আমার মা বিপন্ন হয়ে তখন ঘুরে বেড়াতো পথে-ঘাটে, মসজিদে, মন্দিরে, পুকুরপাড়ে, হিজলের বনে।
বিপন্ন সময় ঘিরে রাখতো তাকে।
ঢলঢলে মুখে তখন লেগে থাকতো বিষাদের ছায়া।
চোখে ভেসে থাকতো কতো স্মৃতি,
কতো বেদনার কথা।
শাড়ির আঁচলে থাকতো ফেঁসে যাওয়া রিপুর দাগ।
উনুনের ধোঁয়ায় বিষণ্ণ মুখে লেগে থাকতো ক্লান্তির ছাপ।
সকালে সন্ধ্যায়, অনাদরে অবহেলায় তার মুখে-চোখে রক্তিম ছাপ।
তার এই অব্যক্ত যন্ত্রণা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো,
আছড়ে পড়লো জনতার স্রোতে।
নিশুতি রাতে মায়ের কান্না
ভেসে যেতো প্রত্যেকের বুকে।
গর্জে উঠলো জনতা ।
সুপ্রতিম মাস্টারের শুভ্র দাঁড়িতে তখন শনশনে হাওয়া।
তার বেহালায় বাজছে,
“তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা।
আমরি বাংলা ভাষা।”
১৯৫২,একুশে ফেব্রুয়ারি,
প্রথম বসন্ত বছরে এসে ভিড়লো হওয়ায়।
গাছে গাছে পলাশের নেশা লেগে যায়।
চিৎকার করে কাঁদে কোকিল।
শঙ্খনিনাদ বেজে উঠলো জনতার মাঝে,
গর্জে উঠলো কামান।
কুইক মার্চ, লেফট রাইট- লেফট রাইট।
সুপ্রতিম মাস্টারের শুভ্র দাঁড়িতে তখন শনশনে হাওয়া।
তার বেহালার তারে তখন ঝড় উঠেছে,
“মোদের গরব, মোদের আশা
আমরি বাংলা ভাষা।”
হাজার হাজার মানুষের শোনিতের স্রোতের ধারা।
লুটিয়ে পড়লো সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতরা।
মায়ের মাথায় উঠলো সোনার মুকুট।
শুকনো মায়ের মুখে তখন বিজয়িনীর গর্বের হাসি।
মা পেলো মাতৃভাষার স্বীকৃতি।
জন্মাবার পরে প্রথম শিখি যে মায়ের বোলে শরীর ছেড়ে দিলে
শেষ কথা বলি অস্ফুটে মায়ের কোলে।
দুখিনী বাংলা বর্ণমালা মা আমার।
সুপ্রতিম মাস্টারের শুভ্র দাঁড়িতে তখন শনশনে হাওয়া।
বেহালায় বাজছে,
“গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।”
এখন আমার বাংলা মায়ের মাথায় মুকুট,
আলমারীতে বেনারসি শাড়ির স্তূপ।
বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় তার জন্য জ্বলে ওঠে মঙ্গল দীপ আর সুগন্ধি ধূপ।