুপুরুষ‌, এখনও শরীর বেশ সমর্থ আছে। চোয়ালের হাড়ের কঠিনতা দেখিয়া মনে হয় একটু কড়া মেজাজের লোক।

ড্রয়িং-রুমে বসিয়া কিছুক্ষণ কথাবাতার পর মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, এখানে কিন্তু আপনাদের ছদ্মনামে থাকতে হবে। আপনার নাম গগনবাবু্‌, আর অজিতবাবুর নাম সুজিতবাবু। আমার আসল নাম চলে সকেলই বুঝতে পারবে আপনার কী উদ্দেশে এসেছে। সেটা বাঞ্ছনীয় নয়।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘বেশ তো‌, এখানে যতদিন থাকব। গগনবাবু সেজেই থাকব। অজিতেরও সুজিত সাজতে আপত্তি নেই।’

দ্বারের কাছে একটি যুবক দাঁড়াইয়া অস্বচ্ছন্দভাবে ছট্‌ফট করিতেছিল‌, বোধহয় ব্যোমকেশের সহিত পরিচিত হইবার জন্য প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিল। মণীশবাবু ডাকিলেন‌, ‘ফণী।’

যুবক উদগ্ৰীবিভাবে ঘরে প্রবেশ করিল। মণীশবাবু আমাদের দিকে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আমার ছেলে ফণীশ। —ফণী‌, তুমি জানো এরা কে‌, কিন্তু বাড়ির বাইরে আর কেউ যেন জানতে না পারে।’

ফণীশ বলিল, ‘আজ্ঞে না।’

‘তুমি এবার এঁদের গোস্ট-রুমে নিয়ে যাও। দেখো যেন ওঁদের কোনো অসুবিধা না হয়।–আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, চা তৈরি হচ্ছে।

ড্রয়িং-রুমের লাগাও গোস্ট-রুম। বড় ঘর, দুটি খাট! টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি উপযোগী আসবাবে সাজানো, সংলগ্ন বাথরুম। ফণীশ আমাদের ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল ।

ছেলেটিকে কেশ শান্তশিষ্ট এবং ভালোমানুষ ঋলিয়া মনে হয়। বাপের মতই সুপুরুষ, কিন্তু দেহ-মনের পূর্ণ পরিণতি ঘটিতে এখনও বিলম্ব আছে; ভাবভঙ্গীতে একটু ছেলেমানুষীর রেশ রহিয়া গিয়াছে । বয়স আন্দাজ তেইশ-চব্বিশ।

কেশবাস পরিবর্তন করিতে করিতে দুই-চারিটিা কথা হইল; ফণীশ লাজুকভাবে ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তর দিল। সে পিতার একমাত্র সন্তান, এক বছর আগে তাহার বিবাহ হইয়াছে। সে প্রত্যহ পিতার সঙ্গে কয়লাখনিতে গিয়া কাজকর্ম দেখাশুনা করে। লক্ষ্য করিলাম, ব্যোমকেশের কথার উত্তর দিতে দিতে সে যেন একটা অন্য কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু বলিতে গিয়া সংকোচবেশে থামিয়া যাইতেছে।

ফণীশ কী বলিতে চায় শোনা হইল না, আমরা বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। ইতিমধ্যে চা ও জলখাবার উপস্থিত হইয়াছে; আমরা বসিয়া গোলাম।

চায়ের আসরে কিন্তু মেয়েদের দেখিলাম না, কেবল আমরা চারজন। অথচ বাড়িতে অন্তত দুইটি স্ত্রীলোক নিশ্চয় আছেন। মণীশবাবু বোধকরি পুরাপুরি স্বদেশীবৰ্জন করেন না। তা আজকালকার সাড়ে-বত্রিশ-ভাজার যুগে একটু অন্তরাল থাকা মন্দ কি ?

পানাহার শেষ করিয়া সিগারেট ধরিইয়াছি, একটি প্রকাণ্ড গাড়ি আসিয়া বাড়ির সামনে থামিল। গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। গেরিলার মত চেহারা, কালিমাবেষ্টিত লোক দুইটিতে মন্থর কুটিলতা। মুখ দেখিয়া চরিত্র অধ্যয়ন যদি সম্ভব হইত বলিতাম লোকটি মাহাপাপিষ্ঠ।

মণীশবাবু খুব খাতির করিয়া আগস্তুককে ঘরে আনিলেন, আমাদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘ইনি শ্রীগোবিন্দ হালদার, এখানকার একটি কয়লাখনির মালিক। এঁরা হচ্ছেন শ্ৰীগগন মিত্র এবং সুজিত কন্দ্যোপাধ্যায় ; আমার বন্ধু, কলকাতায় থাকল। বেড়াতে এসেছেন।’

গোবিন্দবাবু তাঁহার শনৈশ্চর চক্ষু দিয়া আমাদের সমীক্ষণ করিতে করিতে মণীশবাবুকে বলিলেন, ‘খবর নিতে এলাম। খনিতে আর কোনো গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?’

মণীশবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, ‘গণ্ডগোল তো লেগেই আছে। পরশু রাত্রে এক কাণ্ড। হঠাৎ পাঁচ নম্বর পিট্‌-এর পাম্প বন্ধ হয়ে গেল। ভাগ্যে পাহারাওয়ালার সজাগ ছিল তাই বিশেষ অনিষ্ট হয়নি। নইলে—’

গোবিন্দবাবু মুখে চুকচুক শব্দ করিলেন। মণীশবাবু বলিলেন, ‘আপনারা তো বেশ আছেন, যত উৎপাত আমার খনিতে। কেন যে হতভাগাদের আমার দিকেই নজর তা বুঝতে পারি না।’

গোবিন্দবাবু বলিলেন, ‘আমার খনিতেও মাস ছয়েক আগে গোলমাল শুরু হয়েছিল। আমি জানি পুলিসের দ্বারা কিছু হবে না, আমি সরাসরি চুর লংগালাম। আটজন লোককে গুপ্তচর লাগিয়েছিলাম, দিন অষ্টেকের মধ্যে তারা খবর এনে দিল কার্য শয়তানি করছে; পাঁচটা লোক ছিল পালের গোদা, তাদের একদিন ধরে এনে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলাম। তাদের বরখাস্ত করতে হল না, নিজে থেকেই পালিয়ে গেল। সেই থেকে সব ঠাণ্ডা আছে।’ বলিয়া তিনি দস্তুর গেরিলা-হাস্য হাসিলেন।

মণীশবাবু বলিলেন, ‘আমিও গুপ্তচর লাগিয়েছিলাম কিন্তু কিছু হল না। যাকগে——’ তিনি অন্য কথা পাড়িলেন। সাধারণভাবে কথাবার্তা চলিতে লাগিল। গোবিন্দবাবুর জন্য চা-জলখাবার আসিল, তিনি তাহা সেবন করিলেন। তাঁহার চক্ষু দুইটি কিন্তু আমাদের আশেপাশেই ঘুরিতে লাগিল। আমরা নিছক বেড়ানোর উদ্দেশ্যে এখানে আসিয়াছি একথা বোধহয় তিনি বিশ্বাস করেন নাই।

ঘণ্টাখানেক পরে তিনি উঠিলেন। মণীশবাবু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি-বারান্দা পর্যন্ত গেলেন‌, আমরাও গেলাম। ড্রাইভার মোটরের দরজা খুলিয়া দিল। গোবিন্দবাবু মোটরে উঠিবার উপক্রম করিয়া ব্যোমকেশের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া হাসি-হাসি মুখে বলিলেন, ‘দেখুন চেষ্টা করে।’

তিনি মোটরে উঠিয়া বসিলেন‌, মোটর চলিয়া গেল।

মণীশবাবু এবং আমরা কিছুক্ষণ দৃষ্টি-বিনিময় করিলাম‌, তারপর তিনি বিষণ্ণ সুরে বলিলেন‌, ‘গোবিন্দ হালদার লোকটা ভারি সেয়ানা‌, ওর চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়।’

রাত্রির খাওয়া-দাওয়া সারিয়া শয়ন করিতে এগারোটা বাজিল। শরীরে ট্রেনের ক্লান্তি ছিল‌, মাথার উপর পাখা চালাইয়া দিয়া শয়ন করিবার সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে ডুবিয়া গেলাম।

পরদিন যখন ঘুম ভাঙ্গিল তখন বেলা আটটা বাজিয়া গিয়াছে।

একজন ভৃত্য জানাইল‌, বড়কর্তা এবং ছোটকত ভোরবেলা কোলিয়ারিতে চলিয়া গিয়াছেন। আমরা তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া দেখি আমাদের চা ও জলখাবার টেবিলের উপর সাজাইয়া একটি যুবতী দাঁড়াইয়া আছে।

বাড়ির মেয়েদের দেখি নাই‌, আমরা একটু থতমত খাইয়া গেলাম। ব্যোমকেশের সুস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে মেয়েটি নীচু হইয়া ঈষৎ জড়িতম্বরে বলিল‌, ‘আমি ইন্দিরা‌, এবাড়ির বৌ। আপনারা খেতে বসুন।’

ফণীশের বৌ। শ্যামবর্ণা অনুদীর্ঘাঙ্গী মেয়ে‌, মুখখানি তর্‌তরে; বয়স আঠারো-উনিশ। দেখিলেই বোঝা যায় ইন্দিরা লাজুক মেয়ে‌, অপরিচিত বয়স্থ ব্যক্তির সহিত সহজভাবে আলাপ করার অভ্যাসও তাহার নাই। নেহাত বাড়িতে পুরুষ নাই‌, তাই বেচারী বাধ্য হইয়া অতিথি সৎকার করিতে আসিয়াছে।

আমরা আহারে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বোসো না‌, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’

ইন্দিরা একটি সোফার কিনারায় বসিল।

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় একটু চুমুক দিয়া গলা ভিজাইয়া লইল‌, তারপর জলখাবারের রেকবি টানিয়া লইল‌, ‘আজ আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেল। কত কি ভোরবেলাই কাজে বেরিয়ে যান?’

‘হ্যাঁ‌, বাবা সাতটার সময় বেরিয়ে যান।’

‘আর তোমার কর্তা?’

ইন্দিরার ঘাড় অমনি নত হইয়া পড়িল। সে চোখ না তুলিয়াই অস্ফুটস্বরে বলিল‌, ‘উনিও।’ তারপর জোর করিয়া লজা সরাইয়া বলিল‌, ‘ওঁরা বারোটার সময় ফিরে খাওয়া-দাওয়া করেন‌, আবার তিনটের সময় যান।’

ব্যোমকেশ তাহার পানে চাহিয়া মিটমিটি হাসিল‌, আর কিছু বলিল না। আহার করিতে করিতে আমি ইন্দিরাকে লক্ষ্য করিলাম। সে চুপটি করিয়া বসিয়া আছে এবং মাঝে মাঝে ব্যোমকেশের প্রতি চকিত কটাক্ষপাত করিতেছে। মনে হইল অতিথি সৎকার ছাড়াও অন্য কোনও অভিসন্ধি আছে। ব্যোমকেশ কে তাহা সে জানে‌, ফণীশ স্ত্রীকে নিশ্চয় বলিয়াছে‌, তাই ব্যোমকেশকে কিছু বলিতে চায়। সে মনে মনে কিছু সংকল্প করিয়াছে কিন্তু সংকোচবশত বলিতে পারিতেছে না। কাল রাত্রে ফণীশের মুখেও এইরূপ দ্বিধার ভাব দেখিয়ছিলাম।

প্রাতরাশ শেষ করিয়া চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ রুমালে মুখ মুছিল‌, তারপর প্রসন্নস্বরে বলিল‌, ‘কি বলবে এবার বল।’

আমি ইন্দিরার মুখে সংকল্প ও সংকোচের টানাটানি লক্ষ্য করিতেছিলাম‌, দেখিলাম সে চমকিয়া উঠিল‌, বিস্ফোরিত চোখে চাহিয়া নিজের অজ্ঞাতসারেই উঠিয়া দাঁড়াইল। তারপর তাহার সব উদ্বেগ এক নিশ্বাসে বাহির হইয়া আসিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার স্বামীকে রক্ষে করুন। তাঁর বড় বিপদ।’

ব্যোমকেশ উঠিয়ে গিয়া সোফায় বসিল, ইন্দিরাকে পাশে বসিবার ইঙ্গিত করিয়া বলিল, ‘বোসো। কি বিপদ তোমার স্বামীর আমাকে বলো।’

ইন্দিরা তেরছাভাবে সোফার কিনারায় বসিল‌, শীর্ণ সংহত স্বরে বলিল‌, ‘আমি-আমি সব কথা গুছিয়ে বলতে পারব না। আপনি যদি সাহায্য করেন‌, উনি নিজেই বলবেন।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘খনি সম্বন্ধে কোনো কথা কি?’

ইন্দিরা বলিল‌, ‘না‌, অন্য কথা। আপনারা বাবাকে যেন কিছু বলবেন না। বাবা কিছু জানেন না।’

ব্যোমকেশ শান্ত আশ্বাসের সুরে বলিল‌, ‘আমি কাউকে কিছু বলব না‌, তুমি ভয় পেও না।’

‘ওঁকে সাহায্য করবেন?’

‘কি হয়েছে কিছুই জানি না। তবু তোমার স্বামী যদি নির্দোষ হন নিশ্চয় সাহায্য করব।’

‘আমার স্বামী নির্দোষ।’

‘তবে নিৰ্ভয়ে থাকো।’

বাড়ির পাশের দিকে বাগানের কিনারায় একসারি ঘর। ইন্দিরার মুখে হাসি ফুটিবার পর আমরা সিগারেট টানিতে টানিতে সেইদিকে গেলাম।

সামনের ঘর হইতে একটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বাহির হইয়া আসিলেন। পরিধানে ফরাসডাঙ্গার ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি‌, ফিটফট চেহারা। চুলে নিশ্চয় কলপ লাগাইয়া থাকেন‌, কালো চুলের নীচে শ্বেতবর্ণ অন্ধুর মাথা তুলিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার নাম গগন মিত্র‌, ইনি সুজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। মণীশবাবুর অতিথি।’

ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হইয়া আমাদের সংবর্ধনা করিলেন‌, ‘আসুন‌, আসুন। আপনারা আসবেন কর্তার মুখে শুনেছিলাম। আমি সুরপতি ঘটক‌, এই অফিসের দেখাশোনা করি।’

সুরপতিবাবু আমাদের প্রকৃত নাম জানেন না। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এটা বুঝি কয়লাখনির অফিস। আপনি অফিস-মাস্টার।’

সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে। কয়লাখনিতে একটা ছোট অফিস আছে‌, এটা বড় অফিস। আসুন না দেখবেন।’

ঘরগুলি একে একে দেখিলাম। বিভিন্ন ঘরে কেরানিরা খাতপত্র লইয়া কাজ করিতেছে‌, টাইপরাইটারের খটখটি শব্দ হইতেছে‌, দর্শনীয় কিছু নাই। ঘুরিয়া ফিরিয়া শেষে আমরা সুরপতিবাবুর অফিসে বসিলাম।

সাধারণভাবে কিছুক্ষণ বাক্যালাপ চালাইবার পর ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে বলি‌, আমরা দুই বন্ধু মিলে একটা ছোটখাটো কয়লাখনি কেনবার মতলব করেছি। এখানে নয়‌, অন্য জেলায়। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কি করে কয়লাখনি চালাতে হয় আমরা কিছুই জানি না; তাই মণীশবাবুর খনি দেখতে এসেছি। অফিসের কাজ‌, খনির কাজ‌, সব বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই।’

সুরপতিবাবু মহা উৎসাহে বলিলেন‌, ‘নিশ্চয়‌, নিশ্চয়। এ আর বেশি কথা কি? অফিসের কাজ দুদিনে শিখে যাবেন; আর খনির কাজও এমন কিছু শক্ত নয়। তাছাড়া যদি দরকার হয় আমি আপনাকে খুব ভাল লোক দিতে পারি।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি রকম লোক?’

সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘অফিসের কাজ জানে‌, কোলিয়ারির কাজ জানে এমন লোক। আমার নিজের হাতে তৈরি করা লোক।’‌

ব্যোমকেশ আগ্রহ দেখাইয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি! তা কাজ-জোনা ভাল লোক পেলে আমরা নেব। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা হবে। অফিসের কাজকর্মও দেখব। আমরা এখন কিছুদিন আছি।’

অফিস হইতে ফিরিয়া আসিলাম।

বারোটার সময় ফণীশ ও মণীশবাবু খনি হইতে ফিরিলেন। স্নানাহার সারিতে একটা বাজিয়া গেল। তারপর খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়া আমরা চারজন মোটরে চড়িয়া কয়লাখনিতে চলিলাম।

মস্ত বড় মোটর। ফণীশ চালাইয়া লইয়া চলিল‌, আমরা তিনজন পিছনে বসিলাম।

মোটর শহর ছাড়াইয়া নির্জন রাস্তা ধরিল। মাইল তিনেক দূরে কয়লাখনি।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সকলে সুরপতিবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। উনি কতদিন আপনার কাজ করছেন?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘প্রায় কুড়ি বছর। পাকা লোক।’

ব্যোমকেশ কহিল‌, ‘ওঁকে বলেছি আমরা একটা কয়লাখনি কিনব। তাই খোঁজ খবর নিতে এসেছি। আমাদের সত্যিকার পরিচয় দিইনি।’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘ভালই করেছেন। সুরপতি। অবশ্য বিশ্বাসী লোক‌, দোষের মধ্যে বছর দুই আগে দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করেছে।’

সুরপতিবাবুর চুলের কলপ এবং শৌখিন জাম-কাপড়ের অর্থ পাওয়া গেল। প্রৌঢ় বয়সে তরুণী ভাৰ্য্যর চোখে যৌবনের বিভ্বম সৃষ্টি করার চেষ্টা স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সম্প্রতি কেউ আপনার খনি কেনবার প্রস্তাব করেছিল?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘সম্প্রতি নয়‌, কয়েক বছর আগে। একজন মাড়োয়ারী। ভাল দাম দিতে চেয়েছিল‌, আমি বেচিনি।’

ব্যোমকেশ দ্বিতীয় প্রশ্ন করিল‌, ‘এখানে অন্য যেসব খনির মালিক আছেন তাঁদের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব আছে?’

মণীশবাবু বলিলেন‌, ‘গাঢ় প্রণয় আছে এমন কথা বলতে পারি না‌, তবে মুখোমুখি ঝগড়া কারুর সঙ্গে নেই।’

‘এমন কেউ আছেন যিনি বাইরে ভদ্রতার মুখোশ পরে ভিতরে ভিতরে আপনার অনিষ্ট চিন্তা করছেন?’

‘থাকতে পারে‌, কিন্তু তাকে চিনিব কি করে?’

‘তা বটে। কাল রাত্রে যিনি এসেছিলেন-গোবিন্দ হালদার-তিনি কি রকম লোক?’

মণীশবাবু চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘গোবিন্দ হালদারকে চেনা শক্ত। পাঁকাল মাছের মত চরিত্র‌, ধরা-ছোঁয়া যায় না। তবে গোবিন্দবাবুর ছোট ভাই এবং অংশীদার অরবিন্দ অতি বদ লোক। মাতাল‌, জুয়াড়ী্‌্‌, দুশ্চরিত্র। বছর কয়েক আগে স্ত্রীটা আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছে। তারপর থেকে অরবিন্দ একেবারে নামকটা সেপাই হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

আর কোনও কথা হইল না‌, আমরা কয়লাখনির এলাকায় প্রবেশ করিলাম।

কয়লাখনির বিস্তারিত বর্ণনা দিবার ইচ্ছা নাই। যাঁহারা স্বচক্ষে কয়লাখনি দেখেন নাই তাঁহারা নিশ্চয় রঙ্গমঞ্চে বা চিত্রপটে দেখিয়াছেন‌, এমন কিছু নয়নাভিরাম দৃশ্য নয়। বিশেষত এই কাহিনীতে কয়লাখনির স্থান খুবই অল্প; কয়লাখনিকে এই কাহিনীর কালো পশ্চাৎপট বলাই সঙ্গত। পশ্চাৎপট না থাকিলে কাহিনী উলঙ্গ হইয়া পড়ে‌, তাই রাখিতে হইয়াছে।

কয়লা! যাহার জোরে যন্ত্র চলিতেছে তাহাকে যন্ত্রের সাহায্যে মৃত্তিকার গভীর গর্ভ হইতে টানিয়া আনা হইতেছে; সভ্যতার চাকা ঘুরিতেছে। নমো যন্ত্র। তব খনি-খনিত্র নখ-বিদীর্ণ ক্ষিতি বিকীর্ণ অস্ত্র! নমো যন্ত্র। অলমিতি।

খনির ম্যানেজার তারাপদবাবুর সঙ্গে পরিচয় হইল। বয়স্ক লোক‌, খনির সীমানার মধ্যে তাঁহার বাসস্থান; রাশভারী জবরদস্ত লোক বলিয়া মনে হয়। তিনি আমাদের লইয়া খনির বিভিন্ন অংশের কার্যকলাপ দেখাইলেন। খনির গর্ভে অবতরণ করিবার প্রস্তাবও করিয়াছিলেন‌, কিন্তু আমরা রাজী হইলাম না। সীতা পাতাল প্রবেশ করিয়াছিলেন তাহার যথেষ্ট কারণ ছিল; আমাদের সেরাপ কোনও কারণ নাই।

অপরাহ্নে আমরা তারাপদবাবুর অফিসে চা খাইলাম। সেখানে খনির ডাক্তার যতীন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্য উচ্চ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা হইল। কাজের কথা কিছু হইল না‌, সাধারণভাবে আলাপ-আলোচনা চলিতে লাগিল। বলা বাহুল্য‌, আমরা ছদ্মনামেই রহিলাম। এক সময় লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশ ডাক্তার ঘোষের সঙ্গে বেশ ভাব জমাইয়া ফেলিয়াছে‌, ঘরের এক কোণে বসিয়া নিবিষ্ট মনে তাঁহার সহিত গল্প করিতেছে। ডাক্তার ঘোষ আমাদের সমবয়স্ক্‌্‌, তিনিও খনিতেই ডাক্তারখানা ও হাসপাতাল লইয়া থাকেন। তাঁহার কোট-প্যান্টুলুন-পরা চেহারায় জীবন-ক্লান্তির একটু আভাস পাওয়া যায়।

তারপর সন্ধ্যা হইলে আমরা আবার মোটরে চড়িয়া বাড়ির দিকে যাত্ৰা করিলাম।

রাত্রে আহারাদির পর মণীশবাবু উপরে শয়ন করিতে গেলেন‌, আমরা নিজের ঘরে আসিলাম। ফণীশ আমাদের সঙ্গে আসিল।

ব্যোমকেশ পাখা চালাইয়া দিয়া নিজের শয্যায় লম্বা হইল‌, সিগারেট ধরাইয়া ফণীশকে বলিল‌, ‘বোসো। কী কাণ্ড বাধিয়েছ? বৌমাকে এত উদ্বিগ্ন করে তুলেছ কেন?’

ফণীশ চেয়ারে বসিয়া হাত কচুলাইতে লাগিল‌, তারপর কুষ্ঠিত স্বরে বলিল‌, ‘ইন্দিরাকে রাজী করিয়েছিলাম। আপনাকে বলতে‌, নিজে বলতে সাহস হয়নি—’

‘কিন্তু কথাটা কী? তোমাদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ভারি গুরুতর ব্যাপার।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, গুরুতর ব্যাপার। একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছি ঘটনাচক্ৰে। বাবা যদি জানতে পারেন–’

ব্যোমকেশ বিছানায় উঠিয়া বসিল‌, ‘খুনের মামলা।’

ফণীশ শীর্ণকণ্ঠে বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, বিশ্ৰী ব্যাপার। পুলিস তদন্ত শুরু করেছে‌, তারা জানতে পেরেছে যে আমরা–

‘কি হয়েছিল সব কথা গুছিয়ে বল।’

ফণীশ অবশ্য সব কথা গুছাইয়া বলিতে পারিল না। তাহার জেট-পাকানো কাহিনীকে আমি যথাসম্ভব সিধা করিয়া লিখিতেছি।–

এই শহরে একটি ক্লাব আছে। কৌতুকবশে তাহার নামকরণ হইয়াছো-কয়লা ক্লাব। ক্লাবের চাঁদার হার খুব উচু‌, তাই বড় মানুষ ছাড়া অন্য কেহ ইহার সভ্য হইতে পারে না। ফণীশ এই ক্লাবের সভ্য। আরও অনেক গণ্যমান্য সভ্য আছে; তন্মধ্যে উলুডাঙ্গা কয়লাখনির মালিক মৃগেন্দ্ব মৌলিক‌, ধুবিপোতা খনির মধুময় সুর এবং শিমুলিয়া খনির অরবিন্দ ও গোবিন্দ হালদার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ক্লাবে অপরাহ্নে টেনিস খেলা‌, ব্যাডমিণ্টন খেলা হয়; সন্ধ্যার পর বিলিয়ার্ড্‌্‌, পিংপং‌, তাস-পাশা চলে। বাজি রাখিয়া তাস খেলা হয়। কিন্তু ক্লাবের নিয়মানুযায়ী বেশি টাকা বাজি রাখা যায় না; তাই যাহাদের রক্তে জুয়ার নেশা আছে তাহাদের মন ভরে না। অরবিন্দ হালদার এই অতৃপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। কিন্তু উপায় কি? শহরে ভদ্রভাবে জুয়া খেলার অন্য কোনও আস্তানা নাই।

বছরখানেক আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ক্লাবের সভ্য হইয়াছিলেন। পয়সাওয়ালা লোক‌, মহাজনী কারবার খুলিয়াছিলেন‌, শহরে নবাগত। বাজার অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র অফিস আছে‌, কিন্তু থাকেন শহরের বাহিরে নির্জন রাস্তার ধারে এক বাড়িতে। শকুনি-মার্কা চেহারা‌, নাম প্রাণহারি পোদ্দার।

পোদ্দার মহাশয় ক্লাবে আসিয়া বসিয়া থাকেন। তাঁহার সমবয়স্ক বৃদ্ধ ক্লাবে কেহ নাই‌, বেশির ভাগই ছেলে-ছোকরা‌, দুচারজন মধ্যবয়স্ক আছেন। ক্রমে দু’একজনের সঙ্গে পরিচয় হইল। কিন্তু বয়সের পার্থক্যবশত কাহারও সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠত হইল না।

ফণীশ‌, মৃগেন মৌলিক‌, মধুময় সুর এবং অরবিন্দ হালদার এই চারজন মিলিয়া ক্লাবে একটি গোষ্ঠী রচনা করিয়াছিল। ফণীশ ছিল এই চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে ছোট‌, আর অরবিন্দ হলুদ ছিল সবচেয়ে বয়সে বড়। তাহার বয়স আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ; দলের মধ্যে সে-ই ছিল অগ্রণী।

একদিন সন্ধ্যার পর ইহারা ক্লাবের একটা ঘরে বসিয়া ব্রিজ খেলিতেছিল‌, পোদ্দার মহাশয় আসিয়া তাহাদের খেলা দেখিতে লাগিলেন। টেবিলের চারিপাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কে কেমন হাত পাইয়াছে দেখিলেন। অরবিন্দ অলসকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি কন্ট্রাক্ট ব্রিজ জানেন?’

বৃদ্ধ একটু হাসিয়া বলিলেন‌, ‘জানি।’

‘খেলবেন?’

‘খেলব। কি রকম বাজি?’

‘এক টাকা পয়েণ্ট। চলবে?

‘চলবে।’

যে রাবার খেলা হইতেছিল তাহা শেষ হইলে তাস কাটিয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন বাহির হইয়া গেল। প্ৰাণহরি পোদ্দার খেলিতে বসিলেন।

দেখা গেল পোদ্দার মহাশয় অতি নিপুণ খেলোয়াড়। কিন্তু সেদিন তাঁহার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না‌, ভাল হাত পাইলেন না। খেলার শেষে হিসাব করিয়া দেখা গেল। তিনি একুশ টাকা হরিয়াছেন। তিনি টাকা শোধ করিয়া দিলেন।

তারপর হইতে প্ৰাণহারিবাবু প্ৰায় প্রত্যহই ফণীশদের দলে খেলিতে বসেন। কখনও হারেন‌, কখনও জেতেন; সকল অবস্থাতেই তিনি নির্বিকার। এইভাবে তিনি ফণীশদের দলের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেলেন।

কয়েকমাস। এইভাবে কাটিল।

গত ফান্ধুন মাসে একদিন খেলিতে বসিয়া প্ৰাণহারিবাবু বলিলেন‌, ‘আপনারা ব্রিজ ছাড়া অন্য কোনো খেলা খেলেন না?’

মধুময় সুর প্রশ্ন করিল‌, ‘কি রকম খেলা?’

প্ৰাণহরি বলিলেন‌, ‘এই ধরুন‌, পোকার কিংবা রানিং ফ্লাশ।’

মৃগেন মৌলিক বলিল‌, ‘আমরা সব খেলাই খেলতে জানি। কিন্তু ক্লাবে জুয়া খেলার নিয়ম নেই। ব্রিজ তো আর জুয়া নয়‌, game of skill.’ বলিয়া নাকের মধ্যে ব্যঙ্গ-হাস্য করিল।

প্রাণহরি তখন কিছু বলিলেন না। খেলা শেষ হইলে বলিলেন‌, ‘একদিন আসুন না। আমার বাসায়‌, নতুন খেলা খেলবেন।’

কাহারও আপত্তি হইল না। অরবিন্দ বলিল‌, ‘মন্দ কি। আপনি কোথায় থাকেন?’

প্রাণহরি বলিলেন‌, ‘শহরের বাইরে উলুডাঙা খনির রাস্তায় আমার বাসা। একলা থাকি‌, আপনারা যদি আসেন বেশ জমজমাট হবে। কালই আসুন না।’

সকলে রাজী হইল। প্ৰাণহারি ট্যাক্সি ধরিয়া চলিয়া গেলেন। তাঁহার নিজের গাড়ি নাই‌, ট্যাক্সির সহিত বাঁধা ব্যবস্থা আছে‌, ট্যাক্সিতেই যাতায়াত করেন।

পরদিন সন্ধ্যার পর চারজন অরবিন্দের মোটরে চড়িয়া প্রাণহোরর গৃহে উপস্থিত হইল। শহরের সীমানা হইতে মাইল দেড়েক দূরে নির্জন রাস্তার উপর দোতলা বাড়ি‌, আশেপাশে দু-তিনশত গজের মধ্যে অন্য বাড়ি নাই।

প্ৰাণহারিবাবু পরম সমাদরের সহিত তাহাদের অভ্যর্থনা করিলেন‌, নীচের তলার একটি সুসজ্জিত ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। কিছুক্ষণ সাধারণভাবে বাক্যালাপ হইল। প্রাণহারিবাবু

বিপত্নীক ও নিঃসন্তান; পূর্বে তিনি উড়িষ্যার কটক শহরে থাকিতেন। কিন্তু সেখানে মন টিকিল না। তাই এখানে চলিয়া আসিয়াছেন। সঙ্গে একটি দাসী আছে‌, সেই তাঁহার রন্ধন ও পরিচর্যা করে।

এই সময় দাসী চায়ের ট্রে হাতে লইয়া প্রবেশ করিল‌, ট্রে টেবিলের উপর নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল‌, আবার এক থালা কাটলেট লইয়া ফিরিয়া আসিল। দিব্য-গঠন যুবতী। বয়স কুড়ি-বাইশ; রং ময়লা‌, কিন্তু মুখখানি সুন্দর‌, হরিণের মত চোখ দু’টিতে কুহক ভরা। দেখিলে বিপ্ন-চাকরানী শ্রেণীর মেয়ে বলিয়া মনে হয় না। সে অতিথিদের মধ্যে কাহারও কাহারও মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল।

গরম গরম কাটলেট সহযোগে চা পান করিতে করিতে অরবিন্দ বলিল‌, ‘খাসা কাটলেট ভেজেছে। এটি আপনার ঝি?’

প্রাণহারিবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। মোহিনীকে উড়িষ্যা থেকে এনেছি। রান্না ভাল করে।’

পানাহারের পর খেলা বসিল। সর্বসম্মতিক্রমে তিন তাসের খেলা রানিং ফ্লাশ আরম্ভ হইল। সকলেই বেশি করিয়া টাকা আনিয়াছিল‌, প্রাণহরিবাবু পাঁচশো টাকা লইয়া দেখিতে বসিলেন।

দুই ঘণ্টা খেলা হইল। বেশি হার-জিত কিন্তু হইল না; কেহ পঞ্চাশ টাকা জিতিল‌, কেহ। একশো টাকা হারিল। প্রাণহারিবাবু মোটের উপর হারিয়া রহিলেন। স্থির হইল তিন দিন পরে আবার এখানে খেলা বসিবে।

ফণীশের মনে কিন্তু সুখ নাই। সে তাঁস খেলিতে ভালবাসে বটে‌, কিন্তু জুয়াড়ী নয়। তাহার মাথার উপর কড়া প্রকৃতির বাপ আছেন‌, টাকাকড়ি সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। দলে পড়িয়া তাহাকে এই জুয়ার ব্যাপারে জড়াইয়া পড়িতে হইয়াছে‌, কিন্তু দল ছাড়িবার চেষ্টা করিলে তাহাকে হাস্যাম্পদ হইতে হইবে। ফণীশ নিতান্ত অনিচ্ছাভরে জুয়ার দলে সংযুক্ত হইয়া রহিল।

দ্বিতীয় দিন খেলা খুব জমিয়া গেল। মোহিনী মুগীর ফ্রাই তৈরি করিয়াছিল। চা সহযোগে তাহাই খাইতে খাইতে খেলা আরম্ভ হইল; তারপর মধ্যপথে প্ৰাণহারিবাবু বিলাতি হুইস্কির একটি বোতল বাহির করিলেন। ফণীশের মদ সহ্য হয় না‌, খাইলেই বমি আসে‌, সে খাইল না। অন্য সকলে খাইল। অরবিন্দ সবচেয়ে বেশি খাইল। খেলার বাজি উত্তরোত্তর চড়িতে লাগিল। সকলেই উত্তেজিত‌, কেবল প্রাণহারিবাবু নির্বিকার।

খেলার শেষে হিসাব হইল; অরবিন্দ প্রায় হাজার টাকা জিতিয়াছে‌, আর সকলে হারিয়াছে। প্রাণহারিবাবু দুইশত টাকা জিতিয়াছেন।

অতঃপর প্রতি হগুপ্তায় একদিন-দুইদিন খেলা বসে। খেলায় কোনও দিন একজন হারে‌, কোনও দিন অন্য কেহ হারে‌, বাকি সকলে জেতে। প্রাণহারিবাবু কোনও দিনই বেশি হারেন না‌, মোটের উপর লাভ থাকে।

খেলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি পার্শ্বাভিনয় আরম্ভ হইয়াছিল; তাহা মোহিনীকে লইয়া। মধুময় এবং মৃগেন্দ্ব হয়তো ভিতরে ভিতরে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল‌, কিন্তু অরবিন্দ একেবারে নির্লজ্জভাবে তাহার পিছনে লাগিল। খেলার দিন সে সকলের আগে প্ৰাণহারিবাবুর বাড়িতে যাইত এবং রান্নাঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া মোহিনীর সহিত রসালাপ করিত। এমন কি দিনের বেলা প্রাণহরিবাবুর অনুপস্থিতি কালে সে তাঁহার বাড়িতে যাইত এরূপ অনুমানও করা যাইতে পারে। মোহিনীর সহিত অরবিন্দের ঘনিষ্ঠতা কতদূর হইয়াছিল। বলা যায় না‌, তবে মোহিনী যে স্তরের মেয়ে তাহাতে সে বড়মানুষের কৃপাদৃষ্টি উপেক্ষা করিবে এরূপ মনে করিবার কারণ নাই।

যাহোক‌, এইভাবে পাঁচ-ছয় হগুপ্ত কাটিল। ফণীশের মনে শান্তি নাই‌, সে বন্ধুদের এড়াইবার চেষ্টা করে। কিন্তু এড়াইতে পারে না; অরবিন্দ তাহাকে ধরিয়া লইয়া যায়। তারপর একদিন সকলের জ্ঞানচক্ষু উম্মীলিত হইল। তাহারা জানিতে পারিল প্রাণহরিবাবু পাকা জুয়াচোর‌, তাক সুপ্রিয় মৃত সাফাই করেন। খুব খানিকটা বাচসা হইল‌, তারপর অতিথিরা খেলা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল।

হিসাবে জানা গেল অতিথিরা প্রত্যেকেই তিন-চার হাজার টাকা হারিয়াছে এবং সব টাকাই প্ৰাণহারির গর্ভে গিয়াছে। সবচেয়ে বেশি হারিয়াছে অরবিন্দ; প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।

অরবিন্দ ক্লাবে বসিয়া আফসাইতে লাগিল‌, ‘আসুক না হাড়গিলে বুড়ো্‌্‌, ঠেঙিয়ে হাড় গুড়ো করব।’ মধুময়‌, মৃগেন্দ্র মুখে কিছু বলিল না‌, কিন্তু তাহাদের ভাবভঙ্গী দেখিয়া মনে হইল। প্ৰাণহারিকে হাতে পাইলে তাহারাও ছাড়িয়া দিবে না।

প্রাণহারিবাবু কিন্তু হুঁশিয়ার লোক‌, তিনি আর ক্লাবে মাথা গলইলেন না।

দিন সাতেক পরে অরবিন্দ বলিল‌, ‘ব্যাটা গা-ঢাকা দিয়েছে। চল‌, ওর বাড়িতে গিয়ে উত্তম-মধ্যম দিয়ে আসি।’

ফণীশ আপত্তি করিল‌, ‘কি দরকার। টাকা যা যাবার সে তো গেছেই—’

অরবিন্দ বলিল‌, ‘টাকা আমাদের হাতের ময়লা। কিন্তু ব্যাটা ঠকিয়ে দিয়ে যাবে? তুমি কি বলে মৃগেন?’

মৃগেন বলিল‌, ‘শিক্ষা দেওয়া দরকার।’

মধুময় বলিল‌, ‘ওর বাড়িতে একটা মেয়েলোক ছাড়া আর কেউ থাকে না‌, ভয়ের কিছু নেই।’

একটা ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া প্ৰাণহারির বাড়ির দিকে চলিল। নিজেদের মোটরে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়; ঐ রাস্তাটা নির্জন হইলেও‌, রাত্রিকালে উলুডাঙা কোলিয়ারি হইতে বহু যানবাহন যাতায়াত করে। তাহারা প্ৰাণহারির বাড়ির কাছে চেনা মোটর দেখিতে পাইবে; তাছাড়া অভিযাত্রীদের মোটর-চালকেরা মুক-বধির নয়‌, তাহারা গল্প করিবে। কাহাকেও উত্তম-মধ্যম দিতে হইলে সাক্ষীসাবুদ যথাসম্ভব কম থাকিলেই ভাল।

প্রাণহোরর বাড়ি হইতে একশো গজ দূরে ট্যাক্সি থামাইয়া চারজনে অবতরণ করিল। রাস্তা নিরালোক‌, মধুময়ের হাতে একটা বড় বৈদ্যুতিক টর্চ ছিল‌, তাহাই মাঝে মাঝে জ্বালিয়া জ্বালিয়া তাহারা বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল‌, ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাইয়া অপেক্ষা করিতে বলিয়া গেল।

দ্বিতলের ঘরে আলো জ্বলিতেছে। নীচে সদর দরজা খোলা। রান্নাঘর হইতে ছাঁক-ছোঁক শব্দ আসিতেছে‌, মোহিনী রান্না করিতেছে। সকলে শিকারীর মত নিঃশব্দে প্রবেশ করিল।

সদরে একটা লম্বা গোছের ঘর‌, তাহার বাঁ পাশ দিয়া দোতলায় উঠিবার সিড়ি। এইখানে দাঁড়াইয়া চারজনে নিম্নস্বরে পরামর্শ করিল‌, তারপর অরবিন্দ মধুময়ের হাত হইতে টর্চ লইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে উঠিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, ‘সিঁড়ির মাথায় দরজা আছে‌, মজবুত দরজা। ভিতর থেকে বন্ধ কি বাইরে থেকে বন্ধ বোঝা গেল না। ইয়েল-লক লাগানো।’

আবার পরামর্শ করিয়া স্থির হইল, নীচের তলাটা ভাল করিয়া খুঁজিয়ে দেখা দরকার। বুড়ো ভারি ধূর্ত হয়তো উপরের ঘরে আলো জ্বালিয়া নীচে অন্ধকারে কোথাও লুকাইয়া আছে। অরবিন্দ রান্নাঘরের দ্বারে উঁকি মারিয়া আসিল‌, সেখানে মোহিনী দ্বারের দিকে পিছন ফিরিয়া একা রান্না করিতেছে‌, অন্য কেহ নাই।

অতঃপর চারজনে পৃথকভাবে বাড়ির ঘরগুলি ও পিছনের খোলা জমি তল্লাশ করিতে বাহির হইল।

পনেরো মিনিট পরে সকলে সিঁড়ির নীচে ফিরিয়া আসিল। কেহই প্রাণহারিকে খুঁজিয়া পায় নাই। সুতরাং বুড়ো নিশ্চয় উপরেই আছে। অরবিন্দ বলিল‌, ‘চল‌, আর একবার দোর ঠেলে দেখা যাক।’

এবার চারজনেই সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিল। বন্ধ কপাটে চাপ দিতেই কপাট খুলিয়া গেল। ঘরের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। ঘরের মাঝখানে মেঝের উপর প্রাণহরি পোদ্দার কাত হইয়া পড়িয়া আছেন। তাঁহার বিরলকেশ মাথার ডান পাশে লম্বা রক্তাক্ত একটা দাগ‌, তিনি যেন মাথার ডান দিকে সিঁথি কাটিয়া সিঁথির উপর সিঁদুর পরিয়াছেন। মুখ বিকৃত‌, দন্ত নিক্রান্ত; প্রাণহারি অন্তিম শয্যায় শয়ন করিয়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে ভেংচি কাটিতেছেন।

ক্ষণকাল স্তম্ভিত থাকিয়া চারজনে হুড়মুড় করিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিল। তারপর একেবারে রাস্তায়।

ট্যাক্সির কাছে গিয়া দেখিল ট্যাক্সি-ড্রাইভার স্টীয়ারিং হুইলের উপর মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে। সকলে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া পরস্পরকে সাবধান করিয়া দিল‌, তারপর গাড়িতে উঠিয়া বসিল। ড্রাইভার জাগিয়া উঠিয়া গাড়ি চালাইয়া দিল।

চারজনে যখন ক্লাবে ফিরিল তখন মাত্র নটা বাজিয়াছে। তাহারা একান্তে বসিয়া পরমার্শ করিল‌, কাহাকেও কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। প্রাণহোরর অপঘাত মৃত্যুর সংবাদ অবশ্য প্রকাশ পাইবে‌, কিন্তু তাহারা চারজন যে প্রাণহারির বাড়িতে গিয়াছিল তাহার কোনও প্রমাণ নাই। ট্যাক্সি-ড্রাইভারটা একশো গজ দূরে ছিল। সে তাঁহাদের প্রাণহোরর বাড়িতে প্রবেশ করিতে দেখে নাই। সুতরাং অভিযানের কথা বেবাক চাপিয়া যাওয়াই বুদ্ধির কাজ।

সেদিন সাড়ে দশটা পর্যন্ত ক্লাবে তাস খেলিয়া তাহারা গৃহে ফিরিল। যেন কিছুই হয় নাই।

পরদিন প্রাণহারির মৃত্যু-সংবাদ শহরে রাষ্ট্র হইল বটে‌, কিন্তু ইহাদের চারজনের নাম হত্যার সহিত জড়িত হইল না। তৃতীয় দিন পুলিস অরবিন্দের বাড়িতে হানা দিল। পুলিস কেমন করিয়া জানিতে পারিয়াছে।

কিন্তু ইহারা চারজনই শহরের মহাপরাক্রান্ত ব্যক্তি‌, তাই এখনও কাহারও হাতে দড়ি পড়ে নাই। বাহিরেও জানাজানি হয় নাই। পুলিস জোর তদন্ত চালাইয়াছে‌, সকলকেই একবার করিয়া ছুইয়া গিয়াছে। কখন কী ঘটে বলা যায় না। ফণীশের অবস্থা শোচনীয়। একদিকে খুনের দায়‌, অন্যদিকে কড়া-প্রকৃতি পিতৃদেব যদি জানিতে পারেন সে জুয়া খেলিতেছে এবং খুনের মামলায় জড়াইয়া পড়িয়াছে তাহা হইলে তিনি যে কী করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফণীশের কাহিনী শেষ হইতে বারোটা বাজিয়া গেল। তাহাকে আশ্বাস দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বৌমাকে বোলো ভাবনার কিছু নেই‌, আমি সত্য উদঘাটনের ভার নিলাম। কাল আমরা শহরে বেড়াতে যাব‌, একটা গাড়ি চাই।’

ফণীশ বলিল‌, ‘ড্রাইভারকে বলে দেব ছোট গাড়িটা আপনাদের জন্যেই মোতায়েন থাকবে।’ ফণীশ চলিয়া গেল। আমরা আলো নিভাইয়া শয়ন করিলাম। নিজের খাটে শুইয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল‌, মৃদুমন্দ টানিতে লাগিল।

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কি বুঝলে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পাঁচজন আসামীর মধ্যে মাত্র একজনকে দেখেছি। বাকি চারজনকে না। দেখা পর্যন্ত কিছু বলা শক্ত।’

‘পাঁচজন আসামী!’

‘হাঁ। চাকরানীটাকে বাদ দেওয়া যায় না।’

আর কথা হইল না। প্ৰাণহরি পোদ্দারের জীবন-লীলার বিচিত্র পরিসমাপ্তির কথা ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িলাম।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress