Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এখানে একটা লাশ আছে || Anish Deb

এখানে একটা লাশ আছে || Anish Deb

তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ, রাকেশ।

হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছি।

তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও। ততক্ষণ আমি তোমার ওয়াইফের সঙ্গে একটু কথা বলি।

ঠিক আছে, ডক্টর, আমি বিশ্রাম করছি।

আপনার স্বামী এখন হিপনোটাইজড অবস্থায় রয়েছে, মিসেস শর্মা। আমরা কথাবার্তা বললে ওর কোনও অসুবিধে হবে না।

ঠিক আছে, ডক্টর রাও। বলুন, কী জানতে চান?

আপনার স্বামী যেসব দুঃস্বপ্ন দেখেন, সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি বলেছেন, আপনাদের বিয়ের রাত থেকে ওইসব দুঃস্বপ্নের শুরু, তাই তো?

হ্যাঁ, একসপ্তাহ আগে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর আমরা এখানে আমাদের নতুন বাড়িতে চলে আসি। খাওয়া-দাওয়া করে শুতে যাই প্রায় মাঝরাতে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে রাকেশ আমার ঘুম ভাঙায়। তখন সবে ভোর হচ্ছে। ও বিছানায় ভীষণ ছটফট করছিল, আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিল। ওকে জাগিয়ে দিলাম। ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কাঁপতে-কাঁপতে কোনওরকমে ও বলল, ও একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখছিল।

কিন্তু স্বপ্নের ডিটেইলস কিছুই ওর মনে ছিল না?

না, কিচ্ছু না। ও তারপর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু পরদিন রাতেও সেই একই ব্যাপার—তার পরদিন রাতেও। প্রত্যেক রাতেই এই একই ব্যাপার চলছে।

রোজ একই নাইটমেয়ার। হুঁ। কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না। রাকেশকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। ওকে আমি ঠিক সারিয়ে তুলব।

সেই আশাতেই তো আছি, ডক্টর।

সম্ভবত অভিরাম আবার ওর মনের মধ্যে জেগে উঠতে চাইছে।

অভিরাম? কে অভিরাম?

রাকেশের মনের সেকেন্ড পার্ট। ওর দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব।

কী জানি—কিছু বুঝতে পারছি না।

রাকেশের বয়েস যখন বারোবছর, তখন ও একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে। এতে ও ভীষণ শক পায়। তারপর দেখা দেয় স্কিটসোফ্রিনিয়্যা—যার ফলে ওর মধ্যে তৈরি হয়ে যায় দুটো ভিন্ন-ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। একজন হল স্বাভাবিক রাকেশ শর্মা। আর দ্বিতীয়জন, চঞ্চল, ধূর্ত, ইভল। রাকেশ তার নাম দিয়েছিল অভিরাম। বলত, সে ওর যমজ ভাই, ওর মনের অনেক ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে।

কী অদ্ভুত!

এ ধরনের ঘটনা সাইকিয়াট্রির হিস্ট্রিতে প্রচুর আছে। রাকেশ যখন চিন্তাগ্রস্ত কিংবা টায়ার্ড হয়ে পড়ে, তখন অভিরাম ধীরে-ধীরে ওর ওপর চেপে বসে—ওকে দখল করে, কন্ট্রোল করে। তারপর ওকে দিয়ে ঘুমিয়ে চলা, বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া—এসব ধরনের বাজে কাজ করায়। অভিরাম যখন ওকে চালায়, তখন রাকেশের কিছুই করার ক্ষমতা থাকে না। কখনও-কখনও তো ওর মনেই পড়ে না, কী হয়েছে। অন্যসময় ভাবে, সবই একটা দুঃস্বপ্ন।

কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো!

তখন রাকেশ আমার ট্রিটমেন্টে ছিল। আমি ভেবেছিলাম, রাকেশ পুরো সেরে গেছে। অভিরামকে আমরা তাড়িয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু এখন দেখছি…ঠিক আছে, রাকেশকে ওর রোজকার এই দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে কোয়েশ্চেন করলেই সব জানা যাবে। ওর স্বপ্নের খুঁটিনাটি জানলেই আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব।…রাকেশ!

বলুন, ডক্টর?

যে-স্বপ্ন তোমাকে রোজ ট্রাবল দেয়, সেটা আমাকে খুলে বলো। তোমার তো ওটা মনে আছে, আছে না?

স্বপ্ন! হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে!

উত্তেজিত হোয়ো না। শান্তভাবে ধীরে-ধীরে আমাকে সব খুলে বলো।

আমি শান্ত হব। একেবারে শান্ত।

এই তো, লক্ষ্মীছেলের মতো কথা। এবার বলো, প্রথম কোনদিন তুমি স্বপ্নটা দেখলে—কী দেখলে?

প্রথম? প্রথম—ও, সেটা আমার আর অনিতার বিয়ের রাত ছিল। না, না, ভুল বললাম। ওটা ছিল বিয়ের আগের রাত।

ঠিক বলছ?

হ্যাঁ। কোর্ট থেকে কয়েকটা দিন ছুটি নেওয়ার জন্যে সারাটা দিন আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। সন্ধেবেলা সবকিছু ঠিকমতো হয়েছে কিনা দেখার জন্যে আমি যোধপুর পার্কের এই নতুন বাড়িতে এলাম। বিকজ আমি চাইনি, অনিতার কোনও অসুবিধে হোক। সেখান থেকে শেয়ালদায় নিজের পুরোনো ফ্ল্যাটে ফিরে গেলাম রাত প্রায় এগারোটায়। একেবারে ডগ টায়ার্ড হয়ে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কিন্তু ঘুম এল না। হয়তো ম্যাক্সিমাম টায়ার্ড ছিলাম বলেই। একটা সেকোনাল ট্যাবলেট খেলাম। ঘুম শুরু হয়েছে কি হয়নি, স্বপ্নটা শুরু হল।

কীভাবে শুরু হল, রাকেশ?

স্বপ্নে দেখলাম, টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনটা আমার বিছানার পাশের টেবিলেই থাকে। স্বপ্নে আমি উঠে বসলাম, রিসিভার তুলে নিলাম। হঠাৎই মনে হল, এ স্বপ্ন নয়, সত্যি—সত্যিই হয়তো আমি ফোনে কথা বলছি। কিন্তু নেক্সট মোমেন্টেই বুঝলাম, না, আমি স্বপ্ন দেখছি।

কী করে বুঝলে যে, স্বপ্ন দেখছ?

কারণ, ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলছে নিনা। আর ঘুমের মধ্যেও আমার স্পষ্ট মনে আছে, নিনা মারা গেছে।

কবে মারা গেছে, রাকেশ?

একবছর আগে। দার্জিলিঙের পাহাড়ি রাস্তায় ও গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, একটা বাঁকের মুখে চাকা পিছলে ওর গাড়ি খাদে গিয়ে পড়ে। জ্যান্ত অবস্থায় ও পুড়ে মারা যায়।

ও, তা হলে নিনার গলা শুনেই তুমি বুঝলে যে, তুমি স্বপ্ন দেখছ?

হ্যাঁ। ও বলল, ‘রাকেশ, আমি নিনা…রাকেশ, তোমার কী হয়েছে? কথা বলছ না কেন?’

একমুহূর্ত আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি। তারপর স্বপ্নের মধ্যে আমি উত্তর দিলাম, ‘না, তুমি নিনা নও। নিনা মারা গেছে।’

‘জানি, রাকেশ,’ ওর গলায় আমার খুব চেনা ঠাট্টার সুর—বেঁচে থাকতে যেরকম সুরে কথা বলত: ‘জানি, আমি মরে গেছি।’

‘এ শুধু স্বপ্ন—আমার মনের ভুল।’ নিনাকে বললাম, ‘এক্ষুনি আমার ঘুম ভেঙে যাবে—স্বপ্নও মিলিয়ে যাবে।’

উত্তরে মিষ্টি করে হাসল নিনা। বলল, ‘তাই তো আমি চাই। নইলে আমি যখন তোমার কাছে যাব, তখন তো তুমি ঘুমিয়ে থাকবে। আমি এক্ষুনি তোমার কাছে চলে আসছি। জেগে থেকো, লক্ষ্মীসোনা।’

তারপরই মনে হয় ও ফোন নামিয়ে রাখল, ঠিক জানি না। হঠাৎ স্বপ্ন যেরকম বদলে যায়, সেরকম সব বদলে গেল। দেখলাম, আমি জামা-প্যান্ট পরে বিছানায় বসে আছি, হাতে সিগারেট জ্বলছে, অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি নিনার আসার জন্য। জানি, ও আসবে না। কিন্তু স্বপ্নে যেরকম অসম্ভবকে সম্ভব বলে মেনে নেওয়া হয়, সেরকম মেনে নিয়ে আমি নিনার জন্যে অপেক্ষা করছি।

দরজার কলিংবেল যখন বেজে উঠল, তখন দুটো সিগারেট শেষ করে ফেলেছি। যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। দরজা খুললাম।

কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে নিনা নয়। অভিরাম।

তোমার যমজ ভাই, অভিরাম?

হ্যাঁ, আমার যমজ ভাই। তবে আমার চেয়ে আরও লম্বা, গায়ে অনেক জোর, আর খুব সুন্দর দেখতে। অভিরাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কনফিডেন্ট হাসি, চোখে সেই চেনা ছটফটে ভাব।

‘কী ব্যাপার, রাকেশ?’ সে প্রশ্ন করল, ‘ভেতরে ঢুকতে দেবে না নাকি? পনেরোবছর বাদে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, তবুও?’

‘না, অভিরাম!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘তুমি ফিরে আসতে পারো না!’

‘কিন্তু আমি যে ফিরে এসেছি।’ এ-কথা বলে ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ‘বহুদিন ধরেই ভাবছি তোমার সঙ্গে দেখা করব। তাই আজ রাতের প্রোগ্রাম দেখে আর স্থির থাকতে পারলাম না। চলে এলাম।’

‘তুমি কী জন্যে এসেছ?’ আমি জানতে চাইলাম, ‘তুমি মরে গেছ। ডক্টর রাও আর আমি মিলে তোমাকে খুন করেছি।’

‘নিনাও মারা গেছে,’ অভিরাম বলল, ‘কিন্তু আজ রাতে ও ফিরে আসছে। তা হলে আমি কী দোষ করলাম?’

‘কী চাও তুমি?’

‘শুধু তোমাকে সাহায্যে করতে চাই, রাকেশ। আজ রাতে কেউ একজন তোমার পাশে থাকা দরকার। কারণ, তোমার মরা ওয়াইফের সঙ্গে একা-একা দেখা করতে তুমি রীতিমতো ভয় পাচ্ছ।’

‘চলে যাও, অভিরাম। চলে যাও—’ আমি ওকে রিকোয়েস্ট করে বললাম।

‘দ্যাখো, আবার কে এল।’ দরজার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল অভিরাম, ‘নিশ্চয়ই নিনা। তুমি ওর সঙ্গে একা কথা বলো। তবে মনে রেখো, আমি পাশের ঘরেই আছি। দরকার হলে ডাকবে।’

ও পাশের ঘরে চলে গেল। কলিংবেল অধৈর্যভাবে দ্বিতীয়বার বেজে উঠল। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললাম।

নিনা দাঁড়িয়ে। গায়ে সাদা শিফনের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। মারা যাওয়ার সময়ে যে-পোশাক ওর গায়ে ছিল। ওর পোড়া মুখ বীভৎস। আমাকে পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দে ও ঘরে ঢুকল। বাতাসের ঝাপটায় ঢেউ খেলে গেল ওর শাড়িতে। খুব ধীরে অলস ভঙ্গিতে ঘরের ছায়া-ছায়া অংশে গিয়ে দাঁড়াল ও। একটা চেয়ারে বসল।

এক দীর্ঘ মুহূর্ত নিনা নীরব রইল। তারপর বলল, ‘রাকেশ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন ভীষণ অবাক হয়ে গেছ। যাও, দরজাটা বন্ধ করে দাও। ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ঠান্ডা হাওয়া আমার ভালো লাগে না।’

দরজা বন্ধ করে ফিরে আসতেই কথা ছিটকে বেরোল আমার ঠোঁট চিরে।

‘এখানে কী চাই? কেন তুমি ফিরে এসেছ? তুমি মরে গেছ!’

ও হাসিতে ফেটে পড়ল: ‘তুমি কি সত্যি সে-কথা বিশ্বাস করো, রাকেশ? আমি মরিনি গো। এই একটা বছর তোমার সঙ্গে একটু মজা করছিলাম।’

‘মজা করছিলে?’

আমার প্রশ্নে ওর হাসি আরও বেড়ে চলল। আকাশ-বাতাস কাঁপানো এক খিলখিল হাসি। যেন কোনওদিন থামবে না।

‘হ্যাঁ, রাকেশ।’ হাসির দমক থামিয়ে চোখের জল মুছে ও বলল, ‘বিপদের সময় অল্পেতেই তুমি ঘাবড়ে যাও। তাই ভাবলাম, ভূতের অভিনয় করে তোমাকে একটু ভয় পাইয়ে দিই।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নিনা।

‘লায়ার! তুমি মিথ্যে কথা বলছ!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘তুমি মরে গেছ। আমি তোমাকে—তোমার ডেডবডি—নিজের হাতে পুড়িয়েছি!’

‘আস্তে, রাকেশ।’ নিনা নির্বিকার। অল্প হেসে ও বলল, ‘আশপাশের লোক জেগে উঠবে। …সত্যি করে বলো তো, আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি মরে গেছি?’

ছায়া-ছায়া অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তে এসে দাঁড়াল ও। ওর ফরসা গালে লালচে আভা, দু-চোখে দুষ্টু হাসি—আমার অনেক চেনা। ধীরে-ধীরে উচ্চারণ করল ও, ‘রাকেশ, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে আমি মারা যাইনি। মারা গিয়েছিল আমার পাশে বসা অন্য একটা মেয়ে। অ্যাক্সিডেন্টের পরে যখন দেখলাম, মেয়েটা মারা গেছে, তখন কী খেয়াল হল, হাতের আংটিটা ওর আঙুলে পরিয়ে দিলাম। হাতব্যাগটা রেখে দিলাম ওর বডির নীচে। তারপর আমি গাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দিই। সুতরাং যে-ডেডবডি তোমরা শ্মশানে পুড়িয়েছ, সেটা আমার নয়।’

‘কিন্তু কেন? কেন ও কাজ তুমি করলে?’ কোনওরকমে একটা চেয়ারে বসলাম।

‘ইচ্ছে হল একটু মজা করতে, তাই। আমাকে সংসারে দেখে তুমি যতটা বিরক্ত হতে, তোমাকে দেখে আমি তার চেয়ে কম বিরক্ত হতাম না। সেইজন্যেই মনে হল, একটা অন্য পরিচয় নিয়ে নতুন জীবন শুরু করি। তা ছাড়া আমি জানতাম, যেদিন এই খেলার আকর্ষণ আমার কাছে কমে যাবে, সেদিন আমি সহজেই আবার তোমার কাছে ফিরে আসতে পারব। এখন আমার টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে গেছে। তাই ফিরে এসেছি।’

‘কিন্তু কাল আমার বিয়ে। অনিতার সঙ্গে।’

‘জানি—খবরের কাগজেই বিজ্ঞাপন দেখেছি, ফেমাস ল’ইয়ার রাকেশ শর্মা নতুন করে বিয়ে করতে চলেছেন। এও জানতাম, আমার আসাটা তোমার পছন্দ হবে না। ঠিক আছে, রাকেশ, আমি চলেই যাব। আরও কিছুদিন ”মরে গেছি” এই অভিনয়ই না হয় করব। তুমি তোমার সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্টের মেয়ে অনিতাকে নির্বিবাদে বিয়ে করতে পারো। তবে আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘না! তোমাকে টাকা আমি দেব না! তুমি মরে গেছ!’

‘তা হলে আগামীকালের কাগজের সেনসেশনাল হেডিং আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি। প্রখ্যাত আইনজীবীর মৃতা স্ত্রীর পুনর্জীবন। আপাতদৃষ্টিতে মৃতা স্ত্রীর হঠাৎ আবির্ভাবে আইনজীবীর নতুন বিয়েতে বাধা।’

‘না!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘এ-কাজ তোমাকে আমি করতে দেব না!’

‘তাই বুঝি? কিন্তু আমারও যে হাজার-দশেক টাকার ভীষণ দরকার। টাকাটা দিলে চুপিচুপি আমরা ডিভোর্স করে নেব। কেউ টেরটি পর্যন্ত পাবে না। তুমিও তোমার এই নতুন বিয়েটাকে আবার নতুন করে রেজিস্ট্রি করে নিয়ো। দেখছ তো, কী সহজ!’

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আমার মন তখন ঘুরপাক খাচ্ছে। শরীর দুর্বল লাগছে। মনে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। শুধু একটা গভীর বিশ্বাস আমাকে সচেতন রাখল। এসবই একটা দুঃস্বপ্ন।

নিনা উঠে দাঁড়াল: ‘আমার অফারটা ভেবে দ্যাখো। আমি মাথাটা একটু আঁচড়ে আসি। তোমাকে পাঁচমিনিট সময় দিলাম—তারপর একটা চেক আশা করাটা কি খুব একটা অন্যায় হবে?’

ও পাশের ঘরে গেল। দ্বিধার যন্ত্রণায় দু-হাতে মুখ ঢাকলাম। মনে-মনে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চাইলাম। অবশেষে চোখ তুলে যখন তাকালাম, তখন অভিরাম, আমার যমজ ভাই, আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

‘এভাবে কি এর কোনও ফয়সালা করা যায়, রাকেশ? ওর ঠাট্টায় ভয় পেয়ে গিয়েই তুমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছ যে, তুমি হেরে গেছ।’

‘কিন্তু ও মরে গেছে!’ চিৎকার করে বললাম, ‘এসব স্বপ্ন।’

‘কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব, কে বলতে পারে। আমার মত হল কোনও রিসক নিয়ো না। যদি ওকে টাকা দাও, তা হলে আবার ও ফিরে আসবে—আরও টাকার লোভে।’

‘কিন্তু আর তো কিছু করার নেই।’ হতাশায় আমি বললাম।

‘নেই কে বলল! আছে। নিনা একবার মারা গেছে। ওকে আর-একবার মরতে হবে।’

‘না! আমি তোমার কথা শুনব না!’

‘তা হলে দেখছি সমস্ত দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে—ছোটবেলায় যেমন নিতাম।…আমার দিকে তাকাও, রাকেশ।’

‘না!’ চেষ্টা করলাম চোখ ঘুরিয়ে নিতে, কিন্তু পারলাম না। ওর জ্বলজ্বলে নেশা-ধরানো দৃষ্টি আমাকে হিপনোটাইজ করে দিল।

‘আমার চোখে তাকাও, রাকেশ।’

‘না! না!’

কিন্তু পারলাম না। বহুবছর আগে, ছোটবেলায়, যেমন হত, সেরকম অবস্থা হল আমার। অভিরামের চোখদুটো ক্রমশ বড় হতে লাগল। যেন দুটো অন্ধকার হ্রদ, আমাকে গ্রাস করতে আসছে।

‘রাকেশ, এবার আমি তোমার শরীর-মন সব দখল করব—ছোটবেলায় যেমন করেছি। আর তোমাকে চলে যেতে হবে এতদিন আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে—আমাদের ব্রেনের একেবারে ডিপে, গভীরে।’

আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলাম। কিন্তু বিশাল কালো হ্রদের মতো ওর দু-চোখ ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তলিয়ে যেতে লাগলাম সেই হ্রদের গভীরে। তারপর একটা স্নায়ু-ছেঁড়া যন্ত্রণা অনুভবের সঙ্গে-সঙ্গে অদৃশ্য হল অভিরাম।

বুঝলাম, ও জিতে গেছে। এখন ওর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে—আমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ওর হাতে। আমি একেবারে অসহায়। আমি সব দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু অভিরামের কাজের ওপরে কোনও হাত আমার নেই।

নিনা এসে ঘরে ঢুকল। ওর উজ্জ্বল চোখে আত্মবিশ্বাস ঝিলিক মারছে।

‘কী হল, রাকেশ, কী করবে ঠিক করেছ?’ ও প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, করেছি।’

অভিরামের কণ্ঠস্বর আমার চেয়েও গভীর, জোরালো, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। নিনাকে দেখে মনে হল, এ পরিবর্তনে ও চমকে গেছে।

কিন্তু তারপরই সামলে নিয়ে ও বলল, ‘চেকটা চটপট লিখে দাও। রাত হয়ে যাচ্ছে। ডিভোর্সটা আমি চুপিচুপি করে নেব। তোমার নামের সঙ্গে কেউ আমার নাম জড়াবে না।’

‘চেক অথবা ডিভোর্সের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’ অভিরাম ওকে বলল।

‘তা হলে লোক জানাজানি হবে। রগরগে অপ্রীতিকর কেলেঙ্কারির খবরে সবাই মজা পাবে। এতে তোমার ক্ষতিই হবে।’

‘উঁহু, লোকে জানবে না। আর তা ছাড়া, আমি রাকেশ নই, আমি অভিরাম।’

‘অভিরাম?’ নিনার মুখে এই প্রথম অনিশ্চয়তার প্রতিবিম্ব: ‘কীসব আজেবাজে কথা বলছ?’

‘আমি রাকেশের যমজ ভাই। যেসব কাজ রাকেশ নিজে করতে ভয় পায়, সেসব কাজ ওর হয়ে আমিই করে দিই।’

‘এসব আবোলতাবোল কথার কোনও মানে হয় না। আমি চললাম। ওই চেকের ব্যাপারটা ভাবার জন্যে তোমাকে কাল সকাল ন’টা পর্যন্ত টাইম দিলাম।’

‘টাইমের দরকার নেই। তা ছাড়া, তুমি যে কথা দিয়ে কথা রাখবে না, তাও আমি জানি।’

অভিরাম এক পা এগিয়ে গেল।

নিনা ভয় পেল। ও ঘুরে দাঁড়াল। যেন দৌড়ে পালাবে।

অভিরাম ওর হাত চেপে ধরল, এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নিল মুখোমুখি। তারপর ওর নরম গলায় দু-হাতের দশ আঙুল বসিয়ে দিল।

না দেখে আমার উপায় ছিল না। কিন্তু আমি অসহায়। দেখলাম, ওর হাত নিনার গলায় ক্রমশ জোরে চেপে বসতে লাগল। নিনার মুখ লালচে হল, চোখদুটো হয়ে উঠল বিশাল, বিস্ফারিত। সেকেন্ড-তিরিশ মতো ও ধস্তাধস্তি করল, হাত-পা ছুড়ল। তারপর নিস্তেজ হয়ে পড়ল। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল। ওর মুখের রং এখন আরও লাল। ঢিলে ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসবে।

শান্তভাবে অভিরাম ওর হাতের চাপ বাড়িয়েই চলল। অবশেষে নিনার মৃত্যু সম্পর্কে আর কোনও সন্দেহ রইল না, তখন ও নিনার শরীরটা ছেড়ে দিল।

নিনার মৃতদেহ শব্দ করে এলিয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে।

‘ও. কে. রাকেশ,’ ও বলল ‘কিছু বলার থাকলে এখন বলতে পারো।’

‘তুমি ওকে খুন করেছ!’

আমার রুমাল দিয়ে অভিরাম ঠোঁট মুছল।

‘চিন্তার কথা। আমি ওকে খুন করেছি, নাকি করিনি? ও কি বেঁচে ছিল, নাকি সত্যিই মারা গিয়েছিল মোটর অ্যাক্সিডেন্টে?’

‘আমার কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। নিনা তো মরেই গেছে। এটা শুধু একটা স্বপ্ন। কিন্তু—।’

‘স্বপ্ন হলেও আমরা তো একটা ডেডবডি তোমার ঘরের মধ্যে ফেলে রাখতে পারি না। তার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। এটাকে বরং গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া যাক।’

‘কিন্তু এত রাতে—’ আমি চিন্তিত গলায় বললাম। টের পেলাম, আমার ভয় করছে।

‘ওসব চিন্তা তোমার জন্যে, আমার জন্যে নয়। আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি। তারপর নিনাকে নিয়ে ট্যাক্সি করে চলে যাব সোজা গঙ্গার ধারে। তুমি এখন চুপ করে থাকো। আমি না বলা পর্যন্ত কোনও কথা বলবে না।’

শান্তভাবে ওর উন্মাদ-পরিকল্পনাকে কাজে লাগাল অভিরাম।

প্রথমে ও আমার একটা কোট আর একজোড়া দস্তানা পরে নিল। একটা হালকা চাদর নিয়ে নিনার বীভৎস মুখের ওপরে জড়িয়ে দিল। ওর মাথার চুল আর শাড়ি হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে দিল। তারপর ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল দু-হাতে। যেন একটা ঘুমন্ত শিশু।

ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল অভিরাম। একতলায় পৌঁছে ও দারোয়ানের মুখোমুখি হল।

লোকটা ঝিমোচ্ছিল। অভিরাম এবং ওর কোলে নিনাকে দেখে সোজা হয়ে বসল।

‘দারোয়ানজি, ভদ্রমহিলা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পারো?’

অভিরাম এ-কথা বলতে-বলতে নিনার ব্যাগটা ওর কোল থেকে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। দারোয়ানজি সেটা তুলে দিল ওর হাতে। তারপর বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি ডাকতে।

আমি ভেবেছিলাম, এই বোধহয় ধরা পড়ে যাব, পুলিশ আসবে। কিন্তু না। মিনিট-কুড়ির মধ্যেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে দারোয়ান ফিরে এল। অভিরাম নিনাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল। তারপর টাকা বের করে দারোয়ানজির হাতে দিল। আমরা রওনা হলাম। অভিরামকে দেখে মনে হল যেন মাঝরাতে কোনও মহিলার ডেডবডি নিয়ে কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়ানোটা ওর কাছে নেহাতই রোজকার স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অভিরাম যতই চালাক হোক না কেন, এ উদ্ভট পরিকল্পনায় একটা না একটা গন্ডগোল হবেই। হলও তাই। কিছুটা পথ গিয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ট্যাক্সি ড্রাইভার।

‘কোথায় যাবেন?’

‘গঙ্গার ধারে।’ অভিরামের গলা এতটুকু কাঁপল না।

‘গঙ্গার ধারে?’ ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, ‘এত রাতে? কি মজাক করছেন?’

‘না।’ কেউ ওর কথাকে ঠাট্টা ভাবলে অভিরাম বিরক্ত হয়: ‘ভদ্রমহিলা নেশার ঝোঁকে আছেন। তাই এঁকে গঙ্গার হাওয়া খাইয়ে চাঙ্গা করে তুলব।’

‘শুনুন স্যার!’ ড্রাইভার গাড়ি থামাল। ঘুরে তাকাল অভিরামের মুখোমুখি। রাগে তার মুখ লাল: ‘নেশার ঝোঁকে কে আছে? উনি, না আপনি? রাস্তার কল থেকে মাথায় জল দিন, সব নেশা ছুটে যাবে। এবার নামুন গাড়ি থেকে।’

অভিরাম ইতস্তত করল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তা হলে যোধপুর পার্কেই চলুন।’

ড্রাইভার গজগজ করতে-করতে গাড়ি চালাল।

নির্জন পথে ট্যাক্সি ছুটে চলল। অভিরাম নিনার ডেডবডি কোলে নিয়ে তখন গুনগুন করে গান গাইছে। আর আমি একইসঙ্গে বিস্ময় আর ভয়ের দোলায় দুলছি।

অবশেষে একটা বাড়ির সামনে পৌঁছলাম। যে-বাড়িটা আমি আমার আর অনিতার জন্যে কিনেছি।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে খুব সাবধানে নিনাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল অভিরাম।

অন্ধকার রাত। শীত আর রাতের নির্জনতা। সদর দরজায় নিনার বডিটা নামিয়ে তালা খুলল অভিরাম। কেউ ওকে লক্ষ করল না।

নিনাকে নিয়ে ও বাড়িতে ঢুকল।

বাড়ি অন্ধকার। কিন্তু অভিরাম আলো জ্বালল না। নিনাকে বসবার ঘরে একটা লম্বা সোফায় শুইয়ে দিয়ে ওর মুখোমুখি একটা সিঙ্গল সোফায় বসল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘রাকেশ, এবার বলো, কী বলবার আছে।’

‘অভিরাম!’ আমি রাগে চিৎকার করে উঠলাম, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? নিনাকে এখানে নিয়ে আসার চেয়ে আমার ফ্ল্যাটে রাখলেই বা কী ক্ষতি ছিল কি? এখন কী করবে এই বডি নিয়ে?’

‘সে-কথাই তো ভাবছি;’ খিটখিটে সুরে বলে উঠল অভিরাম। পরিকল্পনায় বাধা পড়লে ও খুব অধৈর্য আর রুক্ষ হয়ে পড়ে: ‘ড্রাইভারটা গঙ্গায় যেতে রাজি হল না বলেই তো যত ঝামেলা—।’

এমন সময় নিনা উঠে বসল।

জ্বরগ্রস্ত মানুষের মতো টলোমলো ভঙ্গিতে ও উঠে বসল। নিজের গলায় হাত বোলাতে লাগল। তারপর শোনা গেল ওর ভারি কর্কশ কণ্ঠস্বর।

‘রাকেশ,’ ও বলল, ‘তুমি—তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছ?’

নিনাকে দেখার জন্যে অভিরাম ঘুরে তাকাল। অন্ধকারে নিনা শুধু যেন একটা আবছায়া প্রেত, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

‘ও, কাজটা তা হলে ভালোভাবে শেষ করতে পারিনি দেখছি!’ বিরক্তির সুরে মন্তব্য করল অভিরাম।

‘তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছ।’ নিনা আবার বলল। যেন ঘটনাটা ও বিশ্বাস করতে পারছে না: ‘তোমাকে এর জন্যে জেলে যেতে হবে। সে ব্যবস্থা আমি করছি।’

‘উঁহু, ওসব কিছুই হবে না।’ উঠে দাঁড়াল অভিরাম। ওর বিশাল শরীর নিনার ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে: ‘শুধু আমাকে একই কাজ আবার প্রথম থেকে করতে হবে।’

নিনা পলকে ওর কাছ থেকে কুঁকড়ে সরে গেল।

‘না! না!’ ও চিৎকার করে উঠল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, রাকেশ। আমি আর কোনওদিন ফিরে আসব না। আমি চলে যাব। চিরকালের মতো চলে যাব। আর কোনওদিন তোমাকে বিরক্ত করব না।’

‘আমি অভিরাম, রাকেশ নই।’ অভিরামের স্বর গম্ভীর, ‘তোমার দেখছি কইমাছের জান, নিনা। দু-দুবার তুমি মারা গেছ, কিন্তু তবুও তুমি মরোনি। হয়তো এই তৃতীয়বারই শেষবার হবে।’

‘অভিরাম, থামো!’ আমি চিৎকার করে বললাম, ‘ওকে ছেড়ে দাও। ও সত্যি কথাই বলছে। ও আর কোনওদিন ফিরে—।’

‘নিনার মতো মেয়েদের তোমার চিনতে এখনও দেরি আছে।’ অভিরাম ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘তা ছাড়া, এ হল ও আর আমার ব্যাপার। তোমাকে এখানে নাক গলাতে হবে না। তুমি ঘুমোও, রাকেশ…তুমি ঘুমিয়ে পড়ো…ঘুমোও…।’

মনে হল যেন অজ্ঞান হয়ে যাব। অন্ধকার আমাকে গ্রাস করল। ছোটবেলায় যেমনটা হত, স্বপ্নেও তাই হল—আমাকে সম্পূর্ণ উধাও করে দিল অভিরাম। এখন ও যা খুশি তাই করতে পারে।

এরপর যখন চেতনা ফিরে পেলাম, তখন আমি পাজামা পরে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরের মাঝখানে অভিরাম দাঁড়িয়ে—আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

‘রাকেশ, আর তোমার কোনও ভয় নেই।’ ও বলল, ‘আমি চললাম। অবশ্য আবার ফিরে আসব। দরকার হলেই।’

‘নিনা!’ চিৎকার করে উঠলাম আমি, ‘ওকে তুমি কী করেছ?’

অভিরাম হাই তুলল: ‘নিনার কথা ভুলে যাও। ও তোমাকে আর কখনও বিরক্ত করবে না। তোমার তরফ থেকে পুরো ব্যাপারটা আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি, রাকেশ।’

‘কী করে? কী করেছ তুমি ওকে নিয়ে?’

অভিরাম শুধু হাসল। ‘বিদায়, রাকেশ।’ ও বলল, ‘ও, ভালো কথা—আমি চাই না ভোরবেলা এসব কথা ভেবে তোমার দুশ্চিন্তা হোক। অতএব মনে রেখো, এসবই একটা স্বপ্ন। নিছকই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন—আর কিছু নয়।’

ও চলে গেল। পরমুহূর্তেই চোখ খুলে দেখি, সকাল ন’টা বাজে। ঘড়ির অ্যালার্ম বাজছে।…এই আমার স্বপ্ন, ডক্টর।

এবারে ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, রাকেশ। তোমার স্বপ্নের কারণটা তোমাকে এবার বুঝিয়ে দিই, তা হলে এ-স্বপ্ন দ্বিতীয়বার আর তুমি দেখবে না।

বলুন, ডক্টর।

তোমার ফার্স্ট ওয়াইফ, নিনা, মারা যাওয়ার আগেই তুমি ওর মৃত্যু কামনা করেছিলে, তাই না?

হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম, ও মরে যাক।

ঠিক তাই। তারপর যখন ও মারা গেল, তুমি মনে-মনে একটা অপরাধবোধ, মানে, একটা গিল্ট কমপ্লেক্স—মানে, তোমার মনে হত যে, তুমিই ওকে খুন করেছ। তাই অনিতাকে বিয়ে করার ঠিক আগের রাতে সেই অপরাধবোধ একটা দুঃস্বপ্নে বদলে যায়—যে-দুঃস্বপ্নে নিনা আবার বেঁচে উঠেছে। পসিবলি ওই ঘড়ির অ্যালার্মকেই তুমি টেলিফোনের শব্দ ভেবেছ এবং ওইভাবেই শুরু হয়েছে গোটা স্বপ্নটা—নিনা, অভিরাম, সব। এবার বুঝেছ?

হ্যাঁ, বুঝেছি।

এখন তুমি একটু বিশ্রাম নাও। এরপর আমি যখন বলব জেগে উঠতে, তুমি জেগে উঠবে। সব স্বপ্ন তুমি ভুলে যাবে। ওই স্বপ্ন আর কোনওদিন তোমাকে ভয় দেখাবে না। এবার বিশ্রাম করো, রাকেশ।

হ্যাঁ, ডক্টর।

ওহ। ডক্টর রাও—।

বলুন, মিসেস শর্মা?

আপনি ঠিক জানেন, ও আর কোনওদিনও এসব স্বপ্ন দেখবে না?

কোনওদিনও না। ওর মনের সাপ্রেসড অপরাধবোধ ভেন্টিলেটেড হয়ে গেছে। চিরদিনের জন্যে মুক্তি পেয়ে গেছে। এখন ওটার আর কোনও অস্তিত্ব নেই।

দারুণ, ডক্টর দারুণ! আই ফিল গ্রেট। নইলে রাকেশ যেভাবে দিনের পর দিন ভেঙে পড়ছিল। ওহ, একমিনিট, দরজায় কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে।

দেখুন আবার কে এল।

…আমার মা লোক দিয়ে বিছানার চাদর, বেডকাভার সব পাঠিয়ে দিয়েছে। এগুলো বিয়েতে পেয়েছি। মা সবাইকে নিয়ে কাল সকালে আসবে বলেছে। দেখুন, কী সুন্দর, না?

হ্যাঁ, দারুণ দেখতে।

দাঁড়ান, এগুলো জানলার পাশের এই কাঠের পোর্টম্যানটায় রাখি। এটা রাকেশের খুব শখের জিনিস। এটা বন্ধ করলে পোকামাকড়, হাওয়া, কিছুই ভেতরে ঢুকতে পারে না। তাই কাপড়চোপড়ও নষ্ট হওয়ার ভয় নেই।

রাকেশ, তুমি এখন জেগে উঠতে পারো…এই তো, কেমন লাগছে?

ভালো। তবে আমি অভিরাম, রাকেশ নই। ভেবে অবাক লাগছে, কী করে আপনি রাকেশের স্বপ্নটাকে স্বপ্ন বলে বিশ্বাস করলেন! এটা যে রাকেশের একটা ছল, সেটা আপনার অন্তত বোঝা উচিত ছিল, ডক্টর। প্রথম যেদিন ও স্বপ্নটা দ্যাখে, সেদিন সত্যি-সত্যিই একটা ফোন এসেছিল…অনিতা! পোর্টম্যানটা খুলো না! খুলো না বলছি…ঠিক আছে, আমার কথা তো শুনলে না! সেই খুলতে গেলে। তা হলে এখন ওখানে দাঁড়িয়ে চোখ বড়-বড় করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কোনও লাভ আছে? আপনিই বলুন, ডক্টর!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress