Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি || Shamsur Rahman

কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি || Shamsur Rahman

যখন আমি সাত আট বছরের বালক
তখন আমার মেজোভায়ের হাতে
প্রথম দেখেছিলাম
রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা। আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায়
কাটতো আমার অগ্রজের সিংহভাগ সময়।
অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর,
যদিও মঞ্চে পাঠ মুখস্থ বলেননি কোনো দিন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
নানা ধরনের মুখভঙ্গি করার অভ্যাস ছিল তাঁর।
কখনও ভুরু জোড়া কুঁচকে যেত খুব
কখনও আবার চোখ হয়ে উঠতো
শোকাহত বাল্মীকির চোখের মতো। মাঝে-মাঝে তিনি
চয়নিকা থেকে আবৃত্তি করতেন
পাকা অভিনেতার মতো হাত-পা নেড়ে,
দিব্যি গলা খেলিয়ে। যখন দরাজগলায়
অগ্রজ উচ্চারণ করতেন, ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থ,’
তখন কেন জানি না
আমি নিজেকে দেখতে পেতাম খুব উঁচুতে
কোনো পর্বতচূড়ায়। আর যখন ‘মহামানবের সাগরতীরে’
বলে তিনি তাকাতেন জানালার বাইরে,
তখন তাঁকে এক মুগ্ধ বালকের চোখে লাগতো
যাত্রাদলের সুদর্শন রাজার মতো। সবকিছু ছাপিয়ে
মহামানবের সাগরতীরে-এই শব্দগুচ্ছ
আমার সত্তায় জলরাশির মতো গড়িয়ে পড়তো বারংবার।
চয়নিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হবার আগেই
হলদে মলাটের সেই বইটি
কোথায় হারিয়ে গেলো, তারপর
কখনও চোখে পড়েনি আর।
এখনও যখন আমি ফিরে যাই মাঝে-মধ্যে
ছেলেবেলার চিলেকোঠায়, তখন বিকেলের রঙের মতো
চয়নিকা কেমন অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে।

চয়নিকার সঙ্গে যখন আমার চক্ষু মিলন হয়েছিলো,
তখন রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে
শুধু একটা নাম। সে নামের আড়ালে কী মহান বিস্ময়
দীপ্যমান, তা জানার জন্যে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে
দীর্ঘপথ। আমার নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে
আমি আবিষ্কার করেছি ক্রমান্বয়ে
অভিযানের দুর্বার নেশায়।
চয়নিকার কাল থেকেই কি শুরু
কবিতার সঙ্গে আমার গেরস্থালি? নাকি
বাঁশবাগানের মাথার উপর যে-শাশ্বত চন্দ্রোদয়
আমি লক্ষ্য করেছিলাম, সেদিন থেকে?
হতে পারে অনেক অনেক বছর আগে
আমার নানি ভোরবেলা আঙিনায় বসে
যে-মুহূর্তে গৃহপালিত মোরগের ঝুঁটি
পরখ করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, ‘এটা ওর তাজ’
সেই মুহূর্তেই কবিতা ঊষা হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো আমাকে,
কিংবা এও তো সম্ভব,
দীর্ঘকাল আগে আমার নানা যে-স্বপ্নের
কথা বলেছিলেন, যে স্বপ্নে তিনি বহু আলিশান হাবেলি
মিস্‌মার হতে দেখেছিলেন,
সেই স্বপ্নই আমাকে কবিতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো,
অথবা হতে পারে বাল্যকালে কোনো এক মধ্যরাতে
বৃষ্টির শব্দ শুনে আমি জেগে উঠেছিলাম
যখন, ঠিক তখনই কবিতা আমাকে নিয়ে গেলো
বিরামবিহীন শ্রাবণধারায়।

আমাদের চিলেকোঠা থেকে চয়নিকা লুপ্ত হবার পর
আমার অগ্রজ আর কখনও গলা খেলিয়ে
কবিতা আবৃত্তি করেছে কিনা, মনে পড়ে না।
তাঁর আবৃত্তি আর না শুনলেও,
সেই, যে মহামানবের সাগরতীরের ধ্বনি
তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন আমার অন্তর্লীন প্রবাহে
তা আমাকে ছেড়ে যায়নি কখনও।
চল্লিশের দশকের গোধূলিতে কবিতার সঙ্গে, বলা যায়,
আমার ঘনিষ্ঠ জীবনযাপন হলো শুরু।
তখনই সঞ্চয়িত উপহার হয়ে
এসেছিলো আমার হাতে। কিছুকাল আমি
মগ্ন হয়েছিলাম তাতে, যেমন কোনো দরবেশ
সমাধিস্থ হন অনন্ত কি অসীমের প্রেমে।
কিন্তু কী যে হলো, পঞ্চাশের দশকের প্রত্যূষ
আমাকে ছুঁতেই, সেই ঘোর গেলো কেটে-
তিরিশের কবিসংঘ দিলেন প্রবল ডাক, পোড়ো জমি থেকে
হাতছানি দিলেন এলিয়ট, জান পাতলাম
এলুয়ার এবং আরাগর যুগলবন্দিতে আর নিমেষে
তারুণ্যের তেজে হঠকারী অবহেলায়
সঞ্চয়িতাকে ধূলোয় মলিন হতে দিয়ে
স্বভাবত স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে গেলাম
ভিন্ন স্বাতন্ত্রের আকুল সন্ধানে। বুঝি তাই
তখন আমাকে লিখতে হলো-
‘মধ্যপথে কেড়েছেন মন,
রবীন্দ্র ঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।’

কিন্তু সরে গেলেই কি যাওয়া যায়?
বয়স যতই বাড়ছে, ততই আমি সেই সমুদ্রের দিকে
যাচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ যার নাম, যেমন যাচ্ছি
দান্তের বিপুল বিশ্বে; যেন ভীষণ রুক্ষ
নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তন করছি নিজ বাসভূমে।
জানি না আমার অগ্রজ-উচ্চারিত
মহামানবের সাগরতীরে সেই সুদূরে
কবিতার সঙ্গে প্রথম আমার জীবনযাপন
শুরু হয়েছিলো কিনা,
তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কোনো গৌরীর
মুখ মনে-পড়ার মতন্‌
একদা আমাদের চিলেকোঠায় হারিয়ে যাওয়া
হলদে মলাটের চয়নিকাকে আজও মনে পড়ে, মনে পড়ে, মনে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress