কবিতার ভাল-খারাপ
পাগলামি এবং আলসেমি করা ছাড়া আর প্রায় সব কাজেরই একটা বা একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। পাগলামি, আলসেমিও কখনও কখনও উদ্দেশ্যপরায়ণ হতে পারে, তবে সেটা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব।
একজন মানুষ হাঁটছে। সে কোথাও যাওয়ার জন্য হাঁটছে। অথবা কিছু করার নেই বলে হাঁটতে বেরিয়েছে। এমনও হতে পারে সে হণ্টন প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে চায়। হেঁটে হেঁটে হাঁটার গতি বাড়াচ্ছে। কিংবা সে খুব সমাজ সচেতন। দল বেঁধে সাক্ষরতা, মাদকমুক্তি, নর্মদারক্ষা কিংবা বইয়ের জন্য হাঁটছে। আরও কতরকম ভাবা যায়, সে হয়তো কোনও অভীষ্ট জনের সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় হাঁটছে, পাওনাদারের হাত এড়ানোর জন্য বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়েছে।
তালিকা দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই। হাঁটার মতোই, যে কোনও কাজেরই অভিপ্রায় থাকে। আমাদের কাজকর্ম, চলা-ফেরা, ভাব-ভালবাসা সবই উদ্দেশ্যমূলক। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ফল আশা করবে না কাজ করে যাও। সেই অতি ক্লিশে সংস্কৃত শ্লোকটি উদ্ধৃত না করেই বলি, পৃথিবীর মানুষেরা যা কিছু করে সবই ফলের জন্যে, মরজগতে উদ্দেশ্যই বিধেয়।
যে কোনও ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ‘এটা কেন করেছ?’ সত্যি মিথ্যা সে একটা কারণ দেখাবে, হয়তো একটা বিশেষ প্রয়োগ দর্শাবে।
পাহাড়ে ওঠার ব্যাকুলতা যাদের আছে, সেই খেয়ালি পর্বতারোহীদের এবং এই জাতীয় অ্যাডভেঞ্চারকামীদের উদ্দেশ্য বোঝা যায় না। বোঝা যায় না তারা কেন অত কষ্ট করে পাহাড় বেয়ে ওঠেন। কী লাভ? কী প্রয়োজন?
পর্বতারোহীদের কিন্তু এ বিষয়ে একটা চমৎকার বাঁধা উত্তর আছে, ‘পাহাড়ে উঠি, পাহাড় আছে বলে।’
সবাই এভারেস্টে ওঠে না, যে কোনও দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে খবরের কাগজে নাম বেরয় না, সমতল পৃথিবীর লোকেরা হাততালি দেয় না। তবু পাহাড় পাগলেরা পাহাড়ে উঠবেই, বর্ষে বর্ষে দলে দলে।
এবার কবিতার কথায় আসি।
যে মানুষ কবিতা লেখে, ভাষার লঙ্ঘন ভেঙে ভাবের চূড়ায় উঠতে চায় সে কি ওই পর্বত লঙঘনকারীদের মতো বলতে পারবে, ‘কবিতা আছে, তাই লিখি।’
আসলে এই সব প্রশ্ন, ‘কবিতা কেন লেখো, কবিতা কী জন্যে লেখ, কবিতা লিখে কী হবে?’… অনেক সময়েই ওঠে। একজন কবিকে তাঁর পরিবেশ ও সমাজ, তাঁর বস্তুবাদী, শুভানুধ্যায়ীরা জিজ্ঞাসা করে, জিজ্ঞাসা করতে পারে ‘কবিতা লিখে কী চাও? কবিতা লিখে কী লাভ?’
একটি ষোলো বছরের ছেলে বয়সকালের নিয়মে ধাঁই ধাঁই করে লম্বা হচ্ছে, হয়তো একটু অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, তাকে যদি বলা যায়, ‘আর লম্বা হয়ো না, বেশি লম্বা হয়ে লাভ কী?’
ছেলেটি কী করবে লম্বা হওয়া বন্ধ করে দেবে? সেটা কি তার নিজের আয়ত্তের মধ্যে আছে? তা ছাড়া বেশি লম্বা হয়ে লাভ নেই এ কথারই বা প্রমাণ কী।
অনেকদিন আগে কবিতা লেখার একটা স্পষ্ট কারণ দেখিয়েছি সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি কবিতা লিখে প্রাসাদ বানাতে চেয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি।’ তারও বেশ কিছুকাল আগে অন্যযুগের এক বিদ্রোহী কবি কবিতাকে সত করেই কবিতাকে ছুটি দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর কিশোর কল্পনায় পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো, রুটির সঙ্গে উপমা দিয়ে কবিতাকে জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছিলেন। এসব অবশ্য পুরনো কথা। আসল সমস্যা কবিকে নিয়ে নয়, কবিতাকে নিয়ে। কবিতা কী এবং কেন এর কোনও সহজিয়া বা পাওয়া যাবে না।
অনেকদিন আগে এক চতুর পণ্ডিত রাজাকে কবিতা শেখানোর নাম করে ঠকিয়েছিলেন। তিনি একটি পঙ্ক্তি লিখে রাজার কাছ থেকে স্বর্ণমুদ্রা উপহার পেয়েছিলেন। পঙ্ক্তিটি ছিল ‘মার্জার ক্ষীরং পিবর্তি’। রাজামশায় পুরস্কার দিলেন বটে কিন্তু সভাপণ্ডিত ছাড়বেন কেন। তিনি কবিকে বললেন, ‘এটা আবার কী কবিতা হল?’ কবি বলেন, ‘কেন কবিতা হবে না?’ সভাপণ্ডিত বললেন, ‘কবিতা যদি হবেই তবে এর চারচরণ কই?’ সপ্রতিভ কবি জবাব দিলেন, ‘ওই যে মার্জার, ওর চার চরণ।’ সভাপণ্ডিত থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি কাব্যই হবে তবে রস কোথায়?’ কবি বললেন, ‘ওই তো ক্ষীরের মধ্যে রস রয়েছে।’ অবশেষে বিমূঢ় সভাপণ্ডিত জানতে চাইলেন, ‘এর অর্থ কী?’ কবি বললেন, ‘দেখলেন না, এর অর্থ রাজামশাই দিলেন।’
আসল কবিতার চেয়ে এ রকম গোঁজামিলের কবিতা কখনওই কম নয় এবং রাজ-অনুগ্রহ, পুরস্কার পৃষ্ঠপোষকতা এইরকম কবিরাও পেয়ে থাকেন। হয়তো একটু বেশিই পান।
তা হোক। এই সূত্রে আমরা মূল প্রশ্নে ফিরে যাই। একজন কেন কবিতা লিখবে? সারাজীবনে একটা কি দুটো দশ-পনেরো হাজার টাকার পুরস্কার, সম পরিমাণ কবিতার বইয়ের রয়্যালটি— এতে কোনও ভদ্রলোকের এক বছরও সংসার চালানো কঠিন। সুতরাং অর্থের জন্য কোনও বুদ্ধিমান লোকই কবিতা লেখে না। তবে এ বাবদ যদি কিছু অর্থাগম হয়, তবে সেটা উপরি পাওনা।
উপরি পাওনা ব্যাপারটা না হয় একটু বোঝা গেল। কিন্তু আসল পাওনাটা কী। কাগজকলম নিয়ে বসে পাতার পর পাতা কবিতা লিখে যাওয়াটা কঠিন নয়। সে কবিতা ভাল কি খারাপ সে প্রশ্ন অবশ্য আলাদা। ধরা যাক, ভাল কবিতা লিখেছেন একজন। কিন্তু কবিতা ছাপানো সোজা নয়। সে পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই হোক বা বইতেই হোক। সম্পাদক-প্রকাশকের স্নেহ বা অনুগ্রহ পাওয়া সহস্র বর্ষের সাধনার ধন। কারও কারও ভাগ্যে যে হঠাৎ শিকে ছেঁড়ে না তা নয়, কিন্তু সে তো নিতান্ত ব্যতিক্রম।
সব ভাল কবি একদিন মনে মনে টের পান, আর সবাই যে রকম লিখছে বা লিখেছে, লিখে নাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তিনি তা পাননি। তাঁর মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। তিনি ভাবেন তাঁকে বঞ্চনা করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কারা তাঁকে বঞ্চনা করেছে সে বিষয়ে তাঁর কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই। এক অদৃশ্য শত্রু-শিবির তিনি মনে মনে রচনা করেন। ক্রমশ তঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়, চোখের জ্যোতি কমে যায়। পড়ে যায়। তিনি বিস্মৃত হয়ে যান।
খারাপ কবিতার সমস্যা আলাদা। অনেকে জানে না সে কবিতা লিখতে পারে না। কখনও বুঝতেই পারে না। একবার, পাড়ার এক উঠতি কবি মধ্যরাতে মদ খেয়ে পাড়ার পাশের ড্রেনে পড়েছিল। তাকে স্থানীয় মস্তান ঘণ্টাদা চুলের মুঠি ধরে তুলে গালে দুটি থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, ‘ওমুক-দার কাছে মদ খাওয়াটা শিখলি। পদ্য লেখাটা শিখতে পারলি না।’ এর চেয়েও একটি করুণ কাহিনী আমি জানি। তরুণ কবিদের এক পানের আসরে যথারীতি কবিতা নিয়ে চেঁচামেচি হচ্ছিল। যে সবচেয়ে বেশি চেঁচামেচি করছিল, বন্ধুরা একমত হয়ে তার মদের গেলাস ভেঙে দিয়ে তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘যা, মোড়ের দোকানে গিয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খা। তুই যা কবিতা লিখিস, তাতে মদ খাওয়া হয় না।’
বুদ্ধিমতী পাঠিকা, আপনি বুঝতে পারছেন আমি প্রৌঢ়জনোচিত কূট কৌশলে মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে কয়েকটি আপাত অবান্তর কেচ্ছা-কথার মধ্যে আবদ্ধ রইলাম। আসলে মূল প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। কবিতা লেখার কোনও কারণ নেই, শর্ত নেই। যে লেখার সে লিখবে।
যে ভাল লেখার,সে ভাল লিখবে। যে খারাপ লেখার সে-ও লিখবে।