কবি দেবী রায় (হাংরি আন্দোলনের অন্যতম উদ্ভাবক এবং বাংলার প্রথম দলিত কবি)
১৯৩৮ সালের ২১শে নভেম্বর, মেদিনীপুর জেলার এক হত-দরিদ্র মাহিষ্য কৃষক পরিবারে হারাধন ধাড়া (১৯৬৪ সালে হলফনামা দিয়ে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘দেবী রায়’) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তাঁদের কোন চাষের জমি ছিল না। অন্যের জমিতে ঠিকা চাষীর কাজ করে স্যসার চালাতেন তাঁর বাবা। সেকাজ করে একসময় সংসার চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাই তিনি একদিন ভাগ্যান্বষণে, তার দুই পুত্রসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে হাওড়া শহরের নেতাজি সুভায রোডের এক বস্তির একটি চালার ঘরে এসে উঠেন।
তারপর থেকে বাবা – মা উভয়েই নানা প্রকার পরিশ্রমের কাজ করে দুই ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি দেবী রায় বাবা – মাকে সাহায্য করার জন্য কলকাতার একটি চায়ের দোকানে কাজের ছেলে হিসাবে কাজ করেছিলেন কিছুদিন।
এইভাবে নানা রকম কাজ-কর্ম করে অর্থ উপার্জন করে স্নাতক পর্যন্ত পড়াশুনার খরচ তিনি নিজেই চালিয়ে ছিলেন।
১৯৫৯ সালে (বাংলায় অনার্স নিয়ে) ভালোভাবে পাশ করে তিনি এবং সেই বছরই ভারতীয় ডাক বিভাগে চাকরি পান এবং ছোট ভাইয়ের শিক্ষা ভার নেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত।
তাঁর পরিবারে স্কুল – কলেজে পড়া মানুষ তিনিই প্রথম। চাকরি পাবার পর তিনি সরকারি চাকরীর উন্নতিকল্পে বিভিন্ন হিন্দী পরীক্ষায় বসেন এবং পাশও করেন, যা তাকে পরবর্তী কালে সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদকরূপে কাজ করতে সহায়তা করেছে।
শৈশব থেকেই তার কবিতার প্রতি স্বাভাবিক টান ছিল। তিনি একাধারে কবি, অনুবাদক, সমালোচক, প্রাবন্ধিক,সম্পাদক। তিনি “শনিবারের” সাহিত্যের পাতায় চিঠি লিখতেন “সুনন্দা রায়” ছদ্মনামে।
১৯৬০ সালে ছোটগল্প পত্রিকার দপ্তরে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেবী রায়ের পরিচয় হয় এবং তা একটি গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরী হাংরি আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনার জন্য পাটনায় মলয় রায়চৌধীর বাড়িতে প্রথম বৈঠকটি করেছিলেন। সেখানে তাদের আমন্ত্রণে দেবী রায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিতব্য বুলেটিনগুলির সম্পাদনার ভার নেবেন দেবী রায়।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘হাংরি-আন্দোলন’-য়ের যতগুলি বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রতিটিতে দেবী রায়ের হাওড়াস্থিত চালাবাড়ির ঠিকানা ব্যবহৃত হয়েছে। হাংরি আন্দোলনে যারা যোগ দিতে চাইতেন তারা দেবী রায়ের বস্তিবাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে হতাশ হতেন। অনেক তরুণ কবি ও লেখক বস্তির ঘর দেখে শেষাবধি যোগ দেননি এই আন্দোলনের সঙ্গে, তার কারণ ১৯৬০ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য মোটামুটি ছিল উচ্চবিত্তের আয়ত্তে। তবুও চল্লিশের বেশি সদস্য সংখ্যা হয়ে গেলে, ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি থেকে যখন যার যেমন ইচ্ছা হত সে নিজে বুলেটিন প্রকাশের উদ্যোগ নিত। ফলে সেসময় দেবী রায়ের কাজটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত তিনি হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা ‘চিহ্ণ’ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ তিনি হাংরি আন্দোলন মামলায় গ্রেপতার হন, কিন্তু ১৯৬৫ সালের মে মাসে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছিল। কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারী পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হয়ে যাওয়ায়, দেবী রায় আন্দোলন ত্যাগ করেন।
সরকারি চাকরি চলে যাবার ভয় এবং সর্বোপরি পুনরায় বাবা ও মাকে দারিদ্রে ঠেলে দেবার আতঙ্ক হাংরি আন্দোলন ত্যাগের আরেকটি কারণ। বস্তুত হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার কারণগুলির মধ্যে দেবী রায়ের আন্দোলন ত্যাগও একটি অন্যতম কারণ।
দেবী রায় অন্য রকম এক বাগবিন্যাসপ্রণালীতে (diction) কবিতা লেখা শুরু করেন। দেবী রায়ের কবিতার পংক্তিগুলি অর্ধসমাপ্ত, একটি পংক্তির সঙ্গে পরেরটির আপাতসংযোগহীনতা এবং ছন্দকে তিনি তাঁর কবিতায় মোটেই গুরুত্ব দেননি। অন্যান্য হারি আন্দোলনকারীদের মতোই ইচ্ছাকৃতভাবে চিত্রকল্প ও ছন্দ ভেঙেছেন, চিত্রকল্পকে নিটোল হতে দেননি। হাংরি আন্দোলনকারীরা এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তি-ফাটল। দেবী রায়ের কবিতার বাক্যগুলি ক্ষোভে আকস্মিক, ক্রোধে এলোমেলো, শোকে অসংলগ্ন, হতাশায় খাপছাড়া (eccentric), গ্লানিতে ব্যাজস্তুতিময়, এবং প্রেমে ক্রমান্বয়হীন (out of order)। দেবী রায় এই ক্রমহীনতাকে বলেছেন ‘থট জাম্পিং’। পরবর্তী কালের বাঙালি কবিরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ফলে তাকে প্রথম উত্তর-আধুনিক (Post modern) বাঙালি কবিদের একজন বলে মনে করা হয়।
তাঁর কবিতা সম্পর্কে, ড. অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘দেবী রায় প্রথম থেকেই তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গড়ে নিতে পেরেছিলেন, এবং সেকারণে হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে তাকে অনায়াসে চিনে নেয়া যায়’।
ড. উত্তম দাশ বলেছেন, ‘দেশে – কালে সর্বভূতে যে অন্ধকার, সেই সর্বস্ব হারানো অবস্থায় আত্মার ইরিটেশান থেকে’ দেবী রায়ের কবিতা উৎসারিত; ‘অস্তিত্বের অসহায়তায় নিমজ্জিত ব্যক্তির মধ্যে ডুবে নিজের মানবসত্ত্বার অর্থ খোঁজায় আছে তাঁর কবিতার উদ্দেশ্য, কবিতার পরিত্রাণ, তার কবিতায় আছে বন্দী আত্মার ক্রন্দন, হতাশা, শোক,কৌমবেদনা, ক্ষোভ ও ক্রোধ।’
তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক মর্যাদাপূর্ণ কবি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর কবিতাগুলি খুব বিখ্যাত বুলেটিন ট্যাবলয়েড, জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (বিশেষ করে নয়াদিল্লি, বোম্বে, পুনে, কালিকট, বিহার ইত্যাদি) আন্তর্জাতিকভাবে (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিতে, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ইত্যাদি) তিনি পূর্বে ভারতীয় লেখক সমিতির সেক্রেটারি এবং কলকাতায় সার্ক লেখক সেমিনারের সদস্য ছিলেন (২০১০ সাল)।
তিনি পুরস্কার পেয়েছেন “উত্তর প্রবাসী” পুরস্কার (১৯৮৫ সাল, সুইডেন), প্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৫ সাল)।
ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টার, কলকাতা এবং ডিপার্টমেন্ট অফ কালচারাল অ্যাফেয়ার্স, সরকার যৌথভাবে আয়োজিত কবি সম্মেলন – ২০০২ সাল অংশগ্রহণ করেছেন, যা সিকিমের (২৭শে জুলাই, ২০০২ সালে) কমিউনিটি হল, গ্যাংটক, সিকিমে অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি ভারতীয় PEN, WB দ্বারা সম্মানিত হন তিনি যথাক্রমে ১৯৯৭ সাল এবং ১৯৯৮ সালে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের ঢাকা, টাঙ্গাই, ময়মনসিংহে সম্মানজনক সফরে গিয়েছিলেন।
(দেবী রায়ের কাব্য সংকলন)
১). উন্মাদ শহর
২). কলকাতা ও আমি
৩). মানুষ মানুষ
৪). সাম্প্রতিক তিনজন
৫). দেবী রায়ের কবিতা
৬). ভ্রকুটির বিরুদ্ধে এক
৭). এই সেই তোমার দেশ
৮). পুতুলনাচের গান
৯). সর্বহারা, তবু অহংকার
১০). ভারতবর্ষ, তোমায় খুঁজছে
১১). আগুনের গান
১২). একুশে ফেব্রুয়ারি
১৩). নির্বাচিত কবিতা
—————————————————————-
[ তথ্যসূত্র সংগৃহীত ও সম্পাদিত
ঋণস্বীকার –
কৃত্তিবাস। সম্পাদক: সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যুগীপাড়া রোড, দমদম, কলকাতা (১৯৬৬ সাল)।
Intrepid Hungryalist Issue. Editor: Allan De Loach. Buffalo, New York, USA. (1967).
যুগযন্ত্রণা ও সাহিত্য। ড.আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বসুমতী, বৌবাজার, কলকাতা (১৯৬৮ সাল)।
Salted Feathers Hungryalist Issue. Editor: Lee Altman and Dick Bakken . Portland, Oregon, USA. (1969).
একালের গদ্যপদ্য আন্দোলনের দলিল। সত্য গুহ। অধুনা, আমহার্স্ট স্ট্রিট, কলকাতা (১৯৭০ সাল)।
কবিতা-ষাট সত্তর। সম্পসদক : পরেশ মণ্ডল, মৃত্যুঞ্জয় সেন ও ড.উত্তম দাশ। মহাদিগন্ত, বারুইপুর, কলকাতা ৭০০১৪৪ (১৯৮২ সাল)।
হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। ড.উত্তম দাশ। মহাদিগন্ত, বারুইপুর, কলকাতা ৭০০১৪৪ (১৯৮৬ সাল)।
উত্তরপ্রবাসী হাংরি আন্দোলন সংখ্যা। সম্পাদক: গজেন্দ্রকুমার ঘোষ। গোথেনবুর্গ, সুইডেন (১৯৮৬ সাল)।
তৃুলসীর গন্ধ (১৯৮৮ সাল) লিখেছেন ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’।
হাংরি কিম্বদন্তি। মলয়রায়চৌধুরী। দে বুক স্টোর, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩ (১৯৯৪ সাল)।
ক্ষুধিত প্রজন্ম ও অন্যান্য প্রবন্ধ। ড.উত্তম দাশ। মহাদিগন্ত, বারুইপুর, কলকাতা ৭০০১৪৪ (১৯৯৫ সাল)।
দেবী রায় আলোচনাসমগ্র। সম্পাদক: স্বরাজ সেনগুপ্ত। রেনেসঁস পাবলিশার্স, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩ (২০০৪ সাল)।
হাওয়া ৪৯ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা। সম্পাদক: সমীর রায়চৌধুরী ও মর্শিদ এ. এম। হাওয়া ৪৯, বাঁশদ্রোণি, কলকাতা ৭০০০৭০ (২০০৬ সাল)।