Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ওমেগা স্মৃতি || Suchandra Basu

ওমেগা স্মৃতি || Suchandra Basu

ওমেগা স্মৃতি

ফেরিওয়ালার চিৎকারে আমার ভোরের আরামের ঘুম ভেঙে গেল।সে পথে যেতে যেতে বিকট সুরে
বলছিল পুরানা মোবাইল, ঘড়ি, পুতুল, টেপ রেকর্ডার বিক্রি আছে।দাও আমার কাছে। সঠিক দাম আমি দিবে।ঘরে ওসব রেখে কি হবে।পুরানা
জিনিস দাও।বিনিময়ে পয়সা নাও।আমি ঘাপটি মেরে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তার সুর শুনছিলাম।
আর জানলা দিয়ে আকাশে মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখছিলাম। তার সুর কখন থেমে গেছে
খেয়াল নেই। গেট খোলার শব্দটা অন্যরকম লাগলো। তারপর নীচের বারান্দার গ্রীলের তীব্র
ঝাঁকুনি কানে এলো। আমি উঠে উপরের বারান্দা
থেকে উঁকি মেরে দেখি ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞেস করলাম,কি চাই? সে বলে ওমেগা দাদুকে
ডেকে দাও।দাদু তাকে নাকি বলেছিল ঘড়িটা বিক্রি করবে।সেদিন বেশি টাকা তার কাছে ছিল না।আজ সে টাকা দিয়ে ঘড়িটা নিয়ে যাবে।ছেলেটির কথায় বেশ অবাক হতে হল আমায়।দাদু
এমন কথা বলতে পারে বলে মনে হল না।যত তাকে বলি দাদু এখানে আর থাকে না। কিছুদিন
হল আমাদের এখান থেকে চলে গেছে। সে নাছোড়বান্দা বলে দাদুর ঠিকানা দাও।আরে,সেই
ঠিকানা কি কাউকে দেওয়া যায়? সবাইকে একদিন সেখানে যেতে হয়।সে বলে তবে ঘড়িটা
দাও।তুমি তো ভাই ঘড়ি হাতে বেঁধে রাখো না আর
তোমার মোবাইলেই কাজ চলে যায়। এবার আমি
রেগে তাকে ধমক দিয়ে বলি,যা তো এখান থেকে।
সাতসকালে এসে বিরক্ত করিস কেন?দূর হ তুই।
বলেই আমি মায়ের ডাকে চলে এলাম।ছেলেটির
কথা মাকে বলতেই অপদার্থ বলে গালমন্দ শুনতে
হল। মাঝেমধ্যেই মা সেই প্রসঙ্গ তোলে আমি সেসব গায়ে মাখি না।
রবিবারের আয়েশটুকু ছেলেটা দিল নষ্ট করে। সবাই জানে আমার সময় জ্ঞান কম।তখন ক্লাস
এইটে পড়ি।সময়ের জ্ঞান যাতে হয় তাই মা একটা
টেবিল ঘড়ি কিনে দিয়েছিল।সে তার মতো বেজে
বেজে থেমে যেতো। আমি সুখনিদ্রায় বিছানায়।
দাদুও চেয়েছিল সেই জ্ঞান আমার মধ্যে সৃষ্টি
করতে।তাই আমার জন্মদিনে আমাকে তার মতো
দম দেওয়া ঘড়ি উপহার দিতে চেয়েছিল। আমি
বলেছিলাম আমার ঘড়ি পরতে ভালো লাগে না।এখন কেউ আর ঘড়ি পরে না।মোবাইলে সময়
দেখা যায়।
দাদু ছিল সনাতনী নিয়মনিষ্ঠ সুপুরুষ। সব কাজ
ছিল তার সময় মেপে। মায়ের কাছে শুনেছি,দাদু
রাত থাকতে উঠে পড়ত।ভোরের আলো ফোটার
আগে কলঘর সেরে বাসি রুটি খেয়ে সাইকেল নিয়ে রওনা দিত,উচ্চবিত্তের পোষ্য কুকুরকে
অনুশীলন পাঠের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘড়িটা বাম
হাতে বাঁধতে কোনদিন ভুল হত না।
হ্যাঁ আমিও দেখেছি ঘড়িতে দম দিতে দিতে বাম
হাতে সেটা বেঁধে নিয়ে আমাদের একতলার দক্ষিণের বারান্দায় আসনে বসে বেশ বেলা পর্যন্ত
খবরের কাগজ পড়ত।আর পাশে থাকত এক কৌট লজেন্স।ছোট বড় যারা বাড়ির সামনে দিয়ে
যেত,সবাইকে ডেকে লজেন্স দিত।
একদিন দাদু নিজেই বলেছিল,জানিস বিয়েতে
আমি দুটো জিনিস পেয়েছিলাম।একটি অবুঝ দেশি আর একটি বিদেশি। বিদেরশির সঙ্গে দাদুর
যে মধুর সম্পর্ক তা হাতে বাঁধতে দেখলেই বোঝা
যেত।একেবারে বন্ধুর মতো সখ্যতা।আর যত তিক্ততা দেশি অবুঝ আমার দিদার সাথে। বিদেশির মতো অতটাও ছিল বলে আমার মনে হয় নি।
আজও সময় জ্ঞান হয়নি আমার।তাই মা ক’দিন ধরে বায়না ধরেছিল আমাকে হাতে ঘড়ি বেঁধে ঘুরতে হবে।তবে যদি আমার সে জ্ঞান হয়।আরে
বাবা,সব মানুষ কি আর এক ধাঁচের হয়? দাদু ছিল দাদুর মতো। আমি আমার মতো। মাকে সেটা
বোঝাতেই পারি না। আবার মায়ের কথা ফেলতেও পারি না।বললাম দাও,দাদুর ঘড়িটা
কোথায়? কতদিন দেখিনি সেটা। দম দেওয়াও
হয়নি প্রায় বছরখানেক হয়ে গেল।দাদু থাকতে সে
রোজ দম পেত।তাই ঠিকমতো চলত।ওর তিনটি
কাঁটা ঘুরত যে যার নিয়মে।
অগত্যা দেশির কাছে সেই বিদেশির খোঁজ করলাম।বললাম আজ দাদুর ঘড়িটা চালু করতে হবে।কোথায় আছে জানো?আমার হাতে চাবি দিয়ে বলল আলমারিটা খুলে দেখ।দাদু চলে যাওয়ার পর এই প্রথমবার তার আলমারিতে হাত
দিলাম।
এতদিন তাকে এড়িয়ে যেতাম।এখন তার
সাথে আমার সংযোগটা বুঝতে পারি।দুজন মানুষ
পাশাপাশি থাকলে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে
ওঠে।তখন অভাবটা বোঝা যায় না। অনুপস্থিতি
যেন অভাবকে জাগিয়ে তোলে।
দাদুর কথা এখন বড্ড মনে পড়ে যায়।অনেক কিছু জানার ছিল মানুষটার কাছ থেকে। আলমারির ভিতরের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেই ঘড়িটা দেখতে পাই।দেখলাম কাঁটাদুটো
বিকেল চারটে বেজে থেমে গেছে। আর তারিখ
দেখতে পাচ্ছি সেই চোদ্দ-ই ডিসেম্বর। ঘড়িটা হাতে
নিয়ে দম দিতে গিয়ে কেমন কেঁপে উঠল। মনে হল
আমি কি পারব? তবু জোর করে চেষ্টা করে দম
দিলাম।ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করল।দেওয়াল
ঘড়ি দেখে সময় মিলিয়ে নিলাম।কিন্তু পড়তে গিয়ে
কেমন বাধোবাধো ঠেকছিল। দাদু শখ করে কতবার আমায় দম দেওয়া ঘড়ি কিনে দিতে চেয়েছিল। আমি বলতাম তবে কোয়ার্টাজ ঘড়ি কিনে দিলে সেটা পড়তে পারি। দাদুর সে কথাটা অপছন্দ হয়েছিল। বলেছিল,গিয়ার ছাড়া গাড়ি চালিয়ে পানসে লাগে।দম ছাড়া ঘড়িও আমার
কাছে পানসে ঠেকে।আরও বলত হাতে ঘড়ি বাঁধলে সেটা সচল থাকে। কথাটা মনে হতেই দাদুর
ঘড়িটা হাতে বেঁধে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা এসে হাতটা টেনে নিয়ে ঘড়িটা দেখতে দেখতে বলল, ঘড়িটা হাতে বেশ মানিয়েছে।এমা ঘড়ি বন্ধ যে। ভাল করে দম দিস নি? আমি কোন উত্তর করলাম না।মা বলল এতো
কি ভাবছিস? উত্তর দিচ্ছি না দেখে বলল,তবে চেষ্টা করেও কোনদিন দাদুর মতো সুপুরুষ হতে
পারবি না।সেটা আমিও ভাবিনি যে তা নয়।
বললাম ঘড়িটা দোকানে নিয়ে যাব ভাবছি। অনেকক্ষণ ধরে দম দিয়েও পাঁচ দশ মিনিট চলে
থেমে যাচ্ছে। আর চলছে না।ব্যাটারির ঘড়ি এসে
যাওয়ায় এইসব ঘড়ি আর সারায় না কোন দোকানে। তবুও ভাবছি ওই মন্দাকিনীর বুড়োটা
যদি সারিয়ে দিতে পারে।একবার দাদুর সঙ্গে
মন্দাকিনীতে গিয়েছিলাম।দাদু ওখান থেকেই
ঘড়িটা একবার অয়েলিং করে এনেছিল মারা
যাওয়ার কিছুদিন আগে।
যথারীতি ঘড়িটা নিয়ে একদিন দোকানে গিয়েছিলাম। দেখলাম বুড়ো ভদ্রলোকের চেয়ারে
অচেনা একজন ছেলে বসে।কর্মচারি কি না প্রথমে
বুঝতে পারিনি।আমি দেওয়ালে টাঙানো মালায় সাজানো বুড়ো ভদ্রলোকের স্মিত হাসিতে হারিয়ে যাই।ওভারে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা নিজেই বলল উনি আমার বাবা।কিছুদিন আগেই আমাদের মুক্তি দিয়ে গেছেন।লালবর্ণ চোখে ছেলেটা বলল কি ঘড়ি চাই বলুন?আমি কিছু না
বলে ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে বললাম,এর এই
বন্ধ অবস্থাটা আমার দেখতে ভাল লাগছে না।দেখুনতো একে সচল করা যায় নাকি।গম্ভীর স্বরে
বলল রেখে যান চেষ্টা করে দেখব।রেখে আসতে
ভরসা হচ্ছিল না।তবুও বিশ্বাস করে রেখে এলাম।দিন দুই পরে খবর নিতে বলেছিল।আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। পরের দিনই ছুটে যাই।যেতেই ছেলেটা,মৃদুস্বরে বলল বসুন।চা খাবেন? আমি
ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,ঘড়িটা দেখেছিলেন? ঘাড় নেড়ে বলল ওমেগা। এতো বিদেশি ঘড়ি,এর পার্টস আর পাওয়া যায় না। তাই একে সারানো যাবে না।এ আর চলবে না।মনটা
ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা চাইতেই সে বলল বিক্রী করবেন? আমি সন্দেহের
চোখে প্রশ্ন করি কেন? সে বলল বন্ধ ঘড়ি আপনার কি কাজে লাগবে? সাহস দেখে অবাক।ভাবলাম দুজনেরই এক উদ্দেশ্য। বুঝলাম না দুজনেই মানে ওই ফেরিওয়ালা আর এই ঘড়ি সারাইওয়ালা দাদুর স্মৃতি কেরে নিতে চায় কেন?
চোখটা আমার বন্ধ হয়ে গেল। ভেসে উঠলো দাদুর
অবয়ব। স্পষ্ট যেন কানে শুনতে পাচ্ছি দাদু আমায় বলছে ছোটসাহেব আমি তো সময়কে
পেরিয়ে এসেছি। এটার আর কি প্রয়োজন?হাতে
একটা স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললাম। ছেলেটা জান্তে
চাইল ঘড়িটা কার।দাদুর ঘড়ি শুনে আমার হাতে
সেটা দিয়ে বলল ওমেগা আর কোন দিন জাগবে না।বাড়ি এসে দেশির হাতে দিয়ে বললাম এই বিদেশির সমস্ত শক্তি দাদুর সাথে সেদিন পরলোকে চলে গেছে।এর শক্তিকে আর কোন
মূল্যেই ফিরানো যাবে না।এই বিদেশি দাদুর স্মৃতি। তুমি ওমেগাকে যত্নে রেখে দাও।বুঝলাম সময় সব,স্মৃতিকে ম্লান করতে পারে না।দাদুর কথায়,সময় এক অদ্ভুত জিনিস। নিজে বদলায়।সাথে সবকিছু বদলে দেয়। জীবনের প্রতি অধ্যায়
সময় মেপে চলতে হয়। জীবনের পরবর্তী পরিচ্ছেদে ভালো কিছুর আশায় সময়ের সাথে
জীবনের পাতা উল্টে যেতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress